বুধবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত থাকা বাধ্যতামূলক এবং সঠিক ইসলামী দল বা আন্দোলন এর ধরণ

ইসলাম দিয়ে আমাদের ব্যক্তিগতসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন চালানো ফরয একথা বোঝার পর একজন মুসলমানের পক্ষে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা ছাড়া উপায়ন্তর নেই। কিন্তু কারো একক প্রচেষ্টায় বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা অপসারণ করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়বরং একাধিক লোকের একটি দল মিলেই একাজ করতে হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠায় রাসূলূল্লাহ(সাঃ) দেখানো পদ্ধতিতে একটি দল গঠন করা বা অনুরূপ একটি আন্দোলনরত দলের সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা একজন মুসলমানের জন্য একটি আবশ্যিক বিষয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

তোমাদের মাঝে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যানের প্রতি আহ্বান করবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দিবে আর অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং এরাই সফলকাম [সূরা আলি ইমরান: ১০৪]

উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন যেন তাদের মাঝে অবশ্যই এমন একটি সুসংগঠিত দল থাকে, যে দল নিম্মোক্ত দুটি কাজ সম্পাদন করবে:

        ১. খায়ের তথা ইসলামের প্রতি আহ্বান করা।
        ২. আমর বিল মারূফ এবং নাহি আনিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ) করা।

এই দলটি এই দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনৈতিক দল যে, আলোচ্য আয়াতটি মুসলমানদের নিকট এমন একটি দল গঠন করার দাবী করেছে, যে দলের কাজ হবে ইসলামের প্রতি মানুষকে আহ্বান করা এবং আমর বিল মারূফ আর নাহি আনিল মুনকার করা। একাজের মধ্যে শাসকদেরকে ভাল কাজ করতে বলা এবং মন্দকাজ থেকে বিরত রাখাও শামিল। বরং, শাসকদেরকে কাজ কর্মের ব্যাপারে ভাল-মন্দের হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা এবং তাদেরকে উপদেশ দেয়াই সবচেয়ে বড় আমর বিল মারূফ এবং নাহি আনিল মুনকার। আর এটিই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কাজ। বস্তুতঃ একাজটি হচ্ছে কোন রাজনৈতিক দলের মূল কাজ সমুহের একটি। সুতরাং এটা প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক ধাঁচের দল গঠন করা ফরয। তাছাড়া রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক পদ্ধতি ছাড়া একটি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে আরেকটি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কাজেই একজন মুসলমানের জন্য একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা বা কোন দলটি সঠিক অর্থাৎ ইসলামী চিন্তা ও পদ্ধতির উপর কাজ করছে, সেটা খুঁজে বের করে উক্ত দলের সাথে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জড়ানো একটি আবশ্যিক বিষয়।

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইসলাম প্রতিষ্ঠার যে পদ্ধতি আমাদের দেখিয়ে গেছেন তাতে প্রম ধাপ ছিলো একটি দল গঠন। তিনি একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন না বরং ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। যদি কারো সাহায্য ছাড়া একাই ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো তবে তাঁর পক্ষেই এটা সম্ভব ছিল। তথাপি তিনি সাহাবাদের (রা.) একটি দলের মাধ্যমে সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। এ থেকেই একটি দল গঠন ও দলের সাথে কাজ করার আবশ্যকতা বোঝা যায়।

আসলে এটা সাধারণ বুদ্ধিরই দাবী যে, একা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আবার ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ না করে বসে থাকাও ইসলাম অনুমোদন করেনি। তাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সঠিক ইসলামী দল বা আন্দোলন খুঁজে বের করে অবিলম্বে তাতে যোগদান করতে হবে।

সঠিক ইসলামী দল বা আন্দোলন এর ধরণ

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব এবং এ লক্ষ্যে একটি দলে যোগদানের আবশ্যকতা বোঝার পর আমাদেরকে সঠিক ইসলামী আন্দোলনের ধরণ ও প্রকৃতি বুঝতে হবে। তাহলে আমরা শত দলের মাঝেও সঠিক ইসলামী আন্দোলনকে চিহ্নিত করতে পারবো।

প্রথমতঃ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা দলটির একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে। দলের সমস্ত চিন্তাভাবনা ও ধ্যান-ধারণা ইসলামের ভিত্তিতে হবে। দলের মূলনীতি বা শাখা-প্রশাখা কোন ক্ষেত্রেই ইসলাম ছাড়া অন্য কোন উৎস থেকে গৃহীত কোন চিন্তা থাকতে পারবে না।

দ্বিতীয়তঃ দলটি অবশ্যই হতে হবে একটি রাজনৈতিক দল কেননা আন্দোলন ছাড়া ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যেহেতু আন্দোলন হচ্ছে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। অতএব, স্বাভাবিকভাবেই দলটি হবে একটি রাজনৈতিক দল। দলটির আহ্বান হবে সামগ্রিক ইসলামের দিকে, স্রেফ ইসলামের সুনির্দিষ্ট দুএকটি বিষয়ের দিকে নয়। এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন সর্বত্র দলটিকে এই আহ্বান ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এটাই করেছেন। অতএব, যে দল রাজনৈতিক দল নয় এবং ইসলামকে প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বর্জন করে অথবা কেবল সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ইসলামী ইবাদতের দিকে ডাকে, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার দিকে ডাকে না- সেটি সঠিক ইসলামী দল হবে না। অনুরূপে কেবল সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে নিয়োজিত দল বা কেবল বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ইসলামের চর্চাকারী ও প্রচারকারী দল ইত্যাদি সঠিক ইসলামী দল হবে না কেননা তারা রাজনৈতিক সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পথকে পরিহার করেছে।

তৃতীয়তঃ ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দলটির সকল কার্যক্রম ও আন্দোলনের পদ্ধতি হতে হবে শুধুমাত্র ইসলামের ভিত্তিতে এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দেখানো পথে । রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আমাদেরকে একটি অনৈসলামী সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পদ্ধতি দেখিয়ে গেছেন। দলটিকে পুরোপুরি সেই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। যুগের দোহাই বা কৌশলের অজুহাতে এমন কোন পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া চলবেনা যা ইসলাম অনুমোদন করে না। যেমন: দলটি কোন গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার অধীনে শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না, যেহেতু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ইসলাম অনুমোদন করে না। অনুরূপে দলটির জঙ্গী কার্যক্রমের আশ্রয় নেয়াও চলবে না যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে অস্ত্র ব্যবহারের কোন পদক্ষেপ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) নেননি। তিনি যেসব যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন সবই ছিলো মদীনাতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর। কাজেই কোন দল উপরোক্ত পদ্ধতিগুলোর আশ্রয় নিলে সেটা সঠিক ইসলামী আন্দোলন হবে না।

চতুর্থতঃ আন্দোলনের পথে দলটি হতে হবে আপোষহীন। কোন ভয় বা প্রলোভনে আন্দোলনের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতির কোন দৃষ্টান্ত তাদের থাকতে পারবেনা। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর ও তাঁর সাহাবীদের (রা.) উপর শত জুলুম-নির্যাতন সত্ত্বেও ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তিনি কখনো কোন আপোষ করেননি। বরং আপোষরফার প্রস্তাব পেয়ে তিনি বলেছিলেন, তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চন্দ্র এনে দিতো যাতে আমি এই কাজ পরিত্যাগ করি তবু আমি তা পরিত্যাগ করতাম না যতক্ষণ না আল্লাহ একাজকে সফল ও জয়যুক্ত করেন অথবা আমি একাজ করতে করতে শহীদ হয়ে যাই।

তিনি (সাঃ) আরো বলেন, জালিম শাসকের সামনে হক কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ।

অতএব দলটি শাসকগোষ্ঠীর শত জুলুমের সামনেও মাথা নত করবেনা এবং আপোষহীন ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সঠিক পথে তার আন্দোলন চালিয়ে যাবে। অনুরূপভাব, কোন লোভে পড়ে বা সংসদে দুএকটি আসনের লোভেও সে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসবেনা। ইসলাম প্রতিষ্ঠা না হওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত এই আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া হবে সেই দলের সত্যতার চিহ্ন।

পঞ্চমতঃ দলটি ইসলামের সত্যিকার শত্রু অর্থাৎ ইহুদী-খ্রীষ্টান-মুশরিক রাষ্ট্রগুলো এবং তাদের ইসলাম বিদ্বেষী ও সাম্রাজ্যবাদী প্রকৃতিকে চিহ্নিত করবে। মুসলিম ভূমিগুলোতে তাদের সকল চক্রান্তকে উম্মোচন করে দিবে এবং এসবের বিরুদ্ধে উম্মাহকে সচেতন করার পাশাপাশি নিজেরা এসবের বিরুদ্ধে কঠোর রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। কেননা, এরাই ইসলামকে পৃথিবীতে বিজয়ী করার পথে প্রধান শত্রু এবং মুসলিম দেশে বসিয়ে রাখা জালিম শাসকরা এদেরই এজেন্ট। অতএব, একটি সঠিক আন্দোলন আমেরিকা-বৃটেন-ইসরাইল-ভারত ও অনুরূপ কাফের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে কখনই মুসলমানদের বন্ধু মনে করবে না বরং শত্রু মনে করবে। তাই যে দল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এসব রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক রাখবে অথবা মুসলিম ভূমিতে তাদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকবে তা সঠিক ইসলামী দল হতে পারে না।

ষষ্ঠতঃ ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তব রূপরেখা সম্পর্কে দলটির সুস্পষ্ট ধারণা থাকবে যাতে করে আল্লাহ্ প্রদত্ত বিজয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করা মাত্র তারা অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা সবকিছু ইসলামের ভিত্তিতে ঢেলে সাজাতে ও পরিচালনা করতে পারে। কেবল ইসলামী আবেগ নির্ভর কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তুব রূপরেখা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণাবিহীন কোন দল সঠিক ইসলামী দল হতে পারে না।

যে কেউ উপরোক্ত মাপকাঠির ভিত্তিতে পূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে যাচাই করবে তার পক্ষে সঠিক ইসলামী আন্দোলন ও সেই আন্দোলন পরিচালনাকারী দলকে চিহ্নিত করা কঠিন হবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন