বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৩

আফগানিস্তানঃ সাম্রাজ্যবাদীদের মরণ ফাঁদ

সম্প্রতি আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের শর্ত হিসেবে দেশটির জন্য নয়া সংবিধান প্রণয়নের দাবি করেছে তালেবান।আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত দু’দিনব্যাপী বৈঠক শেষে এক ঘোষণাপত্রে এ শর্ত দেয় তালেবান। ২০ ডিসেম্বর ২০১২ ওই বৈঠক শুরু হয়। ২০০১ সালে মার্কিন সামরিক আগ্রাসনে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে উত্খাত হওয়ার পর এই প্রথম সরকারের সঙ্গে তালেবান শীর্ষ নেতাদের এ ধরনের বৈঠক হলো। ফ্রান্সের থিঙ্ক ট্যাংক ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ (এফআরএস) এ বৈঠকের আয়োজন করে। মজার ব্যাপার হলো ন্যাটোর প্রভাবশালী সদস্য ফ্রান্স এ মধ্যস্থতার আয়োজন করছে। উদ্দেশ্য, পরাজিত আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের আফগানিস্তান থেকে ‘নিরাপদ প্রস্থান’-এর ব্যবস্থা করা। মনে পড়ে ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০০১ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘এই ধর্মযুদ্ধ (ক্রুসেড), এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ খুব অল্প সময়ের মধ্যে শুরু হতে যাচ্ছে।’ ২০০১ সালে ক্রুসেড ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে বাহিনী এখানে তালেবান নামক মুসলিম সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডে নেমেছিল, আজ সেই আমেরিকা/ন্যাটোজোটের সঙ্গে সন্ত্রাসী আল কায়দার আশ্রয়দাতা মুসলিম সন্ত্রাসী তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা! সত্যি ইতিহাস বড় বিচিত্র। ‘ন্যায়ের জন্য যুদ্ধবাজ’ বুশ-ওবামা কি আজ অন্যায়ের সঙ্গে আপস করছেন!

আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সালে ন্যাটো সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর, বিশেষ করে ওই বছর অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপি হলে দেশটির সরকারের পতন ঘটতে পারে। ৮ অক্টোবর, ২০১২ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) এক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়। আফগানিস্তান বিষয়ক আইসিজির সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ক্যান্ডেস রনডক্স বলেন, ‘আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সৈন্য প্রত্যাহার কাবুল সরকারের পতন ঘটাতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দ্রুত শেষ হয়ে আসছে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ ও ২০১০ সালে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর দেশটিতে আবারও কারচুপির নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আসছে।

পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো সাম্প্রতিক ইতিহাসেও এশিয়ার এ গুরুত্বপূর্ণ স্থানটিকে দখলে রাখতে চায়। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য বাহিনী পাঠিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নেয়ার পর এক দশক কাল (১৯৭৯-১৯৮৯) সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিটি এ দেশটিকে জোরপূর্বক দখল করে রাখে। এর পরের ইতিহাস প্রায় সবার জানা। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে হটানোর জন্য পুঁজিবাদী অপর আরেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকা তার কৌশলগত মিত্র পাকিস্তানের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তালেবান মুজাহিদিনদের সহায়তা করে। তালেবান মুজাহিদিনদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ও আক্রমণের মুখে ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানের মুজাহিদিনদের কাছে আত্মসমর্পণ করে দেশে ফিরে যায়। উল্লেখ্য, তখন তালেবান মুজাহিদিনদের আমেরিকা বা পশ্চিমা মিডিয়াগুলো জঙ্গি বলে সম্বোধন করতো না। কিন্তু, আজকের নতুন প্রজন্মের একজন সাধারণ তরুণের সামনে যদি তালেবানকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ বলে সম্বোধন করা হয়, তাহলে সে হয়তো বিস্ময়ে আঁতকে উঠবে। আর তা যদি আমেরিকান প্রেসিডেন্টের মুখ দিয়ে বের হয়, তখন বিষয়টি কেমন যেন অবিশ্বাস্য রূপ লাভ করবে।

একদিন এ ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৮৫ সালে একদল তালেবান মুজাহিদিন তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগানের সঙ্গে ওয়াশিংটনে এক বৈঠককালে তিনি তাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ (Freedom fighter) হিসেবে অভিহিত করেন।

১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়া আফগানিস্তান দখল করে। এর ১০ বছর পর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু যুদ্ধে পরাজিত হয়নি, দুঃখজনকভাবে ভেঙে পড়ে বিশাল বিস্তৃত এ ইউনিয়নটি। রাশিয়া আফগানযুদ্ধে আমেরিকা-ন্যাটোর চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল।

তত্কালীন রাশিয়ার সীমানার মধ্যেই ছিল আফগানিস্তান। আমেরিকার চেয়ে বেশি সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিল রাশিয়া। রাশিয়ার নিয়োজিত সৈন্য সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার। রাশিয়ান সৈন্যরা আমেরিকান সেনাবাহিনীর চেয়ে ভাষাগত দিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। তারা পশতু, উজবেক ও তাজিক ভাষায় দক্ষ ছিল। শহরাঞ্চলগুলোতে রাশিয়ান সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণও বেশি ছিল। যা আমেরিকান ও ন্যাটো বাহিনীরও ছিল কিন্তু দুই বাহিনী মূলত পর্যুদস্ত হয় গ্রামাঞ্চলের যুদ্ধে।

১৯৮৬ সালে মার্শাল অ্যাখরোমেইভ বলেন (Marshal Akhromeyev), “আমরা কাবুল ও প্রাদেশিক কেন্দ্রগুলোতে নিয়ন্ত্রণ করলেও কিন্তু ... আমরা আফগান সাধারণ মানুষের জন্য যে যুদ্ধ করেছি তাতে হেরেছি।” ১৯৮৬ সালে গর্ভাচেভও ওবামা প্রশাসনের মতো সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে আফগানিস্তানে যুদ্ধ জয়ের চেষ্টা করেছিলেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ওবামা ১ ডিসেম্বর, ২০০৯ একই ঘোষণা দিয়েছিলেন ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বলেন,“আরো সৈন্য নিয়োগ, আরো টাকা খরচ ও আরো কঠিন প্রচেষ্টা আমাদের অবশ্যই চালাতে হবে।”

আমেরিকার আগে ফ্রান্স ভিয়েতনামে আক্রমণ করেছিল আর আফগানিস্তানে রাশিয়া। আর দুই আগ্রাসী দেশই ছিল তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী। তাই শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা ভিয়েতনাম ও আফগানদের আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরণা যোগায়। দুই ক্ষেত্রেই আমেরিকানদের এক ভিন্ন এবং প্রতিকূল পরিবেশে যুদ্ধ করতে হয়। আর লজিস্টিক সাপোর্টও তারা ঠিকমত পায়নি। আর আফগানিস্তানে আরেকটি সমস্যা হলো আমেরিকান সবচেয়ে চৌকস মেরিন সেনা তথা তাদের নৌবাহিনী কাজে আসেনি। কারণ, আফগানিস্তান কোনো সাগর বা নদীবেষ্টিত নয়।

দুটি যুদ্ধই ছিল গ্রামভিত্তিক যুদ্ধ। গ্রামে বাস করা ৮০ ভাগ মানুষ আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষ পোষণ করে। উপজাতীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যেও আমেরিকানদের প্রতি নেই কোনো গ্রহণযোগ্যতা। অথচ তালেবানের জন্য তারা নিরাপদ আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা। দু’ দেশই প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থা ও দুর্গম পাহাড়েঘেরা, যেখানে আধুনিক সাঁজোয়া যান নিয়েও আমেরিকানদের জন্য যুদ্ধ করা কঠিন। দুটি যুদ্ধেই ভাষান্তরকারীরা স্থানীয় যোদ্ধাদের আগ্রাসনকারীদের প্রতিটি পদক্ষেপের কথা জানিয়ে দিত। স্থানীয়দের সংস্কৃতিকবোধ উপলব্ধি না করে নারী-পুরুষ-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে বোম্বিং করে স্থানীয় যোদ্ধাদের দমন করার যে নীতি আমেরিকানরা নিয়েছিল, তা স্থানীয় মানুষের কাছে কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। বরং এতে স্থানীয় যোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আফগানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক বেশি ইসলামী মূল্যবোধ দিয়ে পরিচালিত। ভিয়েতনামের মতো একই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে অ্যান্থনি কোর্ডসম্যানের মতো বিশেষজ্ঞরা আফগানিস্তানে আমেরিকান নীতির ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন।

দুই মিলিয়নের দুর্ধর্ষ মঙ্গল সৈন্যদলসহ চেঙ্গিস খানের আগ্রাসন থেকে শুরু করে আমেরিকা ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলো আফগানিস্তানের বাণিজ্যিক পথগুলো ও এর স্থলবেষ্টিত স্থানগুলোকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দখলে রাখার চেষ্টা করেছে। আফগানিস্তানকে পারস্য, গ্রিক, আরব, তুর্কি, মঙ্গল, বৃটিশ ও সোভিয়েতের মতো আগ্রাসনকারীদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু, কোনো দখলদার শক্তিই এ স্থানটি সফলভাবে জয় করে রাখতে পারেনি। বর্তমানের কারজাইয়ের চাপিয়ে দেয়া সরকারের বৈধতা ও নির্বাচনে বৈধতা নিয়ে এমনকি জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা প্রশ্ন তুলেছেন। ২০০৯ সালের নির্বাচনেও মাত্র ৩০% ভোটার ভোট দিতে এসেছিলেন। ২০০৯ সালে সমাজ বিজ্ঞানী থমাস এইচ জনসন ও ক্রিস ম্যাসন (Thomas H Johnson & Chris Mason) প্রভাবশালী ফরেন পলিসি জার্নালের এক আর্টিকেলে কারজাইয়ের সরকারকে ‘সম্পূর্ণভাবে অবৈধ, অদক্ষ চোরের সরকার’ বলে সম্বোধন করেন। একটি চাপিয়ে দেয়া সরকার ও চাপিয়ে দেয়া ব্যবস্থাকে (গণতন্ত্র) এ অঞ্চলের ইতিহাসে কখনও সফল হতে দেখা যায়নি। পশ্চিমা মিডিয়াগুলোতে এখানে গণতন্ত্রের যে সফলতার কথা বা তালেবান বিরোধিতার কথা বলা হয়, তা আফগানদের প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন নয়। কারণ, দখলদারিত্বের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন ও জরিপ কোনটি সম্ভব নয়। থমাস এইচ জনসন ও ক্রিস ম্যাসন বলেন, ‘আফগানরা ভদ্র জাতি হিসেবে সুপরিচিত। পশ্চিমা জনমত জরিপগুলো তাদের প্রত্যাশিত কিছু উত্তরকে প্রকাশ করে, যেগুলো পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকূলে, এগুলো আসলে আফগানদের প্রকৃত মতের প্রতিফলন নয়।’

গিলেস ডরোনসরো ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’-এর আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞ। তিনিও আফগানিস্তানে নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করছেন। তবে তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে আফগানিস্তানে তালেবানের শাসন প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার কথা বলেন। সম্প্রতি বিশ্লেষণধর্মী এক নিবন্ধে তিনি বলেন, ২০১৪ সালের পর আফগান সরকারের জন্য মার্কিন সমর্থন সীমিত হয়ে আসবে। তখন আরেকটি গৃহযুদ্ধ শুরু হবে এবং এতে বিজয়ীর বেশে ক্ষমতায় আসবে তালেবান। হয়তো এ ভবিষ্যত্ উপলব্ধি করে ডিক চেনি (Dick Cheney) আফগান যুদ্ধকে ‘না ফুরনো যুদ্ধ’(Endless War) বলে সম্বোধন করেছিলেন। আর আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারকে যদি আমরা পরাজয় বলি তবে আমেরিকান পুঁজিবাদী-সম্রাজ্যবাদীরাও হেরে বিতাড়িত হলো এই মুসলিম ভূ-খণ্ড থেকে।

খান শরীফুজ্জামান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন