রবিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১২

ইসরাইল ও হামাসের যুদ্ধবিরতি চুক্তি: সামরিক ও কৌশলগত বিশ্লেষণ

একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন থেকে সংগৃহীত

গত সপ্তাহে হামাস আর ইসরাইলের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি চুক্তি ছিল একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এই চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল ফিলিস্তিনি স্থল অভিযান হতে বিরত হল এবং যে সংকটের জন্য তারা নিজেরাই দায়ী তার জন্য হামাসের সাথে তারা সমঝোতা করল। হিলারি ক্লিনটন ইসরাইলের এই পিছু হটা আশাই করেননি। তাই তিনি সমঝোতা মিটিংয়ে যোগদান করার কোনো প্রাথমিক উদ্যোগ নেননি। হামাসের শর্ত মেনে নিয়ে ইসরাইল গাজার উপর তার চার বছরের অবরোধ তুলে নিয়ে গোলাবর্ষণ থেকে বিরত হল। এর সাথে সীমান্ত খুলে দিয়ে গাজার উপকূল হতে তারা কয়েক মাইল পিছিয়ে অবস্থান নিল। একই সাথে ইসরাইল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা গাজায় অবস্থানকারী হামাসের নেতৃস্থানীয়দের উপর লক্ষ্য করে গুপ্তহত্যা বন্ধ করবে। এই সব কিছু ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে পরিষ্কার যুদ্ধগত কৌশল পরিবর্তনের ইঙ্গিত করে।

যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইলের সম্মত হওয়ার বহু কারণ ছিল। প্রথমত, হামাসের রকেটের আক্রমণের টার্গেট ও তীব্রতা। ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘর্ষের ইতিহাসে এই প্রথম ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিব ও পশ্চিম জেরুজালেম ফিলিস্তিনি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে ইরানি ফাজর-৫ রকেটের কারণে - যার লক্ষ্যবস্তু আঘাত করার পরিসর প্রায় ৮০ কি.মি.।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দিনোমাকে আঘাত করেছে হামাসের রকেট, যেখানে ইসরাইলি পরমাণুকেন্দ্র অবস্থিত। সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো হামাসের লক্ষ্যবস্তুর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। রিশন লিজিওন, আশ্‌দুদ ও বি'এর শিভা এগুলোর প্রত্যেকটিতে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের বসবাস। ইসরাইল প্রায় ১,৫৫০ টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে গাজার উপর এবং এর জবাবে হামাস ১,৪৫৬ টি রকেট নিক্ষেপ পরে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) ভাষ্যমতে, এ নজিরবিহীন হামলার ভয়াবহতায় হাজার হাজার ব্যক্তি বোমানিরাপদ কেন্দ্রে আশ্রয় নেয় এবং শতকরা ৪৫ ভাগ (প্রায় ৩০ লক্ষ) ইসরাইলি জনগণকে হুমকির মুখে ফেলে।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, ইসরাইলি বাহিনীর প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা। তারা ক্ষেপণাস্ত্রবিরোধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করতে ব্যর্থ হয় যা কিনা ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলকে হামাসের রকেট হতে রক্ষা করার কথা। ইসরাইল দাবি করে যে, তাদের আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্রবিরোধী ব্যবস্থা হামাসের এক-তৃতীয়াংশ রকেট ধ্বংস করেছে - যদিও এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। প্রত্যেকটি আয়রন ডোম মিসাইলে ইসরাইলের খরচ হচ্ছে ৫০ হাজার ডলার। এই মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জবাবে হামাস অনবরত একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রকেট ছোড়ে যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাত্রা ছাড়িয়ে যায় এবং যার ফলে সেই জায়গাটি হামলার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। ব্যয়ের দিক থেকে হামাসের অস্ত্রাগারের একটি রকেট ইসরাইলের আয়রন ডোম মিসাইলের তুলনায় খুবই নগণ্য।

তৃতীয় কারণ, বিশ্বস্ত ও প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্যের অভাব। যদিও এটি ছিল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ কিন্তু এর উপর মিডিয়ায় সবচেয়ে কম আলোচনা হয়েছে। সবসময়ের মতো ইসরাইল দাবি করেছে যে, তাদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে গাজার অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থানের তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। বাস্তবে ইসরাইল প্রমাণ করেছে যে, এই তথ্যগুলো কার্যকরী ছিল না। যার প্রমাণ বেসামরিক ভবনে ইসরাইলের বোমা হামলা যেখানে কোনো অস্ত্রভাণ্ডার পাওয়া যায়নি। ইসরাইল আরও দাবি করেছে যে, তারা হামাসের রকেটভাণ্ডার ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের এই দাবিও ভুল প্রমাণ হয় যখন হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তির একদিন পরও রকেট নিক্ষেপ অব্যাহত রাখে। হামাস শক্ত হাতে গাজায় শাসনকর্তৃত্ব বজায় রেখেছে, যার প্রভাব গাজার সীমান্তের ভিতর অবস্থিত ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যোগাযোগের উপর পড়েছে এবং এর ফলে ইসরাইল প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে ভুগছে।

চতুর্থত, হামাসের দারুন প্রতিরোধ ক্ষমতা গাজার উপর আক্রমণ অনেক কষ্টসাধ্য করে দিয়েছে। হামাস একটি যুদ্ধবিমান ও একটি মনুষ্যবিহীন পর্যবেক্ষণ প্লেনে গুলি করে ভূপাতিত করে। একটি এফ-১৬ বিমান ভূপাতিত করার জন্য অত্যাধুনিক মিসাইল প্রয়োজন। আর তা যদি হামাসের আয়ত্বে থাকে তবে তা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য অনেক বড় অর্জন। হামাসের দাবির পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে, তারা এরই মধ্যে গত অক্টোবরে একটি ইসরাইলি হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে কাঁধে বহনযোগ্য বিমানবিরোধী এসএ-৭ মিসাইল ব্যবহার করেছে। এর সাথে হামাস সফলভাবে গাজার আকাশ থেকে একটি রাফায়েল স্কাইলাইট-বি পর্যবেক্ষণ বিমান ইউএভি ভূপাতিত করেছে। যে ব্যাপারটি স্থল অভিযানে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে তা হল হামাসের দখলে থাকা অত্যাধুনিক করনেট অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল ব্যবস্থা - যা অত্যাধুনিক ইসরাইলি মিরকাভা ট্যাংক অকার্যকর করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই একই জিনিস ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধে হিজবুল্লাহ সেনারাও অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছিল।

ইসরাইল গাজায় মিলিটারি অপারেশনের জন্য দুটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল - হামাসের রকেট হামলার প্রতিরোধ এবং এদের মিসাইলভাণ্ডার অকার্যকর করা। যুদ্ধবিরতি চুক্তি ছাড়া রকেট আক্রমণ প্রতিরোধ করা যেত না এবং হামাসের অস্ত্রভাণ্ডার তথা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপরও এর কিছুটা প্রভাব পড়েছে। এই অপারেশন ছিল ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর আরেকটি ব্যর্থতা। ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধে হারের পর এই প্রতিরোধ ইসরাইলি তথাকথিত অপরাজেয় বাহিনীর জন্য ছিল আরেকটি ধাক্কা।

কিছুদিন আগে হিজবুল্লাহ ইসরাইলকে সতর্ক করে দিয়েছে যে, এর দক্ষিণ সীমান্তের শহরগুলোর উপর হাজারো মিসাইলের বর্ষণ ঘটবে - যদি তারা আরেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত ভারসাম্যের পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হামাস ইসরাইলকে একটি নতুন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এর পরিণতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কৌশলগত পরিবর্তনের একটি সুবর্ণ সুযোগ এলো। বিশেষ করে মিশরের জন্য সুযোগ এলো ইসরাইলের পরিবর্তে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রতাপশালী খেলোয়াড় হওয়ার।

ওমর শরীফ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন