শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

ইসলাম ও বিজ্ঞান কি পরস্পর সাংঘর্ষিক ?

বিজ্ঞানের উত্থানকে সাধারণভাবে কয়েক শতকের একটি বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। ধরে নেয়া হয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসে ধর্মীয় আধিপত্যবাদের যুগ অবসানের পরই বিজ্ঞানের অগ্রগতির সূচনা। বিজ্ঞান, পার্থিব উন্নতি ও ধর্মকে পৃথক করে দেখার এ মানসিকতার উদ্ভব হয়েছে আজকের পশ্চিমা সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের অগভীর ধারণা থেকে। কারণ এ সভ্যতা গড়ে উঠেছে ধর্মীয় কাঠামো ও প্রভাবের সম্পুর্ণ বাইরে। তাই পশ্চিমা প্রচারণার ডামাডোলে বিজ্ঞান ও ইসলামের সম্পর্ক বিষয়ক অসংখ্য প্রশ্নের সমাধান আমাদের মনে অজানা রয়ে গেছে। যেমনঃ

১। ইসলাম আধ্যাত্মিক জগত নিয়ে কাজ করে যেখানে বিজ্ঞান কাজ করে বস্তুজগৎ নিয়ে। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন কিভাবে সম্ভব?

২। কিছু বৈজ্ঞানিক মতবাদ রয়েছে যা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। কিভাবে এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য হবে?

৩। ইসলাম মূলত পরকালীন জীবনকে প্রাধান্য দেয়, সেখানে কিভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রেরণা পাওয়া সম্ভব?

৪। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে এমন কোন উদাহরণ নেই যারা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে অগ্রগণ্য। এটা কি সম্ভব যে শুধুমাত্র ইসলামের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত কোন দেশ শিল্প ও বিজ্ঞানে উন্নতি করতে পারে?

ইউরোপের পুরো ইতিহাস জুড়ে দেখা যায় সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে বিজ্ঞানী ও চার্চের মতবাদের বিরোধী চিন্তাশীল ব্যাক্তি ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা স্থবির হয়ে গিয়েছিল এবং ফলাফলস্বরূপ ধর্ম মানব সভ্যতার উন্নতির পথে অনুপযুক্ত বলে গণ্য হল। ধর্মকে দেখা হল অবাস্তব, অনমনীয় ও স্ববিরোধী এক প্রতিপক্ষ হিসেবে। কিন্তু শুধু ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের এ অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই কি এ সরলীকৃত সিদ্বান্তে আসা যায় যে উন্নতির একমাত্র সোপান হচ্ছে মানুষের নিজেদের তৈরী করা শাসন ব্যবস্থা এবং সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জীবনব্যবস্থা অপর্যাপ্ত এবং ত্রুটিপূর্ণ?

অথচ ইসলামের সাথে খৃষ্টবাদ ও ইহুদীবাদের চরম বৈপরীত্য হচ্ছে যে, ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্ম বা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয় বরং ইসলাম সেই মহান বাণী যা একক সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পক্ষ থেকে রাসুল (সা) এর প্রতি প্রেরিত হয়েছে। ইসলাম হচ্ছে এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা যা মানুষের জীবনের সমস্ত বিষয় তথা জাগতিক, বুদ্ধিভিত্তিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের প্রতি দিক নির্দেশনা দেয়। ইসলামের শক্তিশালী বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তাভাবনা মুসলিমদের জীবনকে দারুণভাবে গতিশীল করে তোলে। ইসলাম কোন সনাতন অন্ধবিশ্বাস নয় কিংবা অনুকরণের উপর গড়ে উঠেনি বরং তা মানবজাতিকে তার নিজের অস্তিত্ব ও তার চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনার দিকে আহবান করে।

নিঃসন্দেহে আসমান জমীনের সৃষ্টির মাঝে, রাত দিনের এই আবর্তনের মাঝে, মহাসাগরে ভাসমান জাহাজসমূহে যা মানুষের জন্য কল্যাণকর দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ( এসবকটিতে) আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন মজুদ রয়েছে, (আরও রয়েছে) আল্লাহ তায়ালা আকাশ থেকে (বৃষ্টি আকারে) যা কিছু নাজিল করেন সেই বৃষ্টির পানির মাঝে, ভূমির নির্জীব হওয়ার পর তিনি এ পানি দ্বারা তাতে নতুন জীবন দান করেন, অতঃপর তিনি এ ভূখণ্ডে সব ধরণের প্রাণীর আবির্ভাব ঘটান, অবশ্যই বাতাসের প্রবাহ সৃষ্টি করার মাঝে এবং সে মেঘমালা যা আসমান জমীনের মাঝে বশীভূত করে রাখা হয়েছে, তার মাঝে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে। [সুরা বাকারাহ, ২:১৬৪]

আর এ সবই আমাদেরকে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের ব্যাপারে সুনিশ্চিত প্রমাণ দেয়। ইসলাম মানুষকে এসব বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনার দিকে উদাত্ত আহবান জানায় এবং একক সৃষ্টিকর্তার সত্যতার ব্যাপারে স্বাক্ষ্য প্রদান করে।

ইসলাম অতীত ও বর্তমানের অন্যান্য ধর্মযাজকদের মত মানুষকে শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয় নিয়ে চিন্তা করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে না বরং চিন্তা করাকে তার জীবনের অন্যতম প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে। ইসলাম মানুষের কোন প্রবৃত্তিকে, চাহিদা ও আকাংখাকে অস্বীকার করে না বরং তা সুশৃঙ্খল করে যা মানুষকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বৈষয়িক উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান হচ্ছে বাস্তব বিষয়ের পর্যবেক্ষণ। বিজ্ঞান আমাদের অক্সিজেনের গঠন পদ্ধতি বলে দেয়  কিন্তু এটা বলে না যে, অক্সিজেন কে তৈরী করেছে। তাই বিজ্ঞান ও ইসলাম নিয়ে সংঘাতের কোন সুযোগ নেই। নিরেট বিজ্ঞান মানুষের জীবন দর্শন নিয়ে মাথা ঘামায় না, হোক তা পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র বা ইসলামী জীবনাদর্শ। নিরেট বিজ্ঞান সকল মানুষের কাছে একইভাবে গ্রহণযোগ্য হয়। আর এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই প্রথম যুগের মুসলিম বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের সকল শাখায় প্রভূত উন্নতি লাভ করেছিল এবং নতুন নতুন শাখায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।

মুসলিমরা ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই ইসলাম সম্প্রচার, হজ্জ ও ব্যবসায়িক কারণে দুনিয়াব্যাপী ব্যাপকভাবে পরিভ্রমণ করেছে। তারা যেখানে গিয়েছে ও অধিবাসী হয়েছে সেখানকার সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক ও কৃষিজাত সহ অন্যান্য সকল বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করেছে। বিদেশী ভাষায় বৈজ্ঞানিক কাজগুলো সহজে বোঝার জন্য মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনুবাদের জন্য অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। আব্বাসিয় খিলাফতের সময় বিশেষ করে খলীফা আল মানসুর ও খলীফা আল মামুনের সময় বৈজ্ঞানিক কাজের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনুবাদ ও প্রস্তুতির কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা যায়। দশম শতাব্দীর শেষাংশে এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। অনুবাদকরা ছিলেন বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের। উদাহরণস্বরূপ নওবখত ছিলেন পারস্যের অধিবাসী, মোহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম আল ফাজারী ছিলেন একজন আরব এবং হুমায়ুন ইবনে ইসহাক ছিলেন হিরার একজন নেষ্টোরিয়ান খ্রিষ্টান।

মুসলিম বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অন্যদের বৈজ্ঞানিক সমাধানগুলো গ্রহণ করেন এবং নতুনভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যেমনঃ দামাস্কাস, বাগদাদ ও নিশাপুরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য পর্যবেক্ষন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বিদ্যার বাস্তব জ্ঞানের জন্য মৃতদেহের সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা হতো। খলীফা মুহতাসিম এ কারণে চিকিৎসকদের বানর সরবরাহ করতেন। হাসপাতালগুলোতে ছাত্রদের বাস্তব শিক্ষার জন্য শল্যচিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হতো। একাদশ ও দ্বাদশ শতকের মধ্যে মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার এক উঁচুমান স্থাপিত হয়েছিল। সে যুগের বৈজ্ঞানিক চেতনা শিহাব আল দীন আল কিরাফীর দৃষ্টি সংক্রান্ত কাজের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় যিনি একাধারে ছিলেন কায়রোর একজন ইসলামী আইন ও বিচার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং তিনি দৃষ্টি সংক্রান্ত পঞ্চাশটির মত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইবনে খুরদাদবে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের অক্ষাংশ্ ও দ্রাগিমাংশ নির্ণয় করেন। আল বিরুনী বিভিন্ন বস্তুর সুনির্দিষ্ট ভর নিরূপণ করেন।

ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অধীনে থাকার সময় বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক তত্ত্বেরই আবিষ্কার করেনি বরং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোকে প্রযুক্তিতে রূপান্তর করেছেন। তারা গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং নৌ চলাচলের জন্য তারকা মানচিত্র তৈরী করেছেন। ইবনে ইউনুস সময় পরিমাপের জন্য পেন্ডুলাম তৈরী করেন, ইবনে সিনা বাতাসের তাপমাত্রা মাপার জন্য বায়ুমাপক যন্ত্র আবিষ্কার করেন। কাগজ, কম্পাস, বন্দুক, গান পাউডার, অজৈব অম্ল ও ক্ষারীয় পদার্থের আবিষ্কার হচ্ছে মুসলিম বিজ্ঞানীদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কার যেগুলো মানব সভ্যতায় অসামান্য অবদান রেখেছিল। মুসলিম বিজ্ঞানীরা এলজেবরা আবিষ্কার করেন যেটা গণিতের একটি স্থায়ী শাখায় পরিণত হয়। এলজেবরা শব্দটি উৎসারিত হয়েছে আরবী শব্দ জাবর থেকে। মুসলিম বিজ্ঞানীরা সমতল এবং গোলাকর ভূমির জন্য ত্রিকোণমিতি আবিষ্কার করেন এবং তা জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রয়োগ করা হয়। তারা জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে আলাদা করেন কারণ ইসলামে মানুষের ভাগ্যের উপর তারকাদের প্রভাব জাতীয় বিশ্বাসকে নিষিদ্ধ বলে গণ্য করা হয়। ফলে জ্যোতিষশাস্ত্রের অন্ধ-বিশ্বাস থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে নিরেট বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়ে পরিণত করা হয়।

সহস্র বছরের এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পরেও মুসলিম বিশ্ব আজ চিহ্নিত হয়েছে ব্যর্থতা ও অনৈক্যের প্রতীক হিসেবে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নেমে এসেছে স্থবিরতা। মুসলিমদের প্রচুর ধন সম্পদ থাকার পরও তারা বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা তদোপরি শিল্পায়নে পিছিয়ে আছে। এ দুঃখজনক পরিণতির কারণ ইসলামের অনুসরণ না করার প্রত্যক্ষ্য ফলাফল, ইসলাম বোঝার ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের শৈথিল্য। কোন জাতির বৈজ্ঞানিক বা অন্য কোন ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারেনা যতক্ষণ না সে কোন মতাদর্শকে আঁকড়ে ধরে, মুসলিমরাও এই নিয়মের বাইরে নয়। পশ্চিমা বিশ্ব পুঁজিবাদকে তাদের আদর্শকে ধারণ করেছে এবং তার ফলে জীবনের নানা ক্ষেত্রে তারা উন্নতি লাভ করেছে। প্রাচ্যে সমাজতন্ত্র জোর করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তারাও বৈষয়িক কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে স্বল্পসময়ে উন্নতি লাভ করেছিল। মুসলিমরাও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আবারো চালকের আসনে ফিরে আসতে পারে যদি তারা ইসলামকে জীবনাদর্শ তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সুমহান বাণীকে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলিমদের নেতৃত্ব অবশ্যই প্রয়োজনীয়। ইসলাম দ্বারা পরিচালিত একটি রাষ্ট্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উন্নয়ন সহায়ক পরিবেশ তৈরী হবে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত উপকরণ সরবরাহ করা হবে। সে রাষ্ট্রের মূলনীতি ও উদ্দেশ্য হবে যান্ত্রিক বিষয়ের সমাধান, শিল্প পদ্ধতি উন্নয়ন সাধন, রোগ প্রতিরোধের উপায় এবং যতদূর সম্ভব জীবনকে সমৃদ্ধ করার পদ্ধতি ও উপায়-উপকরণ অনুসন্ধান করা। জীবনব্যবস্থার মানোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন চিন্তা ভাবনাকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য উৎসাহিত করা হবে। প্রকৃতপক্ষে শিল্পায়ন হবে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম উদ্দেশ্য এবং এ বিষয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই যে ইসলামী রাষ্ট্র অতিদ্রুত সময়ে শিল্প ও বিজ্ঞানে বিশ্বে আবারো নেতৃস্থানীয় অবস্থান তৈরী করে নেবে এবং সে রাষ্ট্র পরিণত হবে তথ্য প্রযুক্তি গবেষণা, চিকিৎসা, প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষণ, মহাশূন্য ও জিন গবেষণাসহ মানুষের জীবনের সকল প্রয়োজনীয় সমস্যার সমাধানের এক আকর্ষণীয় কেন্দ্রবিন্দু।

তাই এ ধারণা ঠিক নয় যে ইসলাম বৈজ্ঞানিক উন্নতির সাথে অসামঞ্জস্যশীল। ইসলামের প্রথম যুগে বিজ্ঞান উন্নতি লাভ করেছিল এবং একটি সত্যিকার ইসলামী রাষ্ট্রে বিজ্ঞান আবারো উন্নতি লাভ করবে। ইউরোপের খ্রিষ্টবাদ ও বিজ্ঞানের মধ্যকার তিক্ত অভিজ্ঞতা মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য করে তোলার প্রয়াস সুস্থ স্বাভাবিক মস্তিষ্কের নয়। তাই ইসলামকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য এবং সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা তথা খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার করার জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। তাহলে আমরাও প্রথম যুগের মুসলিমদের মত সত্যিকার ইসলামের অনুসারী হতে পারবো যারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি লাভ করেছিল।

ইসলামে আরবী ভাষা, এর গুরুত্ব ও উম্মতের পুনর্জাগরণে এর ভূমিকা

 ভাষা
তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে। [রূম: ২২]

ভাষা একে অপরের সাথে চিন্তা, ভাবনা ও ধারনার যোগাযোগের মাধ্যম। এর মাধ্যমে চিন্তা-ভাবনা একজন থেকে অন্যজনে প্রবাহিত হয়, এক স্থান হতে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়। লিখিত হোক বা অলিখিত, এটাই মানুষের জন্য চিন্তা-চেতনা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রাচীনকাল হতে। ভাষা অবশ্যই আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়ার অংশ নয় বরং এর ফলাফল। এ বিষয়টি Rational Empirical উভয় চিন্তার পদ্ধতি দ্বারাই প্রমাণ করা সম্ভব। এটা আমরা বুঝতে পারি যখন আমরা দেখি বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে একই চিন্তা-চেতনা একই ভাবে বিরাজ করে কিন্তু তা প্রকাশ করার সময় বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ করে। উদাহরনসরূপ, একজন ইংরেজ, একজন চাইনিজ, একজন জার্মান কিংবা একজন বাঙ্গালী ভিন্ন ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও কমিউনিজমকে তাদের আদর্শ হিসেবে নিতে পারে। ভিন্ন ভাষা তাদের আদর্শিক চিন্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য ঘটায় না।
  
ভাষা অনেকটা মানুষের মতোই। এর উদ্ভব হয়, বিবর্তন হয়, উন্নতি হয়, দূর্বলতা দেখা দেয় এবং কখনো কখনো ভাষার মৃত্যু তথা বিলুপ্তিও দেখা দিতে পারে। ভাষার উৎপত্তি মূলত কথ্য রুপে শুরু হয়, পরবর্তীতে তা লিখিত রুপে আসে এবং কোনো প্রতিষ্ঠিত ভাষার পন্ডিতগণ সাধারণত তখনই ভাষার নিয়মনীতি তথা ব্যকরণ রচনা করেন যখন তারা ভাষার বিকৃতির আশঙ্কা করেন।

আরবী ভাষা
অন্য সকল ভাষার মতোই আরবীও পৃথিবীর একটি প্রচলিত ভাষা। এটি একটি সেমিটিক ভাষা এবং পৃথিবীর বৃহত্তম সেমিটিক ভাষা। পৃথিবীর প্রায় ২৮০ মিলিয়ন মানুষের জন্য এটি তাদের প্রধান ভাষা। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার প্রায় ২২টি দেশের রাষ্ট্রভাষা এটি। ধারণা করা হয়ে থাকে যে প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে এ ভাষা অস্তিত্বে আসে যদিও এর লিখন প্রক্রিয়ার শুরু আরো অনেক পরে। কেউ কেউ এ ভাষার উৎপত্তি আরো আগে মনে করেন। কোনো কোনো আলেম এটাও মনে করেন যে এ ভাষাটি আল্লাহর পক্ষ হতে আদম (আ) নিয়ে এসেছিলেন, তবে এ মতটি বিতর্কিত।

ইসলামের সাথে আরবী ভাষার সম্পর্ক
আমি যদি একুরআন অনারব ভাষায় নাজিল করতাম, তবে অবশ্যই তারা বলত, এর আয়াতসমূহ পরিষ্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চর্য যে, কিতাব অনারব ভাষার আর রাসূল আরবী ভাষী। বলুন, এটা বিশ্বাসীদের জন্য হেদায়েত ও রোগের প্রতিকার। যারা ঈমান আনয়ন করে না, তাদের কানে আছে ছিপি, আর কুরআন তাদের জন্যে অন্ধত্ব। তাদেরকে যেন দূরবর্তী স্থান থেকে আহ্বান করা হয়। [হা মীম আস-সাজদাহ: ৪৪]

আরবী ভাষার সাথে ইসলামের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও অবিচ্ছিন্ন। পবিত্র কুরআন মুহাম্মদ (সা)-এর উপর নাযিল হয়েছে আরবী ভাষায়। এবং পুরো কুরআনই আরবী ভাষায় নাযিলকৃত। এটি সম্পূর্ন আরবী এবং এতে কোনো বিদেশী শব্দ নেই। ইমাম শাফেঈ' তার আর-রিসালাহ গ্রন্থে বলেন: "কুরআন এই দিক নির্দেশনা দেয় যে আল্লাহর কিতাবের কোনো অংশই আরবী ভাষার বাইরে নয়...।" আল্লাহর কিতাবের ১১টি আয়াত হতে এ নির্দেশনা পাওয়া যায় যে কুরআন সম্পূর্ন আরবী ভাষায় নাযিলকৃত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,

"বিশ্বস্ত রূহ একে নিয়ে অবতর করেছে। আপনার হৃদয়ে, যাতে আপনি ভীতি প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভূক্ত হন। সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়।" [সূরা শু'আরা: ১৯৩-১৯৫]

"এমনিভাবে আমি এ কুরআনকে আরবী নির্দেশরুপে নাযিল করেছি।" [সূরা রাদ: ৩৭]

"এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবী ভাষায় কুরআন নাযিল করেছি।" [সূরা শুরা: ৭]

"আরবী ভাষায় এ কুরআন বক্রতামুক্ত, যাতে তারা সাবধান হয়ে চলে।" [সূরা যুমার: ২৮]

"এবং এ কুরআন পরিষ্কার আরবী ভাষায়।" [সূরা নাহল: ১০৩]

ইসলামী আদর্শের সাথে আরবী ভাষার সম্পর্ক ও এর গুরুত্বকে তিনটি অংশে ভাগ করা যায়।

মৌলিক বিশ্বাস: এক্ষেত্রে ভাষা তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। কোনো ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে ঈমান এনে আল্লাহ, তার ফেরেশতা, রাসূল, ওহী, বিচার দিবস ও কদর-এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে মুসলিম হতে পারে। এক্ষেত্রে ভাষার জ্ঞান থাকা অনিবার্য নয়।

পালন: ইসলাম পালন করার জন্য কিছু পরিমান আরবী জানা অবশ্যই দরকার। উদাহরণসরূপ, নামায আদায় ইত্যাদি।

ইসলামী জ্ঞান ও আইনবিদ্যা: ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে প্রকৃতভাবে জানতে হলে ও ইসলামী শরীয়াহর আইনসমূহ অধ্যয়ন করতে হলে আরবী ভাষার জ্ঞান অত্যাবশ্যকীয়। উদাহরণসরূপ, হকুম শরঈ', উসূল আল ফিকহ ইত্যাদি। সকল যুগেই মুসলিম পন্ডিতগণ ইজতিহাদের জন্য আবশ্যক আরবীভাষা, এর নাহু-সরফের জ্ঞান, শব্দভান্ডার, ব্যকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমানে জ্ঞান রাখতেন।

শাইখ তাকী (রহ) বলেন, "ঈমান ও আহকাম বোঝার বিষয়টি ইসলামে দুটি ভিন্ন বিষয়। ইসলামে ঈমান প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিবৃত্তি বা আকলী দলীল দ্বারা। যাতে করে কোনো সন্দেহের অবকাশ না থাকে। কিন্তু আহকাম বোঝার বিষয়টি শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করে না, বরং আরবী ভাষা জানার উপর, হুকুম বের করে আনার যোগ্যতা, দূর্বল হাদীস হতে সহীহ হাদীস পৃথক করার উপরও নির্ভর করে।" [১]

যেহেতু ইসলামী শরী'য়াহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে তথা ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয় এবং যেহেতু কুরআন ও সুন্নাহ ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি সেহেতু ইসলাম নিয়ে যেকোনো গভীর অধ্যয়ন-এর সাথে আরবী ভাষার অধ্যয়ন থাকা অত্যন্ত আবশ্যক। এখানে আরবী ভাষা বলতে প্রাচীন (Classical) আরবী ভাষা ও তার কাঠামোকে বোঝানো হচ্ছে। কথ্য ও আঞ্চলিক ভাষার চর্চা এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। এছাড়াও ইসলামী সভ্যতাকে শক্তিশালীভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য আরবী ভাষাকে বিকৃতির হাত রক্ষা করাও আবশ্যক।

আমাদের সালাফ তথা পূর্ববর্তীগণ এ বিষয়গুলো খুব ভালোভাবেই বুঝতেন। বিশেষ করে খোলাফায়ে রাশিদীনের আমলেও এ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।

উমর (রা) আবু মূসা আশ'আরী (রা)-কে চিঠিতে লিখেছিলেন, "সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন ও আরবীর জ্ঞান অর্জন কর এবং কুরআন আরবীতে অধ্যয়ন কর কারণ এটা আরবী।" [২]

আরেকটি বর্ণনায় উমর (রা) বলেন, "আরবী শেখ কারণ এটি তোমাদের দ্বীনের অংশ"। তিনি আরো বলেছেন, "কারো কুরআন পড়া উচিত নয় ভাষার জ্ঞান ছাড়া"

উবাই বিন কা'ব (রা) বলেছেন, "আরবী ভাষা শেখ ঠিক যেভাবে তোমরা কুরআন হিফজ করা শেখ"। [৩]

আলী (রা) যখন কুফায় তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন তখন সেখানে তিনি নতুন এক ধরনের আরবীর চর্চা দেখতে পান। এতে তিনি বেশ চিন্তিত হন এবং তিনি তৎকালীন আরবী পন্ডিত আবুল আসওয়াদ আদ-দুয়ালীর সাথে বৈঠক করেন এবং তাকে আরবী ভাষার মৌলিক নীতিসমূহ বিশ্লেষন করেন। ইবনু কাছীর (রহ) তার আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে লিখেছেন,

"আবুল আসওয়াদ হচ্ছে তিনি যাকে নাহু জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত করা হয়। এবং বলা হয়, যারা এ বিষয়ে কথা বলেছেন তাদের মধ্যে তিনি প্রথমদিককার একজন। তিনি তা আমীর-উল-মু'মিনীন আলী ইবনে আবী তালিব (রা) হতে গ্রহণ করেছেন।" [৪]

ইমাম শাফেঈ' আরবী ভাষার জ্ঞান থাকাকে ফরজে আইন মনে করতেন এবং তিনি তার আরব ছাত্রদের আরবী ভাষা ভালোভাবে রপ্ত করার তাগিদ দিতেন। তিনি তার ছাত্রদের বলতেন, "নিশ্চয়ই আমি জ্ঞান অন্বেষনকারীদের ব্যপারে এই ভয় পাই যে তারা আরবী ভাষার নাহু (ব্যকরণ) সঠিকভাবে জানবে না এবং এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সেই হাদীসের (বাস্তবতার) মধ্যে প্রবেশ করবে, 'যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যারোপ করল, সে যেন (জাহান্নামের) আগুনের মধ্যে তার আসন খুজে নেয়'" ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহও ইমাম শাফেঈ'র মতো অনেকটা একই মত পোষন করতেন। তার মতে যেহেতু একজন মুসলিমের জন্য কুরআন সুন্নাহ বোঝাটা আবশ্যক সেহেতু "অত্যবশ্যকীয় কিছু পালন করার জন্য যা প্রয়োজন তাও অত্যাবশ্যক"-এই নীতি অনুযায়ী আরবী ভাষা শেখাও আবশ্যক। তিনি আরো বলতেন, "আরবী ভাষা ইসলাম ও এর অনুসারীদের প্রতীক এবং যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি দ্বারা জাতিসমূহ নিজেদের পৃথক করে ভাষা তাদের মধ্যে অন্যতম।" [৫]

মু'জিযা
২৮ টি হরফ। এ কটি হরফ ও এর দ্বারা গঠিত শব্দ দিয়েই পৃথিবীতে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়। আমরা জানি, কুরআন একটি মু'জিযা যা মানবজাতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জসরূপ। এবং অন্যান্য নবী-রাসূলদের মু'জিযার সাথে কুরআনের পার্থক্য হচ্ছে, অন্যান্য নবী-রাসূলদের সময় শেষ হলে তাদের মু'জিযারও সমাপ্তি ঘটত, কিন্তু কুরআন একটি চলমান মু'জিযা যার সমাপ্তি হয়নি। যদিও কুরআনের মু'জিযা হওয়াটা আমাদের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু এ বিষয়টি শুধু জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ, অভিজ্ঞতা দ্বারা নয় (But this is only through knowledge, not through experience) একমাত্র আরবী ভাষা শেখা ছাড়া এ অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি অর্জন করা সম্ভব নয়।

ঐতিহাসিকভাবে এ ভাষার অবহেলা ও এর পরিনাম
মুসলিমদের পতনের পেছনে যেভাবে কাফেরদের চক্রান্ত ছিল, ঠিক একইভাবে মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু দূর্বলতা দেখা দিয়েছিল। এবং এসব কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম এক কারণ হলো আরবী ভাষার প্রতি অবহেলা। যদিও মুসলিমরা এ ভাষার গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল, কাফেররা ঠিকই এ ভাষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। এ জন্যই তারা আরব-তুর্কিদের মধ্যে বিভেদ লাগানোসহ আরো অনেক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। শাইখ তাকী (রহ) তার বই "ইসলামী রাষ্ট্র"-তে বলেন:

"এরপর ইসলামের শত্রুরা আরবী ভাষার উপর আক্রমণ চালায়। কারণ, এই ভাষাতেই ইসলাম এবং এর হুকুম আহকামকে প্রচার করা হয়। তাই, তারা ইসলামের সাথে আরবী ভাষার সম্পর্ককে ছিন্ন করতে ব্যাপক তৎপরতা চালায়। কিন্তু, প্রথমদিকে তারা সফলতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। কারণ, প্রথমদিকে মুসলিমরা যে দেশই জয় করেছে সেখানেই তারা কোরআন, সুন্নাহ ও আরবী ভাষাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে এবং জনগণকে তারা এ তিনটি জিনিসই শিক্ষা দিয়েছে। বিজিত জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং আরবী ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলেছে। কিছু কিছু অনারব এ ব্যাপারে এতো পারদর্শীতা অর্জন করেছে যে, তারা ইসলামের প্রখ্যাত মুজতাহিদও হয়েছে। যেমন, ইমাম আবু হানিফা। কেউ কেউ বা হয়েছে অত্যন্ত উচুঁ মাপের কবি, যেমন, বাশার ইবন বুরদ। আবার, কেউ বা হয়েছে প্রখ্যাত লেখক, যেমন, ইবন আল-মুকাফফা'এভাবেই, মুসলিমরা (প্রথমদিকে) আরবী ভাষাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিল। ইমাম শাফেঈ' কুরআনের কোন ধরনের অনুবাদ বা অন্য কোন ভাষায় সালাত আদায় করাকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। আবার, যারা কুরআন অনুবাদের অনুমতি দিয়েছেন, যেমন, ইমাম আবু হানিফা, তারা অনুবাদকে কুরআন হিসাবে স্বীকৃতি দিতেও অস্বীকার করেছেন। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে আরবী ভাষা সবসময় মুসলিমদের মনোযোগ ও গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। বস্তুতঃ এ ভাষা হচ্ছে ইসলামের মৌলিক অংশ এবং ইজতিহাদের জন্য এক অপরিহার্য বিষয়। আরবী ভাষা ব্যতীত উৎস থেকে ইসলামকে বোঝা অসম্ভব এবং এ ভাষা ব্যতীত শরীয়াহ্‌ থেকে নির্ভুল ভাবে হুকুম-আহকাম বের করাও সম্ভব নয়। কিন্তু, হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে, আরবী ভাষার গুরুত্ব ধীরে ধীরে হৃাস পেতে থাকে। কারণ, এ সময় এমন সব শাসকেরা ক্ষমতায় আসে যারা আরবী ভাষার প্রকৃত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝতে ব্যর্থ হয় এবং এ বিষয়টিকে তারা ক্রমাগত অবহেলা করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের আরবী ভাষার উপর দখল কমে যায় এবং ইজতিহাদের প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যায়। এখানে মনে রাখা দরকার যে, যেকোনো বিষয়ে শরীয়াহ্‌র হুকুম খুঁজে বের করতে হলে, যতগুলো উপাদান অপরিহার্য তার মধ্যে আরবী ভাষা একটি। বস্তুতঃ ইতিহাসের এই পর্যায়ে, আরবী ভাষা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে, রাষ্ট্রের শরীয়াহ্‌ সম্পর্কিত ধ্যানধারণাও অস্পষ্ট হয়ে যায় এবং সেইসাথে, অস্পষ্ট হয়ে যায় শরীয়াহ্‌ আইনকানুন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া। ইসলামী রাষ্ট্রকে দূর্বল ও রুগ্ন করে ফেলতে এ বিষয়টি ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের পক্ষে নতুন নতুন সমস্যা সমূহকে বোঝা এবং সে সমস্যাগুলোর মুকাবিলা করা কঠিন হতে থাকে। একসময় রাষ্ট্র উদ্ভুত সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয় কিংবা সমাধানের লক্ষ্যে ভ্রান্ত পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। এভাবে, সময়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রের সমস্যা ঘনীভূত হতে থাকে এবং ইসলামী রাষ্ট্র একসময় অন্তহীন সমস্যার সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে।" [৬]

সুতরাং এ থেকে বোঝা যায় এ ভাষা অবহেলার পরিনাম কতটা মারাত্মক ছিল।

এ ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্য
আরবী একটি অত্যন্ত চমৎকার ভাষা। এর কাঠামো অত্যন্ত দৃঢ়, সংগঠিত ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুবই জটিল। অনেক ভাষাবিদই এ চিন্তা করে হতবাক হন যে কিভাবে এ ভাষা প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভব হলো।

নিম্নে আরবী ভাষার (Grammatical Structure) সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া হল,

পদ বা শব্দের শ্রেণীবিভাগ (اجزاء الكلام):শব্দকে তিনভাগে ভাগ করা হয় আরবীতে

১. বিশেষ্য/Noun (اسم) ২. ক্রিয়া/Verb (فعل) ৩. অব্যয়/Particle (حرف)

লিঙ্গ (الجنس): আরবী ভাষায় লিঙ্গ মূলত দু'টি, পুংলিঙ্গ (المذكر) ও স্ত্রীলিঙ্গ (المئنث)উদাহরনসরূপ, (زيد، خالد، احمد) এগুলো পুংলিঙ্গবাচক শব্দ আবার (فاطمة، داكا، ريح، نار، يد) এগুলো স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ। এছাড়াও এ ভাষায় কিছু সংখ্যক উভয় লিঙ্গের শব্দও রয়েছে যাদের (الجنس المشترك) বলা হয়। এ ভাষায় কোনো ক্লীবলিঙ্গ নেই।

বচন (العدد): আরবী ভাষায় বচন মূলত তিনটি।

১. একবচন (واحد) ২. দ্বিবচন (تثنية) ৩. বহুবচন (جمع)

এছাড়াও আরবী ভাষায় বহুবচনের বহুবচন (الْجُمُوع الْمُنْتَهَى)-এর প্রচলন রয়েছে, যেমন- (فتح، فتوح، فتوحات)এ বৈশিষ্ট সমূহের ফিকহী গুরুত্ব অপরিসীম। এর ফলে ফিকহ-এর কোনো মাসআলাকে অত্যন্ত নির্দিষ্ট করে বর্ণনা করা যায়।

ক্রিয়া (الفعل): নিম্নোক্তভাবে আরবী ক্রিয়াকে ভাগ করা হয়,

১. অতীতকাল (الفِعْلُ الْماضِي) ২. বর্তমান/ভবিষ্যৎ কাল (الفِعْلُ الْمُضارِي৩. নির্দেশবাচক (الفِعْلُ الأَمْر) ৪. নিষেধাজ্ঞা (الفِعْلُ النهي)

এ ভাষায় বর্তমান ও ভবিষ্যৎকালের জন্য একটিই Structure রয়েছে। যদিও কখনো কখনো ভবিষ্যৎকে আলাদা করে বোঝানোর জন্য (فعل)-এর আগে একটি (س) যুক্ত করা হয়, যেমন, (بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا)[৭] এছাড়াও বচন, লিঙ্গ, কাল ইত্যাদি ভেদে ক্রিয়ার শাব্দিক রূপান্তর ঘটে যাকে (صَرْفُ الفِعْل) বলা হয়। এ বৈশিষ্ট্যের কারণেও ফিকহ-এর কোনো মাসআলাকে অত্যন্ত নির্দিষ্ট করে বর্ণনা করা যায়।

'রাব (الإعرَب): সাধারণত বাক্যে প্রতি (مُعْرَب) শব্দের শেষ হরফের স্বর-চিহ্ন হলো ই'রাব। এ স্বর-চিহ্ন পরিবর্তনশীল, অবস্থার পরিবর্তনভেদে একটি শব্দের শেষ হরফ যবর (فَتْحَة), যের (كَسْرَة), পেশ (ضَمَّة) বা সুকূন গ্রহণ করতে পারে। যেমন, সাধারণত শব্দটি কর্তা (فاعِل) হলে পেশ গ্রহণ করে, কর্ম (مَفْعُول) হলে যবর গ্রহণ করে ইত্যাদি। পৃথিবীতে এ ধরনের স্বর-চিহ্ন বর্তমানে আরবী ছাড়া হাবশী ও জার্মান ভাষায় কিছুটা রয়েছে। স্বর-চিহ্ন প্রাচীন সভ্যতার একটি নিদর্শন। [৮] উদাহরণসরূপ, (جَاءَ زَيْدٌ، ضَرَبَ زيدً، قَلَمُ زَيْدٍ)

আরবী ভাষা প্রধানত একটি মূলশব্দ তাড়িত ভাষা (root-driven language)এ ভাষায় বিভিন্ন Pattern (وزن)-এ অসংখ্য মূল শব্দ (مَصْدَر বা فِعْل) রয়েছে। উদাহরণসরূপ, (فَعَلَ، سَمِعَ، نَصْرٌ، ذَكَّرَ، تَعْلِيْم)এসব মূল শব্দ হতে অসংখ্য শব্দ বের হয়ে আসে যাদের (مُشْتَقات) বলা হয়। উদাহরণসরূপ, (عِلْمٌ) এ শব্দের উপাদান (مادة) হচ্ছে (ع ل م) যা থেকে বের হয়ে আসে, (عَلِمَ، مَعْلُوم، عَلَّمَ، تَعْلِيم، مُعَلِّم، مُتَعَلِّم، عَلّامَة)

কোনো ভাষার শক্তি পরিমাপ করতে হলে সে ভাষার শব্দ ভান্ডার-এর পরিমান দেখতে হয়। ভাষার শব্দ যত বেশি তত বেশি শক্তিশালী সে ভাষা। আরবী ভাষা এক্ষেত্রে এগিয়ে অর্থাৎ এ ভাষার বিশাল শব্দ ভান্ডার রয়েছে। যেখানে বাংলায় সব মিলিয়ে রয়েছে মাত্র ১ লক্ষ এবং ইংরেজীর রয়েছে ২ লক্ষাধিক শব্দ।

আরবী ভাষায় অনেক শব্দ রয়েছে যা বিভিন্ন অর্থে প্রকাশ পায়। উদাহরণসরূপ, (قضاء، قدر)এ বৈশিষ্ট্য আরবী ভাষাকে আরো শক্তিশালী করেছে।

অল্প কথায় বা বাক্যে অনেক অর্থ প্রকাশ আরবীতে যেমন সম্ভব অন্য ভাষায় তেমন সম্ভব নয়। আরবীতে প্রবাদ রয়েছে (خَيْرُ الكَلامِ ما قَلَّ وَدَلَّ) অর্থাৎ উত্তম কথা হলো সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থপূর্ণ। কুরআন ও হাদীস এমনি সব সংক্ষিপ্ত অর্থপূর্ণ বাক্যে পরিপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (সা)ও বলেছেন, 'আমাকে (جَوَامِعَ الْكَلِم) দেওয়া হয়েছে' [৯] অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত কথায় গভীর জ্ঞান দেবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাকে। এ বিষয়টির উদাহরণ হিসেবে নিম্নোক্ত হাদীসটি উল্লেখ করা যেতে পারে,

تَهَادَوْا تَحَابُّوا

"উপহার বিনিময় কর, একে অপরকে ভালোবাসতে পারবে।" [১০] অর্থাৎ উপহার বিনিময় করলে পারস্পরিক ভালোবাসা-সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে।

এ ভাষার বর্ণনাশৈলী এত চমৎকার যে তা শ্রোতার কাছে ছবির মতো ধরা দেয়। এবং পবিত্র কুরআনে এ রকম অসংখ্য আয়াত রয়েছে। উদাহরণসরূপ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا ~ وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا

"তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সবচেয়ে সুন্দর ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে 'উফ' শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে সম্মানজনকভাবে কথা বল। তাদের উপর রহমত (ভালবাসা/স্নেহ/দয়া/মমতা/করুনা) দিয়ে তোমার নতজানু হয়ে থাকা বিনয়ের ডানা মেলে দাও এবং বল: হে প্রতিপালক, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।" [বনী ইসরাঈল: ২৩-২৪]

এ ভাষার এক অসামান্য সামর্থ্য রয়েছে অন্যান্য ভাষাকে গ্রাস করে ফেলার যখন তারা এর নিকটে আসে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীগণ দাওয়া নিয়ে যে অঞ্চলেই গেছেন, কিছুদিনের মধ্যেই সে অঞ্চলের লোকজনের ভাষা সহজেই আরবীতে পরিনত হয়েছে। এর ফলে খিলাফতের অভ্যন্তরে অনেক অনারব আরবীতে অত্যন্ত পারদর্শী ব্যক্তিত্বে পরিনত হয়েছে। এমনকি আরবী ভাষার ব্যকরণের পথিকৃত সিবাওয়েও একজন অনারব ছিলেন। পরবর্তীতেও অনেক যুগ পর্যন্ত এ ধারা বজায় ছিলকোনো অঞ্চলে অবহেলার কারণে এ ভাষা প্রতিষ্ঠা না হতে পারলেও সে অঞ্চলের বিদ্যমান ভাষার উপর ব্যপক প্রভাব বিস্তার করে গেছে এ ভাষা যা এখনও বিদ্যমান।

এ ভাষার আরো একটি সামর্থ্য হচ্ছে, এ ভাষা বিদেশী কোনো ভাষার শব্দকে আরবী শব্দতে রূপান্তর করতে পারে। অন্যকথায়, এ ভাষা অন্য ভাষার শব্দ Arabize তথা (مُعَرَّب) মু'আর্রাব করতে পারে। এ ভাষায় শব্দ ও এর আরবী রূপান্তর নিয়ে ইজতিহাদ করার জন্য জ্ঞানের আলাদা শাখা রয়েছে।

ইজতিহাদ
ইজতিহাদের জন্য শর্তাবলী রয়েছে যা উসূলের আলেমগণ ব্যখ্যা করে গিয়েছেন। এর জন্য দরকার বিস্তৃত জ্ঞান, কুরআন-সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান ও যথেষ্ঠ পরিমান আরবী ভাষাতত্ত্বের জ্ঞান... [শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানী, মাফাহীম, পৃষ্ঠা ৪৬]

আরবী ভাষার অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হচ্ছে ইল্লত আহরণ অর্থাৎ একজন মুজতাহিদ কোনো নস (نص) থেকে হুকুমের পেছনের 'ইল্লাহ' বের করতে পারেন এবং অন্য পরিস্থিতিতে এর প্রয়োগ করতে পারেন। এছাড়াও আইনগত দিক থেকে, আরবী ভাষায় কোনো বাক্যে বিভিন্ন শব্দের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি বাক্যেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ প্রদান করে। উদাহরণসরূপ, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ইমাম হচ্ছে রাখাল (দায়িত্বশীল) এবং সেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। এখানে 'সেই' শব্দটি আরবী ব্যকরণের পরিপ্রেক্ষিতে সীমিতকরণ (اداة حصر)-এর হুকুম পায় এবং এটি একটি আলাদা সর্বনাম। এভাবেই তাঁর (সা) বক্তব্য, 'এবং সেই জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে' (রাষ্ট্রের) জন্য দায়িত্বশীলতাকে ইমামের জন্য সীমিত করে। সুতরাং, রাষ্ট্রের মধ্যে মূলত খলীফা ছাড়া আর কেউই শাসন করবার কোনো ক্ষমতা রাখেনা, হোক ব্যক্তি অথবা দল। [১১]

ইসলাম মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে সর্বশেষ জীবনব্যবস্থা। দুনিয়ার সমাপ্তি পর্যন্ত এ দ্বীন দিয়েই সমাজ পরিচালনা করতে হবে। আর এ কাজ করতে গিয়ে যুগে যুগে মুসলিম জাতিকে অসংখ্য নতুন সমস্যার সম্মুক্ষীন হতে হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবে ভবিষ্যতেও হতে হবে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য একমাত্র উপায় হচ্ছে ইজতিহাদ। ইজতিহাদ হচ্ছে সেই ইঞ্জিন যা ইসলামকে চালিত করে। এটি না থাকলে উম্মাহর মধ্যে জলাবদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং উম্মাহর সমৃদ্ধি থমকে যাবে। এবং ঐতিহাসিকভাবেও এ বিষয়টির সত্যতা আমরা দেখেছি। শাইখ তাকী (রহ) বলেন,

"(মুসলিম উম্মাহ্‌র) এ অধ:পতনের পেছনে একমাত্র একটি কারণই ছিল, (মুসলিমদের) প্রচন্ড দূর্বলতা যা তাদের ইসলামকে বোঝার জন্য চিন্তা করার যোগ্যতা ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ দূর্বলতার পেছনের কারণ ছিল ৭ম শতাব্দী হিজরীর প্রথম থেকে শুরু করে ইসলাম ও আরবী ভাষার বিচ্ছিন্নকরন যখন আরবী ভাষা ও ইসলামের প্রসার অবহেলিত হয়েছে। সুতরাং, যতক্ষন পর্যন্ত আরবী ভাষাকে ইসলামের সাথে এর এক অবিচ্ছেদ্য মৌলিক অংশ হিসেবে মিশ্রিত না করা হবে, ততক্ষন পর্যন্ত এ অধ:পতন মুসলিমদের আরো অবনতির দিকে নিয়ে যাবে। এটা এ কারণে যে, এই ভাষার ভাষাগত ক্ষমতা ইসলামের শক্তিকে এমনভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে যে একে ছাড়া ইসলামকে বহন করা সম্ভব নয়, এবং যদি একে অবহেলা করা হয়, তবে শরীয়াহ্‌র মধ্যে ইজতিহাদ করা আর সম্ভবপর হবে না। (আর) আরবী ভাষার জ্ঞান ইজতিহাদের জন্য একটি মৌলিক শর্ত। এছাড়াও ইজতিহাদ উম্মতের জন্য অপরিহার্য যেহেতু এর সদ্ব্যবহার ছাড়া উম্মাহর উন্নয়ন সম্ভব নয়।" [১২]

সুতরাং, বোঝা যাচ্ছে উম্মাহর সমৃদ্ধির সাথে আরবী ভাষার সম্পর্ক কত গভীর।

উম্মাহ্‌র পূনর্জাগরণ
নিশ্চয়ই আল্লাহ এ কিতাবের দ্বারা বিভিন্ন জাতিকে উচ্চকিত করেন আর অন্যান্যদের করে দেন নিচু। [মুসলিম]

পূনর্জাগরণ বস্তুগত বা বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের মধ্যে নিহিত নেই। বরং চিন্তাগত ও মতাদর্শিক উন্নয়নই পূনর্জাগরনের সঠিক ভিত্তি আর বস্তুগত উন্নয়ন হচ্ছে এর ফলাফল। আমরা যখন উম্মতের পূনর্জাগরনের কথা বলি তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে এ পুনর্জাগরণ ইসলামী আকীদাহ ও তা থেকে বের হয়ে আসা ব্যবস্থার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ আমাদেরকে পৃথিবীতে এ আকীদাহ প্রতিষ্ঠা ও এর ব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এবং এ ব্যবস্থাটি রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ্‌র মধ্যে আরবী ভাষায়। অতীতে আরবরা পৃথিবীর শ্রেষ্ট জাতিতে পরিনত হয়েছিল কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা এ ভাষায় পবিত্র কুরআন নাযিল করেছিলেন। এবং এ ভাষাতেই তারা শরীয়াহ বুঝেছিলেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছিলেন। এবং আরবী ভাষার কোনো কিছু সবচেয়ে ভালোভাবে আরবীতেই বোঝা যাবে। এক্ষেত্রে অনুবাদ গ্রহণযোগ্য নয় যেহেতু ভাষার অর্থ ও আকুতি অনেকটাই অনুবাদে হারিয়ে যায়। অন্য যেকোনো ভাষার সাহিত্য অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। উদাহরণসরূপ, আমরা শেক্সপিয়ারকে ইংরেজি, ইকবালকে উর্দূ, নজরুলকে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাতেই পূর্নাঙ্গরূপে বুঝতে পারবো না। সুতরাং ইসলামী ব্যবস্থার খুটিনাটি বিশ্লেষন বুঝতে হলে আরবী ভাষার জ্ঞানও থাকতে হবে।

আমরা যারা হুকুম শরঈ' নিয়ে পড়াশুনা করেছি তারা জানি যে, ফরয-এ-কিফায়া ও আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বাধ্যতামূলক ফরয দায়িত্ব এবং ফরয হিসেবে ফরয-এ-আইন হতে কোনো অংশে এটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধুমাত্র পার্থক্য হল, ফরয-এ-কিফায়াকে পালন করার জন্য আল্লাহ পুরো উম্মতকে একসাথে দায়িত্ব দিয়েছেন, উম্মতের প্রত্যেকটি সদস্যকে আলাদা আলাদা চিহ্নিত করে দায়িত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু উম্মাহর মধ্যে যথেষ্ঠ পরিমান সদস্য যদি সন্তোষজনকভাবে এ দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে কাজটি সম্পন্ন করাটা পূরো উম্মতের জন্য ফরজে আইন হিসেবে ঝুলে থাকে। আমরা জানি ইজতিহাদ করাটা ফরযে কিফায়া এবং ইজতিহাদ করার জন্য আরবী ভাষা জানাটাও আবশ্যক। এবং উম্মতের মধ্যে প্রত্যেক যুগে অবশ্যই যথেষ্ঠ পরিমানে মুজতাহিদ থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে কি আমরা সে পরিমান মুজতাহিদ ও সেরকম ইজতিহাদ চর্চা দেখতে পাবো ? এখন আমরা একটু চিন্তা করলেই উপলব্ধি করতে পারবো যে বর্তমানে আরবী ভাষার জ্ঞান অর্জন করা আমাদের জন্য কতটা জরুরী। এছাড়াও খিলাফত প্রতিষ্ঠার দা'য়ী হিসেবে উম্মতের কাছ থেকে আস্থা ও নেতৃত্ব অর্জন করার জন্য আরবী ভাষা জানাটা খুবই জরুরী।

উপসংহার
"আল্লাহ তাঁর সেই বান্দার মুখ উজ্জ্বল করুন যে আমার কথা শুনেছে, সেগুলো মনে রেখেছে, বুঝেছে এবং অন্যের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কারণ কেউ নিজে ফকীহ্‌ (জ্ঞানী) না হয়েও ফিকহ্‌ (জ্ঞান) বহনকারী হতে পারে। আবার কেউ তার নিজের চাইতে বড় ফকীহ (জ্ঞানী) এর নিকটও ফিকহ্‌ পৌঁছে দিতে পারে।" [আবু দাউদ, তিরমিযী এবং আহমদ থেকে বর্ণিত]

আমরাই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এবং আমাদেরকেই পৃথিবীকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ দিয়ে শাসন করতে হবে। জনগণ আমাদের কাছেই আসবে ইসলাম শিখতে। আমরাই তারা যাদেরকে পৃথিবী বিভিন্ন প্রান্তে প্রেরণ করা হবে আমিল, ওয়ালী কিংবা মুজাহিদ হিসেবে। ঠিক সেভাবেই যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের প্রেরণ করতেন। আমরা জানি, মু'আজ বিন জাবাল যখন ইয়েমেনে প্রেরিত হয়েছিলেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)-এর প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে তিনি আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নত ও তার ইজতিহাদের দ্বারা রায় দেবেন। সুতরাং, আমরা যদি সেই আলী, মু'আজ, আমর ইবনুল আস (রা)-দের সত্যিকার উত্তরসূরী হয়ে থাকি এবং আমরা যদি কিছুদিনের মধ্যে তাদের মতো দায়িত্বপ্রাপ্ত হই তখন কিভাবে আমরা উত্তমরুপে খিলাফতের অফিসকে চালাবো যখন আমরা আরবী ভাষার জ্ঞান রাখি না।

সুতরাং আমাদের আরবী ভাষা শিখতে হবে। শুধুমাত্র সাধারণ নিত্যনৈমিত্তিক যোগাযোগের আরবী ভাষা নয় যা আমাদের দেশের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা একাডেমি শিক্ষা দেয়, বরং আমাদের আরবী শিখতে হবে দ্বীনকে বোঝার জন্য। ভাষা শিক্ষাকে আমাদের কঠিন কোনো কিছু মনে করা উচিত নয়। আর কেন আমরা আরবী ভাষা শেখাটা কঠিন মনে করব যখন আমরা জানি যে যাইদ (রা)-কে যখন রাসূলুল্লাহ (সা) হিব্রু ভাষা শিখতে বলেছিলেন তখন তিনি তা মাত্র ১৫ দিনে সম্পন্ন করেছিলেন। তার সময়ে কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা একাডেমি ছিল না অথচ আমাদের সময়ে তা আছে। তার সময়ে কোনো টেকনোলজিও ছিল না তাকে এ বিষয়ে সাহায্য করার জন্য অথচ আমাদের সময়ে তা আছে। আমরা দুনিয়ার বিভিন্ন কাজের জন্য ইংরেজি বা ফ্রেঞ্চ শিখতে পারলে আরবী কেন পারবো না। আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা নিয়ে আমাদের প্রত্যেকের এ কাজে অগ্রসর হওয়া উচিত। আল্লাহ্‌র কাছে দু'আ করি যাতে তিনি আমাদের তাঁর কিতাবের ভাষার সঠিক জ্ঞান দান করেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,

"আর যারা আমার পথে চেষ্টা সংগ্রাম করে তাদের আমি অবশ্যই আমার পথ দেখিয়ে দেব। আর আল্লাহ অবশ্যই রয়েছেন তাদের সাথে যারা সবচেয়ে উত্তমরুপে কাজ সম্পাদন করে।" [আনকাবুত: ৬৯]
 

এস এম নাজিম উর রশীদ
১ জানুয়ারী ২০১১


তথ্যসূত্র:

[১] মাফাহীম, তাকী উদ্দীন আন-নাবহানী, পৃষ্ঠা ৪৭
[২] ইকতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম, ইবনু তাইমিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ২০৭
[৩] মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ
[৪] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনু কাছীর, ৮ম খ-, ৩৪৩ পৃষ্ঠা
[৫] ইকতিদা'উস সিরাতিল মুসতাকীম, ইবনু তাইমিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ২০৩
[৬] ইসলামী রাষ্ট্র, তাকী উদ্দীন আন-নাবহানী, পৃষ্ঠা ১৬৪
[৭] সহীহ মুসলিম
[৮] আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, আ ত ম মুসলেহউদ্দিন, ইসলামী ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ২৬২
[৯] সহীহ মুসলিম
[১০] মুআত্তা ইমাম মালিক, সুনান আস-সাগীর লিল-বাইহাকী, মু'জাম আল-আওসাত লিত-তাবারানী
[১১] কিভাবে খিলাফত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, আবদুল কাদীম জাল্লুম, পৃষ্ঠা ৬০
[১২] মাফাহীম, তাকী উদ্দীন আন-নাবহানী, পৃষ্ঠা ১

স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির কিছু উপায়

بسم الله الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله

ইসলামী জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্মৃতিশক্তির গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে যখন সহীহ হাদীস সংকলনে তা একটি মানদন্ড। তথাপি কুরআন হিফজ করা, হাদীস বর্ণনা করা এবং দ্বীনের প্রয়োজনীয় আরকান-আহকাম ধারন করার জন্য স্মৃতিশক্তির প্রখরতা অতীব প্রয়োজনীয়।

স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির কিছু করণীয় নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১। পরিপূর্ণ ইখলাস (اخلاص) অর্থ্যাৎ জ্ঞানর্জনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য নির্ধারণ করা। দুনিয়াবী কোন মোহ্ কিংবা জাহির করা যেনো একে কলুষিত না করে; তা নিশ্চিত করা এবং প্রতিনিয়ত নিজের নিষ্ঠাকে প্রশ্ন করা।

২। গুনাহ্ থেকে বিরত থাকা। বিশেষ করে কবীরা গুণাহ্সমূহ থেকে। কেননা, দ্বীনী ইলম আল্লাহ্র এক অশেষ অনুগ্রহ। আর, আল্লাহর অনুগ্রহ সীমালঙ্গনকারীদের জন্য নয়।

৩। যা শিখা হয়েছে তার উপর আমল করা। কারণ, ইলমের (علم) দাবী আমল (عمل)

৪। শিখা পাঠসমূহ পুনরাবৃত্তি করা। অত্যন্ত পুরনো হলেও এই পদ্ধতি বেশ কার্যকরী।

৫। অন্যকে শিক্ষাদান করা এবং দাওয়ার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌছে দেয়া।

৬। মধু, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

৭। এছাড়া ও সুন্নাহ্ভিত্তিক আরো পদ্ধতি রয়েছে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য।

কিছু দোয়া আমরা সবসময় পাঠ করতে পারি। নিম্নে কিছু দোয়া উল্লেখ করা হলো:

-رب زدني علما–‘হে আল্লাহ্1 আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও [১]

-“رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِي يَفْقَهُوا قَوْلِي
  
হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দাও।আমার কাজকে সহজ করে দাও। আমার জিহ্বার জড়তা (বচনের ত্রুটি) দূর করে দাও।যাতে তারা আমার বলা কথা বুঝতে পারে[]
  
আল্লাহ্ তাআলা আমাদের আমল করার তৌফিক দিন।
سبحانك اللهم و بحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك و أتوب إليك

امين
সায়্যিদ মাহমুদ গজনবী


তথ্যসূত্র:

[১] সূরা ত্ব-হা: ১১৪
[২] সূরা ত্ব-হা: ২৫-২৮


মূলঃ ইসলামের ফিরে আসা

বুধবার, ২৮ মার্চ, ২০১২

খিলাফত ব্যবস্থা কি মাত্র ত্রিশ বছর টিকে ছিল? পর্ব-১

খিলাফাহ জার্নালের একটি প্রবন্ধ অবলম্বনে ভাষান্তরিত

একথা সর্বজন স্বীকৃত যাতে কোন সন্দেহ নেই যে, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে সারা বিশ্বের নেতা রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ (সা) এর হাতে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তা ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ বিশ্বাসঘাতক কামাল আতাতুর্কের হাতে তা ধ্বংস হয়। খুলাফায়ে রাশেদিনের পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা বা খিলাফত ব্যবস্থা যে ধারাবাহিকভাবে টিকেছিল তা ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও শরীয়াহর দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করলে তা আমাদের কাছে বোধগম্য হবে।

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এ ব্যবস্থার ধারাবাহিক অস্তিত্ব বুঝতে চাই, তাহলে দেখতে হবে প্রথমতঃ এ ব্যবস্থার কাঠামো কি ইতিহাস জুড়ে টিকেছিল কিনা। দ্বিতীয়তঃ এ কাঠামোতে সময়ের আবর্তে কি কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা। রাসুল (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদিনের সময়ের ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভগুলো হলঃ

১। খলীফা বা রাষ্ট্রপ্রধান
২। খলীফার প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী (মুওয়ায়ীন আত তাফউয়ীদ)
৩। খলীফার নির্বাহী সহকারী (মুওয়ায়ীন আত তানফীদ)
৪। গভর্ণরবৃন্দ (উলাহ্)
৫। আমীর-উল-জিহাদ
৬। বিচার বিভাগ
৭। প্রশাসনিক বিভাগ
৮। উম্মাহ্ কাউন্সিল (মাজলিস আল-উম্মাহ্)

তাই আমরা যদি ১৯২৪ সাল পর্যন্ত ১৩০০ বছরের ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাই পরামর্শ সভা মাজলিস আল উম্মাহটাই শুধু বিভিন্ন সময়ে উপেক্ষিত বা অবহেলিত ছিল। খুলাফায়ে রাশেদিনের পর মাজলিস আল উম্মাহর প্রতি কিছু সংখ্যক খলীফার উদাসীনতার অর্থ এই নয় যে, পরামর্শ সভা না থাকলেই ব্যবস্থা হিসেবে খিলাফতের অবসান হয়ে গেল। অন্য সব স্তম্ভ টিকে থাকলে মাজলিসুল উম্মাহ বা শুরা ছাড়াও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চলতে পারে, যদিও শুরা উম্মাহর অধিকার। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সংকট, গৃহযুদ্ধ ও বিদেশী সেনাবাহিনীর আগ্রাসন ঘটলেও এমন কখনো হয় নি যে, মুসলিমরা খলিফা বিহীন ছিল।

নিজের পুত্রকে খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দেয়া বা বংশীয় শাসনের অভিযোগ খানিকটা সত্য এবং এটাও সত্য যে, খলীফা নিয়োগের বায়াতের পদ্ধতিতেও কখনো কখনো অনিয়ম দেখা যায়। কিন্তু এটা খিলাফতের ধারাবাহিকতাকে কখনো প্রভাবিত করতে পারেনি। অনেক সময় এমনও ঘটেছে যে, খলীফা তার ছেলেকে যোগ্য মনে করলে তার মৃত্যুর আগেই জনগণের কাছ থেকে ছেলের জন্য বায়াতের শপথ আদায় করেছিলেন। পরবর্তীতে তা আবার নবায়ন করেছেন। এ বায়াত মূলত প্রভাবশালী লোকজন এবং জনপ্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করত।

খুলাফায়ে রাশেদিনের পর খিলাফত টিকে থাকার কথা ইসলামী পণ্ডিতরাও স্বীকার করেছেন। যদিও এদের মধ্যে দু একজন তিরমিযী শরীফের একটি হাদিসের কারণে প্রথম চার খলীফার পর পরবর্তী খলিফাদের ক্ষেত্রে খলীফাশব্দটি ব্যবহার করতে অপছন্দ করতেন। সে হাদিসটি হলঃ রাসুল (সা) বলেছেন, “আমার পর আমার উম্মাহর মধ্যে ৩০ বছর পর্যন্ত খিলাফত থাকবে তারপর শুরু হবে বংশীয় শাসন (মুলকান আদ্দুদান) [একই বর্ণনা-সুনানে আবু দাউদ (২/২৬৪) এবং মুসনাদে আহমদ (১/১৬৯) থেকেও পাওয়া যায়।] ইসলামী বিশারদগণ  ব্যাখ্যা করেন যে, যেহেতু এ হাদিসটি এ বিষয়ক অন্যান্য হাদিসের সঙ্গে আপাত দৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক মত প্রদান করে তাই এই হাদিসের গূঢ় অর্থ ৩০ বছর পর খিলাফত ব্যবস্থা শেষ হয়ে যাবে তা নিশ্চিতভাবে বোঝাচ্ছে না।

জাবির বিন সামুরাহ (রা) বর্ণনা করেন, “রাসুল (সা) বলেন, দীন ইসলাম ততদিন পর্যন্ত টিকে থাকবে যতদিন না আল্লাহর নির্ধারিত ক্ষণ উপস্থিত হয় অথবা কুরাইশ বংশীয় বারজন খলীফা তোমাদেরকে শাসন না করে।[সহিহ মুসলিম] এ হাদিস থেকে বোঝা যায় মুসলমানদের চার পাঁচ জন নয় বরং একাধিক সংখ্যক খলীফা শাসন করবেন। এ হাদিস অনুসারে খিলাফত ব্যবস্থা শুধু ত্রিশ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা বাস্তব সম্মত নয়। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় কাজী আইয়াদ বলেন, “এই হাদিসটিতে যেখানে বলা হয়েছে আমার পর খিলাফত ৩০ বছর টিকে থাকবে, এর পর শুরু হবে বংশীয় শাসনযা পুর্ববর্তী এই হাদিসটির সাথে সাংঘর্ষিক- যত দিন না কুরাইশ বার জন খলীফা উম্মাহকে শাসন করে, ইসলামী দ্বীন ততদিন টিকে থাকবে। [সহিহ মুসলিম] এ সাংঘর্ষিক মনে হওয়া বিবৃতির সমাধান হল-৩০ বছর খিলাফত টিকে থাকবে নবুয়্যতের আদলে অর্থাৎ সঠিকভাবে পরিচালিত খিলাফত ব্যবস্থার আদলে। বাস্তবে এই ত্রিশ বছর হযরত আবু বকর (রা) থেকে হাসান বিন আলী (রা) এর শাসনকালকেই বোঝায়। [এভাবেই অ্যান নববী তার সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যার মধ্যে উল্লেখ করেছেন পৃষ্ঠা-৮২১। পাঠক লক্ষ্য করুন এ ত্রিশ বছরে চার জন নয় বরং পাঁচ জন খলীফা উম্মাহকে শাসন করেছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে রাসুল (সা) বলেন, “বনী ইসরাইলকে শাসন করতেন নবীগণ, যখন এক মৃত্যুবরণ করতেন তখন তার স্থলে অন্য নবী আসতেন, কিন্তু আমার পর আর কোন নবী নেই। শীঘ্রই অনেক সংখ্যক খলীফা আসবেন। তারা (রা) (সাহাবীরা) জিজ্ঞেস করলেন, তখন আপনি আমাদের কি করতে আদেশ দেন? তিনি (সা) বললেন, তোমরা তাদের একজনের পর একজনের বায়আত পূর্ণ করবে, তাদের হক আদায় করবে। (বুখারী, মুসলিম)

উল্লিখিত হাদিস থেকে বোঝা যায় রাসুল (সা) এর পর কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী না আসায় কার তত্ত্বাবধানে মুসলমানদের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালিত হবে সেটা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন এবং সেটা হচ্ছে খিলাফত ব্যবস্থা ও খলীফার তত্ত্বাবধানে।

১২ জন খলীফার বিষয়টিও কাযী আইয়াদ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন সম্ভবত হাদিসটিতে যে ১২ জন খলিফার কথা বলা হয়েছে তারা হল এমন ১২ জন খলিফা যাদের শাসনকালে ইসলামের শৌর্য-বীর্য বৃদ্ধি পেয়েছিল-উম্মাহ ঐ সকল নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং সর্বোপরি খলীফা হিসেবে উম্মাহর দেখাশুনাও তারা ঠিকভাবে করেছিলেন। [আস সুয়্যুতি তারিখ আল খুলাফা, পৃষ্ঠাঃ ১৪]

ইবনে হাজার বলেন, “এই হাদিসটি সম্পর্কে যে কয়েকজন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার মধ্যে কাযী আইয়াদের যুক্তি সবচেয়ে শক্তিশালী কারণ রাসুল (সা) এর কিছু সংশ্লিষ্ট সহীহ হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েই তিনি যুক্তি তুলে ধরেছেন। যেমনঃ এ সম্পর্কে রাসুল (সা) বলেন, লোকেরা তাদেরকে কেন্দ্র করে একত্রিত হবে......। (ফাতহুল বারী) এর পাশাপাশি ইবনে হাজার কয়েকজন খলিফার উদাহরণসহ ঐতিহাসিক সত্যতা তুলে ধরেন।

চলবে .........

সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১২

গণতন্ত্র উন্নয়নের পূর্বশর্ত নয়

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths” বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)


প্রায় সব গবেষণায় ধরে নেয়া হয় যে, গণতন্ত্র উন্নয়নের পূর্বশর্ত - হোক সেটা অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত কিংবা বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির জগৎবিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যানকার ওলসেন তার পুরষ্কারপ্রাপ্ত ‘Power and Prosperity’ (2000) গ্রন্থে উল্লেখ করেন, অন্যান্য যে কোন সরকার ব্যবস্থার চেয়ে গণতন্ত্রে উন্নয়ন ও অগ্রগতি বেশী হয়ে থাকে। ওলসেন যুক্তি প্রদান করেন যে সাংঘর্ষিক পরিবেশ সবসময় ধ্বংসপ্রবণতা ও দুর্নীতিকে উষ্কে দেয়, অন্যদিকে একনায়কতন্ত্রে শাসককে বেশী সময় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে লুটপাটের প্রবনতা দেখা যায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তিনি পর্যবেক্ষণ করেন,ব্যক্তি এবং তার উন্নয়নকে এ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়-কেননা শাসককে ভোটের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়। ওলসেন গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রার মধ্যে সভ্যতার উম্মেষ দেখতে পান যা অগ্রগতির পথকে সুগম করে। এর ফলে জনগণের ইচ্ছার সাথে আরও নিবিড় সম্পর্কের মাধ্যমে সুশাসন ফলপ্রসু হয়ে উঠতে পারে।

অন্যান্য গবেষণায়ও এটা বেরিয়ে এসেছে যে, গণতন্ত্র হল উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এমনকি ইলিয়নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইভান রডরিক যুক্তি প্রদান করেন যে, “বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান (মেটা ইনস্টিটিউশন) হিসেবে গণতন্ত্র অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সাহায্য করে এবং গণতন্ত্রই হল সাফল্যের একমাত্র পূর্বশর্ত


গণতন্ত্রে প্রবেশ
(সার্বজনীন ভোটাধিকার অর্জনের বছর)
নিউজিল্যান্ড
১৯০৭
ডেনমার্ক
১৯১৫
সুইডেন
১৯১৮
যুক্তরাজ্য
১৯২৮
ফ্রান্স
১৯৪৬
জার্মানী
১৯৪৬
ইতালী
১৯৪৬
বেলজিয়াম
১৯৪৮
যুক্তরাষ্ট্র
১৯৬৫


যদিও গণতন্ত্রের কোন সর্বসম্মত সংজ্ঞা নেই; তারপরও গণতন্ত্রের যে কোন সংজ্ঞায় দুটি মৌলিক নীতি থাকতে হবে। প্রথম নীতিটি হল ক্ষমতায় সমাজের সকলের সমান অধিকার থাকতে হবে এবং সকলে সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তি ভোগ করবে।
      
যেসব রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি করে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের বিস্তার চায় তাদেরকে উপরের উপাত্তের সাথে মিলিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যায় যে, গণতন্ত্রের পক্ষে উপরে উল্লেখিত যুক্তিসমূহ মেলে না। অধিকাংশ উন্নত দেশসমূহে উন্নয়ন সুনিশ্চিত হয়েছে অগণতান্ত্রিক নীতিমালার কারণে এবং গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিই  উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে। পশ্চিমে যখন সর্বপ্রথম ভোটকে কার্যকরী করা হয়-তখন এ সুযোগ কেবলমাত্র কিছু ধনী ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল এবং ভোটের গুরুত্বের দিক থেকে সম্পদ, শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রভৃতিকে প্রাধান্য দেয়া হত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের পর ভোটাধিকার আইন ১৯৬৫ এর মাধ্যমে শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭০ সালে মার্কিন সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলের ভোটের অধিকার সংরক্ষণ করা হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা দক্ষিণের রাজ্যসমূহ ভোট কর প্রদানের মাধ্যমে বৈষম্যের স্বীকার হয়।

ফ্রান্স ১৮৩০ সালে ত্রিশোর্ধ ব্যক্তিদের ৩০০ ফ্রাঙ্ক প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে ভোট প্রদানের সুবিধা প্রদান করে - যারা ৩২ মিলিয়ন জনসংখ্যার মাত্র ০.০২% ছিল। ১৮৪৮ সালে পুরুষদের ভোট প্রদান সার্বজনীন হয় এবং শিল্পায়ন হওয়ার পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। জাপান ব্যাপক সামরিক শক্তি অর্জনের পর যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের ব্যাপারে চাপ দেয় তখনই ভোটদানকে সার্বজনীন করে। মার্কিনীরা জাপানকে ১৯৫২ সালে ভোট প্রদানের ক্ষমতা দিতে সম্মত হলেও তার নিজের দেশের জনগণকে পুরোপুরিভাবে তা দিতে আরও ১৩ বছর সময় নেয়।

১৮০০ সালে যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদের স্বর্ণযুগ-তখন সেখানে মাত্র ৩ ভাগ জনগণ ভোটের অধিকার পায়। মধ্যযুগ থেকে প্রতি জেলায় বড় বড় ভূস্বামীরা কেবলমাত্র হাউস অব কমনসের সদস্য নির্বাচিত করতে পারত। এই ব্যবস্থা ভূমিহীন ব্যবসায়ী এবং দক্ষ শ্রমিকদের ভোটদানকে অস্বীকার করত। শত শত বছর ধরে সমৃদ্ধ অঞ্চলসমূহকে সংসদে বারংবার গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করা হত। অথচ নতুন গড়ে উঠা শহরসমূহ সেভাবে উল্লেখ করা হত না। সংসদের কিছু কিছু আসন কিছু ব্যক্তির জন্য সবসময় সংরক্ষিত থাকত। ১৮৬৭ সালে জনসংখ্যার শতকরা ১৩ ভাগ লোক ভোট দিতে পারত। ৬১বছর পর ১৯২৮ সালে পুরুষ মহিলা উভয়ের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত হয়। সুতরাং গণতন্ত্র এসেছে উন্নয়নের পর এবং বৃটেনের উন্নয়নে এর কোন ভূমিকা ছিল না।

উন্নত বিশ্বকে অনুসরণ করে বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক বেশী পরিমাণে জনগণকে ভোটার অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ করে দিয়েছে। অথচ গণতন্ত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে-এ ধারণা গ্রহণ করার আগে সতর্কতা অবলমম্বন করা উচিত।

চীন, রাশিয়া (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) এবং জার্মানী কার্যতই প্রমাণ করেছে যে, গণতন্ত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত নয়। রাশিয়া এবং চীন পশ্চিমা উদারপন্থী গণতন্ত্রকে অনুসরণ না করে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে গেছে। সেকারণে এখন প্রশ্ন করার সময় এসেছে, গণতন্ত্রের সাথে অর্থনৈতিক অগ্রগতির আদৌ কি কোন সম্পর্ক আছে?

অর্থনৈতিক অগ্রগতি বলতে একটি দেশের নিজস্ব স্বার্থে জনগণকে সাথে নিয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে শিল্পোন্নত হওয়াকে বুঝায়। এর জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার যা পুরো দেশকে একটি লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাবে। আর না হয় তা হবে দ্বান্দ্বিক। ব্রিটেনের মূল প্রণোদনা আসে গীর্জার আধিপত্য খর্ব করে উদার মূল্যবোধ গ্রহণ করার মাধ্যমে। মূলত: এর ভিত্তিতে তারা একত্রিতও হয়েছিল। অভিজাত শ্রেনী কর্তৃক সম্পদ ও ভূমির মালিক হবার সুযোগ লাভ এবং এর মাধ্যমে ঔপনিবেশিকতার গতিপথ নির্ধারনের ক্ষমতা তাদের উন্নতি সুনিশ্চিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন জারদের ব্যর্থতা থেকে প্রণোদনা লাভ করে এবং পরবর্তীতে সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে একত্রিত হয়। পরবর্তীতে তাদের অর্থনীতিবিদেরা সমাজতান্ত্রিক জীবনদর্শন থেকে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করে। মার্কিনীরা ব্রিটেনের কাছ থেকে মুক্ত হবার পর একত্রিত হয়ে কাজ শুরু করে। আর জাপানীরা যখন বুঝতে পারল তারা উন্নত বিশ্বব্যবস্থা থেকে কতটা পিছিয়ে আছে, তখনই অর্থনীতিকে উন্নত করার যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ল। চীন একমাত্র দেশ-যার উন্নয়ন কেবলমাত্র আদর্শিক নয়। তবে সেদেশের নীতি নির্ধারকরা জনগণের ভেতর চীনারা একটি মহান জাতি এ চেতনাবোধ জাগ্রত করতে সমর্থ হয়েছে। জার্মানীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। এমনকি তারা বর্ণবাদকে উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করে।

প্রকৃত প্রস্তাবে গণতন্ত্র উন্নয়নের জন্য কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। সেকারণে উপরে উল্লেখিত দেশসমূহ কখনই জনগণের রায়ের জন্য অপেক্ষমান থাকেনি। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক খুবই দুর্বল। বর্তমানে যারা গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে তারা গণতান্ত্রিক হয়েছে উন্নত হবার পর। আর চীন প্রমাণ করে উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র কোন বিষয়ই নয়।