রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

খিলাফত এক অনন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেম শাইখ আতা ইবনু খলীল আল-রাশতা কর্তৃক লিখিত আজহিজাতু দাওলিাতিল খিলাফাহ - ফিল হুকমি ওয়াল ইদারাহবইটির বাংলা অনুবাদ এর একটি অংশ হতে গৃহীত)

বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত যে শাসনব্যবস্থাগুলো আছে, এগুলো তাদের ভিত্তি, চিন্তা, ধ্যান-ধারণা, মাপকাঠি, গঠন, এমনকি যে বিধিবিধান দিয়ে এ ব্যবস্থাগুলো তাদের কার্যাবলী পরিচালনা করে এবং যে সংবিধান ও আইন-কানুনের মাধ্যমে এ ব্যবস্থাগুলো তাদের বিধিবিধানগুলো বাস্তবায়ন ও কার্যকর করে - এ সমস্ত দিক থেকেই ইসলামী শাসনব্যবস্থা (খিলাফত) থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

খিলাফতের শাসন কাঠামো রাজতান্ত্রিক নয়:
খিলাফত কোন রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয় কিংবা এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণও নয়। রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজপুত্র উত্তরাধিকার সূত্রে বাদশাহ্‌ হয় যেখানে সাধারণ জনগণের বলার কিছু থাকে না। অন্যদিকে, খিলাফত শাসনব্যবস্থায় খলীফা নিয়োগ করার পদ্ধতি হল বাই'আত। রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজা-বাদশাহ্‌দের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা, যে কারণে সে নিজেকে সকল আইনের উর্ধ্বে রাখতে পারে। কিছু রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাদশাহ্‌কে জাতির প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে সে রাজ্যের মালিক কিন্তু শাসক নয়। আবার কিছু রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সে মালিক এবং একইসাথে রাজ্যের শাসকও; যেখানে সে তার রাজ্য ও জনগণকে তার ইচ্ছামত শাসন করে। জনগণের উপর অত্যাচার, নির্যাতন ও দুঃশাসনের মাত্রা যত ভয়াবহ হোক না কেন, এদুটি ক্ষেত্রেই সে সকল প্রকার জবাবদিহিতার উর্ধ্বে। অপরদিকে, খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা খলীফাকে বিশেষ কোন অধিকার প্রদান করে না - যা তাকে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মত জনগণের উপরে স্থান দেয়। না এ ব্যবস্থায় তিনি এমন কোন অধিকার প্রাপ্ত হন যাতে বিচার বিভাগের সামনে তাকে সাধারণ জনগণ থেকে আলাদা কোন মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া, রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মত তিনি জাতির কাছে কোন প্রতীকও নন। বরং, তিনি শাসন ও কর্তৃত্বের দিক থেকে জনগণের একজন প্রতিনিধি। যার অর্থ হচ্ছে, উম্মাহ্‌ (জনগণ) তাকে নির্বাচিত করেছে এবং বাই'আতের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় নিয়োগ দিয়েছে, যেন তিনি আল্লাহ্‌ প্রদত্ত আইন দিয়ে তাদের শাসন করেন। খলীফার সমস্ত কাজ, সিদ্ধান্ত জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ দেখভাল করার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ প্রদত্ত সীমারেখা দ্বারা নির্ধারিত।

খিলাফত রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অনুরূপ নয়:
সাম্রাজ্যবাদ ইসলামের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় জাতি ও বর্ণভেদে এ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা শাসিত হয়েছে। যদিও এ অঞ্চলগুলো সবসময় একটি কেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অনুরূপ ছিল না। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের অধীনস্থ বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের জনগোষ্ঠীকে কখনও এক দৃষ্টিতে দেখে না। বরং, তারা শাসন, অর্থায়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবসময় কেন্দ্রকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

ইসলামী শাসনব্যবস্থার লক্ষ্য হচ্ছে এর অধীনস্থ সকল অঞ্চলের জনগণের মাঝে সমতা তৈরী করা। ইসলাম গোত্রবাদকে প্রত্যাখান করেছে এবং শারী'আহ আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়েছে ও সেইসাথে তাদের নাগরিক কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে ইসলাম অমুসলিমদেরকেও মুসলিমদের মতোই জবাবদিহিতার সম্মুখীন করেছে। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে ইসলামী রাষ্ট্র সমান নাগরিক সুবিধা প্রদান করেছে। বিপরীতভাবে, ইসলামী রাষ্ট্রের বাইরে বসবাসরত মুসলিমদেরকে ইসলামী রাষ্ট্র নাগরিক সুবিধা প্রদান থেকে বিরত থেকেছে। সকল নাগরিককে সমান অধিকার প্রদানের দিক থেকে ইসলামী শাসনব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নসাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের ক্ষমতাকে সুসংহত করার লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ (colony) স্থাপন করে সে অঞ্চলসমূহকে শোষণ করে কেন্দ্রকে ক্রমাগত শক্তিশালী করে। অপরদিকে, খিলাফত রাষ্ট্র কখনই তার অধীনস্থ অঞ্চলসমূহকে উপনিবেশ হিসেবে দেখে না এবং এ অঞ্চলগুলো থেকে ধনসম্পদ লুটপাট করে কেন্দ্রকেও সম্পদশালী করে না। বরং খিলাফত রাষ্ট্র সব অঞ্চলকে সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখে, তা কেন্দ্র থেকে যত দূরেই অবস্থিত হোক না কেন, কিংবা, সে অঞ্চলের মানুষ যে বর্ণেরই হোক না কেন। এ রাষ্ট্র প্রতিটি অঞ্চলকে রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং প্রতিটি অঞ্চলের জনগণ কেন্দ্রে বসবাসকারী নাগরিকের মতই সমান নাগরিক সুবিধা ভোগ করে। একই সাথে, এ রাষ্ট্র এর অধীনস্থ সকল অঞ্চলে একই শাসন কর্তৃত্ব, কাঠামো এবং আইন-কানুন প্রয়োগ করে।

খিলাফত ফেডারেল রাষ্ট্রও নয়:
খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার মতোও নয়, যেখানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলসমূহ স্বায়ত্বশাসন ভোগ করে এবং সাধারণ কিছু আইনকানুন দিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকে। প্রকৃত অর্থে, খিলাফত একটি ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থা। যেখানে পশ্চিমের মারাকেশ পূর্বের খোরাসানের মতই সমান গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়। আবার, আল ফায়ূম প্রদেশ কায়রোর মতই বিবেচিত হয় - যদিও বা এটা হয় ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী। এ রাষ্ট্রে সব অঞ্চলের জন্য সমানভাবে অর্থায়ন করা হবে, একইভাবে নির্ধারণ করা হবে বাজেট। প্রতিটি প্রদেশের জন্য ন্যায্যভাবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ করা হবে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি কোন প্রদেশ হতে সংগৃহীত ট্যাক্স উক্ত প্রদেশের প্রয়োজনের দ্বিগুণ হয়, তাহলেও ঐ প্রদেশের প্রয়োজন অনুযায়ীই ব্যয় নির্ধারণ করা হবে, উক্ত প্রদেশ থেকে কতটুকু ট্যাক্স সংগৃহীত হল তার উপর নির্ভর করে নয়। আবার, অন্য কোন প্রদেশের সংগৃহীত ট্যাক্স যদি প্রয়োজনীয় ব্যয়ের চাইতে কম হয়, তাহলে সাধারণ বাজেট থেকে ঐ প্রদেশের ব্যয় মেটানো হবে; সে প্রদেশের ট্যাক্স যাই সংগৃহীত হোক না কেন।

খিলাফত প্রজাতান্ত্রিক (Republic) ব্যবস্থা নয়:
রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিষ্ঠুর আচরণের ফলস্বরূপ প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব হয়, যেখানে রাজা-বাদশাহরা ছিল স্বাধীন, সার্বভৌম ও স্বেচ্ছাচারী এবং তারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী রাজ্য ও জনগণকে শাসন করত। সুতরাং, রাজতন্ত্রে রাজার ইচ্ছাই ছিল আইন। প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের কাছে সার্বভৌমত্ব ও কর্ততৃ হস্তান্তরের চেষ্টা চালায়। ফলে, মানুষ আইন প্রণয়ন করতে শুরু করে এবং সেইসাথে, জনগণ তাদের ইচ্ছানুযায়ী যে কোনকিছু অনুমোদন ও নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। এ ব্যবস্থায় শাসন-কর্তৃত্ব বাস্তবিকভাবে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট, তার কেবিনেট বা মন্ত্রী পরিষদের হাতে ন্যস্ত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শাসন-কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রী ও তার কেবিনেটের হাতে অর্পণ করা হয় এবং এক্ষেত্রে, রাজা বা রাণীকে নেহায়েত প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

উপরে বর্ণিত প্রতিটি (প্রজাতান্ত্রিক) ব্যবস্থা থেকে ইসলামী শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলামে মানুষের আইন তৈরির কোন অধিকার নেই। এ অধিকার শুধুমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার। আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কারো কোন ব্যাপারে অনুমতি প্রদান বা নিষেধাজ্ঞা জারি করার ক্ষমতা নেই। ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে মানুষকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা অত্যন্ত ভয়াবহ অপরাধ। পবিত্র কুর'আনে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন :

"তারা আল্লাহ্‌'র পরিবর্তে তাদের ধর্মযাজক ও সাধুদেরকে নিজেদের প্রভূ বানিয়ে নিয়েছে।" [সূরা আত-তাওবা : ৩১]

রাসূল (সাঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, বনী ইসরাইলীরা তাদের ধর্মযাজক ও সাধুদের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছিল, যা তাদের কাছে প্রেরিত আল্লাহ্‌'র বিধানের বিপরীত ছিল। অর্থাৎ, তাদের ধর্মযাজকেরা যে কাজকে অনুমোদন দিত তারা তাই করতো, আর যার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতো তারা তা থেকে বিরত থাকতো। এটাই হচ্ছে আল্লাহ্‌'র পরিবর্তে তাদের (ধর্মযাজকদের) প্রভু হিসাবে মেনে নেয়ার অর্থ। ইসলামে আল্লাহ্‌'র পরিবর্তে কাউকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করাকে শিরক বলা হয়, যা কিনা ভয়ঙ্কর অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়।

সুতরাং, উপরোক্ত আয়াতটি সেই সমস্ত মানুষের ভয়ঙ্কর অপরাধের দিকে নির্দেশ করছে যারা আল্লাহ্‌'র আইন অনুসরণের পরিবর্তে নিজেদের হাতে আইন প্রণয়ের ক্ষমতা তুলে নিয়েছে। আদি ইবনে হাতিমের রেওয়াতে তিরমিযী বর্ণনা করেন, "আমি একদিন একটি স্বর্ণের ক্রুশ গলায় ঝুলানো অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি (সাঃ) বললেন, 'হে আদি! এই মূর্তিকে ছুঁড়ে ফেলে দাও।' তখন আমি তাঁকে (সাঃ) পবিত্র কালামের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করতে শুনেছি যে, তারা আল্লাহ্‌'র পরিবর্তে তাদের ধর্মযাজক ও সাধুদের নিজেদের প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। অতঃপর রাসূল (সাঃ) বললেন, "তারা এইসব আলেম ও দরবেশদের উপাসনা করে না; কিন্তু, (ল্লা'র পক্ষ থেকে) তাদের জন্য যা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তারা (ধর্মযাজকেরা) তাদের জন্য তা হালাল করেছে। আর, তাদের জন্য যা হালাল করা হয়েছিল তারা (ধর্মযাজকেরা) তাদের জন্য তা নিষিদ্ধ করেছে।" (সূনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৩০৯৫) বস্তুতঃ ইসলাম মন্ত্রী পরিষদ দ্বারা শাসিত কোন ব্যবস্থা নয় - যেখানে মন্ত্রীদের রয়েছে নির্দিষ্ট ক্ষমতা ও পৃক বাজেট। এই ধরনের ব্যবস্থায় (প্রজাতন্ত্রে) সাধারণত এত বেশি প্রশাসনিক জটিলতা (red tape) থাকে, যে কারণে এক মন্ত্রনালয়ের উদ্বৃত্ত বাজেট সহজে অন্য মন্ত্রনালয়ে স্থানান্তরিত হয় না; যা জনগণের সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তাছাড়া, এক বিষয়ে একাধিক মন্ত্রনালয়ের হস্তক্ষেপের ফলে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়। অথচ জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহকে একটি একক প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসলে খুব সহজেই এসব সমস্যা এড়ানো সম্ভব হয়।

রিপাবলিকান বা প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব বিভিন্ন মন্ত্রীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয় এবং প্রতিটি মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীগণ একত্রিত হয়ে একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়। এভাবে সম্মিলিতভাবে মন্ত্রী পরিষদের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করা হয়। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রজাতন্ত্রের মতো কোন মন্ত্রীপরিষদ নেই যারা কিনা সম্মিলিতভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে। বরং, এখানে খলীফাকে জনগণ আল্লাহ্‌'র কিতাব ও রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ্‌ অনুসারে শাসন করার জন্য বাই'আত দিয়ে থাকে। তবে, এক্ষেত্রে খলীফা তার গুরুভার লাঘব করার জন্য প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী (delegated assistants) নিয়োগ করতে পারেন। এদের আক্ষরিক অর্থেই খলীফার সহকারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যারা খিলাফতের গুরুদায়িত্ব পালনে খলীফাকে সহায়তা করেন।

খিলাফত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়:
জনগণকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদানের দিক থেকে বিবেচনা করলে বলা যায় যে, খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক নয়; যেখানে জনগণই তাদের ইচ্ছানুযায়ী কোন বিষয়কে অনুমোদন দেয়, নিষিদ্ধ করে, উৎসাহিত করে কিংবা তিরস্কার করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোন অবস্থাতেই শারী'আহ্‌ আইনের কাছে দায়বদ্ধ নয়। বরং, তাদের আইন-কানুনের মূলভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতা (freedom)অবিশ্বাসীরা জানে যে, মুসলিমরা গণতন্ত্রকে এর প্রকৃত চেহারায় গ্রহণ করবে না। এ কারণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, একথা বলে মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছে যে, গণতন্ত্র শুধুমাত্র শাসক নির্বাচনের একটি পদ্ধতি। এভাবেই তারা মুসলিম উম্মাহ্‌কে প্রতারিত করেছে এবং উম্মাহ্‌কে শাসনব্যবস্থা হিসাবে গণতন্ত্রকে মেনে নিতে প্ররোচিত করেছে। যেহেতু মুসলিম দেশসমূহ ইতিমধ্যে প্রকৃত রাজতান্ত্রিক কিংবা প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোড়কে বিভিন্ন স্বৈরশাসকদের স্বৈরাচারী শাসনের নীচে নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং সেইসাথে, মুসলিম বিশ্বে জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে প্রচন্ডভাবে অবদমিত রাখা হয়েছে, তাই এ ভূমিগুলোতে নতুন শাসক নির্বাচনের পদ্ধতি হিসাবে গণতন্ত্রের বিস্তার ঘটানো সহজ। এভাবেই তারা গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে আলোচনাকে সযত্নে এড়িয়ে গেছে - যা হচ্ছে স্রষ্টার পরিবর্তে তাঁর সৃষ্ট মানুষকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতার বিষয়টি।

দূর্ভাগ্যবশত কিছু ইসলামী চিন্তাবিদ, যাদের মধ্যে কিছু উলামাও আছেন, তারা সৎ কিংবা অসৎ নিয়তে এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। যদি তাদের কাছে গণতন্ত্র সম্বন্ধে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে তারা বলেন এটা শাসক নির্বাচন করার একটি পদ্ধতি মাত্র। আর, এদের মধ্যে যারা অবিশ্বাসীদের মতোই মুসলিমদের সাথে প্রতারণা করতে চায়, তারা গণতান্ত্রিক মতবাদ প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থটি এড়িয়ে গিয়েই এ বিষয়ে জনগণকে তথ্য প্রদান করে।

তারা এ বিষয়ে আলোচনা সবসময় পরিহার করতে চায় যে, গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে মানুষকে সার্বভৌমত্ব প্রদান করা, মানুষের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ করা, সংখ্যা গরিষ্ঠের ইচ্ছানুযায়ী আইন প্রণয়ন করা; এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠের চ্ছানুযায়ীই যে কোন বিষয়ে অনুমোদন, নিষেধাজ্ঞা, উৎসাহ প্রদান কিংবা তিরষ্কার করা। এ সকল গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার পরিবর্তে এ মতবাদের প্রচারকরা শুধুমাত্র নির্বাচনের বিষয়টি জনসম্মুখে তুলে ধরে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছানুযায়ী যা খুশী তাই করার জন্য অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে (তা না হলে সে সার্বভৌম হবে কিভাবে?) অতএব, এ ব্যবস্থায় সে চাইলে মদ পান করতে পারে, যিনাহ্‌ করতে পারে, ধর্মত্যাগ করতে পারে কিংবা পবিত্র বিষয় নিয়ে কটুক্তিও পারে। এ সবকিছুই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে অনুমোদিত।

মূলতঃ এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রকৃত বাস্তবতা এবং প্রকৃত অর্থ। এ সবকিছু অনুধাবন করার পরেও কিভাবে একজন মুসলিম, যে কিনা ইসলামী আক্বীদাহ্‌'র উপর বিশ্বাস করে বলতে পারে যে, গণতন্ত্র মুসলিমদের জন্য অনুমোদিত কিংবা গণতন্ত্র ইসলাম থেকেই উত্থিত?

ইসলাম জনগণ কর্তৃক খলীফা নির্বাচনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে। যদিও ইসলামে সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণভাবে শারী'আহ্‌', কিন্তু উম্মাহ্‌'র (জনগণ) বাই'আতের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়া যে কারও খলীফা হবার একটি মৌলিক শর্ত। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় সেই সপ্তম শতাব্দীর প্রম ভাগ থেকেই খলীফা নির্বাচন হয়েছে, যখন সমগ্র বিশ্ব স্বৈরশাসক ও রাজা-বাদশাহদের ভয়ঙ্কর অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল। কেউ যদি খোলাফায়ে রাশেদীন অর্থাৎ, আবু বকর (রা), উমর (রা), উসমান (রা.) এবং আলী (রা) এর নির্বাচন প্রক্রিয়াকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন, তবে এটা তার কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে, এদের প্রত্যেককে খলীফা হিসাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ্‌'র প্রভাবশালী অংশ এবং উম্মাহ্‌'র প্রতিনিধিদের কাছ থেকে বাই'আত গ্রহণ করা হয়েছিল। উমর (রা.) এর শাসনামলের শেষের দিকে আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) কে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল মুসলিম উম্মাহ্‌'র প্রতিনিধিদের (তৎকালীন মদীনার জনগণ) কাছ থেকে খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে মতামত সংগ্রহের জন্য।

মদীনার জনগণ খলীফা পদে কাকে নির্বাচিত করতে চায় এ তথ্য অনুসন্ধানে তিনি মদীনার বহুসংখ্যক মানুষের বাসগৃহে প্রবেশ করে জনগণের মতামত যাচাই করেছিলেন। তিনি মদীনার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, সামগ্রিকভাবে জনমতের পালা উসমান (রা) এর দিকেই ভারী হয়েছে। এরপর, উসমান (রা) কে বাই'আতের মাধ্যমে খলীফা হিসাবে নির্বাচন করা হয়।

পরিশেষে একথা বলা যায় যে, গণতন্ত্র একটি কুফরী ব্যবস্থা। এটি এ কারণে নয় যে, এটা মানুষকে শাসক নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়; কারণ এটি প্রকৃতঅর্থে মূল আলোচ্য বিষয়ও নয়। বরং এটি এ কারণে যে, যে কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলভিত্তিই হল মানুষের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, এ মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার নয়। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন:

"বস্তুত সার্বভৌমত্ব ও শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কারো জন্য নয়।" [সূরা ইউসুফ: ৪০]

"কিন্তু না, তোমার রব এর শপথ, এরা কিছুতেই ঈমানদার হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের পারস্পরিক মতভেদের ব্যাপারসমূহে তোমাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে নেবে। অতঃপর তুমি যাই ফায়সালা করবে, সে সম্পর্কে তারা নিজেদের মনে কিছুমাত্র কুন্ঠাবোধ করবে না, বরং এর সম্মুখে নিজেদেরকে পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেবে।" [সূরা আন-নিসা : ৬৫]

এরকম আরও অনেক প্রসিদ্ধ দলিল রয়েছে যা নিশ্চিত করে যে, আইন প্রণয়নের একমাত্র ক্ষমতা হল আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার।

এছাড়া, আরও গভীরভাবে বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যে, গণতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়, যেখানে কোন নারী বা পুরুষ হালাল-হারামের প্রতি লক্ষ্য না করেই যা খুশী তাই করতে পারে। গণতন্ত্র ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে ধর্মত্যাগের অধিকার প্রদান করে এবং ধর্ম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনরূপ বাঁধা আরোপ করে না। এছাড়া, মালিকানা অর্জনের স্বাধীনতা মূলতঃ ধনীকে অসৎ ও প্রতারণাপূর্ণ উপায়ে দূর্বলকে শোষণ করার অনুমোদন দেয়; ফলে, ধনীর সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দরিদ্র আরও বেশী দরিদ্র হতে থাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সত্য বলাকে উৎসাহিত করে না, বরং উম্মাহ্‌'র পবিত্র আবেগ-অনুভূতিকে নির্মম আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করতেই তা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি এ পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে যে, যারা মত প্রকাশের ছদ্মাবরণে ইসলামকে আক্রমণ করে তাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার মানুষ হিসাবে গণ্য করা হয় এবং এ হীনচেষ্টার জন্য তাদেরকে পুরস্কৃতও করা হয়।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী শাসনব্যবস্থা (খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা) রাজতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদী, ফেডারেল, প্রজাতান্ত্রিক কিংবা গণতান্ত্রিক কোনটিই নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন