বুধবার, ২ মে, ২০১২

খিলাফত প্রতিষ্ঠায় মুসলিম সেনাবাহিনীর ভূমিকা পর্ব-৩

পূর্ব প্রকাশের পরঃ

খিলাফাহ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ

সতর্ক পরিকল্পনা ও সাহসী বাস্তবায়ন:
নুসরাহ্ একটি ইসলামিক দায়িত্ব। এটি ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য একটি অবশ্যকরণীয় কর্তব্য। কেউ যদি তার সামর্থ্য থাকার পরও এ দায়িত্ব পালন না করে তবে এটি বড় গুনাহের কাজ। ইসলাম ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিদের দু’টি দায়িত্ব দিয়েছে। যার একটি আরেকটি হতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রথমত, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যা নাযিল করেছেন তা দিয়ে যারা শাসন করেনা সেসব শাসকদের কাছ থেকে তারা ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কেড়ে নিবেন। দ্বিতীয়ত, যে বা যারা ইসলামী খিলাফতের জন্য কাজ করছে এ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তাদের কাছে হস্তান্তর করবেন।

আর এ দু’টি দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে নুসরাহর কর্তব্য সম্পাদিত হয় এবং যে ব্যক্তি এ দুটি কাজ সম্পাদন করবে তাকে বলা হবে ‘আনসারুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ্’র সাহায্যকারী। তাদের মর্যাদা মদিনার আনসারদের মর্যাদার সমান। এভাবে একবার খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তাদের মর্যাদা ও সম্মান হবে সা’দ ইবনে মুয়ায (রা.), সা’দ ইবনে উবাদা (রা.), আসাদ ইবনে জুরারাহ (রা.) ও উসায়েদ ইবনে হুজায়ের (রা.) এর মত, যারা রাসূল (সাঃ) কে প্রথম খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সাহায্য করেছিলেন।

আজকে পশ্চিমাদের জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়নকারী মুসলিম বিশ্বের বর্তমান যালেম শাসকদের অপসারণ করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষমতা গ্রহণ এবং তা খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত দলের কাছে হস্তান্তর করার জন্য প্রয়োজন একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা। এর জন্য প্রয়োজন অপরিসীম সাহস এবং বাস্তবায়ন করার জন্য ইসলাম অনুসারে বৈধ নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ। তাছাড়া ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিদের মাঝে যারা নুসরাহ্ প্রদান করতে চায় তাদের সাথে খিলাফতের প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত দলের একটি সুসংগঠিত সহযোগীতার পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। সর্বোপরি নুসরাহ্ গ্রহণের জন্য যাবতীয় শারী’আহ্ সিদ্ধ প্রাথমিক কার্যাবলী সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। আর এসবের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ইচ্ছা ও অনুগ্রহে প্রতিষ্ঠিত হবে নবুয়্যতের আদলে খিলাফত। ইনশা’আল্লাহ্।

আর তাই এদু’টি কাজ, পরিকল্পনা এবং দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন আমাদেরকে রাসূল (সাঃ) এর সময়ে একই কাজে তাঁর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রাসূল (সাঃ) এর মাঝে আমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। আর রাসূল (সাঃ) এর পদ্ধতির অনুসরণই আমাদের জন্য একমাত্র গ্রহণযোগ্য কর্মপন্থা। রাসূল (সাঃ) এর হিজরতের ঘটনা এ’কাজের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। কারণ হিজরতের মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) মদিনায় প্রথম ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজকে সম্পন্ন করেছেন। এটা কোন সাধারণ সফর নয়। এটা ছিল আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার একটি হুকুম। এটা ছিল মদিনায় গিয়ে ইসলাম বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেয়া। এটা ছিল ইসলামকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করে এর ভিত্তিতে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আর তাই মক্কার কাফেররা এটা হওয়া থেকে রাসূল (সাঃ) কে বিরত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে। তারা রাসূল (সাঃ) কে হত্যা করতে চেয়েছে। যাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আর তাই হিজরত আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ হতে রাসূল (সাঃ) ও ইসলামের প্রতি এক চূড়ান্ত বিজয়। আর এ কাজে জড়িত থাকার জন্য মদিনার লোকদেরকে আনসার বলা হয়। তারা সাহায্য করেছেন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কে, সাহায্য করেছেন রাসূল (সাঃ) কে, সাহায্য করেছেন ইসলামকে।

রাসূল (সাঃ) হিজরতের মাধ্যমে মদিনায় গিয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার পুরো কৌশল পূর্ণাঙ্গরূপে পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের জন্য তাঁর সমস্ত সহায়-সম্বল এতে ব্যবহার করেছেন। আর পুরো কাজের সফলতার জন্য তিনি পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার উপর নির্ভর করেছেন। তিনি ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ হতে আশু সাহায্যের উপর এতটুকুও দ্বিধান্বিত ছিলেন না। আর আজকের দিনে খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজে নুসরাহ্’র বিষয়টি যখন অনিশ্চিত, তখন রাসূল (সাঃ) এর উদাহরণ আমাদের জন্য অনুকরণীয়।

সিরাতে বর্ণিত আছে যে, জিব্রাঈল (আ) রাসূল (সাঃ) এর কাছে ওহী নিয়ে এসে মক্কার কুরাইশদের ষড়যন্ত্র ও রাসূল (সাঃ) কে হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করেন।। জিব্রাঈল (আ.) রাসূল (সাঃ) কে মক্কা ত্যাগের ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আদেশ অবহিত করেন এবং বলেন যে, “আপনি যে বিছানায় রাতে ঘুমান, সেখানে আজ ঘুমাবেন না।” অতঃপর মক্কার নিয়মানুযায়ী সবাই যখন দিনের প্রচন্ড তাপের সময় নিজগৃহে বিশ্রাম নেয় তখন রাসূল (সাঃ) আবু বকর (রা.) এর কাছে গিয়ে তাকে হিজরতের ব্যাপারে জানান এবং তাদের যাত্রার ব্যাপারে আলোচনা সেরে নেন। অতঃপর নিজ গৃহে ফিরে তিনি রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকেন। অন্যদিকে সন্ত্রাসী কুরাইশ নেতারা, যারা রাসূল (সাঃ) কে হত্যা করে তাঁর পবিত্র রক্ত বিভিন্ন গ্রোত্রের মাঝেবন্টন করার হীন চক্রান্ত করেছিল তারা বিভিন্ন গোত্র হতে ১১ জনকে বাছাই করে রাতের প্র ম ভাগে রাসূল (সাঃ) এর বাসার কাছে জড়ো করে, যাতে করে রাসূল (সাঃ) যখন ঘুমিয়ে পড়বেন তখন তারা যেন রাসূল (সাঃ) কে হত্যা করার হীন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারে। রাসূল (সাঃ) আলী (রা.)-কে তাঁর গৃহে ঘুমানোর জন্য নির্দেশ দেন এবং তাঁকে একটি সবুজ হাদরামী কম্বল দিয়ে তাঁর মুখ ঢেকে রাখার পরামর্শ দেন। রাসূল (সাঃ) আলী (রা.) কে বলেন যে, তাঁর উপর কোন ধরনের বিপদ আসবে না। রাসূল (সাঃ) রাতের বেলায় কয়েক মুঠো বালি কাফেরদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সূরা ইয়াসিনের ৯ নং আয়াত পড়তে পড়তে তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সাহায্যে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। যখন অন্য একজন ব্যক্তি তাদেরকে বললেন যে, রাসূল (সাঃ) ইতোমধ্যেই গৃহ ত্যাগ করেছেন, তখন তারা তা বিশ্বাস করেনি। পরবর্তীতে তারা দেখল যে, রাসূল (সাঃ) এর পরিবর্তে আলী (রা.) তাঁর বিছানায় শুয়ে আছেন। অন্যদিকে রাসূল (সাঃ) প্রথমে আবু বকর (রা.) এর গৃহে যান এবং আবু বকর (রা.) সহ তিনি দেয়ালের মধ্যবর্তী ফাঁকা দিয়ে বের হয়ে পড়েন, যাতে করে কেউ তাঁদেরকে চিনতে না পারে। তাছাড়া তাঁরা মদিনার উল্টো পথে চলতে থেকে ইয়েমেনের পথের দিকে অগ্রসর হয়ে মক্কা হতে ৫ মাইল দূরের থাওর গুহার কাছে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা তিন রাত পাহাড়ের গুহায় অবস্থান করেন। এটি ছিল পর্বতের উপরের অংশে এবং এর রাস্তা ছিল কংকরযুক্ত ও খাড়াভাবে উপরের দিকে উঠা। রাসূল (সাঃ) এর পরিকল্পনা ছিল যে, মক্কার কাফেররা তাঁকে খোঁজার জন্য উত্তর দিকে মদিনার পথে অগ্রসর হবে। আর তাই তিনি অগ্রসর হয়েছেন দক্ষিণ দিকে ইয়েমেনের পথে। রাসূল (সাঃ) এ যাত্রা শুরু করেন ২৭শে সফর।

আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রা.) রাতে এসে তাঁদের সাথে অবস্থান করতেন এবং ভোরের দিকে মক্কায় ফিরে আসতেন। তিনি তাঁদেরকে মক্কার কুরাইশ নেতাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করতেন। আবু বকর (রা.)’র দাস আমের ইবনে ফুহাইরা (রা.) গভীর রাতে এসে বিভিন্ন প্রকার খাবার সরবরাহ করতেন ও আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রা.)’র পায়ের চিহ্ন মুছে দিতেন।

কুরাইশরা যখন বুঝতে পারল যে, রাসূল (সাঃ) মক্কা ত্যাগ করেছেন, তখন তারা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আলী (রা.) কে আটক করে কাবা’র কাছে নিয়ে তাঁকে অত্যাচার শুরু করে। কিন্তু আলী (রা.)’র কাছ থেকে তারা কোন তথ্য না পেয়ে আবু বকর (রা.)’র বাসায় গিয়ে আসমা (রা.) কে পেয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা শুরু করে। তাঁর কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে আবু জাহেল (তার উপর আল্লাহ্’র লানত) আসমা (রা.) কে মুখের উপর থাপ্পড় দিয়ে রাগে বের হয়ে আসে। পরবর্তীতে তারা এক জরুরী বৈঠক ডেকে রাসূল (সাঃ) ও আবু বকর (রা.) কে ধরার সমস্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাঁর মক্কা হতে মদিনা যাবার সকল রাস্তায় তাদের গোয়েন্দা নিয়োগ করে এবং রাসূল (সাঃ) ও আবু বকর (রা.) এর পবিত্র মস্তকের উপর ১০০ উটের পুরষ্কার ঘোষণা করে। ফলে মক্কার বিভিন্ন গোত্রের সামর্থবানরা পুরস্কারের আশায় রাসূল (সাঃ) কে ধরতে বের হয়ে পড়ল। তারা এমনকি রাসূল (সাঃ) এর অবস্থিত গুহার পথে এসে উপস্থিত হয়। তারা এক পর্যায়ে গুহার এমন কাছে এসে উপস্থিত হল যে, আবু বকর (রা.) বললেন, “তারা যদি তাদের পায়ের দিকে তাকায় তবে তারা আমাদেরকে দেখতে পাবে।” রাসূল (সাঃ) তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, “আপনি এই দুই ব্যক্তি ছাড়া তৃতীয়, আল্লাহ্’র ব্যাপারে কি বলবেন?” এ ব্যাপারে সূরা আত-তওবার ৪০ নং আয়াত নাযিল হয়।

আর এভাবেই মক্কার কুরাইশদের মিশন ব্যর্থ হয়ে পড়ে। যখন কুরাইশদের নজরদারি কমতে শুরু করে তখন রাসূল (সাঃ) মদিনা যাবার প্রস্ততি শুরু করেন। রাসূল (সাঃ) যাত্রা পথে তাঁকে সহায়তার জন্য পথ সম্পর্কে অভিজ্ঞ আব্দুল্লাহ ইবনে উরাইকা আল-লুথির সাথে ইতোমধ্যেই কথা বলে নিয়েছিলেন। তিনি যদিও তার পূর্বপুরুষের ধর্ম তখনও বিশ্বাস করতেন, তবুও সে ছিল এ কাজে দক্ষ ও বিশ্বস্ত। কথা মত সে তিন দিন পর এসে উপস্থিত হলে রাসূল (সাঃ) রবি-উল আউয়াল মাসের প্রথম তারিখ রাতে আমের ইবনে ফুহাইরা (রা.) সহ রওনা হলেন।

তারা প্রথমে আরো দক্ষিণ দিকে ইয়েমেনের দিকে রওনা হন। তারপর সমুদ্রের পাশ দিয়ে এগিয়ে এমন স্থানে এসে উপস্থিত হন যা সম্পর্কে কুরাইশদের কোন ধারণা নেই। অতঃপর তারা লোহিত সাগরের পাশ ঘেঁষে উত্তরের দিকে যাত্রা করেন। অবশেষে তারা রবিউল আউয়াল মাসের ৮ম তারিখে মদিনার কুবা নামক স্থানে এসে উপস্থিত হন। মদিনার মুসলিমরা রাসূল (সাঃ) হিজরতের খবর পেয়ে আল-হারার দিকে এসে প্রত্যেকদিন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। এভাবে তাদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। রাসূল (সাঃ) মদিনায় এসে উপস্থিত হন। এমন সময় এক অপেক্ষারত ইহুদী বাড়ীর ছাদ থেকে বলে উঠল, “হে আরবের লোকেরা! এইতো আসছে সেই ব্যাক্তি যার জন্য তোমরা অপেক্ষা করছিলে।” মুসলিমরা তাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিল এবং সবাই আনন্দে তাকবির দিতে থাকল। মদিনার সকল লোকেরা রাসূল (সাঃ) কে স্বাগত জানানোর জন্য তাদের ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। এটা ছিল মদিনার জন্য, ইসলামের জন্য এক স্মরণীয় দিন। হিজরতের এই প্রক্রিয়ায় রাসূল (সাঃ) থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।

প্রথমত, পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনা ও কৌশল অবলম্বন:
রাসূল (সাঃ) হিজরতের এই পরিকল্পনা নিজে গ্রহণ করেন। তিনি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যাবতীয় বিষয় নিজে তদারকি করেন। রাসূল (সাঃ) এর পরিকল্পনার ধরণ থেকে বুঝা যায় যে, পুরো বিষয়টিই ছিল বিচক্ষণতা ও কৌশল গত। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা রাসূল (সাঃ) কে হিজরতের নির্দেশ দেন আর রাসূল (সাঃ) নিজে এ জন্য পুরো পরিকল্পনা তৈরী এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বস্তুগত সম্বল সংগ্রহ করেন। এর মাধ্যমে তিনি হিজরত পুরো সফলতার সাথে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। আর তাই আজকে যারা খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজকে সম্পনন্ন করার জন্য আনসারদের মত নুসরাহ্ প্রদান করবেন তাদেরকে অবশ্যই একটি পুর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তৈরী করতে হবে। আর এর জন্য যাবতীয় বস্তুগত সহায়-সম্বল ও কৌশল গ্রহণ এবং সাহসের সাথে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। মদিনায় হিজরত করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজকে সম্পন্ন করার জন্য রাসূল (সাঃ) কর্তৃক গৃহীত পরিকল্পনার ধাপসমূহকে নিচে উল্লেখ করা হল:

১. রাসূল (সাঃ) তাঁর বিছানায় আলী (রা.) কে ঘুমানোর জন্য ব্যবস্থা করেন।

২. রাসূল (সাঃ) তাঁর গৃহ থেকে রাতের অন্ধকারে আবু বকর (রা.)-এর বাসায় গমন করেন। এর মাধ্যমে তিনি (সাঃ) আরবরা তাঁকে খুঁজে পাবার সম্ভাবনাকে হ্রাস করেছেন।

৩. তাঁরা দু’জনেই আবু বকরের (রা.) গৃহ ত্যাগ করেছেন বাসার দরজার পরিবর্তে দেয়ালের মধ্যবর্তী ফাঁকা দিয়ে। এর মাধ্যমে কুরাইশরা যেন তাঁদেরকে খুঁজে পেতে না পারে বা তাঁদের পেছন নিতে না পারে তা নিশ্চিত করেছেন।

৪. তাঁরা মদিনায় যাবার জন্য সচরাচর যে পথ ব্যবহার করা হয় তা ত্যাগ করে উল্টোদিকে ইয়েমেনের পথের দিকে এগিয়েছেন।

৫. তাঁরা থুর গুহায় তিন দিন অপেক্ষা করেছেন যাতে করে রাসূল (সাঃ) কে খুঁজে পাবার তৎপরতা কুরাইশদের মাঝে কমে যাবে তখন মদিনার পথে যাত্রা করতে পারেন।

৬. আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রা.) রাতের বেলায় এসে কুরাইশদের পরিকল্পনা তাঁদেরকে অবহিত করতেন। এর মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) কুরাইশদের তৎপরতা সর্ম্পকে অবহিত থাকতেন।

৭. তাঁদের যাত্রার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) এর মাধ্যমে।

৮. আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রা.)’র রাতের বেলায় আসা যাবার পদচিহ্ন মুঁছে ফেলার জন্য আমের ইবনে ফুহাইরা (রা.) কে ব্যবহার করা হয়েছে।

৯. ইবনে উরাইকা নামের একজন বিশ্বস্ত ও দক্ষ লোককে তাঁদের গাইড নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ঐশ্বরিক সাহায্য:
হিজরতের পুরো প্রক্রিয়ায় রাসূল (সাঃ) আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কর্তৃক সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছেন। পবিত্র কুরআন ও সহীহ্ হাদীসে এ বিষয়ে বর্ণনা পাওয়া যায়। এসব ঘটনা হতে আমরা আমাদের সময়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠার সময় সাহায্য পেতে পারি। ইমাম আহমেদ থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) হিজরতের সময় যে পর্বতের গুহায় তিন দিন আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে কুরাইশদের লোকজন গিয়ে উপস্থিত হয়। এমন সময় আবু বকর (রা.) রাসূল (সাঃ) কে বলেন, “হে আল্লাহ্’র রাসূল (সাঃ), তারা আমাদেরকে খুঁজে পেয়ে যাবে।” রাসূল (সাঃ) বলেন, “না, তারা আমাদের খুঁজে পাবেনা। কারণ জিব্র্ঈাল (আ.) তাঁর পাখা দিয়ে আমাদেরকে ঘিরে রেখেছে।” লোকটি গুহার দিকে ফিরে বসে পড়ল। রাসূল (সাঃ) বললেন, “যদি সে আমাদেরকে চিহ্নিত করে ফেলে, তবে তা সে পারবেনা।” সহীহ বুখারী থেকে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি (রা.) বলেন, “হে আল্লাহ্’র রাসূল (সাঃ) তারা যদি তাদের মাথা নিচু করে তবে তারা আমাদেরকে দেখতে পাবে।” রাসূল (সাঃ) বললেন, “শান্ত হও আবু বকর! আমরা দু’জন আর তৃতীয়জন হল আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা।” সুতরাং, এ ঘটনা হতে এটা প্রমাণিত যে, রাসূল (সাঃ)-এর সকল মানবীয় ক্ষমতা, পরিকল্পনা ও বিচার-বিশ্লেষণের পরও, কাফেররা আল্লাহ্’র রাসূল (সাঃ) এর কাছে এসে পৌঁছে যায়। এতে তাদের দৃঢ় সংকল্প এবং ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য রাসূল (সাঃ) কে হত্যা করার ব্যপারে তাদের বিরামহীন পরিকল্পনার সুষ্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। আর এই পরিস্থিতিতে রাসূল (সাঃ) আল্লাহ্’র উপর পূর্ণ আস্থা ও আল্লাহ্’র পক্ষ হতে রাসূল (সাঃ)-কে সাহায্য করার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠে।

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, “যদি তোমরা তাঁকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখ, আল্লাহ্ তাঁর সাহায্য করেছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দু’জনের একজন। যখন তাঁরা গুহার মধ্যে ছিলেন, তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন, বিষন্ন হয়োনা, আল্লাহ্ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ্ তাঁর প্রতি স্বীয় শান্তনা নাযিল করলেন এবং তাঁর সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখনি। বস্তুতঃ, আল্লাহ্ কাফেরদের মাথা নিচু করে দিলেন, আর আল্লাহ্’র কথাই সদা সমনত এবং আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা তওবা : ৪০]

আজকে যারা আল্লাহ্’র পৃথিবীতে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম করছে এবং যাদের নুসরাহ্ দেবার মত সামর্থ্য ও মন মানসিকতা আছে তাদের জন্য এ আয়াতের অর্থ বুঝা গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ্’র বান্দা হিসাবে আল্লাহ্ ও তাঁর দ্বীনের প্রতি নুসরাহ্ দেয়ার অর্থ হল পূর্ণাঙ্গ ও সার্বিকভাবে দ্বীন ইসলামকে সমর্থন করা এবং আল্লাহ্’র পক্ষ হতে তাঁর বান্দার প্রতি নুসরাহ্ হল তাকে সাহায্য করে ইসলামকে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করা। আজকে যদি বিশ্বাসীদের ভিতর থেকে ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিবর্গ এবং ইসলামের দাওয়াত বহণকারী মানুষদের একটা বড় অংশ দ্ব্যার্থহীনভাবে তাদের সকল প্রচেষ্টা দ্বারা এই কাজে আত্মনিয়োগ করতো তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে নুসরাহ্ খুবই সন্নিকটে এবং এতে কোন প্রকার দ্বিধার অবকাশ নেই; কারণ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলেন,

“নিশ্চয়ই আমি বিজয়ী করবো আমার নবীদেরকে এবং তাদেরকে যারা ঈমানদার এই দুনিয়ার জীবনে এবং ঐ দিন যখন সবাই স্বাক্ষ্য দিবে (কেয়ামত দিবসে)।” [সূরা আল-গাফির : ৫১]

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলার হস্তক্ষেপ ও সাহায্য নিশ্চিতভাবেই আসবে যদিও আমরা তার প্রকৃতি ও ধরন সম্পর্কে অজ্ঞ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন