শনিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১২

ফিরাসাহ্ [অন্তর্দৃষ্টি] - মূলঃ ইবনুল কায়্যিম


بسم الله الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله

ফিরাসাহ্ হচ্ছে ধীশক্তির অনুভব, উপলব্ধি ও অন্তর্দৃষ্টি।

আল্লাহ্ তাআলা বলেন:

إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَاتٍ لِّلْمُتَوَسِّمِينَ

অর্থঃ নিশ্চয় এতে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।“ [সুরা হিজরঃ ৭৫]

এবং لِّلْمُتَوَسِّمِينَ এর অর্থ, এখানে কিছু প্রখ্যাত তাফসীরবিদদের মতামত উল্লেখ করা হলো:

মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ্ বলেন, এটা হচ্ছে যারা ধীশক্তির অধিকারী

ইবনু আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহুমা বলেন, এর অর্থ হচ্ছে যারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে।কাতাদাহ্ রহিমাহুল্লাহ্ বলেন, এর অর্থ হচ্ছে যারা শিক্ষা গ্রহণ করে।

মুতাকিল রহিমাহুল্লাহ্ বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, “যারা চিন্তাশীল

এখানে, সকল ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে তেমন কোন মতপার্থক্য কিংবা বাহ্যিক অসামন্জস্যতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যেমন-কেউ যদি যারা আল্লাহ্র রাসূলকে অস্বীকার করেছিল তাদের ধ্বংসস্তুপ এবং আবাস দেখে, তবে সে অন্তর্দৃষ্টি, সতর্কবাণী এবং চিন্তার খোরাক খুঁজে পাবে।

আল্লাহ্ সুবহানাহু তাআলা মুনাফিকদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:

وَلَوْ نَشَاء لَأَرَيْنَاكَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُم بِسِيمَاهُمْ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِي لَحْنِ الْقَوْلِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ أَعْمَالَكُمْ

অর্থঃ আমি ইচ্ছা করলে আপনাকে তাদের সাথে পরিচিত করে দিতাম। তখন আপনি তাদের চেহারা দেখে তাদেরকে চিনতে পারতেন এবং আপনি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদেরকে চিনতে পারবেন। আল্লাহ তোমাদের কর্মসমূহের খবর রাখেন।“ [সুরা মুহাম্মদঃ ৩০]

এখানে, যে বিষয়টি প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলো চোখের ফিরাসাহ্ [অন্তর্দৃষ্টি] এবং দ্বিতীয় যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে কর্ণকুহরের এবং শ্রবণশক্তির ফিরাসাহ্। তাদের কথার ভঙ্গি যা মূলতঃ দুই ধরনের। যার একটি ভাল, অপরটি মন্দ।

এখানে যথার্থ কিংবা ভাল কথার ভঙ্গি বলতে হয়তো বুঝানো হয়েছে যেমনটি হাদীসে বর্ণিত আছে: এবং হয়তো তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অন্যদের তুলনায় তাদের দাবীতে বেশী বাগ্মী” [বুখারী এবং মুসলিম]; অথবা এটা দ্বারা পরোক্ষ উল্লেখ কিংবা নির্দেশ বুঝানো হয়েছে। আর মন্দ কথা বলার ভঙ্গি হচ্ছে যার মধ্যে ব্যাকরণগত অশুদ্ধি রয়েছে। এর ব্যবহার দ্বারা লোকজনের ভুল ব্যাখ্যার তাড়না অথবা গোপন কোন অর্থ খোঁজার প্রয়াস থাকে; যা হয়তো উদ্দেশ্য করা হয়নি।

এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্ তাআলা তার রাসূলকে [صلى الله عليه وسلم] নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি তাদেরকে তাদের বাচনভঙ্গি দেখে চিনতে পারবেন। একজন বক্তা আর তার অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে; বাহ্যিক অবয়বের চেয়ে তার বক্তব্য এবং তার কন্ঠস্বর দ্বারা জানার সম্ভাবনা বেশী। ভাষ্য এবং কন্ঠস্বর দ্বারা বক্তার উদ্দেশ্য অনেক বেশী প্রকাশ পায় , বাহ্যিক উপস্হিতির চেয়ে। ফিরাসাহ্ [অন্তর্দৃষ্টি] দর্শন কিংবা শ্রবণের হতে পারে।

এটা বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল  [صلى الله عليه وسلم]  বলেন:

বিশ্বাসীদের অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে সতর্ক হও, কেননা সে আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্যোতি দ্বারা দেখে। এরপর তিনি আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন: নিশ্চয় এতে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।” [তিরমিযী]। বিশ্বাসীদের ফিরাসাহ্ সবসময় সত্য হয়।

ফিরাসাহ্ হচ্ছে আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্যোতি যা তিনি তার বান্দার অন্তরে প্রবিষ্ট করান। এই জ্যোতি দ্বারা তার বান্দা সত্য-মিথ্যার এবং ভাল-মন্দের পার্থক্য নিরুপণে সমর্থ হন।

প্রকৃতপক্ষে, ফিরাসাহ্র স্বরুপ হলো কোন তীক্ষ্ন চিন্তা অন্তরে প্রবেশ করা এবং মতামতের উপর তা প্রবলতর হওয়া। এটা অন্তরের উপর এত বেশী প্রভাব বিস্তার করে যেভাবে সিংহ তার শিকারের উপর। এজন্য আরবীতে ফিরাসাহ্ আর ফারিসাহ্র মিল দেখুন। ভাষাগতভাবে, ফারিসাহ্ হলো বস্তু আর ফিরাসাহ্র সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে ওয়াইলাইআহ্ [কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা], ইমারাহ্ [কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ] এবং সিয়াসাহ্ [প্রশাসন এবং নেতৃত্ব] এর সাথে।

ফিরাসাহ্র প্রখরতা নির্ভর করে ঈমানের প্রখরতার উপর। প্রখর ঈমানের একজন ব্যক্তির ফিরাসাহ্ প্রখর হয়। আমর বিন নুযাইদ বলেন, শাহ আল-কিরমানির ফিরাসাহ্ ছিলো খুবই প্রখর এবং কখনো ভুল ছিল না। তিনি আরো বলতেন, যে ব্যক্তি তার দৃষ্টি সংযত করবে, নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকবে, নিজের অন্তঃকরণকে গড়ে তুলবে মুরাক্বাবাহ্ [আল্লাহ্ সর্বদ্রষ্টা : এই উপলব্ধি থাকা], তার বাহ্যিক অবয়বকে সুন্নাহ্ দ্বারা এবং নিজেকে হালাল ভক্ষণে অভ্যস্থ করে; তার ফিরাসাহ্ কখনো ভুল হবার নয়।

আবদুল্লাহ্ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন: তিনজন লোকের ফিরাসাহ্ সবচেয়ে তীক্ষ্নতম। যে মিশরীয় ইউসুফ আলাইহি সালাম কে খরিদ করেছিল আর তার স্ত্রীকে বলেছিল, “একে সম্মানে রাখ। সম্ভবতঃ সে আমাদের কাজে আসবে অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করে নেব।“[সুরা ইউসুফ: ২১]। অন্যজন হলেন শোয়াইব তণয়া, যে তার পিতাকে মুসা আলাইহি সালাম সম্পর্কে বলেছিল, “একে বরং তুমি (তোমার) কাজে নিয়োগ করো। [সুরা কাসাস: ২৮]এবং আবু বকর, কেননা তিনি উমারকে তার উত্তরসূরী নিযুক্ত করেছিলেন।

অন্য বর্ণনায় যুক্ত হয়েছে, ফিরআউনের স্ত্রীর কথা যিনি মুসা আলাইহি সালাম সম্পর্কে বলেছিলেন:এ শিশু আমার ও তোমার চক্ষু শীতলকারী [হবে], তাকে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।[সুরা কাসাস: ৯]

আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু আনহু ই এই উম্মাহ্র সর্বোত্তম ফিরাসাহ্র অধিকারী এবং উমার রাদিআল্লাহু আনহু কে দ্বিতীয় হিসেবে ধরা হয়। উমার রাদিআল্লাহু আনহুর ফিরাসাহ্র উদাহরণ অনেক, পরিচিত আর সর্বজনবিদিত। তিনি কখনো কিছু সম্বন্ধে বলেননি, “আমার মনে হয় এটা এমন…” বরং এটা ছিল তার চিন্তার প্রতিফলন। বাস্তবিক পক্ষে, কুরআনে তার মতের স্বপক্ষে অনেক ঘটনাকে সত্যায়িত করেছে। এর মধ্যে একটি হলো বদর যুদ্ধের যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে।

একদা সাওয়াদ বিন কারিব নামে এক ব্যক্তি উমার রাদিআল্লাহু আনহুর সামনে হেটে গেল এবং তিনি তাকে চিনতেন না। উমার রাদিআল্লাহু আনহু বললেন: হয় সে গণক অথবা জাহিলিয়্যাহয় সে গণক ছিলো।উমার রাদিআল্লাহু আনহুর সামনে বসার পূর্বে, সাওয়াদ বলেন: ও আমিরুল মুমিনীন! আপনি কখনো আপনার অতিথিদের এভাবে স্বাগত জানান না; যেভাবে আমাকে জানালেন। উমার বললেন, “আমরা জাহিলিয়্যাহয় এর চেয়ে মন্দ কাজ করতাম। কিন্তু আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার সম্পর্কে বল।সাওয়াদ বলেন: আপনি সঠিক ছিলেন, ও আমিরুল মুমিনুন! আমি জাহিলিয়্যাহয় গণক ছিলাম, এরপর তিনি তাকে তার গল্প বললেন।

স্বাভাবিকভাবেই, সাহাবারাই ছিলেন সবচেয়ে তীক্ষ্ন আর নির্ভুল ফিরাসাহ্র অধিকারী। সত্য ফিরাসাহ্ অর্জিত হয় জীবন থেকে এবং আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্যোতি দ্বারা; যা তিনি তার অনুগত বান্দাদের যাকে খুশি প্রদান করেন। হৃদয় প্রাণশক্তি লাভ করে এবং আলোকিত হয়; অতঃপর এর ফিরাসাহ্ প্রায় নির্ভুল হয়।

আল্লাহ্ তাআলা বলেন:

أَوَ مَن كَانَ مَيْتًا فَأَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهُ نُورًا يَمْشِي بِهِ فِي النَّاسِ كَمَن مَّثَلُهُ فِي الظُّلُمَاتِ لَيْسَ بِخَارِجٍ مِّنْهَا كَذَلِكَ زُيِّنَ لِلْكَافِرِينَ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ

আর যে মৃত ছিল অতঃপর আমি তাকে জীবিত করেছি এবং তাকে এমন একটি আলো দিয়েছি, যা নিয়ে সে মানুষের মধ্যে চলাফেরা করে। সে কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে, যে অন্ধকারে রয়েছে-সেখান থেকে বের হতে পারছে না? এমনিভাবে কাফেরদের দৃষ্টিতে তাদের কাজকর্মকে সুশোভিত করে দেয়া হয়েছে[সুরা আল-আনআম: ১২২]

এই আয়াহ্য় ব্যক্তিকে মৃতবলা হয়েছে তার অন্তরের অবিশ্বাস এবং তার দ্বারা যাপিত অজ্ঞতাপূর্ণ জীবনকে কিন্তু তারপর আল্লাহ্ তাকে জীবন দান করলেন তাকে ঈমানের জ্ঞান দান করে। আর এই উপহারসমুহ লাভের মাধ্যমে কুরআন আর ঈমান তার আলোকবর্তিকা হয়, যা দ্বারা সে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার পাথেয় লাভ করে এবং সরলপথ প্রাপ্ত হয়।

ফিরাসাহ্র সাথে তিনটি মানব-অঙ্গ সম্পর্কযুক্ত: চোখ, কান এবং অন্তর। তার চোখ বাহ্যিকতা আর নিদর্শনসমুহ পরীক্ষণ করে, তার কর্ণ পরীক্ষণ করে ভাষ্য, অতিশয়োক্তি, তির্যক অনুমান ও ইঙ্গিত, সারমর্ম, যুক্তি এবং কন্ঠস্বর। এবং তার অন্তর পর্যালোচনা করে দৃশ্য এবং শ্রাব্য উপাত্তসমুহ যা দ্বারা অন্যের লুকায়িত চিন্তার উপলব্ধি লাভ করে। তার অন্তর্নিহিত পর্যালোচনা এবং পরীক্ষণ বাহ্যিকতার সাথে তুলনার স্বরুপ যেভাবে মুদ্রার বাহ্যিকতা দেখে তা নকল কিনা পরীক্ষণের মত। এটার অন্য স্বরুপ হলো হাদীস-বিশারদদের ভাল সনদের একটি হাদীস পাঠের পর হাদীসের শব্দচয়ন [মতন] পরীক্ষণে হাদীস জাল প্রমানিত হওয়ার মত।

ফিরাসাহ্র ক্ষেত্রে দুটো ব্যাপার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে স্মৃতিশক্তির প্রখরতা, অন্তরের সূক্ষ্নদর্শীতা আর বোধশক্তি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে নিদর্শণের উপস্হিতি আর অন্যের উপর এর নির্দেশিকা। যখন উভয় গুণের সমন্বয় ঘটে তখন কারো ফিরাসাহ্ ভুল হয় না। ইয়াস্ বিন মুয়াউইয়াহ্র প্রখর ফিরাসাহ্ ছিলো এবং তিনি এর জন্য সুপরিচিত, এরুপ ইমাম শাফিঈ ও যার ফিরাসাহ্র উপর লেখনীর বর্ণনা পাওয়া যায়।

[প্রবন্ধের সমাপ্তি এখানেই]

আল্লাহ্ তা'আলা আমাদেরকে অনুধাবন করার তাওফীক দিন।

سبحانك اللهم و بحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك و أتوب إليك

[অনুবাদকর্মের শব্দচয়ণে দুর্বলতা, ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

[মূল: ইবনুল কায়্যিম এর একটি প্রবন্ধ থেকে অনুদিত]

সায়্যিদ মাহমুদ গজনবী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন