রবিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

বিশ্বব্যাপী পূঁজি বাজারের ধস, পূঁজিবাদের ব্যর্থতা এবং খিলাফতের সমাধান


বিশ্ব অর্থনীতি পতনের ঘটনা প্রবাহ : বর্তমান বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সমস্যার কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরা হলো :

৪ এপ্রিল ২০০৭:
নিউসেঞ্চুরী লিমিডেট নামের মার্কিন সাব-প্রাইম মর্গেজ ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণা।
মে- ২০০৭:
এক মাসের মধ্যে প্রায় ২৫টি সাব-প্রাইম মর্গেজ ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ে।
মে-২০০৭:
এর এক সপ্তাহের মাঝে আর্থিক বাজারের মোট ক্ষতির পরিমান দাড়ায় প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার।
জুন-২০০৭:
শুরু হয় তারল্য সংকট এবং ঋণ প্রদান বন্ধ করে দেয় অনেক ব্যাংক। একেই বলা হয় credit crunch
ফেব্রুয়ারী-২০০৮:
Citi Group Credit মার্কেটে loss করে প্রায় ৪০.৭ বিলিয়ন ডলার, HSBC ব্যাংক এর ক্ষতির পরিমান ১৫.৫ বিলিয়ন, Merrill Lynch এর ক্ষতির পরিমান দাড়ায় ৩১.৭ বিলিয়ন।
মার্চ- ২০০৮:
বৃটেনের পঞ্চম বৃহত্তম ব্যাংক Northern Rock দেউলিয়া ঘোষিত হয়।
সেপ্টেম্বর-২০০৮:
১৮৪ বছরের পুরানো পঞ্চম বৃহত্তম মার্কিন ব্যাংক Lehman Brothers দেউলিয়া ঘোষিত হয়।
সেপ্টেম্বর-২০০৮:
বিশ্বের সবচে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠা AIG Group দেউলিয়ার কবলে পড়ে এবং মার্কিন সরকার ৮০% মালিকানা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করন করে নেয়।
সেপ্টেম্বর-২০০৮:
আইসল্যান্ডের/আয়ারল্যান্ডের প্রায় সমস্ত ব্যাংক জাতীয় করন করা হয়।
সেপ্টেম্বর-২০০৮:
৭৪০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন এবং ৫০০ বিলিয়ন পাউন্ডের বৃটিশ rescue plan অনুমোদন হয়।
সেপ্টেম্বর-২০০৮:
শেয়ার বাজারের দর পতন অব্যাহত থাকে। ইউরোপ, এশিয়া ও মার্কিন শেয়ার বাজারগুলো এক বছরে প্রায় ৩০-৪০% সম্পত্তি হারিয়ে ফেলে।
সেপ্টেম্বর-২০০৮:
সারা বিশ্বে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী মহামন্দার সূচনা।

ভূমিকা :

বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েল ষ্টেট সেক্টরে যে সংকট দেখা দিয়েছে এবং এর পরবর্তীতে যেভাবে সারা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট ছড়িয়ে পড়েছে তা উপরের ঘটনা প্রবাহ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান। এই প্রবন্ধে আমরা সমস্যার স্বরূপ ও প্রকৃত কারণ তুলে ধরার চেষ্টা করব এবং এই ধরণের সমস্যা, আশু খিলাফত কিভাবে সমাধান করবে তা বিস্তারিত উপস্থাপন করা হবে। এই প্রবন্ধের বেশ কিছু কন্‌সেপ্ট যেহেতু খুব বেশী টেকনিক্যাল তাই উপস্থাপনা এবং বুঝার সুবিধার জন্য পুরো প্রবনন্ধটিকে নিম্নোক্ত ভাবে সাজানো হলো।

- কিছু টেকনিক্যাল শব্দের সংজ্ঞা।

- আর্থিক সংকটের তৈরীর পেছনে কার্যক্রর প্রক্রিয়াটি এবং এতে জড়িত বিভিন্ন ধরণের বাজারের কার্যপ্রক্রিয়া বর্ণনা করা।

- পুঁজিবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সংকটের কারণ এবং সংকট উত্তোরণে পুঁজিবাদী প্রেসক্রিপশন।

- সংকটের প্রকৃত কারণের বিবরণ।

- খিলাফতের সমাধান।

- বর্তমান সংকটে আমাদের ভূমিকা।

১ম ধাপ : কিছু টেকনিক্যাল শব্দের সংজ্ঞা

- বাণিজ্যিক ব্যাংক (Commercial Bank) : যেসব ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ সুদের বিনিময়ে জমা নেয় এবং অধিক সুদের বিনিময়ে অন্যের কাছে তা ঋণ দেয় তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে।

- পেনশন ফান্ড প্রতিষ্ঠান : যে সকল প্রতিষ্ঠান চাকুরীজীবিদের পেনশনের টাকা জমা নেয় এবং তা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে এবং চাকুরী শেষে তা ফেরৎ দেয়।

- মিউচ্যুয়াল ফান্ড কোম্পানী     : যে সকল প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির কাছ থেকে কাগজি সার্টিফিকেট বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে।

- বন্ড বাজার    : যে বাজারে ঋণের দলিল ক্রয়-বিক্রয় হয়।

- ঝুঁকি  : ঋণ দেয়ার পর ফেরৎ না পাবার সম্ভবনা কে ঝুঁকি বলে।

- সিকিউরিটি    : এক ধরনের দলিল যার মাধ্যমে কোন কিছুর উপর আপনার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন : শেয়ার।

- জামানাতযুক্ত গৃহঋণ (Home Loan Mortgage) : কোন ব্যক্তি যদি গৃহ নির্মানের জন্য গৃহিত ঋনের (Loan) এর বিপরীত জামানত হিসাবে ঋণ দাতাকে বা ঋণদাতার পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট স্থাবর সম্পত্তি (যেমন বাড়ী, জমি ইত্যাদি) জামানত রেখে ঋণ গ্রহণ করে তাকে জামানতযুক্ত গৃহঋণ বলে।

- প্রাইম মর্গেজ বাজার (Prime-Mortgage Market) : জামানতযুক্ত গৃহঋণ গ্রহণের সময় ঋণ গ্রহীতার আর্থিক সামর্থ্য এবং ঋণ পরিশোধের সম্ভবনা ক্ষতিয়ে দেখা হয়। যেসব ঋণ গ্রহীতার ঋণ পরিশোধের আর্থিক সামর্থ্য আছে তাদেরকে বলা হয় প্রাইম কাষ্টমার (Prime Customer)এই বাজারে যেসব গৃহঋণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ দেয় তাদেরকে Prime-Mortgage Bank বলে। এক্ষেত্রে ঋনের জামানত হিসাবে ঐ বাড়ীটিই (যা এখনও তৈরী হয়নি) মর্গেজ ব্যাংক এর নিকট দায়বদ্ধ রাখা হয়।

- ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠান : যেসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ ঝুঁকির পরিমান নির্ধারণ করে।

- সাব প্রাইম মর্গেজ (Subprime-Mortgage Market) : সারা বিশ্বব্যাপী আমেরিকান মর্গেজ বাজারের পতন যে ভয়বহ অর্থনৈতিক সংকট তৈরী করেছ তার মূলে রয়েছে সাব প্রাইম মর্গেজ বাজার (Subprime-Mortgage Market)

খুব সহজ ভাষায়, যেহেতু ঋণ পাবার জন্য ঋণগ্রহীতার আর্থিক অবস্থার মূল্যায়ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ শর্ত, তাই যখন কোন ব্যক্তির গ্রহণযোগ্য পরিমান আর্থিক অবস্থা না থাকে তখন সে ব্যক্তি প্রথম শ্রেণীর প্রাইম মর্গেজ ব্যাংক সমূহ হতে ঋণ পায় না। যখন মার্কিনীদের মাঝে সকল প্রাইম কাষ্টমাররা মর্গেজ ঋণ নিয়ে নিল তখন এ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে স্থবিরতা চলে আসল। সেই সময় কম অবস্থা সম্পন্নদের জন্য সাব-প্রাইম মর্গেজ ব্যাংক সমূহ ঋণ প্রদান শুরু করে। প্রায় ২৫% মার্কিন জনগণ এই ধরনের কম অবস্থা সম্পন্ন আয়ের মানুষ। এটি একটি বিশাল বাজার। ফলে বেশীর ভাগ সাব প্রাইম মর্গেজ ব্যাংক এ ধরনের লোকদের কাছে ঋণ দিতে থাকে। যার বিনিময়ে জামানত হলো ভবিষ্যতে তৈরী বাড়ীটি।
 
- নিলাম কৃত সম্পত্তি বাজার : যদিও এই ধরণের ঋণ খুব বেশী ঝুঁকিপূর্ণ, তারপরও এই ব্যাংকগুলো এই ধরনের ঋণ প্রদান অব্যাহত রাখল এই যুক্তিতে যে, যদি ঋণ গ্রহীতা ঋণ প্রদান ব্যর্থ হয়, তবে ব্যাংকগুলো জামানতকৃত বাড়ী বিক্রি করে এই ঋণ আদায় করবে। এই ধরণের বাড়ী বিক্রি করার জন্য আমেরিকায় রয়েছে নিলাম কৃত সম্পত্তি বাজার।

২০০৭ সালের দিকে এই ধরনের বাজারে প্রদান করা ঋণের পরিমান দাড়াল ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। যা মার্কিন জিডিপির (GDP) প্রায় এক-দশমাংশ। এভাবেই Subprime-Mortgage Bank গুলো আরো বেশী মুনাফা করার জন্য ঝুঁকির পরিমাণ চিন্তা না করে বিনিয়োগ করতে থাকলো।

- মর্গেজ বেকড বন্ড (Mortgage Backed Bond) : পশ্চিমা অর্থব্যবস্থা বর্তমান সংকট যে কারণে এত প্রকট হয়েছে তার মূলে রয়েছে এই বন্ড। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একটি সাব-প্রাইম মর্গেজ ব্যাংক কয়েকজনকে গৃহঋণ দিয়েছে। যার বিপরীতে জামানত হল নির্মিতব্য গৃহটি এবং ধরা যাক সব মিলিয়ে ঋণ দিয়েছে ২ কোটি ডলার। এখন মরগেজ ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটি এই ঋণের বিপরীতে মাসিক বা ত্রৈমাসিক বা অর্ধ-বাৎসরিক বা বাৎসরিক কিস্তি পাবে। যার মাধ্যমে ঋণ আদায় হবে। এখন প্রতিষ্ঠানটি আরো বেশি অর্থ বিনিয়োগ করার জন্য এই প্রাপ্য কিস্তির (ভবিষ্যতে পাবার) বিপরীতে অন্যের কাছ থেকে (যেমন: প্রাইম মর্জেগ ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক ব্যাংক ইত্যাদি) কাছ থেকে বিভিন্ন ঋণ দলিল বিক্রি করে আরো ঋণ গ্রহণ করল। আর এই নতুন ঋণপত্র ক্রেতাকে মর্গেজ লোন থেকে প্রাপ্ত কিস্তি হতে সুদ প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেয়।। এর ফলে ঋণ কিস্তি একটি ক্রয় বিক্রয়ের সামগ্রী হয়ে পড়ল। একেই বলা হয় মর্গেজ বেকর্ড বন্ড (Mortgage Backed Bond)

২য় ধাপ : আর্থিক সংকটের তৈরীর পেছনে কার্যক্রয় প্রক্রিয়া এবং এতে জড়িত বিভিন্ন ধরণের বাজারের কার্যপ্রণালী  
                              
২.১ বুদ্ধিমান (?) মার্কিনীদের ঋণ বিক্রি :

আমরা হয়তো একটু আশ্বার্যই হব যে, বুদ্ধিহীন মার্কিনীরা বা সমগ্র পাশ্চাত্য সভ্যতা তাদের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক দর্শন, মুনাফা অর্জনের জন্য কি না করে থাকে। আশ্চর্য্য তাদের কৌশলসমূহ। তবে এখানে আমরা তাদের ঋণ বিক্রির (অপ) কৌশল দেখব।

সাব-প্রাইম মর্গেজ বাজার যেহেতু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং একই সাথে বেশি লাভজনক তাই, বড় বড় ব্যাংকগুলো (বলা হয় Wall Street Banks) এই জায়গায় বিনিয়োগ করার নানান রকম উপায় বের করল। যার মাধ্যমে তারা আরো বেশি অর্থায়ন এবং এর ফলে আরো বেশি মুনাফা করার সুযোগ পেল। এই উপায়গুলো হলো বিভিন্ন প্রকার মর্গেজ সিকিউরিটির উদ্ভাবন। বিভিন্ন ধরনের মর্গেজ সিকিউরিটির মাঝে Mortgage Backed Bond, Mortgage Pay-through Securities, Collateralized Mortgage Obligation Mortgage Backed Bond ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক ব্যাংক (মানুষের সঞ্চয় কৃত অর্থ) মিচুয়্যাল ফান্ড প্রতিষ্ঠান (সাধারণ মানুষের বিনিয়োগকৃত অর্থ), প্যানশান ফান্ড প্রতিষ্ঠান (চাকুরী জীবিদের প্যানশনের কিস্তির অর্থ), বীমা প্রতিষ্ঠান (সাধারণ মানুষের বীমা পলিসির কিস্তি হতে প্রাপ্ত অর্থ) এই মর্গেজ বেকর্ড বন্ড (Mortgage Backed Bond) ক্রয় করতে থাকে। এর মাধ্যমে এই বাজারে আরো বেশি অর্থায়নের সুযোগ তৈরী হলো।

শুধুমাত্র এই ধরণের মার্কিন প্রতিষ্ঠানই নয় বরং ইউরোপ, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যে, প্রাচ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই ধরণের ঋণপত্রে বিনিয়োগ শুরু করলো। লক্ষ্যনীয় যে, যে সকল প্রতিষ্ঠান এই মর্গেজ বন্ড কিনছে তারা মোটেও জানতে পারছে না যে, মার্কিন এই মর্গেজ ব্যাংকগুলো কোথায়, কি পরিমানে এবং কত ঝুঁকিতে তাদের অর্থ বিনিয়োগ করছে। আর কতইবা এই মর্গেজ বাজারের প্রকৃত ঝুঁকির পরিমান। Credit Rating প্রতিষ্ঠান সমূহ মর্গেজ ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপকদের যোগ সাজসে এই সেক্টরের বিনিয়োগ ঝুঁকির পরিমান প্রকৃত ঝুঁকির পরিমান থেকে কম বলে রির্পোট বের করতে থাকল।

সাধারণ মানুষ, যারা বীমা প্রতিষ্ঠানে টাকা দেয় বীমা পলিসীর জন্য, যারা পেনসন ফান্ড কোম্পানীতে মাসিক কিস্তি দেয় বৃদ্ধ অবস্থায় পেনসন পাবার জন্য, যারা ব্যাংকে টাকা জমা দেয় ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সমস্যা হতে মুক্ত থাকার জন্য, তাদের পক্ষে এই সব বিনিয়োগের ঝুঁকি জানা একদমই অসম্ভব।

২.২ Farnic Mae & Faddie Mac এর ভূমিকা (SWAP এর উদ্ভব):

যেহেতু সাব প্রাইম ব্যাংকের ইস্যুকৃত মর্গেজ বেকর্ড বন্ড ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, Federal National Mortgage Association বা সংক্ষেপে Fannie Mac/FNMA এই ঝুঁকির পরিমান কমানোর জন্য এই সব ঋণ পত্রের বিনিময় গ্যারান্টি প্রদান করে নতুন ঋণপত্র বিক্রি শুরু করে। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় Credit SWAPযেহেতু Fannie Mac একটি মার্কিন সরকারী প্রতিষ্ঠান, যা বাংলাদেশের House Building Finance Corporation (BITBFC) এর মত, তাই এই প্রতিষ্ঠানটির গ্যারান্টির বিপরীতে ইস্যুকৃত মর্গেজ বেকর্ড বন্ড আস্তে আস্তে বাজারে জনপ্রিয় হতে থাকলো। ২০০৭ সালে এই বাজারের মোট মূল্য দাড়ায় ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এখানে লক্ষ্যনীয়, যে প্রতিষ্ঠানটি এই গ্যারান্টি প্রদান করলো তার নিজের আর্থিক অবস্থাই নাজেহাল। ২০০৭ সালের মোট সম্পত্তির পরিমান ৮৮২.৫ বিলিয়ন ডলার অথচ নিজস্ব মুলধন হল মাত্র ৪৪ বিলিয়ন ডলার। এইভাবেSWAP এর মাধ্যমে Fannie Mac প্রাইভেট মর্গেজ ব্যাংকগুলোকে আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসা করার জন্য উৎসাহিত করলো।

তাছাড়াও শেয়ার বাজার, বন্ড বাজার, বিভিন্ন ধরণের ঋণপত্র, margin trading, ডোরভেটিবস ও হেজ্‌ফান্ড ইত্যাদি জটিল কাগুজে সম্পত্তির মাধ্যমে এই সেক্টরে প্রকৃত সম্পত্তির মূল্যের তুলনায় অধিক হারে ঋণ ক্রয়-বিক্রয় শুরু হলো। ২০০৭ সালে এ বাজারের পরিমাণ ছিল ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ এর বিপরীতে অধিক পরিমান ঋণ বিক্রির ফলে ঋণ বাজারের পরিমান দাঁড়ায় ৫১ ট্রিলিয়ন ডলার, শেয়ার বাজারের পরিমান দাড়ায় ৪৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং এসবের বিপরীতে ডেরিভেটিব্‌স বাজারের পরিমান ছিল ৫০০ ট্রিলিয়ন ডলার। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সেই একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের কোন ব্যক্তির একটি বাড়ী তৈরীর বিষয়কে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক ব্যাংক, মর্গেজ ব্যাংক, সাব-প্রাইজ মর্গেজ ব্যাংক নিলামে বাড়ী বিক্রির বাজার, পেনশন ফান্ড, মিউচুয়্যাল ফান্ড, লিজিং ফার্ম, বীমা প্রতিষ্ঠানসহ সবাই কিভাবে ব্যবসা করছে। আর সুদ হচ্ছে এই সমস্ত ব্যবসায়ের পণ্য।

২.৩ আর্থিক বাজারে ধসের প্রক্রিয়া ও প্রভাব:

এই ভাবে যখন বিভিন্ন ধরণের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সাব-প্রাইম মর্গেজ বন্ড ও এর বিপরীতে তৈরী হওয়া বিভিন্ন ডেরিবেটিবস-এ বিনিয়োগ শুরু করলো তখন মর্গেজ এবং সাব-প্রাইম মর্গেজ ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার পরিমাণ বেড়ে গেল। যেসব মর্গেজ ব্যাংক গৃহঋণ দিল তারা ভবিষ্যতে এই বাড়ীর মূল্য কয়েকগুণ বাড়বে এই চিন্তায় ঐ পরিমান ঋণের দলিল ইস্যু করতে থাকলো। এই ভাবে বাজারে মর্গেজ বন্ড ও অন্যান্য ঋণপত্রের পরিমাণ বেড়ে গেল। অন্যদিকে জর্জ ডব্লিউ বুশের গত ৮ বছরের জঘণ্য অর্থনৈতিক ও বৈদিশিক নীতির কারণে সাধারণ মার্কিন জনগণের পক্ষে সময়মত গৃহ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ল।

মার্কিন অর্থনীতি ধ্বংসের প্রথম লক্ষণ দেখা গেল যখন ২রা এপ্রিল ২০০৭ সালে নিউ সেঞ্চুরী লিমিটেড নামের সর্ববৃহৎ সাব-প্রাইম মর্গেজ ব্যাংকে দেউলিয়া ঘোষিত হল। এক মাসের মধ্যে প্রায় ২৫টি সাব-প্রাইম ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষিত হল। আর যখন এক সাথে অনেকগুলো মর্গেজ ব্যাংক দেউলিয়া হলো তখন নিলাম বাজারে বাড়ী বিক্রির পরিমান বেড়ে গেল। ফলে দ্রুত এসব বাড়ীর দাম কমতে শুরু করলো। অন্যদিকে যেহেতু আর্থিক অর্থনীতির সকল সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই মর্গেজ বন্ড বাজারে বিনিয়োগ করেছিল তাই সাব-প্রাইম মর্গেজ ব্যাংকগুলোর দেউলিয়ার ফলে দ্রুত মর্গেজ বন্ডের দাম কমে গেল। শুরু হল বাজারে দরপতন। এতে করে সংকট চক্রবৃদ্ধি হারে প্রভাব ফেলতে শুরু করলো এবং যারাই এই বাজারে বিনিয়োগ করলো তারা সবাই একে একে ক্ষতির সম্মুখিন হতে শুরু করলো। একে একে ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান, হেজ ফান্ড, পেনশন ফান্ড, মিউচুয়্যাল ফান্ড, বিনিয়োগ ব্যাংক, এরা সবাই ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হয়। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে মাত্র ৭ দিনেই এই ক্ষতির পরিমাণ দাড়াল ৮০০ বিলিয়ন ডলার। এই বিক্রি বেড়ে যাবার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রাইম মর্গেজ ব্যাংকগুলোকেও ঋণ দেয়া বন্ধ করে দিল। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অন্যান্য ব্যাংককেও ঋণ প্রদান বন্ধ করে দিল। তৈরী হলো Credit Crunch

অন্যান্য দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন বুঝতে পারে তারা ইউ,ইস-এর মর্গেজ বাজারে বিনিয়োগকৃত টাকা উদ্ধার করতে পারবে না। তখন তারাও বন্ড বাজারে বিক্রি আরো বাড়িয়ে দিল। আস্তে আস্তে এর প্রভাব শেয়ার বাজারেও পড়তে থাকে। ব্যাপক হারে শেয়ার এবং Derivative securities বিক্রির ফলে একে একে বিভিন্ন বন্ড ও শেয়ার বাজারে দাম কমতে শুরু করে এবং বিভিন্ন বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাপক হারে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পশ্চিমা Central bank গুলো মাত্র ৪৮ ঘন্টা সময়ের মধ্যে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার নগদ অর্থ আর্থিক বাজারে সরবরাহের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলো। যেহেতু মর্গেজ বন্ড বাজারের পরিমান ছিল ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার, বন্ড বাজারের পরিমান ছিল ৫১ ট্রিলিয়ন ডলার, শেয়ার বাজারের পরিমান ছিল ৪৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং এসবের বিপরীতে ডেরিভেটিব্‌স বাজারের পরিমান ছিল ৫০০ ট্রিলিয়ন ডলার তাই শুরু হলো ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট। অনেক ব্যাংক দেউলিয়ার দারপ্রান্তে পৌছে যায়। যাদের মাঝে রয়েছে বৃটেনের Northern Rock, সুইজারল্যান্ডের USB, ১৮৫ বছরের পুরাতন আমেরিকান ব্যাংক Lehman Brothers.

এই সমস্যার ফলে USA, Japan, UK, Germany, France, ইটালি, অষ্টেলিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে প্রকৃত উৎপাদন কমে গেছে। মর্গেজ লোন নিয়ে করা বাড়িগুলো নিলামে উঠছে। টঝঅ-তে প্রত্যেক দশ সেকেন্ডে ১টি বাড়ী নিলামে বিক্রি হয়- যার দাম গত বছরের তুলনায় ১/৩ অংশ। বিলাস পণ্যের ভোগ কমে গেছে। USA-তে গাড়ি বিক্রি কমে গেছে প্রায় ৭৮%, দাম কমেছে প্রায় ৪০%। চীনে অনেক ফ্যাক্টরী বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ আমেরিকানরা তাদের ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশেও প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার গার্মেন্টেস বাজারের আশু পতন পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ স্টেপ্টম্বর ডিসেম্বর হল বিক্রির মৌসুম। প্রায় ৭০০ বড় বড় আমেরিকানরা নতুন অর্ডারতো দূরে থাক, পুরাতন অর্ডার গুলোও তুলে নিচ্ছেন।

৩য় ধাপ : পুঁজিবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সংকটের কারণ এবং সংকট উত্তোরণে পুঁজিবাদী প্রেসক্রিপশন

৩.১ সংকট উত্তরণে পুঁজিবাদীদের ব্যবস্থা:

এই ঘটনার পরবর্তীতে অনেকেই এই সমস্যার কারন ও সমাধান খুঁজার চেষ্টা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্ণর, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্ণর, G8 সম্মেলনের বক্তারা কারণ হিসেবে আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, হিসাব রক্ষন ব্যবস্থা ওRegulation-কে দায়ী করেছেন। যা সত্যিকার অর্থে সমস্যার মূল কারণ নয়।

তাছাড়া এই অবস্থা হতে উদ্ধারের জন্য পশ্চিমা পুঁজিবাদী সরকারগুলো সাধারণ মানুষের টাকা এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি পূরণে ব্যায় করার মত সিদ্ধান্ত নেয়। Free market economy-তে আমরা এই সিদ্ধান্ত দেখে আশ্চার্য নই। এটি তাদের আর্থিক নয় বরং আদর্শিক দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করে। ইউএসএ-তে প্রায় ৭০০ বিলিয়ন ডলারের উদ্ধার প্যাকেজ এবং ইউকে-তে প্রায় ৫৫০ বিলিয়ন পাউন্ড উদ্ধার প্ল্যান সরকার ভাবে গ্রহণ করা হয়। এর ফলে বৃটেনে জনপ্রতি প্রায় ২২০০ পাউন্ড পরিমান ঋণের বোঝা বাড়াবে। এসব উত্তরণ পরিকল্পনা সত্যিকারের কোন সমাধানতো দেয়ই নি বরং সমস্যা আরো ঘনীভূত করেছে। পরবর্তীতে আরো ৩৫০ বিলিয়ন ডলার উদ্ধার পরিকল্পনাও কোন সমাধান আনতে পারেনি। বিশ্বব্যাপী শেয়ার ও বন্ড বাজারের দরপতন আজঅব্দি অব্যহত আছে। গত ১ বছরে মার্কিনসহ সারা বিশ্বের শেয়ার বাজারের দরপতন হয়েছে গড়ে ৩৫-৪৫%।

৩.২ সংকট উত্তরণে সত্যিকার পুঁজিবাদীদের ব্যবস্থা:

এই ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে উত্তরণের উপায় হিসাবে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা সভ্যতার মোড়ল আমেরিকার রয়েছে পুরাতন ফর্মূলা। তারা নিজেরাও জানে আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, হিসাব রক্ষণ ব্যবস্থা ও Regulation-ইত্যাদির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হবে না। তাদের ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। তাদের ১৯৩০ এর অর্থনৈতিক মহামন্দা কেটেছে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা এবং পরবর্তীতে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে। ১৯৫০ এর অর্থনৈতিক সংকট কেটেছে কোরিয়ান যুদ্ধ দ্বারা। ১৯৬০ এর অর্থনৈতিক সংকট কেটেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ দ্বারা। ১৯৭০ সালের মন্দা কেটেছে সৌদি রাজা ফয়সালকে হত্যা করে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমিয়ে। ১৯৮০-র দশকের অর্থনৈতিক মন্দা কেটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ঠান্ডা যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের মাধ্যমে। ১৯৯০ এর সমস্যা কেটেছে সিনিয়র বুশের নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার প্রথম যুদ্ধ- মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রথম ইরাক যুদ্ধের মাধ্যমে এবং তারপর ২০০০ সালের সমস্যা কাটানোর চেষ্টায় রয়েছে ২য় ইরাক যুদ্ধ। পরবর্তীতে war on terror নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নব্য ক্রুসেড পরিচালনার মাধ্যমে। বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের লক্ষ্য আশু Pakistan আক্রমন, প্রক্সি-ওয়ারের মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে arm race শুরু করে। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি প্রায় ৩০ বছর পুরনো ভারতের বিরুদ্ধের অবরোধ উত্তোলণের মাধ্যমে ভারতকে nuclear fuel সরবরাহ করার পরিকল্পনা। যা ভারত-পাকিস্তানের মাঝে প্রতিযোগীতা তৈরী করবে এবং USA এর অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করবে। এছাড়াও রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমানো, যাতে করে আমেরিকানদের জীবন নির্বাহ ব্যয় হ্রাস পায়। বিষয়টি ইতিমধ্যেই ঘটতে শুরু করেছে। প্রায় ৭-৮ মাস আগে তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলারের মত, যা বর্তমানে মাত্র ৫০ ডলারে নেমে এসেছে। সর্বপরি রয়েছে আরো বেশি ডলার মুদ্রা ছাপানো কাজ। যা USA এর সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখবে এবং অন্যান্য দেশকে সমস্যায় ফেলবে। কারণ এতে করে অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখা ডলার রির্জার্ভের মূল্য কমে যাবে।

তবে লক্ষ্যনীয় যে, আজকের আমেরিকা সারা বিশ্বে সামরিক দিক থেকে একটি পরাজিত শক্তিতে পরিনত হয়েছে। পরিনত হয়েছে পরাজিত শক্তি হিসেবে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এবং সারা বিশ্বে তাদের ফেরী করা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন ভাবে অস্ত্র প্রচার হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে বর্তমান আমেরিকা আরেকটি উন্নত আদর্শিক রাষ্ট্রেও আগমনের জন্য পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

৩.৩ পুঁজিবাদী সভ্যতার আদর্শিক দেউলিয়াত্ব:

বিশ্বব্যাপী পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক এই সংকটের কারণে মানব সভ্যতার যে সংকট দেখা দিয়েছে তাতে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, হংকং, জাপান, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানী, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইটালী, ইউকে, আরব রাষ্ট্রসমূহ এবং ভারত সহ সারা বিশ্বে ব্যাপক ভাবে এ অর্থনৈতিক সংকট ছড়িয়ে পড়েছে। সকল দেশের সরকারই তাদের আর্থিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রানান্তরকর চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেমন করে একজন জুয়ারী ক্যাসিনোতে বারবার ফিরে যায় তার ক্ষতি পুরণের জন্য। ইউএসএ-ইউকে সরকার তাদের সাধারণ মানুষের করের টাকা এই ধরণের জুয়ারী আর্থিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ঢেলে যাচ্ছেন। যদিও তাদের এ উদ্ধার পরিকল্পনা কাজ করবে কিনা এ নিয়ে বির্তক আছে, তবে পুঁজিবাদের আর্দশিক মৃত্যু নিয়ে আর কোন সন্দেহ বা বিতর্ক নেই। পশ্চিমা জাতি সমূহ দশকের পর দশক বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাজার অর্থনীতি, মালিকানার স্বাধীনতা, বাজার অর্থনীতি, ইত্যাদি বিষয়গুলো সারা বিশ্বে ফেরি করে আসছে। প্রচুর বেতনভূক্ত পরামর্শক (consultant) ও তাদের প্রতিষ্ঠান ও IMF, World Bank এর মাধ্যমে তারা বেসরকারীকরণ (Privatization), মুক্তবাজার নীতিমালা, যৌথমুলধনী পাবলিক কোম্পানী এবং শেয়ার ও বন্ড বাজারের প্রসারের কাজ করে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি বাংলাদেশ কিভাবে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন : সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী ব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারীকরণ করেছে। অথচ তারা যখন নিজেদের দেশে সমস্যায় পড়েছে তখন তারা তাদের মুক্তবাজার অর্থনীতির শ্লোগান, প্রাইভেটাইজেশনে বা প্রতিযোগিতামূলক প্রেশক্রিপশনকে নিজেদের জন্য গ্রহণ করছেনা।

- USA তাদের দেশের বিখ্যাত গৃহ ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান "Fannie Mae" এবং "Faddie Mac"-কে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করেছে। বিখ্যাত ইন্সুরেন্স প্রতিষ্ঠান AIG গ্রুপকেও করা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব। এমনিভাবে তারা প্রচুর আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করেছে, যার উদাহারণ ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, জার্মানী, ফ্রান্স-এ প্রচুর পাওয়া যায়।
- পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাষট্রগুলো বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর কথা বলে, অথচ বর্তমান সমস্যা তারা তাদেররই তৈরী "Anti-competition" আইন পরিত্যাগ করে দু'টি প্রতিষ্ঠানকে একত্রে মার্জ হওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করছে। যা তাদের শিখানো "competition" আইন প্রতিযোগিতা আইন -এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী। উদাহরণ হচ্ছে, যুক্তরাজ্যের Loyads & HBOS- আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মার্জার।
- তাদের সরকারী কোষাগারে বর্তমানে আর্থিক সংকট চলছে। এই সময় করের হার ও করের ধরণ বাড়ানোর কথা ছিল যা তারা সারা বিশ্বে ফেরি করে বেড়ায়। অথচ বর্তমান সময় তরা নিজেরা নিজেদের দেশে করের হার কমাচ্ছে। যা তাদের Frudent (কৃচ্ছতাসাধন) অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধ।

এইভাবেই তাদের শুধু অর্থনৈতিক নয়, আদর্শিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ, ভবিষ্যতে যখন তাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাঠামোর দেউলিয়াত্ব বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশ পাবে তখন জনগণ তা ছুঁড়ে ফেলে দিবে।

৪র্থ ধাপ : সংকটের প্রকৃত কারণের বিবরণ

পূঁজিবাদী অর্থনীতির ব্যর্থতার সত্যিকার কারণ : বর্তমান পুঁচিবাদী অর্থনীতির ব্যর্থতার কারণ আলোচনায় এই নিবন্ধে সমস্যার মূল কারণ হিসাবে ৪টি বিষয়কে চিহ্নিত করা হলো। সমস্যার ৪টি মূল কারণ হলো-

১। সুদ ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা
২। Complex Financial Product System & Practices
৩। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গঠন প্রক্রিয়া (Corporate Structure)
৪। Currency Standard

৪.১ সুদ ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা (Interest based economy & financial system):

পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো "সুদ"। পশ্চিমা অর্থনীতির বইগুলোতে বলা হয় সুদের কারণে মানুষ ব্যাংকে সঞ্চয় করে, যা মূলধন তৈরী করে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে ফলে অর্থনীতি শক্তিশালী হয়। তাছাড়া বলা হয় যে ব্যাংক যেহেতু ব্যক্তি হতে বেশি তথ্যসমৃদ্ধ তারা বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রকল্পের মাঝে সবচেয়ে safe বা কম ঝুঁকি সম্পন্ন প্রকল্প খুব সহজেই চিহ্নিত করতে পারে এবং দেশের মূলধন সবচেয়ে বেশি কার্যকর খাতে খাটাতে পারে। অথচ তাদের সব দাবিই মিথ্যা-

ক.    বর্তমান সমস্যায় তারা কিভাবে ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার মর্গেজ বাজারের বিপরীতে Complex financial products তৈরী এবং এসব Product এর বিপরীতে আবার Derivative তৈরী (অর্থাৎ ঋণের উপর ঋণ এবং তার উপর ঋণ থাকে ইংরেজীতে বলে turbo-debt তৈরী করে) কিভাবে এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ৫০০ ট্রিলিয়ন ডলার বাজারে বিনিয়োগ করল? আর credit-rating প্রতিষ্ঠানগুলোও কি কারণে এই bubble investment এর ঝুঁকি সঠিক ভাবে নির্ধারণ করতে পারল না? তাহাল কিভাবে বলা যায় যে, সুদ ভিত্তিক ব্যাংক কম ঝুঁকিতে বিনিয়োগ করতে পারে? তাহলে কেন Northern Rock, Lehman brothers দেউলিয়া হলো। বাংলাদেশের ঋণ খেলাপীর ইতিহাস ও তাদের দাবির ভিত্তিহীনতার প্রমাণ। তাছাড়া সঠিক খাতে বিনিয়োগের অর্থ কি এই যে, আদমজীতে বিনিয়োগ না করে বসুন্ধরার মত শপিংমলে বিনিয়োগ করা?

খ.    তাদের আরো দাবি যে, সুদ ভিত্তিক ব্যবস্থার কারণে বিনিয়োগ উৎসাহিত হয়। এটিও পুরোপুরি মিথ্যা কথা। ধরুণ তাদের ব্যবস্থা মতে পূবালী ব্যাংক ঋণের উপর ১০% সুদ চার্জ করে, আর IFIC ব্যাংক চার্জ করে ১৫%। তাহলে অবশ্যই বর্তমান ব্যবস্থায় সবাই পূবালী ব্যাংক থেকে ঋণ নিবে। কারণ এতে উৎপাদন খরচ কমবে। তাহলে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি ঋণের উপর ০% সুদ ধার্য করে, তবে! এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান কি সম্ভব! প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে এই বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

গ.    তাছাড়া বর্তমান ব্যবস্থায় আমানতকৃত অর্থের উপর প্রায় ২০% রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। অন্যদিকে minimum deposit এর নামে কোটি কোটি টাকা অলস পড়ে থাকে। সুতরাং ব্যাংককে তার লাভ, আমানতকারীদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সুদ ফেরৎ দেবার জন্য ঋণের উপর অধীক হারে সুদ চার্জ করে। তাছাড়া top management এর বোনাস ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা যেহেতু বেশি বেশি মুনাফার সাথে জড়িত তাই তারা বেশি risky project এ বিনিয়োগ করার জন্য এবং আরো বেশি ঋণ বিক্রির জন্য নিচের কর্মচারীদের চাঁপ দেয়। ফলে প্রকৃত জমার বিপরীতে ঋণ আমানত সৃষ্টির মাধ্যমে ১ ডলার মূলধনের বিপরীতে কয়েকগুণ ঋণ প্রদান করা হয়। যেমন : আইন অনুযায়ী যেখানে ১ ডলার মূলধনের বিপরীতে ৩০ ডলার ঋণ প্রদান সম্ভব মার্কিন অর্থনীতিতে, তা বর্তমানে ৯৯ ডলার ঋণে এসে দাড়িয়েছে।

প্রকৃত অর্থে এটি হলো সাধারন মানুষ থেকে সুদের মূলা ঝুলিয়ে পূঁজিপতিদের টাকা হাতিয়ে নেবার উপকরণ।

৪.২  Complex Financial Products, system Practices:

বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ধ্বস একটি অনিবার্য বাস্তবাতা ছিল। কারণ লোভের বশবর্তী হওয়া এ পশ্চিমা সভ্যতা মূনাফার জন্য তাদের Financial System এ প্রচুর পরিমান Complex Financial Products, System Securities তৈরী করেছে যাতে বৈধ চুক্তির কোন শর্ত নেই।

- যেমন Margin Trading যেখানে মূলধনের কিছু অংশ ধার করে শেয়ার বা বন্ড ক্রয় করা যায়। শুধু পুঁজিপতিরাই Margin Trading এর সুযোগ পায়। ফলে শেয়ার বাজারে চাঙ্গা অবস্থায় তারা অধীকহারে মূনাফা অর্জন করতে পারে। আর দর পতন শুরু হলে তারা শেয়ার বা বন্ড বিক্রি বাড়িয়ে দেয় ফলে তাদের ক্ষতির পরিমান কমে যায় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

- Short Sale : যদি বাজারে দাম কমে তবে দাম কমার মূহুর্তে অন্যের কাছ থেকে শেয়ার ধার করে বিক্রি করে পরবর্তীতে দাম আরো কমলে তা আবার কিনে শেয়ারের মালিককে শেয়ার ফেরৎ দেয়া হবে। এর মাঝখানে এই কৌশলের মাধ্যম মূনাফা কিছু অর্জন সম্ভব। আশ্চর্য যা কোন ব্যক্তির নিজের নয় তা সে কিভাবে বিক্রি করে?

- Speculation & Hyping : কোন সাদা চামড়ার লোক এসে সংবাদ সম্মেলন করলো, যে তিনি অনেক পরিমান কোন বিশেষ বা একাধিক কোম্পানীর শেয়ার কিনবেন। পরের দিন media তা প্রচার করল। জনগণ মনে করল যেহেতু এই লোক এসব শেয়ার কিনছেন, তার মানে এসব শেয়ারের অবস্থা ভালো হবে, তারাও এই শেয়ার ক্রয় শুরু করেন ফলে বাজারে দাম বেড়ে যায়। পরবর্তীতে ঐলোক তার শেয়ারগুলী বিক্রি করে মুনাফা হাতিয়ে নেয় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পথে বসিয়ে সে বাজার ছাড়ে।

- Derivatives : এটি একটি জটিল ধরণের Financial Product যা ভবিষ্যত ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত। একটি উদাহরণের মাধ্যমে এর প্রভাব বুঝানো যেতে পারে। ২০০৭ এর শুরুতে তেলের উপর derivative সিকিউরিটির জন্য ব্যারেল প্রতি তেলের দাম বেড়ে দাড়ায় প্রায় ১৪৮ ডলার। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব ব্যবস্থা এর জন্য suffer করে। অথচ বর্তমান সংকটে এই বাজারের পতনের পর তেলের দাম ১/৩ ভাগে নেমে এসেছে।

৪.৩  Corporate Structure:

বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী অন্যতম আরেকটি কারণ হলো তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গঠণ প্রক্রিয়া। এই প্রতিষ্ঠান গঠণ হয় একটি চুক্তির মাঝে যাকে বলা হয় Article of Association I Memorandum of Association বা কোম্পানী গঠণতন্ত্র। চুক্তি অনুযায়ী যারা শেয়ার কিনে তারা প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং পরবর্তীতে তারা এ শেয়ার বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। এখানে শেয়ার ক্রেতা কোন ব্যক্তি হতে শেয়ার ক্রয়ের প্রস্তাব পাচ্ছে না, না শেয়ার বিক্রেতা শেয়ার ক্রেতা হতে বিক্রয়ের প্রস্তাব পাচ্ছে। কারণ এখানে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের লিখিত সংবিধান অনুযায়ী শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করছে কোন আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব বা স্বীকৃতি এতে নেই। তাছাড়া আপনি যে কোম্পানীর শেয়ার কিনছেন হয়তবা একজন মদ্যপ, ব্যভিচারী ও সেই কোম্পানীর শেয়ার মালিক। এখানে এ বিষয়ে কোন বাচ বিচার নাই। তাছাড়া ক্রেতা বিক্রেতার সরাসরি চুক্তি অনুপস্থিত বলে যে কেউ যে কোন তথ্য দিয়ে বাজারের দামকে প্রভাবিত করতে পারে এবং এক ধরণের জুয়াড়ি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দামের সাথে কোম্পানীর সত্যিকার উৎপাদন (Real Production) এর কোন সম্পর্ক নেই। যেমন- IPO ইস্যু করার পর বাজারে শেয়ারের দাম বাজারে যেভাবে একদিনেই ৮/১০ গুন বেড়ে যায়। সত্যিকার অর্থেই কোম্পানীর উৎপাদন ঐ পরিমান বাড়ে কি? বর্ধিত এই দামে শেয়ার ক্রেতারা যদি কোম্পানীর কাছে তাদের টাকা দাবী করে তাহলে কোম্পানী কি তা ফেরত দিবে পারবে?

তাছাড়া, কোম্পানীগুলোর দায় সীমাবদ্ধ অর্থাৎ কোম্পানীগুলো দেউলিয়া হলে ঋণদাতারা শুধু শেয়ার মূলধনের সমপরিমান অর্থ ফেরত পাবেন। আজ যদি একটি ব্যাংকের ঋণের পরিমান কয়েক হাজার কোটি টাকা হয় তারা দেউলিয়া হলে ঋণ দাতারা শুধু ঐ ব্যাংকের মূলধনের সমপরিমান (মাত্র ২৫০ কোটি টাকার মত) সর্বোচ্চ ফেরত পাবেন। অথচ তাদের নিয়মেই ক্ষুদ্র ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠানের মালিক পুরো দায় বহন করবে। তাহলে এই বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কেন তাদের সমূদয় ঋণ বহন করবে না? আমরা দেখেছি Lehman Brothers দেউলিয়া হবার পর ৪৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের বিপরীতে মাত্র ২.৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে।

সত্যিকার অর্থে বড় বড় পূঁজিপতিদের রক্ষা করার জন্যই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের ঋণের টাকায় তারা ব্যবসা করবে অথচ ফেরত দেবার সময় পুরোটা ফেরত দিতে অস্বীকার করবে। এটিই হলো পশ্চিমা অর্থ ব্যবস্থার প্রতারণা।

৪.৪ Currency Standard:

বর্তমান সমস্যার সম্ভবত সবচে বড় কারণ হল বিশ্বব্যাপী ডলার ভিত্তিক মুদ্রা ব্যবস্থা। যার ফলে সারা বিশ্বের মুদ্রাস্ফিতি বেড়ে অসম্ভব হারে। ১৯৭১ সালে নিক্সন যখন স্বর্ণমান মুদ্রা ব্যবস্থা (Gold Standard) বাদ দেয় তখন এক আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ৩৫ ডলার যা বর্তমানে ৯৫০ ডলার।

স্বর্ণমান মুদ্রা ব্যবস্থা ব্যবস্থা বাদ দেবার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ভাবে ডলারকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালায়। বিভিন্ন দেশ স্বর্ণের পরিবর্তে ডলার রিজার্ভ রেখে তাদের নিজস্ব মুদ্রা প্রচলন শুরু করে। ফলে সারা বিশ্বের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিদ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করে। প্রতিবছর USA এর Federal Reserve System প্রায় ৮ থেকে ১২% হারে ডলার ছাপানো বৃদ্ধি করে। অথচ USA এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩-৪%। আর তাই বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। তাছাড়া এই ব্যবস্থায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেহেতু টাকার বিনিময়ে নোট, চেক, ড্রাফট, ইত্যাদি ইস্যু করে টাকার মত প্রচলনযোগ্য মুদ্রা বাজারে ছাড়তে পারে ফলে অর্থনৈতিক সংকট আরো মারাত্মক আকার ধারন করে। অথচ এই সব মুদ্রার বিপরীতে কোন প্রকৃত সম্পদ জমা নেই। আজ যদি সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মার্কিন যুক্টরাষ্ট্রের কাছে ডলার জমা দিয়ে দেয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এইসব দেশকে কিছুই ফেরত দিতে পারবে না।

এছাড়া পূঁজিবাদী এই সংকটের কারণগুলোর পেছনে কিছু আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে যা এই ব্যবস্থার পতন নিশ্চিত করছে, সেগুলি হল:

- আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যক্তিকে Economic Unit বা ব্যবসায়ের পণ্য হিসাবে গণ্য করা।
- অর্থনীতির মূল সমস্যা চিহ্নিত করণে ব্যর্থতা।
- Real Economy এর পাশাপাশি কৃতিম Financial Side of the Economy চালু করা।

ক. আদর্শিক দৃষ্টি : পূজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিটি ব্যক্তিকে Economic Unit বা অর্থনৈতিক একক হিসাবে বিবেচণা করে। আর তার সমস্ত প্রয়োজনকে ব্যবসায়ের পণ্য মনে করে। মুনাফা তাদের মূল লক্ষ্য। তথাকথিত ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা তাদের মোহনীয় এক বুলিমাত্র। আর মুনাফা অর্জনের উপায় হিসাবে যে কোন প্রথাই সিদ্ধ যা বাজার ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করবে। আর অর্থনীতির basic বইগুলোতে পড়ানো হয় অর্থনীতি নীতিস্বাশ্র নিয়ে আলোচনা করেনা, তা নীতিবিজ্ঞানের কাজ। তাই মানুষের দয়া, মায়া ভালভাসা, মৌলিক চাহিদা যেমন- বাসস্থান এসবই ব্যবসায়ের পণ্য। প্রয়োজন হলে নতুন চাহিদা তৈরী করে ব্যবসা করতে হবে (যেমন- আপনি যে কোন সময় মরতে পারেন, আপনার Family-র কি হবে ইত্যাদি বলে, আপনাকে চিন্তাগ্রস্ত করে বীমা করানো)।

খ. অর্থনীতির মূল সমস্যা চিহ্নিত করণের ব্যার্থতা : পশ্চিমা পুঁজিবাদী সভ্যতা অর্থনীতি সম্পদের সল্পতাকে সবচে বড় সমস্যা মনে করে। তারা মনে করে তাদের প্রভু পৃথিবীতে তাদের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় কম সম্পদ রেখেছেন। আর মানুষদের কে দিয়েছেন অসীম অভাব এবং প্রতিটি অভাবই পূরণ করতে হবে। কারো যদি জুয়া খেলায় তাগিদ হয় তার জন্য Casino পর্যন্ত বানাতে হবে। আর বাজার ব্যবস্থা নির্ধারণ করবে কার প্রয়োজন পূরণ করার জন্য দেশের এই সীমিত সম্পদ ব্যয় করতে হবে। যে ব্যক্তি তার চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দিতে পারবেন তাই পূরণ করা হবে, চাহিদাটি যতই অদ্ভদ হউক না কেন। ধরুণ কেউ উস্কি কাটবে। তার জন্য সে যদি দাম দিতে পারে, তবে বাজার ব্যবস্থায় তাকে তা সরবরাহ নিশ্চিত করবে। মানুষের প্রয়োজনের কোন অগ্রাধিকার নেই। সাধারন মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এগুলো উৎপাদনের চাইতে যদি ফ্যাশন বা বিনোদনের জন্য সিনেমা তৈরী বেশি বেশি লাভজনক হয় তবে, তাই উৎপাদন করতে হবে। আর যেহেতু Service sector এর ক্ষেত্রে উৎপাদনের খরচ কম ও লাভ বেশি তাই আস্তে আস্তে পূঁজিবাদী অর্থনীতিগুলো Manufacturing থেকে service sector transform হতে শুরু করল। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৮০% service sector এবং service sector এর ক্ষেত্রে financial service industry হল সবচেয়ে বড়।

গ. Real economy এর পাশাপাশি কৃত্রিম financial side of the economy চালু করা : ১৯৪০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৪% লোকের নিজস্ব বাড়ী ছিল, ১৯৬০ সালে তা হয়েছে ৬২% আর বর্তমানে প্রায় ৭০% এর বেশি লোক বাড়ীর মালিক। আর এই বাড়ীর মালিকানা পাবার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণ নিয়ে। বর্তমানে প্রায় ২০% USA-র লোকের সম্পত্তি হতে দায় বেশি। আর অধিকাংশ দায়ই দীর্ঘমেয়াদী যা পরিশোধ করতে হয়ত অনেকেরই সারা জীবন পেরিয়ে যায়। আমরা যদি বৃটেনের দিকে তাকাই তবে দেখব বৃটেনের GDP হল ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার অথচ বৃটেনের জাতীয় ঋণ (National debt) হল ১১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার, USA এর ক্ষেত্রে GDP ১৩.৮ ট্রিলিয়ন ডলার, National debt ১২.৮ ট্রিলিয়ন, Service based Industry এবং বিলাসজাত পণ্য ও সেবার ব্যবহারের কারণে তাদের এই অবস্থা। সম্পদ বৃদ্ধির জন্য তারা বিভিন্ন ধরণের পুঁজি বাজারের উদ্ভব ঘটালো। অথচ শুধু Real Sector এ আমরা যা সরাসরি ভোগ করতে পারি তা উৎপাদন ও বন্টন হয়, financial sector এ হয় জুয়াখেলা। এটি কখনোই real sector এর মত কোন ভোগ করার কিছু তৈরী করতে পারে না। অথচ পুরো বিশ্বে real sector এর তুলনায় financial sector কয়েকগুণ বড়। বিশ্বব্যাপী বন্ড মার্কেটের সাইজ হল ৪৫ ট্রিলিয়ন, Stock market এর মোট সাইজ হল ৫১ ট্রিলিয়ন এবং এইসব সিকিউরিটিজের উপর নির্ভর করে গঠিত ডেরিভেটিবস বাজারের সাইজ হল ৫০০ ট্রিলিয়ন, যা মার্কিন প্রকৃত অর্থনীতির ৩০ গুন আর বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ১২ গুণ। অর্থাৎ পুরো বিশ্বকে ১২ বার বিক্রয় করা হলেও এই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়।

৫ম ধাপ : ইসলামি সমাধান

খিলাফতের সমাধান :

বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে finance বা অর্থায়নের উদ্ভাবন পশ্চিমা পূঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার তথাকথিত লালসার অর্থনীতিকে তার অনিবার্য পরিণতির দিকে ধাবিত করেছে। আজ পশ্চিমা পূঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা মৃত্যুশয্যায় শায়িত। আর এই লোভ লালসার অর্থনীতির বিপক্ষে একমাত্র টেকসই সমাধার খিলাফতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। যখন খিলাফত ব্যবস্থা ফিরে আসেব তখন খিলাফত অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাবে শরীয়াভিত্তিক নীতিমালা এবং এ নীতিমালার আঙ্গিকে প্রণীত বিভিন্ন শরীঈ নিয়ম কানুনের মাধ্যমে। আর এই শরীঈ নিয়মকানুনই পরবর্তীতে সমাজের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য পূর্ণাঙ্গ ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে। বর্তমান পূঁজিবাদী সমাজের ভয়াবহ অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব, ইসলামী অর্থনীতিতে পূরোপুরি অনুপস্থিত কারণ ইসলাম অর্থনৈতিক সমস্যাকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করে এবং সমাধাণের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী এবং একমাত্র টেকসই ব্যাপকতর ব্যবস্থা প্রণয়ন করে।

মূলনীতিমালা:

পূঁজিবাদ যেখানে অর্থনৈতিক সমস্যার মূল হিসাবে অসীম অভাব এর বিপরীতে সীমিত সম্পদ কে দায়ী করছে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের utility maximization কে ultimate লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করছে; ইসলাম তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে। ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলে রয়েছে তিনটি নীতিমালা- ক. সম্পত্তির মালিকানা, খ. সম্পত্তি ব্যবহার, গ. সম্পত্তির বন্টন ব্যবস্থা।

এই তিনটি মূলনীতির ভিত্তিতে খিলাফত রাষ্ট্র জনগণের মধ্যে অর্থনীতিক লেনদেনের বিভিন্ন নিয়মকানুন নির্ধারণ করে দেয়। নিম্নে আমরা খিলাফতের অর্থব্যবস্থার কিছু উল্লেখযোগ্য নিয়মকানুন আলোচনা করব। এর মাধ্যমে খিলাফত পশ্চিমা অর্থব্যবস্থার মত সমস্যাগ্রস্ততা হতে নিজেকে রক্ষা করবে, উপরন্ত অর্থনেতিক কর্মকান্ডের মাঝে গতির সঞ্চার করবে, জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।

প্রথমত : ইসলাম মানুষকে অর্থনৈতিক একক বা ব্যবসায়ের নিষয় মনে করেনা

যেহেতু ইসলাম মানুষকে অর্থনৈতিক একক বা ব্যবসায়ের বিষয় মনে করেনা, তাই ইসলাম মানুষের সকল সমস্যাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করা বা সব কিছু লাভ ক্ষতির দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করা নিষেধ করে। পূঁজিবাদ যেমন মানুষের বাসস্থানের বিষয়কে নিয়ে ব্যবসা করে বর্তমান পরিস্থিতি ডেকে এনেছে, ইসলাম এর পরিবর্তে কিছু বিষয়কে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসাবে সুনির্ধারিত করেছে।

রাসুল (সা) বলেন- "আদম সন্তানের তিনটি অধিকার রয়েছে, বসবাসের জন্য একটি বাড়ী, পরিধানের জন্য এক টুকরা কাপড় এবং আহারের জন্য এক টুকরা রুটি" (তিরমিজী)।

খিলাফত ব্যবস্থার জন্য এটি বাধ্যতামূলক যে, খলীফা দেশের সমস্ত জনগনের জন্য খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে। এটি খিলাফতের অর্থনীতির সবচে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাছাড়া ইসলাম যেহেতু মানুষের জৈবিক চাহিদা ও প্রবৃত্তিকে বিবেচনা করে, তাই ইসলাম এসমস্ত জৈবিক চাহিদা ও প্রবৃত্তি পূরণের বিস্তারিত নীতিমালা প্রণয়ন করে। এরই অংশ হিসেবে ইসলাম মানুষকে সম্পত্তি অর্জনের বৈধ ও অবৈধ উপায় সুনির্ধারিত করে দেয়।

সম্পত্তির অর্জনের বৈধ ও অবৈধ উপায়সমূহ : ইসলাম কাজের মাধ্যমে সম্পত্তি উপার্জনের উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর মাঝে আছে : পতিত জমি চাষাবাদ, ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে থাকা সম্পদ আহরণ, শিকার, দালালী ও কমিশন এজেন্সি, বৈধ ব্যবসা, যৌথ চাষাবাদ (Shared Cropping) ও শ্রমের মাধ্যমে। তাছাড়াও উত্তারাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ, রাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদ, বিনা শ্রমে অর্জিত সম্পদ উপার্জণের বৈধ উপায় হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। পশ্চিমা সভ্যতারমত সম্পদের লালসার জন্য যে কোন উপায়ে সম্পদ অর্জন ইসলাম নিষেধ করেছে।

ইসলাম শুধু সম্পত্তি উপার্জনের বৈধ উপায়ই বলে দেয়নি, পাশাপাশি ইসলাম সম্পত্তি অর্জনের অবৈধ উপায়ও বলে দিয়েছে। যেমন- জুয়া খেলা, সুদ, অপরাধ বা প্রতারণার মাধ্যমে সম্পত্তি অর্জন, একচেটিয়া ব্যবসা ও মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া। এর মাঝে একচেটিয়া ব্যবসা ও মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া এই দু'টি বিষয় সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা হলো।

- একচেটিয়া ব্যবসা : ইসলাম কোন ব্যাক্তিকে একটি ব্যবসায়ের মাধ্যমে সম্পদ অর্জনকে সম্পূর্ণ রূপে নিষেধ করেছে। সাদ ইবনে আল-মুসাঈব, মুয়াম্মার ইবনে আবদুল্লাহ আল-আদওয়াই হতে বর্ণনা করেন যে রাসুল (সা) বলেন "অপরাধী ছাড়া আর কেহই বাজারকে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে আনেনা"। (বুখারী)

উল্লেখ্য যে, একচেটিয়া হিসাবে গণ্য হতে হলে শর্ত হল এই যে, ক্রেতারা ঐ প্রয়োজনীয় দ্রব্যটি অতিরিক্ত দামের কারণে ক্রয় করতে পারছেনা। এখন সে এটি নিজে উৎপাদন করুক বা ক্রয় করে জমা করুক। একজন একচেটিয়া ব্যবসায়ী কোন পণ্য জমা করে তার ইচ্ছামাফিক পণ্যের দাম চার্জ করে এবং ক্রেতাকে বাধ্য করে ঐ দামে পণ্যটি ক্রয় করার কারণ ঐপণ্যটি অন্য কোথায়ও পওয়া যাবেনা। মাকাল ইবনে ইয়াছার হইতে বর্ণিত রাসুল (স) বলেন, যে ব্যক্তি মুসলামনদের কাছ থেকে ছড়ামূল্য আদায় করে আর এর ফলে তার সম্পত্তির পরিমান বেড়ে যায়, আল্লাহ তাকে বিচারের দিন জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলাকে সুনির্ধারিত করে রাখেন।

- মূল্য নির্ধারন : আবু সাঈদ হতে বর্ণিত রাসুল (সা) বলেন লেনদেন হবে ক্রেতা বিক্রেতার সম্মতিতে (ইবনে মাজা) আর তাই ইসলাম ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ হারাম করেছেন। আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত "রাসুল (সা) এর সময় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়, সুতরাং সাহাবীরা মূল্য নির্ধারণের জন্য বললেন। রাসুল (সা) বলেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা, তিনি রিজিক দাতা আর তিনিই মূল্য নির্ধারক। তিনি আরো বললেন, আমি আশা করি, আমি আল্লাহ (সুত্তার) সম্মুখে দাড়াই এমতাবস্থায় যে, কেউই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন না, যে আমি তাদের প্রতি অন্যায় করেছি না রক্তের বিষয়ে না সম্পত্তির বিষয়ে (ইমাম আহমদ)। এমনকি দুর্ভিক্ষের বছরও ওমর ইবনুল খাত্তাব হিজাজে মূল্য নির্ধারণ করেনি বরং মিশর ও সিরিয়া হতে পণ্য দ্রব্য হিজাজে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত : ইসলাম কাগজী মুদ্রা ব্যবস্থার পরিবর্তে দ্বি-ধাতু মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলন করে

ইসলামি খিলাফতের অর্থব্যবস্থা অর্থ প্রচলন করবে স্বর্ণ ও রোপ্য এই দ্বি-ধাতুকে বাইতুল মালে জমা রাখার মাধ্যমে। ইসলাম অর্থের একক হিসাবে স্বর্ণ ও রোপ্যকেই শুধু গ্রহণ করবে এবং বর্তমান কাগুজে মুদ্রা ডলারকে ভিত্তি করে অর্থ প্রচলণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করবে।

কারণ রাসুল (সা) যখন যাকাত সংগ্রহ করতেন বা কোন ট্যাক্স ধার্য্যকরতেন এবং কারোর উপর জরিমানা আরোপ করতেন, এসবই তিনি পরিমাপ করতেন স্বর্ণ ও রোপ্যের ভিত্তিতে। যার ফলে খিলাফত ইচ্ছামত কাগজ ছাপিয়ে দেশে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করবেনা বা করতে পারবেনা। কারণ যে কোন পরিমান মুদ্রা প্রচলন এর বিপরীতে বাইতুল মালকে স্বর্ণ বা রোপ্য জমা রাখতে হবে এবং জনগণ যদি চায় যে কোন সময় কাগুজে মুদ্রা জমা দিয়ে স্বর্ণ বা রৌপ্য উত্তোলণ করে নিতে পারবে। অর্থাৎ খিলাফত ব্যবস্থায় যে কোন পরিমান অর্থ সরবরাহ কোন প্রকৃত সম্পত্তির বিপরীত হতে হবে। বর্তমানে আমেরিকা যে ডলার ছাঁপছে তার বিপরীতে কোন প্রকৃত সম্পত্তিই জামানত নেই, এটি শুধুই ফাঁকা। জনগণের হাতে যে ডলার আছে, তা যদি তারা জমা দিতে চায় এই পূঁজিবাদী মার্কিন সরকার এর বিপরীতে কোন প্রকৃত সম্পত্তিই ফেরত দিতে পারবেনা।

তৃতীয়ত : ইসলামে কোম্পানী গঠন প্রক্রিয়া পূঁজিবাদী প্রক্রিয়া হতে সম্পুর্ণ ভিন্ন

ইসলাম বর্তমান পূঁজিবাদী কোম্পানী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে। রাসুল (সা) বলেন, যে ব্যক্তি কারো থেকে ঋণ গ্রহণ করে এই উদ্দেশ্যে যে, সে তার সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে দিবেনা সে যেন জাহান্নামে তার জন্য স্থান নির্ধারণ করে নেয়।"

ইসলাম তাই বর্তমান পূঁজিবাদী কোম্পানী গঠন প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ ঘোষণা করবে। ইসলামে কোম্পানী ব্যবস্থা হল একটি চুক্তির ভিত্তিক বিষয় এবং এই চুক্তির জন্য আইনসিদ্ধ প্রস্তাব ও স্বীকৃতি থাকতে হবে। আর এই প্রস্তাব ও স্বীকৃতির ভিত্তি হবে হবে কোন সম্পদ বা এমন কিছু যা ব্যবহার করা যায়। তাছাড়াও তারা কি বিষয়ের ব্যবসা করবেন, কিভাবে লাভ-ক্ষতি বন্টন হবে এসব পূর্ণাঙ্গ লিপিবদ্ধ থাকবে। ইসলামে ৫ ধরণের কোম্পানী রয়েছে- যেমন : আল ইনাম (company of Equals), আল-আবদান (Company of Bodies), মুদারাবা (Company of body & capital), সুনামের ভিত্তিতে ব্যবসা (Company of Reputations) এবং মুফাওয়াদা।

আর তাই ইসলাম এ ধরণের কোম্পানী গঠণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূঁজিবাতিদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার পরিবর্তে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। এই ধরণের ব্যবসা সরাসরি প্রকৃত অর্থনীতির সাথে জড়িত বলে বর্তমান পূঁজিবাদী লিমিটেড কোম্পানীর জুড়ার আসর শেয়ার বাজার বা বন্ড বাজার এর প্রয়োজনীয়তাকে খিলাফত পূরোপূরো বিলুপ্ত করবে। তাছাড়া এই সব ব্যবসার মাধ্যমে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয় বরং কোন ব্যাক্তি যিনি প্রতিষ্ঠানের মালিক সে (তারা) সরাসরি নিজের দায়ে পুরোপুরি পরিশোধের অঙ্গীকারসহ গ্রহণ করবে।

চতুর্থ : খিলাফত বর্তমান অর্থনীতির Financial Sector কে পুরোপুরি বিলুপ্ত করবে এবং অর্থনীতি হবে শুধু financial sector এর ভিত্তিতে

যখন খিলাফত আসবে তখন বর্তমান financial sector কে পুরোপুরি বিলুপ্ত করা হবে। কারণ financial sector এর মাধ্যমে কোন সত্যিকার উৎপাদণ হয় না। যমুনা ওয়েল কোম্পানীর একটি শেয়ার ১০ টাকায় ইস্যু করলেও শেয়ার বাজারে প্রথম দিন এই শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে ৭৮০ টাকায়। সত্যিকার অর্থে একদিনে প্রায় ৭৮ গুণ দাম বৃদ্ধি প্রকৃত অর্থনীতিতে কোন উৎপাদন বাড়ায়নি। বর্তমানে ব্যাংক ও শেয়ার বাজার ব্যবস্থার কারণে মানুষ শেয়ার অবস্থা ভালো থাকলে ব্যাংক হতে টাকা তুলে শেয়ার বাজারে অর্থ বিনিয়োগ করে আর শেয়ার বাজারের অবস্থা খারাপ থাকলে শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংকে টাকা জমা রাখে। ফলে প্রকৃত কোন উৎপাদন হয় না। তাছাড়া বিভিন্ন ধরণের মুনাফা লোভী কৌশল যেমন : ধারের ক্রয়, ডেরিভেটিবিস এর মাধ্যমে অর্জিত মুনাফার পেছনে কোন প্রকার প্রকৃত উৎপাদন নাই। পুরোটাই লালসার জুড়াবাজি।

তাছাড়া এই financial sector এর সমস্ত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, হেজফান্ড, লিজিং ফার্ম, বিনিয়োগ ব্যাংক, সিকিউরিটি হাউস, পেনশন ফান্ড কোম্পানী, মিউচুয়্যাল ফান্ড প্রতিষ্ঠান এরা সবাই সুদের বিনিময়ে জনগণের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়। আর তারা ঋণ বিক্রি করে অধিক মুনাফা ভোগ করে এবং উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়। যার জন্য সাধারণ মানুষকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়। খিলাফত আসলে জনগণ বাইতুল মালে তাদের অর্থ জমাকরতে পারবে। কিন্তু এর জন্য সুদ দেয়াতো দুরে থাক বরং তাদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে চার্জ রাখা হবে। ফলে ১০০ টাকা জমা রাখলে আগামী বছর এটি হবে ধরুণ ৯৫ টাকা। আর তাই খিলাফতের অর্থনীতিতে জনগণের যেহেতু বাইতুলমালে জমা রাখার জন্য কোন প্রকার সুবিধা পাচ্ছে না। ফলে অতিরিক্ত অর্থের ব্যবহার তিনটি : ক. বেশি বেশি করে পণ্য দ্রব্য ক্রয় বা (consumption) বাড়ানো, খ. এই অর্থ real economy তে বিনিয়োগ করে ব্যবসা শুরু করা। যেমনঃ আল-ইনাম, আল-আবদান, মুদারাবা, ওযুহ বা মুফাওয়াদার মত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরী করা এবং গ. অথবা অন্যকে ব্যবসা করার জন্য ঋণ দেয়া। ফলে অর্থনীতিতে প্রচুর পরিমান উদ্যোক্ত তৈরী হবে এবং প্রকৃত উপাদন, বেড়ে যাবে।

অন্যদিকে খলীফা যেহেতু জনগণকে তার জীবিকা নির্বাহের জন্য নুন্যতম ব্যবস্থা করতে বাধ্য, তাই জনগণ তার মৌলিক অধিকার পূরণের জন্য কোন প্রকার ঋণ গ্রহণের প্রয়োজন পড়বেনা। শেয়ার বাজার না থাকার কারণে ব্যবসায়ের জন্য অর্থ প্রয়োজন পড়লে তা নতুন অংশীদার এনে অর্থায়ন করতে পারবে। তাছাড়া বাইতুল মালের ফান্ড হতেও ব্যবসায়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ঋণ গ্রহণ করা যাবে। আর এসব ঋণ গ্রহণের সময় সুদ থাকবেনা বলে, উৎপাদণ খরচ অনেক কমে যাবে।

এরই সাথে সাথে খিলাফত ব্যবস্থায় যেহেতু বর্তমান ব্যবস্থার মত বিভিন্ন প্রকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর থাকছেনা এর ফলে কোন ব্যাক্তি বা উপার্জন করবে তাইযে ব্যবহার, বিনিয়োগ বা ভোগ করতে পারে। পশ্চিমা দেশে, VAT, Federal tax, state tax, municipal tax এর সাথে সাথে বিভিন্ন ধরণের income tax দেবার ফলে একজন ব্যাক্তি ১০০ টাকা উপার্জন করলে প্রায় ৪০-৫০ টাকা এসব খাতে চলে যায় এবং তার কাছে বাকী থাকে মাত্র ৫৫-৬০ টাকা। ফলে পশ্চিমা অর্থনীতিতে একজন ব্যাক্তি যা উপার্জন করছে তার পুরোটাই অর্থনীতিতে ব্যবহার করা যাচ্ছেনা। সে সমস্যা খিলাফত ব্যবস্থায় থাকছে না।

তাছাড়া পশ্চিমা বিশ্বে একজন ব্যাক্তি যেহেতু তার সমস্ত প্রকার অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে বিনিয়োগ, সঞ্চয় এবং ভোগ সুদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, ফলে তাদের জীবন যাত্রার ব্যায় অসম্ভব হারে বেড়ে যায়। আর তাই আগামী খিলাফাত একদিকে সুদ ভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা বন্ধ করে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং অন্যদিকে মানুষের উপর বিভিন্ন নামে ট্যাক্স চার্জ না করে জনগণের consumptions এর সামর্থ্যকে বাড়াবে। ফলে খিলাফত অর্থনীতি হবে একমাত্র অর্থনীতি যা বিনিয়োগ উৎসায়িত করবে, উৎপাদন বাড়াবে, প্রচুর উদ্যোক্তা তৈরী করবে, কর্মসংস্থান বাড়াবে এবং সর্বোপুরি ভোগ (consumption) বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিকে সচল রাখবে। আর এটিই হবে একমাত্র টেকসই ও সুপারপাওয়ার অর্থনীতি।

৬ষ্ঠ ধাপ : বর্তমান সংকটে আমাদের ভূমিকা- (আবার আসবে খিলাফত)

বিশ্বব্যাপী পূঁজিবাদী অর্থনীতির দেউলিয়াত্ব এর আদর্শিক দেউলিয়াত্বকে স্পষ্ট ভাবে প্রমাণ করেছে, BBC-তে Washington Post এর Economic Editor-কে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছে Is the American Capitalism Dead? সে উত্তরে বলেছে, not really just tell me, what is the alternative we have? ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধানদের পূঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থাকে পাল্টাতে বলেছেন। বুশ ও ব্রাউনের শতশত বিলিয়ন ডলার উদ্ধার তৎপরতার পর, পূঁজি বাজার অব্যাহত পতন পশ্চিমা বিশ্বের সকল মানুষকে আক্রান্ত করেছে। রাশিয়ার একদিনে ৭০,০০০ শ্রমিক ছাঁটাই, শতশত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন, ইউরোপের ১২% এর মত বেকারত্বের হার, ১ বছরে মার্কিন অর্থনীতির একতৃতীয়াংশ পতন তাদের অবদা স্বাধীন অর্থব্যবস্থার প্রবর্তকদের বিশ্বাসকে নষ্ট করে দিয়েছে।

পূঁজিবাদীরা তাদের অর্থ ব্যবস্থা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছে। আর যে সভ্যতা তাদের বিশ্বাসের ব্যাপারে সন্দিহান তারা অবশ্যই অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পশ্চিমারা তাদের মুক্তবাজার অর্থনীতির উচিত জবাব পাচ্ছে।

আর তাই আমাদের উচিত বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে সুদ বিহীন, স্বর্ণমান মুদ্রা ব্যবস্থার পক্ষে জনমত তৈরী করা। জনমত তৈরী করা সেই অর্থব্যবস্থার পক্ষে যে অর্থ ব্যবস্থা ১৩০০ বছরের অধিকাল কোন উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সংকট ব্যাতিত বিশ্ব অর্থনীতেকে রাজত্ব করেছে। আজ সারা বিশ্বের মানুষ তাকিয়ে আছে। আমরা যারা খিলাফত পুনঃ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আন্দোলনরত, তাদের জন্য সময় এসেছে বিশ্বের তাকিয়ে থাকা মানুষের কাছে পশ্চিমা অর্থব্যবস্থার ভন্ডামী ও লালসার আগ্রাসণকে উন্মোচন করা। যাতে মানুষ পশ্চিমাজীবন ব্যবস্থাকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে এবং খিলাফত ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করে। খিলাফত ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহ্‌ আমাদেরকে কবুল করুন। আমিন।

"নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌র পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সমস্ত বিষয়ের উপর, যদিও বেশির ভাগ মানুষই এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।" [সুরা ইউসুফ : ২১]


প্রথম ড্রাফট
মোঃ আল মামুন।
৩০ শাওয়াল, ১৪২৯
৩১ অক্টোবর, ২০০৮ইং

ইসলামের দাওয়াত - পর্ব ৭


(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী গবেষক শাইখ আহমদ মাহমুদ কর্তৃক রচিত “Dawah to Islam” বইটির খসড়া অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)

পঞ্চম অধ্যায়: যেসব পদ্ধতি শরী'য়া পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক

আমরা ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা) এর কর্মপদ্ধতি, তা অনুসরণ করা ও এ পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়ার গুরুত্ব উপস্থাপন করেছি। তবে আমরা দেখতে পাই কিছু ইসলামি দল ও চিন্তাবিদগন এ পদ্ধতি ব্যতিরেকে অন্য পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। যাইহোক যারাই এসব পদ্ধতি গ্রহণ করছেন, আমাদেরকে সে বিষয়ে অবশ্যই আলোচনা করতে হবে। দ্রুত পরীক্ষা করে এ বিষয়ে এমনভাবে অজ্ঞানতার পর্দাকে উন্মোচন করতে হবে যাতে মুসলিমগণ অবিরতভাবে হতবুদ্ধি না হয় এবং গোলকধাঁধায় হারিয়ে না যায় অথবা দাওয়াত বহনের ক্ষেত্রে সন্দিহান না থাকে। নিম্নে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি উপস্থাপন করব।

কিছু মুসলিম বলে যে, খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার কাজের বাধ্যবাধকতা কেবলমাত্র শাসক ও তাদের পারিষদবর্গকে আহবানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত

মালা'আ হল একটি জনগোষ্ঠীর প্রধান। তাদের হাতে জনগনের সব বিষয় থাকে এবং তারা সব সময় শাসকদের চারপাশে থাকে। যদি তাদের ক্ষেত্রে দাওয়াত সফল হয় তাহলে ইসলামের সুবিধা হবে, সমাজকে সহজেই পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। যে বিষয়টি দাওয়াত কেবলমাত্র শাসকশ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবার উপলদ্ধি তৈরি করেছে তা হল, সাধারণ জনগণকে দাওয়াত প্রদান করবার মাধ্যমে খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজ করা শুরু করলে তা তাদের জন্য শাসক কতৃক লাঞ্চণা বয়ে নিয়ে আসবে। তারা এমন বোঝায় ভারাক্রান্ত হয়ে যাবে-যা বহনে তারা অক্ষম এবং মুসলিমদের এ অবস্থায় পর্যবসিত হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

'একজন মুমিনের উচিত নয় নিজেকে ছোট করা।' যখন তাঁকে (সা) জিজ্ঞেস করা হল, 'কীভাবে একজন নিজেকে ছোট করে?' তিনি (সা) বলেন, 'নিজেকে এমন ক্লেশের মধ্যে ঠেলে দিয়ে-যা বহনে সে অক্ষম।' (আহমেদ, তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ)

কেউ যদি যে পরিবেশে সমাজ পরিবর্তনের দাওয়াতের উত্থান ঘটে সে বাস্তবতা অধ্যয়ন করে, তাহলে দেখতে পাবে যে, তা এমন একটা সময়ে হয় যখন সমাজে থাকে অবিচার, নৈতিক অবক্ষয়, ধ্বংস, দূর্দশা এবং প্রতিকূলতা। সমাজে এসবই হয়ে থাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ও তাঁর সার্বভৌমত্বের প্রতি ঈমানের অভাবের কারনে, এজন্য অতীতে নবীরা এবং আমাদের মহান রাসূল (সা) প্রথমেই দাওয়াত দিতেন ঈমান ও আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা)র ইবাদতের প্রতি।

অতীতে এবং আজকেও সমাজ শাসক ও তাদের পারিষদবর্গের দ্বারা পরিচালিত হয়। তারা নিজের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মনগড়া আইন ও মিথ্যা আক্বীদাভিত্তিক চিন্তা ধারণ করে। নিজের স্বার্থ ও সামাজিক মর্যাদার জন্য তারা এসব মিথ্যা বিশ্বাসকে রক্ষা করে। এ কারণে ইসলামের দাওয়াতের কথা প্রথমবার শুনবার পর একজন বিচক্ষণ বেদুইন নিম্নের গভীর ও সঠিক মন্তব্যটি করেছিল যে,'অবশ্যই এটা এমন একটি বিষয় যা শাসকদের বিরাগভাজন হওয়ার কারণ।' সমাজের লোকেরা নিজেদের সমাজের শাসক ও তাদের পারিষদগবর্গের কাছে সমর্পন করে। একটি প্রতিক্রিয়া তৈরির বদলে তারা প্রভাবিত হয়। ঘৃণা করা সত্ত্বেও তারা তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য করে। কারণ তারা জানে শাসকদের এ অবিচারের মূলোৎপাটন করা সহজসাধ্য নয়।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা যখন কোন নবী বা রাসূল প্রেরণ করেন তা হয় তাদের লোকদের সত্য পথ নির্দেশ করবার জন্য। যারা এ ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং নবী রাসূলদের বিপক্ষে অবস্থান নেয় তারা হল এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ শাসক ও তাদের পারিষদবর্গ। মালা'আ গণ শাসকদের সাহায্যকারী। তারা স্বার্থলিপ্সু, ধনী ও অমিতব্যয়ী। তারা জনগনের নেতা ও প্রধান-যারা শাসকদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাহক হয়ে উঠে। শাসকগণ তাদের উপর নির্ভর করে ও সাহায্য প্রার্থনা করে। তারা এমনসব লোক যাদের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন যে, যারা আল্লাহর নবীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তাদের মধ্যে তারা সম্মুখে থাকবে। কারণ তাদের হৃদয় টাকা ও পদমর্যাদার প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং স্বার্থের সাথে তাদের পদমর্যাদা সর্ম্পকিত। সেকারণে যখনই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি দাওয়াতের কথা আসে তখনই তারা চিন্তা করে যে, এটা তাদের স্বার্থ ও পদমর্যাদার পথে অন্তরায়। তারা দাওয়াতের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং শাসকদের দাওয়াতকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ও নির্মূল করতে প্ররোচিত করে। পাপ ও পঙ্কিলতার কারনে শাসক তাদের উপদেশ গ্রহণ করে। এ কারণে অবধারিতভাবে আল্লাহর নবীগণ ও মালাআর পাশে থাকা শাসকদের সাথে সংঘাত হয়েছে। আল্লাহর নবী, শাসক ও তাদের পারিষদবর্গদের মধ্যে সাধারণ লোকদের হৃদয় জয় করবার জন্য রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার প্রতিযোগিতা হত। নবীগণ সত্য দিয়ে লোকদের আহ্বান করতেন। কিন্তু তারা ছিলেন দূর্বল, অরক্ষিত। কেবলমাত্র সত্য উচ্চারণের ক্ষমতা দিয়ে মানুষের হৃদয় মন জয় করে নিয়েছিলেন। শাসক ও তাদের পারিষদবর্গ প্রথমদিকে এ আহ্বানের বিরুদ্ধে অসত্য যুক্তি উপস্থাপন করে বলত- এগুলো জাদুকরী মন্ত্র, পৌরাণিক গল্প, সত্য ধারণকারীরা মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসীরা বোকা অথবা হীন মানসিকতাসম্পন্ন। যখন এ পদ্ধতি কাজ না করত তখন নির্যাতন, বিতাড়ন, গ্রেফতার ও হত্যার পথ বেছে নেয়া হত। নবী ও তাঁর অনুসারীদের সাথে শাসক, তাদের পারিষদবর্গ ও রাজার ধর্ম অনুসারীদের মধ্যে সর্বাত্নক যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। কুরআন বারংবার এ বিষয়টিকে একটি আইন বলে উল্লেখ করেছে।

সেকারণে আমরা দেখতে পাই যে, সাইয়্যিদিনা নুহ (আ) যখন লোকদের দাওয়াত দিচ্ছিলেন তখন সর্বপ্রথম বাধা এসেছিল এই পারিষদবর্গের কাছ থেকে। এ সর্ম্পকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

'নিশ্চয়ই আমি নুহকে তার সম্প্রদায়ের প্রতি পাঠিয়েছি। সে বলল: হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। আমি তোমাদের জন্যে একটি মহাদিবসের শাস্তির আশঙ্কা করি। তার সম্প্রদায়ের সর্দাররা বলল: আমরা তোমাকে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতার মাঝে দেখতে পাচ্ছি। সে বলল: হে আমার সম্প্রদায়, আমি কখনও ভ্রান্ত নই; কিন্তু আমি বিশ্ব প্রতিপালকের রাসূল।' (সূরা আ'রাফ:৫৯-৬১)

সাইয়্যিদিনা হুদ (আ) তার কওম আদকে আহ্বান করেছিলেন। লোকদের মধ্যে নেতাগন সর্বপ্রথম এ দাওয়াতকে প্রত্যাখান করেছিল। এ সর্ম্পকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

'আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই হুদকে। সে বলল: হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। তার সম্প্রদায়ের সর্দাররা বলল: আমরা তোমাকে নির্বোধ দেখতে পাচ্ছি এবং আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।' (সূরা আ'রাফ: ৬৫-৬৬)

সাইয়্যিদিনা সালেহ (আ) তার কওম সামুদকে আহ্বান করেছিলেন। লোকদের মধ্যে নেতাগন সর্বপ্রথম এ দাওয়াতকে প্রত্যাখান করেছিল। এ সর্ম্পকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

'সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই সালেহ্‌কে। সে বলল: হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই......।' (সূরা আ'রাফ: ৭৩)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আরও বলেন,

'তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক সর্দাররা ঈমানদার দরিদ্রদেরকে জিজ্ঞেস করল: তোমরা কি বিশ্বাস কর যে, সালেহ্‌কে তার প্রতিপালক প্রেরণ করেছেন? তারা বলল: আমরা তো তার আনীত বিষয়ের প্রতি বিশ্বাসী। দাম্ভিকরা বলল: তোমরা যে বিশ্বাস স্থাপন করেছ, আমরা তাতে অস্বীকৃত।' (সূরা আ'রাফ: ৭৫-৭৬)

একইভাবে সাইয়্যিদিনা শোয়াইব (আ) মাদাইনের লোদের যখন আহ্বান করেছিলেন তখন নেতৃস্থানীয় লোকেরা অত্যন্ত ঔদ্ধ্যতের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

'আমি মাদইয়ানের প্রতি তাদের ভাই শোয়ায়েবকে প্রেরণ করেছি। সে বলল: হে আমার সম্প্রদায়। তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নাই...।' (সূরা আ'রাফ: ৮৫)

এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

'তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক সর্দাররা বলল: হে শোয়ায়েব, আমরা অবশ্যই তোমাকে এবং তোমার সাথে বিশ্বাস স্থাপনকারীদেরকে শহর থেকে বের করে দেব অথবা তোমরা আমাদের ধর্মে প্রত্যাবর্তন করবে। ' (সূরা আ'রাফ: ৮৮)

যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সাইয়্যিদিনা মুসা (আ) কে ফিরাউন ও তার পারিষদবর্গের কাছে প্রেরণ করলেন, তখন তারা তাকে প্রত্যাখান করল ও মুসার সঙ্গীদের ভয় পেল এবং তাঁকে হত্যা করবার জন্য পরামর্শ দিল। এ সর্ম্পকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

'অতঃপর আমি তাদের পরে মূসাকে পাঠিয়েছি নিদর্শনাবলি দিয়ে ফেরাউন ও তার সভাসদদের নিকট। বস্তুত ওরা তার মোকাবেলায় কুফরী করেছে। সুতরাং চেয়ে দেখ, কি পরিণতি হয়েছে অনাচারীদের।' (সূরা আ'রাফ: ১০৩)

এবং আল্লাহ বলেন,

'ফেরাউনের সাঙ্গ-পাঙ্গরা বলতে লাগল, নিশ্চয় লোকটি বিজ্ঞ- যাদুকর।' (সূরা আ'রাফ: ১০৯)

'ফেরাউনের সম্প্রদায়ের সর্দাররা বলল, তুমি কি এমনি ছেড়ে দেবে মূসা ও তার সম্প্রদায়কে। দেশময় হৈ-চৈ করার জন্য এবং তোমাকে ও তোমার দেব-দেবীকে বাতিল করে দেবার জন্য।' (সূরা আ'রাফ: ১২৭)

'আর কেউ ঈমান আনল না মূসার প্রতি তার কওমের কতিপয় বালক ছাড়া- ফেরাউন ও তার সর্দারদের ভয়ে যে, এরা না আবার কোন বিপদে ফেলে দেয়। ফেরাউন দেশময় কর্তৃত্বের শিখরে আরোহণ করেছিল। আর সে তার হাত ছেড়ে রেখেছিল।' (সূরা ইউনুস: ৮৩)

রাসূলুল্লাহ (সা) এর সীরাত অন্যান্য নবী রাসূল (সা) এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। দাওয়াতের গতিকে মন্থর এবং লোকদের দাওয়াত শোনা ও গ্রহণের ব্যাপারে বিতস্পৃহ করবার জন্য ব্যাপক নির্যাতন ও বিশ্বাসীদের উপর অত্যাচার চালানো হয়। বিশ্বাসীরা ভাবত ঈমানের জন্য নিজের লোকদের দ্বারা অত্যাচারিত হতে হবে। যে বিশ্বাস স্থাপন করতে চাইত সে ভেবে নিত যে, পূর্বের বিশ্বাসীদের মতই তার অবস্থাও করুণ হবে। বিশ্বাসী ও মা'লা নেতৃত্বাধীন তাদের অনুসারীদের মধ্যকার বিবাদ পর্যায়ক্রমিক সফলতার মাধ্যমে চলত। অতপর একসময় তাগুতের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেল। পরবর্তীতে দাওয়াত বহনকারীরা ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরে।

ইবনে মাসঊদের বরাত গিয়ে সহীহ বুখারীতে বলা হয়েছে:

'যখন রাসূলুল্লাহ (সা) সিজদারত অবস্থায় তখন একদা কুরাইশের লোকেরা তার চারপাশে ছিল। এমতাবস্থায় উকবা বিন আবি মু'ইত উটের নাড়িভূড়ি নিয়ে এল এবং রাসূলুল্লাহ (সা) এর উপর নিক্ষেপ করল। নবী (সা) তাঁর মাথা উঠালেন না। ফাতিমা (রা) দৌড়ে এলেন এবং নবী (সা) এর পিঠ থেকে উটের নাড়িভূড়ি সরালেন এবং যারা এ কাজটি করেছে তাদের অভিসম্পাত করলেন। নবী (সা) বললেন, 'হে আল্লাহ! কুরাইশদের নেতা (মালাআ) আবু জাহেল বিন হিশাম, উতবা বিন রাবিয়্যাহ এবং উমাইয়্যা বিন খালাফ.....এর (শাস্তির) দায়িত্ব তোমার।' ইবনে মাসুদ অন্য একটি বর্ণণায় বলেন, 'আমি তাদের বদরের দিন নিহত হতে দেখেছি এবং কূপে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।'

মক্কায় কেবল একজন নেতা ছিল না, অনেক মা'লা ছিল। এই লোকগুলো রাসূলুল্লাহ (সা) এর দাওয়াতকে বিরোধিতা করেছিল এবং লোকদের এ পথ থেকে বিভ্রান্ত করবার অপচেষ্টা করেছে।

অন্যান্য নবীদের কেবলমাত্র তাদের লোকদের কাছে প্রেরণ করা হত, কিন্তু মুহাম্মদ (সা) এর দাওয়াত গোটা মানবতার জন্য।

কুরাইশদের পারিষদবর্গ দাওয়াতের কাজে ব্যাপক প্রত্যাখান ও বাধা সৃষ্টি করা শুরু করা সত্ত্বেও দাওয়াত কেবলমাত্র তাদের মাঝেই পরিগ্রহ করেনি। দাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) কোন বৈষম্য করেননি। গরীব-ধনী, প্রভূ-ক্রীতদাস কারও ক্ষেত্রে তিনি ভেদাভেদ করেননি। তারপরেও ইবনে উম্মে মাকতুম (রা) এর মত একজন অন্ধ দরিদ্র ব্যক্তির প্রতি ভ্রুকুঞ্চিত করবার কারণে তাঁকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে। তিনি নেতাদের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাবার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল ছিলেন এই আশায় যে, তারা ঈমান গ্রহণ করলে তাদের অনুসারীরাও ঈমান গ্রহণ করবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কতৃক রাসূলুল্লাহ (সা) কে সতর্ক করা সত্ত্বেও নেতৃস্থানীয় লোকদের প্রতি দাওয়াত বন্ধ হয়নি। কারণ এ তিরষ্কার ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। আহ্বানের দৃষ্টিভঙ্গিতে নেতাদের প্রতি দাওয়াত ও সাধারণ জনগনের প্রতি দাওয়াত একইরকম।

সীরাত থেকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (সা) নেতা ও প্রধানদের কাছে কেবলমাত্র তাদের পদমর্যাদার কারণে দাওয়াত নিয়ে যাননি, বরং তারা বিশ্বাসী হলে তাদের অনুসারীরাও বিশ্বাসী হবে-এ আশা থেকে তিনি (সা) দাওয়াত দিয়েছিলেন। এ কারণে দাওয়াতের আওতার মধ্যে সবাই অর্ন্তভুক্ত।

এছাড়াও এমন লোক দাওয়াত গ্রহণ করেছিল যারা লোকদের নেতা ছিল না, যেমন: বিলাল, আম্মার (রা) এবং তাঁর মা ও বাবা। একই কথা শোয়াইব ও সালমান (রা) এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; কারণ তারা কেউ কুরাইশ নেতা ছিলেন না। আবার আমীর বিন ফুহাইরা, উম্মে আবিস, জুনাইরাহ, আন নাহদিয়্যা ও তাঁর কন্যা এবং বানু মু'মিল এর ক্রীতদাসী এর ক্ষেত্রেও এ কথা খাটে। কারণ আবু বকর (রা) ও প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণকারীরা তাঁদের সবাইকে দাসত্ব মুক্ত করেছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (সা) প্রাথমিকভাবে তাদেরই দাওয়াত দিয়েছিলেন যাদের মধ্যে খায়ের ছিল। অতপর তিনি সবার কাছে গিয়েছিলেন। তরুণ ও বৃদ্ধরা সাধারণত সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। সাধারণ ও সম্মানিত লোকেরাও সাড়া দিয়েছিল।

দাওয়াতের পাত্র অনুসন্ধান করবার ক্ষেত্রে কোন সীমাবদ্ধতা নেই। এর মধ্যে সব ধরনের লোকেরাই থাকবে। আর পদ্ধতি হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা) এর পদ্ধতির কোন বিকল্প নেই-যার মাধ্যমে তিনি দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কিছু মুসলিম মনে করে, ইবাদত (আনুষ্ঠানিক ইবাদত) করাটাই হলো প্রয়োজনীয় কাজ; ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা নয়

তারা আরও বলে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) লোকদের আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছেন, কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে নয় অথবা আল্লাহর প্রতি ইবাদত হল কেন্দ্রীয় ইস্যু, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়; কিংবা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা জরুরী নয় যতটা জরুরী আল্লাহর ইবাদত করা। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তারা এ জাতীয় আরো কিছু কথা বলে থাকে।

এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অবশ্যই ইবাদতের বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত করব এবং দেখাব কীভাবে তা অর্জন করতে হয়।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষকে ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং মানুষকে সৃষ্টির অর্ন্তনিহিত উদ্দেশ্য হল ইবাদত করা। 'লা ইলাহা ইল্লালাহু' এর অর্থ হল, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। আর এ কথার ব্যতিক্রম যে কোন কিছুই মিথ্যা ও অবশ্যই পরিত্যাজ্য এবং মানুষ এ ব্যাপারে অবশ্যই সাক্ষ্য দেবে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ - এর অর্থ হলোو ইবাদত ও আনুগত্য শুধুমাত্র মুহাম্মদ (সা) যা নিয়ে এসেছেন সে পদ্ধতিতে হবে এবং মানুষকে অবশ্যই তার সাক্ষ্য দিতে হবে।

সুতরাং, ইবাদাহ বা উপাসনা হল কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্য। আর এটা ততক্ষণ পর্যন্ত করা যাবে না যতক্ষণ না আল্লাহ সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিচ্ছেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা) তা প্রদর্শন করেছেন। আর এ বাণীটি আমাদের জীবনে যে কোন কথা ও কাজে মনে রাখতে হবে।

যখন একজন মুসলিম তার বাস্তবতায় নিজের কোন চাহিদা মেটাবার জন্য বা কোন মূল্যবোধের তাগিদে কোন কাজ করে তখন সে কেবলমাত্র তার চাহিদা ও প্রবৃত্তিকে সন্তুষ্ট করবার উদ্দেশ্য নিয়ে অগ্রসর হয়, এবং যা সম্পন্ন করা যায় একাধিকভাবে।

শরীয়াগত পদ্ধতিতে এ চাহিদা পূরণ করা এবং এ সীমার মধ্যে অবস্থান করা ও এ কাজকে আল্লাহর বিশ্বাসের সাথে সর্ম্পকযুক্ত করার নামই হল ইবাদত।

প্রতিটি কাজের পিছনে কাজ করে ইচ্ছা ও চাহিদার সন্তুষ্টি, আর মানুষের প্রয়োজন নানাদিকের সাথে সম্পর্কযুক্ত, এটা সহজাত যে তার এ ক্রিয়াকলাপ জীবনের সবদিকই আচ্ছাদিত করে।

সুতরাং ইবাদত হল সে কাজ যা মানুষ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আদেশ ও নিষেধ মেনে করে থাকে এবং এটা কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি ঈমানের ভিত্তিতে হতে হবে। আর এর মাধ্যমেই ইবাদতের পূর্ণাঙ্গতা নিশ্চিত হয় এবং এ ইবাদত মানুষের সব কাজকে বেষ্টন করে।

কাউকে 'আল্লাহর উপাসনা' করতে বলার অর্থ কেবলমাত্র সালাত আদায়, যাকাত প্রদান, হজ্জ সম্পাদন বা ফকীহগন যেগুলোকে ইবাদত বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন সেগুলো করা বুঝায় না, বরং সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলার নামই হল্‌ ইবাদত।

সুতরাং যে কোন কাজের মূল হল আল্লাহর প্রতি ঈমান। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের দিকে সব কাজকে ধাবিত করার জন্যই ইবাদত। সুতরাং পুরো দ্বীন হল ইবাদাহ এবং ইবাদাহ অর্থ হল সমর্পণ করা। আর আল্লাহর কাছে মানুষকে সমর্পণ করবার অর্থ হল তার ইবাদত করা, তার আদেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, তাকে সর্বজ্ঞ ও সর্বসচেতন হিসেবে মেনে নেয়া, সন্তুষ্টির সাথে সর্বান্তকরণে তার কাছে আন্তসমর্পণ করা।

সেকারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদত করা ও তাঁকে মান্য করবার অংশ হল সালাত আদায়, যাকাত প্রদান ও ক্বিয়াম বা রাত জেগে ইবাদত করবার পাশাপাশি সৎ কাজের আদেশ প্রদান করা ও অসৎ কাজে নিষেধ করা, কুফর ও নিফাক (মুনাফেকী) এর বিরুদ্ধে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে অংশগ্রহণ করা, মুসলিমদের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করা, সব লোকদের কাছে দাওয়াতের প্রসার ঘটানো এবং মুসলিমদের সুরক্ষা প্রদান করা।

আল্লাহর প্রতি উপাসনার মধ্যে মানুষের সব কাজই অর্ন্তভুক্ত-যা মানুষ তার বাস্তবতা অনুসারে পালন করে থাকে। যদি এমন হয় কোন মুসলিম সালাত আদায় করছে না, তাহলে তখন সালাতের দিকে আহ্বান করা হল ইবাদত। একইভাবে সাওম পালনের জন্য আহ্বান করা ইবাদত, শরী'আহ অনুযায়ী ক্রয় বিক্রয় করবার আহ্বান জানানোর নামও ইবাদত। আল্লাহর প্রতি ঈমানই হল সব ইবাদতের মূল। সেকারণে কাউকে যখন সালাত আদায় বা সাওম পালনের দিকে আহ্বান জানানো হয় তখন যাকে আহ্বান করা হয় তার ঈমানী চেতনাকে আগে জাগ্রত করতে হবে এবং এই ঈমানকে কাজের প্রতিশ্রুতি ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিণত করতে হবে।

একইভাবে লোকদের ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা দিয়ে শাসন করবার দিকে আহ্বান করাও আল্লাহর নির্দেশ এবং এগুলো আমাদের মানতে হবে। এগুলো সে-ই পালন করবে যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। সে কারণে এগুলোর দিকে আহ্বান করার আগে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের দিকে আহ্বান করতে হবে। এভাবে এ ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদত উপলদ্ধি হবে।

মুসলিমরা আজকাল কুফরী ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করে-যার হুকুমসমূহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে উৎসারিত নয় এবং এর মধ্যে থেকে তারা ইসলামী জীবনব্যবস্থা চর্চা করতে পারে না। এমতাবস্থায় দ্বীন প্রতিষ্ঠার আহ্বান অবশ্যই আল্লাহর ইবাদতের দিকে দাওয়াত দেয়া বুঝায় এবং এ দিকেই মনোযোগ আকর্ষণ করা ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

সুতরাং আমাদের যুগের সমস্যার সাথে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বানকে সর্ম্পকযুক্ত করতে হবে। আর এটি প্রতিফলিত হয় যখন ইসলামি জীবনধারা পূণপ্রবর্তনের দিকে কেউ আহ্বান করে। কেবলমাত্র তখনই আল্লাহর ইবাদত পূর্ণাঙ্গরূপে করা সম্ভবপর হবে। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তবায়নের দিকে আহ্বানের অর্থ হল দ্বীন প্রতিষ্ঠার দিকে আহ্বান করা-যা একটি ইবাদত এবং এ দাওয়াতও একটি ইবাদতের দিকে আহ্বান। কারণ এটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার একটি হুকুম-যার প্রতি আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আল্লাহর ইবাদতের ব্যাপারে আত্মতুষ্টি থেকে কোন মুসলিম এটাকে অবহেলা করে।

সুতরাং বিভিন্ন লোক কর্তৃক এ বিষয়টি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা সঠিক নয়। কারণ তারা এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে, খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা আল্লাহর ইবাদতের সাথে সাংঘর্ষিক। আর এ ধরনের মন্তব্য করা বা দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা কুরআনের একটি অংশের উপর আক্রমণের নামান্তর এবং এটা করা হারাম।

কারও কারও মতে রাসূলুল্লাহ (সা) এর সীরাতের যথার্থতা যাচাই করা হয়নি

এর অর্থ হল, যে বিষয়ের দলিল প্রমাণিত নয় সেটি মানতে আমরা বাধ্য নই। ফলে আমরা সে অনুযায়ী কাজও করতে পারি না। তারা মনে করে, খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য মক্কী জীবনে রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাজকে অনুসরণ না করবার ব্যাপারে তাদের মতামতের পক্ষে এটি একটি দলিল।

এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিক্রিয়ায় আমরা বলতে পারি, সীরাত হল বর্ণণা ও ঘটনার সংগ্রহ- যে ব্যাপারে নিরীক্ষা ও দালিলিক প্রমাণ অত্যাবশ্যকীয়। যেহেতু এটা রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাজের সাথে সর্ম্পকযুক্ত সেহেতু তা ওহীর অংশ। সুতরাং মুসলিমদের মুস্তফা (সা) এর সীরাতের ব্যাপারে এমনভাবে সচেতন থাকতে হবে যেভাবে তারা কোরআন ও হাদীসের ব্যাপারে সচেতন থাকে। সীরাতে মক্কী জীবনের কাজ বলতে রাসূলুল্লাহ (সা) সেখানে অবস্থানকালে যা করেছিলেন তাকেই বুঝায়-যখন তিনি মদীনাতে দার-উল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কাজ করেছিলেন। যাদের সীরাতের যথার্থতা নিয়ে কাজ করবার সক্ষমতা আছে, যদি তারা তা না করে অথবা অন্যদের এ ব্যাপারে উৎসাহ না দেয় তাহলে তারা গোনাহগার হবে।

এটা খুবই অদ্ভুত যে, যারা এরকম দাবী করে তারা সবাই হাদীস গবেষক ও নিরীক্ষক। এমনভাবে এ দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থাপন করে যেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে তারা দায়মুক্ত। অবস্থা এমন যেন, তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ ও সিদ্ধান্তগ্রহণকারী উপসংহারে উপনীত হয়েছে।

এ মুসলিমগন কি ভুলে গেছে যে, অন্যান্য মুসলিমদের মতই তারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দায়িত্বশীল? এটা তাদেরকে সীরাত অধ্যয়ন ও নিরীক্ষণকে বাধ্যতামূলক করেছে। যদি বাস্তবতা তাদের আংশিক শরীয়া বিষয়গুলোর ব্যাপারে হাদীস পরীক্ষা করতে প্রচেষ্টা চালাতে উদ্ধুদ্ধ করে, (এর জন্য তারা ধন্যবাদ পাবে, এ বিষয়ে তারা জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং এ পথে অনেক সময় ব্যয় করেছে), তাহলে দ্বীন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনুধাবন করার পর তারা কী পরিমাণ গবেষণা ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে বাধ্য?

যদি সীরাতের কোন বর্ণণার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দালিলিক প্রমাণ না থাকে তাহলে এমন কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না যে, বিশেষ কোন সীরাত গ্রন্থের সব বর্ণণা গ্রহণ করা যাবে না।

ইতিহাসের যে শাখায় সীরাত লেখকগন কাজ করেছেন সেখানে মুহাদ্দীসীনদের পদ্ধতির মত সাবধানতা অবলম্বন করেননি। এমনকি বর্ণণাকারী বা সংগ্রাহকের বিশ্বস্ততা, বর্ণিত বিষয়ের যথার্থতা, বাহুল্যতা এবং সঞ্চারণে বীতস্পৃহা সর্ম্পকে সাবধানতা অবলম্বন করা হয়নি। এটা হাদীস বিশারদ ও সীরাতের যাচাইমূলক কাজের সাথে জড়িত যারা তাদের আত্মপ্রসাদপূর্ন করে তুলে।

আসল ব্যাপারটি হল, মুহাদ্দিসগন ও হাদীস বিশেষজ্ঞগন নিজেরা যে তথ্যনুসন্ধান এবং সঞ্চারন (transmit) করেন তা-ই হাদীস বিজ্ঞানের (science of hadith) জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়। সীরাত বিজ্ঞান একটি দিক থেকে এ জিনিসটি (বর্ণণার বিশুদ্ধতা) দাবী করে, আর সেটা হলো রাসূলুল্লাহ (সা) ও সাহাবী (রা) এর জীবনের সাথে সম্পৃক্ত বিবরণ। অপরদিকে, যে বিষয়টি রাসূল (সা) এবং তাঁর সাহাবা (রা) গণের সাথে সম্পৃক্ত নয় সে বিষয়ে নমনীয়তা এ সর্ম্পকিত জ্ঞান কে ক্ষুন্ন করে না।

ঘটনাপ্রবাহ অনেক বেশী এবং অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। সেকারণে সীরাত লেখক ও ঐতিহাসিকগন মুহাদ্দিসগণের পদ্ধতির উপর নির্ভর করলে এত ঘটনাকে বেষ্টন করতে পারবে না। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা) এর সীরাত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান- যে ব্যাপারে মুসলিমদের সচেতন থাকা উচিত। কারণ এতে রয়েছে তাঁর উক্তি, কাজ, সম্মতি ও বৈশিষ্ট্য। এসবই কোরআনের মত আইনের অংশ। নবীর সীরাত আইনের একটি উপাদান বিধায় হাদীসের অংশ। নবী (সা) এর পক্ষ থেকে যা দালিলিক প্রমাণসহ পাওয়া যায় তাই শরীয় হুকুম। কারণ এটি সুন্নাহ থেকে নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা) কে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) বলেন,

'নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে রাসূলুল্লাহ্‌র মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।' (সূরা আল আহযাব: ২১)

সুতরাং সীরাতের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করা ও গুরুত্ব প্রদান করা শরঈ বিষয়।

পূর্বে সীরাত সরবরাহের পদ্ধতি হিসেবে কেবলমাত্র বর্ণণার উপর নির্ভর করা হত। ঐতিহাসিকগন মৌখিভাবে তা সঞ্চালিত করা শুরু করলেন। যে প্রথম প্রজন্ম রাসূলুল্লাহ (সা) কে প্রত্যক্ষ করেছে ও তার ব্যাপারে শুনেছে তারা অন্যদের কাছে এ ব্যাপারে তথ্য সঞ্চালিত করেছে। পরের প্রজন্মের কেউ কেউ এগুলো মিশ্রভাবে লিখে সংরক্ষণ করেছিল-যেগুলো আমরা এখন হাদীস গ্রন্থ হিসেবে পাই। দ্বিতীয় শতাব্দীতে আমরা দেখতে পাই কেউ কেউ সীরাত বিষয়ক কিছু বর্ণণা সংকলন করে একীভূত করেন। সংকলনের সময় তারা হাদীসের মত সঞ্চালক এবং এসব সঞ্চালকগণ যাদের থেকে সংগ্রহ করেছেন তাদের নামও উল্লেখ করেন। সেকারণে হাদীসবেত্তা ও ইসনাদ (বর্ণণাকারীদের ধারাবাহিকতা) নিরীক্ষকগণ গ্রহণযোগ্য ও প্রামাণিক সীরাত বর্ণণা থেকে বর্ণণাকারী ও বর্ণণাকারীদের ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে দূর্বল ও প্রত্যাখানযোগ্য অংশগুলো খুজে বের করেন। প্রামাণিক সীরাত থেকে এভাবে বর্ণণার সময় নির্ভর করা হয়। নতুন কোন বিষয়ের অবতারণা করা প্রধান ইস্যু নয়, বরং রাসূলুল্লাহ (সা) এর কথা ও কাজের বর্ণণার নির্ভূলতা ও সঠিকতা নিরূপণ করা অতি প্রয়োজনীয়। তবে কিছু সচেতন মানুষ সীরাত পরীক্ষা করে দেখেছে। সুতরাং যে দল বা সংগঠনটি রাসূলুল্লাহ (সা) এর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের অবশ্যই প্রামাণ্য দলিল নির্ভর সীরাত পরখ করে দেখতে হবে।

তাছাড়া, সীরাতের বইগুলোতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অমত সত্ত্বেও হাদীসের গ্রন্থ ও কুরআনের মত দাওয়াতের বিভিন্ন পর্যায় ও কর্মকান্ডের বর্ণণায় অভিন্নতা রয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআন দাওয়াতের অনেক বিষয় বিস্তারিতভাবে আমাদের সামনে এমনভাবে তুলে ধরেছে যে, এ বিষয়ে একটি সঠিক চিত্র পাওয়া যায়। কুরআন প্রয়োজনীয় অনেক কিছু সুস্পষ্ট ও সঠিকভাবে উপস্থাপন করেছে।

উদাহরণস্বরূপ, রাসূলুল্লাহ (সা) মিথ্যা বিশ্বাস, মূর্তিপূজা, নাস্তিক্যবাদ, ইহুদীবাদ, জাদুবিদ্যা, গোত্রবাদকে আক্রমণ করেছিলেন। কন্যা সন্তান জীবন্ত পুতে ফেলা, ঊসীলা হিসেবে মাদী উট চারণভূমিতে ছেড়ে দেওয়া, কোন প্রানীর জমজ বাচ্চা হলে মুর্তির উদ্দেশ্যে কোরবানী দেওয়া, শরনিক্ষেপ করা ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলে তিনি (সা) তাদের ঐতিহ্য ও রীতিনীতিকে আক্রমণ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং তাদের নাম উল্লেখ করে বর্ণণা দেন ও দাওয়াতের ব্যাপারে তাদের ষড়যন্ত্র উন্মোচন করেন। দলটিকে অবশ্যই এগুলো গ্রহণ করতে হবে। গ্রহণের সময় কাজের মৌলিকতা এবং এর সাধারণ অর্থের দিকে খেয়াল খেয়াল করতে হবে, বিস্তারিতভাবে উপকরণ বা ধরণ নয়। সেকারণে দলটি ভুল চিন্তা, অসঠিক ধারণা ও ইসলাম বিরোধী ঐতিহ্য ও রীতিনীতির বিরুদ্ধাচরণ করবে। এটা শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে, তাদের মুখোশ ও ষড়যন্ত্র উন্মোচন করবে, ইসলামের চিন্তা ও হুকুমসমূহকে পরিষ্কার করে তুলে ধরবে, লোকদের এদিকে আহ্বান করবে ও তাদের জীবনে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমন্ত্রণ জানাবে।

রাসূলুল্লাহ (সা) নিরস্ত্র ও প্রতিরক্ষাহীন অবস্থায় এগুলো মোকাবেলা করেছেন এবং তখন কোন পক্ষ অবলম্বন করেননি, কারও প্রতি নতজানু হননি এবং কোন আপোষ করেননি। তিনি সব লোভনীয় প্রস্তাব ও হুমকিকে অবজ্ঞা করেছেন এবং ধৈর্য্যের সাথে তার প্রভূর পথের উপর অটল ছিলেন। কোরআন আমাদের এ ব্যাপারে অবহিত করেছে এবং এ কারণে দলটি যখন কাজ করবে তখন এ নির্দেশনা মেনে চলবে।

এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা) এর প্রতি আল্লাহ নাজিল করেন,

"অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয়" আয়াত থেকে নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, এর আগে দাওয়াত প্রকাশ্য ছিল না, বরং তা ছিল গোপনীয়-যা প্রকাশ্য দাওয়াতের পূর্বের ধাপ।

এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

'যাতে আপনি মক্কাবাসী ও পার্শ্ববর্তীদেরকে ভয় প্রদর্শন করেন।' (সূরা আল আনআম : ৯২)

এ আদেশ মক্কার বাইরে দাওয়াকে বিস্তৃত করবার নির্দেশনা প্রদান করে। পবিত্র কুরআন মোহাজেরীনদের হিজরত ও আনসারদের নুসরার ব্যাপারে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

সুতরাং কুরআন হল প্রথম নির্দেশিকা। মক্কীযুগে মুসলিমদের বর্ণণার বিষয়ে অসংখ্য হাদীস রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বুখারী 'কীভাবে নবী (সা) এবং তাঁর অনুসারীদের সাথে মক্কার মুশরিকরা আচরণ করেছিল'-শিরোনামে আলোচনা করেছেন। তিনি খাব্বাব বিন আল আরাতের (রা) হাদীস বর্ণণা করেন যখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) এর কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে প্রার্থনা করবার অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন যাতে মুসলিমগন বিজয় লাভ করে। তিনি কুরাইশ নেতাদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা) এর দোয়ার কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন নবী (সা) কীভাবে তায়েফের লোকদের দ্বারা নির্মম আচরনের শিকার হয়েছিলেন। আমরা হাদীসের অন্যান্য গ্রন্থেও এরকম বর্ণণা পাই। অতএব আমরা এমন কোন বিষয়ের হুকুম পালন করছি পারি না যার পক্ষে কোন বর্ণনা নেই।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সব সীরাত রচয়িতারা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য যা অন্যান্য চিন্তাবিদদের দ্বারা সমর্থিত।

- ইবনে ইসহাক (৮৫-১৫২ হিজরী) 'আল মাগাজী' (সামরিক অভিযান) নামে একটি বই লিখেন। আয জুহরী তার সর্ম্পকে বলেন, 'যে ব্যাক্তি মাগাজী (সামরিক অভিযান) সর্ম্পকে জানতে চায় সে যেন ইবনে ইসহাক পড়েন। শা'ফেঈ তার সর্ম্পকে বলেন, 'কেউ যদি মাগাজীর উপরে একজন বিশেষজ্ঞ হতে চান তিনি পুরোপুরি মুহম্মদ বিন ইসহাকের উপর নির্ভর করতে পারেন।' বুখারী তাকে তার তারিখ গ্রন্থে উল্লেখ করেন।

- ইবনে সাদ (১৬৮-২৩০ হিজরী) ও তার বই আত তাবাকাত (প্রজন্ম)। আল খতীব আল বাগদাদী তার সর্ম্পকে বলেন, 'আমাদের জন্য মুহম্মদ বিন সা'দ একজন বিশ্বাসভাজন লোক। কেননা বর্ণণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকেন বলে তার হাদীসসমূহ বিশ্বাসযোগ্য।' ইবনে খাল্লিকান বলেন, 'তিনি সৎ ও বিশ্বস্ত।' ইবনে হাজার তার সর্ম্পকে বলেন, 'তিনি ছিলেন অন্যতম একজন মহান ও নির্ভরযোগ্য হুফফাজ (যারা হাদীস মুখস্থ করেন) এবং সমালোচক।'

- আত তাবারী (২২৪-৩১০ হিজরী) লিখিত বইয়ের নাম 'রাসূলগণ ও রাজাদের ইতিহাস' (তারিখ আর রুসুল ওয়াল মুলুক)-যার মাধ্যমে তিনি ইসনাদ (বর্ণণার ধারাবাহিকতা) এর পদ্ধতি বিধৃত করেন। আল খতীব আল বাগদাদী তার সর্ম্পকে বলেন, 'তিনি সুনান (হাদীস), তাদের বর্ণণার ধারবাহিকতা, জাল হাদীস থেকে সহীহ হাদীস পৃথকীকরণ, লোকদের ইতিহাস ও খবারখবরের বিষয়ে ভাল জ্ঞান রাখতেন।' অধিকাংশ হাদীসের ক্ষেত্রে মুহাদ্দীসীনদের পদ্ধতি অনুসরণ করে তিনি তারিখ লিখেন। তিনি হাদীসের একটি বই সংকলন করেন, যার নাম 'তাহজীবুল আতাহার ওয়া তাফসীল আস সাবিত'আন রাসূলুল্লাহি (সা) মিনাল আখবার' (রাসূলুল্লাহ (সা) সর্ম্পকিত বর্ণণার পর্যালোচনা এবং প্রামাণিক তথ্যাদির বিস্তারিত আলোচনা)। ইবনে আসাকীর এ সর্ম্পকে বলেন, 'এটি একটি অসাধারণ বই, যেখানে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) এর প্রত্যেকটি প্রামাণিক হাদীস নিয়ে লিখেছেন।'

- একইভাবে ইবনে কাসীর এবং আয যাহাবীকে হাদীসের উপর বিশেষজ্ঞ ভাবা হয়।

কিছু মুসলিম ভাবে, এখনকার শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করাই হচ্ছে পরিবর্তনের পদ্ধতি যা অনুসরণ করতে আমরা বাধ্য

তারা দলীল হিসেবে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন না করলে 'অসৎ শাসক'দের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা) এর অস্ত্রধারণ করবার নির্দেশনার কথা উল্লেখ করেন।

এ অবস্থার প্রতিক্রিয়ায় বলতে চাই যে, অমত পোষণ করলেনও এ ধরনের চিন্তা যারা পোষণ করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এটুকু বলব যে, আলোচ্য হুকুমের মানাত (যে বাস্তবতার জন্য হুকুমটি এসেছে) বুঝতে পারলে হাদীসটি হৃদয়ঙ্গম করাও সহজতর হবে। এ হাদীসটি মূলত দার ঊল ইসলামের ইমাম এর বিষয়ে-যাকে আইনগতভাবে শরঈ বায়া'আত দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ মুসলিমদের বায়া'আতের মাধ্যমে তিনি একজন ইমাম হয়েছেন। আর এই ইমাম যে ভূমিকে শাসন করেন তাকে দার ঊল ইসলাম বলা হয়। অর্থাৎ এ ভূমি ইসলাম দ্বারা শাসিত হয় এবং এর নিরাপত্তা কেবলমাত্র মুসলিমদের হাতেই ন্যস্ত। মুসলিমগণ তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য। যদি সে শাসক আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা দিয়ে শাসন করবার ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করেন এবং প্রকাশ্যে কুফর আইন দিয়ে জনগনকে পরিচালনা করতে থাকেন-এমনকি যদি সেটি একটিও হুকুম হয় যে ব্যাপারে শুবহাত দলিলও বা শারী'য় দলিলের সাথে সাদৃশ্য খুজে পাওয়া না যায়-তখন প্রয়োজনে মুসলিমদের অস্ত্র ধারণ করে তাকে উৎখাত করতে হবে। নিম্নে বর্ণিত এ হাদীসটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এটি বর্ণণা করেছেন আউফ বিন মালিক আল আসযা'য়ী, যিনি বলেন,

'আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি, 'শাসকদের মধ্যে তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ যাদের তোমরা ভালবাস ও যারা তোমাদের ভালবাসে; যাদের জন্য তোমরা প্রার্থনা কর ও যারা তোমাদের জন্য প্রার্থনা করে এবং সবচেয়ে মন্দ শাসক হল তারাই যাদের তোমরা অভিশাপ দাও ও যারা তোমাদের অভিশাপ দেয়।' তারা বললো,' ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি তরবারীর বলে তাদেরকে অপসারন করব না?' তিনি বললেন-'না। যতক্ষন পর্যন্ত তারা তোমাদের মাঝে সালাত কায়েম রাখবে।" (মুসলিম)

এখানে সালাত কায়েম করা বলতে পুরো শরীয়াহ বাস্তবায়নকেই বুঝায়- 'বাব তাসমিয়াতুল কুল বি ইসমিল জুজা' (একটি অংশ বুঝানোর মাধ্যমে পুরো জিনিসটিকে বুঝানো)।

দার উল কুফরের শাসকদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতা। সে শাসক মুসলিমদের ইমাম নয়। কারণ সে শরীয়া পদ্ধতি অনুসারে শাসক হিসেবে আসীন হয়নি। বাধ্যবাধকতা হওয়া সত্তেও সে কখনোই ইসলামী আইন তাদের জীবনে বাস্তবায়ন করবার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেনি।

যখন আমরা বাস্তবতার দিকে তাকাই, তখন বুঝতে পারি এখন পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় অস্ত্র ধারণ করা যথেষ্ট নয়। এটা এখন কেবল শাসকদের পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা ইসলাম দ্বারা শাসন করার বিষয়। সুতরাং কে এই দায়িত্ব পালন করবে? এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষ ব্যক্তি ও একটি ইসলামী রাজনৈতিক মাধ্যম। ইসলাম দিয়ে শাসন করবার বিষয়টি এত সহজ নয় যে, এ দায়িত্ব কোন সেনাপ্রধান বহন করতে পারবেন, তিনি সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত দক্ষ হলেও ও ইসলামের দিক দিয়ে আন্তরিক হলেও। এর জন্য দরকার অভিজ্ঞতা, উপলদ্ধি, উদ্বুদ্ধকরণ এবং স্বাতন্ত্রমন্ডিত শরীয়ার জ্ঞান।

কেবল রাসূলুল্লাহ (সা) এর পদ্ধতি নীচের সব কিছু নিশ্চিত করে:

- ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তবায়নের আগে আসাধারণ মুসলিম রাজনীতিবিদ ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করে, যাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের দাওয়াতের অভিজ্ঞতা। যিনি কাফেরদের বিরুদ্ধে অপরাজেয় থাকবার জন্য কূটকৌশল ও সূক্ষ চিন্তার অধিকারী হয়ে উঠেন। তখন তিনি রাষ্ট্রটিকে রক্ষা করবার সক্ষমতা অর্জন করতে পারবেন ও বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে পথপ্রদর্শক ও পথপ্রদর্শিত, নব্যুয়তের আদলে খোলাফায়ে রাশেদীন হিসেবে পরিগণিত করতে পারবেন।

-এ পদ্ধতি আন্তরিক শাবাব তৈরি করে যারা রাষ্ট্র কায়েমের আগে দাওয়াতের বোঝা বহন করবে। দাওয়াতের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল অন্যান্য মুসলিমদের সাথে নিয়ে এই ইসলামী রাজনৈতিক মাধ্যম (Islamic political medium) থেকে এমন লোক তৈরি করবে যাদের মধ্য থেকে ওয়ালী (গভর্ণর), আমীরুল জিহাদ, প্রতিনিধি এবং অন্য রাষ্ট্রে ইসলাম নিয়ে যাবে এমন দাওয়াত বহনকারী হবেন।

- এটা এমন জনপ্রিয় ভিত্তি তৈরি করবে যারা ইসলাম ও রাষ্ট্রকে গ্রহণ (embrace) করবে এবং রক্ষা করবে।

- এটা সুপ্রশিক্ষিত ক্ষমতাধর লোক তৈরি করবে। সাধারণ জনগণ বিরুদ্ধাচরণ না করে তাদের সাথে থেকে শক্তি বৃদ্ধি করবে। কেননা তারা (জনগণ) বুঝতে পারবে শাসক, শাসনযন্ত্র এবং যে ক্ষমতার উপর তারা (শাসক) নির্ভর করে তা তাদের (জনগন) জন্য একটি শক্তি এবং এ এমন এক দায়িত্ব যা ইসলাম প্রয়োগ ও দ্বীনকে বুলন্দ করবার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নির্দেশ।

তাছাড়া সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য দরকার টাকা, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ। এটা আন্দোলনের জন্য অতিরিক্ত বোঝা হয়ে যাবে-যা অন্যদের উপর নির্ভরশীল হতে প্ররোচিত করবে। এটাই ব্যর্থতার প্রথম সোপান। মুসলিমগন এ পথে প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং নিজেদের অনেক ক্ষতিসাধন করেছে। এটা আর উল্লেখের প্রয়োজন নেই যে, 'চেষ্টা করে দেখা যাক' (try out) একটি ভ্রমাত্বক অভিব্যক্তি।

যখন আমরা বলি অস্ত্রধারণ করা শরঈ পদ্ধতি নয়, তখন মোটেও সেইসব শাসকদের ছাড় দেয়া হয় না যারা মুসলিমদের তোয়াক্কা করে না। বরং আমরা দ্বীনের ভেতর কিছু আন্তরিক ভাইদের তাদের বর্তমান কাজকে পরিত্যাগ করতে বলি যাতে তাদের প্রচেষ্টাকে শরঈ কাজে একীভূত করতে পারি। আমরা তাদের মক্কীযুগে কিছু সাহাবীর অস্ত্র ধারণ করা বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিষেধাজ্ঞা মনে করিয়ে দিতে চাই, যখন তিনি (সা) বলেছিলেন,

'আমি ক্ষমা করবার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, সুতরাং যুদ্ধ করো না।' (সীরাত ইবনে হিশাম)

এছাড়া আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কোরআনে নাজিল করেন যে,

'তুমি কি সেসব লোককে দেখনি, যাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তোমরা নিজেদের হাতকে সংযত রাখ, নামায কায়েম কর এবং যাকাত দিতে থাক? অতঃপর যখন তাদের প্রতি জেহাদের নির্দেশ দেয়া হল.....।' (সূরা নিসা:৭৭)

একইভাবে আমরা আরও শক্তিশালী শরঈ দলিল দেখাতে পারব যার মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে বলা সম্ভব যে, দাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) এর পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এর সাথে কোন কিছু যুক্ত করা, বাদ দেয়া, পরিবর্তন করা, সংশোধন দাওয়াত, দল ও ইসলামি উম্মাহের উপর কুপ্রভাব ফেলবে। নবী (সা) এর সুন্নাহকে পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের জন্য এ কারণে শরী'আর সঠিক অধ্যয়ন ও রাসূলুল্লাহ (সা) এর পদ্ধতির আনুগত্য করার উপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। এটা কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্য যিনি আমাদের সঠিক পথ দেখান।


Please note that this is a draft translation. It is likely to go through further edits. So, we would suggest not to spread this widely or publish this anywhere online for the time being.

Link for English translation of the book 'Dawah to Islam'