বুধবার, ৯ মে, ২০১২

ইসলামের দাওয়াত - পর্ব ১

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী গবেষক শাইখ আহমদ মাহমুদ কর্তৃক রচিত “Dawah to Islam” বইটির খসড়া অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)

সূচনা

সকল প্রশংসা জগতসমূহের অধিপতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি এবং সালাম পেশ করছি রাহমাতুল্লীল আলামীন ও সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহম্মদ (সা), তাঁর পবিবার ও তাঁর সাহাবীদের প্রতি এবং যারা বিচার দিবসের আগ পর্যন্ত তাঁকে ইহসানের সাথে অনুসরণ করবেন তাদের প্রতি। অত:পর,

- 'ইসলামের দাওয়াত' শীর্ষক এই বইয়ে আমরা ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। এই বিষয়টি ব্যাপক, অনেক শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত ও চিন্তাগ্রাহ্য। এটা এমন এক পথ যা কুসুমাস্তীর্ণ নয় বরং বন্ধুর। আমাদের পূর্ববর্তী আলেম ও মুজতাহিদগন (র) ইবাদত, মুয়ামালাত, বিবাহ, উত্তরাধিকার ইত্যাদির মত এত ব্যাপকভাবে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেননি। 'ইসলামের প্রতি আহবান' এর যে দিকটি নিয়ে আলোচনা বেশী আবর্তিত হয়েছে তা হল, 'আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার' অর্থাৎ 'সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ' ও ব্যক্তিপর্যায়ের দাওয়াত। কারণ তাদের বাস্তবতা এই রকম ছিল না যে, খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা সমূলে উৎপাটিত হয়েছে, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে, শরীয়াহ পরিত্যাক্ত হয়েছে এবং দারুল ইসলাম দারুল কুফর দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে তারা গবেষণা করতে পারেন না কেননা মুজতাহিদগন কেবলমাত্র বাস্তবে উদ্ভুত সমস্যাই বিবেচনা করেন, কোন আপাত বা কাল্পনিক বিষয় নিয়ে নয়।

অতএব এই বইয়ে আমরা উক্ত বিষয়ে আলোকপাত করব। আমরা বলতে চাচ্ছি না এটা পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপক। তবে এটা অবশ্যই এ বিষয়টিকে প্রবৃত্তির অনুসরণ, যথেচ্ছাচার, অতিরঞ্জিত চিন্তাচেতনা, কুফরের অন্ধ অনুকরণ ইত্যাদি থেকে ইসলামী শরীয়ার মূল ভিত্তির দিকে ফিরিয়ে নেয়ার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

- দাওয়াতের ফরযিয়্যাত ও মানদুব (সুন্নাহ) বিষয়সমূহ আলোচনার চেয়ে এই বইয়ে দাওয়াতী কাজ করবার পদ্ধতি নিয়ে বরং বেশী গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কারণ বর্তমানে অন্য যে কোন বিষয়ের চেয়ে দাওয়াতী কাজ করবার পদ্ধতিগত জ্ঞানই সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

বইটিতে মূলত 'খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দাওয়াতের পদ্ধতি' নিয়েই আলোচনা করা হবে। কারণ আজকের দিনে দাওয়াত বহন করবার ক্ষেত্রে এটাই দাওয়াতের মেরুদন্ড হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন আর অস্তিত্বশীল নয়- এই বাস্তবতায় আজকের দিনে যখন কোন ইসলামী আহ্বানের শীর্ষে খিলাফত রাষ্ট্র পুণ:প্রতিষ্ঠার আহ্বান না থাকে অথবা এটিকে মনোযোগের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত না করা হয় তখন বুঝতে হবে সে আহ্বান আংশিক অথবা বিচ্যুত।

- বইটি 'ইসলামের দাওয়াত' নিয়েই মূলত আলোকপাত করবে এবং 'দাওয়াতের কাজ করবার পদ্ধতি' বিশেষ করে 'ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দাওয়াতের কাজ করবার পদ্ধতি'র উপর আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করবে -যা ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহ থেকে উৎসারিত। সেসব মৌলিক বিষয়গুলোও সংক্ষেপে উল্লেখ করা হবে, যদিও এসব মৌলিক বিষয় এই বইয়ের প্রধান প্রতিপাদ্য নয়। যেমন:

১. ইসলামী আক্বীদার স্পষ্টতা ও বিশুদ্ধতা - যা ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

২. ইসলামী আক্বীদার মধ্যে যন্ (অনুমাননির্ভরতা) বা ন্যূনতম যন্ এর সুযোগ নেই বরং তা হতে হবে ক্বাতঈ (সুনির্দিষ্ট ও সিদ্ধান্তগ্রহণকারী) হতে হবে। এক্ষেত্রে ত্বাকলীদ বা অন্ধ অনুকরণের সুযোগ নেই। যদি তা না করা হয় তাহলে মুসলিমগন কুসংস্কারকে গ্রহণ করবে ও প্রবঞ্চণার মধ্যে পতিত হবে।

৩. আক্বীদার সাথে সর্ম্পকযুক্ত চিন্তার (ভিত্তিসমূহের শাখা) ক্ষেত্রে যৎসামান্য পরিমাণে যন্ বা অনুমাননির্ভরতা এবং ত্বাকলীদ বা অনুকরণ অনুমোদনযোগ্য। শরীয়াহ'এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

৪. শরীয়াহ'র আইনকানুন সমূহ সরাসরি শরীয়াহর দলিল এর উপর ভিত্তি করে গ্রহন করতে হবে অর্থাৎ কোরআন, সুন্নাহ, সাহাবাগনের ইজমা (ঐকমত্য), শরীয়াহর বর্ণণা থেকে আসা শরই ইল্লাত (ঐশী কারণ) এর উপর ভিত্তি করে কিয়াস। শরীয়াহ'র দলিল থেকে কেবলমাত্র মুজতাহিদ হুকুম বের করে নিয়ে আসেন। আর মুক্বাল্লিদ (অনুসরণকারী) কে সুনিশ্চিত করতে হবে যে, তিনি যে মুজতাহিদের অনুসরণ করেন তার বক্তব্য তিনি বুঝতে পারছেন।

৫. যদি বাধ্যবাধকতার সংখ্যা অনেক বেশী হয়ে যায় এবং সবগুলো পালন করা মুসলমানের জন্য কঠিন হয়ে যায় বা তিনি অপারগ হন, তাহলে তাকে অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বাধ্যবাধকতাটিকে প্রাধান্য দিতে হবে। (এটাও শরীয়া দলিলের ভিত্তিতে হতে হবে, ব্যক্তিগত খেয়ালখুশী বা পছন্দের ভিত্তিতে নয়)

- যখন মুসলিমগন স্বাভাবিক অবস্থায় আছে, অর্থাৎ যখন ইসলামী খিলাফত রয়েছে তখন 'আমর বিন মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার' করা এবং রাষ্ট্রের ভেতরকার অমুসলিমদের ইসলাম গ্রহণের আহ্বানের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণভাবে দাওয়াতী কাজ করা হবে। আর রাষ্ট্রের বাইরের অমুসলিমদের প্রামাণ্য দলিল সহকারে ইসলামের দিকে আহ্বান করা হবে। এবং এটা করা হবে খলীফার বিবেচনা অনুসারে জিহাদের মাধ্যমে।

আর যখন মুসলিমগন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে থাকবে, অর্থাৎ খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা নেই তখন খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে সামনে রেখে ইসলামী দাওয়াতের কাজ করতে হবে। মুসলমানদের সংস্কার সাধনের জন্য তখন মারুফের আদেশ-মুনকারের নিষেধে, এবং অন্যদিকে ইসলাম গ্রহণের জন্য অমুসলিমদের আহ্বানের কাজটি তখন সঙ্কীর্ণ পরিসরে চলবে। কারণ যখন ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম ভূমিসমূহতে কোন রাষ্ট্র বা কর্তৃত্ব না থাকে তখন সেটি দারুল কুফর হয়ে যায়। তখন মুনকার সংঘটনের বিষয়টি একটি রীতিতে পরিণত হয় এবং সেকারণে সংস্কার সাধনের আংশিক কাজটি অকার্যকর ও অপর্যাপ্ত হয়ে যায়। আমূল পরিবর্তনের কর্মকান্ড তখন শরীয়াগত বাধ্যবাধকতা হয়ে যায়-যা কুফর ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে ইসলামী ব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন করবে। [খিলাফত অনুপস্থিত থাকা অবস্থায়] মুসলিম ভূমির বাইরে অমুসলিমদের দাওয়া করাকে বুঝায় তাদের ইসলাম গ্রহণের জন্য দাওয়াত দেয়া। অনৈসলামী চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং মুসলিম ভূমির বাইরে অবস্থানরত মুসলমানদের প্রচেষ্টাসমূহকে একীভূতকরণের দ্বারা মুসলিম ভূমিতে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার মাধ্যমে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

- ইসলামের দাওয়াতের সাথে সম্পৃক্ত যে কোন বইয়ে দাওয়াতের মৌলিক নিয়মাবলী নিয়ে আলোচনা থাকা উচিত। এগুলো নিম্নরূপ:

১. খিলাফতের জন্য কাজ করা এখন ফরযে আইন (প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরয)। এর জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ ও কর্মতৎপরতা সৃষ্টি করা একান্ত কর্তব্য।

২. একাজটি দলগতভাবে হতে হবে এবং ব্যক্তিগতভাবে করবার কোন সুযোগ নেই।

৩. এই দলের একজন আমীর থাকবেন যিনি শরীয়া প্রদত্ত ক্ষমতায় বলীয়ান - যার আওতার মধ্যে তাকে মান্য করা হবে।

৪. এই দলে পুরুষ ও নারী উভয়ই থাকবে, কেননা দাওয়াত বহন করার ব্যাপারে উভয়ই দায়িত্বশীল।

৫. এই দলের সদস্যদের বন্ধনের ভিত্তি হবে ইসলামী আক্বীদা ও চিন্তা।

৬. দলটিকে তার কর্মকান্ডের জন্য অবশ্যই ইসলামী চিন্তা, নিয়ম কানুন ও মতামতকে গ্রহণ করবে এবং তাদের আনুগত্য থাকবে আদর্শের প্রতি, কোন ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়।

৭. দলটি অবশ্যই রাজনৈতিক হবে, কারণ এর কাজ হল রাজনৈতিক - যা খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষমতায় যাবে।

৮. দলটির কাজ হবে বুদ্ধিবৃত্তিক; সহিংস (Violent) কোন কর্মকান্ডের সাথে এর সম্পৃক্ততা থাকবে না। কারণ ইসলামের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে জনমত তৈরি করে জনগনের সহায়তায় ক্ষমতায় আসাই এ দলের কাজ।

৯. বর্তমান কুফর শাসনব্যবস্থার সাথে কোনরকম ক্ষমতার অংশীদার হওয়া এ দলের জন্য নিষিদ্ধ।

১০. বর্তমান কুফর শাসনব্যবস্থার উপর যে কোন ধরনের নির্ভরশীলতা এ দলের জন্য নিষিদ্ধ। কুফর ব্যবস্থা থেকে কোন ধরনের অর্থনৈতিক সাহায্য বা নির্ভরশীলতা অবশ্যই বর্জনীয়।

- একইভাবে, ইসলামের দাওয়াত বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে এমন একটি বইতে দাওয়াত বহন করার পদ্ধতি বিষয়ে আহকামে শরীয়াহ আলোচিত হওয়া উচিত, যেমন:

১. বাস্তব মূলনীতির (Practical Principal) অনুসরণ - দাওয়াতের কাজ অন্তসারশূন্য হবে না, বরং সুচিন্তিত হবে। আর এই চিন্তাও কেবলমাত্র অনুমাননির্ভর হবে না, বরং তা আসবে বাস্তব উপলদ্ধি থেকে। এই চিন্তার সাথে কাজ যুক্ত করে একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হতে হবে। এই লক্ষ্য, কর্মকান্ড ও চিন্তা সবই ইসলাম থেকে উৎসারিত হতে হবে। আর চূড়ান্ত লক্ষ্য হল ইসলামিক আক্বীদার ভিত্তিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। এটা দাওয়াত বহনকারীকে ঈমানের পরিবেশে রাখে, তাকে উদ্দীপনা দেয় এবং নিয়ন্ত্রনে রাখে।

২. পদ্ধতি ও উপকরণের পার্থক্য সুস্পষ্ট হতে হবে। তরীকাহ বা পদ্ধতি হল শরীয়াহর আহকাম-যা ক্বিয়ামতের দিন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট। ঊসলুব বা উপকরণ হল মুবাহ-যা পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুসারে দাওয়াত বহনকারী গ্রহণ করতে পারে।

৩. আহকামে শরীয়ার মতই রাজনৈতিক বাস্তবতার জ্ঞান অপরিহার্য। এর কারণ হল হুকুম শরীয়াহ প্রয়োগ করতে হলে হুকুমে শরীয়াহ ও এর বাস্তবতা বা মানাত (যে বাস্তবতার জন্য হুকুমটি এসেছে) সর্ম্পকে জ্ঞান থাকা দরকার। কেউ যদি শরীয়াহর হুকুম জানে কিন্তু মানাত না জানে, তাহলে সে তা প্রয়োগে ব্যর্থ হবে। এবং আমরা যদি তা বাস্তবায়ন করতে যাই, তবে আমরা ভুল করে ফেলব কারণ আমরা এ হুকুমের বাস্তবতা হতে কোনো পৃথক বাস্তবতায় তা বাস্তবায়ন করে ফেলব। যারা বর্তমান ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে ক্ষমতা গ্রহণ করতে চায় তাদেরকে অবশ্যই কেবলমাত্র আভ্যন্তরীণ নয়, আঞ্চলিক ও আর্ন্তজাতিক রাজনৈতিক বাস্তবতার সম্পূর্ণ জ্ঞান রাখতে হবে।

৪. কেউ কেউ ভাবতে পারেন, খিলাফত প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা গ্রহণের জন্য কেবলমাত্র ক্ষমতাধর ও কর্তৃত্বশীল ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালালেই হবে। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। বরং প্রথমে সাধারণ জনগনের কাছে দাওয়াত নিয়ে যেতে হবে। দাওয়াত যখন চিন্তা বিকাশের স্তর থেকে গনসংযোগের পর্যায়ে যাবে এবং সফলভাবে জনগনের সাথে সংযোগ স্থাপনে সমর্থ হবে ও সাধারণ সচেতনতা থেকে ইসলামের পক্ষে জনমত তৈরি হবে তখন দলটি ক্ষমতাধর ও কর্তৃত্বশীল লোকদের কাছে নুসরাহ চাইবে।

৫. শরীয়াহ একাধিক কুতলাহ বা দল অনুমোদন করে। তবে শর্ত হল তারা অবশ্যই ইসলামী আক্বীদা ও শরীয়ার ভিত্তিতে গঠিত হবে।

৬. যদি একের অধিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি থেকে থাকে তবে, তাদের প্রত্যেককেই শরীয়াহ হুকুমের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, যেন তাদের মধ্যকার মতপার্থক্যগুলো আদাব আল ইখতিলাফ বা মতপার্থক্যের নিয়মানুযায়ীই হয়ে থাকে। কোন বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হলেই একজন মুসলিম অপর মুসলিমকে কুফর বা সীমালঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করবে - এ বিষয়টি অনুমোদিত নয়। কোন মতামতের পক্ষে দূর্বল বা শক্তিশালী দলীল বা দলীলের সাথে সাদৃশ্যতা (শুবহাত আদ দলীল) থাকলে এটি একটি আইনসঙ্গত মতামত। এ ধরনের মতামত অবলম্বনকারীদের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করা যাবে না। দূর্বল দলীল বা দলীলের সাদৃশ্যতার ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে, আপনার মতামত ভুল বা দূর্বল এবং তার সাথে উত্তম নসীহত সহকারে প্রামাণ্য দলিলের ভিত্তিতে আলোচনা করতে পারি। যদি কোন মতামতের শরীয়াহভিত্তিক দলিল না থাকে অথবা সাদৃশ্য না থাকে তাহলে সে মতামতটি অনৈসলামিক (কুফরী মতামত) হবে। সেক্ষেত্রে এই মতামতের বিরুদ্ধাচরণ করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকবে না এবং এ মতাবলম্বীদের এ ব্যাপারে সাবধান করে দেয়া উচিত (যদিও সবসময় কুফরী মতামত অবলম্বনকারীরা কাফের নয়)।

৭. যেসব শাসক ইসলামী শরীয়াকে পরিত্যাগ করে এবং চাপ প্রয়োগ না করা সত্ত্বেও অন্য আইন দিয়ে শাসন করে, তাদের অধিকাংশই কাফির-যদিও তারা সালাত আদায় করে, রোজা পালন করে, হজ্জব্রত পালন করে এবং মুসলিম বলে দাবি করে। এর কারণ হচ্ছে তারা ইসলামী আইন না নিয়ে কুফরী আইনকে গ্রহণ করেছে। যদি তারা বিশ্বাস করে যে ইসলামী শরীয়াহ হল সর্বশ্রেষ্ঠ আইন এবং তারা সাময়িকভাবে খেয়ালের বশবর্তী হয়ে তা পরিত্যাগ করে তবে সে জালিম হবে, কিন্তু কাফের হবে না। সে কারণে একজন দাওয়াত বহনকারী কখনওই এ ধরনের শাসককে মেনে নেয়ার ঘোষণা দিতে পারেন না, সমর্থন ব্যক্ত করতে পারবেন না, এমনকি তার ব্যাপারে নীরবতা পালনও করতে পারবে না। কারণ এ ব্যাপারে যে প্রসিদ্ধ হাদীসটি রয়েছে, তা হল:

"তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন তার হাত দ্বারা তা প্রতিহত করে। তার এই সামর্থ্য না থাকলে সে যেন তার মুখ দ্বারা তা প্রতিহত করে। তার এই সামর্থ্যও না থাকলে সে যেন তার অন্তর দ্বারা তা প্রতিহত করে (ঘৃণার মাধ্যমে), আর এটা হলো দূর্বলতম ঈমান।" (মুসলিম, তিরমিযী)

- ইসলামের দাওয়াত বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে এমন কোন বই দাওয়াতী কাজে রাসুলুল্লাহ (সা) এর অনুসরণ করার ব্যাখ্যায় নিম্ন লিখিত কিছু ইস্যু তুলে ধরবে:

১. রাসূলুল্লাহ (সা) কাফেরদেরকে ইসলামে প্রবেশ করবার জন্য আহ্বান জানাতেন। আর আমরা এখন অধিকাংশক্ষেত্রে মুসলিমদের ইসলাম গ্রহণের জন্য আহ্বান জানাই।

২. রাসুলুল্লাহ (সা) এমন এক সময়ে দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন যখন পুরো শরীয়াহ অবতীর্ণ হয়নি। এখন আমাদের সামনে সম্পূর্ণ শরীয়াহ রয়েছে। তার মানে রাসূল (সা) অবতীর্ণ না হওয়ার কারণে অনেক হুকুম মক্কায় পালন করতে পারেননি। কিন্তু আমাদেরকে এগুলো মেনে চলতে হবে। আবার কিছু আইন তিনি মেনে চলেছেন যেগুলো পরবর্তীতে রহিত হয়ে গেছে। সে কারণে সেই রহিত আইনসমূহ আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়। যেমন: মক্কায় জিহাদ আইনসিদ্ধ ছিল না, কিন্তু এটা এখন বৈধ (রক্ষণাত্নক জিহাদ আজকে আমাদের উপর ফরয এবং এটা রাষ্ট্র না থাকলেও করা যাবে। কেননা এই ধরনের জিহাদের সাথে রাষ্ট্র বা খিলাফত থাকার বিষয়টি বিজড়িত নয়) মক্কায় কেবলমাত্র রাসুলুল্লাহ (সা) এর দাওয়াতের কাজ করা ফরয ছিল, কিন্তু সাহাবাদের জন্য এটা মানদুব ছিল, যেহেতু তখন তারা তাঁর প্রতি কেবল নারীদের বাইয়াতের অনুরূপ বাইয়াতে আবদ্ধ ছিলেন। এ অবস্থা চলতে থাকে যতদিন না দ্বিতীয় আকাবার শপথে আওস ও খাযরায গোত্র বায়াত প্রদান করে। এর পর থেকে শুধুমাত্র রাসূল (সা)ই নয়, বরং সাহাবীদের উপরও দাওয়াতের কাজ করা ফরয হয়ে যায়। আর যা রহিত হয়েছে তা হল মক্কা বিজয়ের পর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করবার ফরযিয়্যাত।

৩. কাজের প্রকারভেদের দিক থেকে মক্কার হুকুমসমূহ অধিকাংশক্ষেত্রে ব্যক্তির সাথে সর্ম্পকযুক্ত ছিল এবং মদীনার হুকুমসমূহ শাসকের (খলীফা) দায়িত্বের সাথে সর্ম্পকযুক্ত ছিল। কিছু কিছু নির্দেশ আছে যা কেবলমাত্র শাসকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ব্যক্তির বা দলের ক্ষেত্রে নয়; যেমন: হুদুদ বাস্তবায়ন, জিহাদ ঘোষণা করা এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদন করা। আবার কিছু কাজ আছে যা ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ব্যক্তি দারুল ইসলাম বা দারুল কুফর যেখানেই থাকুক, যেমন: ইবাদত (উপাসনা), আখলাক (নৈতিকতা), মাতউমাত (খাদ্য), মালবুসাত (পোশাক পরিচ্ছদ) এবং মু'আমালাত (লেনদেন)। আবার কিছু হুকুম রয়েছে যা ব্যক্তি ও শাসক উভযই সম্পাদন করে থাকে, যেমন: মসজিদ নির্মাণ করা, সৎ কাজের আদেশ প্রদান করা, অসৎ কাজে নিষেধ করা ও দলিলের ভিত্তিতে দাওয়াতী কাজ করা।
 
- খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবার মত কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে যখন কোন দাওয়াত বহনকারী অগ্রসর হয় তখন একটি ইস্যুর সম্মুখীন হয়, তা হল: এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট সময়সীমা আছে কি (দশ, বিশ বা ত্রিশ বছর)? নাকি নেই? এটা থেকে আবার দু'টি ইস্যুর জন্ম হয়। প্রথমত: এই কাজের প্রকৃতি অনুসারে (শরীয়াহ ও আক্বীদার ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা) এক, দুই বা তিন দশকের মধ্যে কি লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব? কারণ কুতলাহ বা দল যথেচ্ছভাবে কাজ করতে পারে না, বরং কাজের প্রকৃতি অনুসারে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে একটি পূর্বনির্ধারিত সময়কালের মধ্যে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অন্যথায়, বুঝতে হবে কুতলাহ আন্তরিক নয় এবং কোন নির্দেশনা ছাড়াই চলছে। দ্বিতীয়ত: যদি দলটি ব্যর্থ হয় এবং সঙ্গত সময়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জন করতে না পারে, তাহলে এটা থেকে কি তার পরিকল্পনা ভুল এ সিদ্ধান্তে আসবে এবং তার গৃহীত নীতি কি সংশোধনের উদ্দেশ্যে পর্যালোচনা করবে? অথবা তারা কি এ সিদ্ধান্তে পৌছবে যে, দলটি আল্লাহর প্রতি আন্তরিক নয় এবং একারণে আল্লাহ তাদের মাধ্যমে ইসলামকে বিজয়ী করতে চাচ্ছেন না? এই বই এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করবে।
  
- 'ইসলামের দাওয়াত' বইটি কিছু প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করবে, কিছু সন্দেহ দূর করবে এবং কিছু বিষয়ে সঠিক ধারণা তুলে ধরবে। যেমন:

১. অনেকে নিম্নের আয়াতটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে থাকে,

'হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের চিন্তা কর। তোমরা যখন সৎপথে রয়েছ, তখন কেউ পথভ্রান্ত হলে তাতে তোমাদের কোন ক্ষতি নাই। তোমাদের সবাইকে আল্লাহ্‌র কাছে ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তোমাদেরকে বলে দেবেন, যা কিছু তোমরা করতে।' (সূরা মায়েদা-১০৫)

সুতরাং এই আয়াত থেকে অনেকে এ সিদ্ধান্তে পৌছে যে, মুসলিমগন কেবলমাত্র তার এবং তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল ও তাকে অন্য মুসলিমদের কাছে দাওয়াত বহন না করলেও চলবে।

২. নিম্নের হাদীসটিকেও অনেকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে:

'এটা ঠিক নয় যে, একজন মু'মিন নিজেকে অপমানিত করবে। এবং (তা হচ্ছে) এমন দূর্ভোগের মধ্যে নিজেকে ঠেলে দেবে - যা বহনে সে অক্ষম।'

এ হাদীস থেকে অনেকে এ সিদ্ধান্তে পৌছে যে, এমন কোন কাজ করা যাবে না যা তাকে কারাভোগ, কর্মস্থল থেকে পদচ্যুতি এবং অত্যাচারী শাসকের রোষানলে পড়তে হয়। সেক্ষেত্রে যদি তাকে দাওয়াতী কাজ থেকে বিরত থেকে অত্যাচারী শাসককে মেনে নিতে হয় তারপরেও।

৩. অনেকে হুযায়ফা বিন ইয়ামান (রা) বর্ণিত রাসূল (সা) হাদীসকে ভুল বুঝে থাকে, 'আমি বললাম: যদি মুসলিমদের কোন জামায়াত বা ইমাম না থাকে তাহলে কী হবে? তখন তিনি (সা) বললেন, “অতপর তুমি এসমস্ত দল গুলিকে পরিত্যাগ করবে, যদিও বা তোমাকে কোন গাছের গুড়ি কামড়ে থাকতে হয় যতক্ষন না তোমার মৃত্যু এসে যায়।

লোকেরা এটা থেকে ধারণা করে যে, যখন মুসলিমদের খলীফা থাকবে না তখন মুসলমানদের জন্য খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা ফরয নয়। বরং এ অবস্থায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলবে।

৪. আবার কেউ কেউ নিচের বিখ্যাত হাদীসকে ভুল বুঝে থাকে

'তোমাদের কাছে এমন একটি দিন বা বছর আসবে না যা তোমাদের রবের সাথে সাক্ষাতের পূর্ব পর্যন্ত আরও বেশী মন্দ হতে থাকবে না।' সুতরাং, এটা সেইসব লোকদের নিরাশ, হতাশ ও কর্মবিমুখ করে।

৫. আবার অনেকে বলেন যে, পরিবর্তনের দায়িত্ব ইমাম মাহদীর এবং এর জন্য আমরা দায়িত্বশীল নই। ফলে তারা এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে নিষ্ক্রিয় থাকে।

- এই বইটি এর ভূমিকাতে যেসব ইস্যু তুলে ধরেছে এইরকমের সব বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে আলোকপাত করেছে। যদি এতে কোন ঘাটতি থাকে তবে মনে রাখতে হবে কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাই নিখুঁত হতে পারেন। সম্ভবত দ্বিতীয় মুদ্রণে আমরা আল্লাহর কৃপায় আরও সামগ্রিক ও নিঁখুত করবার প্রয়াস নেব। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে এই প্রার্থনা করছি যে, তিনি এ বই থেকে মুসলিমদের উপকৃত করবেন এবং এর লেখককে অনেক উত্তম প্রতিদান দিবেন।

সালাম ও দরুদ পেশ করছি নবী মুহম্মদ (সা), তাঁর পরিবারবর্গ, শেষ দিবসের পূর্ব পর্যন্ত আগত তাঁর অনুসারীদের প্রতি এবং সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার।

Please note that this is a draft translation. So, we would suggest not to spread this widely or publish this anywhere online for the time being.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন