সময়ে বেঁচে আছি। কাগজের উপরে ২০১২ সাল লিখতে গেলে হাতে
কেমন যেন বেঁধে যায়। দু'হাজার বছর
পেরিয়ে আরেকটা যুগ কেটে যাচ্ছে হযরত ঈসা আলাইহিস
সালামের মৃত্যুর পরে। আজ থেকে পনের'শত বছর আগে
চলে গেছেন পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর চরিত্রের মানুষটি। হয়ত হাজার-কোটি বছরের
আগের এই পৃথিবী -- তার একটা আবশ্যকীয় ধ্বংসের নিশ্চিত বারতা ছিলো নবীকরীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিদায়ের মাঝেই।
এরপর আরো কতকিছুর ইতিহাস! মিশরের ফারাওদের পিরামিডগুলোর ছবি
দেখছিলাম সেদিন একটা ওয়েবসাইটে, দেখছিলাম সেই ফিরাউন 'নেমেসিস' এর মৃতদেহটার
চিত্র। বনী ইসরাইল জাতিগোষ্ঠীর মাঝে কত যে নবী এসেছিলেন আল্লাহর দ্বীনের
দাওয়াহ প্রচারের জন্য! হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এবং হযরত হারুন
আলাইহিস সালামের পরেই শেষ হয়ে যায় প্রবল প্রতাপশালী ফিরাউন এর
"খোদায়ী"। তাদের ইতিহাসটা জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম পবিত্র কুরআনুল কারীম
তিলাওয়াতের সময় বারবার "ইয়া বানী ইসরাইল" আসে বলে...
পিরামিড কীভাবে বানিয়েছিলো, কীভাবে অত বছর
আগে এতগুলো মৃতদেহকে 'মমি' করে রেখে দিয়েছিলো ফারাওরা --
সেই রহস্য আজো উন্মোচিত হলো না আমাদের এই 'ড্রোন হামলার' যুগেও। সেই
ক্ষমতাশালী রাজারাও হারিয়ে গেছে... কোথায় হারালো তারা? মৃত্যুর
কাছেই। যেখানে এই জগতের সমস্ত প্রাণের একটাই নিশ্চয়তা আছে -- সেটা হলো মৃত্যু।
আচ্ছা, ইতালির পম্পেই নগরীতে কী হয়েছিলো? আগ্নেয়গিরির
অগ্নুৎপাত না? পুরো নগরীটাই হারিয়ে গিয়েছিলো সেই উত্তপ্ত লাভাতে। ভষ্মীভূত
হয়ে গিয়েছিলো একটা রঙ্গিন শিল্পকলার নগরী। পিসার হেলানো মিনারের মতন
আর কিছু কেন আর কেউ হেলাতে পারলো না? এখনো কেন সবাই যখন উঁচু উঁচু টাওয়ার বানাচ্ছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
এর প্রবল প্রযুক্তিতে তখনো সেই সহস্র বছর আগেকার হারিয়ে যাওয়া সভ্যতাগুলোকে
কেন বুড়ো আঙ্গুল দেখানো যাচ্ছেনা?
আমার কাছে অনুভব হয় -- আমরা যেমন আইফোন, আইপ্যাড আর
স্মার্টফোনের যুগে আঙ্গুলের স্পর্শে কল করে, ছবি তুলে, ফেসবুকে
স্ট্যাটাস আপডেট করে 'কানেক্টেড' থেকে 'কমিউনিকেট' করে নিজেদের স্মার্ট মনে করছি -- অমন স্মার্ট সভ্যতা এই
পৃথিবী হাজার হাজার পেয়েছে। আমরা খালি একটা সময়কে অতিক্রম করছি। ঘুরে ফিরে এই
জীবনধারণে একটা গুগল ও মাইক্রোসফটের প্রোগ্র্যামার হওয়াতে, ব্রিটিশ
আমেরিকান টোব্যাকোতে উঁচু বেতনের চাকুরি করার কৃতিত্ব আসলে গর্বিত হবার এমন কিছু
না যা কিনা কোটি বছরের এই পৃথিবীর সমুদ্রসমান ইতিহাসে
জায়গা পাবার একটা ফোঁটা জল হতে পারে!!
আমরা এতই ক্ষুদ্র একেকটা স্বত্ত্বা। তবে হ্যাঁ, এরই মাঝে
সফলতাও আছে। দেখা যায়না! আমার পাশের বাড়ির টিনের চালার ঘরে বড় হওয়া
করিম আর সামনের দিকের অ্যাপার্টমেন্টের ন্যান্সী আপুর ভাই এরিক -- এই দু'জনের জীবনে জন্মের আকাশ-পাতাল
ব্যবধান। তাতে কারো কোন ক্রেডিট নাই। করিম, এরিকদের সাথে আম্রিকাতে জন্ম নেয়া জাস্টিন বিবার আর সিডনির মাইকেলের
জন্ম আর জীবনধারণের উপকরণ আর পরিবেশে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আবার এই মার্কিন
ও ইংরেজ হিসেবে জন্মানো জাস্টিন বিবার আর এমা ওয়াটসনদের তুলনায় সেই
ফারাওদের রাজপ্রাসাদের খেনশা ও খুফুদের জীবন খুব খারাপ ছিলোনা। তাদের ছিলো
অবারিত রাজ্যক্ষমতা আর বিশাল এলাকার
রাজত্ব -- অসামান্য প্রযুক্তি -জ্যোতির্বিজ্ঞান -শিল্পকলা।
তাহলে সফলতা কোনটা? আইফোন, ম্যাকবুক, মজার বিছানা, হিপহপ গান শুনে নিজেকে
স্মার্ট ভাবা, জোশিলা বয়ফ্রেন্ড আর খুউল গার্লফ্রেন্ড থাকা, ব্যাটে/জিপিতে
অথবা মাইক্রোসফটে চাকুরি করে বিশাল টাকা ঘরে আনা? এই টাইপেরই স্মার্ট মানুষ
এই জগতে আরো শতকোটি ছিলো। কিন্তু খুব কম জনই আসলে সফল। এই জীবন কেন --
এই প্রশ্নের উত্তরে কেউই আসলে ভাবতে চায়নি। নিজেদের ভাবনাদের মাটিচাপা
দিয়ে আবার ফিরে যাওয়া শরীরের চাওয়ার কাছেই...
ডাক্তার হয়ে, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে, বিশাল বাড়ি-গাড়ি করে, অনেক টাকার ব্যাংক-ব্যালেন্স
করে, পার্লারে
গিয়ে চুলস্ট্রেইট-রিবন্ডিং-ম্যানিকিউর-পেডিকিউর করে, চুলে জেল
লাগিয়ে স্পাইক করে দামী পার্ফিউম লাগিয়ে নতুন লেটেস্ট মডেলের বাইকে ভুমভুম
করে রাস্তা কাঁপানোতে? এগুলো আসলে কোন সফলতা না। সফলতা আসলে সেই মহান আল্লাহ
সুবহানাহু ওয়া তা'আলার দাসত্ব
করাতে -- যেই আল্লাহর দাসত্ব করা এই পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম
আলাইহিস সালাম তার জীবনসঙ্গিনী হযরত হাওয়াকে নিয়ে দু'জন মিলে ছিলেন কেবল তখনো একমাত্র কাজ ছিলো। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
মানুষ আমরা -- একটা ভূমিকম্প, একটা সুনামি আমাদেরকে ভাসিয়ে গ্রাস করে দেয়। আমাদের এই
দুনিয়া অনন্ত জগতের আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। যেই অনন্ত জগতের
শুরুতেই আমার পৃথিবীতে আমি যতটুকুই সুবিধা পেয়েছি তার অনুপাতেই বিচার হবে --
বিচারক হবেন মহাবিশ্বের অধিপতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা। যিনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিসেরও
নিপুণ বিচার করবেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবারই সমান আপন। সৌদিতে জন্ম
নেয়া পবিত্র কাবার খতীবের যতটা কাছে তিনি, সেনেগালের
আব্দুল্লাহ নামের ছেলেটাই হোক, উইসকনসিনের ইয়াসমিন হোক, ঢাকার তানভীরই
হোক, মিশরের
নুসাইবা হোক -- সবারই তিনি সমান আপন, একটুও পার্থক্য নাই। গায়ের রঙ-বংশ-বর্ণ-গোত্র-সময়-সম্পদ-জ্ঞান
সবকিছুর উর্ধে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের প্রিয়তম, অন্তরতম, আপনতম। জীবনের প্রতিটি ক্ষণ আমাদের সবারই সমান স্কেলে
মূল্যায়ন হবে উনার কাছে। আল্লাহ শুধু দেখবেন অন্তরের আর্তিগুলো, জীবনে পাওয়া সময়ে তার
নির্দেশ পালনের প্রতি ভালোবাসাটুকু, তার স্মরণে চোখের পানিগুলো -- এটাই না
জীবন!! সব সংকীর্ণতা,শংকার উর্ধে অর্থপূর্ণ জীবন আমাদের
সবারই!
এই অল্প ক'টি বছরের এই
জীবনের পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে দুঃখী হলে কি চলে? যেদিন
জান্নাতে সুন্দর লেকের উপরে বয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
হয়ত দেখা হবে হযরত ইদ্রিসের সাথে, হযরত আবু বকরের সাথে, হয়ত আমাদের আব্বু-আম্মুর সাথে, হযরত আসিয়া
আর হযরত ফাতিমাদের সাথে , আর আমাদের জীবনে পাওয়া
প্রিয় ভাই-বোন-বন্ধুদের সাথে -- সেদিন অনুভব করতে পারবো আমাদের জীবনটা কতটা সুন্দর ছিলো, ছিলো
অর্থপূর্ণ! "দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র" -- আমরা জানি বলেই তো চারা বুনেছি ঈমান দিয়ে এই বুকে। পানি
দিয়ে উর্বর করবো আমল দিয়ে, যখন নিড়ানি দিবো তখন কষ্ট হয়ে যাবে বুকের উপর; যন্ত্রণা হবে। আবার যত্ন নেবো ঈমানের, আমলের।
ভালোবাসবো আল্লাহকে, নবীদেরকে, আব্বা-আম্মাকে, আর তাদেরকে যারা আল্লাহকে ভালোবাসেন। ফল তো আজকে না --
এই শস্যের চালান আমরা রিসিভ করবো ইয়াওমুল কিয়ামাহ তে গিয়ে।
আমাদের রব, বিশ্বজাহানের প্রতিপালক, আল্লাহ
সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাদের ঈমানকে শক্তিশালী করে
দিন, আমাদেরকে তিনি
সিরাতাল মুস্তাকীমের পথ দেখান, আমাদের মুসলিম উম্মাহকে একই পতাকাতলে আসার তাওফিক দান করুন, আমাদেরকে
আল্লাহ ও তার রাসূলকে সবার চাইতে ভালোবাসার এবং তাদের নির্দেশিকা অনুযায়ী
দুনিয়ার জীবন পরিচালনা করে অনন্ত জগতে সফলদের দলে অন্তর্ভুক্ত
হবার যোগ্য করে দিন।
সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন