মঙ্গলবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১১

শেয়ার মার্কেট: ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে

ইসলাম যে একটি জীবনব্যবস্থা এই কথাটা মোটামুটি সব মুসলিম কম বেশি জানে। কিন্তু এই কথাটার তেমন কোন প্রয়োগ আমাদের জীবনের মধ্যে নেই, কারণ আমাদের বেশিরভাগ এই কথাটাকে ধারণ করেছি তথ্য (Information) হিসেবে, প্রতিষ্ঠিত ধারণা (Concept) হিসেবে নয়প্রতিষ্ঠিত ধারণা সেগুলোই যা আমাদের দৈনন্দিন কাজে-কর্মে বা আচার-আচরণে প্রভাব ফেলে, আমরা যে ধারণাগুলো ধারণ করিতাই বর্তমানে মুসলিমদের জীবনসম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী তথ্যবহুল হওয়ায় তাদের জীবনে ইসলামের ছবি প্রতিফলিত হয় না, প্রতিফলিত হয় জাহেলিয়াতের চিত্র।

কেউ যদি একটু খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন, আপনার চারপাশে শেয়ার বাজার নিয়ে আলোচনাটা গত কয়েক বছরে কয়েকশ গুণ বেড়েছে। কিন্তু, এই আলোচনার মধ্যে ইসলামের আলোচনাটা খুব একটা আসে না, আসলেও সেটা কুফর নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া দেখাতে চায় না, কিংবা আলোচনাটা ভুল ভাবে করা হয়েছে, অথবা সে আলোচনাতে অজ্ঞানতা বা অসম্পুর্ণতা আছে, কিংবা সে আলোচনাতে ইসলাম এসেছে, কিন্তু শেয়ার বাজারের বাস্তবতা ঠিকমত অনুধাবন করা হয়নি।

যেহেতু, ইসলাম সেই জীবনব্যবস্থা যা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এসেছে সব যুগের জন্য, তাই শেয়ার বাজারের বৈধতা নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আছে এটি খ্রিষ্টানিটির মত পার্থিব বিষয়ে নিশ্চুপ থাকে না, কিংবা, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার মত কিছুদিন পর পর আদর্শিক দুর্বলতা কিংবা স্বার্থের কারণে তার মরালিটির সংজ্ঞা পরিবর্তন করে না। নতুন কোন বিষয়ে যখন ইসলাম থেকে মুসলিমরা কোন মতামত গ্রহণ করবে তখন যে বিষয়গুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয় তা হল-
১। বিষয়টির বাস্তবতা
২। শরীয়ার টেক্সট (কুরআন এবং সুন্নাহ)

যখন কোন বিষয়ের বাস্তবতা বোঝা যাবে, তারপর তার সাথে কুরআনের কোন আয়াত বা রাসূল (সাঃ) এর কোন হাদীসের সাথে সেই বিষয়টির বাস্তবতার সম্পর্ক আছে, তা বুঝে তারপর ফতোয়া দেয়া হয়, এই কাজটি করে থাকে একজন মুজতাহিদ। এই দুইটি বিষয়ের কোন একটিতে ভুল হলে ফতোয়াটিও ভুল হবে।

শেয়ার বাজার সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি কি সেটা বুঝার জন্য শেয়ার বাজারে কিভাবে কাজ করে তা বোঝা দরকার, এরপরই বোঝা যাবে, শরীয়াহ কি বলছে।

শেয়ার মার্কেট:

শেয়ার মার্কেটের ধারণাটি এসেছে পূঁজিবাদ থেকে। দাবি করা হয়, এটা আধুনিক কালের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার Prerequisite। এটা আক্ষরিক অর্থে কোন “প্রকৃত বিনিয়োগ নয়”। প্রকৃত বিনিয়োগ হল যখন কোন ব্যক্তি বা সরকার কাচামাল কিনে বিনিয়োগ করে উৎপাদন করবে এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করে বিক্রয় করবে। কিন্তু শেয়ার বাজার হল, “Indirect Investment”, যখন কোন ব্যক্তি স্থানীয় কোন কোম্পানীর “শেয়ার”, [এটা একটা কাগজ হিসেবে ধরা যায়, যে কাগজের উপর সে শেয়ারের ফেসভ্যালু লেখা থাকে], এবং সে কাগজ স্থানীয় মার্কেটে ভাসমান অবস্থায় থাকে। ব্যাক্তি এই শেয়ারটি এজন্য কেনে না যে এর মাধ্যমে সে কোম্পানীর মালিকানার অংশীদার হয়ে লভ্যাংশ(Dividend) ভোগের জন্য অপেক্ষা করবে, বরং সে শেয়ার কেনে যেন এটির দাম বাড়লেই বিক্রি করে প্রফিট উপার্জন করবে (কোম্পানীর লাভ হোক বা না হোক)।

শেয়ার বাজারের বাস্তবতাঃ

উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজার অনেক দুর্বল এবং ভঙ্গুর, এ কারণে এখানে কোন বিনিয়োগকারীর পক্ষে শেয়ারের দামে প্রভাব বিস্তার করা সহজ। এ কাজটি করতে পারে পুজিবাদিরা, যাদের অনেক টাকা অথবা ব্যাংকের সাথে যোগসাজশে তারা অনেক টাকা ঢালতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ, কেননা এখানকার স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের তুলনায় পুজি কম, মার্কেটের ব্যাপারে আইডিয়া দুর্বল।

তাই পশ্চিমারা (অথবা স্থানীয় কেউ, ব্যাংক নিজে, অথবা শাসকশ্রেণি বা পুজিবাদিরই কেউ, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে) যখন এই মার্কেটে প্রবেশ করে অন্যদের তুলনায় অনেকগুণ বেশি টাকা নিয়ে, তখন তারা অন্য বিনিয়োগকারীদের মত এখানে প্রবেশ করলেও তাদের কাজকর্ম সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মত নয়, তারা বিভিন্ন ধোয়াশা তুলে, যেমন তারা বিপুল বিনিয়োগ করেছে এই খবর ছড়িয়ে বা মিডিয়াতে ঐ কোম্পানীর “অভিজাত” পোশাক বা নতুন কোন প্রজেক্টের খবর ছড়িয়ে, যেটা বেশিরভাগ সময় স্থানীয়দের মাথার উপর দিয়ে যায়, মুদি দোকানদার বদি মিয়া কতটুকুই বা বুঝে! শেয়ারের দাম প্রকৃত দাম থেকে অনেকগুন বাড়িয়ে দেয়। তারপর অন্যেরা এসে বেশিরভাগই বর্ধিত দামে সে শেয়ার কেনে এবং তারা একইসাথে বর্ধিত দামে শেয়ারগুলো বিক্রি করে চলে যায়। ফলে স্থানীয়রা এই “দামি” শেয়ারগুলো নিয়ে বসে থাকে এবং কিছুদিন পর তারা যখন ব্যাপারটি বুঝতে পারে তখন হয় চরম দরপতন। এবং যারা এই দাম ফটকাবাজির মাধ্যমে বৃদ্ধি করেছে তাদের কোন দায়বদ্ধতা থাকে না। তাদেরকে কেউ চেনে না এবং চিনলেও লাভ নাই, কারণ পুজিবাদিদের হাতে গড়া আইন তার এই কাজকে হালাল ঘোষণা করেছে। যদিও হালাল-হারাম ঘোষণা করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থায় আল্লাহর আইন বলে কিছু নেই।

তবে উন্নত দেশে এতটা সহজে বাজার নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয় না, কারণ সেখানে পুজিবাজের বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেশি। তবে, যেহেতু পশ্চিমা জীবনব্যবস্থায় ইলাহ হল “প্রফিট”, তাই এই কাজটাও করা সম্ভব হয়েছে, যার ফলাফল ১৯২৯, ১৯৮৭, ১৯৯৭ এবং ২০০৮ এর মন্দা।

মজার ব্যাপার হল, শেয়ারের দাম ওঠানামার সাথে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার কোন সম্পর্কই নেই! এরকম হরহামেশাই হয়েছে, যে কোম্পানী বার্ষিক লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ কিন্তু তাদের শেয়ারের দাম ফাসভ্যালু থেকে কয়েকশ গুণ বেশি। এর আরও বড় প্রমাণ হচ্ছে, মার্চেন্ট ব্যঙ্কের ভূমিকা, তারা কোন কোম্পানীর শেয়ারের জন্য লোন দিলে সেটার দাম বাড়বে, কোম্পানীর প্রকৃত ব্যবসার সাথে তাই শেয়ারের দাম বাড়ার সম্পর্ক নেই! এই মার্চেন্ট ব্যাঙ্কগুলো হল কৃত্তিম চাহিদা সৃষ্টির উপায়। দাম বাড়া/কমার আরেকটি কারণ হল, এসইসির সিদ্ধান্ত এবং গুজব (যেমন সৌদি যুবরাজ কিনবে রুপালী ব্যাঙ্ক) অর্থাৎ, পুরো বিষয়টির সাথে কোম্পানীর আর্থিক অবস্থার তেমন কোন সম্পর্কই নেই, আছে ভাওতাবাজি, ফটকাবাকি, জুয়াবৃত্তি আর মাথামোটা সরকারের কিছু মাথামোটা সিদ্ধান্ত।

পুজিবাদের পিতা আমেরিকা তার এই ব্যবসার ধরণ টিকিয়ে রাখতে এই দেশগুলোতে বসিয়ে রাখে তার দালাল শাসক এবং স্কলারশিপ আর নিজেদের সত্য-মিথ্যা মেশানো সিলেবাস দিয়ে পেলে-পূষে বড় করা কিছু লোকজন এনে “বুদ্ধিজীবি” তকমা লাগিয়ে দেয়, আর এরপর সে পরগাছা বুদ্ধিজীবির দল দেশের টকশো তে বড় বড় বুলি ছেড়ে বলে, “আমাদের উন্নত বিশ্বকে অনুসরণ করতে হবে”। বইপত্রে শেখানো হয়, “গ্লোবালাইজেশন একটি আশির্বাদ”, “ফ্রি মার্কেট পলিসি ছাড়া বিশ্ব অচল”। আর সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অন্যান্য সব জায়গায় ছাত্ররা এগুলো কপাকপ মুখস্থ করে ভাবে “আহা জ্ঞানী হয়ে গেলাম” – তাদের কয়েকজনকে দিয়ে সৃষ্টি হয় নতুন বুদ্ধিজীবি তৈরির সাইকেল।

আর যখন তারা নিজেদের চোখের সামনে সমস্যাগুলো দেখে তখন তারা তাদের গুরু আমেরিকার হাতে জন্ম নেয়া পুজিবাদের মধ্যেই সমাধান খুজতে থাকে। সরকার ব্যাংককে একবার বলবে, “শেয়ারের জন্য লোন দেবেন না”, কিছুদিন পর বলবে, “লোন দেন”। বিনিয়োগকারীদের সরকার কাকুতি মিনতি করে বলে, “দোহাই লাগে, আপনারা শেয়ার বিক্রয় করবেন না, দাম আবার বাড়বে”। ধস নামলে টাকা ছাপাবে out of thin air, এরপরে “সমস্যা হলে হোক, চুলায় যাক”। এসইসি দেরকে বাপ-মা তুলে গালি দেয়া হবে, তবে গালি দিয়ে লাভ নেই, কারণ আমেরিকা তাদেরকে সমস্যা কিভাবে তৈরি করে শিখিয়েছে, সমাধান শিখায় নি, সমাধান খোজার আগেই পুজি হারিয়ে লোকজনের মাথা যখন খারাপ হয়, তখন তাদের কারও কারও আল্লাহর কথা মনে পড়ে। বোকা জনগণের সামনে সরকার বা অন্য কেউ জবাবদিহিতার মুখেও পড়ে না, আর এই বাস্তবতায় আখিরাতে শাস্তির ভয়ও নেই, তবে বুদ্ধিজীবিরা freedom of speech এর বুলি আওড়াতে থাকে মুখস্থের মত। বাস্তবতা হল, বর্তমান জীবনব্যবস্থা চিন্তা-শক্তিহীন মানুষ তৈরি করে, যারা কেবল ব্যস্ত থাকে প্রফিটের পেছনে ছুটতে, সত্যকে জানতে নয়। সমস্যার সমাধান ও আর হয় না। আর কেউ যদি সমস্যা সমাধানে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের আহবান জানায় তাহলে তাদের বলা হবে জঙ্গি, কোন বন্দুক-বোমা না থাকলেও।

তবে, আলোচনার আরও অনেক বিষয় আছে। এর পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে পুরো ব্যবস্থাটার মাঝে আর কোথায় কোথায় সমস্যাগুলো লুকিয়ে আছে যার মাধ্যমে ইনশাল্লাহ বোঝা যাবে মানবরচিত আইনের ফাক-ফোকড়গুলো এবং আদর্শিক দুর্বলতা গুলো কোথায়।

শেয়ার মার্কেটের পিছনে যে তিনটি ব্যাপার কাজ করে তা হল
১-পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী সিস্টেম
২-সুদভিত্তিক ব্যাংকিং সিস্টেম (usurious banking system)
৩-অবিনিময়যোগ্য কাগুজে টাকা/মুদ্রা (nonconvertible paper money)

এই তিনটি ধারণা অর্থনীতিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে। প্রকৃত অর্থনীতি (Real Economy) এবং আর্থিক অর্থনীতি (Financial economy)। প্রকৃত অর্থনীতি হচ্ছে, উৎপাদন-বাজারজাত প্রক্রিয়া এবং ফিনান্সাল ইকোনমি হল তা যেখানে বিভিন্ন ফিনান্সাল পেপার উদ্ভব এবং কেনা বেচা হয়, সেগুলোকে অর্থনীতির ভাষায় বলে, transferable certificate, বাস্তবে কোন (প্রকৃত) ব্যবসা হয় না। এগুলো হস্তান্তরযোগ্য, এই কাগজের টুকরোটির মাধ্যমে হস্তান্তর করা যেতে পারে অনেক কিছুই, যেমন কোন কোম্পানির সম্পদ, তাদের ঋণ(!), বন্ড ইত্যাদি। এই অর্থনীতির সাথে প্রকৃত অর্থনীতির কোন সম্পর্ক নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৃত অর্থনীতি ২%, এবং ফিনানসিয়াল ইকোনমির অংশ ৯৮%। ফিনান্সিয়াল ইকোনমিকে বলা হয় পরজীবি অর্থনীতি।

পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিঃ

পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি যে ধারণা ও শর্তের ভিত্তিতে দাড়াঁ করানো হয়েছে তা দেখলে সহজেই প্রতীয়মান হওয়ার কথা যে, এটি কতিপয় পুজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করে, অন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বারটা বাজিয়ে।পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে “সীমিত দায়বদ্ধতা” (limited liability)
যেমন, কেউ যদি ১০টাকা দামের শেয়ার কেনে ১৫০ টাকা দামে, সেক্ষেত্রে কোম্পানি তার কাছে শেয়ারের প্রকৃত মূল্য (ফেসভ্যালু) ১০টাকার জন্য দায়বদ্ধ। মাঝখানে যারা ফটকাবাজি এবং গুজবের মাধ্যমে শেয়ারের দাম ১৪০০% বাড়িয়েছে, তারা একদমই নিষ্পাপ ! তাদের দায় নেই তখন থেকে যখনই তারা তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছিল, যদিও তারা একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে পুরো ব্যবসাটি নিয়ন্ত্রণ করেছে। যদি কোম্পানি দেউলিয়া হয় বা ক্ষতির স্বীকার হয়, কোম্পানি শুধু তাকে ১০ টাকা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য, ১৪০ টাকার দায়ভার থেকে মুক্ত কোম্পানি এবং পুজিপতিরা, এবং যখন কোম্পানি ডিভিডেন্ট দেয়, সেটা ১০টাকার উপরে দেয়, ১৫০ টাকার উপরে নয়।

পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র থেকে memorandum of association দেয়া হয়, যেটা এই ব্যবসার প্রকৃতি এবং শেয়ারের সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়। কোম্পানি একটি সত্ত্বা হিসেবে কাজ করে, আইনের ভাষায় বলা হয়, juristic person, যেখানে “কোম্পানি” হল মালিক। বিনিয়োগকারীদের সাথে কোম্পানি মালিকানার ভিত্তিতে কোন সম্পর্ক থাকে না, সম্পর্ক থাকে শেয়ারের কাগজের। বিনিয়োগকারীদের প্রতি কোম্পানির আক্ষরিক অর্থে কোন দায়বদ্ধতা তাই থাকে না।

পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে থাকে “বোর্ড অফ ডিরেক্টরস”, যারা শেয়ার বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে নতুন “বোর্ড অফ ডিরেক্টরস” নির্বাচন করা যায়, তবে এক্ষেত্রে, প্রত্যেক শেয়ারহোল্ডার একটি করে নয়, বরং, যার শেয়ার যতবেশি সে ততগুলো ভোট দিতে পারে। অর্থাৎ, কারও যদি অনেক বেশি শেয়ার কেনা থাকে, তাহলে সে ইচ্ছামত এই নির্বাচন করতে পারে, বাকিরা নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং ব্যবসার নীতিমালায় কোন প্রভাব রাখতে পারে না। তাই বাস্তবে, এই শেয়ারহোল্ডারদের কোম্পানির মালিকানায় কোন অংশ নেই, বরং তারা নিছক কিছু কাগজের মালিক।

পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির নিয়মানুসার যে কোন ব্যাক্তি যখন চান তখনই তার শেয়ারগুলো বিক্রি করে দিতে পারেন, এজন্য তিনি কোম্পানি বা অন্য শেয়ারহোল্ডারদের জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আবারও সেই “সীমিত দায়বদ্ধতা”। তাই তারা তাদের নিয়ন্ত্রণে ঘটা কোম্পানির কোন কাজের ব্যাপারে দায়ী থাকেন না। এভাবে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি কতিপয় ব্যাক্তিকে নিরাপত্তা দেয়।

কোন কোম্পানির যে বৈশিষ্ট্য দেখে সে কোম্পানির শেয়ার কেনা হয় তা হল price/earnings ratio (বাস্তবে এটার সাথে শেয়ারের দাম ওঠা নামার তেমন কোন সম্পর্ক নেই, বিনিয়োগকারীরা এটা নিজেরাও জানেন না কিভাবে এটা কাজ করে)।তত্ত্বীয়ভাবে এটা হল, কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের দাম এবং ঐ একটি শেয়ারের উপর কোম্পানির বার্ষিক লাভের অনুপাত। যদি কোন কোম্পানির শেয়ারের দাম ৪০ টাকা এবং তার উপর লভ্যাংশ (প্রতিটি শেয়ারে) ২ টাকা তাহলে, price/earning ration হল ২০। অন্যভাবে বলা যায়, প্রতিটি শেয়ারের পিছনে লাভ ৫%। বাস্তবে যা ঘটে তা হল, এই রেশিওটি কোম্পানি থেকে কোম্পানি ব্যাপকভাবে হেরফের করে, কোথায় ১০০%, কোথাও ৫%। এটা নির্দেশ করে, কোম্পানিগুলোর স্টক মার্কেটের অবস্থা এবং প্রকৃত অবস্থার পার্থক্য। এটা থেকেও এটাও বোঝা যায়, শেয়ার ব্যবসা কিভাবে ক্যাসিনোতে পরিণত হয়েছে।

সুদভিত্তিক ব্যাংকের ভূমিকাঃ

শেয়ার মার্কেটে সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ভূমিকা আর ভয়ঙ্কর। ব্যাংকগুলো সাধারণত কম রেটে বেশি বেশি লোন দেয় পুজিপতিদের, অন্যদের লোন দেয় কম বেশি রেটে, যে কারণে টাকা ব্যবহার করার ক্ষমতা অল্প কিছু লোকের হাতেই ঘোরাফেরা করে। ব্যাংকগুলো শেয়ার কেনার জন্য বিনিয়োগকারীকে তার কাছে যত টাকা তার থেকেও বেশি লোন দেয়, এবং এটা দেয়া হয় সাধারণত ধনীদের। যেমন শেয়ারের দাম ১০০ টাকা হলে, ব্যাংক লোন দিল ৮০ টাকা, আর বিনিয়োগকারী নিজে থেকে দিল ২০ টাকা। এখন ধরা যাক, কেউ ১০,০০,০০০ টাকার শেয়ার কিনল। এখন যদি হঠাৎ শেয়ারের দাম ১০% কমে ৯,০০,০০০ টাকা হল, তাহলে তাকে ব্যাংকের দেয়া ৮০% রেট (৭,২০,০০০ টাকা) ধরে রাখতে তাৎক্ষনিকভাবে ১,৮০,০০০ টাকার শেয়ার বিক্রি করতে হবে। তার নিজের টাকা দিয়ে সে এটা পরিশোধ করতে পারে, তবে সাধারণত থাকে না, তখন তাকে এই ১,৮০,০০০ টাকা পরিশোধ করতে নিজের কিছু শেয়ার বিক্রি করে দিতে হয়, ফলে শেয়ারের সাপ্লাই বেড়ে গিয়ে দাম আরও কমে যায়। এই অবস্থা কয়েকজনের একসাথে হলে পুরো মার্কেটে এটা প্রভাব পড়ে ফলে মূল্যপতন অব্যাহত থাকে।

এভাবেই ব্যাংকের কারণে মুদ্রাস্ফীতি এবং বিস্ফীতিকরণ ঘটতে থাকে। শেয়ারের দাম বাড়লে ব্যাংকগুলো বেশি লোন দেয়, কমে গেলে সেটা ফিরিয়ে নিতে গিয়ে আরও মুদ্রাপতন ঘটায়। তবে দরপতন খুব বেশি হলে ব্যাংকগুলো নিজেরাই বিপদে পড়ে, তখন তারা লোনের টাকা ফিরে পায় না, ফলে ক্ষতি হয় যারা ডিপোসিটর তাদের, তাদের টাকা ফিরিয়ে দিতে ব্যাংক ব্যর্থ হয়।

এই নাজেহাল অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য লোভাতুর চোখে অর্থের পিছনে ছুটে বেড়ানো পশ্চিমারা যে ব্যবস্থার মাধ্যমে সাময়িক পরিত্রাণ পেতে চায় তা হল, অবিনিময়যোগ্য কাগুজে টাকা, যা আরও জঘন্য একটি ব্যবস্থা। তাদের যেহেতু আখিরাতে কৃতকর্মের বিচারের ভয় নেই, কাজেই প্রতারণামূলক যেকোন কাজই ধর্মনিরপেক্ষ পুজিবাদী ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।

অবিনিময়যোগ্য কাগুজে মুদ্রাঃ

এই কাগুজে মুদ্রা হল এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাগজ (টাকা) ছাপিয়ে ফেলতে পারে। অর্থাৎ, তারা একটা ৫০০টাকা ছাপিয়ে বলল, এটার দাম ৫০০ টাকা (ধরে নেয়া হল) বস্তুত, এই কাগজের দাম ৫০০ টাকা নয়, এবং এটা কোন রিসার্ভের সাপেক্ষেও ছাপা হয় নি। এই কাগজের কোন প্রকৃত/স্বাভাবিক (intrinsic) ভ্যালু নেই। কেউ ৫০০ টাকা নিয়ে গেলে কিছু ফেরত পাবে না (ইসলামিক রাষ্ট্রে সে ৫০০ টাকা নিয়ে গেলে বায়তুল মাল তাকে ৫০০ টাকার স্বর্ণ দেবে)

যখন ভয়াবহ মূল্যপতন হয় এবং কিছু করার থাকে না, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে (out of thin air) ব্যাংকগুলোতে (লোন হিসেবে) দেয় এবং বাজার চাঙ্গা করার চেষ্টা করে। কিন্তু এটা সৃষ্টি করে মুল্যস্ফীতি, যার ভার বহন করে জনগণ। টাকার (currency) দাম কমে যায়, মানে তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যায়। যদিও বা ক্ষণিকের জন্য দেউলিয়াত্ব সমাধান করা যায়, কিন্তু কে না বোঝে এটা কোন বাস্তব সমাধান নয়। এর পেছনে যে প্রতারণামূলক চিন্তাটি কাজ করে তা হল, একটি কাগজের টুকরার দাম জোরপূর্বক নির্ধারণ করা, যদিও তার কোন দাম নেই।

Afterthought:

পুজিবাদী এই ব্যবস্থাটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তাদের প্রত্যেকটি পদক্ষেপের পেছনে আছে লোভ আর ভোগ। এই ব্যবস্থা দেখিয়ে দেয়, তাদের জীবনের উদ্দেশ্য হল, “highest sensual pleasure”, এখানে আলোচনার একমাত্র বিষয় হল “প্রফিট”,”প্রফিট” এবং “প্রফিট”, সেটা প্রতারণা করে হোক আর মিথ্যা বলে হোক। জীবন থেকে ধর্মকে পৃথক করে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা এটাই নিশ্চিত করেছে যেন মানুষকে তার প্রবৃত্তির উপাসনাতেই ব্যস্ত থাকে।এভাবেই জীবনের আগের এবং পরের সত্যকে উপেক্ষা করে তাকে নামিয়ে দিয়েছে পশুর স্তরে। তাদের জীবনব্যবস্থা এবং দর্শন এমন কিছু ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যা মোটেই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং তারা কেবল অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলে।

ইসলামিক শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক ধারণাঃ

১।সীমিত দায়বদ্ধতাঃ

ইসলামিক শরীয়াহ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির এই “সীমিত দায়বদ্ধতা”র ধারণাকে স্বীকার করে না। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির এই ধারণাটি এসেছে বড় বড় ব্যাংক এবং পুজিবাদীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। এখানে বিনিয়োগকারীকে তার পুরো টাকা ফিরিয়ে দিতে হবে, কারণ এই টাকাটা ঋণের সাথে সমতুল্য। ফটকাবাজি করে দাম বাড়িয়ে চলে যাবে এবং তার দায়বদ্ধতা থাকবে না- এটা ইসলামে অনুমোদিত নয়।

আবু হুরায়রা বর্ণনা করেছেন রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
"HE WHO TAKES MONEY FROM PEOPLE WITH THE INTENTION OF PAYING IT BACK ALLAH WILL PAY ON HIS BEHALF, AND HE WHO TAKES IT WITH THE INTENTION TO WASTE ITS ALLAH WILL WASTE HIM."  [বুখারী]

তিনি আরও বলেন,
"YOU SHALL RETURN THE RIGHTS TO THEIR RIGHTFUL OWNERS ON THE DAY OF JUDGEMENT; EVEN THE EWE WITH NO HORNS WILL GET EVEN WITH THE EWE WITH HORNS BY BUTTING IT BACK." [আহমেদ]

অর্থাৎ, পার্থিব জীবনে প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার (ঋণ) তাকে দিতে হবে, এটার জন্য কিয়ামতে জিজ্ঞাসা করা হবে।

তিনি আরও বলেছেন,
“THE DELAY OF RICH IS UNJUST”

যেহেতু, ধনীদের ঋণ পরিশোধ করতে দেরি করাকে যেখানে তিনি “অন্যায় বলছেন”, সেখানে একজনকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে-এমন নিয়ম বা কনট্রাক্ট নিশ্চিতভাবে আরও বড় অন্যায়।

কাজেই কোন ব্যাক্তির দেয়া ঋণের উপর তার অধিকার সীমিত (restriction) করার অধিকার ইসলাম দেয় না।

২।পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির সংজ্ঞাঃ

পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির সংজ্ঞাটি হল,
A CONTRACT IN WHICH TWO OR MORE PERSONS UNDERTAKE THAT EACH ONE OF THEM PARTICIPATE IN A FINANCIAL PROJECT, BY TENDERING A SUM OF MONEY, THUS SHARING WHAT THIS PROJECT YIELDS IN TERMS OF PROFIT OR LOSS.

যদিও সংজ্ঞার মধ্যে CONTRACT শব্দটি আছে, কিন্তু ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এটা কোন চুক্তি বা contract নয়। ইসলামিক শরীয়াহ অনুসারে, চুক্তি হল দুই পক্ষের মধ্যকার “প্রস্তাব” (offer) এবং “গ্রহণ” (acceptance) এর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক। অর্থাৎ, এক পক্ষকে ব্যবসার প্রস্তাব দিতে হবে এবং অপর পক্ষ সেটি গ্রহণ করতে সম্মত হলে, সেটি শরীয়ার দৃষ্টিতে বৈধ। যদি এরকম দুই পক্ষ না থাকে, এবং OFFER এবং ACCEPTANCE না থাকে, তাহলে সে চুক্তি বৈধ নয়।

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ … “[TMQ ৪:২৯]

পাবলিক লিমিটেড কোম্পনির শেয়ার কেনার সময় এই ঘটনাটি ঘটে না, যে কেউ যখন তখন শেয়ার কিনে ফেলতে পারে এবং বিক্রি করতে পারে, কোম্পানিকে বা অন্য কোন শেয়ারহোল্ডারদের জানাতে হয় না, অর্থাৎ এটি একটি “একপক্ষীয়” (unilateral) সিদ্ধান্ত। মাত্র একটি শেয়ার কিনেও সে ব্যবসায় প্রবেশ করতে পারে, অন্য কারও সম্মতি বা আপত্তি ছাড়াই। তাই, এটা ইসলামের দৃষ্টিতে চুক্তি হওয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে না।

ইসলামের দৃষ্টিতে কোম্পানির সংজ্ঞা হল,

"A CONTRACT BETWEEN TWO OR MORE PARTIES, WHO AGREE TO UNDERTAKE A FINANCIAL VENTURE WITH THE AIM OF MAKING A PROFIT."

স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, দুটি পক্ষের মধ্যকার চুক্তি, কোনভাবেই একপক্ষীয়(unilateral) নয়। এবং এর উদ্দেশ্য হল, ব্যবসায়িক ঝুকি নেয়ার মাধ্যমে প্রফিট(ডিভিডেন্ট বা লভ্যাংশ) অর্জন। এর উদ্দেশ্য নিছক শেয়ার কিনে দাম বেড়ে গেলে সেটা বিক্রয় করে দেয়া নয়, কিংবা নিছক অংশীদার হতে হবে তাই নামে মাত্র শেয়ার কিনে অংশীদার হওয়া নয়, বরং ব্যবসার লাভের অংশীদার হওয়া।

এবং এই venture বা ঝুকির জন্য অবশ্যি কাউকে না কাউকে, অন্তত একজনকে এটা দায়িত্ব নিতে হবে, যাকে বলা হবে PHYSICAL PARTNER। বাস্তবে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে কোন physical partner নেই, সবাই এখানে পুজির পার্টনার। ফিজিক্যাল পার্টনার হল সেই ব্যাক্তি যে ব্যাক্তি কোম্পানি চালানো এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরাসরি দায়ী থাকবে। ইসলামিক শরীয়াহ অনুসারে, যে ব্যাক্তি পুজির পার্টনার, সে কোম্পানি চালাবে না কিংবা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। কিন্তু এই নীতিটিও পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে লংঘিত হয়। কোম্পানির ডিসপোসালের ক্ষমতা কোম্পানি অর্থাৎ একটি কাল্পনিক আইনগত সত্ত্বার হাতে, কিন্তু এটা ইসলামিক শরীয়াহর মতে থাকবে কোন ব্যাক্তির কাছে, প্রকৃত ব্যাক্তির কাছে।

যেহেতু, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ইসলামিক শরীয়াহর বেধে দেয়া শর্ত পূরণে ব্যর্থ, কাজেই এই কোম্পানির শেয়ার কেনা যাবে না। কারণ এই কোম্পানির মূলধন বৈধ হলেও প্রফিট বৈধ+অবৈধ (যেটি এসেছে অবৈধ লেনদেন থেকে), তাই এই ব্যবসায় অংশগ্রহণ করতে ইসলাম অনুমোদন দেয় না।

৩।সুদঃ

আর সুদের ব্যাপারে ইসলামের আহকাম খুবই পরিষ্কার। শেয়ার মার্কেটের বড় বড় দুর্যোগের পিছনে ব্যাংকগুলো দায়ী, এবং ইসলাম সুদের লেনদেনকে খুব পরিষ্কার ভাব হারাম ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

“যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছেঃ ক্রয়-বিক্রয় ও তো সুদ নেয়ারই মত! অথচ আল্লা’হ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।“[TMQ ২:২৭৫]

৪।কারেন্সিঃ

ইসলামে ফাপড়ঁবাজি নেই, তাই ইসলাম হাওয়ার উপর অবিনিময়যোগ্য কাগুজে মুদ্রা ছাপানো অনুমোদন করে না। ইসলামে কারেন্সির স্ট্যান্ডার্ড হল, ধাতব মুদ্রা, যেমন-সোনা এবং রুপা।বায়তুল মালে যে পরিমাণ ধাতব মুদ্রা আছে তার উপর কাগুজে টাকা ছাপান যাবে, এর বেশি নয়।ফলে টাকার মুদ্রামান স্থিতিশীল থাকবে। অতীতে এই প্রথা চালু থাকলেও প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর কিছু সময়ের জন্য কাগুজে মুদ্রা চালু করা হয়, পরে আবার ফিরে যাওয়া হয় ধাতব মুদ্রার কারেন্সিতে। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে চূড়ান্তভাবে ধাতব মুদ্রাকে কারেন্সি হিসেবে বাতিল করে কারেন্সি হিসেবে নেয়া হয় ডলারকে। এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে (এবং উন্নত) দেশগুলোতে মুদ্রার ক্রমাগত দরপতনের পিছনে এই ফিয়াট কাগুজে মুদ্রার ভূমিকাই প্রধান।

শেয়ারবাজারে ক্রমাগত ধ্বসগুলো চোখে দেখিয়ে দেয়, এই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এবং ডলারভিত্তিক কারেন্সির ধারণাগুলো কিভাবে অর্থনীতিকে ধংস করছে। এটা প্রমাণ করছে, যতদিন পর্যন্ত এই ব্যবস্থার মূলোতপাটন করা না হবে, ততদিন এই চক্র বিরাজমান থাকবে। এটি উন্মোচিত করে আধুনিক বিশ্বের সুদভিত্তিক ব্যাংকিং কিভাবে ধনীকে আরও ধনী এবং গরীবকে আরও গরীব করছে। এই ব্যবস্থার সমাধান হিসেবে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে ইসলামিক ব্যবস্থায় যেখানে প্রতারণা এবং ফটকাবাজির স্থান নেই। এই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিগুলোকে রুপান্তর করতে হবে ইসলামিক কোম্পানিতে। ইসলামে পাচঁ ধরণের কোম্পানি ব্যবস্থা আছেঃ আল-ইনান, আল-আবদান, মুদারাবা, উজুহু, মুফাওয়াদাহ। এর মধ্যে মুদারাবা ব্যবস্থায় একপক্ষ ব্যবসা পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং দায়িত্বশীল থাকে এবং অপরপক্ষ পুজি দেয়, তাই অবশ্যই এটা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি নয়। সমস্যা সমাধানে ডলারভিত্তিক কারেন্সি ব্যবস্থা পরিবর্তন করে ফিরে আসতে হবে ধাতব-মুদ্রা ভিত্তিক কারেন্সি ব্যবস্থায়। এবং একইসাথে উচ্ছেদ করতে হবে সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা।

এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন এক ব্যক্তির কাজ নয়, বরং এর জন্য সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে।এখানে আমেরিকাকে ভয় করলে বা আনুগত্য করলে চলবে না, আনুগত্য করতে হবে আল্লাহর, সর্বশক্তিমান হলেন আল্লাহ, আমেরিকা নয়। মুসলিমদের বুঝতে হবে তাদের কাজ-কর্মের মানদন্ড “প্রফিট” বা “বেনিফিট” নয়, বরং, আল্লাহ সুবহানাল্লাহ ওয়াতা’আলার দেয়া হালাল-হারামের বিধান। তাদের ইলাহ টাকা নয়, বরং আল্লাহ। মুসলিমদের মনে রাখতে হবে, এমন এক সময় আসবে যখন এই শেয়ার ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জন করা টাকা তাদের কোন কাজে আসবে না। সেদিন এই কাজকে হালাল ঘোষণা করা সরকারকে খুজে পাওয়া যাবে না, খুজে পাওয়া যাবে না এই ব্যবস্থার প্রবর্তক দেশগুলোকে, যাদের কে mighty power হিসেবে ধরা হয়। মুসলিমদের এটাও জেনে রাখতে হবে, জীবনব্যবস্থা হিসেবে আল্লাহ একমাত্র ইসলামকে অনুমোদন দিয়েছেন, অন্য কিছুকে নয়, হোক সেটা গণতন্ত্র, পুজিবাদ,ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্র। এই আইডিয়া গুলো হল তাগুত (false judgment), যাকে বর্জন করতে হবে এবং গ্রহণ করতে হবে ইসলাম।

হে আল্লাহ! আপনি মুসলিমদের ইসলাম জানার, বোঝার এবং মানার তৌফিক দিন এবং ইসলামের গৌরবে এই উম্মাহকে গৌরবান্বিত করুন।

পৃথিবী কি জনসংখ্যার আধিক্যে ভারাক্রান্ত?

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths” বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)

জিনের গঠন নিয়ে বর্তমান আধুনিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, ১৫০০০ বছর আগে পৃথিবীর জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫ মিলিয়ন (বর্তমান ঢাকা ও দিল্লীর সমান)। যীশু খ্রীস্টের সময় অর্থাৎ আজ থেকে ২০০০ বছর আগে পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫০ মিলিয়ন (বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার সমান)। শিল্প বিপ্লবের শুরুর দিকে অর্থাৎ ১৮০০ শতকের দিকে জনসংখ্যা তিনগুন বেড়ে দাঁড়ায় ৭০০ মিলিয়ন (বর্তমান ইউরোপের সমান)। গত দুই শতাব্দীতে বার্ষিক ৬ ভাগ হারে বৃদ্ধিতে ১৯৫০ সালে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২.৫ বিলিয়ন। আর ২১ শতকের শুরুর দিকে বিগত ৫০ বছরে শতকরা ১৮ ভাগ হারে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ বিলিয়ন। যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে গেছে এবং কিছু কিছু এলাকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে, তারপরেও ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৯ বিলিয়ন। সেপ্টেম্বর ২০০৮ অনুসারে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৬.৭২ বিলিয়ন। 

বিগত শতাব্দীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এমন মাত্রায় এসে পৌঁছেছে যে, একেই দেখানো হয় পৃথিবী এখন বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনিত হবার মূল কারন হিসেবে। যুক্তি দেখানো হয় যে, আমরা এখন এই বিশাল জনসংখ্যাকে যোগান দেয়ার মত খাদ্যেও অপ্রতুলতার সম্মুখীন। এছাড়াও বলা হয় এ ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধি দরিদ্রতা, পরিবেশ বিপর্যয়, সামাজিক অস্থিরতা এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহের অনুন্নয়নের জন্য দায়ী। এ কারণে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারসমূহ জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধকল্পে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নানাবিধ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।

তথাকথিত এই অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে এমন কোন কিছুর সাথে তুলনা করতে হবে যা সীমিত। আর তা হল পৃথিবীর মোট সম্পদের পরিমাণ।

কিন্তু খুব সূক্ষভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, পৃথিবীর অনেক বড় বড় সমস্যা - যেগুলোর দায়ভার জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর চাপানো হয়েছে-তা আদৌ সঠিক নয়। বরং এগুলোর পেছনে রয়েছে স্পষ্ট রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য। মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখবার জন্যই জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিকে সামনে তুলে ধরা হয়েছে। মূল সমস্যা হল জীবনযাপন প্রণালী, ভোগবাদী মনোবৃত্তির স্ববিনাশী প্রবণতা, দরিদ্রতা এবং নিজেদের স্বাচ্ছন্দের স্বার্থে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো কর্তৃক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে শোষণ করবার হীন মানসিকতা।

উন্নত বিশ্ব বিশেষত: জাপান, রাশিয়া, জার্মানী, সুইজারল্যান্ড এবং পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ আরেকটি বড় সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে-যা হল জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের নিম্নগতি। পশ্চিমের অন্যান্য অংশেও এ নিম্ন হার অব্যাহত রয়েছে। তবে অভিবাসনের মাধ্যমে সেটা কিছুটা ঠেকানো হয়েছে। যদি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোসহ পুরো মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হার অব্যাহত থাকে, তাহলে তথাকথিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব আনুপাতিক হারে বেড়ে যাবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকানো ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে শক্তিশালী হওয়া জাতিকে পদানত করবার এক হীন প্রক্রিয়া। এ ব্যাপারটি স্পষ্ট ফুটে উঠবে তুরষ্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। প্রায় ৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার অনুপাতে ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য রয়েছে তুরষ্কের। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এটা প্রমাণ করে ২০২০ সালের মধ্যে পার্লামেন্টে এ দেশটি জার্মানীকে ছাড়িয়ে যাবে। তুরষ্কের অন্তর্ভুক্তি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমপ্রসারণের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ফেলবে। সেকারণে ফ্রান্সের ভ্যালেরি গিসকার্ড ডিএস্টাইং তুরষ্কের অন্তর্ভুক্তিতে আপত্তি তুলেন। ডি এস্টাইং- এর মতে তুরষ্কের অন্তর্ভুক্তি মরক্কোর অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করবে।

যদিও এ ব্যাপারে কোন ঐকমত্য নেই যে, কেন ব্রিটেন পৃথিবীর প্রথম শিল্পোন্নত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তারপরেও যে আটটি পূর্বশর্তের দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করা হয়; তার মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি। ১৭০৭ সালে স্কটল্যান্ডের সাথে সংযুক্তির পর ব্রিটেনের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৬.৫ মিলিয়ন। এক শতাব্দী পর সেটি প্রায় দ্বিগুন হয়ে দাঁড়ায় ১৬ মিলিয়ন। ১৭৫০ এর পরে এ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ-যা ব্রিটেনের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। এ জনসংখ্যা বৃদ্ধি থেকে তৈরি হয় দক্ষ শ্রমিক ভোক্তা

চীন এবং ভারত ইতোমধ্যে প্রমাণ করতে সমর্থ্য হয়েছে যে, বিরাট জনসংখ্যা এক বড় আর্শীবাদ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে সংকুচিত করবার অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকলেও চীন ও ভারত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকে অন্যতম বৃহৎ দুটি দেশ। এই জনসংখ্যার উচ্চ বৃদ্ধি হারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাদের অর্থনীতি। যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফলতার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক।

পৃথিবী কখনোই জনসংখ্যার আধিক্যে ভারাক্রান্ত নয়। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার তুলনায় এখনও অতিরিক্ত সম্পদ রয়ে গেছে। যদিও তার সিংহভাগ পশ্চিমারা একা ভোগ করছে।

সোমবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১১

ইসলামী রাজনীতি: ময়দান ছেড়ে ঘরে

কিছুদিন আগে পল্টন গিয়েছিলাম। আজাদ প্রডাক্টস এর থেকে খানিকটা সামনে এগোতেই দেখা গেলো সমাবেশ হচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর উদ্যোগে নারীনীতি ও আনুসাঙ্গিক বিষয়ে ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশ হচ্ছে। নোয়াখালী টাওয়ারের নিচ থেকে শুরু করে বেশ অনেকদূর পর্যন্ত নেত-কর্মীদের ভীর লক্ষ্য করার মতো। এখানে সমাবেশের কারণ জিজ্ঞেস করলে জানা গেলো, অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিলো মুক্তাঙ্গনে। কিন্তু সরকার মুক্তাঙ্গনে ১৪৪ ধারা জারি করার কারণে বাধ্য হয়ে এখানে সমাবেশ করতে হচ্ছে। এর কয়েকদিন আগে মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করতে অনেকে পুলিশের লাঠিচার্জ ও গণগ্রেফতারের শিকার হয়েছেন। তাই বাধ্য হয়েই এখানে সমাবেশ করতে হচ্ছে।

গত ০৪ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী পালনের জন্য আসতে চাইলে মুফতী ফজলুল হক আমিনীকে লালবাগে নিজ বাসার নিচেই তাকে বাঁধা দেয়া হয়। বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে মুফতী আমিনী অভিযোগ করেন তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনে বাঁধা দেয়া হচ্ছে। তবে মুফতী আমিনীকে অবরুদ্ধ করার কথা অস্বীকার করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়, তিন দিন আগে আমিনীর মেয়ের জামাই জনাব জুবায়ের আহমাদ পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্ত চেয়ে লালবাগ থানায় জিডি করেছেন। সুতরাং আমিনীর নিরাপত্তার দায়িত্ব এখন তাদের উপর। তাই তারা আমিনীর নিরাপত্তার স্বার্থেই তাকে বের হতে দিচ্ছেন না।

উপরোক্ত বাস্তবতা বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং শীর্ষ ইসলামী রাজনৈতিক দলের। যারা বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ইসলামিক ইস্যুতে কিছুটা সক্রিয় আন্দোলন করার চেষ্টা করছেন তাদেরই এই অবস্থা। এর বাইরে বাকি যেই ইসলামী দল আছে তাদের অবস্থাও এর চেয়ে ভালো নয়।

ইসলামী আন্দোলনের যেই উত্তাল ঢেউ এক সময় মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে পল্টন ময়দান পর্যন্ত লাখো জনতাকে আলোড়িত করতো, লংমার্চের ঘোষণায় সারা দেশ জুড়ে ইসলামী রাজনীতির যেই সুবাতাস বয়ে যেতো, বর্তমান আমলে সেটি বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট তারপর মুক্তাঙ্গন হয়ে এখন নিজ দলের অফিসের সিঁড়িতে এসে ঠেকেছে। এটি কি ইসলামী দল, নেতৃবৃন্দ আর ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী লাখো লাখো তৌহিদী জনতার জন্য সুখবর না দু:সংবাদ, তা আজ ভেবে দেখার সময় এসেছে। ইসলামী দল গুলো এবং তাদের আন্দোলন যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে ইসলামী দল গুলো যে প্রেস রিলিজ সর্বস্ব দলে পরিণত হবে না, তার কি গ্যারান্টি কে দিবে?

ইসলামী দল ও তাদের জনসম্পৃক্ততা: বয়স্ক মুরুব্বীদের অনেক সময় গল্প করতে শোনা যায় যে, আমাদের ছোট বেলায় নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিষ এতো এতো সস্তা ছিলো। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, আর গোয়াল ভরা গরু ছিলো... ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ যখন ইসলামী দলের অতীত ও বর্তমান আন্দোলন সম্পর্কে আমার নিজের অল্প কয়েক বছরের দেখা প্রেক্ষাপট গুলোর পর্যালোচনা করছি তখন নিজেকে নিজের কাছেই সেই বৃদ্ধের মতো মনে হচ্ছে। লাখো লাখো মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশ গ্রহণে পল্টন ময়দানের সেই জোয়ার কিংবা মানিক মিয়া এভিনিউতে কাদিয়ানী বিরোধী উত্তাল সেই আন্দোলন গুলো আজ যেন স্বপ্নের মতো। প্রশ্ন জাগছে, ইসলামী আন্দোলনের প্রতি গণ মানুষের সেই সমর্থন ও সহমর্মিতা কি আজও আছে? ইসলাম দল গুলোর প্রতি ধর্মপ্রাণ দেশবাসীর আকাঙ্খা কি ইসলামী নেতৃবৃন্দ অনুভব করতে পারেন? তাহলে কেন তারা দিন দিন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হচ্ছেন। কেন তারা জাতির আন্তরিক কামনা একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে সুনির্দিষ্ট কর্ম পদ্ধতি ও কর্মসূচি দিতে পারছেন না? কেন তাদের আন্দোলনে জনগণের গণসম্পৃক্ততা দিন দিন কমে যাচ্ছে?

একথা অনস্বীকার্য যে আগে এদেশে যেভাবে এবং যেই ব্যাপক সংখ্যক গণমানুষের সম্পৃক্ততা নিয়ে ইসলামী আন্দোলন গড়ে উঠতো, ইসলামী নেতৃবৃন্দের ডাকে লাখো লাখো মানুষ ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমে আসতো, অনেক ক্ষেত্রেই আজ আর তেমনটি দেখা যায় না। বর্তমান সময়ে ইসলামী দল গুলোর কর্মসূচীতে নেতৃবৃন্দের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক কিংবা সামান্য ভক্ত-মুরীদই মূল দর্শক স্রোতা হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। কেন এমনটি হচ্ছে? দিন দিন কেন ইসলামী দলগুলো তাদের আন্দোলনে গণমানুষের ব্যাপক অংশকে সম্পৃক্ত করতে পারছে না। দিন দিন তাদের সক্রিয় অনুসারীদের সংখ্যা কমার পরিবর্তে বাড়ছে না?

নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর পেছনে যে সকল কারণ দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:

১. সুনির্দিষ্ট চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণে অপারগতা।
২. গণমানুষের দৈনন্দিন সমস্যার ইস্যু গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া।
৩. আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ভাঙ্গন।
৪. বিভিন্ন ইস্যুতে উত্তাল আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে হঠাৎ খেই হারানো।
৫. নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখার পরিবর্তে কখনো বিএনপি বা কখনো আওয়ামী লীগের শরণাপন্ন হওয়া।
৬. অনেক ক্ষেত্রে অনেকের বিরুদ্ধে আঁতাতের অভিযোগ।

আমাদেরকে অবশ্যই বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। নিজেদের মূল সমস্যা চিহ্নিত করে তাকে দূর করার জন্য আন্তরিক হতে হবে। বাংলাদেশের ইসলামী দলসমূহের জন্ম এবং তাদের আন্দোলনের ইতিহাস বলে, এদেশে ইসলামী সংগঠনের সৃষ্টি হয় কেবলমাত্র এক দু’জন বরেণ্য ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি কেন্দ্রিক আর তাদের আন্দোলন হয় ছোট খাটো ইস্যু ভিত্তিক। সেই ইস্যু শেষ হয়ে গেলে বা বরেণ্য ও শ্রদ্ধেয় সেই ব্যাক্তি ইন্তেকাল করলে বিলুপ্তি ঘটে সেই দলের ও তাদের ইস্যুভিত্তিক রাজনীতির।

অনেক সময় সেই বরেণ্য ব্যক্তির ইন্তেকাল বা তার বার্ধক্যেই সংগঠনে সৃষ্টি হয় বিভক্তি ও সীমাহীন মতপার্থক্যের। একটি দল ভেঙ্গে একই নামে সৃষ্টি হয় ২, ৩, ৪ টি দলের। অনেক সময় এই সংখ্যা গাণিতিক হারে বাড়তে থাকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রত্যেকটি দলই পূর্বের সেই একটি নামই ব্যবহার করে এবং প্রত্যেকেই তাদেরকে মূল দল ও সংগঠনের লোক বলে দাবী করতে থাকে।

এর মূল কারণ হচ্ছে, এদেশের ইসলামী দলগুলো ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠার মহান ও চূড়ান্ত ইস্যূ নিয়ে মাঠে নামে না। জনগণের সামনে তারা জনগণের প্রত্যাহিক সমস্যার ইসলাম সম্মত সমাধান তুলে ধরতে পারে না। প্রচলিত গণতান্ত্রিক পুজিবাদী শাসনব্যবস্থার বাইরে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি মডেল জাতির সামনে তুলে ধরতে তারা অক্ষমতার পরিচয় দেন। কখোনো এ দলে কখনো বা ও দলে কেবলমাত্র কয়েকটি আসন লাভের জন্য ভীড় জমান। ফলে জনগণ তাদেরকে আওয়ামীলীগ বা বিএনপির বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করার কোন কারণ খুঁজে পায় না। অনেকেই হয়তো আমার সাথে এই ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবেন, তবুও সত্যের জন্য বলতে হচ্ছে যে, রাজনীতির ময়দানে ইসলামী দলগুলো যেই সকল ইস্যু নিয়ে সরব হয়, জনগণ তাদের প্রত্যাহিক কাজের ক্ষেত্রে সেই ইস্যুর কোন প্রয়োজন মনে করে না বা অনুভব করতে পারে না। উদাহরণত: ইসলামী দলগুলো যখন ফতোয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলো তখন এই আন্দোলনে কওমী মাদ্রাসাসমূহের ছাত্র, ইমাম-খতীব ও আলেম-উলামা ছাড়া ব্যাপক জনগোষ্ঠীর খুব সামান্য অংশই অংশগ্রহণ করেছিল।

একইভাবে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের বিতর্কিত খতীব নিয়োগের পর সারাদেশের সকল হক্কানী উলামায়ে কিরাম যেভাবে এর প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন আমার জ্ঞাতসারে নিকট অতীতে আর কোন ইস্যুতে তারা সকলে এমন সরব ও সক্রিয় হননি। কিন্তু ফলাফল কি?

অবশ্যই শূন্য। কারণ আলেম-উলামা ও ইসলামী সংগঠনগুলোর আন্দোলনের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা একেবারে ছিলো না বললেই চলে। দেশের আপামর জনসাধারণের বড় একটি অংশ ফতোয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং ইসলামী শরীয়া সম্পর্কেই অবগত নয়। আর বায়তুল মোকাররমের ইমাম পরিবর্তন নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথাই নেই। কারণ এটি তাদের প্রত্যাহিক সমস্যার কোন অংশ নয়।

এক্ষেত্রে ইসলামী দলসমূহের ব্যর্থতা হলো তারা এই সকল ইস্যুকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ও খিলাফত রাষ্ট্রের শাসন তথা কুরআন-সুন্নাহর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিকে জনগণকে আহ্বান করে তার সাথে এই ফতোয়া বা খতীব সমস্যার লিঙ্ক করতে পারেন নি। এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অতীতের বাংলাদেশ আর বর্তমানের বাংলাদেশ এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে এদেশের গণমানুষের কাছে ইসলামের দাবী ও দরদ যতটা প্রকট ছিলো, দিন দিন কিন্তু তার পরিমাণ কমছে। অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে অপসংস্কৃতি আর অশ্লীলতার ছয়লাবে যুব-তরুণ সমাজের এক বিশাল অংশ আজ ইসলামী আদর্শ থেকে অনেক দূরে। টিভি-সিনেমা আর নাটক-গান খুবই সহজলভ্য হওয়ার কারণে ধর্ম-কর্মের প্রতি তাদের আকর্ষণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার কারণে আগের মতো এখন আর তাদেরকে খুব সহজেই ইসলামী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট করা সহজ নয়। বর্তমান সময়ের আধুনিক তরুণ সমাজের কাছে এবং শিক্ষিত পরিবারকে ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করতে হলে অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যেতে হবে। মানব জীবনের প্রতিটি সমস্য বিশেষত: বর্তমান জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাবলীর ইসলাম সম্মত সহজ সমাধান এবং ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে কত সহজে যে দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব তার যৌক্তিক বাস্তবতা তুলে ধরতে হবে। বর্তমান সময়ে ইসলামী আন্দোলনকে বেগবান করতে হলে এর কোন বিকল্প নেই।

ইসলামী দলগুলোকে ভাবতে হবে নিজেদের বাস্তবতা নিয়ে। তাদের আন্দোলনের ভবিষ্যত ও বর্তমান কর্মপন্থা নিয়ে। ইসলামী নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে নিজেদের মধ্যকার কোন্দল আর আভ্যন্তরীন সমস্যা গুলো নিয়ে। পুরো জাতীর সামনে আজকে ইসলামী দলসমূহের যেই ভবিষ্যত পরিকল্পনা দেয়া প্রয়োজন, তাহলো ইসলামিক জীবন ব্যবস্থার জন্য, ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ বা বোমা হামলা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কুরআন ও সুন্নাহ সমর্থিত পদ্ধতি নয়। এক্ষেত্রে ইসলাম সমর্থিত একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে ব্যাপক গণদাওয়াত, খিলাফতের লক্ষ্যে গণসচেতনতা তৈরী, সমাজের নেতৃস্থানীয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের নুসরাহ বা সাহায্য প্রার্থনা এবং এই দুটি অর্থাৎ গণসম্পৃক্ততা ও নেতৃস্থানীয়দের সহযোগিতা নিয়ে এক আদর্শিক গণবিপ্লব। যেই বিপ্লব গণতান্ত্রিক পুজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করে এদেশে ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বা খিলাফত পদ্ধতির শাসন কায়েম করবে। মহান আল্লাহ আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ইসলামী দল সমূহকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার তাওফীক দিন। আমীন।

ইসহাক খান