শনিবার, ৫ মে, ২০১২

ইসলামী রাষ্ট্র - ইসলামী খিলাফতের পূনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধা

[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রবাহিনী ইসলামী খিলাফতের সকল ভূখন্ড দখল করে নিয়েছিল। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চিরতরে ইসলামী খিলাফত ধ্বংস করে দেয়া এবং এটি নিশ্চিত করা যেন আর কখনোই ইসলামী রাষ্ট্র মাথা তুলে দাড়াতে না পারে। ইসলামী রাষ্ট্র ধ্বংস করে দেয়ার পর তারা নিশ্চিত করল যাতে পূনরায় এর কোন ভূখন্ডে যাতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে। ইসলামী রাষ্ট্র যাতে আর কখনোই প্রত্যাবর্তিত হতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা ও পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল এবং এ লক্ষ্যে তারা এখনো কাজ করে যাচ্ছে।

একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম ভূখন্ড অধিকারের প্রথম দিন থেকেই অবিশ্বাসী ঔপনিবেশিক শক্তি মুসলিম বিশ্বে তাদের মুঠি শক্ত করছিল। ১৯১৮ সালে তারা উসমানী খিলাফতের অন্তর্গত বেশ কিছূ ভূখন্ড দখল করে নিয়েছিল এবং ১৯২২ সাল নাগাদ সেসব স্থানে সামরিক আইন বলবৎ করেছিল। তারা বাধ্যতামূলক শাসন বা স্বায়ত্ত্ব শাসনের মাধ্যমে তাদের দখলদারিত্ব শক্ত করার দিকে মনযোগ দিয়েছিল। অবশেষে এল ১৯২৪ সাল। এ বছর শত্রুপক্ষ বিশেষত বৃটেন, ইসলামী রাষ্ট্রের পুনর্জাগরণের পক্ষে যে কোন প্রকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আন্দোলন দমন করতে বহু পদক্ষেপ নিয়েছিল।

এ বছর মুস্তাফা কামাল ঔপনিবেশিক অবিশ্বাসী শক্তির চাপে উসমানী খিলাফত ব্যবস্থা অবলুপ্ত করে তুরস্ককে একটি ‘গণতান্ত্রিক’ প্রজাতান্ত্রিক (রিপাবলিক) রাষ্ট্রে পরিণত করল। এভাবে সে খিলাফত ধ্বংস করল এবং খিলাফত পুনরাবির্ভাবের অবশিষ্ট ক্ষীণ আশাটিও তিরোহিত হয়ে গেল। একই বছর আল হুসাইন বিন আলীকে হিজাজ থেকে বহিষ্কার করা হল এবং যেহেতু তিনি খিলাফতের প্রতি লক্ষ্য করছিলেন, ফলে তাকে সাইপ্রাসে বন্দী করা হল। একই বছর বৃটিশরা তাদের ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে নিয়ে কায়রোতে অনুষ্ঠিতব্য খিলাফাহ কনফারেন্সের আয়োজন স্থগিত করে এ প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিল। আবার ঐ একই বছর বৃটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে দানা বেঁধে ওঠা খিলাফাহ আন্দোলন দমন করতে সচেষ্ট হল। তারা এ আন্দোলনের লক্ষ্যচ্যূত হওয়া নিশ্চিত করল এবং আন্দোলনটিকে জাতীয়তাবাদী ও গোত্রীয় আন্দোলনে পরিণত করল। ঐ একই বছর ঔপনিবেশিক অবিশ্বাসীদের চাপে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আলেমগণ রাষ্ট্র থেকে দ্বীন পৃথক করার আহ্বান সম্বলিত কিছু প্রবন্ধ রচনা করল। তারা এসব প্রবন্ধে দাবী করল ইসলামে রাষ্ট্র পরিচালনা বা বিচারকার্যের জন্য কোন মূলনীতি নেই, এতে এরূপ কোন শিক্ষাও নেই এবং ইসলাম শুধুমাত্র একটি থিওলজিকাল ধর্ম। এ বছর ও তার পরবর্তী বছর, কিছু কূট-তার্কিক আরব রাষ্ট্রগুলোতে দুটি বিষয়ে ক্রমাগত বিতর্কের অবতারণা করে সকলের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করল। এ দুটি বিষয় হচ্ছে, দুটি লীগের মধ্যে কোনটি উত্তম ‘আরব লীগ’ না ‘ইসলামী লীগ’? পত্রপত্রিকা ম্যগাজিন সমূহ এই বিষয়ের প্রতিই সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে লাগল যদিও বা এ দুটি লীগের ধারণার বিপজ্জনক কুফল ছিল এবং এরা উভয়ের অস্তিত্বই ইসলামী রাষ্ট্র পুন:প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ছিল মূর্তিমান প্রতিবন্ধতা। অবিশ্বাসী ঔপনিবেশিকরা প্রকৃত বিষয় অর্থাৎ ইসলামী খিলাফত থেকে নজর সরাবার জন্যই এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছিল। এই পদক্ষেপ সমূহ মুসলিম ভূখন্ডের জনগণের মনোযোগ খিলাফত ও ইসলামী রাষ্ট্র হতে অন্যত্র সরাবার জন্যই নেয়া হয়েছিল।

তাদের দখলদারিত্ব ছাড়াও ঔপনিবেশিক শক্তি তুর্কী তরুণদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের শ্লোগান ছড়িয়ে দিতে শুরু করল। তারা দাবী করল তুরস্কের উপর বিদেশীদের (অ-তুর্কীয়)  বিষয়গুলো বোঝার মত চেপে আছে। এটিই হচ্ছে উপযুক্ত সময় যখন তুরস্কের উচিৎ ঐ সব লোকদের ভার নিজেদের উপর ছেড়ে দেয়া। রাজনৈতিক দলগুলোও তুর্কী জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কাজ করতে লাগল এবং অ-তুর্কী রাষ্ট্র গুলো থেকে তুরস্কের স্বাধীনতা দাবী করল। অবিশ্বাসীরা একই ধরণের ধারণা আরব তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিল এবং তাদের মাঝে আরব জাতীয়তাবাদ উস্কে দিল। তারা তুরস্ককে একটি দখলদার বাহিনী হিসাবে আখ্যা দিয়ে আরবদের তাদের হাত থেকে মুক্ত হবার দাবী তুলল। অনুরূপভাবে রাজনৈতিক দলগুলোও আরবদের মাঝে ঐক্য ও আরব স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার হল।  তারা শীঘ্রই ইসলামী ধ্যান ধারণায় যে শুন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে স্থান করে নিল। ফলত: তুর্কীরা জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে তাদের স্বাধীনতা লাভ করল এবং আরবরা জাতীয়তাবাদী ভৌগলিক অবস্থানের ভিত্তিতে স্বায়ত্ত শাসনের জন্য কাজ করতে লাগল। জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের ধারণা খুব দ্রুত সমগ্র মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল এবং তারা একসময় এ বিষয়গুলো নিয়ে গর্ব করতে শুরু করল।

ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এখানেই থেমে থাকেনি। বরং তারা ইসলাম ও ইসলামী শাসন সম্পর্কেও ভ্রান্তিমূলক ধারণা ছড়িয়ে দিতে শুরু করল। তারা খিলাফত কে পোপ ও যাজকীয় শাসন হিসাবে চিহ্ণিত করতে লাগল। এটি এমন এক অবস্থায় পৌঁছাল যখন মুসলিমরা খিলাফত ধারণাটি প্রকাশ করতে বা শব্দটি উচ্চারণ করতেই বিব্রতবোধ করতে লাগল। এসময় মুসলিমদের মাঝে অধিকাংশেরই একটি ধারণা জন্মাল যে খিলাফত শব্দটির উচ্চারণ একটি পশ্চাৎপদ বিষয় ও কূপমন্ডুকতা। কাজেই এটি কোন শিক্ষিত মানুষের উচ্চারণ করা শোভা পায়না।

এমনই তীব্র এক জাতীয়তাবাদী অনুভূতির মাঝে অবিশ্বাসীরা (কাফিররা) ইসলামী রাষ্ট্রকে অকার্যকর করেছিল। এটিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত করে স্থানীয় অধিবাসীদের এ বিভক্তি জোরদার করার ব্যাপারে উৎসাহিত করছিল। উসমানী খিলাফত রাষ্ট্র ছোট ছোট কতগুলো রাষ্ট্রে পরিণত হল। এরা হচ্ছে তুরস্ক, মিশর, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, পূর্ব জর্দান, হিজাজ, নজদ এবং ইয়েমেন। এ সকল অঞ্চলের ষড়যন্ত্রকারী কিংবা সদিচ্ছা সম্পন্ন উভয় রাজনীতিবিদগণ প্রতিটি রাষ্ট্রে তাদের স্বাধীনতা দাবী করে কনফারেন্স করতে লাগল। এগুলো ছিল অবিশ্বাসীদের নির্ধারন করে দেয়া পরস্পর বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতার দাবী। এরই ভিত্তিতে তুরস্ক, ইরাক, মিশর, সিরিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য একটি জাতীয় মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি পরবর্তীতে একটি স্বাধীন পরিচয় প্রাপ্ত হয়। এটি ছিল অবিশ্বাসীদের সৃষ্ট মুসলিম বিশ্বে প্রবেশের একটি রাজনৈতিক সেতুমুখ। এর মাধ্যমে অবিশ্বাসী ঔপনিবেশিকরা তাদের অর্থাৎ ফ্রান্স, বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে মুসলিমদের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দিতে সক্ষম হল। এটি আজো খিলাফত পূন:প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বিশাল প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে। এই ভৌগলিক অবস্থান ও সাধারণ দৃশ্যপট এ জন্য সৃষ্টি করা হয় যেন মুসলিমরা কখনোই নিজেদের প্রকৃতার্থে স্বাধীন করতে না পারে।

অবিশ্বাসীরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ এবং সরকারী ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হল। তারা তাদের প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থায় পশ্চিমা আইন চালু করল। তারা তাদের সংস্কৃতি ও জীবন সম্পর্কিত ধারনা ছড়িয়ে দিতে লাগল এবং প্রবলভাবে জীবন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করতে লাগল। ফলে মুসলিমরা পশ্চিমা জীবন পদ্ধতি গ্রহণ করল এবং তা অনুসরণ করতে লাগল। তারা তাদের এ প্রচেষ্টায় সফল হল। তারা মিশরকে সালতানাতে পরিণত করল এবং সংসদীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করল। তারা ইরাকেও একটি সংসদীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করল। সিরিয়া ও লেবাননকে প্রজাতন্ত্র (রিপাবলিক) এবং পূর্ব জর্দানকে একটি আমিরাত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল এবং ফিলিস্তিনকে বাধ্যতামূলক এমন এক শাসনের অধীনস্থ করা হল যা পরবর্তীতে একটি ইহুদী সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল। ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট অংশ পূর্ব জর্দানের সাথে যুক্ত করে একটি সংসদীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হল। হিজাজ এবং ইয়েমেনে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা হল এবং তুরস্কে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা হল। আফগানিস্তানে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল। ঔপনিবেশিক কাফিররা (অবিশ্বাসীরা) ইরানে তার সাম্রাজ্য ব্যবস্থা বজায় রাখতে উৎসাহিত করল এবং ভারতে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখল। পরবর্তীতে ভারত ভেঙ্গে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ঔপনিবেশিক অবিশ্বাসীরা মুসলিমদের উপর তাদের ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে সক্ষম হল এবং এর মাধ্যমে খিলাফত পূণঃপ্রতিষ্ঠার ধারণাটি ধীরে ধীরে জনগণের মন থেকে মুছে ফেলা হল।

এছাড়াও, প্রতিটি স্থানীয় সম্প্রদায়কে অবিশ্বাসীদের ব্যবস্থা আকড়ে ধরতে উৎসাহিত করা হল। তারা মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র সমূহ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কাজ করতে লাগল। এভাবে একজন ইরাকী মিশরে এসে হয়ে গেল একজন বিদেশী। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জনকদের চাইতে এসকল ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের শাসকবৃন্দ পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষায় বেশী আগ্রহী হয়ে উঠল। তারা হয়ে গেল ঔপনিবেশিক কাফিরদের প্রতিনিধি, তাদের দেয়া ব্যবস্থার দেখাশোনা করা ও তা সংরক্ষণ করাই হয়ে উঠল তাদের প্রধান কাজ।

ঔপনিবেশিক কাফির শক্তি মুসলিম ভূখন্ডগুলোতে প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিমা আইন কানুন প্রয়োগ করতে লাগল। অতীতে তারা এসকল আইন মুসলিম বিশ্বে তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে করা চেষ্টা করেছিল। অবিশ্বাসীরা ১৯শ শতকের প্রথমভাগে পশ্চিমা আইন বাস্তবায়নের চেষ্টা নিয়েছিল। তারা মিশরের জনগণকে ফরাসী দেওয়ানী আইন প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করতে লাগল, যাতে করে তারা শরীয়াহ আইনকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে। এ বিষয়ে সফল হবার পর তারা ১৮৮৩ সালে মিশরে ফরাসী বিচার ব্যবস্থা চালু করতে শুরু করল। পুরনো ফরাসী দেওয়ানী আইনগুলো অনুবাদ করে কার্যকর করা হল। এটি হল মিশরের নতুন ব্যবস্থা যা আদালত থেকে শরীয়াহকে প্রতিস্থাপিত করল। উসমানী খিলাফত রাষ্ট্রে ১৮৫৬ সালে পশ্চিমা আইন প্রবেশ করবার লক্ষ্যে একই ধরণের একটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। অবশ্য এ কাজটি মিশরের মত সহজে হলনা, কারণ খিলাফত ব্যবস্থার ভিত্তি তখনো উসমানী রাষ্ট্রগুলোতে ছিল।

অবিশ্বাসীদের ক্রমাগত প্রচেষ্টার ফলে এবং তাদের দোসরদের সহযোগিতায় ফৌজদারী আইন ও নব্য অনৈসলামিক বিধি ও বানিজ্যিক আইন প্রবর্তন করতে সক্ষম হল। এটি করা হয়েছিল একটি ফতোয়ার মাধ্যমে যেখানে বলা হয়েছিল এধরনের কুফর আইন ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। আইন লিপিবদ্ধকরণের ধারণাটি শিকড় বিস্তার করতে শুরু করে এবং  আল মাজাল্লা Code আইন হিসাবে গ্রহণ করে। আল মাজাল্লা হচ্ছে ১৮৬৮ সালে জারিকৃত বিধি যা বহু মাজহাবের দুর্বল মতানুসারে আইন হিসাবে গৃহীত হয় যেখানে পারিপার্শ্বিকতা যুক্তিগ্রাহ্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। আল মাজাল্লাকে আইন হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হল। আদালত ব্যবস্থাকে দুটি ভাগে ভাগ করা হ’ল, ১. শরীয়াহ আদালত যেখানে শরীয়াহ আইন অনুসরণ করা হবে, এবং ২. দেওয়ানী আদালত যা প্রথমত পশ্চিমা আইন দ্বারা পরিচালিত হবে, যে পশ্চিমা আইনগুলো আবার একটি ফতোয়ার মাধ্যমে বৈধ করা হবে এবং দ্বিতীয়ত শরীয়াহ আইন, যেগুলো পশ্চিমা প্রক্রিয়ার অনুকরণে আইন হিসাবে গৃহীত হবে। এ সব পদক্ষেপ ছিল আইনের ক্ষেত্রে। অনুরূপভাবে সংবিধানের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের জন্য নতুন একটি সংবিধান রচনার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হল। এক্ষেত্রে ফরাসী সংবিধানকে উৎস হিসাবে গ্রহণ করা হল। এ প্রচেষ্টাটি নতুন আইন প্রবর্তনের পদক্ষেপ গুলোর সাথে জুড়ে দেয়া হল। ১৮৭৮ সালে এ পদক্ষেপ প্রায় সফল হতে চলেছিল কিন্তু মুসলিমদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়। অবশ্য ঔপনিবেশিক অবিশ্বাসীদের অব্যহত প্রচেষ্টায় এবং তাদের সহযোগী ও তাদের সংস্কৃতিতে মুগ্ধ হওয়া ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় তারা পূনরায় নতুন সংবিধান রচনার আন্দোলনটি শুরু করল এবং এবার তাতে সফল হল। ১৯০৮ সালে এ সংবিধান ও তার নতুন আইন বাস্তবায়িত হল। আরব ব-দ্বীপ ও আফগানিস্তান ছাড়া প্রতিটি মুসলিম ভূখন্ড সরাসরি পশ্চিমা আইন দ্বারা পরিচালিত হতে থাকল। এভাবে শরীয়াহ আইনকে বর্জন করা হল যার অর্থ হচ্ছে কুফর শাসন বলবৎ হল ও ইসলামী শাসন বর্জিত হল।

মুসলিমদের উপর কুফর শাসনকে শক্তিশালী করার পেছনে যে বিষয়টি কাজ করেছে তা হচ্ছে ঔপনিবেশিকদের চাতুর্যের সাথে গৃহীত ইসলামী রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার পদক্ষেপটি। তারা মুসলিমদের জন্য একটি নতুন শিক্ষা কার্যক্রম পরিকল্পনা করেছিল। এ শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যসূচীর মূল লক্ষ্য ছিল প্রতিটি শিক্ষার্থীকে এক একটি পশ্চিমা ব্যক্তিত্বে পরিণত করা। অর্থাৎ এমন এক ব্যক্তিত্বে পরিণত করা যার জীবনের প্রতি থাকবে পুঁজিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী। এ কার্যক্রম এখন পর্যন্ত সকল মুসলিম ভূখন্ড এবং এমন কি তাদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও কার্যকর রয়েছে। যার ফলে আমরা বহু শিক্ষক পাই যারা এ শিক্ষা কার্যক্রমকে রক্ষা করতে ব্যস্ত। তারা প্রভাবশালী পদগুলো গ্রহণ করে এবং কাফিরদের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করে। শিক্ষা নীতিটি মূলত দুটি মূলনীতির ভিত্তিতে তৈরী করা হয়েছিল।

প্রথম মূলনীতিটি হচ্ছে, শাসন কার্য থেকে দ্বীনকে পৃথক করে দেয়া যার পরিণতিতে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্র থেকে দ্বীনকে পৃথক হবে। এ পদক্ষেপটি আরো একটি বিষয় নিশ্চিত করে, তা হচ্ছে তরুণ মুসলিমরা ভবিষ্যতে ইসলামী রাষ্ট্র পূন:প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করবেনা। কারণ এটি (ইসলামী রাষ্ট্র পূন:প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই), সে যে শিক্ষা লাভ করেছে তার মৌলিক বিষয়ের সাথেই সাংঘর্ষিক।

দ্বিতীয় মূলনীতি হচ্ছে ঔপনিবেশিক কাফিরদের ব্যক্তিত্বকে তরুণ মুসলিমদের জন্য অনুকরণীয় করা। এটি তাদের মনকে কুফর সংস্কৃতি ও তথ্য দ্বারা পূর্ণ করে রাখতে সহায়ক হবে। এ ধরণের পদক্ষেপ কাফিরদের প্রতি সম্মান জানাতে শেখাবে। এটি তাকে, ঔপনিবেশিক কাফির হওয়া সত্ত্বেও তাদের মহিমামন্ডিত করতে, অনুকরণ করতে ও বন্ধু হতে উদ্বুদ্ধ করবে। এটি তাদের মুসলিমদের অশ্রদ্ধা ও হেয় করতে শেখাবে এবং তাদের থেকে দুরে থাকতে সাহায্য করবে। এ ধরণের অনুভূতি তাদের পক্ষ থেকে কিছু শিখতে বা গ্রহণ করতে নিরূৎসাহিত করবে এবং স্বাভাবিকভাবেই ইসলামী রাষ্ট্র পূন:প্রতিষ্ঠার লড়াই থেকে দুরে ঠেলে দেবে।

ঔপনিবেশিকরা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের পরিকল্পিত ও নিবিড় তত্ত্বাবধানে প্রণীত স্কুলের পাঠ্যসূচীই যথেষ্ট নয়। তারা আরো অগ্রসর হয়ে ঔপনিবেশিক মূলনীতির উপর ভিত্তি করে মিশনারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করল। এর সাথে যোগ হল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সমূহ যাদের প্রধান কাজ ছিল বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক ধারণা ছড়িয়ে দেয়া। ফলাফল স্বরূপ এধরণের শিক্ষা কেন্দ্রসমূহের শিক্ষার পরিবেশ উম্মাহকে এমন এক সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করে তুলল যা তাদের ইসলামী রাষ্ট্র পূন:প্রতিষ্ঠার চিন্তা হতে দুরে সরিয়ে দিল এবং একাজে নিয়োজিত হওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল।

জীবন থেকে দ্বীনকে পৃথক করার ধারণাটি বুদ্ধিজীবিদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। সমাজের বাকীদের নিকট এটিকে প্রচার করা হল এভাবে যে এটি হচ্ছে রাজনীতি কিংবা দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজগুলো থেকে ধর্মের পৃথকীকরণ। ফলাফল স্বরূপ কিছু বুদ্ধিজীবি দাবী করল যে মুসলিমদের অবনতির কারণ হচ্ছে দ্বীনের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা এবং জাতীয়তাবাদই হচ্ছে পূনর্জাগরণের একমাত্র পথ। অন্য একদল বুদ্ধিজীবির মতে মুসলিমদের অধ:পতনের জন্য তাদের নৈতিক অবক্ষয় দায়ী। প্রথম দলের ধারণা অনুযায়ী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল গঠিত হল এবং দাবী করা হল তাদের ইসলামী ভিত্তি রয়েছে। এটি আসলে ছিল ঔপনিবেশিকদের একটি চাল মাত্র। অপরদিকে নৈতিকতার ভিত্তিতে বেশ কিছু দল গঠিত হ’ল যারা ধর্ম প্রচার করা ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা নিয়ে ব্যস্ত থাকল। এরা স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের নৈতিকতার উৎকর্ষতা নিয়ে কাজ করতে লাগল কিন্তু রাজনীতিতে জড়ানো থেকে বিরত থাকল। এ ধরণের দলগুলোই ইসলামী রাষ্ট্র পূণর্প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কার্যকর ভূমিকা রাখল। তারা মুসলিমদের মনকে অন্যত্র সরিয়ে দিল। এছাড়াও এ দলগুলো তৈরী করা হয়েছিল ঔপনিবেশিক ভিত্তির উপর দাড় করিয়ে যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।  এবং একারণেই তারা ইসলামী রাষ্ট্রের পূণ:প্রতিষ্ঠায় সবসময় বাঁধা সৃষ্টি করে এসেছে।

গৃহীত নতুন রাজনৈতিক কার্যক্রম রক্ষা করতে নতুন নতুন আইন পাশ করা হতে লাগল। কিছু আইন করা হল যার মাধ্যমে ইসলামী দল গঠন ও আন্দোলন নিষিদ্ধ করা হল। আর কিছু আইন ও উপধারা তৈরী করা হল যেখানে দলগুলোর উপর তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হল এবং বলা হল তাদের দলের সদস্যপদ কোন বিশেষ ধর্মাবলম্বী বা গোত্রের জন্য সীমাবদ্ধ রাখতে পারবেনা। এর অর্থ হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র পূনর্জন্মের জন্য মুসলিম ভূখন্ডে ইসলামী দল গঠন আইনের পরিপন্থী। মুসলিমদের দাতব্য সংস্থা ও অনুরূপ সংগঠন ছাড়া আর কোন দল গঠনের অধিকার থাকল না। ইসলামের ভিত্তিতে রাজনীতি করা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হল। কোন কোন আইন করে বলা হল ইসলামী দল গঠন হচ্ছে মারাত্মক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিধিমালার অধীনে মুসলিম বিশ্বে যে রাজনৈতিক কার্যক্রম গৃহীত হল তার মূল লক্ষ্য হল ইসলামী রাষ্ট্রের (খিলাফত) পূণর্গঠনকে প্রতিহত করা।

ঔপনিবেশিকরা এখানেই থেমে থাকল না। বরং তারা ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তা থেকে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখার লক্ষ্যে মুসলিমদের ক্ষুদ্র ও গুরুত্বহীন বিষয়ে ব্যস্ত করে রাখল। তারা এমন ইসলামী কনফারেন্স আয়োজন করতে উৎসাহিত করতে লাগল যা প্রকৃত কাজ অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে ইসলামী জীবন যাপন করার আহ্বান থেকে মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে রাখে। এধরণের কনফারেন্স মুসলিমদের হতাশা ও ইসলামী আবেগকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার একটি নিরাপদ রাস্তা হিসাবে কাজ করতে লাগল। এসকল কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত হবে, পত্র পত্রিকায় ছাপা হবে, রেডিও টিভিতে প্রচারিত হবে, কিন্তু কখনোই তা বাস্তবায়িত হবেনা।

লেখক ও বক্তাদের উৎসাহিত করা হল ইসলামী রাষ্ট্রকে (খিলাফত) একটি হুমকি হিসাবে জনসমক্ষে প্রচার করার জন্য। তারা এ ধারণা প্রচার করতে লাগল যে ইসলামে কোন বিচার ব্যবস্থা নেই। ভাড়া করা মুসলিমদের দিয়ে ঔপনিবেশিকদের এ সকল মতবাদ সম্বলিত বহু বই পুস্তক, প্রবন্ধ, রচনা লেখা হল। এর লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের আরো বিপথগামী করা এবং তাদের দ্বীন থেকে আরো দুরে সরিয়ে দেয়া এবং দ্বীন অনুযায়ী ইসলামী জীবন যাপন করার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কাজ করা থেকে বিরত রাখা।

ইসলামী রাষ্ট্রকে (খিলাফত) ধ্বংস করার পর থেকে ঔপনিবেশিকরা ইসলামী রাষ্ট্র পূণর্গঠনের প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে এবং করছে। তারা পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামী রাষ্ট্র ধ্বংস করে দেয়ার পর এর পূন:প্রতিষ্ঠার সকল প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার জন্য তাদের প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত করেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন