সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

খিলাফত রাষ্ট্র কিভাবে জনগণ কর্তৃক শাসকের জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করবে ?

বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা যাকে বলা হয়ে থাকে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী ও জবাবদিহিতামুলক সরকার কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে এই ব্যবস্থায় জনগণের ক্ষমতা থাকে সংসদে ৩০০ জন স্বেচ্ছাচারী নির্বাচন করা পর্যন্ত। যার ফলে নির্বাচিত হওয়ার পর তারা জনগণকে ভুলে নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত থাকে।

অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠীর এই বিশ্বাসঘাতক দেখে জনগণের আর কিছু করার থাকে না কারন তথাকথিত স্বাধীন বিচার বিভাগ সবসময় সরকার পক্ষের উকিলদের দখলে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ন্যায়বিচারতো দূরে থাক বরং জনগণের উপর জুলুম করা হয়।

অনেকে বলে থাকেন খিলাফত রাষ্ট্রে খলিফার স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ আছে। আশা করি এই আলোচনায় আমরা তাদের এই ধারনা পরিবর্তন করতে পারব।

যাইহোক আলোচনাটি দুটি ধাপে করা যেতে পারে:

১। স্বেচ্ছাচারিতা
২। জবাবদিহিতা

স্বেচ্ছাচারীতাঃ

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষ আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে অধিকাংশের মতামত সবসময় সঠিক না হতে পারে আবার মানুষের প্রকৃতিগত কারনে এই সকল আইন স্বার্থান্বেষী ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে বাধ্য। সর্বোপরি, আইন প্রণয়নের মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং মানুষ কর্তৃক আইন প্রণয়ন করা প্রকাশ্য কুফর।

অন্যদিকে, খলিফা শরীয়া ব্যতীত অন্য কোন কিছু প্রবর্তন করতে পারবেন না ফলে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার কোন সুযোগ নেই।এছাড়াও খলিফা যদি শরীয়ার সাথে সাংঘর্ষিক কিছু করেন তবে মাহাকামাতুল মাযালিমে তার বিচার করা হবে।

জবাবদিহিতা:

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ ও শাসকের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন বিচার বিভাগ নেই। আর বাস্তবতা হচ্ছে বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানোর কারনে যে সরকার ক্ষমতায় আসে বিচার তার পক্ষে থাকে। অন্যদিকে সরকারের অপরাধ গুলো দমনের জন্য তথাকথিত দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে যা ক্ষমতাশীলদের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে।

কিন্তু খিলাফত ব্যবস্থায় মাহাকামাতুল মাযালিম একটি বিশেষ আদালত যা কাজ হবে শুধুমাত্র জনগণ ও শাসকের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদের মীমাংসা করা। যদিও এই বিভাগের বিচারপতিকে খলিফা নিয়োগ করবেন কিন্তু খলিফাকে নিয়ে কোন বিচার চলাকালীন সময়ে খলিফা বিচারপতিকে বরখাস্ত করতে পারবেন না। মাহাকামাতুল মাযালিমের বিচারক নিজে থেকেও সরকারে দুর্নীতির বিষয়ে খেয়াল রাখবেন এবং এর জন্য কারো মামলা করার প্রয়োজন নেয়।
নিম্নে মাহাকামাতুল মাযালিম সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হল:

ইসলামী শারী’আহ্‌ বিচারকদের তিন ভাগে ভাগ করে:

একজন হলেন কাজী-উল-খুশুমাত - যিনি হুদুদ এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যকার বিবাদ নিরসন করবেন।

দ্বিতীয় জন হলেন কাজী-উল-মুহতাসিব - যিনি কোন আইন ভঙ্গের কারণে জনগণের স্বার্থ এবং তাদের সম্পদের জন্য ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করবেন।

এবং তৃতীয় জন হলেন, কাজী-উল-মাজালিম - যিনি রাষ্ট্র এবং জনগণের মধ্যকার বিরোধ নিরসনের দায়িত্বে ন্যাস্ত থাকেন।

বিচারকের যোগ্যতার শর্তাবলী

যিনি বিচারকের গুরুদায়িত্বভার গ্রহণ করবেন তাকে অবশ্যই মুসলিম, মুক্ত (আজাদ), পূর্ণবয়স্ক, সুস্তমস্তিষ্কসম্পন্ন, ন্যায় বিচারক, ফকীহ (বিজ্ঞ আলেম) এবং শরীয়াহর আইন প্রয়োগের ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে।

যিনি মাজালিমের বিচারকের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন তাকে উপরোক্ত শর্তপূরণ করা ছাড়াও পুরুষ ও মুজতাহিদ হতে হবে, যা প্রধান বিচারপতির (chief justice)  ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ মাজালিমের বিচারকের কাজে বিচার ও শাসন দু’টি বিষয় জড়িত ও এখানে শাসকের উপর শরীয়াহ বাস্তবায়ন করা হয় । সুতরাং  বিচারকের অন্যান্য পদের ব্যতিক্রম হিসেবে অতিরিক্ত যোগ্যতার শর্তে মাজালিমের বিচারককে পুরুষ হতে হবে। আবার শাসকগণ আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে শাসন করছেন কিনা অর্থাৎ এমন কোন আইন প্রয়োগ করছেন যার কোন শরীয়াগত ভিত্তি নেই বা যে ভিত্তি তিনি ব্যবহার করছেন তা ঘটনার সাথে সামজ্ঞস্যপূর্ণ নয়, তা বুঝবার জন্য তাকে মুজতাহিদও হতে হবে, । একজন মুজতাহিদই এ ধরনের মাজালিমা বুঝতে পারবেন। আর তাই যদি তিনি মুজতাহিদ না হন, তাহলে এমন কোন কিছু দিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন যে ব্যাপারে তার জ্ঞান নেই - যা হারাম। সেকারণে শাসক  পদ ও অন্যান্য বিচারিক পদের ব্যতিক্রম হিসেবে অতিরিক্ত যোগ্যতার শর্তে মাজালিমের বিচারককে মুজতাহিদ হতে হবে।

মাজালিম এর বিচারক 

মাজালিমের বিচারককে নিয়োগ দেয়া হয় রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যক্তির উপর যে কোন মাজালিমা বা অন্যায় আচরণের বিচারের জন্য। আর এ ব্যক্তি রাষ্ট্রের নাগরিক বা অধীনস্ত কেউ হতে পারেন। আর এ মাজালিমা বা অন্যায় আচরণ খলিফা, খলিফার অধীনস্ত কেউ কিংবা কোন সরকারী জনপ্রশাসন সংঘটিত করতে পারেন

মাজালিমের বিচারক নিয়োগ ও অপসারণ

খলিফা বা প্রধান বিচারপতি মাজালিমের বিচারক নিয়োগ করে থাকেন। যেহেতু মাজালিম বিচারব্যবস্থার একটি অংশ সেহেতু সব ধরনের বিচারকদের অবশ্যই খলিফাই নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এটি জানা যায় রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাজ থেকে যে, তিনি নিজে সব বিচারকদের নিয়োগ দিতেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, মাজালিমের বিচারককে খলিফাই নিয়োগ দেবেন। তবে প্রধান বিচারপতি এ নিয়োগ দিতে পারবেন যদি এ সংশ্লিষ্ট একটি অনুচ্ছেদ তার নিয়োগে উল্লেখিত থাকে। এটা অনুমোদিত যে, রাষ্ট্রের রাজধানীতে অবস্থিত মাজালিমের প্রধান আদালত (মাহকামাত উল মাজালিম) খলিফা, তার সহকারীগন ও প্রধান বিচারপতির মাজালিমা খতিয়ে দেখবেন। বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত মাজালিমের আদালতের শাখাসমূহ ওয়ালী ও অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তাদের মাজালিমা খতিয়ে দেখবেন। খলিফা কেন্দ্রীয় মাজালিম আদালতের বিচারপতিকে বিভিন্ন প্রদেশের  শাখা আদালতসমূহের মাজালিম বিচারপতিদের  নিয়োগের ক্ষমতা দিতে পারেন।

মাজালিমের প্রধান আদালত (মাহকামাত উল মাজালিম) এর বিচারপতিদের খলিফা নিয়োগ ও অপসারণ করতে পারবেন। কেন্দ্রীয় মাহকামাত উল মাজালিম-এর প্রধান বিচারক এর ক্ষেত্রে, যিনি খলিফার অপসারণের বিষয়টি খতিয়ে দেখেন; অপসারণের ব্যাপারে নীতিগতভাবে খলিফাই দায়িত্বশীল যেহেতু তিনি তাকে নিয়োগ  দিয়ে থাকেন। কিন্তু খলিফার উপর কোন তদন্ত বা বিচার চলাকালে মাহকামাত উল মাজালিমকে অপসারণের ক্ষমতা খলিফার হাতে থাকলে তা হারামের দিকে যাবে। এ অবস্থায় এই মূলনীতিটি প্রযোজ্য যে, ‘হারাম করবার উপায়সমূহও হারাম’। এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকায় উক্ত নীতিটি ভালভাবেই প্রযোজ্য।  

এ ধরনের পরিস্থিতি তখনই উদ্ভব হবে যখন খলিফা, তার সহযোগীবৃন্দ বা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কোন মামলা চলতে থাকবে। উক্ত পরিস্থিতিতে ঐ সময় মাহকামাত উল মাজালিম কে অপসারণের ক্ষমতা খলিফার হাতে থাকলে তা বিচারের রায়কে প্রভাবিত করতে পারে এবং এভাবে খলিফা এবং তার সহযোগিকে অপসারণের ক্ষমতা সংকুচিত হতে পারে।

মাজালিমের বিচারকের আবশ্যিক ক্ষমতা

মাজালিমের বিচারকের দায়িত্ব হল যে কোন ধরনের মাজলিমা বা অন্যায় আচরণ খতিয়ে দেখা। হোক সেটা সরকারী কর্মচারীর মাধ্যমে, অথবা খলিফার কাজের সাথে শরীয়ার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত, বা খলিফা কর্তৃক জারিকৃত আইন-কানুন সংক্রান্ত বা সংবিধানের আইনি ব্যাখ্যা সংক্রান্ত, কিংবা নতুন করারোপ ইত্যাদি কারণে সৃষ্ট। 

মাজালিমের বিচারকের কাছে অভিযোগ করা না হলেও সংশ্লিষ্ট আইন ভঙ্গের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবার ব্যাপারে দলিল রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে এখানে কোন ফরিয়াদি থাকা অপরিহার্য নয়। মাজালিমের বিচারকের কাছে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দায়ের না করলেও যে কোন মাজালিমা তদন্ত করার এখতিয়ার তার রয়েছে এবং এর জন্য ফরিয়াদি বা  অভিযুক্ত কারোরই  অংশগ্রহণ জরুরী নয় ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন