বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

গনতন্ত্র মুক্তি (!) পাক

“গনতন্ত্র তুঁহু মম শ্যাম সমান”, গনতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে চোখের মনির মতো” ...গনতন্ত্রের নিরবিচ্ছিন্ন রক্ষা এবং গনতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য এই জাতীয় কথাবার্তা দেশি বিদেশী কিছু মহলের কাছ থেকে আমরা প্রায় শুনতে পাই। তাদের কথা হচ্ছে গনতন্ত্রই শেষ কথা, গনতন্ত্রের বিকল্প আর কিছু নেই। সরকারী দল, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ, বিদেশী মহল এমনকি ইসলামপন্থী ও বাম্পন্থী কিছু দলও আর কোন ব্যাপারে এক না হলেও, গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঐক্যমত পোষণ করছে। সকল সমস্যার সমাধান নাকি এই গনতন্ত্র! সত্যি কি তাই? গনতন্ত্রের সাথে আমাদের বসবাস তো অনেক দিনের। আমরা যদি একটু পিছনে তাকাই অথবা পার্শ্ববর্তী দেশ বা পৃথিবীর দিকে তাকাই যেখানকার গনতন্ত্রের বয়স আরও বেশি, তবে দেখতে পাব গনতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে আমাদের কি দিয়েছে। সমস্যার সমাধান নাকি আরও বেশি সমস্যা ?

গনতন্ত্রের প্রশংসা করার জন্য অনেকে বলে থাকেন এতে রয়েছে সকল প্রকার মত প্রকাশের অধিকার। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাই মত প্রকাশে কাজ হয় না, বিদ্যুৎ, পানি, সার এমনকি খাদ্যের মতো একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্যও মানুষকে রক্ত দিতে হয়। সিডর ও আইলা ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা নিজেদের এই দুরাবস্তায় মাথা তুলে দাড়ানোর বদলে মানব বন্ধন করছে। প্রশ্ন উঠে, সরকার কি অন্ধ? সরকার কি দেখে না তাদের পেটের সাথে পিঠ লেগে যাবার অবস্থা? কেন সরকার জনগণের এই সাধারন চাহিদা গুলো পূরন করে না? রক্ত ঝরিয়ে , বিদ্রোহ করে দাবি আদায় করতে জনগণ চাই না। তারা তাদের প্রাপ্য নিয়ে শান্তিতে নিশ্চিন্তে থাকতে চায়। অথচ রক্ত ঝরিয়েও দাবী আদায় হয় না বরং ফুলবাড়িয়া , কানসাটের ন্যায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায়।

গণতন্ত্র বহু দলের শাসন বলে পরিচিত হলেও আমাদের দেশে বি. এন.পি আর আওয়ামিলীগ-ই তার ষোল আনা পূরণ করছে। অবশ্য আরও বেশি দল তাদের অবস্থানে থাকলে হয়ত তাদের হাতে দেশ তুলে দিয়ে আমাদেরকে জংগলে গিয়ে থাকতে হতো! আমরা বাঙ্গালী নাকি বাংলাদেশী, আমাদের জাতির নেতা কে এই বিষয়ে তারা আজ অবধি একমত হতে পারে না। আমদের চোখের সামনে দিয়ে ভারত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র ঘটিয়ে নিরবিঘ্নে , নিরাপদে বের হয়ে গেল, আর তাদের কাছে এহেন অপকর্মের পর  ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য প্রমোশন দিয়ে বি. ডি. আর. বাহীনির প্রধানকে প্রেরন করা হল, তিনি আবার শেয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেবার মতো করে বি. ডি. আর. পুনর্গঠনে ভারতের কাছেই সহায়তা চেয়ে প্রমোশন প্রাপ্তির দায় মোচন করে আসলেন- আশ্চর্য  সব ঘটনাবলী তথাকথিত প্রধান বিরধীদল বি. এন. পি. ধর্যের সাথে , সহনশীলতার সাথে পর্যবেক্ষণ করল। তারা  নাকি জাতীয় স্বার্থে ধৈর্য ধারন করেছে! অন্যদিকে খালেদা জিয়ার ‘বাড়ী ইস্যু’ তে একেবারে রাজপথ গরম করে বহুদলীয় গণতন্ত্র তথা দলের শাসনের রূপটা একেবারে স্পষ্ট করে দিয়েছে। গণতন্ত্র আসলে কেবল এই সকল দলেরই স্বার্থ সংরক্ষন করার জন্য সৃষ্ট।

গণতন্ত্রে  ‘জবাবদিহিতা’ শব্দটা আমরা কেবল বই পত্রে দেখে আসতেছি। বাস্তবে জবাবদিহিতা প্রভু রাষ্ট্রের জন্য সংরক্ষিত। জনগণের কাছে তারা কখনও দায়বদ্ধ হয় না। এর ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, আর্থিক মন্দার এ সময়ে সরকারের গাড়ী কেনার ধুম এবং এ বাবদ ২০৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়। আর জবাবদিহিতার চর্চা করতে যেয়ে সাংসদকে তার পূর্ব প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেওয়াতে মার খেয়ে লাঞ্ছিত হয়ে আসতে হয় এক আইনজীবীকে।

আমাদের দেশে তো গণতন্ত্র  স্বরূপে আছেই, তবুও কেন গণতন্ত্রের জন্য এতো হাহাকার এবং কারো কারো নাভিশ্বাস এবং বাহির থেকে জোর চাপাচাপি? শুধু চাপ নয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের স্পিকার সোমনাথ চ্যাটারজী আমাদের দেশের সাংসদের প্রশিক্ষন পর্যন্ত দিতে এসেছিলেন ফেব্রুয়ারী মাসে। তার মানে কি এই যে ভারতে খুব ভালো গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে?

দেখা যাক পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের অবস্থা; ভারত হলো এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ। অথচ বিশ্বে সরকারী হেফাযতে মৃত্যু সংখ্যায় ভারত ১ নম্বরে। এটা এমন একটা দেশ যার ২৫ ভাগ এলাকায় সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আত্মহত্যা করেছে এমন কৃষকের সংখ্যা ১ লাখ ৩৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কাশ্মীরেই ৬৮-৬৯ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। (জেট নেট থেকে অরুনধতি রায়ের সাক্ষাতকার)

 এই যখন ভারতের অবস্থা তখন জনগণের প্রতক্রিয়া সম্পর্কে অরুনধতির মতামত- “ মানুষ আজ বেপরোয়া। এদের(শাসক) হাত থেকে বাঁচতে আজ নিজেই অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। মানুষ জানে না কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায়। তারা নিজেরাই নিজেদের বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। আজ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রচারিত গণতন্ত্রের  থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে’’।

B.B.C জরীপে এসেছে গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতিতে কৃষকরা আস্থা হারিয়েছেন। আর শাসকদের প্রতি এবার নির্বাচনে ভারতের মানুষের মনভাব তো জুতো দিয়েই প্রকাশ পেয়েছে। একের পর এক জুতো যেন কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছিলো না।

অন্যান্য স্বপ্নের দেশে মনোযোগ দেওয়া যাক। গণতন্ত্রের জনক আমেরিকায় তো মন্দার কারনে মানুষ সব রাস্তায় নেমে আসছে। সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডে অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগী বৃদ্ধদের কাছ থেকে যৎসামান্য পেনসনের টাকা থেকে কেটে যখন বড় ব্যাবসায়ীদের ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল তখন তারা বাধ্য হয়ে এই বয়সে পথে নামে। প্ল্যাকার্ডে লেখা শ্লোগান “don’t pay the greedy from the needy” আসলে গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। আমেরিকা বাস্তবে লবিতন্ত্রে চলে। মুলত গণতন্ত্র নামক মনোমুগ্ধকর মুখোশের আড়ালে একেক দেশে একেক শক্তিশালী গোষ্ঠীতন্ত্রই চলে আসছে। এরকম করেই গণতন্ত্রকে ডিজাইন করা হয়েছে।

গণতন্ত্রের সুফল ব্রিটেনের মন্ত্রী এমপিরা খুব ভালো করেই পেয়েছে। সাম্প্রতীক বছরগুলোতে  যেসব ব্রিটিশ মন্ত্রী, এম পি ঢাকায় এসে বাংলাদেশের গণতন্ত্র , দুর্নীতি ও সন্ত্রাস সম্পর্কে নীতি কথা ও পরামর্শ দিয়েছেন, তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও নীতি গর্হিত কাজের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। তাদের নীতি গর্হিত কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন ধর্মীয় নেতা লর্ড কারী বলেছেন, “ এসব অনিয়মের কারণে পার্লামেন্টের নৈতিক কর্তৃত্ব স্মরণ কালের মধ্যে সবচেয়ে নিচে চলে আসেছে”। ( আমার দেশ,  ১৩মে, ২০০৯)

প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষনে এই গনতন্ত্রকে হাতিয়ার বানিয়ে আমাদের মত দেশগুলোকে শোষণ করে আসছে বছরের পর বছর। ১৯৯০ সাল থেকে এই দেশে গণতন্ত্র আমাদেরকে শোষণ , লুণ্ঠন ও দ্বিদলীয় হানাহানি ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। তবে সাধারন মানুষ রক্ত দিয়ে কিছু না পেলেও একটি শ্রেণীর লোক যে একটি ফোনকলের মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত বস্তু হাসিল করে ফেলে তা  আমরা দেখেছি। গণতন্ত্র আসলে ধনতন্ত্রের রাজনৈতিক শ্লোগান। গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বিভিন্ন এজেন্টরা প্রতিনিয়ত পত্রিকা, টক শো, গোলটেবিল বৈঠক, সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে গনতন্ত্রকে মুখরোচক করে আমাদের সামনে তুলে ধরে। কিন্তু জনগণ এখন সচেতন, এবং আমরা তরুণরাও সচেতন। গণতন্ত্র নামক এসব সুগার কোটেড কুইনাইন আমাদের দিয়ে আর গিলানো যাবে না। ৩ হাজার বৎসর আগে গ্রীসের যে গোরস্থান থেকে এই মৃত পরিত্যক্ত ব্যবস্থাকে আমেরিকা শোষণের উদ্দেশে তুলে এনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে তাকে আমরা আবার সেখানেই ফেরত পাঠাবো, ইনশাআল্লাহ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন