বুধবার, ২ মে, ২০১২

ভু-রাজনীতির মর্মকথা

একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনেকগুলো ঘটনা ঘটলে অনেকের চিন্তার জগত এটা ভেবে মেঘাচ্ছন্ন হতে পারে যেকারা কোন উদ্দেশ্যে এসব করছেযেহেতু মুসলিম উম্মাহ পুরো পৃথিবীতেই ইসলামের দাওয়াকে ছড়িয়ে দিবেসেহেতু বিশ্ব বাস্তবতা সম্পর্কে জানা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এ বাস্তবতা অনুধাবন করা এবং বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও জাতির রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও অভিলাষ সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। বিশ্ব বাস্তবতা ও ক্ষমতার ভারসাম্যের মত ব্যাপারসমূহ বুঝবার জন্য কিছু জিনিস খেয়াল রাখা দরকার :

১. যে কোন রাজনৈতিক বাস্তবতা কিংবা কোন নীতির কৌশলগত অবস্থান নিরীক্ষণ অথবা কোন আপাত বাস্তবতা সাজানো নাটক কিনা এ ব্যাপারে বুঝতে হলে একজনকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বিবাদমান বিভিন্ন পক্ষগুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে। ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে সবসময় সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না, বরং যেসব রাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী শক্তির ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তাদের বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে সামগ্রিক ও ব্যাপক চিন্তা কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য ধরিয়ে দেয়।

২. ভূ-রাজনীতি রাজনীতির একটি অংশ। বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা না নিয়ে ভূ-রাজনীতি বুঝতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। রাজনীতির মাধ্যমে ভূ-রাজনীতি প্রতিভাত হয়। রাজনীতি হল একটি আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত রাষ্ট্রের নীতি, পরিকল্পনা ও কার্যপদ্ধতির অপর নাম। আর সেদেশের পররাষ্ট্রনীতি হল রাষ্ট্রের গন্তব্যকে সামনে রেখে গৃহীত নীতিসমূহ। রাজনীতি ভূ-রাজনীতির গতিপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করে। পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা পানির উৎসসমূহের নিয়ন্ত্রণ, তেলের রাজনীতি, সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ অথবা পারস্য উপসাগরীয় সংঘাত এর কোনটিই শুধুমাত্র এদের নিজ নিজ অবস্থানের কারণে নয়, বরং বিভিন্ন জাতির বিবিধ স্বার্থ কৌশলগতভাবে এদের গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

৩. পৃথিবীর কিছু কিছু জাতি আদর্শিক। এই আদর্শই তাদের আইন প্রণয়ন ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দেয়। যেমন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানী পুঁজিবাদী আদর্শের বিশ্বাসী রাষ্ট্র আবার এরকম অনেক রাষ্ট্র রয়েছে যারা ঠিক আদর্শিক নয়, তবে তাদের ইতিহাস ও অবস্থান নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করে। নিজস্ব স্বার্থ নীতিসমুহের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে, যেমন- পাকিস্তান ভারতের মধ্যে একধরণের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলতে থাকে এবং তিব্বত চীন থেকে স্বাধীন হতে চায়। আদর্শের প্রয়োগ অথবা জাতীয় স্বার্থের কারণেই বিশ্বরাজনীতি দ্বন্দ্ব বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে।

৪. সব দেশের অবস্থা সর্বদা একরকম থাকে না। শক্তিমত্তা অথবা দুর্বলতা, প্রভাব বলয় থাকা অথবা না থাকা, অন্য দেশের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি বিভিন্ন দিক থেকে একটি দেশের অবস্থান পরিবর্তনশীল। একারণে একটি ধ্রুব সত্যের ভিত্তিতে কোন দেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অসম্ভব। কারণ পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে রাষ্ট্রের গতিপ্রকৃতি ও নীতিসমূহ পরিবর্তন হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য করা একটি মন্তব্য এ শর্তসাপেক্ষে সঠিক হতে পারে যে, তা সময়ের সাপেক্ষে ধ্রুব নয়। যে কোন দেশের ক্ষমতাও সময় নিরপেক্ষ নয়।

৫. বিশ্বের বিবিধ দেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কাঠামো আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিচায়ক। এই পরিস্থিতি সুপার পাওয়ার ও তার সাথে বিবদমান পক্ষগুলোর সম্পর্কের আলোকে নির্ধারিত হয়। বিশ্বের সুপারপাওয়ারদের সম্পর্কে ধারণা ছাড়াও ক্ষমতার ভারসাম্যে অবদান রাখা পক্ষগুলো এবং এদের নীতি ও পরিকল্পনা বুঝতে হলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জ্ঞান থাকতে হবে। এসব নীতি ও পরিকল্পনা হল সুপারপাওয়ারের সাথে অন্যান্য শক্তি সমূহের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের প্রত্যক্ষ ফলাফল। একারণে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সুস্থির নয় বরং পরিবর্তশীল। বৈশ্বিক ভারসাম্যের যে কোন আলোচনা সময়ের ফ্রেমে সীমাবদ্ধ। যখন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হয় তখন এ আলোচনা আর প্রাসঙ্গিক থাকে না বরং ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়।

৬. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে একটি দশা থেকে অন্য দশায় স্থানান্তরিত হওয়া পরিস্থিতি পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করে। পরিস্থিতি ও অবস্থার এ পরিবর্তন রাষ্ট্রের শক্তিশালী অথবা দূর্বল হওয়া কিংবা অন্যদের সাথে সে রাষ্ট্রের সম্পর্কের শক্তিশালী কিংবা দুর্বল হওয়ার ফল। এসবক্ষেত্রে বিশ্বশক্তিসমূহের ক্ষমতার ভারসাম্যের কারণে বৈশ্বিক ভারসাম্য নির্ধারিত হয়। একারণে ক্ষমতার ভারসাম্য বুঝতে হলে বিশ্বরাজনীতিতে অবদান রাখা বিবিধ রাষ্ট্রের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা থাকা অপরিহার্য।

৭. একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিশ্ব বাস্তবতা বুঝতে হলে একজনকে পুরো বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে এমনটি নয়। পৃথিবীময় ক্ষমতার ভারসাম্য যেহেতু শক্তিধর রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের কারণে নির্ধারিত হয় সেকারণে দুর্বল ও প্রভাব বিস্তারে অক্ষম রাষ্ট্রসমূহ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান থাকার আবশ্যকতা নেই।

-     মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে যে সংকট তা চীন ও মার্কিনীদের মধ্যকার সংঘাতেরই বহিঃপ্রকাশ। চীন তার পেছনের দরজায় কোন ধরনের সংঘর্ষ চায় না বলেই উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার একত্রিকরণের ব্যাপারে বহুপাক্ষিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ ধরনের বৈঠক থেকে আসা সংকেতসমূহ ছিল পরস্পরবিরোধী। চীন এসব প্রচেষ্টায় গা-ছাড়া হতাশাব্যঞ্জক ভূমিকা পালন করলেও মার্কিনীরা যুতসই কুটনীতির মাধ্যমে সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি উত্তর কোরিয়ার সাথে আলোচনায় না বসায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হচ্ছে। প্রলম্বিত ও হতাশাব্যঞ্জক অগ্রগতি ঐ অঞ্চলে প্রায় ১০০০০০ এর মত মার্কিন সেনার অবস্থানকে সমর্থন যোগাচ্ছে। কারণ ২০০৬ সালে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমার পরীক্ষার মাধ্যমে আরও দীর্ঘ সময় ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন উপস্থিতির যৌক্তিকতা পুনপ্রমাণিত হয়েছে। জে রিলে একটি কৌশলপত্রে উল্লেখ করেন: অত্র অঞ্চলে অবস্থানরত মার্কিন সেনা কেবলমাত্র অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর”-এর জন্য নয়, বরং দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণই উপস্থিতির প্রধান কারণ। প্রচুর পরিমানে তেল সম্পদে সমৃদ্ধ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্যের জাহাজ চলাচলের পথের খুব কাছে অবস্থিত এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রগুলোতে প্রবেশের জন্য সুগম। মার্কিনীদের প্রলম্বিত উপস্থিতি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের সাথে সামরিক জোট গঠন চীনের হতাশাকে বাড়াচ্ছে এবং আসিয়ানের মত আঞ্চলিক ফোরাম থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহের স্বাধীন ইমেজ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

-       পূর্ব ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বিরোধের জের ধরেই দক্ষিণ ওসেটিয়া জর্জিয়া থেকে স্বাধীন হওয়ার ডাক দিচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর সময়ে রাশিয়াকে চাপে রাখার জন্য ও প্রভাব বলয়ের ভেতর রাখবার জন্য মার্কিনীরা বলকান যুদ্ধের অবতারণা করেছিল। ঐতিহাসিক কারণে সার্বিয়াকে রাশিয়া তার দলে ভেড়াতে পেরেছে এবং মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। মার্কিন এজেন্ডা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সার্বিয়া একটি বড় বাধা ছিল। সেকারণে শুরুতেই সার্বিয়া থেকে মন্টিনিগ্রো পৃথকীকরণের মাধ্যমে একে দুর্বল করার প্রচেষ্টা চালানো হয় এবং পরবর্তীতে কসোভোকে সার্বিয়া থেকে আলাদা করা হয়। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য কসোভোতে সার্বিয় অবস্থান এবং সার্বিয়ার ভেতরে ন্যাটো হামলা পরিচালনা করে। উত্তর ওসেটিয়া হল রাশিয়ার একটি আধা স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় জর্জিয়ার অন্তর্গত ছিল দক্ষিণ ওসেটিয়া। এ অঞ্চলে মার্কিনীদের বিপাকে ফেলবার জন্য রাশিয়া তার প্রভাব ব্যবহার করে উত্তর ওসেটিয়া মাধ্যমে দক্ষিণ ওশেটিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে উদ্বুদ্ধ করে। রাশিয়া সেকারণে তাসকিনভ্যালী (Tskhinvali) অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতৃবৃন্দের সাথে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখে। অধিকাংশ দক্ষিণ ওসেটিয়দের রাশিয়ান পাসপোট রয়েছে এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা রাশিয়ান মুদ্রা রুবল ব্যবহার করে।

-     তিব্বত থেকে চীনের বিচ্ছিন্নতার আহবান মূলতঃ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের ফসল। ১৯৫০ এর দশকে চীন সমাজতন্ত্রকে তার আদর্শ হিসেবে গ্রহণের পর থেকে সি.আই.এ এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে। ১৯৫৯ সালে সংগঠিত রক্তক্ষয়ী মুক্ত তিব্বত আন্দোলন মূলত সমাজতান্ত্রিক চীনের বিরুদ্ধে সি.আই.এ সমর্থিত গোপন অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা। হাজার হাজার তিব্বতি এতে জীবন দিলেও দালাই লামা ও তার প্রায় ১০০০০০ এর মত অনুসারী দুর্গম হিমালয় দিয়ে নেপাল ও ভারতে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। সি.আই.এ আমেরিকার কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের কেম্প হিলের নিকটে লিডভিলে দালাইলামার অনুসারীদের জন্য গোপন সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করে। তিব্বতীয় গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যাতে তারা সমাজতান্ত্রিক চীনের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ ও অন্তর্ঘাতী আক্রমন পরিচালনা করতে পারে। জিনজিয়াং প্রদেশের উইগুরের মুসলিম, ফালুংগং সম্প্রদায় সহ আরও অনেক স্বাধীনতাকামীদের নিয়ে চীন বেশ বিপদেই আছে। তিব্বতের লোকজন নির্যাতনকারী বেইজিং এবং চীনকে দুর্বলকারী সুযোগসন্ধানী ওয়াশিংটনের ফাঁদে পড়ে বেশ জুলুমের মধ্যে রয়েছে।

৮. সময়ের শুরু থেকেই বিশ্বশক্তি সমূহের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে আসছে, থাকবে শেষ দিন পর্যন্ত। ফেরাউনের অধীনে থাকা মিশর ছিল প্রাচীনকালের সুপারপাওয়ার এবং মেসোপটিয়ানরা ছিল তাদের প্রতিপক্ষ। রোমানরা ছিল সুপারপাওয়ার এবং পারস্যরা ছিল তাদের প্রতিপক্ষ। খিলাফত তারপর অবশিষ্ট পারস্য ও বাইজানটাইন সভ্যতাকে পরাজিত করে এবং আঠারশ শতকের আগ পর্যন্ত মঙ্গোলীয় ও ক্রুসেডারদের চ্যালেঞ্জ্যের মুখে পড়ে। আঠারশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রায় তিন শতাব্দীকাল ধরে ওসমানিয়া খিলাফতের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জার্মানী ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং এসময় ফ্রান্স এবং ব্রিটেন তার সাথে প্রতিযোগিতা করে। জার্মানী আবারও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটেনকে সুপারপাওয়ার হিসেবে চ্যালেঞ্জ করে এবং এর মাধ্যমে জার্মানীর প্রতিপত্তি খর্ব হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র নতুন সুপারপাওয়ার হিসেবে আর্বিভূত হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯০ সালে ধ্বংসের আগ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ দশক ধরে প্রতিদ্বন্দী হিসেবে ছিল।

৯. ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সুপারপাওয়ার। যদিও দোদুল্যমান, তারপরও বিশ্বের সর্বত্র আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এখনও বেশ প্রবল। এ দেশটির রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ অর্থনীতি, ব্যাপক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এবং স্বীয় স্বার্থ সুরক্ষার জন্য পৃথিবীময় সামরিক ঘাটি। আমেরিকার সাথে প্রতিযোগিতায় সক্ষম জাতিসমূহের মধ্যে রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং জার্মানী। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ চারটি রাষ্ট্রের রয়েছে উচ্চাকাংখা। গত দশকে রাশিয়া তার খনিজ সম্পদ ও শক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের মাধ্যমে অর্জনকারী সুবিধাভোগীদের সমূল উৎপাটনে সমর্থ হয়েছে। মার্কিনীরা সে অঞ্চলে এক দশক অপ্রতিদ্বন্দ্বী থাকবার পর এখন রাশিয়ার বিশাল খনিজ সম্পদে আর্শীবাদপুষ্ট অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনীর চ্যালেঞ্জের সমুখীন হচ্ছে।

-       ব্রিটেন ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বশক্তি ছিল এবং এখনও তার উপনিবেশের আওতায় ছিল এরকম রাষ্ট্রসমূহের উপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ইউরোপে ব্রিটেন প্রধান শক্তি এবং সেখানে অনেক মার্কিন পরিকল্পনাকে তারা ভন্ডুল করে দিয়েছে। বৈশ্বিক শক্তি হবার বাসনা ব্রিটেনের বরাবরই রয়েছে এবং এর জন্য প্রয়োজনে কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতাপূর্ণ আবার কখনওবা প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।

-       ব্রিটেনের মত ফ্রান্সও ইতিহাস ও রাজনৈতিক কারণে ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ দেশ। দশকের পর দশক ধরে তার উপনিবেশসমূহে বিভিন্ন নীতি, ফরাসি সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক শক্তির মাধ্যমে বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করবার চেষ্টা করছে।

-    ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি নিয়ে জার্মানী বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ইউরোপের অন্যতম অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস। ১.১ ট্রিলিয়ন ডলারের রপ্তানী বাণিজ্য রয়েছে এদেশটির। পূর্ব ইউরোপে কিছু বিশেষ নীতিমালাসহ জার্মানী এখন অর্থনৈতিকভাবে বিস্তার লাভ করছে। তারা ইসরাইল এবং হিজবুল্লাহর মধ্যকার বন্দী বিনিময়ে সফলভাবে মধ্যস্ততা করেছে। ২০০৬ সালে ইসরাইল কর্তৃক লেবানন দখলের সময় জার্মানী একটি নৌবাহিনী মোতায়েন করে। দুটি ফ্রিগেডের সমন্বয়ে এটি গঠিত ছিল- মেকলেনবার্গ-ভোরপোমার্ণ এবং কার্লশ্রুহে যা হেলিকপ্টার, সরবরাহ জাহাজ এবং ১৫০০ লোকের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন পেট্রোল নৌকা সমৃদ্ধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এটি জার্মানীর সবচেয়ে বড় সামরিক সমাবেশ।

-       মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতা করতে পারে এমন দেশসমূহের পরেই সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী দেশের তালিকায় রয়েছে চীন-যদিও এটা এখনও আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। যদি চীন কেবলমাত্র নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত না থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির প্রয়াস অব্যাহত রাখত-তাহলে এতদিনে বিশ্বশক্তি হিসেবে অনায়াসে আবিভূর্ত হতে পারত। আশা করা যায় ভবিষ্যতে এ দৃশ্যপট পরিবর্তিত হবে।

-       মার্কিনীদের পর জাপান অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম। অর্থনীতি ছাড়া এর প্রভাব বিস্তার করার মত আর কোন দিক নেই। তবে এ দেশটির বর্তমান নীতি হল আফগানিস্তানে সামরিক জোটে অংশ নেয়া এবং সংবিধানের ৯ নং অনুচ্ছেদের বিলোপ সাধন করে সৈন্য মোতায়েন ও পারমাণবিক বোমা প্রস্তুত করার অধিকার লাভ করা। এটা আসলে এ অঞ্চলে চীনের সাথে শক্তির ভারসাম্য বিধান করবে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে।

-      বিশ্বের বড় বড় ক্ষমতাধর শক্তিগুলো নিয়ে আলোচনার পর কিছু কিছু জাতি নিয়ে কথা বলা দরকার যেগুলো ঐতিহাসিক এবং অবস্থানগত কারণে অল্পসংখ্যকক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে এবং যা অস্থায়ী। যেমন ভারতের রয়েছে বিশাল জনসংখ্যা ও পারমাণবিক শক্তি এবং তার আশেপাশের অঞ্চলকে প্রভাবিত করার মত সক্ষমতা। একইভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ইটালী একটি গুরুতপূর্ণ শক্তি ছিল।

বর্তমানে এটা হল বিশ্বশক্তির ভারসাম্যের ব্যাপার, যা সময়নিরপেক্ষ নয়। বিশ্বশক্তিসমূহের ইতিহাস, তাদের উন্নয়ন, তাদের বিশ্বাস এবং বোধ, তাদের আদর্শ প্রত্যেকটি রাষ্ট্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়। এসকল শক্তিসমূহ নিজেদের সাথে এবং কখনও কখনও পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। আন্তর্জাতিক বিশ্ব পরিস্থিতি প্রকৃতপ্রস্তাবে বিশ্বশক্তিসমূহের মধ্যকার স্বাথর্গত দ্বন্দ্বের ফলাফল।

১০. মুসলিমদের একটি ব্যাপার অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, বিশ্ব পরিস্থিতি যা আমাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে তা সবসময় সত্য নাও হতে পারে এবং অনেক সময় অল্প প্রয়াসে এগুলো পরিবর্তন করা সম্ভব। উনিশ শতক পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ বিশ্বশক্তি ছিল এবং পুরো পৃথিবীর রাজনীতিকে প্রভাবিত করত। ১৯২৪ সালে মুসলমানদের সত্যিকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ওসমানিয়া খিলাফতের পতনের পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। কেননা এসময় তাদের প্রতিনিধিত্বকারী রাষ্ট্রব্যবস্থা না থাকায় তারা এখন অধ:পতিত, ক্লিষ্ট এবং নির্যাতিত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি নিকট অতীত থেকে পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। যেকারণে খিলাফত ফিরে আসবার ব্যাপারটি আজ আর শুধু মুসলিমদের মূলধারার চেতনা নয় বরং অমুসলিমদের কন্ঠেও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মুসলিম উম্মাহ পশ্চিমের ব্যর্থ চিন্তার তিক্ত অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে। সেকারণে তারা পুঁজিবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ইসলামকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করতে শুরু করছে। আর খিলাফত ফিরে আসবার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ভবিষ্যদ্বাণী হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি:

তোমাদের মধ্যে নবুয়্যত ততদিন থাকবে যতদিন আল্লাহ চান, তারপর তিনি তার অবসান ঘটাবেন। তারপর নবুয়্যতের আদলে খোলাফায়ে রাশেদীন আসবে। এটাও ততদিন থাকবে যতদিন আল্লাহ চান, তারপর তিনি এরও অবসান ঘটাবেন। এরপর আসবে যন্ত্রণাদায়ক বংশের শাসন। এটাও ততদিন থাকবে যতদিন আল্লাহ চান, তারপর তিনি এরও অবসান ঘটাবেন। অতপর আসবে জুলুমের শাসন আর তা ততদিন বলবৎ থাকবে যতদিন আল্লাহ চান। আল্লাহর ইচ্ছায় একদিন এরও অবসান হবে। তারপর আসবে নবুয়্যতের আদলে খিলাফত (খোলাফায়ে রাশেদা)। অতপর তিনি (সা.) চুপ থাকলেন।’ (মুসনাদে ইমাম আহমদ (২৭৩))

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন