শুক্রবার, ৪ মে, ২০১২

আমাদের নিরবতা কি অপরাধ নয়?

বর্তমান সমাজের যে অবস্থা তাকে কোনোভাবে সুস্থ অবস্থা বলা চলে না। প্রতিদিনের পত্রিকায় যে পরিমাণ নির্যাতন, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাস্তানি, দুর্নীতি, প্রতারণা, কেলেঙ্কারী ইত্যাদির খবর প্রকাশিত হয় তা আমাদের সমাজের মারাত্মক অধঃপতনের চিত্র তুলে ধরে। যদিওবা বিভিন্ন ব্যক্তি এসব ঘটনার সাথে জড়িত, তথাপি এগুলো শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পর্যায়ের কিছু বিচ্ছিন ঘটনামাত্র নয়। এগুলো এখন ব্যাপকতর পরিসরে ঘটমান দৈনন্দিন ঘটনা।

মানব ইতিহাসের শুরু থেকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষের সামনে সবসময় দুটি পথ খোলা রেখেছেন-একটি হল, সত্য বা আলোর পথ। আরেকটি হল, বাতিল বা অন্ধকারের পথ। অর্থাৎ একটি আল্লাহ, তার নবী-রাসুল, আল্লাহর ওহী, আখিরাত-হাশর, জান্নাত-জাহান্নাম বিশ্বাসের পথ আর অন্যটি হচ্ছে অবিশ্বাস, কুফর ও হারামের পথ। সৃষ্টির প্রাম্ভিক কাল থেকে ঈমান আর কুফরের এক চিরন্তন দন্ধ ও সংঘাত চলে আসছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

এবং আমি তাকে (মানুষকে) দুটো পথ (ভাল-মন্দ) দেখিয়েছি” [সূরা আল-বালদঃ ১০]

সমাজের প্রতি ফরয দায়িত্বকে অবহেলা করে শুধু মাত্র ব্যক্তিগতভাবে নামাজ রোজা করে আমরা মুক্তির আশা করতে পারি না। যখন সমাজে ব্যাপক বিশৃংখলা আর জুলুম তখন কিভাবে আমরা শুধুমাত্র নিজের জীবন যাপন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারি? রাসুল (সাঃ) এর উপর যদি আমাদের ভালবাসা থেকে থাকে, আর তাঁর আদর্শ যদি আমরা অনুসরণ করে থাকি তাহলে এই জাহেল সমাজ পরিবর্তন করা সম্ভব।

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন ,

তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন তার হাত দ্বারা তা প্রতিহত করে। তার এই সামর্থ্য না থাকলে সে যেন তার মুখ দ্বারা তা প্রতিহত করে। তার এই সামর্থ্যও না থাকলে সে যেন তার অন্তর দ্বারা তা প্রতিহত করে (ঘৃণার মাধ্যমে), আর এটা হলো দূর্বলতম ঈমান।” (মুসলিম, তিরমিযী)

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আরো বলেন:

যারা আল্লাহ হুকুম মেনে চলে আর যারা সেগুলোকে নিজেদের প্রবৃত্তির খেয়ালে লঙ্ঘন করে, (উভয়ে) যেন তাদের মতো যারা একই জাহাজে আরোহণ করে। তাদের একাংশ জাহাজের উপরের তলায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে এবং অন্যরা এর নিচের তলায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। যখন নিচের লোকদের পিপাসা মেটানোর প্রয়োজন হয় তখন তাদেরকে জাহাজের উপরের অংশের লোকদের অতিক্রম করে যেতে হয়। (তাই) তারা (নিচতলার লোকেরা) নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে নিল, ও আমরা যদি জাহাজের নিচের দিকে একটা ফুটো করে নিই তাহলে জাহাজের উপরের তলার লোকদের কোন সমস্যা করবো না।এখন যদি উপরের তলার লোকেরা নিচতলার লোকদেরকে এ কাজ করতে দেয় তবে নিশ্চিতভাবেই তারা সবাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আর তারা যদি তাদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখে, (তবে) তারা (উপরতলা) রক্ষা পাবে এবং এভাবে (জাহাজের) সবাই রক্ষা পাবে।” (বুখারী)

তাই কেউ ব্যক্তিগত ইবাদত ঠিকমতো চালিয়ে গেলো আর সমাজে যেসব অব্যবস্থাপনা চলছে সে ব্যাপারে কিছু করলো না বা বলল না তখন সেটা  কোন ইসলামী চিন্তাবলে গ্রহণ যোগ্য হবে না । উপরোক্ত হাদীসদ্বয় থেকে এটা পরিষ্কারভাবে অনুধাবন হয়, যে সমাজে যখন জুলুম, অনাচার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন ঐ সমাজে বসবাসরত মুসলমানদের জন্য ঐ সমাজের পরিবর্তন করার জন্য কাজ করা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। আর এ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে না আসলে সবাই একসাথে শাস্তিযোগ্য হবে। হযরত আবু বকর (রা.) বলেনআমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি :

মানুষ কোন অত্যাচারীকে অত্যাচার করতে দেখেও তার দুই হাত চেপে ধরে তাকে প্রতিহত না করলে অচিরেই আল্লাহ্ তাআলা তাদের সকলকে (অর্থাৎ অত্যাচারী ও যারা অত্যাচার মেনে নেয় উভয়কে) তাঁর ব্যাপক আযাবে নিক্ষেপ করবেন।” (তিরমিযী)

আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর পবিত্র সীরাতের দিকে তাকাই তাহলে দেখব তিনি এমন একটি সমাজে এসেছিলেন যা ছিলো পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন, সব ধরণের অন্যায়, অত্যাচার, অনাচারে পরিপূর্ণ। ঐ সমাজের লোকেরা মিথ্যা ইলাহদের পূজা করতো, ওজনে কম দিতো, এতিম ও দাসদের অধিকার বঞ্চিত করতো, কথায় কথায় যুদ্ধ আর হানা-হানিতে মেতে উঠতো ইত্যাদি। এমনি এক পরিস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের সাথে নিয়ে ঐ সমাজকে পরিবর্তনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং সমাজের এসব অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বলে সমাজকে ইসলামের দিকে জোরালোভাবে আহ্বান করেন। তিনি কেবল ব্যক্তিদেরকে সংশোধনে ব্যস্ত থাকেননি বরং পুরো সমাজদেহটাকেই সুস্থ করার লক্ষ্যে সমাজের সব প্রচলিত মিথ্যা ধ্যান ধারণা ও অনাচারের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন। আজকের বর্তমান সমাজ আর ততকালীন মক্কার কুফর সমাজের মধ্য কোন তফাৎ নেই ।

কারণ আমাদের বর্তমান সমস্যার মূল বা প্রকৃত কারণ হচ্ছে মানব রচিত কুফর জীবন ব্যবস্থা-যেখানে টাকা, ব্যক্তি স্বার্থ হচ্ছে মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এই ধরণের জীবন ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবেই এমন সমাজের জন্ম দেয় যেখানে অপরাধ ও দুর্নীতি হয় ব্যাপক ও নিয়ন্ত্রণহীন।

আর এ চিন্তার দ্বারার মূলভিত্তি হচ্ছে মানব রচিত পুঁজিবাদী মতবাদ অর্থাৎ ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে ফেলা। তারা এই পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থাকে মুসলিম জাতিসত্তার ভেতর প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর। এসবের মূল উদ্দেশ্য একটাই আর তা হলো পশ্চিমা কুফর শক্তি যাতে নিশ্চিত থাকতে পারে যে মুসলমানরা সর্বদাই অত্যচার আর নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট হয় এবং কখনোই যাতে মনশ্চক্ষে ইসলামী পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখতে না পায়। পশ্চিমা কুফর শক্তি এও নিশ্চিত করতে চায় যে মুসলমানরা যাতে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নিজেদের আলাদা রাখে। এসবের কারণ হলো পশ্চিমারা ভালো করেই জানে যে একমাত্র রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং ইসলামভিত্তিক রাজনীতি ছাড়া পশ্চিমা রাজনৈতিক চিন্তা ও শাসন ব্যবস্থাকে উৎখাত করার আর কোন উপায় নেই। এই প্রচারাভিযান আজ এ পর্যায় পর্যন্ত পৌছে গেছে যেখানে দেখানো হচ্ছে রাজনীতি হলো ইসলামের মহানত্ব ও পারলৌকিকতার সম্পূর্ণ বিরোধী। কিন্তু আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এটা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন যে আমরা যাতে রাজনীতির সাথে সংযুক্ত থাকি এবং শাসককে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করি। শাসকবর্গকে সৎকাজের আদেশ দেয়া এবং তাদের মন্দ কাজের প্রতিবাদ করা রাজনীতির প্রধান অংশ।

আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন,

তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, তোমরা সৎ কাজে আদেশ করবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে।” [সূরা আলি ইমরান: ১১০]


রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার জন্য।

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন,

অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সত্য কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ। (তিরমিযী)

শহীদদের সর্দার হামযা এবং ঐ ব্যক্তিও, সে অত্যাচারী শাসকের সামনে দাড়িয়ে উপদেশ দেওয়ার পর (ঐ শাসক) তাকে হত্যা করে ফেলে।” (হাকিম)

তিনি (সাঃ) আরো বলেন,

যদি তুমি দেখ যে আমার উম্মত কোন জালেমকে একথা বলতে ভয় পাচ্ছে যে, ‘তুমি একজন জালেমতাহলে আমার উম্মতকে বিদায়” [অর্থাৎ এটা উম্মতের জন্য বিদায় বা পতনের সংকেত] (আহমাদ, তাবারানী, হাকিম, রায়হাকী)

বর্তমান কুফর সমাজে ইসলামী রাষ্ট্রের মাধ্যমে ইসলামকে আবার ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে রাসূলুলাহ্ (সাঃ) এর অনুসরণে রাজনীতি করা আমাদের জন্য ওয়াজিব। আসলে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ সর্বযুগে সর্ব পরিস্থিতিতে একটি ওয়াজিব বিষয় এবং ব্যাপক অর্থে এটাই ইসলামী রাজনীতি। তাই ইসলামের আর সব অবশ্য পালনীয় বিষয়ের মতো এ বিষয়টিকেও আমাদের পালন করতে হবে এবং সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনীতিতে যোগ দিতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন