রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

আরব বসন্তের শিক্ষা – প্রসঙ্গ গাদ্দাফীর মৃত্যু



মাসব্যাপী সংঘর্ষ ও পশ্চিমা আগ্রাসনের পর অবশেষে গাদ্দাফীকে নিজ নিয়তি বরণ করে নিতে হল। সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে দেখা যায়, মুসলিমরা ঐ সব স্বৈরশাসকদের ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করছে যারা বছরের পর বছর তাদের নিজ জনগণের প্রতি অত্যাচার, গণহত্যার ষ্টীম রোলার চালিয়েছে এবং একনিষ্ঠ আজ্ঞাবহ দাসের ন্যায় পশ্চিমা স্বার্থগুলো সংরক্ষণ করে গেছে। এরূপ বিবেচনায় গাদ্দাফী প্রসঙ্গতই তার নিজ জনগণের প্রতি অত্যাচার, নির্যাতনে আপন বৈশিষ্ট্যে স্বকীয়। বর্তমানে অনেকের মাঝে এই উচ্ছ্বাস দেখা যায় যে বিগত এক বছরের মাথায় মুসলিম বিশ্বে এই নিয়ে তৃতীয় স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছে, তবে আমরা যখন এই ঘটনাপ্রবাহগুলো বিশ্লেষণ করব তখন আমাদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।

১। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিউনেশিয়ার এক তরুণ মুহাম্মদ বাওয়াজিজির আত্মহত্যা এমন এক উত্তাল তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে যা দ্রুতই মুসলিম বিশ্বকে ছেয়ে ফেলে। এই উত্তাল তরঙ্গের উন্মাদনা নারী, পুরুষ, তরুণ, শ্রমিক এবং সকল পেশাজীবি নির্বিশেষে তাদের মন হতে অত্যাচারী শাসকের ভয় ছুড়ে ফেলে দেয় এবং সাহসিকতার সাথে তারা রাস্তায় নেমে এসেছে শুধুমাত্রই একটা উদ্দেশ্যে তা হল নিজেদের লক্ষ্য তারা নিজহাতেই গড়তে চাই। মুসলিম উম্মাহর একান্ত প্রচেষ্টায় পরিচালিত তথাকথিত এই আরব বসন্ত এমনই এক বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটিয়েছে যা দীর্ঘদিন মুসলিম ভূখণ্ডে এক কালো ছায়ার ন্যায় জেঁকে বসছিল।

২। মুসলিম উম্মাহ যদি এই আরব বসন্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে চায়, তাহলে তাদের উচিত এই পশ্চিমাদের হতাশায় নিমজ্জিত করা। বেন আলি, মোবারক, এবং গাদ্দাফী হল এমনই ব্যাক্তি যারা দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা স্বার্থ সংরক্ষণ করে এসেছে। পশ্চিমারা এই সকল শাসকদের উপর হতে তাদের আশির্বাদ ঐ সময় উঠিয়ে নিয়েছে, যখন এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে মুসলিম উম্মাহ তাদেরকে উৎখাত করে দিবে। আমরা দেখেছি ব্রিটিশ ক্যামেরন সরকার ২০১১ এর জানুয়ারী নাগাদ গাদ্দাফীর সাথে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল এবং তার কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছিল যা দিয়ে সে বেনগাজির মুসলিমদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে।

৩। আচ্ছা এই আগ্রাসন যদি সত্যিই মানবতার কল্যাণে হয়ে থাকে, তাহলে যে কেউ আশা করতেই পারে যে এই ধরণের পশ্চিমা আগ্রাসন উত্তর কোরিয়া কিংবা জিম্বাবুয়েতেও চালানো হোক। কিন্তু না আফ্রিকার সর্ববৃহৎ তেল সমৃদ্ধ এই দেশের প্রতি পশ্চিমাদের লোলুপ দৃষ্টি কিম জং ইল কিংবা মুগাবের নশৃংসতাকেও অন্ধ করে রেখেছে। এই শঠতা ও ভণ্ডামি এখানেই শেষ নয়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমন অনেক ব্যাক্তিকেই অপহরণ করে গাদ্দাফীর কাছে চালান করে দেয় যাদের মধ্য হতে একজন সামি আল সাদী যে ব্রিটিশ সরকারকে তার প্রতি ঘটে যাওয়া অত্যাচার নির্যাতনের জন্য অভিযুক্ত করে মামলা করে এবং সক্রিয়ভাবে তা পরিচালনায় ব্যস্ত, যা লিবিয়ার প্রশাসন বিশ্বের কাছে লুকিয়ে রাখে। একই ভাবে পশ্চিমারা বাহরাইনের স্বৈরশাসক হামাদ বিন ঈসা আল খলিফা কর্তৃক চালানো নশৃংস হত্যাকাণ্ড ও স্বৈরাচারী আসাদের চালানো দৈনিক গণহত্যার ব্যাপারেও নিশ্চুপ।

৪। আমরা দেখেছি ব্রিটেন এবং আমেরিকা লিবিয়ার শাসকদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে, এমনকি তার যুগপৎভাবে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে ঐ সব ব্যাক্তিদের প্রতি যারা তাদের বিরুদ্ধ মত পোষণ করতো। তারা কূটনৈতিক প্রক্রিয়া ও বৈঠকের মাধ্যমে একে রাজনৈতিক সমর্থন দিত যাতে এই সকল দালাল শাসকেরা একছত্রভাবে পশ্চিমাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করে। পশ্চিমাদের সমর্থনে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে একনায়কতন্ত্রের দীর্ঘ উপস্থিতি এই বাস্তবতাকেই উপস্থাপন করে যে স্বাভাবিকভাবেই এই সকল শাসকেরা উম্মাহর দুর্দশা পরিবর্তনের যেকোন মহৎ প্রচেষ্টাকেই সামরিক আগ্রাসন দিয়েই সাধুবাদ জানাবে। লিবিয়া থেকে তিউনেশিয়া, সৌদি আরব এবং বাহরাইনের শাসকদের প্রতি বিনা অস্ত্রে, বিনা প্রশিক্ষণে এবং কূটনৈতিক বৈধতা এবং সমর্থন দানের মাধ্যমে এটাই সন্দিহান করে তোলে যে তারা এত দিন পর্যন্ত ঠিকে ছিল, পরবর্তীতে যা গণরোষের সৃষ্টি করে। এ থেকে এটাই প্রমাণ করে যে উম্মাহ আজ ভয়ের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত।

৫। উম্মাহকে পশ্চিমাদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং তাদেরকে হতাশায় পর্যবর্সিত করতে হবে যাতে তারা গাদ্দাফী পরবর্তী প্রশাসন সাজানোকে প্রভাবিত করতে না পারে। এটা বিস্ময়ের বিষয় নয় যে, গাদ্দাফীর পতনের দুই দিন পূর্বে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ত্রিপলীতে ঐ সব বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনায় মিলিত হয় যারা পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ পথ দখল করে। ঠিক একইভাবে লিবিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে ডেভিড ক্যামেরন এবং নিকোলাজ সারকোজীও সপ্তাহখানেক পূর্বে বিভিন্ন ব্যাক্তি ও সংগঠনের সাথে আলোচনায় লিপ্ত হয়। পশ্চিমা হস্তক্ষেপে তিউনেশিয়া এবং মিশরের নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে যাতে করে ইসলামী চিন্তা ধারণার মানুষ ও দলগুলোর মন জয় করা যায়।

৬। লিবিয়ার ইতিহাস যদি পর্যবেক্ষন করি তাহলে আমরা দেখতে পাবো, তা ছিল বরাবরই ইসলামের বিরুদ্ধে। হাজারো মানুষকে জেলের ভিতর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়, ব্যাপক গণহত্যা চালানো হয় শুধুমাত্রই ইসলামের প্রতি ঝোঁকের কারণে কিংবা গাদ্দাফীর বিরুদ্ধচারণ করার কারণে। যার মধ্যে একটি বহুল আলোচিত হল ১৯৯৫ এর আবু সালিম কারাগারের গণহত্যা। গাদ্দাফীর পতনের পরও সেই সকল গণকবরে হদিস পাওয়া যায়নি যেখানে ধারণা করা হচ্ছে ১০০০ এর উপর ভুক্তভোগীদের লাশ থাকতে পারে। ১৯৭৮ এর সালে হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের হত্যা করা হয় যখন গাদ্দাফীর আল্লাহর রাসুলের সুন্নাহকে অস্বীকার করে অধ্যাদেশ জারি করার প্রতিবাদে তাদেরই একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে দেখা করে।

বিগত কয়েক দশক ধরে নিজ জনগণের প্রতি চালানো অত্যাচার, যন্ত্রণার পর আজ গাদ্দাফীর ভাগ্য নর্দমায় নিক্ষিপ্ত। আজ যদি গাদ্দাফী কিংবা সাদ্দামের মৃত্যু অথবা হোসনী মোবারক এবং বেন আলির উৎখাত হতে কিছু শিক্ষণীয় থাকে তা হল পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকেরা খুব দ্রুতই তাদের বন্ধুদের থেকে সটকে পরে যখন তাদের ইতিহাস লেখা হয়ে যায়। এই আরব বসন্ত আমাদের আরও দেখিয়েছে যে সমন্বিত জনগণ যেকোন অত্যাচারী শাসককে উৎখাত কুরতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন