বুধবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত থাকা বাধ্যতামূলক এবং সঠিক ইসলামী দল বা আন্দোলন এর ধরণ

ইসলাম দিয়ে আমাদের ব্যক্তিগতসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন চালানো ফরয একথা বোঝার পর একজন মুসলমানের পক্ষে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা ছাড়া উপায়ন্তর নেই। কিন্তু কারো একক প্রচেষ্টায় বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা অপসারণ করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়বরং একাধিক লোকের একটি দল মিলেই একাজ করতে হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠায় রাসূলূল্লাহ(সাঃ) দেখানো পদ্ধতিতে একটি দল গঠন করা বা অনুরূপ একটি আন্দোলনরত দলের সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা একজন মুসলমানের জন্য একটি আবশ্যিক বিষয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

তোমাদের মাঝে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যানের প্রতি আহ্বান করবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দিবে আর অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং এরাই সফলকাম [সূরা আলি ইমরান: ১০৪]

উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন যেন তাদের মাঝে অবশ্যই এমন একটি সুসংগঠিত দল থাকে, যে দল নিম্মোক্ত দুটি কাজ সম্পাদন করবে:

        ১. খায়ের তথা ইসলামের প্রতি আহ্বান করা।
        ২. আমর বিল মারূফ এবং নাহি আনিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ) করা।

এই দলটি এই দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনৈতিক দল যে, আলোচ্য আয়াতটি মুসলমানদের নিকট এমন একটি দল গঠন করার দাবী করেছে, যে দলের কাজ হবে ইসলামের প্রতি মানুষকে আহ্বান করা এবং আমর বিল মারূফ আর নাহি আনিল মুনকার করা। একাজের মধ্যে শাসকদেরকে ভাল কাজ করতে বলা এবং মন্দকাজ থেকে বিরত রাখাও শামিল। বরং, শাসকদেরকে কাজ কর্মের ব্যাপারে ভাল-মন্দের হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা এবং তাদেরকে উপদেশ দেয়াই সবচেয়ে বড় আমর বিল মারূফ এবং নাহি আনিল মুনকার। আর এটিই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কাজ। বস্তুতঃ একাজটি হচ্ছে কোন রাজনৈতিক দলের মূল কাজ সমুহের একটি। সুতরাং এটা প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক ধাঁচের দল গঠন করা ফরয। তাছাড়া রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক পদ্ধতি ছাড়া একটি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে আরেকটি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কাজেই একজন মুসলমানের জন্য একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা বা কোন দলটি সঠিক অর্থাৎ ইসলামী চিন্তা ও পদ্ধতির উপর কাজ করছে, সেটা খুঁজে বের করে উক্ত দলের সাথে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জড়ানো একটি আবশ্যিক বিষয়।

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইসলাম প্রতিষ্ঠার যে পদ্ধতি আমাদের দেখিয়ে গেছেন তাতে প্রম ধাপ ছিলো একটি দল গঠন। তিনি একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন না বরং ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। যদি কারো সাহায্য ছাড়া একাই ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো তবে তাঁর পক্ষেই এটা সম্ভব ছিল। তথাপি তিনি সাহাবাদের (রা.) একটি দলের মাধ্যমে সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। এ থেকেই একটি দল গঠন ও দলের সাথে কাজ করার আবশ্যকতা বোঝা যায়।

আসলে এটা সাধারণ বুদ্ধিরই দাবী যে, একা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আবার ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ না করে বসে থাকাও ইসলাম অনুমোদন করেনি। তাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সঠিক ইসলামী দল বা আন্দোলন খুঁজে বের করে অবিলম্বে তাতে যোগদান করতে হবে।

সঠিক ইসলামী দল বা আন্দোলন এর ধরণ

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব এবং এ লক্ষ্যে একটি দলে যোগদানের আবশ্যকতা বোঝার পর আমাদেরকে সঠিক ইসলামী আন্দোলনের ধরণ ও প্রকৃতি বুঝতে হবে। তাহলে আমরা শত দলের মাঝেও সঠিক ইসলামী আন্দোলনকে চিহ্নিত করতে পারবো।

প্রথমতঃ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা দলটির একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে। দলের সমস্ত চিন্তাভাবনা ও ধ্যান-ধারণা ইসলামের ভিত্তিতে হবে। দলের মূলনীতি বা শাখা-প্রশাখা কোন ক্ষেত্রেই ইসলাম ছাড়া অন্য কোন উৎস থেকে গৃহীত কোন চিন্তা থাকতে পারবে না।

দ্বিতীয়তঃ দলটি অবশ্যই হতে হবে একটি রাজনৈতিক দল কেননা আন্দোলন ছাড়া ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যেহেতু আন্দোলন হচ্ছে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। অতএব, স্বাভাবিকভাবেই দলটি হবে একটি রাজনৈতিক দল। দলটির আহ্বান হবে সামগ্রিক ইসলামের দিকে, স্রেফ ইসলামের সুনির্দিষ্ট দুএকটি বিষয়ের দিকে নয়। এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন সর্বত্র দলটিকে এই আহ্বান ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এটাই করেছেন। অতএব, যে দল রাজনৈতিক দল নয় এবং ইসলামকে প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বর্জন করে অথবা কেবল সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ইসলামী ইবাদতের দিকে ডাকে, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার দিকে ডাকে না- সেটি সঠিক ইসলামী দল হবে না। অনুরূপে কেবল সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে নিয়োজিত দল বা কেবল বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ইসলামের চর্চাকারী ও প্রচারকারী দল ইত্যাদি সঠিক ইসলামী দল হবে না কেননা তারা রাজনৈতিক সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পথকে পরিহার করেছে।

তৃতীয়তঃ ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দলটির সকল কার্যক্রম ও আন্দোলনের পদ্ধতি হতে হবে শুধুমাত্র ইসলামের ভিত্তিতে এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দেখানো পথে । রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আমাদেরকে একটি অনৈসলামী সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পদ্ধতি দেখিয়ে গেছেন। দলটিকে পুরোপুরি সেই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। যুগের দোহাই বা কৌশলের অজুহাতে এমন কোন পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া চলবেনা যা ইসলাম অনুমোদন করে না। যেমন: দলটি কোন গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার অধীনে শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না, যেহেতু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ইসলাম অনুমোদন করে না। অনুরূপে দলটির জঙ্গী কার্যক্রমের আশ্রয় নেয়াও চলবে না যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে অস্ত্র ব্যবহারের কোন পদক্ষেপ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) নেননি। তিনি যেসব যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন সবই ছিলো মদীনাতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর। কাজেই কোন দল উপরোক্ত পদ্ধতিগুলোর আশ্রয় নিলে সেটা সঠিক ইসলামী আন্দোলন হবে না।

চতুর্থতঃ আন্দোলনের পথে দলটি হতে হবে আপোষহীন। কোন ভয় বা প্রলোভনে আন্দোলনের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতির কোন দৃষ্টান্ত তাদের থাকতে পারবেনা। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর ও তাঁর সাহাবীদের (রা.) উপর শত জুলুম-নির্যাতন সত্ত্বেও ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তিনি কখনো কোন আপোষ করেননি। বরং আপোষরফার প্রস্তাব পেয়ে তিনি বলেছিলেন, তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চন্দ্র এনে দিতো যাতে আমি এই কাজ পরিত্যাগ করি তবু আমি তা পরিত্যাগ করতাম না যতক্ষণ না আল্লাহ একাজকে সফল ও জয়যুক্ত করেন অথবা আমি একাজ করতে করতে শহীদ হয়ে যাই।

তিনি (সাঃ) আরো বলেন, জালিম শাসকের সামনে হক কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ।

অতএব দলটি শাসকগোষ্ঠীর শত জুলুমের সামনেও মাথা নত করবেনা এবং আপোষহীন ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সঠিক পথে তার আন্দোলন চালিয়ে যাবে। অনুরূপভাব, কোন লোভে পড়ে বা সংসদে দুএকটি আসনের লোভেও সে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসবেনা। ইসলাম প্রতিষ্ঠা না হওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত এই আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া হবে সেই দলের সত্যতার চিহ্ন।

পঞ্চমতঃ দলটি ইসলামের সত্যিকার শত্রু অর্থাৎ ইহুদী-খ্রীষ্টান-মুশরিক রাষ্ট্রগুলো এবং তাদের ইসলাম বিদ্বেষী ও সাম্রাজ্যবাদী প্রকৃতিকে চিহ্নিত করবে। মুসলিম ভূমিগুলোতে তাদের সকল চক্রান্তকে উম্মোচন করে দিবে এবং এসবের বিরুদ্ধে উম্মাহকে সচেতন করার পাশাপাশি নিজেরা এসবের বিরুদ্ধে কঠোর রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। কেননা, এরাই ইসলামকে পৃথিবীতে বিজয়ী করার পথে প্রধান শত্রু এবং মুসলিম দেশে বসিয়ে রাখা জালিম শাসকরা এদেরই এজেন্ট। অতএব, একটি সঠিক আন্দোলন আমেরিকা-বৃটেন-ইসরাইল-ভারত ও অনুরূপ কাফের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে কখনই মুসলমানদের বন্ধু মনে করবে না বরং শত্রু মনে করবে। তাই যে দল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এসব রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক রাখবে অথবা মুসলিম ভূমিতে তাদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকবে তা সঠিক ইসলামী দল হতে পারে না।

ষষ্ঠতঃ ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তব রূপরেখা সম্পর্কে দলটির সুস্পষ্ট ধারণা থাকবে যাতে করে আল্লাহ্ প্রদত্ত বিজয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করা মাত্র তারা অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা সবকিছু ইসলামের ভিত্তিতে ঢেলে সাজাতে ও পরিচালনা করতে পারে। কেবল ইসলামী আবেগ নির্ভর কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তুব রূপরেখা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণাবিহীন কোন দল সঠিক ইসলামী দল হতে পারে না।

যে কেউ উপরোক্ত মাপকাঠির ভিত্তিতে পূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে যাচাই করবে তার পক্ষে সঠিক ইসলামী আন্দোলন ও সেই আন্দোলন পরিচালনাকারী দলকে চিহ্নিত করা কঠিন হবে না।

কৃষিতে ইসলামের অবদান

কৃষি হচ্ছে মূলত উদ্ভিদ ও প্রাণী থেকে খাদ্য এবং তন্তু উৎপাদনের বা সংগ্রহের সুসংগঠিত পদ্ধতি। মানবসভ্যতার ইতিহাসে কৃষি সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, কারণ বিশ্বব্যাপী আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কৃষিব্যবস্থার অগ্রগতি অন্যতম প্রধান নিয়ামক। শিল্পবিপ্লবের আগ পর্যন্ত পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিল। নিত্যনতুন কলাকৌশল উদ্ভাবন এবং প্রয়োগের ফলে কৃষিজ উৎপাদন বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ সমস্ত কলাকৌশল নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

বর্তমানে অনেক বিষয় কৃষির অন্তর্ভুক্ত, এর প্রধান বিষয়গুলো হচ্ছে-

- কৃষিবিদ্যা (চারা উৎপাদন, রোপণ এবং ফসল সংগ্রহ)
- পশুপালন বিদ্যা
- মৎস্যবিজ্ঞান
- উদ্যানপালন বিদ্যা (স্বল্প পরিসরে ফুল, ফল, সবজি চাষ)

এ সমস্ত বিষয়ের প্রত্যেকটিরই আবার অনেকগুলো শাখা রয়েছে; যেমন কৃষিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম চাষাবাদ পদ্ধতি, পশুপালনবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত  রেঞ্ছিং  (নির্দিষ্ট একটি প্রজাতির পশুপালন পদ্ধতি)। কৃষিবিদ্যার উন্নয়ন এবং বিবর্তনের ফলে নতুন অনেক কৃষিপন্য তৈরি হয়েছে যেমন: পশুখাদ্য (স্টার্চ, স্যুগার, এলকোহল ও রেজিন), তন্তু (তুলা, পশম, শন) , ফ্লাক্স (লিলেন কাপড় তৈরিতে ব্যবহৃত) এবং রেশম জ্বালানি (জৈবপণ্যজাত মিথেন, ইথানল, বায়োডিজেল), পাতাবাহার, কাটফ্লাওয়ার (কাটার অনেকক্ষণ পরেও সতেজ থাকে এমন ফুল) এবং অন্যান্য নার্সারীর উদ্ভিদ।

১৯৯৬ সালের এক হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় ৪২% শ্রমিক কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিল যা ২০০৬ সাল নাগাদ কমে ৩৬% এ দাঁড়ায়। শিল্পায়নের ব্যাপক প্রসারের ফলে পৃথিবীর সর্বাধিক পরিচিত এ পেশার আপেক্ষিক গুরুত্ব দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে এবং নিয়োজিত শ্রমিকের সংখার দিক থেকে ২০০৬ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মত পৃথিবীতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে কৃষিখাতকে টপকে যায় সেবাখাত। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে মোট জিডিপির পাঁচ শতাংশেরও কম আসে কৃষিখাত থেকে।

ইতিহাস: কৃষিক্ষেত্রে ইসলাম

অনেক ঐতিহাসিকের মতে বৈশ্বিক অর্থনীতির সূচনা হয় মুসলিম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে; যার ফলে অনেক খাদ্যশস্য এবং কৃষি প্রযুক্তি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে; পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের বাইরে থেকেও অনেক খাদ্যশস্য এবং কৃষিপ্রযুক্তি মুসলিম বিশ্বে আসে। আফ্রিকা, চীন এবং ভারত থেকে প্রচুর খাদ্যশস্য মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অংশে আনা হতো। এই সময়ে বিপুল পরিমান খাদ্যশস্যের যে স্থানান্তর ঘটে সেটাকে অনেক লেখক খাদ্যশস্যের বিশ্বায়ন বলে অভিহিত করেছেন।

৭৫০ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয়রা যখন খিলাফতের শাসনভার গ্রহণ করেন তখন তারা দামেস্ক থেকে মধ্য মেসোপটেমিয়ার ছোট্ট সাসানিয় শহর (মুসলিমদের অধীনে আসার আগে পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত) বাগদাদে খিলাফতের রাজধানী স্থানান্তর করেন। ইউরোপের শহর, নগর এবং অন্যান্য স্থাপনাগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে সেগুলো ডাকাত এবং অন্য সাম্রাজ্যের সেনা অভিযান থেকে সুরক্ষিত থাকে, কিন্তু বাস্তবে সেগুলো চার কোনায় খুব দুর্বল ছিল। যদি দেয়ালের এই চার কোণায় পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ করা যায়, তাহলে সেগুলো ভেঙ্গে যাবে এবং যোদ্ধারা সহজেই সেই ফাটল দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে। সর্বপ্রথম বৃত্তাকার শহরে বাগদাদকে রূপান্তরিত করে আব্বাসীয়রা এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন।

আব্বাসীয় খলিফা আল মানসুর (৭৫৪-৭৫ খ্রিঃ)  নতুন রাজধানীকে বৃত্তাকার দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টিত করে ফেলেন। খিলাফতের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন সরকারী কাজের জন্য এবং ব্যবসার তাগিদে রাজধানীতে আস্তে লাগলো, যার ফলে ৫০ বছরের মধ্যে বাগদাদের জনসংখ্যা প্রচন্ড পরিমাণে বেড়ে যায়। এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরের সংযোগকারী একটি বৃহৎ ব্যবসাকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয় বাগদাদ। খলীফা হারুন-আর রশীদের (খলিফা মনসুরের দৌহিত্র) সময়কালে (৭৮৬-৮০৬) বাগদাদ কন্সটান্টিনোপলের পরে দ্বিতীয় বৃহৎ নগরীতে পরিণত হয়।

বাগদাদের নিরপত্তা নিশ্চিত করার পর আব্বাসীয়রা ভাবতে লাগলো কিভাবে খিলাফতের বিপুল পরিমাণ জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। আব্বাসীয়দের সময়ে কৃষিব্যবস্থার উন্নতি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ পানির অভাবে মরুভূমিতে পরিণত হওয়া শুষ্ক আরব ভূমিতে কখনোই পর্যাপ্ত পরিমাণ ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। নিজেদের ভূখন্ডে উৎপাদিত খেজুর এবং সামান্য পরিমাণ খাদ্যশস্য পর্যাপ্ত ছিলনা বলে খাদ্যের পরিমাণ পর্যাপ্ত করতে বাইরে থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হতে। সেসময় আরবের চাষাবাদ শুধুমাত্র সেসব জায়গাতেই সীমাবদ্ধ ছিল যেখানে পানির প্রাকৃতিক উৎস বিদ্যমান ছিল। তাছাড়া চাষাবাদ হতো অত্যন্ত প্রাচীন পদ্ধতিতে। এই বিস্তৃত মরুভূমিতে কেবলমাত্র মদীনাই ছিল ঝরণা এবং কূপসমৃদ্ধ সবুজ অঞ্চল। তাইগ্রিস এবং ইউফ্রেতিস নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আব্বাসীয়রা এই সমস্যার সমাধান করেছিল। অসংখ খাল খননের ফলে জমিসেচ পদ্ধতির প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছিল। এসমস্ত খালের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ ছিল তাইগ্রিস এবং ইউফ্রিতিসের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত নহরে ইসা (ইসা খাল) যা ইরাক এবং সিরিয়ার মধ্যে নৌ-যোগাযোগের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এর ফলে ভারত এবং পারস্য উপসাগরের সাথে নৌ যোগাযোগের পথ সুগম হয়। ৭০২ খ্রিস্টাব্দে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সময়ে নির্মিত খাল, হ্রদ এবং অন্যান্য জলাধারগুলোর সংস্কার সাধন করে আব্বাসীয়রা।

এরপরে তারা বাগদাদের চারপাশের জলাশয়গুলোকে পরিষ্কারের মাধ্যমে নগরীকে ম্যালেরিয়ামুক্ত করল। মুসলিম প্রকৌশলীরা জলচাকার (পানির গতিশক্তিকে ঘূর্ণায়মান শক্তিতে রুপান্তরকারী যা পূর্বে জমিসেচের জন্য ব্যবহৃত পানি উত্তোলনকারী যন্ত্রে প্রয়োগ করা হত) উৎকর্ষ সাধন করল এবং কানাত নামের অনেকগুল বৃহদাকারের ভূ নিন্মস্থ পানির চ্যানেল তৈরি করল। অত্যন্ত উঁচুমানের প্রকৌশলবিদ্যা প্রয়োগ করে কানাতগুলো তৈরি করা হয়েছিল যেগুলো সামান্য কোণে হেলানো অবস্থায় অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল মাটির প্রায় পঞ্চাশ ফুট গভীর পর্যন্ত; যার মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ পানি সংগ্রহ করা হতো। এগুলোকে পরিষ্কার এবং সংস্কার করার জন্য ম্যানহোলও সরবরাহ করা হয়েছিল।

এসমস্ত উন্নয়নের ফলে আব্বাসীয়দের সময়ে কৃষিব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটল যার সুফল অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সঞ্চারিত হল। তখন ব্যবসা এবং জমির খাজনা থেকে প্রচুর সম্পদ আয় করেছিল আব্বাসীয় খিলাফত। আব্বাসীয়দের অধীনে ব্যবসায়ীক কর্মকান্ডের যে বিস্তৃতি ঘটেছিল তার প্রভাব অন্যান্য ক্ষেত্রেও সঞ্চারিত হয়েছিল; যেমন ব্যবসায়িক চাহিদার কারণে হস্তশিল্পের প্রসার ঘটেছিল। জনবহুল বাগদাদ নগরীতে বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পী যেমন ধাতুর কাজ, চামড়ার কাজ, বই বাঁধাই করা, কাগজ তৈরি করা, স্বর্ণকার, দর্জি, ঔষধ প্রস্তুত করা, বেকারীর কাজ এবং আরো অনেক ধরনের কাজের জন্য প্রচুর হস্তশিল্পীর উদ্ভব ঘটেছিল। যেহেতু এ সমস্ত হস্তশিল্পীর কাজ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাই তারা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে সামাজিকভাবে সংগঠিত হয়েছিল যা পরবর্তীতে পাশ্চাত্যে গিল্ডের (সংঘ) জন্ম দেয়।

কৃষিতে উন্নয়নের ফলে উদ্যানপালনবিদ্যায় ও ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। ১০০ বছরের মধ্যে বাগদাদ এবং তার পার্শবর্তী অঞ্চলগুলো প্রকৃত বাগানের রূপধারণ করল; বাগদাদ এবং কুফার মধ্যবর্তী অঞ্চল, উন্নয়নশীল শহর, উন্নত গ্রাম এবং সুন্দর উপত্যকায় পরিণত হল। বার্লি, ধান, গম, খেজুর, তুলা, তিল এবং শন প্রভৃতি ছিল ইরাকের প্রধান শস্য। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফলের চাষ হতো এবং ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের ফলের উৎপাদন হতো।

আব্বাসীয়দের সময়ে ভূমধ্যসাগরের ব্যবহার দেখে মনে হতো যেন এটি একটি ইসলামী হ্রদ। ভূমধ্যসাগর এবং এর গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপসমূহ যেমন সিসিলি, ক্রীট, সাইপ্রাস এবং ব্যালেয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ যেগুলো ইসলামী ভূখন্ড দ্বারা তিনদিক থেকে পরিবেষ্টিত ছিল, সেগুলো মুসলিম ওয়ালীদের (খিলাফতের বিভিন্ন প্রদেশের শাসকবর্গ) দ্বারা শাসিত হতো। তিউনিস, আলেকজান্দ্রিয়া, কাদিস এবং বার্সিলোনা প্রভৃতি বন্দর পাশ্চাত্যের সাথে আব্বাসীয়দের সম্প্রসারণশীল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল।

ইসলামের অবদান:

চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মুসলিমদের অবদান কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লবের সুচনা করেছিল:

১) বিভিন্ন মেশিনে যেমন নোরিয়াস, পানির মিল, পানি উত্তোলনকারী যন্ত্র, বাঁধ এবং জলাধার প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত জমিসেচ পদ্বতির সূচনা।  এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মুসলিমরা একদিকে জমির উৎকর্ষ সাধন করেছিল এবং অন্যদিকে অনেক নতুন ভুমিকে কৃষিকার্যের আওতায় নিয়ে এসেছিল।

২) সমগ্র পৃথিবী থেকে কৃষি সম্পর্কিত জ্ঞান সংগ্রহ এবং তুলনামুলক যাচাইয়ের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূচনা করে মুসলিমরা, যার ফলে উন্নত কৃষিপ্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু হয়। বিভিন্ন খাদ্যশস্য কোথায়, কখন এবং কিভাবে উৎপাদন বা রোপণ করতে হবে সে সম্পর্কিত বিস্তারিত কৃষি নির্দেশনার অনুসরণ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র শুরু হয়। উন্নত কৃষি প্রযুক্তি দ্বারা বিভিন্ন মুসলিম বিজ্ঞানী যেমন ইবন আল বাইতারকে নতুন শস্য, বীজ এবং গৃহপালিত পশুর নতুন প্রজাতির উদ্ভাবনে সাহায্য করে, যেগুলো আগে অপরিচিত ছিল। উদ্ভিদবিদ্যার উপর প্রচুর এন্সাইক্লোপিডিয়া রচিত হয় যেগুলো অত্যন্ত উচ্চমানের এবং বিস্তারিত বর্ণনাসংবলিত। আরবীয় রন্ধনপ্রণালীর উপরেও প্রাথমিক বই রচিত হয়েছিল যেমন ইবন সাইয়ি আল-ওয়ারাক (১০ম শতাব্দি) রচিত কিতাব আল তারিখ (বিশেষ খাদ্যের বই) এবং  মুহাম্মদ ইবন হাসান আল বাগদাদী (১২২৬ খ্রিঃ) রচিত কিতাব আল তারিখ।

৩) ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতির পাশাপাশি জমির মালিকানার, শ্রমআইন এবং বর্গাচাষের সূচনা হয় যার ফলে কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত হওয়ার মত অনেক বড় ক্ষেত্রের সুযোগ হয়। অথচ ইউরোপে তখন সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল যেখানে ক্ষুদ্র চাষীরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সামান্য আশা নিয়ে দাসের মত কঠোর পরিশ্রম করত।

৪) খিলাফতের অধীনে প্রচুর নতুন শস্যের প্রচলন ঘটেছিল যেগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ের কৃষিকে একটি আন্তর্জাতিক শিল্পে পরিবর্তিত করে। কৃষিপণ্য তখন ইউরোপসহ অন্যান্য জায়গায় রপ্তানি হতো, ইউরোপের কৃষিকার্য তখন মধ্য এশিয়া হয়ে আসা গমের কিছু প্রজাতির মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ ছিল। ইসলামী স্পেন তখন অনেক নতুন গাছ, ফল ও সবজির পাশাপাশি প্রচুর কৃষি ও ফল উৎপাদন পদ্ধতি ও ইউরোপে রপ্তানি করে। এসমস্ত নতুন শস্যের মধ্যে ছিল আখ, ধান, সাইট্রাস ফলসমূহ (কমলা, লেবু, লাইম, আংগুর প্রভৃতি ফলসমূহ) এপ্রিকট (কুলজাতীয় ফলবিশেষ যা সবজি হিসেবে খাওয়া যায়) এবং স্যাফ্রন। ইউরোপে বিভিন্ন দেশীয় লেবু, কমলা, তুলা, বাদাম, ডুমুর এবং সাব-ট্রপিক্যাল (প্রায় গ্রীষ্মপ্রধান) ফলসমূহ যেমন কলা ও আখ প্রভৃতি শস্যের পরিচিতি ঘটায় মুসলিমরা।

আজকের মুসলিম বিশ্ব:

দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যা, বিশ্বব্যাংক ২০০৬

বাংলাদেশ
৫০%
ইরান
৪০%
পাকিস্তান
৩৩%
জর্দান
৩০%
ইন্দোনেশিয়া
২৭%
তুর্কী
২০%
মিশর
২০%
সিরিয়া
১২%

প্রযুক্তিগত দিক থেকে এবং মুসলিম উম্মাহ্ চাহিদা পূরণের দিক থেকে যে মুসলিম বিশ্ব ছিল সর্বাগ্রে, দুর্ভাগ্যবশত সেই মুসলিম বিশ্ব হচ্ছে আজ কিছু দরিদ্রতম রাষ্ট্রের সমষ্টি। এমনকি জনগনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার মত প্রয়োজনীয় কাঠামোও আজ মুসলিমদের হাতে নেই। মুসলিম বিশ্বের সম্পদ চরম অব্যবস্থাপনা  এবং প্রচন্ড অসম বন্টনের শিকার। মধ্যপ্রাচ্য পৃথিবীর সবচাইতে বড় তেল মজুদক্ষেত্র হওয়া সত্বেও এর বিপুল রাজস্ব আয়ের মাত্র সামান্য অংশই জনগন ভোগ করে থাকে। এখনো আরব বিশ্বের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের দৈনিক মাথাপিছু আয় ২ ডলারের কম। এমনকি গত ২০ বছরে গড় মাথাপিছু বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ০.৫% যা আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চল ছাড়া পৃথিবীর অন্য যে কোন অংশের চাইতে কম। পাকিস্তানে মাত্র ২৩ টি পরিবারের হাতে দেশের ৪০% জমির মালিকানা। মুসলিম বিশ্বের বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় অবকাঠামোগত এবং জনসেবা খাতে সরকারী বিনিয়োগের পরিমান খুবই কম।

আজকের বিস্ময়কর বাস্তবতা হচ্ছে তুরস্ক পৃথিবীর দশম বৃহৎ কৃষি উৎপাদনকারী (৪০ বিলিয়ন ডলার), পাকিস্তান পঞ্চদশতম বৃহৎ (১৫ বিলিয়ন ডলার), ইরান একবিংশতম বৃহৎ (২১ বিলিয়ন ডলার) এবং বাংলাদেশ সপ্তবিংশতম বৃহৎ (১৩ বিলিয়ন ডলার) বার্ষিক কৃষি উৎপাদনকারী দেশ। যে সমস্ত কৃষিপন্য উৎপাদনে মুসলিম বিশ্ব শীর্ষস্থানে আছে সেগুলো হল:

আলজেরিয়া
শিম/বরবটি
বাংলাদেশ
ছাগদুগ্ধ
মিশর
খেজুর
ইন্দোনেশিয়া
দারুচিনি, নারিকেল, লবঙ্গ, জায়ফল এবং এলাচি
ইরান
বেরীফল এবং পেস্তা
মালয়েশিয়া
হাঁসের গোশ্ত
পাকিস্তান
ঘি
সৌদি আরব
ঊটদুগ্ধ
সুদান
ঊটের গোশ্ত
তুরস্ক
হেজেল্বাদাম, দুমুরফল, এপ্রিকট, (কুলজাতীয় ফলবিশেষ), চেরিফল, কুইন্সফল এবং ডালিম

এইসমস্ত দেশগুলি যদি তাদের অতীত ইতিহাস দেখে, তাহলে বুঝতে পারবে যে কিভাবে সম্পদ এবং পণ্যের সুষম বন্টনের মাধ্যমে ইসলাম অতীতে দারিদ্র্যকে ইতিহাসের জাদুঘরে নিক্ষেপ করেছিল।

ইসলাম কি বর্তমানে অঁচল?

গত দেড়শ বছরে মুসলিম বিশ্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তেমন কোন অবদান রাখতে পারেনি। পাশ্চাত্যজগৎ একদিকে নিজেদেরকে শিল্পায়ীত করেছে এবং অন্যদিকে মুসলিম বিশ্ব ছিল অত্যন্ত পশ্চাদপদ এবং পাশ্চাত্যের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নতি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ। মুসলিম বিশ্বের এই ব্যর্থতার কারণ অনেক চিন্তাবিদের মতে ইসলামী শরীয়া তখনকার যুগেই সামঞ্জস্যপূর্ন ছিল যখন অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর এবং আজকের শিল্পযুগে ইসলাম অকার্যকর। তাদের মতে আধুনিক বিশ্বে ইসলামের পক্ষে অবদান রাখার অসম্ভব এবং এর ফলে মুসলিমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে।

এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই যে অতীতে ইসলাম প্রচন্ড অগ্রগতি লাভ করেছিল এবং প্রায় চার শতাব্দীজুড়ে পৃথিবিতে একক পরাশক্তিরূপে বিদ্যমান ছিল। খিলাফতের প্রসারের ফলে কৃষিক্ষেত্রে প্রচুর উন্নতি সাধিত হয়েছিল যা ছিল সেসময় অধিকাংশ অর্থনীতিরই প্রধান ক্ষেত্র। যে বিষয়টা লক্ষণীয় সেটা হচ্ছে ইসলামকে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের পথ ধরেই মুসলিমরা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিল পৃথিবীতে, কিন্তু উসমানীয় খিলাফতকালে ইসলামকে বোঝার ক্ষেত্রে মুসলিমদের অধোগতির ফলে মুসলিমরা প্রযুক্তির ব্যাপারে ভুল ধারণা পোষণ করেছিল।

এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম নয় বরং ইসলামের অনপস্থিতিই সমস্যার সূচনা করেছিল এর, যার ফলে  মুসলিমরা পশ্চাৎপদ হতে শরু করল। ইসলাম আধুনিক উন্নয়নের ধ্যান-ধারণার বিরোধী নয়, বরং আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে ধারণ করতে অধিক সক্ষম।

সবধরনের পদার্থ যার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শিল্প প্রভৃতির বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এগুলো নিছকই বাস্তবতা এবং এবমস্ত বাস্তব বিষয়ের জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে কিভাবে মানুষের অবস্থা এবং জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো যায় সেটা নিশ্চিত করা। বিজ্ঞান এবং এর অন্যান্য শাখার ব্যাপারে এটাই ইসলামের মত।

ইসলামী শরীয়াহ বিষয়টিকে অনেকবার উপস্থাপন করেছে:

তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু যমীনে রয়েছে সে সমস্ত। [সূরা বাকারাহ: ২৯]

তোমরা কি দেখনা আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। [সূরা লোকমান: ২০]
 
যে পবিত্রসত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদস্বরূপ করে দিয়েছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসেবে। [সূরা বাক্কারাহ: ২২]

আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং এর দ্বারা বাগান ও শস্য উদগত করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয় এবং লম্বমান খর্জুর বৃক্ষ যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খর্জুর, বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ এবং বৃষ্টি দ্বারা আমি মৃত জনপদকে সঞ্জীবিত করি......। [সূরা ক্বাফ: ৯-১১]

এই দলীলগুলো পৃথিবীর উপরে এবং অভ্যন্তরে যে সমস্ত বস্তু আছে সেগুলো ব্যবহারের সাধারণ অনুমোদন দেয়। এখান থেকে যে ইসলামী নীতিটি গ্রহণ করা হয় সেটা হল: সমস্ত বস্তুই (things) অনুমোদিত যতক্ষন না শরীয়াহ দ্বারা সেটা নিষিদ্ধ প্রমাণিত হচ্ছে।

ইসলামের প্রথমিক দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে সমস্ত বস্তুই অনুমোদিত যদিও সেগুলোর ব্যবহার সীমাবদ্ধ কারণ প্রত্যেক কাজ (action) এর জন্যই শরীয়া প্রমাণ থাকা প্রয়োজন। উদাহরনস্বরুপ আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক মিসাইল (ICBM)। ইসলামে অনুমোদিত, কিন্তু এর ব্যবহারের জন্য শরীয়তের জ্ঞান থাকা আবশ্যক। ICBM এর ব্যবহার কেবল তখনই বৈধ বলে অনুমোদিত হবে যখন ইসলাম নিষেধ করেছে এমন নিরীহ লোকজনকে মিসাইল থেকে বাঁচানোর মতপ্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকবে। চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশল, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা যেগুলোর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ইন্টারনেট, জলযানবিদ্যা ও ভূগোল প্রভৃতি বিষয়, পাশাপাশি এগুলো থেকে উদ্ভূত যন্ত্রপাতি, ফ্যাক্টরী ও শিল্প তা  সামরিক হোক বা বেসামরিক, হাল্কা বা ভারী শিল্প যেমন ট্যাংক, এরোপ্লেন, রকেট, স্যাটেলাইট, পারমাণবিক প্রযুক্তি, হাইড্রোজেন, ইলেক্ট্রনিক বা কেমিক্যাল বোমা, ট্রাক্টর, ট্রেন এবং বাষ্পচালিত জাহাজ প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানলাভ এবং এ জ্ঞানকে প্রয়োগ করার অধিকার দিয়েছে ইসলাম। এ সমস্ত জিনিসের মধ্যে সাধারণ ভোক্তাদের জন্য নির্মিত শিল্প কারখানা, হালকা অস্ত্র, ল্যাবরেটরীর যন্ত্রপাতির উপাদান, মেডিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস, কৃষি যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, কার্পেট এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্য যেমন টিভি, ডিভিডি ইত্যাদিও অন্তর্ভুক্ত। এখানে যে বিষয়টা বর্ণিত হায়েছে সেটা হচ্ছে যতক্ষণনা শরীয়াহ প্রমাণাদি থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে অমুক বস্তুটা গ্রহণযোগ্য নয় (যদিও এ ধরনের বস্তু সংখ্যায় খুবই কম) ততক্ষণ পর্যন্ত অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের সমস্ত বস্তুই অনুমোদিত।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে বর্তমান যুগে ইসলাম কোনভাবেই অচল নয় বরং যদি পরিপূর্ণ ভাবে ইসলাম বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে মুসলিম বিশ্বের অবস্থা প্রকৃত অর্থেই পরিবর্তিত হবে।

কৃষি সম্পর্কে ইসলামের বিধানসমূহ:

ইসলামের অর্থনৈতিক নীতি তথা ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সার্বিক লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর পূরণ করা এবং যতটুকু সম্ভব তাদের আভিজাত্যপূর্ণ চাহিদাগুলো পূরণে সহায়তা করা। অর্থাৎ শুধুমাত্র বাজারের আন্তক্রিয়ার উপরে চাহিদা পূরণকে ছেড়ে না দিয়ে বরং সবার মৈলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা চালানো হবে ইসলামী অর্থনৈতিক নীতিমালার উদ্দেশ্য।

এজন্যই দেখা যায় খিলাফতের প্রত্যেক নাগরিকের সধরনের মৌলিক চাহিদা (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য  ও নিরাপত্তা) সার্বিকভাবে পূরণের বিষয়টিকে ইসলামী শরীয়াহ নিশ্চিত করেছে। এই বিষয়টি অর্জন করা হয় প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তিকে কাজে নিয়োগদানের মাধ্যমে যার ফলে সে তার নিজের ও তার উপর নির্ভরশীলদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সমর্থ হয়; এ বিষয়টি সেসব প্রমাণাদির উপর ভিত্তি করে নেয়া হয়েছে যেখানে মুসলিমদেরকে কাজ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে, যেমন:

যে ব্যক্তি হালাল এবং উপযুক্ত উপায়ে জীবিকা আহরণের চেষ্টা করল, সে আল্লাহর সাথে এমনভাবে দেখা করবে যেন তার মুখ পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় হবে; এবং যে ব্যক্তি ঔধ্যত্বের সাথে ও সীমালংঘনের মাধ্যমে তা চাইবে সে এমন অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে যেন তিনি (আল্লাহ) তার প্রতি রাগান্বিত। (বুখারী)

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন: “হে আদম সন্তান, তোমাদের সম্পদের মধ্যে তোমরা যা কিছু খেয়েছ বা করেছ, যা কিছু পরিধান করেছ বা ব্যয় করেছ এবং যা কিছু দান করেছ বা নিজের জন্য রেখেছ সেগুলো বাদে তোমাদের আর কী আছে?” (বুখারী)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন:

“তোমরা ইসরাফ (অপব্যয় অর্থাৎ খরচের ক্ষেত্রে ইসলামের সীমা অতিক্রম করে ফেলা) করোনা। তিনি ইসরাফকারীদের পছন্দ করেন না।” [সুরা আরাফ: ৩১]

“আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তদ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেওনা। তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়োনা।”
[সুরা কাসাস:৭৭]

ইসলাম চায় প্রত্যেক মানুষ তার নিজের এবং তার উপর নির্ভরশীলদের মৌলিক চাহিদা তথা পর্যাপ্ত খাদ্য, পোশাক ও বাসস্থান নিশ্চিত করুক। এবপর যতটুকু সম্ভব অন্যান্য আভিজাত্যপূর্ণ চাহিদা পূরণ করার স্বাধীনতা ইসলাম দিয়েছে। যদি কেউ এরূপ সংস্থান করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করতে বাধ্য। ইসলামের দৃষ্টিতে যে কোন মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা হল খাদ্যের চাহিদা এবং এজন্য লোকজনের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষি উন্নয়ন একটি অপরিহার্য বিষয়। এই বিষয়টি নিশ্চিত করতেই ইসলাম শ্রম এবং জমির মালিকানা নিশ্চিত করেছে।

শ্রম এবং জমির মালিকানা:

জীবিকা অর্জন ও মৌলিক খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে শ্রম ও জমির মালিকানা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় আইনকানুনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। ইসলামের দৃষ্টিতে চাকুরি হচ্ছে কোন মানুষ থেকে সুবিধা নেওয়া অর্থাৎ কারো দক্ষতা এবং শ্রমের বিনিময়ে পারিশ্রমিক প্রদান। চাকুরির সংজ্ঞানুযায়ী কাজের ধরন, কর্মঘন্টা, বেতন ও শ্রমের ব্যাপারে চাকুরির শর্তসমূহে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা জরুরী। ইসলামে অন্যান্য চুক্তির মত চাকুরিক্ষেত্রেও দু’পক্ষের বয়স বয়ঃসন্ধিকালের চেয়ে বেশি থাকাটা জরুরী যার ফলে শিশুশ্রম কার্যকরভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।

ইসলাম বর্গাচাষকেও অনুমোদন দিয়েছে। এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি জমিসেচ করা, চারা রোপণ এবং ফসল ফলানোর জন্য নিজের জমি অন্যের কাছে হস্তান্তর করে এবং বিনিময় উৎপাদিত পণ্যের একটি নির্দিষ্ট অংশ গ্রহণ করে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বলেন,

“রাসুল (সা) খাইবারের লোকজনের সাথে এই মর্মে চুক্তি করেছিলেন যে তারা উৎপাদিত গাছ বা ফল-ফসলের অর্ধেক দিয়ে দিবে(মুসলিম)

জমিকে অলসভাবে ফেলে না রেখে বরং এর ব্যবহারকে নিশ্চিত করে ইসলাম। সমাজতন্ত্রীদের মত জমির মালিকানাকে ইসলাম সমস্যা হিসেবে দেখেনা বরং সামন্তবাদ যার ফলে কৃষিকার ব্যাহত হয় এবং জমির ব্যবহার হয়না বলে ইসলাম একে সমস্যা হিসেবে দেখে। কারণ এর ফলে বিপুল পরিমাণ জমি অলস পড়ে থাকে এবং অর্থনীতিতে কোন অবদান তা রাখতে পারেনা। জমি চাষ সংক্রান্ত অনেকগুলো নিয়ম ইসলাম নির্দেশ করে যার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে:

তিন বছর ধরে যদি কেউ জমিচাষ না করে তাহলে তাদের কাছ থেকে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর ভিত্তি হচ্ছে হাদীস বিশষজ্ঞগণ কর্তৃক সংগৃহীত অনেকগুলো বর্ণনা যা উমর (রা) থেকে বর্ণিত এবং যা ইজমা হিসেবে বিবেচিত:

যদি কেউ তিনবছর জমি ফেলে রাখে এবং অন্য কেউ এসে তাতে চাষাবাদ করে তাহলে সে জমির মালিকানা তার”

“কেউ যদি তিনবছর ধরে কোন জমি ব্যবহার না করে ফেলে রাখে এবং অন্যকোন লোক এসে সেটা ব্যবহার করে তাহলে এটা তার”

উমর (রা) বর্ণনা করেন  “তিন বছর পর বেড়া নির্মাণকারীর কোন অধিকার থাকেনা

জমি ব্যবহার পদ্ধতির ব্যাপারে ইসলাম সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ স্পষ্টভাবে জমি ব্যবহারের পদ্ধতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। জমির সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য ইসলাম বাধ্য করেছে যার ফলে জমির মালিকেরা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, বীজ, পশু এবং মজুরির বিনিময়ে শ্রমিক নিয়োগদানের মাধ্যমে নিজেদের জমিতে চাষাবাদ করতে বাধ্য। জমি লিজ দেয়াকে ইসলাম স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছে, যেখানে মালিকপক্ষ কোন ম্যানেজারের মাধ্যমে লোকজনের কাছে কাজ করার জন্য জমি দেয় এবং পরবর্তীতে লাভের একটি নির্দিষ্ট অংশ মালিককে দিতে হয়। এর ভিত্তি হচ্ছে রাসূল (সা) এর বাণী:

যার জমি আছে সে যেন তাতে রোপণ করে অথবা তার ভাইকে দান করে দেয়। যদি সে তা না করে তাহলে তার হাত ধরে ফেল” (বুখারী)

রাসুল (সা) জমি ভাড়া দেওয়া বা জমির লভ্যাংশ নেওয়াকে নিষেধ করেছেন(মুসলিম)

“রাসুল (সা) জমি লিজ দেওয়াকে নিষেধ করেছেন। আমরা বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, তাহলে কি আমরা কিছু শস্যের বিনিময়ে জমি লিজ দিতে পারি?”  তিনি (সা)  বললেন “না”। আমরা বললাম, “আমরা এটাকে খড়ের জন্য লিজ দিতাম”। তিনি (সা) বললেন, “না”। আমরা বললাম, “আমরা রাবিয়া (ছোট্ট নদী) থেকে জলসেচের বিনিময়ে লিজ দিতাম”। তিনি বললেন “না, হয় তোমরা চারা রোপণ করবে নয়তো তোমাদের ভাইকে দিয়ে দিবে(সুনানে নাসাঈ)

খাদ্য সামগ্রী:

কোন ধরনের খাদ্যদ্রব্য ভোগ করা যাবে এবং কোনগুলো যাবেনা সে ব্যাপারে ইসলাম বিস্তারিত নিয়ম বর্ণনা করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে খাদ্য হচ্ছে উদ্ভিদ এবং প্রাণী। ইসলাম কিছ স্থলজ এবং কিছ জলজ প্রাণীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। নিষিদ্ধ ধরন সমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে সেই ধরনের প্রাণী যেগুলো সবসময়ই হারাম এবং অন্যধরনের মধ্যে আছে সেগুলো, যেগুলো কিছু শর্তের উপস্থিতিতে হারাম হয়। এরকম দশ ধরনের হারামের ব্যাপারে কুরআনে বর্ণিত রয়েছে:

“তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শূকরের মাংস, যেসব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গকৃত হয়, যা কন্ঠরোধে মারা যায়, যা আঘাত লেগে মারা যায়, যা উচ্চস্থান থেকে পতনের ফলে মারা যায়, যা শিং এর আঘাতে মারা যায় এবং যাকে হিংস্র জন্তু ভক্ষণ করেছে সেগুলো ব্যতীত যেগুলোকে তোমরা যবেহ করেছ। যে জন্তু যজ্ঞবেদীতে যবেহ করা হয়...... [সুরা মায়িদাহ:৩]
এই আয়াত থেকে যে নিয়মটি বের হয়, সেটি হচ্ছে সবধরনের খাদ্যই জায়েয যতক্ষণনা নির্দিষ্ট দলীলের মাধ্যমে কোন কিছু হারাম সাব্যস্ত হবে। এই আয়াতের মাধ্যমে কোন ফল বা সবজিকে ষ্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি বলে সেসবই খাওয়া জায়েয।

ইসলাম পশুদের সাথে দয়ার্দ্র হতে এবং তাদেরকে অপব্যবহার করতে নিষেধ করে। অন্যসব সৃষ্ট জীবের মত প্রাণীরাও আল্লাহর প্রশংসা করে। কুরআনে প্রাণীদের সাথে সম্পর্কিত দু’শতাধিক আয়াত আছে এবং ছয়টি সুরার নামকরণ হয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর নামে। কিছু ব্যতিক্রম যেমন শুকর ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর গোস্ত খাওয়ার স্পষ্ট অনুমতি দিয়েছে কুরআন। যে সমস্ত প্রাণীর গোশ্ত হালাল সেগুলোকে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে যবেহ করতে হয়; প্রথমে অস্ত্রকে ধারালো করতে হবে এবং তারপর ধারালো ছুরি দিয়ে দ্রত গলা এমনভাবে কাটতে হবে যাতে জুগুলার শিরা এবং ক্যারোটিড ধমনী কেটে যায় কিন্তু স্পাইনাল কর্ড অক্ষত থাকে।

এর ফলে মৃত্যুযন্ত্রণা কম হয় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে সঠিকভাবে রক্ত প্রবাহিত হয়ে যায়। এই পদ্ধতি অনুসরণের ফলে গোশ্তে রক্ত থাকার আশঙ্কা থাকেনা, যা ভোগ করা ইসলামে হারাম।

মূলঃ ইসলামের ফিরে আসা

মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

তিহাত্তর ফিরকা সংক্রান্ত হাদীসসমূহের অর্থ

রাসূল (সা) বলেছেন:

বনী ইসরাইল (আহলে কিতাবীরা/ইহুদী-খ্রীস্টানরা) বাহাত্তরটি ফিরকায় বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মত তিহাত্তরটি ফিরকায় বিভক্ত হবে। তার মধ্যে এই জামা'আত ছাড়া বাকি সবাই জাহান্নামে যাবে। [আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ, হাকিম]

তিরমিযির অপর বর্ণনা হতে জানা যায়, এই জামা'আত হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীগণের পদ্ধতির উপর যারা রয়েছেন তারা।

এই সম্মানিত হাদীসে বর্ণিত 'ফিরকা' শব্দটি নিয়ে অনেকে বিভ্রান্ত হয় আছেন। 'ফিরকা'-কে এরা মাযহাব, রাজনৈতিক দল ইত্যাদি নানা অর্থে বুঝে থাকেন। তাই 'ফিরকা' শব্দের প্রকৃত অর্থ বোঝা খুবই প্রয়োজন।

আরবি ভাষায় 'ফিরকা' শব্দটি 'লাফ্‌জ মুশতারাক' অর্থাৎ বহু ধরনের অর্থ প্রকাশকারী শব্দ। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে 'ফিরকা' শব্দটি ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে ব্যবহার করেছেন। যেমন:
وَمَا كَانَ ٱلْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُواْ كَآفَّةً فَلَوْلاَ نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُواْ فِى ٱلدِّينِ وَلِيُنذِرُواْ قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوۤاْ إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ

আর সমস্ত মুমিনের একত্রে অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ (ফিরকা) কেন বের হলো না, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে? [সূরা তওবা: ১২২]

এই আয়াতে 'ফিরকা' অর্থ দলের অংশবিশেষ।
وَإِنَّ مِنْهُمْ لَفَرِيقاً يَلْوُونَ أَلْسِنَتَهُمْ بِٱلْكِتَابِ لِتَحْسَبُوهُ مِنَ ٱلْكِتَابِ وَمَا هُوَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَقُولُونَ هُوَ مِنْ عِنْدِ اللًّهِ وَمَا هُوَ مِنْ عِندِ ٱللَّهِ وَيَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে এক দল (ফিরকা) রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তারা কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তা আদৌ কিতাব হতে নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যা আরোপ করে। [সূরা আলে-ইমরান: ৭৮]

এই আয়াতে 'ফিরকা' নিন্দাসূচক অর্থে দল-কে বুঝিয়েছে, কেননা ওই দলটি ওহীকে বিকৃত করতো।

সুতরাং 'ফিরকা' শব্দটির প্রকৃত অর্থ বোঝার জন্য শব্দটি কোন প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয়েছে, সেটির দিকে লক্ষ রাখা জরুরি। উপরে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) ব্যাখ্যা করেছেন যে, ইহুদীরা একাত্তরটি ও খ্রীস্টানরা বাহাত্তরটি ফিরকায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তারপর তিনি জানান, এই উম্মতও তিয়াত্তরটি ফিরকায় বিভক্ত হবে। রাসূল (সা) ও তার সাহাবাদের অনুসারী দলটি ছাড়া বাকি সবাই জাহান্নামে যাবে। এভাবে এই হাদীসে ইহুদী-খ্রীস্টানদের মতো করে মুসলিমদের বিভক্ত হওয়াকে নিন্দা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইহুদী-খ্রীস্টানদের এই ধরনের ফিরকার অনুসরণ করতে মুসলিমদেরকে নিষেধ করা হয়েছে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا فَرِيقًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ يَرُدُّوكُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ كَافِرِينَ

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আহলে কিতাবদের কোনো ফিরকাকে অনুসরণ কর, তাহলে ঈমান আনার পর তারা তোমাদেরকে কাফেরে পরিণত করে দেবে। [সূরা আলে ইমরান: ১০০]

তাই হাদীসে বর্ণিত 'ফিরকা' শব্দের প্রকৃত অর্থ বুঝতে হলে ইহুদী-খ্রীস্টানরা কোন ধরনের ইস্যুতে মতভেদ করে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে।

পবিত্র কুরআন বারবার আমাদেরকে ইহুদী-খ্রীস্টানদের মতো মতভেদ করেতে নিষেধ করেছে। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, যেসব ইস্যুতে তারা বিভক্ত হয়েছিল, সেগুলো হলো:

১. তারা নবী-রাসূলদের ব্যাপারে মতভেদ করেছিল। আল্লাহ বলেন:
وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَقَفَّيْنَا مِنْ بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ وَآتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ أَفَكُلَّمَا جَاءَكُمْ رَسُولٌ بِمَا لا تَهْوَى أَنْفُسُكُمُ اسْتَكْبَرْتُمْ فَفَرِيقًا كَذَّبْتُمْ وَفَرِيقًا تَقْتُلُونَ

আমি মুসাকে কিতাব প্রদান করলাম, তারপর পর্যায়ক্রমে অনেক রাসূল পাঠালাম। আর মরিয়মের পুত্র ঈসাকে প্রকাশ্য প্রমাণাদি দিলাম এবং 'রুহুল কুদুস' (জিবারইল) দিয়ে তাঁকে সাহায্য করলাম, তবে কি যখনই কোনো রাসূল তোমাদের মনঃপুত নয় এমন বিধান নিয়ে আগমন করেছেন তখন তোমরা অহংকার করেছ, কতককে মিথ্যাবাদী বলেছ, আর কতককে হত্যা করেছ। [সূরা বাকারা: ৮৭]
وَآتَيْنَا عِيسَى ٱبْنَ مَرْيَمَ ٱلْبَيِّنَاتِ ... وَلَـٰكِنِ ٱخْتَلَفُواْ فَمِنْهُمْ مَّنْ آمَنَ وَمِنْهُمْ مَّن كَفَرَ ..

আর মরিয়মের পুত্র ঈসাকে প্রকাশ্য প্রমাণ দান করেছি... ... ... কিন্তু তারা মতভেদ করলো, ফলে কেউ ঈমান আনলো, কেউ কুফরী করলো.. .. [সূরা বাকারা: ২৫৩]

২. তারা আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে মতভেদ করেছে:
وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَنْ يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ

...
এবং যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের নিকট প্রকৃত জ্ঞান আসার পরও তারা মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে, শুধুমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশত। কেউ আল্লাহর আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করলে নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণে তৎপর। [সূরা আলে ইমরান: ১৯]

৩. তারা নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে একে অপরকে 'কাফির' ডাকতো:
وَقَالَتِ ٱلْيَهُودُ لَيْسَتِ ٱلنَّصَارَىٰ عَلَىٰ شَيْءٍ وَقَالَتِ ٱلنَّصَارَىٰ لَيْسَتِ ٱلْيَهُودُ عَلَىٰ شَيْءٍ وَهُمْ يَتْلُونَ ٱلْكِتَابَ كَذٰلِكَ قَالَ ٱلَّذِينَ لاَ يَعْلَمُونَ مِثْلَ قَوْلِهِمْ فَٱللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ يَوْمَ ٱلْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُواْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ

ইহুদীরা বলে, খ্রীস্টানরা কোনো ভিত্তির উপরেই নয় এবং খ্রীস্টানরা বলে, ইহুদীরা কোনো ভিত্তির নয়। অথচ ওরা সবাই কিতাব পাঠ করে। এমনিভাবে যারা মূর্খ, তারাও ওদের মতো উক্তি করে। অতএব, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে ফয়সালা দেবেন, যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছিল। [সূরা বাকারা: ১১৩]

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ইহুদী-খ্রীস্টানরা দ্বীনের বুনিয়াদী বিষয়গুলো নিয়ে মতভেদ করেছিল। নবী-রাসূল, কিয়ামত দিবস, আল্লাহর একত্ব, পুনরুত্থান, জান্নাত-জাহান্নামের মতো ঈমানের ভিত্তিসমূহ নিয়ে তারা মতভেদে জড়িয়ে পড়েছিল। রাসূল (সা) আলোচ্য 'ফিরকা' বিষয়ক হাদীসে আমাদেরকে ইহুদী-খ্রীস্টানদের মতো মতভেদ করতে নিষেধ করেছেন। এর মানে হলো, দ্বীনের ভিত্তিসমূহ নিয়ে মতভেদ করা এই হাদীস মোতাবেক নিষিদ্ধ। যেমন, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
وَٱعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعاً وَلاَ تَفَرَّقُواْ

তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। [সূরা আলে ইমরান: ১০৩]

এই আয়াতের প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী (রহ) বলেন, ইহুদী-খ্রীস্টানদের মতো দ্বীনের ব্যাপারে বিভক্ত হয়ো না ... ... ... এবং এর অর্থ এটাও হতে পারে যে, নিজের বাসনা ও স্বার্থের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ো না। [তাফসীরে কুরতুবী]

অতএব দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে যারা মতভেদ করবে, তারাই 'ফিরকা'। এধরনের বিষয় নিয়ে মতভেদ ইসলামে বৈধ নয়। কিন্তু দ্বীনের মৌলিক বিষয়ের বাইরের শাখা-প্রশাখায় মতভেদ করলে সেটা জাহান্নামী ফিরকা বলে গণ্য হবে না, কেননা দ্বীনের শাখা-প্রশাখামূলক বিষয়গুলোতে মতভেদ বৈধ।

ইমাম শাফী (রহ) বলেন, মতভেদ দুই ধরনের: এক ধরনের মতভেদ হারাম এবং অন্যটি হারাম নয়। যেসব বিষয়ে আল্লাহ তাঁর কিতাবে নিশ্চিত প্রমাণ (হুজ্জত) দিয়েছেন বা যেসব বিষয়ে রাসূল (সা) সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন, সেসব বিষয়ে জেনেশুনে মতভেদ করা হারাম। ওইসব সুস্পষ্ট বক্তব্যের বাইরের বিষয়গুলোতে যেখানে ভিন্নার্থ প্রকাশ হয় বা কিয়াস করা যায়, সেক্ষেত্রে মতভেদের সুযোগ আছে। [আর রিসালাহ]

শায়খ তাকিউদ্দিন আন-নাবাহানী (রহ) বলেন,

"[
আইনপ্রণেতার] বক্তব্যটি হতে পারে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত (ক্বাতঈ উসুবুত) অর্থাৎ কোনো মতভেদের অবকাশ নেই, যথা কুরআন ও মুতাওয়াতির হাদীস। অথবা বক্তব্যটি হতে পারে অমীমাংসিতভাবে প্রমাণিত (জন্নিঈ উসুবুত) অর্থাৎ মতভেদের অবকাশ রয়েছে, যথা অ-মুতাওয়াতির হাদীসসমূহ। যদি বক্তব্যটি ক্বাতঈ উসুবুত হয় তবে এর অর্থ নির্দিষ্ট (ক্বাতঈ উদালালাহ) ও হুকুমটি চূড়ান্ত অর্থাৎ এ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। এরূপ উদাহরণ হচ্ছে, ফরয সালাতের রাকাতের সংখ্যা - কারণ তা মুতাওয়াতির হাদীসে উল্লেখ রয়েছে... ...।

যদি আইনপ্রণেতার বক্তব্য ক্বাতঈ উসুবুত অথচ একটিমাত্র নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশক না হয় (জন্নিই উদালালাহ), তবে হুকুমটি অমীমাংসীত (অর্থাৎ এ নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে)। উদাহরণস্বরূপ, কুরআনে উল্লেখিত জিযিয়াসংক্রান্ত আয়াতটি উল্লেখ্য। আয়াতটি ক্বাতঈ উসুবুত কিন্তু তার অর্থ নির্দিষ্ট নয়। হানাফী মাযহাবের শর্তানুসারে, একে জিযিয়া বলা বাধ্যতামূলক... ...। শাফঈ মাযহাবের শর্তানুযায়ী এটিকে জিযিয়া বলা বাধ্যতামূলক নয় এবং একে দ্বৈত যাকাত বলা যায়... ...।

যদি আইনপ্রণেতার বক্তব্য জন্নিই উসুবুত হয়, যেমন অ-মুতাওয়াতির হাদীস, তখন অর্থ ক্বাতঈ উদালালাহ হোক বা না হোক, এ-সংক্রান্ত হুকুম চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হবে না, অর্থাৎ এ বিষয়ে মতভেদ থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা কিংবা কৃষিভূমি ইজারা (লীজ) দেয়ার নিষিদ্ধতার বিষয়টি।" [নিযামুল ইসলাম]

সুতরাং হানাফী, মালিকী, শাফেঈ, হাম্বলী ইত্যাদি মাযহাবগুলোকে 'ফিরকা' ভাবার কোনো সুযোগ নেই। মাযহাবগুলোর মতভেদ কেবল শাখা-প্রশাখায়। একইভাবে রাসূল (সা) ও সাহাবাগণের পথ অনুসরণকারী কোনো রাজনৈতিক দলকেও 'ফিরকা' ভাবার ন্যূনতম কোনো কারণ নেই।

তবে যারা মুহাম্মদ (সা)-কে শেষ নবী হিসেবে অস্বীকার করেছে [কাদিয়ানী], যারা হযরত আলী (রা)-কে আল্লাহর অংশ মনে করে [আলাওয়ি শিয়া], যারা আখিরাতের শাস্তিকে অস্বীকার করে, তারা অবশ্যই জাহান্নামী 'ফিরকা'। কেননা তারা দ্বীনের সুনিশ্চিত (ক্বাতঈ) বিষয়ে মতভেদ করেছে। কোনো দল যদি কুরআনের যে কোনো আয়াতের সুনিশ্চিত অর্থকে অস্বীকার করে, তবে তারা জাহান্নামী ফিরকায় পরিণত হবে। একইভাবে কোনো দল যদি কোনো সুস্পষ্ট হারামকে হালাল মনে করে তারা অবশ্যই জাহান্নামী ফিরকা - তাদের আকৃতি যত বড়ই হোক না কেন। কেননা রাসূল (সা) বলেন,
 
سَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى بِضْعٍ وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً أَعْظَمُهَا فِرْقَة قَوْمٌ يَقِيْسُوْنَ الأُمُوْرَ بِرَأْيِهِمْ فَيُحَرِّمُوْنَ الْحَلالَ وَيحللون الْحَرَامَ

সত্ত্বরই আমার উম্মত ৭০-এরও কিছু বেশি ফিরকায় বিভক্ত হবে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফিরকা হবে একদল যারা বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত দেবে এবং তারা হালালকে হারাম করবে ও হারামকে হালাল করবে। [হাকিম]


মূলঃ ইসলামের ফিরে আসা