সোমবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১২

চীন কি সুপারপাওয়ার হতে পারবে

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলো চীন একটি বেশ উপাদেয় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণভাবে একটি ধারণা দাঁড়িয়ে গিয়েছে যে, চীন হতে চলেছে এই গ্রহের নতুন সুপারপাওয়ার। এ-বিষয়ে গভীরতর বিশ্লেষণ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও খুব কমই পাওয়া যায়। তবে বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, সুপারপাওয়ার হওয়ার খুব লক্ষণই আসলে চীনের মধ্যে আছে।

টাইম ম্যাগাজিনের সাথে একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে চীনের এক ধনাঢ্য তরুণ দম্পতি জানিয়েছেন সেদেশের নব্য ধনী শ্রেণির কাছে কোন ধরনের জীবন পছন্দ। সাক্ষাৎকারে তারা তাদের অত্যাধুনিক এপার্টমেন্ট, ফ্যাশনেবল পোশাক ও তাদের শিশুকন্যার উঁচু মানের স্কুল - সবকিছুর কথা জানান। তবে যখন জানতে চাওয়া হয় তাদের মেয়ের জন্য তারা কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা করেন, জবাবে তারা কোনো রকম ইতস্তত না করেই বলেন, 'কানাডিয়ান নাগরিকত্ব'

চীনের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পশ্চিমমুখী হওয়ার বহু কারণ আছে। আসলে বিগত বছরগুলোতে চীনের অর্জিত অবিশ্বাস্য প্রবৃদ্ধিতে বহু ফাঁকফোকর রয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি মোটেও কোনো দীর্ঘমেয়াদি সুফলের ইঙ্গিত দেয় না। বরং এই প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে চীনের সস্তাশ্রম, পরিবেশ দূষণকে ন্যূনতম দাম না দেয়া এবং বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে চীনের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ।

একটি আর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চীনের কর্মোক্ষম জনশক্তির সংখ্যা ২০১১ সালে তার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যায়। এরপর ২০১২ সালে সেই কর্মক্ষম জনশক্তি হ্রাস পেতে থাকে। তার মানে হচ্ছে আগামী বছরগুলোতে চীনে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। ফলে সেখানে শ্রমের দাম বাড়বে, সঞ্চয় কমবে এবং স্বাস্থ্যসেবা ও পেনশনের পেছনে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়বে।

আগেই বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন করতে গিয়ে চীন পরিবেশ দূষণকে আমলেই নেয়নি। বর্তমানে চীনই বিশ্বে সর্বাধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। ২০১০ সালে চীন ৮.২ বিলিয়ন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করেছে- যেটা ১৯৯২ সালে চীনের নিঃসরণ থেকে ২৪০% বেশি। পানি ও বায়ুদূষণের কারণে চীনে প্রতি বছর ৭ লক্ষ ৫০ হাজার লোকের অকালমৃত্যু ঘটে। আর বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বহু ব্যক্তিকে জোর করে বাস্তুহারা করা হয়েছে। এই বাস্তুহারা জনগোষ্ঠী তাদের জীবিকাও হারিয়েছে।

বলা বাহূল্য, এসব নীতি অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনে না। ইতিমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে বেশ কিছু বিশাল অবকাঠামোগত প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে।

এসব অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়াও রাজনৈতিক সমস্যাও চীনে ব্যাপক। চীনে রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গত মাসে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসেও সংস্কারের ইস্যুটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। চীনের সরকারে ব্যাপক দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। আইনের শাসন ও সরকারের জবাবদিহির অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। বিরুদ্ধ মত দমনে রাষ্ট্র যতই সংকল্পবদ্ধ হোক না কেন, নব্য ধনিক শ্রেণি ক্রমেই অধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠছে।

রাজনৈতিক সংস্কার না করে অর্থনৈতিক উন্নতি করাটাই চীনের সবসময়কার চ্যালেঞ্জ। বাস্তব সত্য হলো, চীনের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ সস্তাশ্রমের ওপরই নির্ভরশীল। নিজস্ব উদ্ভাবন বলতে কোনো কিছু সেখানে নেই। এ-রকম অবস্থায় একটি দেশের পক্ষে কেবল চীনের বর্তমান অবস্থা পর্যন্তই আগানো সম্ভব - এরচেয়ে বেশি আগানো সম্ভব নয়। যে জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতা নেই, কেবল অন্যের প্রযুক্তি নকল করে সস্তায় প্রোডাক্ট বানায়, সেই জাতি ভালো বেনিয়া হতে পারবে - সুপারপাওয়ার হতে পারবে না। বস্তুত পক্ষে, কোনো জাতির মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তি জাগরণ, সৃষ্টিশীলতা ও অন্য জাতিকে অতিক্রমণের দৃঢ়চিত্ত মনোভাব না থেকে কেবল সস্তা পণ্যের ফেরিওয়ালার মানসিকতা থাকলে সেই জাতি বিশ্বে সুপারপাওয়ার হতে পারে না।

যেটুকু সমৃদ্ধি চীন অর্জন করেছে, সেটাও কোনো মিরাকল নয়। চীনের মতো জনশক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ দেশের আরো আগেই এই অবস্থায় আসা উচিত ছিল। দীর্ঘদিন কমিউনিজম অনুসরণ করতে গিয়ে বরং চীন বড় দেরিতে ব্যবসার দুনিয়ায় পা বাড়িয়েছে। এখন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের আওতায় যে সমৃদ্ধি চীন পেয়েছে সেটা বরং বিলম্বিত প্রাপ্তি।

কিন্তু সামনের দিনগুলোতে চীনের রয়েছে বহু চ্যালেঞ্জ। জনগোষ্ঠিতে বয়স্ক লোকের আধিক্য, কম জন্মহার, ভারত-ভিয়েতনাম-ব্রাজিলের সাথে বাজার দখলের প্রতিযোগিতা, অভ্যন্তরীণ মতভেদ ও ধনিক শ্রেণির অসন্তুটি এবং সর্বোপরি উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও মতাদর্শিক প্রেরণাহীন একটি ঝিমানো জাতীয় চেতনার কারণে চীনের পক্ষে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাটি ধরে রাখাই কঠিন হবে। আর সুপারপাওয়ার হওয়ার ব্যাপারটি তো হনুজ দূর অস্ত।

ওমর শরীফ

সাপ্তাহিক একটি ম্যাগাজিন থেকে সংগৃহীত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন