রাজনীতি লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রাজনীতি লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৩

সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর দায়িত্ব

২০১১ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে শাসককে জবাবদিহিতা করার ফিকহশীর্ষক কর্মশালা আয়োজিত হয়েছিল। যেখানে ইবন কামালুদ্দিন আল হানাফি, উস্তাদ মুহাম্মদ আলি, উস্তাদ ইয়াহিয়া আবু ইসুফ, উস্তাদ কামাল আবু যাহ্‌রা, উস্তাদ আবু লুকমান ফাতহুল্লাহ প্রমুখ এ বিষয়ে লেকচার দেন। আমি চেষ্টা করছি লেকচারগুলোর ট্রান্সক্রিপ্ট যোগাড় করে বাংলায় নুবাদ করতে। আপাতত দুটো লেকচার বাংলায় অনুবাদ করেছি আলহামদুলিল্লাহ এবং বাকিগুলোর কাজ চলছে, যা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে ইনশাল্লাহ। যেসব লেকচার গুলো অনুবাদ করা হবে বা হয়েছে তার তালিকাঃ

· সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর দায়িত্ব
· ইসলামে জবাবদিহিতা
· শাসককে জবাবদিহিতা করা মুসলিমদের অত্যাবশ্যকীয় কাজ
· শাসক ইসলাম দিয়ে শাসন করতে বাধ্য
· শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা নিয়ে প্রখ্যাত আলেমদের মতামত
· বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল এর শরীআহ দলীল

সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর দায়িত্বঃ

পবিত্র কুরআনে মুমিন ব্যাক্তিদেরকে সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে অনেক আয়াত রয়েছে, তার মধ্যে একটি হল – “বনী ইসরাইল এর মধ্যে যারা (মাসীহ এর ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা) অস্বীকার করেছে তাদের উপর দাউদ ও মারিয়াম এর পুত্র ইসার মুখ থেকে অভিশাপ দেয়া হয়েছে, কেননা তারা আল্লাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং সীমালঙ্ঘন করেছে। তারা যেসব গর্হিত কাজ করতো, তা থেকে তারা একে অপরকে বারণ করতো না,তারা যা করতো নিঃসন্দেহে তা ছিল নিকৃষ্ট। (সুরাহ মায়িদাহ, আয়াতঃ ৭৮-৭৯)

আল্লাহের রাগ এবং অভিশাপ বনী ইসরাইল এর উপর আপতিত হয়েছিল কারণ পাপ, মন্দকাজ, আল্লাহর-অবাধ্যতা থেকে তারা একে অপরকে বিরত রাখত না বা বারণ করতো না।

আব্দুল্লাহ বিন আলাওয়ী হাদ্দাদ (মৃত্যু ১৭২০) বলেনঃ সৎ কাজে আদেশ হল ওয়াজিব, অসৎ কাজে নিষেধ হল ওয়াজিব, কিন্তু মানদুব কাজে আদেশ এবং মাকরুহ কাজে নিষেধ করা মুস্তাহাব।

তাই, বলা যায়

১) এই দায়িত্ব কে কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমান করা যায়
২) এই দায়িত্ব কে এড়ানো যাবে না
৩) এই দায়িত্ব এড়ানোর ফলে আল্লাহের ক্রোধের কারণ হতে পারে।

আল সাইয়িদ আল শারিফ আল জুরানি (মৃত্যু ১৪১৩) তার ইসলামিক অভিধানে সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধএর ব্যাপারে বর্ণনা করেছেনঃ সৎ কাজে আদেশ এর অর্থ হল মুক্তির পথের জন্য নির্দেশনা”, এবং অসৎ কাজে নিষেধএর অর্থ হল শরীয়াহ এর পরিপন্থি ব্যাপারে সতর্ক / সাবধান করা

আলেমগণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলে থাকেন দুটো কাজের মধ্যে কোন বিভাজন নেই, অন্যভাবে বলতে গেলে দুটো কাজ আসলে একই, কেউ একটি কাজ বাদ দিয়ে অন্য কাজ করতে পারে না (যেমন অসৎ কাজে নিষেধ না করে শুধু সৎ কাজে আদেশ দেয়া)।

সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর গুরুত্বঃ

কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সুরাহ আল-ই-ইমরানের আয়াত ১১০ এ বলেনঃ তোমরাই (হচ্ছো দুনিয়ার) সর্বোত্তম জাতি, সমগ্র মানব জাতির (কল্যাণের) জন্যই তোমাদের তুলে আনা হয়েছে, (তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে) তোমরা দুনিয়ার মানুষদের সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে, আর তোমরা নিজেরাও আল্লাহের উপর (পুরোপুরি) ঈমান আনবে...

ইমাম আশ-শাওকানি (মৃত্যু ১৮৩২) এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, মুসলিমদের প্রতি আল্লাহ্‌ তায়ালার এই নতুন সম্বোধনই (সর্বোত্তম জাতি) বলে দেয় অন্যান্য সকল জাতি থেকে মুসলিম জাতি কেন উত্তম। কোন আলেম বলেনঃ লাওহে মাহফুজেই মুসলিমদেরকে উত্থিত করা হয়েছে। অন্য একজন আলেম বলেছেন মুসলিমরা বিশ্বাস স্থাপন করার আগেই তাদেরকে সর্বোত্তম জাতি হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহ সকল জাতি (এমনকি পূর্ববর্তী নবীদের উম্মাহ) থেকেও উত্তম এ ব্যাপারটি সাহাবাগণ বুঝতে পেরেছেন এবং তারা তাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে পেরেছেন। সমগ্র মানব জাতির (কল্যাণের) জন্যই তোমাদের তুলে আনা হয়েছে” – এ বিষয়টি সম্পর্কেও সাহাবাদের ধারণা পরিষ্কার ছিল। এবং আয়াতে তোমরা দুনিয়ার মানুষদের সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে” - মুসলিমদের প্রতি আল্লাহ্‌ তায়ালার আরেকটি নতুন সম্বোধন যা মুসলিমদের সর্বোত্তম জাতি হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত অর্থাৎ যতক্ষণ মুসলিম জাতি একাজ করবে তারা সর্বোত্তম জাতি হিসেবেই থাকবে। তাই মুসলিম জাতি যখন এই মহান কাজ বন্ধ করে দিবে তখনই তারা তাদের এই বিশেষ গুণ থেকে বঞ্চিত হবে।

ইবন কাসীর বলেন আল্লাহ্‌ তালা সর্বোত্তম জাতিবলতে মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উম্মতকেই বুঝিয়েছেন। বুখারি বলেন – “সমগ্র মানব জাতির (কল্যাণের) জন্যই তোমাদের তুলে আনা হয়েছেএ ব্যাপারে আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে আবু হাজিম হতে সুফিয়ান ইবন মায়সারা হতে মুহাম্মাদ ইবন ইসুফ বর্ণনা করেন মুসলিমরা মানবজাতির মধ্যে সর্বোত্তম জাতি কারণ তাদেরকে গলায় শিকল দ্বারা বেঁধে তোলা হয়েছে এবং পরবর্তীতে তাঁরা ইসলাম গ্রহন করেছে।

একইভাবে ইবন আব্বাস, মুজাহিদ, ‘আতিয়া আল আওফি, ইকরিমা, ‘আতা, আল রাবিইবন আনাস বর্ণনা করেছেন মুসলিমরা হল সমগ্র মানব জাতির মধ্যে সর্বোত্তম জাতি।

ইমাম আহমাদ বলেন, আবু লাহাবের কন্যা দুররার স্বামী আব্দুল্লাহ ইবন উমাইরা হতে সাম্মাক হতে শুরায়ক বলেছেনঃ আহমাদ ইবন আব্দুল মালিক বর্ণনা করেনঃ এক ব্যাক্তি উঠে দাঁড়িয়ে মুহাম্মাদ রাসুল্ললাহ (সাঃ) এর কাছে যায় (যখন তিনি মিম্বারে দাঁড়িয়ে ছিলেন) এবং জিজ্ঞাসা করেন, “ও রাসুলুল্লাহ, কারা সর্বোত্তম মানুষ?”; তিনি (সাঃ) উত্তর দিলেন, “তারাই হচ্ছে সর্বোত্তম মানুষ যারা কুরআন বেশী তিলাওয়াত করে, আল্লাহ্‌র ব্যাপারে সবচেয়ে সচেতন (বা হালাল/হারাম এর ব্যাপারে সতর্ক), সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে এবং আত্মীয়স্বজনদের সাথে সম্পর্ক রাখে

উপরোক্ত আয়াত হতে আমরা বুঝতে পারিঃ

১) মুসলিম উম্মাহ কে সর্বোত্তম জাতির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার শর্তে

২) অন্য কোন জাতি বা গোষ্ঠীকে এধরণের মর্যাদা দেওয়া হয়নি।

অন্যদিকে মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বহু হাদীসে সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধএর মহৎ কাজকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন যেমনঃ

১) মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হল সে, যে এই কাজে সবচেয়ে উৎসাহী

২) যে এই কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে, তাকে আল্লাহ্‌র প্রতিনিধি উপাধি দেওয়া হয়েছে

৩) যে এই কাজ করে, তাকে আল্লাহ্‌, কোরআন এবং রসুল্লালাহ (সাঃ) এর প্রতিনিধি বলা হয়েছে

৪) মৃত ও জীবিত মানুষের মধ্যে মূল পার্থক্য হল এই মহান কাজ

সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর মৌলিক বিষয়সমূহঃ

একই বিষয়ে সুরাহ আল-ই-ইমরানের ১১০ আয়াতে আল্লাহ্‌ (আজ্জা ওয়া জ্বাল) বলেনঃ

আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম

এসকল আয়াত থেকে আমরা কিছু মৌলিক বিষয় বিবেচনা করে পারিঃ

· ‘আমীর (যারা কাজটা করবে) যেকোনো মুসলিম (আল জায্যায - মাআনি আল কোরআন ওয়া ইরাবুহু), কিছু মুসলিম (আল জামাখশারি - আল কাশ্যাফ; আল কুরতুবি আল জামিলি আহকাম আল কোরআন; আল রাজি মাফাতিহ আল গাইব; যাদের উপর থেকে এই দায়ীত্ব অব্যহতি দেওয়া হয় এ মহৎ কাজ থেকে তারা হল মহিলা, শিশু, মানসিকভাবে অসুস্থ), উলামা (ইবন কুতাইবা তাউইল মুশকিল আল কুরআন, আল রাজি মাফাতিহ আল গায়েব; সামারকান্দি আত-তাফসির), সাহাবাগণ (তাবারি আল জামি আল বায়ান)।

· মামুর (যাদেরকে দাওয়াহ দিতে হবে) যেকোন মানুষ যথা মুসলিম ও অমুসলিম (মুকাতিল আল তাফসির), শুধুমাত্র মুসলিম (মুকাতিল আল তাফসির, আবুল ফাতহ আল জুরানি তাফসির ই শাফি), সমগ্র পৃথিবীর সকল মানুষ (ইবন আতিয়া আল মাহর)।

· খাইরঃ সাধারণভাবে ভালো কাজবুঝানো হয়। তবে আত-তাবারি (মৃত্যু - ৯২৩)র সংজ্ঞা অনুযায়ী এর অর্থ দাড়ায় ইসলামের আধ্যাত্বিক ও শরীয়াহ আইন এর পথে অন্যকে ডাকা” – (আত তাবারি, জামিআল বায়ান)। এর চেয়ে শ্রেয় সংজ্ঞা দিয়েছেন ইবন কাসির – “কুরআন এবং সুন্নাহ কে আঁকড়ে ধরা। ইবন মারদাওয়াহ হতে বর্ণিত, আবু জাফর আল বাকির বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আয়াতটি পড়লেন (তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি...) এবং তারপর বললেন, “সৎকর্ম হল কোরআন এবং আমার সুন্নাহ কে নুসরন করা

· মারুফঃ মারুফ এর অনেক অর্থ পাওয়া যায়। ইবনুল কাইয়ুম আল জাউযিয়্যাহ (মৃত্যু ১২০১) বলেনঃ এই আয়াতে মারুফ বলতে আল্লাহ্‌ তালার উপাসনা এবং আল্লাহ্‌র আইনের (শরীয়াহ) এর প্রতি আনুগত থাকা, এবং মুনকার বলতে আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা বুঝানো হয়েছে (ইবনুল কাইয়ুম আল জাউযিয়্যাহ জাদ আল মাসির)শারিয়াহর যেসব কাজ ভাল ও সঠিক তার সবই (আল জুরজানি কিতাব আল তারিফাত)।

· মুনকারঃ মুনকারের অর্থও অনেকগুলো পাওয়া যায় যার মধ্যে অন্যতম হল আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুল (সাঃ) কর্তৃক নিষিদ্ধ সকল কাজ (অর্থাৎ হারাম), কোরআন এবং সুন্নাহ এর আলোকে যার কোন ভিত্তি নেই, আল্লাহ্‌ ও রাসুলাল্লাহ (সাঃ) এর ব্যাপারে মিথ্যাচার ইত্যাদি। আত-তাবারানি বলেন শারিয়াহ এবং সুন্নাহ দ্বারা স্বীকৃত নয় এবং শিরক কেই বুঝানো হয়েছে (তাফসির আল কাবির); আত তাবারি বলেন মুনকার বলতে আল্লাহ্‌র প্রতি অবিশ্বাস, মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর প্রতি নাযিলকৃত অহীকে অস্বীকার যেমনঃ জিহাদ বা গনীমাতের মাল ইত্যাদি, (জামি আল বায়ান)। আল জুরজানি বলেনঃ যেকোন কথা বা কাজ যা আল্লাহ্‌ কে সন্তুষ্টি করে না তা-ই মুনকার (কিতাব আত-তারিফাত)।

· আমর (আদেশ)
· নাহি (নিষেধ)
· দাওয়াহ


মূলঃ ইবন কামালুদ্দিন আল হানাফি
অনুবাদঃ প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আবু নাদরাহ

সোমবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১২

ইসলামের দাওয়াত - পর্ব ৯

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী গবেষক শাইখ আহমদ মাহমুদ কর্তৃক রচিত “Dawah to Islam” বইটির খসড়া অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)

সপ্তম অধ্যায়: দলের বিকাশ প্রক্রিয়া (culture)

উম্মাহর দরকার হচ্ছে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনের, আর পরিবর্তনের জন্য আবশ্যক হল ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কোনো রাজনৈতিক কাঠোমোর মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। সুতরাং কাঠামোটির সঠিক বৈশিষ্ট্য ও গাঠনিক উপাদানগুলোর বিষয়ে এবং পূর্ববর্তী কাঠামোগুলোর সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা অপরিহার্য, যাতে সেসবের ব্যর্থতার কারণ বুঝা সম্ভব হয় এবং তা এড়িয়ে চলা যায়। এজন্য কাঠামোগত দিকটি পর্যবেক্ষন করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই দিকটি কায়দা বা ধরনের (style) অন্তর্গত একটি বিষয়। কায়দা বা ধরনের বিষয়টি মূলত মুসলিমদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যাতে কাজের যথার্থতা ও উপযুক্ততা অনুযায়ী তারা তা নির্ধারণ করে। এই বিষয়টি দলীয় কৃষ্টির বা সংস্কৃতির একটি অংশ।

- যে সমাজে মুসলিমরা বাস করে তাতে যেহেতু বিভিন্ন চিন্তা, আবেগ ও ব্যবস্থার মিশ্রণ রয়েছে সেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজ; এর বাস্তবতা, উপাদান, এতে প্রভাব সৃষ্টিকারী বিষয়সমূহ এবং একে পরিবর্তন করার উপায় নিয়ে কথা বলতে হবে যাতে চিন্তা, আবেগ ও ব্যবস্থার দিক দিয়ে সুসংহত ইসলামী সমাজ নির্মাণ করা যায়।

- যেহেতু ব্যক্তির বাস্তবতা থেকে সমাজের বাস্তবতা ভিন্ন, সেহেতু ব্যক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত গাঠনিক বিষয়াদি সমাজের গাঠনিক বিষয়াদি থেকে ভিন্ন। অতএব ব্যক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত শর'ঈ হুকুম সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত শর'ঈ হুকুম থেকে ভিন্ন।

- যেহেতু সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে দলটির কর্মকাণ্ড জড়িত সেহেতু এই বাস্তবতায় কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় চিন্তা ও শরঈ হুকুম দলটিকে বিস্তারিতভাবে গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি এ কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হুকুমসমূহকে গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে সে ব্যক্তিসাধারণ এবং জনগণকে নির্দেশনা দিবে। গ্রহণকৃত এসব হুকুম তার জন্য সামষ্টিক দায়িত্ব হতে পারে যেগুলোর অবজ্ঞা করার কোনো অজুহাত তার নেই অথবা এগুলো তার ব্যক্তিগত দায়িত্বও হতে পারে, যেগুলোর আনুগত্য করতে দল তাকে আহ্বান করছে যেমন: লেনদেন, ইবাদত এবং নৈতিকতা যেগুলো ইসলামী আক্বীদাহ থেকে উৎসারিত এবং তার দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা।

- মুসলিমদের চিন্তার ব্যবহার যেহেতু বর্তমানে পাশ্চাত্য দ্বারা প্রভাবিত এবং চিন্তার সাহায্যেই তারা স্বার্থ নির্ধারণ করছে সেহেতু রাসূল (সা)-এর সর্বোত্তম অনুসরণ এবং শরীয়াহ'র সবচেয়ে সঠিক আনুগত্যের জন্য চিন্তা ও এর উপাদান নিয়ে আমাদেরকে চিন্তাভাবনা করতে হবে যাতে আক্বীদাহ, শরঈ আহকাম অথবা বাস্তবতা নিয়ে চিন্তা করার ক্ষেত্রে চিন্তা ব্যবহারের সীমা কতটুকু এবং কীভাবে তা ব্যবহার করতে হবে সেটি আমরা জানতে পারি।

- যেহেতু আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয়াদি দিয়ে শাসন এবং দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কিত সেহেতু মক্কায় রাসূল (সা) কীভাবে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং কোন কোন কর্মকাণ্ডের ফলে মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে সম্পর্কিত জ্ঞান আমাদেরকে অর্জন করতে হবে। এ জ্ঞান অর্জনের পর আমাদের অবশ্যই তা দ্বারা পরিচলিত হতে হবে। রাসূল (সা)-এর কর্মকাণ্ডকে যথার্থরূপে অনুসরণের জন্য পদ্ধতি সংক্রান্ত হুকুম এবং ধরন ও উপকরণ সম্পর্কিত হুকুমের পার্থক্য আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে।

- যেহেতু দলের কাজ হচ্ছে আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয়াদি দিয়ে পরিচালিত হয় এমন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং বিদ্যমান শাসনব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা, সেহেতু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শাসকদের কর্মকাণ্ডকে, শাসকদের বাস্তবতাকে এবং শাসকদের সাথে তাদের মিত্রদের সম্পর্কের প্রকৃতিকে বোঝা আমাদের জন্য অপরিহার্য। শাসকদের কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণকারী পরাশক্তিসমূহের গৃহীত বিভিন্ন নীতিমালা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ এবং তাদের পরিকল্পনাগুলোকে জনসমক্ষে প্রকাশ করাটাও আমাদের জন্য জরুরী।

- যেহেতু মুসলিম ভূখণ্ডসমূহ পাশ্চাত্য ব্যবস্থা বিশেষত পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক ব্যবস্থাসমূহ দ্বারা পরিচালিত সেজন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের মতাদর্শ, আক্বীদাহ এবং এগুলোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা চিন্তা ও ব্যবস্থা নিয়ে আমাদেরকে পর্যালোচনা করতে হবে।

- ইসলামের বাস্তবায়ন এবং একে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যেহেতু শরীয়াহ'র উদ্দেশ্য সেহেতু শাসনব্যবস্থা, ইসলামী রাষ্ট্র, এর গঠনতন্ত্র ও প্রকৃতি, এর স্তম্ভসমূহ, সংবিধান এবং ইসলামী রাষ্ট্রে যেসব বিষয় বাস্তবায়িত হবে তার উপরে একটি সাধারণ ধারণা অর্জন করা অত্যাবশ্যক। আমাদেরকে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থাসমূহের গঠনতন্ত্রও পরীক্ষা করতে হবে যাতে এগুলো থেকে নিজেদেরকে আমরা পৃথক করতে পারি এবং তা দ্বারা প্রভাবিত না হই। পাশাপাশি আমাদেরকে পরীক্ষা করা প্রয়োজন যার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে।

এভাবে দলটিকে এর বিকাশ প্রক্রিয়ার (culture) উপকরণসমূহ (means) চিহ্নিত করবে এবং যাতে সেগুলো অনুযায়ী কাজ করা যায় এবং জনসাধারনকে এ কাজের প্রতি জরুরীভাবে আহবান করে ইসলামি জীবনব্যবস্থা পুনঃপ্রচলন এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা যায়। খিলাফত রাষ্ট্র ইসলাম দিয়ে মুসলিম ও অমুসলিমদেরকে শাসন করবে এবং দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে এর বার্তা বিশ্বের নিকট পৌঁছে দিবে।

আক্বীদাহ'র গুরুত্ব

যেহেতু ইসলামী আক্বীদাহ হচ্ছে দলটির কাজের প্রেরণা এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয়াদি দিয়ে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা এর উদ্দেশ্য সেহেতু দলটির জন্য বাধ্যতামূলক নিজের বিকাশক্রিয়া (culture) কে এমনভাবে গ্রহণ করা যার সঙ্গে আক্বীদাহ'র জোরোলো সম্পর্ক থাকবে। যার লক্ষ্য হবে দলের কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, উদ্বেগ, আন্তরিকতা, তীব্র ভালোবাসা, আগ্রহ এবং ত্যাগের মানসিকতা গড়ে তোলা। এটি মুসলিমদের মধ্যে চলার পথে দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতাও জাগিয়ে তুলবে। দাওয়াত বহনকারীকে এটি এমনভাবে গড়ে তুলবে যাতে সে লোকজনের প্রশংসার জন্য বসে থাকবে না বরং সে তার রব ও সেইদিনের ভয় করবে যেদিন দুশ্চিন্তায় মানুষের চেহারা বিমর্ষ হবে। রবের সন্তুষ্টি ও আখিরাতের পরম সুখ লাভের জন্য সে পার্থিব যন্ত্রণা গ্রহণ করতে এবং দুনিয়ার সুখ ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে প্রস্তুত থাকবে। বিকাশক্রিয়ার ভিত্তি হিসেবে আক্বীদাহ'কে গ্রহণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে লোকজনের মধ্যে পরিবর্তন সূচিত করতে আক্বীদাহ'কে ব্যবহার করা এবং এক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে কৃত অত্যাচারের বিরুদ্ধে জন্মানো ঘৃণা, অবজ্ঞা থেকে মুক্তি অথবা পরিস্থিতিকে উন্নত করার মানসিকতাকে ব্যবহার না করা। বরং যে বিষয়টি মুসলিমদেরকে দাওয়াত দিতে এবং অন্যান্য মুসলিমদেরকে তা গ্রহণ করতে চালিত করবে তা হচ্ছে তাদের ঈমানের চিন্তা এবং এটাই ইসলামের প্রকৃত পথ।

উপরন্তু ঈমানের চিন্তাসমূহকে (পরিবর্তন সূচিত করার জন্য যা দলটি ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে) এবং দলের গ্রহণকৃত বিকাশক্রিয়াকে (culture) এমনভাবে পৌঁছে দিতে হবে যাতে উদ্দেশ্য পূরণ সম্ভব হয়।

আক্বীদাহ'কে এমনভাবে পৌঁছাতে হবে যাতে তা এই উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হয়।

গ্রহণকৃত শর’ঈ হুকুমকে এমনভাবে পৌঁছাতে হবে যাতে এগুলোর উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হয়।

বাস্তবতা সম্পর্কিত জ্ঞান এমনভাবে পৌঁছাতে হবে যাতে উদ্দেশ্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে তা সহায়ক হয়।

সংক্ষেপে বলতে গেলে দলের বিকাশ প্রক্রিয়াকে ইসলামী আক্বীদাহ'র সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। শরীআহ'র দলীলাদি দ্বারা এগুলো সমর্থিত হতে হবে এবং এমনভাবে পৌঁছাতে হবে এগুলোকে যাতে এরা শরঈ উদ্দেশ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। আর তা (শরঈ উদ্দেশ্য) হল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাস্তবে আল্লাহর দাসত্বের অনুভূতি অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি প্রদান। আর দলের শাবাবদেরকে এই উপলদ্ধির ভিত্তিতেই গড়ে তুলতে হবে।

যেহেতু ইসলামী আক্বীদাহ'র দৃষ্টান্ত হচ্ছে শরীরের জন্য মাথাস্বরূপ এবং অঙ্গসমূহের মধ্যে হৃদপিণ্ডস্বরূপ ; যেহেতু এটি হচ্ছে সমস্ত বিষয়ের ভিত্তিস্বরূপ এবং এর উপরেই সবকিছু নির্ভরশীল সেহেতু একে এমনভাবে পৌঁছাতে হবে যাতে তা নিম্নোক্ত লক্ষ্যসমূহ অর্জন করতে পারে:

- আল্লাহকে ইবাদতের যোগ্য একমাত্র সত্তা হিসেবে এবং বিধানের উৎস হিসেবে মেনে নিতে তা মানুষকে পরিচালিত করবে। তিনি বাদে অন্য কারো এই অধিকার নেই। তিনিই একমাত্র রব এবং একমাত্র খালিক (সৃষ্টিকর্তা)। তিনি সর্বজ্ঞানী, সর্বজ্ঞাত ও বিধানদাতা যিনি সমস্ত বিষয়কে পরিচালনা করেন। যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে মানুষ নিজেকে দুর্বল, সীমাবদ্ধ, চাহিদাসম্পন্ন এবং নির্ভরশীল বলে অনুভব করে সেহেতু সে তাকে সঠিকপথে পরিচালিত করার জন্য এবং গভীর অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসার জন্য এই ইলাহের নিকট আত্মসমর্পণ করে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন এবং বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁকে (সা) মনোনীত করেছেন যিনি তাঁর রবের ইচ্ছানুযায়ী তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন। তিনি (সা) তাঁর রবের পক্ষ থেকে যা কিছু আমাদেরকে পৌঁছে দেন তার আনুগত্য করতে আল্লাহ আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি (সা) নিষ্পাপ, যার প্রতি আল্লাহ পুরো মানবজাতির জন্য একটি বার্তা হিসেবে কুরআন নাযিল করেছেন। এটি এসেছে অন্তরসমূহের জন্য পথনির্দেশনা, আলোকবর্তিকা, রহমত, তিরস্কার এবং নিরাময়কারী হিসেবে। যারা ঈমান আনে ও আনুগত্য করে তাদের জন্য তিনি (আল্লাহ) অনন্তসুখের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং যারা প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে জাহান্নামের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। অতএব, রাসূলুল্লাহ (সা) যে বার্তা নিয়ে এসেছেন সে অনুযায়ী আল্লাহর ইবাদাত করার জন্যই কেবল মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

- জীবনের পূর্বে কী ছিল- সেই বিষয়টি মুসলিমদের কাছে পরিষ্কার করতে হবে কারণ এর মাধ্যমে ইসলাম মানবজাতিকে একটি বন্ধনে আবদ্ধ করে- যা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা এবং সমস্ত বিষয়ের পরিচালনাকারী হিসেবে আল্লাহর উপরে ঈমান। জীবনের পরে কী আছে তার মাধ্যমেও তাকে ঈমানের বন্ধনে আবদ্ধ করে যা হচ্ছে বা'ছ (পুনরুত্থান), নুশূর (একত্রিতকরণ), হিসাব, সাওয়াব এবং ইকাব (শাস্তি)। এ বিষয়গুলো এমনভাবে পৌঁছাতে হবে যাতে এগুলোর মধ্যকার সম্পর্কটি উপস্থাপিত হয়। এই বন্ধনকে যে ছিন্ন করে এবং আলাদা করে ফেলে তার মন্তব্য কোনো স্পষ্ট প্রমাণ বা তথ্যের উপরে ভিত্তিশীল থাকবেনা। বরং এগুলো হবে কুফরী মন্তব্য।

- একে এমনভাবে পৌঁছাতে হবে যাতে তা উম্মাহকে পুনর্জাগরিত করে এবং বিশ্বে ইসলাম ছড়িয়ে দিতে তাকে চালিত করে।

- সমসাময়িক কুফর চিন্তাসমূহের মোকাবেলায় এই চিন্তার যথার্থতা মুসলিমদের কাছে বুঝাতে হবে। পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, অথবা দেশাত্মবোধ থেকে জন্ম নেওয়া বর্তমান চিন্তাসমূহের ভ্রান্তি উন্মোচন করার মাধ্যমে এটি অর্জিত হবে। ইসলাম ও এসব চিন্তার মধ্যকার পার্থক্য বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে এটা সম্ভব হবে; ফলে আমরা দুটো বিষয় অর্জন করতে পারব: প্রথমত; এসব চিন্তা ও এগুলোর উপরে ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যসব চিন্তার খণ্ডন এবং দ্বিতীয়ত; এই বিষয়টিকে তুলে ধরা যে ইসলাম হচ্ছে পুরো মানবজাতির জন্য একমাত্র উপযুক্ত সমাধান (এর আক্বীদাহ ও ব্যবস্থার সার্বজনীন প্রকৃতির কারণে)। পরবর্তীতে সেই রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে আমরা ইসলামের সঠিকত্ব প্রমাণ করতে পারব যা ইসলামকে উপস্থাপন করবে। এক্ষেত্রে কাফেরদের বিভিন্ন শ্লোগান, চমকপ্রদ প্রপাগাণ্ডা ও বিলবোর্ড এবং কাফের ঔপনিবেশিক শক্তি কর্তৃক মুসলিমদের মনে স্থাপিত ভ্রান্ত দাবীসমূহকে দূর করার জন্য দলটি কাজ করবে। উদাহরণস্বরূপ কিছু শ্লোগান তুলে ধরা হল: 'চিন্তা ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা', 'সীজারের প্রাপ্য সীজারকে দাও এবং সৃষ্টিকর্তার প্রাপ্য সৃষ্টিকর্তাকে', 'আমাদের মাতৃভূমি সবসময় সত্যের উপরেই থাকে', 'নির্যাতনকারী হোক অথবা নির্যাতিত- নিজের ভাইকে সাহায্য কর' (প্রাক ইসলামী যুগের ধারণা অনুসারে) প্রভৃতি। মুসলিমদের মন ও জীবন থেকে পাশ্চাত্য চিন্তাসমূহের প্রভাবকে দূর করতে হবে। এজন্য 'শরীআহ'র উন্নয়ন', 'শরীআহ'র আধুনিকায়ন', 'যুগের চাহিদা পূরণে শরীআহ'র নমনীয়তা' (পাশ্চাত্যের ধারণা অনুযায়ী) এবং 'জীবন থেকে দ্বীনের পৃথকীকরণ', 'দ্বীনের মধ্যে কোনো রাজনীতি নেই,' 'এই বিষয়টি প্রত্যাখ্যাত নয় যে, সময় ও স্থানের সঙ্গে হুকুম পরিবর্তিত হয়' প্রভৃতি ধারণার ভিত্তিতে গড়ে উঠা চিন্তাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে উদ্দেশ্য অর্জন করতে হবে। এসমস্ত শ্লোগান দূর করার পাশাপাশি দলটিকে বিকল্প চিন্তাভাবনা প্রোথিত করতে হবে যেগুলো 'আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল' এর ভিত্তিতে এবং এ থেকেই উৎসারিত।

শরীয়াহ থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে 'আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল' এই কথাটি জ্ঞান ও কর্মের দিকে দিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত বিশুদ্ধ হবেনা যতক্ষণ না অন্যসব চিন্তাকে পরিত্যাগ করা হচ্ছে। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন;

"যারা গোমরাহকারী তাগুতদেরকে মানবে না এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল যা ভাঙ্গবার নয়।" [আল-কুরআন ২:২৫৬]

প্রথমে আল্লাহ তাগুতের সঙ্গে কুফর (অস্বীকার) করতে বললেন, যাতে কুফর বা শিরকের কোনো ছাপ অন্তরে না থাকে এবং তারপরে বিশুদ্ধ অবস্থায় অন্তরে ঈমান আসে যাতে তার অবস্থা এমন হয়- যে ব্যক্তি কোনো বিশ্বস্ত হাতকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন:

"জেনে রাখুন (হে মুহাম্মাদ), আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই।" [আল-কুরআন: ৪৭:১৯]

'কোনো ইলাহ নেই' এর অর্থ হচ্ছে জ্ঞানার্জন ও চিন্তাভাবনার মাধ্যমে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে যে ইলাহ কেবলমাত্র একজনই রয়েছেন যার একক আনুগত্য করতে হবে। এছাড়া তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) যখন বলেন:

'আল্লাহ ছাড়া' তখন এর মানে হচ্ছে ইলাহ হিসেবে একমাত্র আল্লাহকে মেনে নেওয়া। এটি এককভাবে আল্লাহকে ইলাহ হিসেবে মেনে নিতে এবং অন্য সবাইকে প্রত্যাখ্যান করতে বলে। আরবি ভাষায় এটি হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী ধরনের দৃঢ়তাসূচক বাক্য যাকে এখানে 'সীমিত করা' অর্থে বুঝানো হয়েছে। ফলে সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও দেশাত্মবোধের চিন্তা আমাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না অথবা এগুলো কোনো সঠিক চিন্তাও নয়। বরং এগুলো হচ্ছে নষ্ট ও ভ্রান্ত চিন্তা। এগুলো মানুষের শান্তি নিশ্চিত করতে পারে না বরং দুর্দশা বয়ে আনে। আল্লাহর দ্বীন ও শরীআ'হ ব্যতীত হিদায়াত, আলোকিত পথ ও নিরাময়কারী অন্যকিছু নেই।

দলের কর্মীদেরকে ইসলামী ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাদেরকে সঠিক ইসলামী বৈশিষ্ট্য (criteria) শেখাতে হবে, শরীআহ'র আনুগত্যের প্রতি ভালোবাসা এবং এর সঙ্গে বিরোধপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ঘৃণা দ্বারা এদের অন্তরকে পূর্ণ করতে হবে এবং কোনো সিদ্ধান্তের জন্য এর দিকে ফিরে আসার প্রতি ভালোবাসা এবং অন্যকিছুর দিকে ফিরে যাওয়ার প্রতি ঘৃণা দ্বারা এদের অন্তরকে পূর্ণ করতে হবে। ফলে কোনো বিষয় বুঝার ক্ষেত্রে তারা যেন শরীয়াহ'র মানদন্ড (criteria) ও চিন্তা দ্বারা পরিচালিত হয় এবং তাদের প্রবৃত্তিসমূহ ইসলামের অনুগামী হয়। ইসলাম যা পছন্দ করে তারা যেন তা পছন্দ করে এবং ইসলাম যা ঘৃণা করে তারা যেন তা ঘৃণা করে।

এই বিকাশক্রিয়ার (culture) দ্বারা শাবাবদেরকে গড়ে তোলার জন্য দলটিকে বিভিন্ন পাঠচক্র আয়োজন করতে হবে যাতে এর শাবাবরা নেতৃত্বের জন্য এবং বাস্তবিক ক্ষেত্রে দাওয়াতের জন্য প্রস্তুত হতে পারে যার ফলে লোকজন সেসব চিন্তাকে গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হবে। দলটি চিন্তার সাহায্যে বাস্তবতাকে বুঝবে এবং শাবাবদের কাছে সেই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করবে যার মাধ্যমে সে চিন্তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। এটা তখন শাবাবদের জন্য পথনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে- কীভাবে বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে হয় এবং কীভাবে বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক সংজ্ঞা যেগুলো বাস্তবতার ব্যাখ্যাদানকারী এবং মানাত যার উপরে শরঈ হুকুম প্রযোজ্য হবে সেগুলো নির্ধারণ করা যায়। দলটি যখন চিন্তা, প্রবৃত্তি, জৈবিক চাহিদা, পুনর্জাগরণ, সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা প্রভৃতি বিষয়কে সংজ্ঞায়িত করে তখন সে তা এজন্য করে যাতে সে এগুলোর বাস্তবতা বুঝতে পারে, কারণ এসব বিষয়ের সঙ্গে অনেক শরঈ হুকুম জড়িত।

শর'ঈ দলীল থেকে শর'ঈ হুকুম বের করার জন্য দলটি প্রচেষ্টা নিবে। বাস্তব সমস্যার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বিষয় সে বের করবে এবং সেগুলোর সমাধান দিবে। এজন্য দলটিকে সেসব বিষয়ের প্রত্যেকটাই গ্রহণ করতে হবে যেগুলোর মাধ্যমে সে শর'ঈ গ্রন্থসমূহ বুঝতে এবং দলটি নিজের জন্য প্রয়োজনীয় আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার হুকুম বুঝতে সক্ষম হবে। ইসতিদলাল (হুকুম বের করা) এর পদ্ধতি স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে হবে দলটিকে যাতে এর শাবাব ও মুসলিমগণ তা শিখতে পারে এবং শরীয়াহ'কে বোঝা ও আহকাম বের করার সঠিক ইসলামী পদ্ধতি তারা অনুধাবন করতে পারে।

গ্রহণকৃত বিকাশক্রিয়া (culture) শাবাবদের কাছে পৌঁছানোর জন্য দলটিকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে যাতে বিষয়টি যেন ব্যবহারিকভাবে বাস্তবায়িত হয়। কারণ নিছক জ্ঞানার্জন, তথ্যবহুল হওয়া অথবা শাবাবদেরকে প্রচণ্ড শিক্ষিত করে তোলা এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য নয়। বরং এসব চিন্তাভাবনার উদ্দেশ্য হচ্ছে বৃদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা করা এবং উম্মাহর মধ্যে এসব চিন্তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করা যাতে এগুলোকে উপস্থাপনকারী একটি কর্তৃপক্ষ সে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

এসব বিকাশক্রিয়াকে (culture) বিস্তারিত ও ব্যবহারিকভাবে যথার্থ উপায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দলটিকে চেষ্টা করতে হবে। কথা ও কাজের মধ্যে গরমিল করা যাবে না। কারণ দলটি যদি সত্যের শিক্ষা দেয় কিন্তু বিপরীত কাজ করে তাহলে তাতে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার ক্রোধের উদ্রেক ঘটাবে।

গ্রহণকৃত বিকাশক্রিয়ার (culture) আলোকে শাবাবদেরকে গড়ে তুলতে হবে এবং এসব চিন্তা তাদের অন্তরে বদ্ধমূল করে দিতে হবে। ইসলামের মৌলিক চিন্তাসমূহ গ্রহণ করার পরে উম্মাহর মধ্যে এগুলোকে ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে ওয়াঈ আম (সাধারণ সচেতনতা) এর ভিত্তিতে ফিকরাহ (চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণা)-এর জন্য রায় আম (জনমত) গড়ে ওঠে। আক্বীদাহ'র চিন্তাভাবনাসমূহ এবং উম্মাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত শর'ঈ হুকুমের মৌলিক নীতিমালাসমূহ এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে দলটিকে যাতে তা উম্মাহকে একটি লক্ষ্যের উপরে এক করে যা হচ্ছে আল্লাহর শরীআহ'র সার্বভৌমত্ব। এভাবেই উম্মাহ সঠিক পথে যাত্রা শুরু করবে এবং নিজের ব্যক্তিত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য পুনরায় অগ্রসর হবে যা সে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে।

এসব মৌলিক চিন্তা এবং শরঈ হুকুমের মৌলিক নীতিমালার ফলে আইন প্রদান ও ইবাদাতের বিষয়টি কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই সংরক্ষিত হবে এবং অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকার কেবলমাত্র রাসূল (সা)-এর জন্যই সংরক্ষিত হবে। এসব মৌলিক বিষয় লোকজনের মধ্যে জান্নাতের আগ্রহ ও জাহান্নামের ভয় সৃষ্টি করবে এবং তাদেরকে এটা বুঝতে সাহায্য করবে যে ইসলামের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অন্যতম একটি ফরয হচ্ছে- ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা; কারণ এর উপরে অনেকগুলো ফরয নির্ভরশীল। এতে উম্মাহ বুঝতে পারবে যে অন্যসব লোকের বাইরে তারা একটি উম্মত এবং কোনো বংশ বা রাষ্ট্রের সীমানা তাদেরকে পৃথক করতে পারেনা। মুসলিমরা একটি ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ যাকে কোনো জাতীয়তাবাদী বা দেশাত্মবোধক বন্ধন ছিন্ন করতে পারে না। আল্লাহর শরীয়াহ'র প্রতি অবহেলার ফলেই মুসলমানরা বর্তমানে অপমানিত ও লজ্জিত অবস্থায় রয়েছে। মুসলিমদেরকে তাদের রবের শরীয়াহ'র আনুগত্য করতে হবে এবং দলীল না জেনে তাদের পক্ষে কোনো কাজ করা উচিত হবেনা।

ইসলামী হুকুমতের অস্তিত্বে আসা এবং তাতে ফলধারণের জন্য এসব চিন্তা উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।

যেসব বিষয় আমরা উল্লেখ করেছি তার সবগুলোই দলের বিকাশক্রিয়ার (culture) অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। শরীয়াহ'র নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে একটি উপযুক্ত রাস্তা তৈরি করা যাতে আমরা চিন্তাভাবনাগুলোকে নির্ধারণ করতে পারি এবং সেই ভিত্তি ঠিক করতে পারি যার আলোকে এসব বিকাশ প্রক্রিয়াসমুহ (culture) গ্রহণ করা হবে।

যথেষ্ট শক্তিশালী চিন্তা, মতামত ও শর'ঈ হুকুম দলটিকে নির্ধারণ করতে হবে যাতে সে নিজেকে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য নিয়ে যেতে পারে এবং দাওয়াতের দায়িত্ব বহনকারীদের মধ্যে পূর্ন মনোযোগের সৃষ্টি করতে পারে। উম্মাহর মধ্যে জনমত গড়ে তোলার জন্যও এসব চিন্তাও প্রয়োজনীয়। দলটি যে ফিকরাহ (ধারণা)-এর উপরে প্রতিষ্ঠিত তা উম্মাহকে গ্রহণ করাতে এগুলো কাজে লাগবে।

উল্লিখিত পরিকাঠামো দলটিকে বজায় রাখতে হবে। এই বিষয়গুলো নির্ধারণ করতে যদি দলটি সমর্থ হয় তাহলে মৌলিক বিষয়ের শাখা-প্রশাখা থেকে উদ্ভূত কম গুরুত্বপূর্ণ হুকুমসমূহ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সে কিছু ভুল করলে, অথবা অন্যান্য দলের সঙ্গে সে মতভেদ করলে অথবা অন্যান্য দল তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করলে তা তেমন ক্ষতিকর হবেনা। কারণ এটি একটি অপরিহার্য এবং অনিবার্য বিষয়।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার শরীআহ'র সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিশ্বের বাকি অংশে দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য অর্জনের জন্য এসমস্ত বিকাশক্রিয়া (culture) দলটির জন্য অপরিহার্য। প্রকৃতপক্ষে সফলতা দেয়ার মালিকতো কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা।

Please note that this is a draft translation. It is likely to go through further edits. So, we would suggest not spreading this widely or publishing this anywhere online for the time being.

Link for English translation of the book 'Dawah to Islam'

উৎসঃ

চীন কি সুপারপাওয়ার হতে পারবে

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলো চীন একটি বেশ উপাদেয় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণভাবে একটি ধারণা দাঁড়িয়ে গিয়েছে যে, চীন হতে চলেছে এই গ্রহের নতুন সুপারপাওয়ার। এ-বিষয়ে গভীরতর বিশ্লেষণ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও খুব কমই পাওয়া যায়। তবে বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, সুপারপাওয়ার হওয়ার খুব লক্ষণই আসলে চীনের মধ্যে আছে।

টাইম ম্যাগাজিনের সাথে একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে চীনের এক ধনাঢ্য তরুণ দম্পতি জানিয়েছেন সেদেশের নব্য ধনী শ্রেণির কাছে কোন ধরনের জীবন পছন্দ। সাক্ষাৎকারে তারা তাদের অত্যাধুনিক এপার্টমেন্ট, ফ্যাশনেবল পোশাক ও তাদের শিশুকন্যার উঁচু মানের স্কুল - সবকিছুর কথা জানান। তবে যখন জানতে চাওয়া হয় তাদের মেয়ের জন্য তারা কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা করেন, জবাবে তারা কোনো রকম ইতস্তত না করেই বলেন, 'কানাডিয়ান নাগরিকত্ব'

চীনের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পশ্চিমমুখী হওয়ার বহু কারণ আছে। আসলে বিগত বছরগুলোতে চীনের অর্জিত অবিশ্বাস্য প্রবৃদ্ধিতে বহু ফাঁকফোকর রয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি মোটেও কোনো দীর্ঘমেয়াদি সুফলের ইঙ্গিত দেয় না। বরং এই প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে চীনের সস্তাশ্রম, পরিবেশ দূষণকে ন্যূনতম দাম না দেয়া এবং বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে চীনের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ।

একটি আর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চীনের কর্মোক্ষম জনশক্তির সংখ্যা ২০১১ সালে তার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যায়। এরপর ২০১২ সালে সেই কর্মক্ষম জনশক্তি হ্রাস পেতে থাকে। তার মানে হচ্ছে আগামী বছরগুলোতে চীনে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। ফলে সেখানে শ্রমের দাম বাড়বে, সঞ্চয় কমবে এবং স্বাস্থ্যসেবা ও পেনশনের পেছনে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়বে।

আগেই বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন করতে গিয়ে চীন পরিবেশ দূষণকে আমলেই নেয়নি। বর্তমানে চীনই বিশ্বে সর্বাধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। ২০১০ সালে চীন ৮.২ বিলিয়ন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করেছে- যেটা ১৯৯২ সালে চীনের নিঃসরণ থেকে ২৪০% বেশি। পানি ও বায়ুদূষণের কারণে চীনে প্রতি বছর ৭ লক্ষ ৫০ হাজার লোকের অকালমৃত্যু ঘটে। আর বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বহু ব্যক্তিকে জোর করে বাস্তুহারা করা হয়েছে। এই বাস্তুহারা জনগোষ্ঠী তাদের জীবিকাও হারিয়েছে।

বলা বাহূল্য, এসব নীতি অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনে না। ইতিমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে বেশ কিছু বিশাল অবকাঠামোগত প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে।

এসব অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়াও রাজনৈতিক সমস্যাও চীনে ব্যাপক। চীনে রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গত মাসে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসেও সংস্কারের ইস্যুটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। চীনের সরকারে ব্যাপক দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। আইনের শাসন ও সরকারের জবাবদিহির অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। বিরুদ্ধ মত দমনে রাষ্ট্র যতই সংকল্পবদ্ধ হোক না কেন, নব্য ধনিক শ্রেণি ক্রমেই অধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠছে।

রাজনৈতিক সংস্কার না করে অর্থনৈতিক উন্নতি করাটাই চীনের সবসময়কার চ্যালেঞ্জ। বাস্তব সত্য হলো, চীনের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ সস্তাশ্রমের ওপরই নির্ভরশীল। নিজস্ব উদ্ভাবন বলতে কোনো কিছু সেখানে নেই। এ-রকম অবস্থায় একটি দেশের পক্ষে কেবল চীনের বর্তমান অবস্থা পর্যন্তই আগানো সম্ভব - এরচেয়ে বেশি আগানো সম্ভব নয়। যে জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতা নেই, কেবল অন্যের প্রযুক্তি নকল করে সস্তায় প্রোডাক্ট বানায়, সেই জাতি ভালো বেনিয়া হতে পারবে - সুপারপাওয়ার হতে পারবে না। বস্তুত পক্ষে, কোনো জাতির মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তি জাগরণ, সৃষ্টিশীলতা ও অন্য জাতিকে অতিক্রমণের দৃঢ়চিত্ত মনোভাব না থেকে কেবল সস্তা পণ্যের ফেরিওয়ালার মানসিকতা থাকলে সেই জাতি বিশ্বে সুপারপাওয়ার হতে পারে না।

যেটুকু সমৃদ্ধি চীন অর্জন করেছে, সেটাও কোনো মিরাকল নয়। চীনের মতো জনশক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ দেশের আরো আগেই এই অবস্থায় আসা উচিত ছিল। দীর্ঘদিন কমিউনিজম অনুসরণ করতে গিয়ে বরং চীন বড় দেরিতে ব্যবসার দুনিয়ায় পা বাড়িয়েছে। এখন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের আওতায় যে সমৃদ্ধি চীন পেয়েছে সেটা বরং বিলম্বিত প্রাপ্তি।

কিন্তু সামনের দিনগুলোতে চীনের রয়েছে বহু চ্যালেঞ্জ। জনগোষ্ঠিতে বয়স্ক লোকের আধিক্য, কম জন্মহার, ভারত-ভিয়েতনাম-ব্রাজিলের সাথে বাজার দখলের প্রতিযোগিতা, অভ্যন্তরীণ মতভেদ ও ধনিক শ্রেণির অসন্তুটি এবং সর্বোপরি উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও মতাদর্শিক প্রেরণাহীন একটি ঝিমানো জাতীয় চেতনার কারণে চীনের পক্ষে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাটি ধরে রাখাই কঠিন হবে। আর সুপারপাওয়ার হওয়ার ব্যাপারটি তো হনুজ দূর অস্ত।

ওমর শরীফ

সাপ্তাহিক একটি ম্যাগাজিন থেকে সংগৃহীত

শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১২

বাংলাদেশকে ঘিরে সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনার সার সংক্ষেপ ও খিলাফতের সমাধান

বাংলাদেশকে ঘিরে সাম্রাজ্যবাদীদের সমস্ত পরিকল্পনা আজ জাতির সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আমাদের অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এসব পরিকল্পনার মুখোশ জাতির সামনে উন্মোচন করতে হবে। এর সার সংক্ষেপ নিম্নরূপ:

১. ক্রুসেডারদের মোড়ল আমেরিকা এ অঞ্চলে ইসলামী খিলাফতের পুনরুত্থান ঠেকানোর পরিকল্পনা করছে এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রসমূহের বলয় দ্বারা চীনকে ঘীরে রাখতে চাচ্ছে। এ অঞ্চলে তার ঘনঘন সামরিক মহড়া এবং নানা অজুহাতে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি, এ পরিকল্পনারই অংশ, যা এখন তার পররাষ্ট্রনীতির প্রধান ভিত্তি, যা "এশিয়ান পিভট" (Asian pivot) নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সাথে মার্কিনীদের কৌশলগত ও নিরাপত্তা সংলাপ, তার এ নীতি বাস্তবায়নের একটি অংশ।

২. তাছাড়া, ভারত যাতে তার হয়ে কাজ করে, এজন্য ভারতকে নিয়ে মার্কিন নীতি হচ্ছে - ভারতকে তার আওতাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করা; যাকে তারা "কৌশলগত অংশীদারিত্ব" বলে উল্লেখ করছে। অর্থাৎ, ভারতকে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছাড় দেয়া কিংবা ফায়দা লুটের সুযোগ করে দেয়া, কারণ, আমেরিকা অনুধাবন করতে পেরেছে যে, এটা ছাড়া ভারতকে ঐতিহাসিকভাবে চলমান বৃটিশ প্রভাব বলয় (বিশেষতঃ কংগ্রেস পার্টির মাধ্যমে জারি রাখা) থেকে বের করে আনা যাবে না।

৩. কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং ভারতকে ফায়দা লুটের সুযোগ করে দেয়ার মার্কিন এ নীতির অর্থ হচ্ছে, ভারতের প্রতিবেশী দুই মুসলিম দেশ অর্থাৎ পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে, বশীভুত দাস রাষ্ট্রে পরিণত করা, যাতে এই দুই রাষ্ট্রের শাসকরা সবকিছু জলাঞ্জলী দিয়ে হলেও ভারতকে যেকোন সুবিধা কিংবা ছাড় দিতে কুণ্ঠাবোধ না করে। যেমন, ভারতের স্বার্থ রক্ষায় মার্কিন হুকুমে, পাকিস্তানের দালাল শাসকরা কাশ্মিরের মুসলিমদের পক্ষ ত্যাগ করেছে।

৪. এই নীতির বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই মার্কিনীরা, বৃটেন ও ভারতের সমঝোতায়, হাসিনাকে ক্ষমতায় বসায়। পাশাপাশি মার্কিনীরা এদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে পুনর্গঠনের এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাতে তা এই নীতি কার্যকরে সহায়ক হয়, তারা নির্বিঘ্নে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে পারে, ভারতকেও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুবিধা কিংবা ছাড় দিতে পারে এবং এর মাধ্যমে মার্কিন-ভারত কৌশলগত সম্পর্ক সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারে।

মার্কিন-ভারত ষড়যন্ত্রে হাসিনার ভূমিকা:

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,

"তারা যদি তোমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে, তাহলে তারা তোমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হবে, এবং তাদের হস্ত ও রসনাসমূহ প্রসারিত করে তোমাদের ক্ষতি সাধন করবে, এবং তাদের আকাংখা, তোমরা যেন কাফিরদের কাতারে শামিল হও।" [সূরা আল-মুমতাহিনা : ২]

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা সত্যই বলেছেন। হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর পর, ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রু, মার্কিন-ভারত, তাদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেক অগ্রসর হয়েছে। এবং দেশের সাথে গাদ্দারীতে কোনরকম সীমা ছাড়াই, হাসিনা এ ঘৃণ্য কাজে তাদের পূর্ণ সহযোগীতা করেছে। তার কিছু নমূনা হচ্ছে:

- পিলখানায় সেনা অফিসারদেরকে নৃশংস হত্যাকান্ডে হাসিনা সহযোগীতা করেছে; এবং তারপর মার্কিন-ভারতের নির্দেশে ইসলাম, দেশ ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে অবস্থানকারী সেনা অফিসারদেরকে নিশ্চিহ্ন করার নীতি বাস্তবায়ন করেছে।

- বাংলাদেশকে, নরঘাতক মার্কিন সেনাদের এমন ঘাঁটিতে রুপান্তর করেছে, যাতে তারা নির্দ্বিধায় নিজের মাটি মনে করে, যখন-তখন এদেশে সামরিক মহড়ার আয়োজন করতে পারে। এবং ACSA চুক্তি (সামরিক ব্যক্তি, মালামাল ও অস্ত্রের সরবরাহ, মজুদ, চলাচল ও বিনিময় চুক্তি) সইয়ের ব্যাপারে মার্কিনীদের সাথে গোপন সন্ধি করেছে, যাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি ডিভিশনে পরিণত হয় এবং মার্কিন যুদ্ধে নিজেদের আত্মনিয়োগ করে, যার নমূনা আমরা ইতোমধ্যে পাকিস্তানে দেখেছি যেখানে ঠিক এই রকমই একটি চুক্তির কারণে আজ পাকিস্তানের মুসলিম সেনাবাহিনী নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছে।

- বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনায় না রেখে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য, "সেভেন সিস্টারস্‌"-এর স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের নেতাদেরকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে, যা ভারতের জন্য অত্যন্ত এক গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সংশিষ্ট বিষয়।

- ট্রানজিট প্রদান করেছে, যা ভারতের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

- সীমান্ত হত্যা ও টিপাইমুখ বাঁধ-এর ব্যাপারে শুন্য-প্রতিরোধ (Zero-resistance) বা কোন বাঁধা না দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে।

- গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের প্রকল্পে সাম্রাজ্যবাদীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে, যা ভবিষ্যতে তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহৃত হবে।

- মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানীর কর্তৃক দেশের তেল ও গ্যাস লুট করার রাস্তা সহজ করতে তাদের সাথে বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন করেছে, এবং দেশের ব্যবসাবাণিজ্যের উপর মার্কিন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায়, TICFA চুক্তি সম্পাদনের সন্ধি করেছে।

- রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে ইসলামের বিরুদ্ধে এবং রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে ইসলামী খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামীল হয়েছে, যা মার্কিন, বৃটেন ও ভারতের এক নম্বর এজেন্ডা।

সুতরাং, মার্কিন ও ভারতের সেবায় বিশ্বাসঘাতক হাসিনা চেষ্টার কোন কমতিই রাখেনি। কিন্তু তারপরও, যা আমরা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি, সাম্রাজ্যবাদীদের নিকট এটা কোন মূখ্য বিষয়ই নয়, কে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো, বরং, তাদের কাছে মূখ্য বিষয় হলো, পুরো শাসনব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজানো, যা তাদের নীতি বাস্তবায়নে সহায়ক হয়; এজন্য প্রয়োজনে সে তার এক দালাল শাসককে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আরেক দালালকে ক্ষমতায় বসাবে, যারাও একইভাবে তাদের সেবায় ব্যস্ত থাকবে।

মার্কিন-ভারতের দাসত্বে খালেদা জিয়ার ভূমিকা একই:

একথা কারও অজানা নয় যে, খালেদা জিয়া হচ্ছে, বহু বছর ধরে পুষে রাখা মার্কিনীদের বিশ্বস্ত এক দালাল, যার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। আর এজন্যই অর্থাৎ, মার্কিন স্বার্থের কারণেই, তার ভারতবিরোধী ছদ্মবেশ, "দেশের প্রতি ভালবাসার" মুখোশ। তার সাম্প্রতিক ভারত সফরে তা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেখানে সে ভারতের স্বার্থ হাসিলে সব রকম সেবা প্রদানের অঙ্গীকার করেছে, যা সে মূলতঃ মার্কিন হুকুমেই, মার্কিন নীতির কারণেই করেছে যাতে ভারতের সাথে মার্কিনীদের কৌশলগত সম্পর্ক আরও এগিয়ে যায়। খালেদা জিয়া বলেছে, সে অতীত ভুলে যেতে চায়! সে কোন অতীত ভুলে যেতে চায়, এই মুশরিক শত্রুরাষ্ট্রের কোন কুকর্ম সে ভুলে যেতে চায়? সেনা অফিসারদের বীভৎস লাশ? নাকি ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ? নাকি ফারাক্কা?...

এবং তাকে যদি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়, তবে ভবিষ্যতে সে কোন পথে হাটবে?

- সে পিলখানা হত্যাকান্ড ভুলে যাবে এবং সেনাহত্যাকারীরা পার পেয়ে যাবে। এবং মার্কিন-ভারতের স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থানকারী এবং ইসলাম ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে অবস্থানকারী নিষ্ঠাবান অফিসারগণের জন্য সামরিক বাহিনীতে কোন জায়গা থাকবে না।

- সে দেশের সেনাবাহিনীর উপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় করতে সহায়তা অব্যাহত রাখবে, যেমনটি সে পূর্বে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ও করেছিল।

- "সেভেন সিস্টারস্‌"-এর স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের ইস্যুতে তার অবস্থান জানিয়ে দিল্লী সফরে খালেদা জিয়া, হাসিনার মতো একই ভাষায় বলেছে, "বাংলাদেশের মাটিকে আমি ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে দিব না।"

- ট্রানজিট ইস্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার অবস্থান জানাতে গিয়ে খালেদা জিয়া, হাসিনার ভাষাই ব্যবহার করেছে, "আমরা আঞ্চলিক সংযোগের অংশ হিসেবে ট্রানজিটকে সমর্থন করি।"

- সীমান্ত হত্যাকান্ড এবং টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতেও তার অবস্থান একই অর্থাৎ হাসিনার মতো শুন্য-প্রতিরোধ (Zero-resistance) বা কোন বাঁধা না দেয়ার নীতি গ্রহণ করবে, যা তার সফরসঙ্গীর এই বক্তব্যে পরিষ্কার: "তিনি [খালেদা জিয়া] এসব বিষয় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিকট উপস্থাপন করেছেন!"

- আন্তর্জাতিক শক্তিসমুহের অংশগ্রহণে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির ব্যাপারেও খালেদা জিয়া একমত হয়েছে।

- মার্কিন তেল এবং গ্যাস কোম্পানীর সাথে চুক্তি সই করার ব্যাপারে ও TICFA চুক্তির ব্যাপারেও তার গৃহীত নীতি হাসিনার মতোই।

- এবং রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া তার প্রভুদের সন্তুষ্টির লক্ষে যুদ্ধ অব্যাহত রেখে হাসিনার পথই অনুসরণ করবে।

সুতরাং, খালেদা জিয়া যে হাসিনার মতোই অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদীদের একনিষ্ট দাস, তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার। এদেশের মানুষ বহুপূর্বে এই আশা ছেড়ে দিয়েছে যে, হাসিনা-খালেদা কোনদিন দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু তারপরও, কিছু লোক খালেদা জিয়ার আড়ম্বরপূর্ণ ভারতবিরোধী বক্তব্যে বিশ্বাস করার কারণে ভাবতো যে, খালেদা এইক্ষেত্রে অন্ততঃ হাসিনা থেকে ভিন্ন। কিন্তু, তারা এটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, হাসিনা এবং খালেদা হচ্ছে একই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফসল, যা এমন শাসকের জন্ম দেয় যারা একদিকে দেশের ভিতরে মানুষের জন্য দুঃখ-কষ্ট বয়ে আনে এবং অপরদিকে বিদেশের মাটিতে তাদের প্রভুদের দালাল হিসেবে কাজ করে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হচ্ছে সেই কারখানা যা এমন দালালদের তৈরি করে

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,

"নিশ্চয়ই, আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকের নিকট ফিরিয়ে দিবে; এবং যখন শাসনকার্য পরিচালনা করবে তখন অবশ্যই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে।" [সূরা আন-নিসা : ৫৮]

এই হচ্ছে শাসকদের উপর আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা প্রদত্ত হুকুম। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে তার ঠিক উল্টো অর্থাৎ আল্লাহ্‌'র হুকুম অমান্য করা। এতে শাসক প্রতিনিয়ত জনগণের বিরুদ্ধে অন্যায় শাসন ও বিশ্বাসঘাতক কর্মকান্ড পরিচালনা করে। ঔপনিবেশিকতাবাদ আগমণের পূর্ব পর্যন্ত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মুসলিমদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। খিলাফতের বিলুপ্তির পর, কাফির সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম উম্মাহ্‌'কে নিজেদের মধ্যে টুকরো-টুকরো করে ভাগ করে নিয়ে, সরাসরি মুসলিম দেশগুলোকে শাসন করতে থাকে। যখন অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা সরাসরি শাসন থেকে বিদায় নেয়, তখন তাদের দালালদের সে স্থানে বসিয়ে যায়, যাতে তাদের স্বার্থ হাসিলের পথ অব্যাহত থাকে। বেশিরভাগ দেশে তারা রাজাবাদশা ও স্বেচ্ছাচারী শাসকদের শাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়, যেমন মধ্যপ্রাচ্যে। যখন এসব দালালদের অন্যায়-অবিচার এবং বিশ্বাসঘাতক কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে, জনগণ পরিবর্তনের দাবীতে সোচ্চার হয়, তখন এই পশ্চিমা শক্তিরা গণতন্ত্রের শ্লোগাণ নিয়ে হাজির হয়ে নতুন দালালদের ক্ষমতায় বসায়, আরববিশ্বে যার সুস্পষ্ট কিছু নমূনা এখন আমাদের চোখের সামনেই বিদ্যমান। কিছু কিছু জায়গায় উপনিবেশবাদী শক্তিরা বিদায় নেয়ার সময়ই স্বেচ্ছাচারী শাসক নিয়োগের পন্থা অবলম্বন না করে "গণতান্ত্রিক" ব্যবস্থা রেখে গেছে, কিন্তু এই বিষয়ে নিশ্চিত হবার পরই যে, এর দ্বারা ক্ষমতা তার দালালদের হাতেই কুক্ষিগত থাকবে, ঠিক যেমনটি ঘটেছিল ভারতে নেহরু এবং পাকিস্তানে জিন্নাহ্‌'র মাধ্যমে। কখনওবা সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের নিজেদের পারস্পরিক প্রতিযোগীতার কারণে, গণতন্ত্রের শ্লোগাণকে ব্যবহার করেছে ও করছে, প্রতিদ্বন্দ্বীর দালালকে অপসারণ করে নিজেদের দালালকে ক্ষমতায় বসানোর কাজে। কোথাও কোথাও তারা "ই৫২" বোমা মেরেও গণতন্ত্রের ফেরী করেছে, যেমন ইরাক ও আফগানিস্তান।

সুতরাং, মুসলিম দেশগুলোতে (এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে) সবসময়ই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর পশ্চিমা দালালদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত, যা পূর্বেও ঘটেছে, এখনও ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। এটা হচ্ছে নব্য-উপনিবেশকতাবাদের ধোঁকাবাজীর এমন এক ঘৃণ্য উপকরণ, যেখানে জনগণ মনে করে সে তারা শাসককে ভোট দ্বারা নির্বাচিত করেছে, অথচ প্রকৃতপক্ষে শাসক হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের একনিষ্ঠ দালাল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও, তার চিত্র একই রকম। স্বাধীনতার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, যারা ছিল বৃটেনের দালাল, তারাই দেশের শাসক হয়েছিল। তারপর জিয়াউর রহমান, যে ছিল মার্কিন দালাল এবং তারপর এরশাদ, যে ছিল বৃটেন-ভারতের দালাল, তারা দেশ শাসন করেছে। এরপর এরশাদের পতনের পর, মার্কিনীদের মদদপুষ্ট খালেদা এবং বৃটিশ-ভারতের মদদপুষ্ট হাসিনা তথাকথি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ নেয় এবং তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এই দুই দালালের মধ্যে ক্ষমতার হাত বদল হচ্ছে, আর তাদের সাথে থাকছে তাদের জোটভুক্ত বড় মিত্ররা।

হে মুসলিমগণ! কতবার আমরা প্রতারিত হব? মুজিব, জিয়া এবং এরশাদের ধোকাবাজীর কথা না হয় বাদই দিলাম; শুধুমাত্র হাসিনা-খালেদার কথাই ধরুন, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮; মাত্র ২০ বছরে ৪ বার! একই ব্যক্তিদের কাছে!!

রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

"মুমিনগণ কখনও একই গর্তে দুইবার পড়ে আঘাত প্রাপ্ত হয় না।"

৫ম বারের মতো প্রতারিত হবেন না। হাসিনা ও খালেদাকে প্রত্যাখ্যান করুন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অপসারণ করুন এবং খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করুন। খিলাফত, আপনাদের মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যাদের গার্মেন্টস্‌ ফ্যাক্টরীর ভেতরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পুড়ে মরতে দেবে না। খিলাফত, নিম্নমানের ফ্লাইওভারের মতো মৃত্যুফাঁদ নির্মাণ হতে দিবে না। খিলাফত, আপনাদের সকল বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখবে, আপনাদের উপর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে এবং আপনাদের আস্থার মর্যাদা রাখবে; এবং দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, সম্পদ এবং সেনাবাহিনীর উপর মার্কিন-বৃটেন ভারতের নিয়ন্ত্রণের পথ চিরতরে রুদ্ধ করবে।

হে ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিবর্গ! আপনাদের চোখের সামনে সংঘটিত, হাসিনা-খালেদার অপরাধমূলক কর্মকান্ডের ব্যাপারে আপনারা নিশ্চয়ই সচেতন আছেন। দ্বিতীয়ত, আপনারা এটাও ভালো করে জানেন যে, তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচন হচ্ছে এদেরকে কিংবা এদের মতো কাউকে ক্ষমতায় বসানো এবং নিষ্ঠাবান ও সচেতন রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা হতে দূরে রাখার এক প্রক্রিয়া মাত্র। মুসলিম হিসেবে এ বাস্তবতা উপেক্ষ করে চোখ বন্ধ করে রাখার কোন সুযোগ নাই। কারণ, আপনাদের রয়েছে বস্তুগত সামর্থ্য, যার দ্বারা আপনারা নিষ্ঠাবান ও সচেতন রাজনীতিবিদদের নুসরাহ্‌ প্রদান করতে পারেন, যাতে এসব শাসকরা অপসারিত হয় এবং খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

ইসলামী খিলাফত বিশ্বে এক নম্বর রাষ্ট্রের অবস্থান অর্জন ও উম্মাহ্‌'র হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করে কিভাবে আঞ্চলিক ও বিশ্বমন্ডলে শক্তির ভারসাম্যের মধ্যে স্থায়ী পরিবর্তন আনবে, তার রোডম্যাপ তৈরিতে সক্ষম। সুতরাং সাড়া দিন, আল্লাহ্‌'র হুকুম পালনে সবচেয়ে অগ্রগামী হউন এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য নুসরাহ্‌ প্রদান করুন।

"এবং (বিশ্বাস ও সৎকর্মে) অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তীই হবে (জান্নাতে)। তারাই (আল্লাহ্‌'র) নৈকট্য পাবে। আহ্লাদপূর্ণ উদ্যানসমূহে। তাদের (অগ্রবর্তীগণ) অধিকাংশ হবে পূর্ববর্তীদের (মুসলিমদের) মধ্য থেকে; এবং অল্পসংখ্যক পরবর্তীদের মধ্যে থেকে।" [সূরা আল-ওয়াক্বি'য়া : ১০-১৪]

উৎসঃ