(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths”
বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)
কথা
বলা হয় যে, ঐতিহাসিকভাবে জাপান হল উদার অর্থনৈতিক আন্দোলনের সাফল্যগাঁথা-যারা মুক্তবাজার
ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল ও অর্ধশতাব্দীরও কম সময়কালের মধ্যে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতিতে
পরিণত হয়। চীনের বর্তমান অগ্রগতির পেছনেও একই ধরণের কথা প্রচলিত আছে। যদিও সত্যিকারের
ঘটনা যা বলা হচ্ছে মোটেও তা নয়।
যেসব
কৌশল গ্রহণ করার কারণে জাপানের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে তা উদারনীতি ও বিশ্বায়নের ধারণার
সম্পূর্ণ বিপরীত। জাপান সরকার তার দেশের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় খাতসমূহকে বিকাশের জন্য
বিদেশী প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত রেখেছে। বৈদেশিক মুদ্রা বন্টনের দায়িত্ব জাপানি সরকার
স্বীয় অধিকারে রাখে-যার মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রনে রাখা, জাপানি কোম্পানিগুলোর
বিদেশী প্রযুক্তি সংগ্রহের ব্যবস্থা করা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের বিভিন্ন উপাদানকে নিয়ন্ত্রনে
রাখা সম্ভবপর হয়। সরকার নির্দিষ্ট শিল্পসমূহেঅর্থপ্রবাহ সুনিশ্চিত করার প্রধান হাতিয়ার
হিসেবে দ্যা এক্্রপোর্ট ব্যাংক অব জাপান এবং জাপান ডেভেলোপমেন্ট ব্যংক স্থাপন করে।
মিনিস্ট্র
অব ইন্টাঃ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (এম আই টি আই) নামক মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগ জাপানের
উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। কেন্দ্রীয় সরকারের এ বিভাগটি উৎপাদন, সেবা এবং
উৎপাদিত পণ্যের প্রসারতাকে নিয়ন্ত্রন করে। জাপানি শিল্প কাঠামোর জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন,
বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রন, জাতীয় অর্থনীতিতে পণ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত এবং কাঁচামাল
ও শক্তির নির্ভরযোগ্য উৎস পর্যবেক্ষণ করা ছিল এ বিভাগের দায়িত্ব। সুতরাং জাপানের অর্থনীতি
ছিল কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত; কোনক্রমেই মুক্তবাজার ব্যবস্থার অধীন ছিল না।
বৈশ্বিক
ব্যপারে চীন তার কয়েক দশকের পুরনো,সংকীর্ণ ও প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতা থেকে বের হয়ে
এসেছে। চীন তার ১৫০ বছরের লজ্জা ও অপমানের দীর্ঘ লালিত ভিক্টিম (victim) মানসিকতাকে
ঝেড়ে ফেলে বৃহত্তর শক্তির মানসিকতা গ্রহন করেছে (ডাগুয়া জিনতাই)। এর অবধারিত ফলাফল
হল বৈশ্বিক বিষয়াবলিতে চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা। ভিক্টিম মানসিকতা থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর
শক্তির মানসিকতা ধারণের কারণে চীন এখন নিজেকে বিশ্বশক্তিসমূহের কাছাকাছি এক সত্ত্বা
হিসেবে খুঁজে পাচ্ছে। ১৯৯০ এর দশক থেকে চীনের এ পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়ে উঠে। চীন এখন
তার বৈশ্বিক দায়দায়িত্বের ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলে থাকে এবং সেদেশের নীতিনির্ধারকেরা
এ চশমা দিয়েই চীন পৃথিবীকে দেখে।
গতানুগতিক
ধারার অর্থনীতিবিদ ও যারা বিশ্বাস করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানে উদার মূল্যবোধ গ্রহণ-তাদের
জন্য চীন এক বিস্ময়। পশ্চিমা উন্নয়নের ধারণা-যেখানে গণতন্ত্র, মুক্ত বাজার এবং উদার
মূল্যবোধ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে- চীন প্রথমেই সেগুলোকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে
এবং দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে পুরো পৃথিবী এ ধারণা সম্পর্কে অজ্ঞ রয়েছে।
গণতান্ত্রিক
শাসনব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা বিশ্বায়নে অংশগ্রহণ না করেও চীনে ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতি
ও শিল্পায়ন হয়েছে- যা ছিল সম্পূর্ণ কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত এবং উদার নীতিমালার সাথে দূরতম
সম্পর্ক বিবর্জিত। চীনের প্রেসিডেন্ট হু জিন তাও ২০০৪ সালে বলেন, 'আমরা কখনই অন্ধভাবে
অন্য দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অনুকরণ করবো না। ইতিহাস প্রমাণ করে যে নির্বিচারে পশ্চিমা
রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনুকরণ চীনের জন্য এক তিমিরাচ্ছন্ন পথ হবে'। সুতরাং একথা থেকে এটা
সুস্পষ্ট যে, চীন অদুর ভবিষ্যতে উদার নীতিমালা গ্রহণ করবে না এবং উন্নয়নের পশ্চিমা
ধারণা ছাড়াই তাদের উন্নয়ন সুনিশ্চিত হয়েছে।
জাপান
এবং জার্মানীর মত চীনও কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত অর্থনীতি নিয়ে এগিয়ে গেছে। বাজারের
সব ক্ষেত্রে রয়েছে চীনা সরকারের হস্তক্ষেপ। কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
দিয়ে চীন তার সম্পদকে একদিকে পরিচালিত করেছে এবং এটা তাকে আঞ্চলিক নেতৃত্ব বিধান করেছে
এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে
সমাজতান্ত্রিক ঘরানার হওয়ার কারণে চীন পশ্চিমাদের সহায়তা একেবারেই পায়নি। তবে তারা
দেখিয়ে দিয়েছে যে একটি স্বাধীন, আগে দেশের স্বার্থ এবং কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত নীতিমালা
অর্থনৈতিক সাফল্য এনে দেয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন