শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১২

খিলাফত শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ ও রূপরেখাঃ অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা

একমাত্র খিলাফত শাসন ব্যবস্থাই পারে অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা করতে।

১. ভূমিকা

সুশীল সমাজে ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার সম্পর্কে একটি আলোচনা-সমালোচনা বিরাজমান। উপরন্তু এই বিষয়টি সম্পের্কে বিভিন্ন মহলে একটি অস্পষ্ট ধারণা বিদ্যমান। এ প্রেক্ষাপটে খিলাফত রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি আলোচনা করা জরুরী।

২. বাস্তবতা

বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এখানে রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ইত্যাদি সম্প্রদায়ের বাস। একটি রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সাথে অন্যান্য সম্প্রদায়ের নাগরিকদের সম্পর্কের বিষয়টি কখনও কখনও নেতিবাচকভাবে আলোচিত হয়। অনেকে ধারণা করেন বাংলাদেশের মুসলমানদের সাথে অমুসলিমদের কোন সম্প্রীতির সম্পর্ক বিরাজমান নেই। উপরন্তু এখানে অমুসলিমদের বিভিন্ন অধিকার সুরক্ষিত কিনা সন্দেহ পোষণ করা হয়। মুসলিমদের দ্বারা প্রায়ই বিভিন্ন সময় অমুসলিমদের উপর হত্যাযজ্ঞ ও লুণ্ঠন চালানোর অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, এখানে মুসলিম কর্তৃক অমুসলিমদেরকে তাদের পৈতৃক বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনাও ঘটে হরহামেশাই। প্রায়ই বাংলাদেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকে জোর করে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় বলেও প্রচার করা হয়। এর কারণ হিসাবে ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করা এবং উদ্ভুত ধর্মীয় মৌলবাদকে চিহ্নিত করা হয়।

২০০৩ সালে ১৩ মে জেনেভায় জাতিসংঘের অফিসে এক সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধি সিতাংশু গুহ বাংলাদেশে অমুসলিমদের উপর সংঘটিত ঘটনাবলীকে ‘নীরব গণহত্যা’র সাথে তুলনা করেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরো একটি গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে সেনাবাহিনীতে অমুসলিমদের নিয়োগকে অনুৎসাহিত করা ও সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদ অর্জনের পথে তাদেরকে বিভিন্নভাবে বাধা দেয়া হয়।

৩. উপরোক্ত দাবীসমূহের অসারতা

প্রকৃতপক্ষে একটু গভীর ভাবে উপলব্ধি করলেই উপরোক্ত অভিযোগগুলোর পিছনের আসল উদ্দেশ্যটি বুঝা য়ায়। বর্তমানে ধর্ম নিরপেক্ষ পূঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইসলাম ছাড়া আর কোন শক্তিশালী প্রতিপক্ষই অবশিষ্ট নেই। তাই যেকোন উপায়ে ইসলামের উপর আঘাত করে মুসলমান ও ইসলামের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি এবং ইসলামকে দূর্বল করার সব রকমের প্রচেষ্টা চালানো হয়। আসলে যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনা যেনতেন উপায়ে ইসলামের উপর চাপিয়ে দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে বিরূপ একটি ধারণা তৈরী করা বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার একটি কৌশল। সেই কৌশলের অংশ হিসাবেইে বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে অমুসলিদের অধিকার হরণকারী উগ্র এবং ইসলামকে অসহিষ্ণু ধর্ম হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। আর এদেশের মুসলামাদেররকে চিত্রিত করা হয় গোঁড়া সাম্প্রদায়িক হিসাবে। এজন্য বিভিন্ন সময় পরিচিত অপরিচিত নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন থাকলে যে কেউ বুঝতে পারবে এখানে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ একেবারে শূণ্যের কোঠায়। শুধুমাত্র অমুসলিমরা নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরাও এখানে গড়পড়তাভাবে জুলুমের শিকার হয়। এবং সংখ্যাধিক্যের জন্য মুসলমানদের উপর সংঘটিত অত্যাচারের সামষ্টিক পরিমাণ অন্য যে কোন সম্প্রদায়ের উপর সংঘঠিত অত্যাচারের তুলনায় বহুগুণ বেশী। এদেশে হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের ধর্মমতে জন্য নয় বরং একটি তথাকথিত পূঁজিবাদি সেক্যুলার রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্যজনক নাগরিক হওয়ার কারণেই সেই রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকের মতই অত্যাচারের শিকার হয়। বস্তুতপক্ষে সেক্যুলার রাষ্ট্রের মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিকই তাদের অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত হয়। বরং এ বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিকূল তৎপরতা ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের স্থাপিত বিভিন্ন উষ্কানীমূলক দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও এখানকার মুসলমানরা শুধুমাত্র ইসলামী মূল্যবোধের কারণেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় বদ্ধপরিকর। এছাড়াও উল্লেখ্য যে, বর্তমানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টকরা ও অমুসলিমদের অধিকার হরণের যত কারণই উল্লেখ করা হোক না কেন তার জন্য কিছুতেই ইসলামকে দায়ী করা যায় না। কারণ বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা হচ্ছে পূঁজিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এ রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যর্থতার দায় ইসলামের উপর আরোপ করা কখনোই যৌক্তিক হতে পারে না। ‘যত দোষ নন্দঘোষ’- এ নীতিতে যেকোন অপকর্মের দায় ইসলামের উপর চাপানো আসলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেকে টিকিয়ে রাখার মানসে বুদ্ধিবৃত্তিক শূণ্যতা থেকে উৎসারিত একটি অপচেষ্টারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে এ ধরণের রাষ্ট্রব্যবস্থা গুটিকয়েক অত্যাচারী শাসক ব্যতিত মুসলিম-অমুসলিম কারো অধিকারই সংরক্ষণ করতে পারে না।

৪. প্রকৃত কারণ

বাংলাদেশের মুসলমানদের উপর আরোপিত উপরোক্ত অভিযোগগুলো গুরুতর তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এর প্রকৃত কারণসমূহ কি তা তেমন স্পষ্টভাবে কখনোই আলোচিত হয়নি। নিম্নে এর প্রধান দুটি কারণ আলোচিত হলঃ

৪.১. আওয়ামী বিএনপির বিভক্তির রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- একে অন্যকে প্রতিপক্ষ হিসাবে মনে করে। এক দল অন্য দলকে ঘায়েল করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার সব ধরণের কৌশল ব্যবহার করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের অমুসলিম সম্প্রদায় সবসময় এ দুটি দলের রেষারেষি ও ফায়দা লুটার অসুস্থ রাজনীতির শিকার। বিশেষ করে ভোটের রাজনীতিতে অমুসলিম নাগরিকদের অবস্থাকে এমনভাবে চিহ্নিত করা হয় যেন কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী অবস্থান ছাড়া বাংলাদেশে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই অসম্ভব । অপর পক্ষে অন্য দলটিকে অমুসলিমদের প্রতিপক্ষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এ জন্য দেখা যায় বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা থেকে এসব ঘটনার শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে নজর না দিয়ে এগুলোকে আরো বিস্তৃত করার চেষ্টা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এ দুটি রাজনৈতিক দলের বিভক্তির রাজনীতি বাংলাদেশে অমুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমানদের সাথে তাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সবচেয়ে বড় বাধা। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিভক্তির রাজনীতি টিকিয়ে রেখে এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষন করা প্রায় অসম্ভব।

৪.২. সাম্রাজ্যবাদীদের ইসলাম বিরোধী প্রচারণা

সমাজতন্ত্রের পতনের পর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ পূঁজিবাদী শক্তি নতুন প্রতিদ্বন্দ্বি পরাশক্তি হিসেবে ইসলামের আগমনের ভয়ে ভীত। তাই সবসময় তারা ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে। মুসলিম-অমুসলিমদের মধ্যে উস্কানী দিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। এভাবে তাদেরকে দূর্বল করে শাসন ও শোষণ করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, মতাদর্শিক রাষ্ট্র হিসেবে খিলাফত রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরে বসবাসকারী প্রত্যেক ধর্মমতের অনুসারীদের শান্তিপূর্ণ সহবস্থান নিশ্চিত করার সর্বত্মক ব্যবস্থা করে। অতীতেও এর প্রমাণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশরা আসার আগ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তারা এসে “ডিভাইড এন্ড রুল” নীতিতে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি নষ্ট করে। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে ভারত ইঙ্গ-মার্কিন গোষ্ঠী মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী সব অপ্রীতিকর ঘটনায় প্রকাশ্যে ও গোপনে ইন্ধন যোগাচ্ছে। বাংলাদেশও তাদের এই ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত নয়। কারণ বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাবের সম্ভাবনাকে তারা কখনোই সন্দেহের বাইরে রাখেনি। তাছাড়া আমাদের দেশের প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এখানে অস্থিরতা তৈরী করা একান্তই প্রয়োজন। আর হিন্দু মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা এই অস্থিরতা তৈরী করারই অংশ বিশেষ। পূঁজিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণের অধিকারসমূহের নিশ্চয়তা দেয়ার কোন যোগ্যতাই নেই।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য আমাদেরকে ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এ ব্যাপারে ইসলামের সুনির্দিষ্ট কতগুলো মূলনীতি রয়েছে। নিম্নে এই মূলনীতিগুলো আলোচনা করা হলঃ

৫. ইসলামের মূলনীতি

মূলত দু’টি প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় রেখে খিলাফত রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণের সর্বাত্মক ব্যবস্থা করা হবে।

ক) মতাদর্শিকঃ

ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্ম নয়, বরং এমন একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা যা জীবনের সব বাস্তব সমস্যার সমাধান দেয়। যেমন যে কোন সেক্যুলার পূঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে হিন্দু ধর্মসহ বিভিন্ন ধর্মের জনসমষ্টি বসবাস করে তেমনি খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও সব ধর্মের জনসমষ্টি বসবাস করতে পারে। বরং খিলাফত রাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ার লক্ষ্যেই তার নিজস্ব ভূখন্ডের সকল ধর্মমতের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেকে আভ্যন্তরীণভাবে দৃঢ় ও সংহত করবে। আল্লাহ্ (সুবাঃ) বলেন,

“তাছাড়া তোমরা পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। যদি তা কর, তবে তোমরা কাপুরুষ হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব চলে যাবে।” (আল-আনফালঃ ৪৬)

সুতরাং খিলাফত রাষ্ট্রের প্রভাব সমুন্নত রাখতে মুসলিম- অমুসলিম সম্প্রীতি তথা রাষ্ট্রের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা অপরিহার্য।

খ) মানবিকঃ

ইসলাম মানুষের প্রত্যেকটি সমস্যাকে মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে। মানুষের সাধ্যের অতিরিক্ত কোন বোঝা ইসলাম তাদের উপর চপিয়ে দেয় না। এটি কোন মানুষের মনগড়া ধর্ম নয়। বরং এ হচ্ছে মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহ্ (সুবাঃ) প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা কোন একক সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীর জন্য নয়। বরং এ হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য। ইসলামের শ্বাশত ও সার্বজনীন বাণী নিয়ে যাঁকে প্রেরণ করা হয়েছে, সেই সর্বশ্রেষ্ট ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ (সুবাঃ) বলেনঃ-

“আপনি বলুন; হে মানব মন্ডলী! আমি তোমাদের সকলের কাছে আল্লাহর প্রেরীত রাসূল। সমগ্র আসমান ও যমীনে যার রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনিই জীবন ও মৃত্যু দান করেন।” (সূরা আরাফ-১৫৮)

উপরোক্ত আয়াতটি গোটা মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র মুসলমাদের উদ্দেশ্যে নয়। খিলাফত রাষ্ট্রের বিধান প্রদানকারী সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দৃষ্টিতে বর্ণ, গোত্র, জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। তিনি ইরশাদ করেনঃ

“হে মানবগোষ্ঠী! আমি তোমাদেরকে একজন পরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক মুত্তাকী।” (সূরা হুজরাতঃ১৩)

বস্তুতঃ ইসলামের আগমনই হয়েছে মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা ও প্রবৃত্তিগুলো পূরণ করা তথা সকলের মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করার জন্য। ইসলাম এক্ষেত্রে মুসলিম অমুসলিমের কোন ভেদাভেদ নির্ণয় করেনি। খিলাফত রাষ্ট্র অমুসলিমদের যে অধিকারগুলো বিশেষভাবে বাস্তবায়ন করে তা হচ্ছেঃ

ü  খাদ্য-বস্তুর-বাসস্থানের অধিকার,
ü  রাজনৈতিক অধিকার,
ü  বিশ্বাসের অধিকার,
ü  সামরিক অধিকার
ü  জান-মালের নিরাপত্তা,
ü  বিচার প্রাপ্তির অধিকার,
ü  শিক্ষার অধিকার,
ü  অর্থনৈতিক অধিকার,
ü  নাগরিক ও সামাজিক অধিকার।

ইসলামী রাষ্ট্র খিলাফতের অধীনে বসবাসকারী প্রত্যেকটি নাগরিক এই সবগুলো অধিকার ভোগ করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে মুসলিম অমুসলিম নাগরিকগণের মধ্যে খিলাফত রাষ্ট্র কোনরূপ পার্থক্য করে না। নিম্নে খিলাফত রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণে বাস্তবায়িত ইসলামের মূলনীতিসমূহ আলোচিত হল।

৫.১. খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অধিকারঃ

খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে খিলাফত রাষ্ট্র মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিককে সমানভাবে বিচার করে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিকের এ তিনটি মৌলিক চাহিদা পূরণ খিলাফত রাষ্ট্রের উপর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এক্ষেত্রে ইসলাম সামগ্রিকভাবে মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিককে নিশ্চয়তা দেয়। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

“তিনটি বস্তু ছাড়া আদম সন্তানের আর কিছুর অধিকার নেই। তাহলোঃ বসবাসের জন্য একটি ঘর, দেহ ঢাকার জন্য কিছু বস্ত্র এবং কিছু রুটি ও পানি।”

এখানে ‘আদম সন্তান’ বলতে মুসলিম-অমুসলিম সকলকে বোঝানো হয়েছে। খলিফা ওমর (রাঃ) মিসরের গভর্ণর আমর ইবনুল আসকে (রাঃ) লেখা এক চিঠিতে বলেছেনঃ

“কসম আল্লাহর, আমার ভয় হয় তোমার শাসনাধীন এলাকার দূরতম কোণায় যদি একটি উট অবহেলায় মারা পড়ে তবে কিয়ামতের দিন আমাকে এরও জবাবদিহি করতে হবে।”

খিলাফত রাষ্ট্রের কর্ণধার খলিফা এভাবেই তার রাষ্ট্রসীমায় বসবাসকারী প্রত্যেক মানুষ নয় শুধু, বরং প্রত্যেকটি প্রাণীর চাহিদার ব্যাপারেও চিন্তা করেন। তাছাড়া অমুসলিম মুআহিদদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের বিষয়ে মুসলমানদের থাকবে বিশেষ ঈমানী দায়িত্ব। ইমাম কারখী (রহঃ) খিলাফত রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের প্রতি মুসলমানদের কর্তব্য সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেন, “তাদের দূর্বলদের সেবা দেওয়া, নিঃস্বদের যাবতীয় প্রয়োজন মিটানো, অনাহারিদের খাদ্য দেওয়া, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া, তাদেরকে সুন্দরভাবে সম্বোধন করা, এমনকি তাদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার ক্ষতির শিকার হলে প্রতিকার করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা মেনে নেওয়া হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মুসলমানদের উপর আরোপ করা দায়িত্ব।”

৫.২. রাজনৈতিক অধিকারঃ

খিলাফত রাষ্ট্রের একটি গুরুত্ব পূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে House of Represntatives বা মজলিসে সূরা। এটি খিলাফত রাষ্ট্রের একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনের সদস্যবৃন্দ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে খলিফাকে অবহিত করেন এবং এসমস্ত বিষয়ে খলিফাকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এজন্য একে বলা হয় পরামর্শ সভা বা মজলিসে সূরা। খলিফা যদি কোন বিষয় ইসলাম অনুসারে সমাধান না করে, তবে মজলিসের সূরার সদস্যরা এই বিষয়ে খলিফার কাছে কৈফিয়ত তলব করতে পারেন। অমুসলিমরাও এ সভার সদস্য হতে পারেন। এমনকি এর জন্য তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থি কোন শপথ করতে হয় না। এই রাজনৈতিক অধিকার লাভের মাধ্যমে তারা নিজেদের দাবী এবং প্রস্তাবসমূহ বিনা বাধায় খিলাফত সরকারের সামনে উপস্থাপন করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা কোন প্রকার রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হবে না।

৫.৩. ধর্মপালন বা বিশ্বাসের অধিকারঃ

ইসলামী রাষ্ট্র কখনও কোন অমুসলিমকে নিজের ধর্মপালনে বাধা দেয়না। কিংবা জোর করে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেনা। পবিত্র কুরআন এ ব্যাপারে পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছেঃ-

“দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জোর-যবরদস্তি নেই।” (আল-বাকারাঃ ২৫৬)

প্রত্যেকটি অমুসলিম নাগরিক সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত মনে নিজ নিজ উপসনালয়ে যাতায়াত করবে। কেউ তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারবে না। আবু উবায়দ (রহঃ) ‘কিতাবুল আমওয়াল’ নামক গ্রন্থে এমন কতিপয় অঞ্চলের নাম উল্লেখ করেছেন, যা খিলাফতের নিকট পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু সেখানের অধিবাসী অমুসলিমদেরকে তাদের ধর্ম পালন এবং উপাসনার পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অমুসলিমদের ধর্মীয় স্থাপনা বা উপসনালয়ের কোন ক্ষতিসাধন তো দূরের কথা বরং খিলাফত নিজ দায়িত্বে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। ইতিহাস স্বাক্ষী, খিলাফত যখন জেরুজালেম শাসন করছিল, তখন খৃষ্টানদের চার্চ এবং গির্জাগুলোকে খুবই ভালভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ গীর্জার সম্পূর্ণ রক্ষণাবেক্ষন করত একটি মুসলিম পরিবার। বংশানুক্রমে আজও সেই মুসলিম পরিবারটিই উক্ত গীর্জার চাবী সংরক্ষণ করছে এবং প্রতিদিন সকাল-বিকাল গীর্জাটি খুলছে ও বন্ধ করছে। খিলাফত সরকার বিনা কারণে অমুসলিমদের কোন উপাসনালয় বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিতে পারেনা। এমনকি সেখানে উপাসনাকারীদের উপর গোয়েন্দাগিরিও করতে পারেনা। যে অন্যায়টি বর্তমানে মুসলমানদের মসজিদ সম্পর্কে করছে মার্কিন এবং বৃটিশ শাসকরা।

স্যার থমাস তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন “আমাদের এমন কোন তথ্য জানা নেই যে, খিলাফত শাসন চলাকালীন ইসলামী কর্তৃপক্ষ কিংবা কোন সংগঠন কোন অমুসলিমকে জোর করে মুসলমান বানানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে কিংবা খৃীষ্টানদেরকে উত্যক্ত করার কোন পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।” তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “যদি এমনটি হতো- তাহলে রাজা ফার্ডিনেন্ড এবং রাণী ইসাবেলার নিষ্ঠুর পদক্ষেপের দরুণ যেমন স্পেন মুসলিম শূণ্য হয়ে পড়েছিল এবং সাড়ে তিন শত বছর যাবত বৃটেনে ইয়াহুদীদের কোন নিবাস ছিল না, তেমনি জেরুজালেমও খৃষ্টান ইয়াহুদী শূন্য হয়ে যেত।”

৫.৪. সামরিক অধিকার

শক্তিশালী মতাদর্শিক রাষ্ট্র হিসাবে খিলাফত রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী নিয়মিত সামরিক বাহিনী থাকবে। এর প্রত্যেক সদস্যকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিয়মিত বেতন দেয়া হবে। এই নিয়মিত বাহিনীতে মুসলিমরা যেমন অর্ন্তভুক্ত থাকবে তেমনি অমুসলিমরাও এর সদস্য হতে পারবেন। মুসলমানরা তাদের বিশ্বাসকে সমুন্নত রাখতে এবং অমুসলিমরা বেতন-ভূক্ত কর্মচারীর মর্যাদায় একটি লাভজনক পেশা হিসাবে এ বাহিনীর সদস্য হবেন। আল-জাহরির বর্ণনামতে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যুদ্ধে কিছু ইয়াহুদীর সাহায্য নিয়েছিলেন এবং তাদের জন্য রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে একটি অংশ নির্ধারণ করেছিলেন। ওহুদের যুদ্ধে অমুসলিম খোজমান মুসলমানদের সাথে অংশ গ্রহণ করে বনু আবু যর গোত্রের তিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে রাসূল (সাঃ) বলেন “নিশ্চই অমুসলিমদের দ্বারা আল্লাহ এই দ্বীনকে সাহায্য করেন।” মুশরিক থাকাকালীন সাফওয়ান আবু উমাইয়া মুসলমানদের সাথে খায়বার অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নির্ধারণ করে দেন। রাসূলূল্লাহ্ (সাঃ) অন্য এক হাদিসে বলেনঃ যার অর্থ নিম্মরূপ “যে নিজের জন্য যুদ্ধ করবে সে পুরষ্কার পাবে আর যে অন্য কারো জন্য যুদ্ধ করবে সে পাবে মজুরী।” অন্য হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “আমার উম্মতের যারা মজুরির বিনিময়ে যুদ্ধ করে শত্রুর বিরুদ্ধে নিজেদেরকে শক্তিশালী করে তারা মুসার মায়ের মত যে তার নিজের সন্তানকে দুগ্ধ পান করিয়ে পুরষ্কার (মজুরি) পেয়েছিল।” এখানে ‘যারা’ বলতে অমুসলিমদেরকে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং খিলাফত রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে অমুসলিমগণ নির্বিঘ্নে যোগদান করতে পারেন। তেমনিভাবে পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহীনিতেও অমুসলিমদের অন্তর্ভূক্তিতে কোন বাধা নেই। বরং খিলাফত রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকগণ এক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা ভোগ করেন; রাষ্ট্রকে সামরিকভাবে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে মুসলমানদের উপর বাধ্যবাধকতা থাকলেও অমুসলিমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। খলিফা অমুসলিম নাগরিকদেরকে সামরিক বাহিনীতে যোগদানে বাধ্য করতে পারে না।

৫.৫. জান-মালের নিরাপত্তাঃ

খিলাফত রাষ্ট্রে একজন মুসলমানের মতই একজন অমুসলিম মুআ‘হিদের জীবন পবিত্র ও সুরক্ষিত থাকে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেনঃ-

“যদি কোন ব্যক্তি কোন মু’আহিদকে হত্যা করে তবে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবেনা। যদিও চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকেই জান্নাতের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।” (বুখারী শরীফ)

তিনি আরো বলেন- সাবধান! কেউ যদি কোন মু’আহিদের প্রতি যুলুম করে কিংবা তার অধিকার হতে কিছু কমিয়ে দেয়, অথবা তার সাধ্যাতিত কোন কাজ তার উপর চাপিয়ে দেয়, বা তার স্বতস্ফূর্ত অনুমতি ছাড়া তার কোন সম্পদ নিয়ে নেয়- তাহলে আমি কিয়ামত দিবসে তার বিরুদ্ধে মামলা করব এবং সে মামলায় জিতব।” (আবু দাউদ)

রাসূল (সাঃ) এর যুগে এক মুসলিম ব্যক্তি অপর এক অমুসলিমকে হত্যা করলে বিচারে তিনি হত্যাকারী মুসলিম ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং তা কার্যকর করেন।

৫.৬. বিচার প্রাপ্তির অধিকারঃ

খিলাফত রাষ্ট্রে বিচার প্রাপ্তির অধিকার সবার জন্য সমান। খলীফা কিংবা তাঁর সরকারের যে কোন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও মুসলিম অমুসলিম যে কোন নাগরিক নির্দ্বিধায় বিচার প্রার্থী হতে পারে। বিচারক বাদী বিবাদীর মাঝে কে মুসলিম কে অমুসলিম কিংবা কে খলীফা কে সাধারণ নাগরিক এই বিবেচনায় বিচার কার্য পরিচালনা করেন না। বরং তার উপর ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে ন্যায়-ইনসাফের ভিত্তিতে বিচার করার। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ-

“যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার কার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কতই না উত্তম।” (সুরা নিসাঃ ৫৮)

অন্য আয়াতে ইয়াহুদীদের প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তাঁর রাসুলকে নির্দেশ দিয়েছেন এই বলে যেঃ

“যদি ফয়সালা করেন তবে ন্যায়ভাবে ফয়সালা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ্ সুবিচারকারীকে ভালবাসেন।” (মায়িদাঃ ৪২)

খিলাফতের ইতিহাসে এমন অনেক অবিস্মরনীয় বিচারের ঘটনা ঘটেছে যা একদিকে ন্যায়বিচারের ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ অন্যদিকে সর্বকালের অমুসলিমদের জন্য হয়ে আছে অনুপ্রেরণার উৎস। আলোচনা দীর্ঘ না করার স্বার্থে শুধুমাত্র একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি। সপ্তম শতাব্দির ঘটনা। তখন খিলাফতের মসনদ অলংকৃত করে আছেন মহাবীর হযরত আলী (রাঃ)। একজন ইয়াহুদী নাগরিক খলীফা আলীর (রাঃ) একটি ঢাল চুরি করলে বিষয়টি বিচারালয়ে উত্থাপিত হয়। তখন কাজী অর্থাৎ বিচারক খলীফাকে তার পক্ষে স্বাক্ষী উপস্থিত করতে বলেন। হযরত আলী তাঁর পুত্রকে স্বাক্ষী হিসাবে হাজির করেন। বিচারক মামলাটি খারিজ করে দেয় এই বলে যে, কোন পিতার পক্ষে পুত্রের স্বাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। ন্যায় বিচারের এই চমৎকারিত্য দেখে ইয়াহুদী লোকটি দারুণভাবে অভিভূত হয় এবং চুরির কথা স্বীকার করে নিজেই মুসলমান হয়ে যায়। এমন অনেক ঘটনা খোদ রাসূল (সাঃ) এর জীবনেও ঘটেছে। যেখানে অমুসলিমরা নিজেদের ধর্মীয় নেতার কাছে না গিয়ে মুকাদ্দমা নিয়ে ইসলামের আদালতে এসেছে এই আশায় যে এখানেই পাওয়া যাবে প্রকৃত ন্যায় বিচার। আমরা আশা করি, ইসলামের এই ইনসাফ ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা এদেশের অমুসলিমদেরকে আশ্বস্ত করবে এবং ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহকে তীব্র করবে। আর অপপ্রচারকারীদের চেহারাকে করবে মলিন।

৫.৭. শিক্ষার অধিকারঃ

একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ার লক্ষ্যে খিলাফত রাষ্ট্র তার নাগরিকদেরকে শিক্ষিত করে তুলবে। নাগরিকগণ তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী বিজ্ঞান, ব্যবসা, আইন, শিল্পকলার মত যেকোন শাখায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। খিলাফত রাষ্ট্রের শিক্ষা সম্পূর্ণ অবৈতনিক। শিক্ষা দান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করে না। শত শত বছর ধরে খিলাফত রাষ্ট্রে এমন শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়িত ছিল। এই শিক্ষাব্যবস্থার সুফল হিসেবে খিলাফত রাষ্ট্রে বিভিন্ন বিষয় হাজার হাজার বিশেষজ্ঞ তৈরী হয়েছিল। এদের মাঝে অমুসলিমদের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। স্পেন মুসলিমদের অধিকারে আসার পর খিলাফত রাষ্ট্র কর্ডোভার পন্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। শুধু তাই নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অমুসলিমরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য নিয়মিত খিলাফত রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত। রাসূল (সাঃ) বদরের যুদ্ধে বিভিন্ন রকম মুক্তিপণের বিনিময়ে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল একজন শিক্ষিত যুদ্ধবন্দির মুক্তিপণ হিসেবে দশজন মুসলিমকে শিক্ষাদান।

৫.৮.অর্থনৈতিক অধিকারঃ

খিলাফত রাষ্ট্রের অর্থনীতি খুবই সরল এবং নাগরিক বান্ধব। এ ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক সম্পদ তথা তেল গ্যাস কয়লা ইত্যাদি কোন কিছুই প্রাইভেট কোম্পানীকে দেওয়া হয়না। সরাসরি সরকারের তত্ত্বাবধানে রেখে এ খাত থেকে লব্ধ আয় জমা রাখা হয় সরকারী ট্রেজারী বা বাইতুল মালে। আর এর রাজস্ব ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র নাগরিকদের স্বার্থ সংলিষ্ট কাজে। আয় উৎপাদন কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রচলিত VAT এর মত অনাকাংখিত কোন কর দিতে হয়না। এ ক্ষেত্রে খিলাফত রাষ্ট্র মুসলমানদের তুলনায় অমুসলমানদের অনেক বেশী সুবিধা দিয়ে থাকে। কারণ মুসলমানদের যাকাত নামক একটি বিশেষ কর দিতে হয় যা অমুসলিম ব্যক্তি বা কোম্পানীকে দিতে হয়না। এমন আরও কিছু বিষয় আছে যা মুসলিম নাগরিকদের উপর বর্তায় কিন্তু অমুসলিমদের উপর বর্তায় না। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, অমুসলিমদের কাছ থেকে নাগরিক নিরাপত্তা বাবৎ যে জিযিয়া আদায় করা হয় তার হার মুসলমানদের যাকাতের হারের চেয়ে অনেক কম। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

“যে ব্যক্তি কোন মুআহিদের উপর জুলুম করবে; তার শক্তির বাইরে খারাজ ও জিযিয়া ধার্য করবে কেয়ামতের দিন আমি তার গর্দান পাকড়াও করব।”

খিলাফত রাষ্ট্র অমুসলিম নাগরিকদেরকে সরকারের প্রশাসনিক কাজে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে থাকে। এতে তারা তাদের মেধা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডে যোগ দানের মাধ্যমে ইসলামী সরকারের অর্থনীতিকে গতিশীল করার ব্যাপারে অবদান রাখতে পারেন। এখানে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উদ্ধৃতি বিষয়টিকে আরও সহজবোধ্য করে তুলবে। পনেরশ শতাব্দিতে ইয়াহুদীদেরকে যখন স্পেন থেকে বের করে দেওয়া হয়, তখন ইসলামী খিলাফত তাদেরকে স্বাগত জানায়। এই সুবাদে তারা স্বাস্থসেবা, গ্লাস তৈরী, মেটাল ওয়ার্কিং ইত্যাদি খাতে ইসলামী সরকারকে প্রচুর সহযোগিতা করেছিল। তৎকালে এই ইয়াহুদীরাই ছিল বিদেশী ব্যবসায়ীদের জন্য বড় বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বি। কারণ তাদের ছিল অসামান্য মেধা, কর্মদক্ষতা এবং বিদেশী ভাষাজ্ঞান। তাদের এই অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে তদানিন্তন উসমানী খলীফা সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ একটি বিখ্যাত উক্তি করে তিনি বলেছিলেন “তোমরা কি করে এই ফার্ডিনেন্ডকে বুদ্ধিমান বল, যে নিজের নাগরিকদেরকে বের করে দিয়ে তার সাম্রাজ্যকে করেছে গরীব আর আমাকে করেছে ধনী।”

৫.৯. নাগরিক ও সামাজিক অধিকারঃ

অমুসলিমরা খিলাফত রাষ্ট্রের বিশেষ সম্মানিত নাগরিক। তারা সবসময় নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপন করবে। নাগরিক নিরাপত্তা ও সকল প্রকার সামাজিক সুবিধা লাভের বিষয়ে খিলাফত রাষ্ট্রের সাথে তাদের একটি চুক্তি থাকবে। সেই চুক্তির আলোকে তারা হবে মুআহিদ। যার অর্থ হচ্ছে চুক্তিবদ্ধ নাগরিক। বর্তমান সমাজের মত সংখ্যালঘু (Ethnic Minorities) নামের কোন অমযার্দাকর উপলব্ধি তাদের থাকবে না। কিংবা বৃটেন বা আমেরিকার মত অভিবাসী নামের কোন পরিচিতি থাকবে না। যার দ্বারা একথা প্রমানিত হয় যে তারা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।

সকল মুসলমান তাদের সাথে সৎ ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করতে বাধ্য থাকবে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

“যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের ক্ষতি করল সে যেন আমাকে ক্ষতিগ্রস্থ করল।”

৬. উপরোক্ত মূলনীতিসমূহের বাস্তব ফলাফল

অমুসলিমদের সম্পর্কে ইসলামের এমন ইনসাফ ভিত্তিক মূলনীতিসমূহ এবং সেগুলোর সফল বাস্তাবায়নের ফলেই মুসলমানদের দ্বারা বিজিত এলাকাসমূহে অমুসলিমরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছিলেন। আফ্রিকা থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত এমনকি ইউরোপের অনেক রাষ্টেও ইসলাম বিজয়ীর বেশে গিয়েছিল। ঐসব রাষ্ট্রের তৎকালীন অমুসলিম নাগারিকরা ইসলামের ন্যায়বিচার দেখে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ইসলাম উদারতার মাধ্যমে আফ্রিকার অসভ্য আদিবাসী থেকে শুরু করে পারস্য ও রোমের মত পরাশক্তিধর সম্রাজ্য দুটির সুসভ্য নাগরিকদেরকে একই রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে পেরেছিল। তাই ইসলামের ন্যায়বিচারে মুগ্ধ হয়ে অর্ধপৃথিবীর মানুষ খিলাফতের ছায়াতলে এসে নিজেদেরকে ধন্য মনে করেছিল। এসব দেশের সাধারণ জনগণ কখনো ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি। উপরন্তু আমরা দেখি রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে খিলাফত না থাকলেও আজও মানুষ ইসলাম ত্যাগ করেনি। মধ্য এশিয়ার কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কিমিনিস্তান ইত্যাদি দেশসমূহে শত বছর মুসলমান ও ইসলামের উপর চরম অত্যাচার চালিয়ে সমাজতন্ত্রীরা জনগণকে ইসলাম থেকে এক দিনের জন্যও বিচ্যুত করতে পারেনি। বরং অধিকাংশ দেশেই ইসলামকে রক্ষা করার জন্য মুসলমানরা দখলদারদেরকে সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবিলা করছে। বাংলাদেশেও আমাদের পূর্বপুরুষরা হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ খ্রিষ্টান তথা মানুষ হিসেবে নির্বিশেষে সকল মুসলিম-অমুসলিমের উপর ইসলামের ন্যায় বিচারে আকৃষ্ট হয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তার প্রমাণ এদেশের অধিকাংশ জনগণ এখনো ইসলামকে সব কিছুর চেয়ে বেশী ভালবাসে। এখনো এদেশের জনগণ বিশ্বাস করে ইসলাম তার সত্যিকার রূপ নিয়ে ফিরে আসলে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরে আসবে, মুসলিম-অমুসলিম সকলের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং এদেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।

৭. উপসংহারঃ

একটি মতাদর্শিক রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্মমতের অনুসারী জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও তাদের মৌলিক অধিকারগুলো সংরক্ষণ ছাড়া শান্তি স্থাপন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতিগুলো খুবই স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট। অতীতে বহু শতাব্দি ধরে এগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং তার সুফল সমাজ ভোগ করেছে। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অনেকগুলো অপপ্রচারের একটি হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার অভিযোগ। বাংলাদেশ একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হওয়ার পরও অমুসলিমদের অধিকার হরণের সব দায়ভার ইসলামের উপর চাপানো সম্পূর্ণরূপে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি - আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতিতে এদেশের অমুসলিমদের ব্যবহার করছে। তাদের অবস্থাকে এমনভাবে চিহ্নিত করা হয় যেন কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী অবস্থান ছাড়া বাংলাদেশে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই অসম্ভব। অপর পক্ষে অন্য দলটিকে অমুসলিমদের প্রতিপক্ষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তাই আমাদের সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ব্যর্থ এই সেক্যুলার রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সবাইকে মনোযোগী হতে হবে।

খিলাফত শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ ও রূপরেখাঃ উৎপাদনমুখী শিক্ষা, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন

১. সূচনা

এবারের আলোচনার বিষয় উৎপাদনমুখী শিক্ষা, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এই আলোচনাটি মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে বর্তমান বাস্তবতা তুলে ধরা হবে। এই ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের দুরবস্থার কারণগুলো আলোচনা করা হবে দ্বিতীয়ভাগে। তৃতীয়ভাগে খিলাফত রাষ্ট্র কি করে এই দুরবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে জাতিকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাবে তা আলোচনা করা হবে।  

২. বর্তমান বাস্তবতা

২.১ শিক্ষাঃ

যদি শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হয়, তাহলে চরিত্র ব্যক্তির মেরুদন্ড। যে শিক্ষা মানুষকে চরিত্রবান করে না, সে শিক্ষা অবশ্যই ব্যর্থ। বর্তমানে আমাদের সার্টিফিকেট-সর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা থেকে একজন শিক্ষার্থী নিজে আদর্শবান হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়না, আর সমাজের অন্যদের নীতি ও আদর্শের দিকেও ডাকে না। এখানে চরিত্র গঠনের চেয়ে সার্টিফিকেটটাই বেশী জরুরী। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা বহুভাগে বিভক্ত। ধর্মকে ভিত্তি  করে রয়েছে মাদ্রাসা। অন্যদিকে রয়েছে তথাকথিত সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা। মাদ্রাসায় রয়েছে আবার দু’টি ধারা - কওমী ও আলিয়া। অপরদিকে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থাতে রয়েছে আবার দু’টি ভাগ - বাংলা মিডিয়াম ও ইংলিশ মিডিয়াম। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রয়েছে পাবলিক ইউনিভার্সিটি ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। এরপরও রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই বহুধা বিভক্তি থেকেই বোঝা যায় যে, কোন বিশেষ উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে এই শিক্ষাব্যবস্থা তৈরী করা হয়নি; এটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যহীন। এরপর  শিক্ষা প্রদানেও রয়েছে সমস্যা। শহর ও গ্রামের শিক্ষার মানে ব্যাপক বৈষম্য থাকায় সকলেই শহরমূখী হচ্ছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটি ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে রয়েছে মানগত বৈষম্য। এদেশের দরিদ্র মানুষ শখ করে পড়ালেখা করে না। শিক্ষাকে চাকুরী জীবনের পূঁজি হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা এখন লাখ ছাড়িয়ে কোটিতে উঠেছে। ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’- এই কথা বলে শিক্ষায় আগ্রহী করার পর শিক্ষাজীবন এককথায় বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ লক্ষ্যহীন।

২.২ শিল্পায়নঃ

কর্মসংস্থানের সাথে শিল্পায়ন সরাসরি জড়িত। গত কয়েক দশকে এদেশে যতটুকু শিল্পায়ন হয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশী শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। যেকোন জাতি মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই ভারী শিল্পে (যেমন, লৌহ ও ইস্পাত শিল্প) স্বাবলম্বী হতে হয়। বাংলাদেশে ভারী শিল্পের অবস্থা বর্ণনাতীত। দেশে উলে−খযোগ্য কোন ভারী শিল্পই গড়ে উঠেনি। উপরন্তু লৌহ ও ইস্পাত শিল্পকে টাটার মতো বিদেশী প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। আদমজী জুট মিলসহ বেশ কয়েকটি জুট মিল, অনেকগুলো চিনির কল, কাগজ তৈরীর শিল্প কারখানা ইত্যাদি বহু সংখ্যক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের পর বহু শিল্প-কারখানা প্রথমে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করা হয়। এরপর কারখানাগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। সাম্প্রতিককালে এই রুগ্ন শিল্পগুলোকে আবার বেসরকারী খাতে ছাড়া হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প আজকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। তাঁত শিল্প, মৃত্তিকা শিল্পসহ সকল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কোন ধরনের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না। অথচ দেশের আভ্যন্তরীণ বস্ত্রের বাজারও বর্তমানে হাতছাড়া হয়ে গেছে। মাত্র কয়েকটি শহর ছাড়া পুরো দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় শিল্পায়ন শহরকেন্দ্রিক হয়েছে। ফলে পুরো দেশের কর্মহীন জনগোষ্ঠী শুধু ঢাকার মতো শহরগুলোতে এসে জমা হচ্ছে। 

২.৩ অবকাঠামোগত উন্নয়নঃ

যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে প্রধানত রয়েছে নদীপথ, রেলওয়ে  ও স্থলপথ (রাস্তা-ঘাট)। এসবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল, জ্বালানী- নির্ভর ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে স্থলপথের যানবাহন। তুলনামূলকভাবে রেলওয়ে অনেক বেশী সস্তা, কম জ্বালানী-নির্ভর। আর নদীপথ হচ্ছে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে ভাল। কিন্তু নাব্যতা হ্রাসের কারণে নদীপথের দৈর্ঘ্য সবসময়ই কমছে। প্রমত্তা পদ্মা নদী শুকিয়ে নর্দমা হয়ে গেছে; তিস্তা আর টিপাইমুখেও নদীশাসনের নতুন প্রকল্প চলছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনামল অবসানের পর তাদের রেখে যাওয়া রেলওয়ে ব্যবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থাতেই রয়ে গেছে। তাছাড়া যমুনা নদীর পূর্ব ও পশ্চিমে ভিন্ন রেল ব্যবস্থা (মিটার গেজ ও ব্রড গেজ) নিয়ে জটিলতারও কোন নিরসন হয়নি। স্থলপথে দেশে যা উন্নতি হয়েছে তা মূলত  Asian Land Transportation Infrastructure Development (ALTID), BYIMT, UN-ESCAP ইত্যাদি আন্তর্জাতিক স্বার্থপুষ্ট Asian Highway (AH) তৈরীর কারণে হয়েছে। যমুনা সেতু এসবেরই ফসল। বাংলাদেশ মূলত আমদানী-নির্ভর হওয়াতে এসব ট্রানজিটে অন্যদের বাণিজ্যিক সুবিধা বেশী হয়। তাছাড়া জাতীয় নিরাপত্তাও এক্ষেত্রে একটি ভাববার মতো বিষয়। অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আই. এম. এফ-এর নির্ধারিত নকশায় বেড়ে উঠা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে আন্তর্জাতিক স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে, জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পায়নি। চীন ও ভারতের মতো দু’টি ক্রমবর্ধমান শক্তির মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান ভূ-রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে উল্লেখ্য চট্টগ্রাম ও মংলার মতো দু’টি প্রাকৃতিক সমূদ্রবন্দরের অধিকারী বাংলাদেশ। এই দু’টি বন্দর নিয়ে চলছে বেসরকারীকরণ করার চক্রান্ত। তাছাড়া চালনা, চাঁদপুরসহ গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দরগুলো পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধ্বংসপ্রায়। 

৩. দুরবস্থার কারণ

যে কোন জাতির নেতৃত্ব যদি সে জাতিকে কোন রাজনৈতিক উচ্চাশার (Vision) ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে, তবে সে জাতি কখনই কোন বিষয়ে অগ্রসর হতে পারে না; প্রতিটি বিষয়েই তারা উদ্দেশ্যহীন থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল উর্বর জমি। কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ। এগুলো এদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, তেলসহ জ্বালানীর বিশাল মজুদ রয়েছে। তাছাড়া রয়েছে বিশাল জনশক্তি। এত কিছুর পরও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব শক্তিশালী নয়। তারা জাতীয় স্বার্থকে বিক্রি করে শুধু লুটপাটে ব্যস্ত থেকেছে। শুধুমাত্র শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবেই আমাদের আজকের এই দূরবস্থাএখন আমরা দেখব বিশেষভাবে শিক্ষা, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুরবস্থার কারনগুলো কী কী। 

৩.১ শিক্ষাব্যবস্থায় দুরবস্থার কারণঃ

বহুভাগে বিভক্ত এই শিক্ষাব্যবস্থা মূলত বিশেষ কোন উদ্দেশ্যকে ঘিরে গড়ে তোলা হয় নি। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থা অন্ধভাবে অনুকরণ করায় এই শিক্ষা আমাদেরকে কোন আদর্শ শেখায় না, চরিত্রবান হিসেবে তৈরী করে না; জাতির জন্য নীতিবান, আপোষহীন শক্তিশালী নেতৃত্ব তৈরী করতে পারেনা। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যহীনতা আরো পরিলক্ষিত হয় যখন দেখা যায় আমাদের উৎপাদনমুখী কোন শিক্ষানীতি নেই। গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম সম্পদ আমাদের আছে তা জানার পরও এর প্রযুক্তি নিয়ে দেশে বিশেষ পড়াশোনা নেই। কয়লা উত্তোলন প্রযুক্তি শত বছরের পুরনো, তথাপি এ বিষয়ে বিশেষ কোন পড়াশোনা নেই। অথচ এদেশের মেধাবী যুব সমাজ কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর মতো অত্যাধুনিক বিষয়েও যে দক্ষতা অর্জন করতে পারে তা প্রমাণ করেছে। অত্যাশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিককালে যেসব বিষয় প্রবর্তন করা হয়েছে তার মাঝে রয়েছে American Studies, Peace and Conflict Studies ইত্যাদি। দেশে শিল্পায়ন না হওয়ার কারণে কোন উৎপাদনমুখী শিল্প নেই। ফলে বর্তমান শিক্ষা চাকুরীর কোনো নিশ্চয়তা দেয়না। অনেকে আবার অন্য দেশে গিয়ে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে। বিষয়টি কতটা প্রকট তা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি আমাদের দেশের নীতি নির্ধারক মন্ত্রী-সাংসদদের প্রত্যেকেই তাদের সন্তানদের বিদেশে পড়াচ্ছেন, আর দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের পেশীশক্তির রাজনীতিতে মাস্তান তৈরীর খামার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এ সুযোগে অনেকে আবার প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি খুলে শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে সরাসরি ব্যবসা করছেন। 

৩.২ শিল্পায়ন না হওয়ার কারণঃ

বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলার কোন পরিকল্পনা কোন সরকারেরই ছিল না। যে কারণে শিল্পকে কখনই অগ্রাধিকার দেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে বাংলাদেশে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে  Import Substitution Strategy (ISS) নেয়া হয়। অর্থাৎ যেসব পণ্য আমাদের আমদানী করতে হবে তা দেশেই প্রস্তুত করার জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। এই নীতি ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় দশকে আগের নীতি ঝেড়ে ফেলে Export-Led Growth Strategy (EGS) গ্রহণ করা হয। কিন্তু সেক্ষেত্রে যেসব পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়, তার অধিকাংশই আমাদের দেশের কৃষি পণ্য, জ্বালানী ইত্যাদি দেশজ শিল্পভিত্তি বাদ দিয়ে নির্ধারিত হয়। ফলাফলস্বরূপ গার্মেন্টস শিল্প ছাড়া অন্য সকল ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থতা নেমে আসে। যেমন - কৃষিভিত্তিক শিল্প, পাটকল, চিনিকল, কাগজের কল ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যায়। শিল্পক্ষেত্রকে দুই দশকে প্রায় ধ্বংস করার পর তৃতীয় দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলোকে (SOE) বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়। এখানে লক্ষ্যনীয় যে প্রথমতঃ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেসরকারী খাতে দেয়ার আগে বলা হচ্ছে যে সরকার এগুলো পরিচালনায় অদক্ষ। অর্থাৎ শাসকগোষ্ঠীর ব্যর্থতা প্রথমেই স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়তঃ এই শিল্প-কারখানাগুলো বেসরকারী খাতে গিয়ে লাভের মুখ দেখছে। অর্থাৎ শিল্পখাতগুলো আসলে লাভজনক। এ প্রক্রিয়ায় বর্তমানে রূপালী ব্যাংক বেসরকারীকরণ করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ বিমানকে বেসরকারীকরণের চেষ্টাও চলছে।  

তিন দশকে তিনটি ভিন্ন নীতি গ্রহণ থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় শাসকগোষ্ঠী শিল্পায়নের ব্যাপারে লক্ষ্যহীন। দু’একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। সাম্প্রতিককালে হংকং-এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO, Hongkong) সম্মেলন থেকে বিভিন্ন নাটকীয় ঘটনার পর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আলতাফ চৌধুরী বাংলাদেশের জন্য বিমান তৈরী করে তা রপ্তানী করার অনুমোদন নিয়ে আসেন। অন্যদিকে আবার “ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ” তাদের ‘রোড ম্যাপ’-এ দেশের অগ্রাধিকার খাত হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ‘কৃত্রিম ফুল তৈরী’ কে প্রস্তাব করেছে! (দেখুন এখানে)

বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী বিশ্বব্যাংকের তাঁবেদারী করতে গিয়ে বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এদেশের পাটশিল্প সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। একদিকে চিনির কলগুলো বন্ধ হয়েছে, অন্যদিকে দেশের মানুষ ৭০ টাকা কেজি দরে চিনি কিনছে। প্রাক্তন বাণিজ্য উপদেষ্টা বরকত উল্লাহ বুলু বলেছেন দেশে ১৪ লক্ষ টনের বেশী চিনির চাহিদা রয়েছে অথচ দেড় লক্ষ টনের মতো উৎপাদন হচ্ছে। তবে কেন চিনির কলগুলো বন্ধ করার হিড়িক পড়ল এ প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (Small & Medium Enterprise, SME) ধ্বংস করার পর এ খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকার একদিকে গালভরা কথা বলে বেড়াচ্ছে, অন্যদিকে টাটার মতো বিশালকায় প্রতিষ্ঠানকে দেশে বিনিয়োগের জন্য আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। টাটা আসলে প্রায় ২,০০০ এর অধিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পই শুধু ধ্বংস হবে না, দেশের টাকা ও সম্পদ দেশের বাইরে চলে যাবে।

৩.৩ অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়ার কারণঃ

শিল্পায়নের যথাযথ বিকাশ না হওয়ায় দেশের অবকাঠামগত উন্নয়ন সুষমভাবে হয়নি। শুরুতে যমুনা সেতুতে রেল সংযোজনের পরিকল্পনা না থাকলেও Trans Asian Railway (TAR)-এর বাস্তবায়নের জন্য বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর চাপে পড়ে Jamuna Bridge Rail Link Project (JBRLP) সংযোজন করা হয়। ফলে সেতু তৈরীর সর্বশেষ পর্যায়ে মাত্র সাত মাসে ঊনিশ কিলোমিটার রেললাইন তৈরী করা হয়। এ থেকে দু'টো বিষয় পরিষ্কার হয়।

প্রথমতঃ সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অত্যন্ত সহজেই দেশে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরী করা সম্ভব।

দ্বিতীয়তঃ সরকার এ বিষয়ে পরিকল্পনাহীন। এই অপরিকল্পিত রেল সংযোজনের কারণে ইতিমধ্যেই এই ব্যয়বহুল সেতুটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানত তিনটি নদী - পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। তিনটি নদীতেই আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা ভারত লুট করে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দু’টি দলই ক্ষমতায় থাকার লোভে ভারতের সাথে নতজানু ও দূর্বল নীতি অবলম্বন করে এসেছে। ভারতের সাথে পানিচুক্তির ত্রিশ বছরে আমাদের প্রাপ্য অংশ না পাওয়ার পরও আওয়ামী লীগ বিগত শাসনামলে এই চুক্তি নবায়ন করেছে। আর এইবার বিএনপি শাসনামলের শেষ পর্যায়ে নির্বাচনী আশীর্বাদ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভারতে যে সফর করেছেন সেখানে আন্তঃনদী সংযোগের বিষয়টি নিয়ে কি কথা হয়েছে তা জনগণ পরিষ্কার না বুঝলেও ঠিক সে সময়েই ভারত টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ উদ্বোধন করেছে। নদীপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার কারণে জনগণ স্থলপথে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে পণ্যের পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে বহুগুণ। গ্রাম ও শহরে কৃষি পণ্যের মূল্যের তফাৎ হয়েছে প্রায় কয়েকগুণ। 

রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত, হাসপাতাল ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনস্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া। এদেশে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিদের এলাকা ছাড়া অন্য অঞ্চল উন্নয়নের আওতাভুক্ত হয় না। অর্থাৎ পক্ষপাতহীনভাবে দেশের সমস্ত অঞ্চলের জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব না দেয়ায় অসমভাবে এই উন্নয়ন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, জাতীয় পার্টির শাসনামলে দেশের অধিকাংশ মানুষ অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকলেও রংপুরের রাস্তায় সোডিয়াম বাতি জ্বলেছে।  

আমাদের শাসকগোষ্ঠী যখন আমাদেরকে লক্ষ্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা দিয়েছে, দেশের ভারী, মধ্যম ও ক্ষুদ্র শিল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছে, জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে দেশকে যখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, তখন দেশের ভূক্তভোগী জনগণ মুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। মূলত আওয়ামী-বিএনপির এই লূটপাট, দুর্নীতি আর দুঃশাসনের পতন ঘটিয়ে একমাত্র ইসলামী আদর্শভিত্তিক খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাঝেই আছে জনগণের মুক্তি।

আসুন, আমরা এখন দেখি খিলাফত রাষ্ট্র কি করে শিক্ষা, শিল্প ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাস্তবায়ন করবে। 

৪. খিলাফত রাষ্ট্রে উৎপাদনমূখী শিক্ষা, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রাসুলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) সহকারে, যেন এই দ্বীন অন্যান্য দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন...।” [সুরা আত্ -তাওবাহ্ - ৩৩]

তিনি আরো বলেন,

“... এবং কিছুতেই আল্লাহ কাফেরদেরকে মুসলমানদের উপর বিজয় দান করবেন না।” (সূরা আন-নিসাঃ ১৪১)

ইসলামকে সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বীন হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে যখন সরে আসার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম, তোমরা আমার ডান হাতে সূর্য, আর বাম হাতে চন্দ্রও যদি এনে দাও, তবুও যতক্ষণ আমার ঘাড়ে মাথা আছে, ততক্ষণ আমি ইসলামকে বিজয়ী করার চেষ্টা করেই যাবো।”

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর অনুসারী সাহাবাদেরকে আপোষহীনভাবে সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত মানুষকে সকল দাসত্ব থেকে মুক্ত করে খিলাফত রাষ্ট্রের অধীনে আনার উচ্চাশায় ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর জমীনে ইসলামের বিজয়ী পতাকা উড়ানোর এই রাজনৈতিক উচ্চাশার (Vision) ফলে আরবের অনগ্রসর জাহেল সমাজ থেকে উঠে আসা সাহাবারা খিলাফত প্রতিষ্ঠার মাত্র বিশ বছরের মাঝে একই সাথে দু’টি পরাশক্তিকে (পারস্য ও রোমান) হারিয়ে বিশ্বের নেতৃত্ব ইসলামের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ব্রিটিশদের দু’শ বছর, রাশিয়া ও আমেরিকার পঞ্চাশ বছরের দুনিয়া শাসনের ইতিহাস থাকলেও খিলাফত রাষ্ট্রের রয়েছে হাজার বছরের একচ্ছত্রভাবে পরাশক্তি থাকার গৌরবময় অতীত। 

খিলাফত রাষ্ট্র তার জাতিকে বিশ্বের নেতৃত্ব দান করার বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ করবে এবং সেই জাতিকে একটি দূর্ভেদ্য, শক্তিশালী, অপরাজেয় পরাশক্তিতে পরিণত করবে। আর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের এই অদম্য উচ্চাশার কারণে ভবিষ্যতে খিলাফত রাষ্ট্র হবে শিল্প ও প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রগামী।

৪.১ খিলাফত রাষ্ট্রে উৎপাদনমুখী শিক্ষাঃ

আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতা’আলা বলেন, “নিশ্চয় আসমান ও জমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকেদের জন্য; যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও।” (সুরা আল ইমরানঃ ১৯০-০৯১)

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “বিদ্যা অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ।”

আরেক হাদীসে রাসুল (সাঃ) বলেন, “শেষ বিচারের দিন তিন ব্যক্তির সুপারিশ গ্রহণ করা হবে- নবীগণ, বিদ্বান, অতঃপর শহীদ।”

অপর এক হাদীসে আছে, “এক ঘণ্টার চিন্তা (গবেষণা) সত্তর বছরের ইবাদতের চেয়ে উত্তম।”

এটা স্পষ্ট যে ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিবেন। খিলাফত রাষ্ট্রের জনগণকে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে খলীফা সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। এটি কোন কথার কথা নয়; উপরোক্ত কুরআন ও হাদীসের আদেশ অনুযায়ী এটা তার অবশ্যকরণীয় দায়িত্ব। রাজনৈতিক উচ্চাশায় উদ্দীপ্ত জাতিকে তার খলীফা যথাযথ শিক্ষার সুযোগ দিতে বাধ্য, অতীতেও দিয়েছেন। খিলাফত রাষ্ট্রে থাকাকালে স্পেন, বাগদাদ, কায়রো ইত্যাদি বিদ্যাপীঠগুলো তারই প্রমাণ দেয়। 

৪.১.১ শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যঃ

 ইসলামী ব্যক্তিত্ব তৈরী ও জাতিকে বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করাই হবে শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য। এটি জাতিকে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে দক্ষ করে গড়ে তুলবে।

১. প্রত্যেক নাগরিককে সৎ, দক্ষ ও উৎপাদনক্ষম করে গড়ে তুলবে। 
২. সামাজিক ক্ষেত্রে ভাল কাজে অংশগ্রহণ ও খারাপ কাজে বাধা প্রদানে দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলবে। 
৩. জাতিকে বিশ্বে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞানে দক্ষ করে তুলবে।

এক্ষেত্রে খলীফা নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গুরুত্বের সাথে বাস্তবায়ন করবেন - ব্যক্তির চরিত্র গঠনে ও আদর্শিক ব্যক্তিত্ব তৈরীতে ফলপ্রসূ পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করা হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের মাঝে নীতিবান ব্যক্তিত্ব ও শক্তিশালী নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা তৈরী হয়। নারী-পুরুষ মুসলিম-অমুসলিম প্রত্যেককে শিক্ষার যাবতীয় সুযোগ দিতে খলীফা বাধ্য থাকবেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সকল শিক্ষা উপকরণ যেমনঃ বই-খাতা ইত্যাদি বিনামূল্যে সরবরাহ করবে। প্রাথমিক শিক্ষা সমস্ত জীবনের ভিত্তি। এক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শিক আক্বীদা জোরালোভাবে তুলে ধরা হবে। ফলে জাতির সামনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের আকাঙ্খা গড়ে উঠবে। এজন্য রাষ্ট্র স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজ করবে। অতীতে এর নিদর্শনও রয়েছে। রাসূল (সাঃ) বদর যুদ্ধে বন্দীদেরকে দশজন মুসলিম শিশুকে শিক্ষা দান করার বিনিময়ে মুক্তি দিয়েছেন। Experimental Science (ফলিত বিজ্ঞান) শিক্ষার যে কোন স্তরেই সংযুক্ত হতে পারে, যতক্ষণ না এটি ইসলামের আক্বীদা-পরিপন্থী কোন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে বাস্তব ব্যবহার শিখানো হবে। শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় রাষ্ট্রের মসজিদগুলো থাকবে। এখানে ফিকাহ, উসুল, তাফসীর, হাদীস, সীরাত এবং অন্যান্য বিষয় শেখানো  হবে। প্রয়োজনে মসজিদে বির্তক, আলোচনা অনুষ্ঠান ইত্যাদি আয়োজন করা হবে। সকল বিদ্যালয়ে পাঠাগার গবেষণাগার তৈরী করা হবে। প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য উৎপাদনমুখী পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করা হবে। শুধুমাত্র প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষা নয়, ররং এর গবেষণাকর্ম, উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণও প্রযুক্তিগত শিক্ষার আওতায় আনা হবে। উলে−খ্য এক্ষেত্রে খলীফা দেশে ডাক্তার, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পোদ্যোক্তা, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এমন কি, মহাকাশ বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রাসয়ন বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা রাখবেন। খলীফা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণাপত্র তৈরীর পৃষ্ঠপোষকতা ও পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করবেন। এক্ষেত্রে পাঠ্যসূচীর বাইরেও বিভিন্ন বই-পুস্তক, পত্রিকা, গবেষণাপত্র ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ পাঠাগার বিভিন্ন এলাকায় বা মসজিদে স্থাপন করা হবে, যেখানে বিনামূল্যে এই সকল বিষয়ে অধ্যয়ন করা যাবে। শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমোদিত পাঠ্যসূচী ব্যতীত অন্য কোন বিদেশী পাঠ্যসূচী অনুসরণ করা যাবে না। বিশেষভাবে আমাদের দেশ বিশাল জ্বালানীও খনিজ সম্পদের অধিকারী হওয়ায় দেশে Gas & Petroleum Technology, Coal Mining  Technology, Agro-Industry ইত্যাদি বিষয়ে নিজেদের বিশেষজ্ঞ তৈরী করার জন্য খলীফা ব্যবস্থা নিবেন। বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে সামরিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান অপরিহার্য। এক্ষেত্রে পরমানু শক্তি গবেষণা, নিজস্ব সামরিক যানবাহন (ট্যাংক, জাহাজ, উড়োজাহাজ) তৈরীর প্রযুক্তি, ভারী  শিল্প তৈরীর প্রযুক্তি ইত্যাদি প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণাধর্মী ও প্রায়োগিক বিজ্ঞান বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরী করার জন্য পর্যাপ্ত পরিকল্পনা নেয়া হবে।

উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনে খলীফা এ বিষয়ে আরও সংযোজন করতে পারেন। 

৪.২ শিল্পায়নঃ

৪.২.১ শিল্পায়নের উদ্দেশ্যঃ

খিলাফত রাষ্ট্রে শিল্পায়ন মূলত নিম্নোক্ত দু’টি উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে।

(ক) স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করাঃ

যে কোন জাতিকে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হয়, অন্যের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হয়। তাই খিলাফত রাষ্ট্র স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে অবশ্যই শিল্পায়নকে গুরুত্ব দিবে। যে বাহিনী যুদ্ধবিমান উড়াতে জানে, ট্যাংক চালাতে জানে, কিন্তু সে বিমান বা ট্যাংক তৈরী করতে জানে না, সে বাহিনী দুর্বল, পরাজিত। রাসূল (সাঃ) তার জীবদ্দশায় মুসলমানদের শিখিয়ে গিয়েছেন কিভাবে শিল্প-প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হয়। তিনি তলোয়ার তৈরীর প্রযুক্তি শেখার জন্য মদীনা থেকে ইয়েমেনে লোক পাঠিয়ে সে প্রযুক্তি আয়ত্ত করিয়েছিলেন। খন্দকের যুদ্ধে তিনি খন্দক খনন প্রযু্ক্তি বহির্বিশ্ব থেকে শিখে আরবে প্রথমবারের মতো প্রয়োগ করেছেন। তায়েফ অবরোধের সময় তিনি লিভার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারী কামান তৈরী করেছেন। মুসলমানরা তাঁর এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে খিলাফত রাষ্ট্রে চিকিৎসা, সমরাস্ত্র (যেমন কামান), জ্যোর্তিবিজ্ঞান ইত্যাদি বহু বিষয়ে দক্ষতা দেখিয়েছে

বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে ত্রাণ কাজে ব্যবহারের জন্য কিছু হেলিকপটার আনা হয়েছিল, যার শুধুমাত্র উড্ডয়ন ব্যবহার আমরা জানতাম। কিন্তু এর যন্ত্রাংশ তৈরী, রক্ষণাবেক্ষণ করার প্রযুক্তি না জানায় আমরা আমদানীকারক দেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে আছি। ফলে দেখা গেছে, কোন কোন হেলিকপ্টার মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের যন্ত্রাংশের অভাবে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির, উৎপাদন, ব্যবহার ও রক্ষনাবেক্ষন, তিনটি পর্যায়েই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকে খলীফা গুরুত্ব দিবেন। আর এজন্যই শিল্পায়ন হওয়াটা খিলাফত রাষ্ট্রের অপরিহার্য অংশ। খলীফা এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ, পরিকল্পনা, গবেষণা, উৎপাদন ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রযুক্তি তৈরীর নির্দেশ দিবেন। 

(খ) শিল্পখাতকে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের প্রভাবমুক্ত রাখাঃ

আগে পশ্চিমাশক্তিগুলো সরাসরি সামরিক ভিত্তি তৈরী করে বাজার দখল করত। এখন এর সাথে নতুন সংযোজন হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেইজ তৈরী করা। এখানে উলে−খ্য যে যেসব দেশে এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেইজ তৈরী করা হয় সেখানে শুধু প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানো হয়, প্রযুক্তি উৎপাদন শেখানো হয় না। ফলে এসব দেশ (যেমন, তাইওয়ান, কোরিয়া, হংকং, ব্রাজিল) এখনো প্রযুক্তিতে অনুন্নত, পশ্চিমাশক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে আছে। তারা কেবল সস্তা শ্রম বিক্রি করে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও একই ধরনের শিল্পভিত্তি রয়েছে এবং সাম্প্রতিককালে টাটা বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলাফলও ঠিক একই হবে। এদেশের মানুষ কেবল এতে শ্রমিক হয়েই খেটে যাবেএক্ষেত্রে বিদেশী নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য খলীফা এধরনের সকল বিদেশী শিল্প ভিত্তিকে উৎখাত করবেন।

৪.২.২ বাংলাদেশে শিল্পায়নের উপযোগিতাঃ

যেকোন শিল্প বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় দরকার –

১. শ্রম
২. শক্তি (জ্বালানী শক্তি)
৩. বাজার

শ্রমঃ
বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ১৫ কোটি মানুষের বসবাস। এত বড় ও ব্যাপক শ্রম বাজারকে ব্যবহার করা খুবই সহজ। উল্লেখ্য যে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ এশিয়ার শ্রমবাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল।

শক্তিঃ
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল ও কয়লার বিশাল মজুদ রয়েছে। এগুলোর জন্য আমরা অন্যের উপর নির্ভরশীল নই। এ সম্পদ বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে না দিয়ে খলীফা এগুলোকে শিল্পায়নের জন্য ব্যবহার করবেন।

বাজারঃ
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ১৫ কোটি মানুষের বাজার যে কোন শিল্প বেড়ে উঠার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এ সকল কারণেই খিলাফত রাষ্ট্র শিল্পায়নের জন্য খুবই অনুকূল। খিলাফত রাষ্ট্রে খলীফা যে বিষয়গলোতে শিল্পায়নের জন্য অগ্রাধিকার দিবেন তা হল-

Ø  স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান
Ø  লৌহ ও ইস্পাত শিল্প
Ø  বাঁধ নির্মাণ শিল্প
Ø  গ্যাস ও কয়লা ভিত্তিক শিল্প (যেমন- বিদুৎ, সার ইত্যাদি)
Ø  মোটর তৈরী শিল্প (যা ট্রাক্টর, ট্যাংক, জাহাজ, উড়োজাহাজ ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়)
Ø  গাড়ী, জাহাজ, উড়োজাহাজ তৈরী শিল্প ইত্যাদি

৪.২.৩ কৃষি-শিল্পঃ

খাদ্যে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। এছাড়া চিনি, পাট, মৎস্য, চা ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলো অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এক্ষেত্রে খলীফা অত্যন্ত জোরালোভাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নিবেন- সকল অব্যবহৃত চাষযোগ্য খাস জমিগুলোকে চাষের আওতায় আনবেন। প্রয়োজনে ভূমিহীন কৃষকদের তা চাষের জন্য দেয়া হবে।

Ø  তাঁত, রেশম ইত্যাদি কুটির শিল্পগুলোকে পূনরুজ্জীবিত করার নির্দেশ দিবেন।
Ø  গবাদি পশুপালন, পোল্ট্রি শিল্পকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিবেন।
Ø  কৃষিতে প্রয়োজনীয় কোন ভারীযন্ত্র আমদানী না করে কি করে দেশে তা তৈরী করা যায়, সে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিবেন। জমির উর্বরতা, উৎপাদন, বিশেষ করে সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়ে কৌশলপত্র তৈরীর জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করবেন।

৪.৩ খিলাফত রাষ্ট্রে অবকাঠামোগত উন্নয়নঃ

অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা তিনটি বিষয়কে ঘিরে তৈরী করা হয়ঃ

৪.৩.১ শিল্পায়নঃ

শিল্পবিকাশের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন পূর্বশর্ত। শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত অবকাঠামোগত সুবিধা থাকা অত্যন্ত জরুরী। সেক্ষেত্রে খলীফা যে সকল পদক্ষেপ গুরুত্বের সাথে নিবেন তা হলো-

Ø  যেহেতু নদীপথে পণ্য পরিবহন সুলভ ও জ্বালানী সাশ্রয়ী, সেহেতু নদীপথ সচল রাখার জন্য দৃঢ় রাজনৈতিক কৌশল নেয়া হবে। নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য শুধুমাত্র ড্রেজিং নয়, বরং পানির ন্যায্য অধিকার আদায়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা হবে।
Ø  দেশের জেলায় জেলায় রেলওয়ে সক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯০০ সালের দিকে খিলাফত রাষ্ট্রের তৎকালীন খলীফা সুলতান আবদুল হামিদ তুরস্ক থেকে আরব পর্যন্ত সুদীর্ঘ রেলওয়ে তৈরী করে ছিলেন।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

৪.৩.২ জনস্বার্থঃ

খলীফা উমর (রাঃ) বলেছিলেন, “ফোরাতের তীরে যদি কোন ভেড়াও না খেয়ে থাকে, তবে আমি উমর এর জন্য দায়ী থাকব।”

দেশের কোন অংশ কম উৎপাদনশীল হলে তাকে বিচ্ছিন্ন রাখা হবে, খিলাফত রাষ্ট্রে সেটা সম্ভব নয়। দেশের প্রতিটি নাগরিকের প্রাপ্য মৌলিক অধিকার তার ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য খলীফা বাধ্য থাকবেন। ফলে তিনি জনস্বার্থের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করবেন। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন যাবৎ অনুন্নত ছিল। সাম্প্রতিককালে বহির্বিশ্বের স্বার্থপুষ্ট এশিয়ান হাইওয়ে তৈরীর কারণে তারা কিছু যোগাযোগ সুবিধা পাচ্ছে। জনস্বার্থে চিকিৎসা, শিক্ষা, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়া হবে।


৪.৩.৩ জাতীয় নিরাপত্তাঃ

যেহেতু খিলাফত রাষ্ট্রে সর্বাগ্রে রাজনেতিক দূরদর্শীতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়, সেহেতু খলীফা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় যেসব পদক্ষেপগুলোকে অগ্রাধিকার দিবেন তা হলঃ

Ø  চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের উপর সকল বিদেশী হস্তক্ষেপ নির্মূল করা হবে। এক্ষেত্রে খলীফা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সমূদ্র বন্দর দু’টিকে সুরক্ষিত ও উন্নত করবেন। কোনক্রমেই এই বন্দরগুলো বেসরকারীকরণ করা বা বিদেশীদের হাতে দেয়া হবে না।

Ø  আন্তর্জাতিক ট্রানজিট বা হাইওয়েগুলোকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হবে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ যেকোন ধরনের চক্রান্ত অবশ্যই প্রতিহত করা হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

এছাড়াও খলীফা এ ক্ষেত্রে আরও উন্নয়ন পরিকল্পনা গুরুত্ব অনুসারে সংযোজন করতে পারেন।

৫. উপসংহার

সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ এই বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে  বিএনপি-আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের কারণে ধ্বংসপ্রায় হয়ে গেছে। এদেশের মানুষকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে, দেশের শিল্প-কারখানাগুলোকে ধ্বংস করে এই শাসকগোষ্ঠী কেবল লুটপাট আর দুর্নীতি করেছে। অক্সিডেন্টাল, এশিয়া এনার্জি, নাইকো ইত্যাদি বিদেশী কোম্পানীর হাতে এদেশের সম্পদ তারা তুলে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিদ্যুতের দাবীতে আন্দোলনকারী কানসাট অঞ্চলের জনগণকে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকার শনির আখরায় দীর্ঘ দুমাস পানিবঞ্চিত জনগণ পানির দাবী করলে প্রকাশ্যে স্থানীয় এমপির নির্দেশে তাদের উপর পুলিশী হামলা চালানো হয়েছে। জনতার উপর গুলি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। পত্রিকায় এসেছে, প্রধানমন্ত্রী যেখানে নির্বাচনী সফরে যান সেখানে কিছুদিন বিদ্যুতের সরবরাহ করা হয়। এদেশের জনগণ আওয়ামী-বিএনপির এই দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। দলের পরিবর্তন অথবা মন্ত্রীর বদল ঘটিয়ে এই দুরবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না। কেবলমাত্র খিলাফত রাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রই এ জাতিকে একটি সুস্পষ্ট নেতৃত্বের মাধ্যমে বিশ্বে অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

বুধবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১২

মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা পর্ব-৩


সাম্রাজ্যবাদ পরবর্তী জাতি রাষ্ট্র তত্ত্বঃ

বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মুসলিম উম্মাহকে ধরাশায়ী করা, বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে উস্কে দেওয়া এবং পরিশেষে ১৯২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে খিলাফতের মৃত্যু সাটিফিকেট দেয়ার পরও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছে এই উম্মাহ্ যাতে কোনদিনও তার গৌরবজ্জল অতীতকে ফিরে না পায়। তাই আরব বিপ্লবের মাধ্যমে খিলাফত ধ্বংসের পরবর্তীতেও তারা উম্মার আরও বিভক্তি তৈরী করেছিল। Sykes-Picot চুক্তির মাধ্যমে আরব ভূমিসমূহকে আবারো খন্ডিত করা ছিল এক ভয়াবহ পরিকল্পনা। ফরাসী এবং বৃটিশ উভয়েই একমত হলো যে তারা তাদের উপনিবেশসমূহকে দু'টি ভাগে বিভক্ত করবে। একটি ভাগ সরাসরি তারা নিয়ন্ত্রণ করবে এবং অন্য ভাগটি থাকবে আধাস্বাধীন কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপীয়দের নিয়ন্ত্রণে। বিভক্তির এই পরিকল্পনা এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে আরব অঞ্চল সর্বদাই ভিক্ত এবং দূর্বল থাকে। এই পরিকল্পনাই পরবর্তীতে জন্ম দিয়েছিল "জাতি-রাষ্ট্র" ধারণার বিশেষতঃ মধ্য প্রাচ্যে।

এটা অবশ্যই বলতে হয় বিভক্ত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের উপর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক একচ্ছত্র অধিপত্য বিস্তারেও পশ্চিমাশক্তি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাই তারা পশ্চিমা রাষ্ট্রের ধাচে মুসলিম মক্কেল জাতি রাষ্ট্র (Client Nation state) তৈরী করল। এই জাতিরাষ্ট্রসমূহ পশ্চিমা ধাচের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কাঠামো নির্মানে মনোযোগী হলো। উপনিবেশিক দেশসমূহের মানুষদের নতুন এই ব্যবস্থায় "প্রগতি"র (Modernism) সুযোগ ও অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হলো যদি তারা ইংরেজি ভাষার শিক্ষা নেয়, ইউরোপীয় ধাচের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করে এবং সাধারণভাবে ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনব্যবস্থা মেনে নেয়। এসবের পরেও যদি তারা কঠোরভাবে ইসলাম চর্চার মাধ্যমে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত 'তাকওয়া' অর্জন করতে চায়, তাহলে ইউরোপীয়দের এতে কোন আপত্তি নেয়। এরকম ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক মুসলিম জাতি-রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখাই হলো মুসলিম উম্মাহ্কে চিরতরের জন্য শোষণ করার সবচেয়ে বড় চাবি কাঠি। ইসলামকে শুধুমাত্র কিছু নৈতিকতার সমষ্টিতে পরিণত করা এবং গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে এই রাষ্ট্রসমূহের জন্য রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে নির্বাচিত করাই হলো ইউরোপীয়দের সুদুর প্রসারী পরিকল্পনা যার চর্চা এখনো মুসলিম ভূমি সমূহতে আমরা দেখতে পাই। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে মুসলিমরা ইউরোপীয় ধাচের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষিত ও আলোকিত হওয়া শুরু করল। যুগে যগে এই বিদ্যাপিঠ সমূহ এমন সব মুসলমান জ্ঞানীর জন্ম দিল যাদের কাজই ছিল মুসলমানদের ইসলাম নিয়ে এমনভাবে বিভ্রান্ত করা যাতে তারা উম্মাহকে একত্রিত করার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, সমসাময়িক পশ্চিমা মুসলিম চিন্তাবিদ ডাঃ আসগার আলি ইঞ্জিনিয়ার ও ফজলুর রহমান - যারা মনে করে কুর'আন সুন্নাহর কোথাও খিলাফতের কথা উল্লেখ নেই, এসবই পরবর্তীকালের মুসলমানদের সংযোজন। এই নিবন্ধের এক পর্যায়ে আমরা এই প্রকারের মুসলিম চিন্তাবিদ ও পুনর্জাগরণকর্মীদের ব্যাপারে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করব।

ইউরোপীয় ভাবধারায় দীক্ষিত নব্য এলিট (Elite) মুসলিম নেতাদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য যাদের উত্তরসূরি আজও আমাদের ভেতর বর্তমান, খিলাফতের পতন পরবর্তীতে এই এলিটদের হতে "স্বাধীন" হওয়া মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের দায়িত্বভার প্রদানের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। ওসমানী খিলাফতের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত "স্বাধীনতা" ছিল মূলতঃ পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে এক ভয়ংঙ্কর প্রতারণা ও ফাঁদসাম্রাজ্যবাদীদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মুসলিম এই স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র সমূহকে নিজেদের উপনিবেশ (Colony) বানানো এসব এলিটদের দ্বারা। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে প্রথমতঃ উম্মাহর বিশ্বাস ও চেতনাকে নিস্তেজ করল এবং অবশেষে যখনই খিলাফত ধ্বংস হলো, "স্বাধীন" আরব দেশ সমূহকে এই জাতীয়তাবাদী মুসলিম এলিট নেতাদের মাধ্যমে ইউরোপীয়রা নিজেদের কবজায় নিয়ে এল। একই রকমের পরিনতি তুরস্কের জন্যও অপেক্ষা করছিল। এক সময়কার বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত খিলাফতের রাজধানী তুরস্ক আজ ইউরোপীয় দেশসমূহের পদলেহন করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আরব বিপ্লব এবং অবশেষে এরই মধ্যে দূর্বল ও নমনীয় খিলাফতকে ''তুর্কি জাতীয়তাবাদের'' মাধ্যমে ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে ধ্বংস করে দেওয়া- এসবই আমাদের দূর্ভাগ্যজনক অতীত এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

যাই হোক, যেটা আমরা বলছিলাম এই "স্বাধীন" মুসলিম রাষ্ট্র সমূহ মূলতঃ স্বাধীনতার পর জাতীয়তাবাদী এলিট নেতাদের মাধ্যমে ইউরোপীয় বলয়ে চলে এল। তারই নমুনা আমরা দেখতে পাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী "লিগ অব নেশনস" (League of Nations) এর "আর্টিকেল ২২" (Article 22) তে- "নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল যা পূর্বে তুর্কি সাম্রজ্যের অধীনে ছিল সেগুলোকে এখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কিন্তু এই শর্তে যে যতক্ষণ পর্যন্ত এই দেশসমূহ নিজের পায়ে দাড়াতে পারবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত এদের জন্য প্রশাসনিক পরামর্শ ও সহযোগীতা (Administrative advice & assistance) বাধ্যতামূলক।"

স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশাসনিক পরামর্শ ছিল সরাসরি মুসলিম ভূমি সমূহকে ইউরোপীয়দের করালগ্রাসে নিয়ে আসা। ব্রিটেন ইরাক, প্যালেস্টাইন ও ট্রান্সজর্ডান দখল করল এবং ফ্রান্সের ভাগে পড়ল সিরিয়া এবং লেবানন। শরীফ হোসেন এর ভাগে অবশিষ্ট যেসব "স্বাধীন আরব রাষ্ট্র" রয়ে গেল যেগুলোকে বলা হতো "হিজাজ রাজ্য" (Kingdom of Hijaz), সেগুলোর নতুন নামকরণ দেয়া হলো ১৯২৫ সালে- সউদী এরাবিয়া।

এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যদিওবা মুসলিম দেশসমূহ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দ্বারা বিভক্ত হয়ে গেল স্বাধীনতার নামে কিন্তু দেশসমূহের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ ঠিকই রয়ে গেল পশ্চিমাদের হাতে এই এলিটদের দ্বারা। যদিওবা বর্তমানে মুসলিম দেশসমূহ পশ্চিমাদের উপনিবেশ আর নেই কিন্তু যুগে যুগে এই রাজনৈতিক এলিটদের উত্তরসুরি আমরা এখানো মুসলিম দেশসমূহে দেখতে পাই। ইরাকের নুরী আল মালিকি এবং আফগানিস্তানের হামিদ কারজাইদের মতো অসংখ্য নেতা আজো বিদ্যামান যারা এখনো মার্কিন-বিট্রিশদের "Administrative Advice" নেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত। মুসলিম দেশসমূহকে যারা কখনোই ঐক্যবদ্ধ হতে দিতে চায়না, মুসলিম ভূমিসমূহকে তারা পশ্চিমাদের দাস বানিয়ে রেখেছে। তাইতো আমরা অপারগতার সাথে দেখি যখন ফিলিস্তিন আক্রান্ত হয় ইয়াহুদ দ্বারা, তখন জর্ডানের বাদশা হোসেন সার্বিক সহায়তা ইয়াহুদী নাসারাদের দিয়ে থাকে। পশ্চিমা রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে এই এলিট তৈরীর সিলসিলা খিলাফতের পুনরাগমনের আগ পর্যন্ত চলতে থাকবে।

নব্য এই ইউরোপীয় শ্রেণীর হাতে 'স্বাধীন' মুসলিম দেশসমূহর ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে শর্তই ছিল "জাতীয়তাবাদী" হওয়া, জাতীয়তাবাদীদের উৎসাহ দেওয়া হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সাথে কিছুটা ইসলাম এর সংমিশ্রণ করা। "পশ্চাৎপদ" মুসলিম দেশসমূহের সাথে যোগাযোগের এটাই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের মতো পশ্চাৎপদ মুসলমানদেশের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয়দের মতো নব্য ইউরোপীয় শ্রেণীর প্রয়োজন এখনো ফুরায়নি।

ইউরোপের সাথে যোগাযোগের আরো একটি সেতুর সফল নির্মাণ সম্পন্ন হলো- "জাতির পিতা" (Father of the Nation)যে স্বাধীনতা তারা আমাদের উপহার দিয়েছিল তা ইউরোপের উপনিবেশ রাষ্ট্র বৈকি কিছুই ছিলনা। এই জাতির পিতারা এমন জাতি রাষ্ট্র আমাদের উপহার দিল যেগুলো জাতীয় সীমানা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, জাতীয় দিন, জাতীয় ভাষা, জাতীয় স্বার্থে পরিপূর্ণ ছিল। প্রতিটি জাতিরই সুনির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র পরিচয় দেয়া হলো। কোন দু'টি জাতি রাষ্ট্রের অভিন্ন স্বার্থ থাকা চলবে না। এই জাতি রাষ্ট্রের ধারণা মুসলিম উম্মাহর জন্য ছিল খুবই ধ্বংসাত্মক। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" তথা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম উম্মাহর মর্মান্তিক পরিণতি আমাদের আরো একটিবার এই "জাতীয়তাবাদ" নামক ষড়যন্ত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জাতীয়তাবাদ এমন এক রাজনৈতিক হাতিয়ার যা মানুষদের খুবই আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। অতপরঃ "Divide and Rule" নীতি খুবই সফলতার সাথে আত্মকেন্দ্রিক এই মানুষদের উপর প্রয়োগ করা যায় যা ৫০ এর বেশী মুসলিম জাতি-রাষ্ট্র সমূহে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান। তাইতো ইরাক আক্রমণ হলে শক্তিশালী ইরান নিশ্চুপ থাকে, অসহায় ফিলিস্তিনেরা মুসলিম সৈন্যদের দিকে শুধুমাত্র তাকিয়েই ছিল। সাহায্য পাওয়া দূরেই থাক ফিলিস্তিনের এই জাতীয় সমস্যা নিয়ে জর্ডান, সিরিয়া নিজেকে জড়াতে চায়না, যেরকম আফগান জাতির নিজস্ব সমস্যা নিয়ে পারমানবিক ক্ষমতাধর পাকিস্তান মোটেও আগ্রহী নয়। এভাবেই ইউরোপ/আমেরিকা মুসলিম উম্মাহকে একাধিক জাতি-রাষ্ট্র বিভক্ত করে "জাতীয়তাবাদ" নামক রাজনৈতিক মারনাস্ত্র এমনসব ক্ষমতালোভী নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছে যাদের উদ্দেশ্যই হলো মুহাম্মাদ (সা) এর উম্মাতকে যত পারা যায় বিভক্ত রাখা আর তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের হাতে উম্মাহর সম্পদ ও সম্মান নজরানা হিসেবে উপহার দেয়া। এই "হামান" আর "কারুন"রাই উম্মাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা একের পর এক করেই যাচ্ছে আজকের ফেরাউন "আমেরিকার" পক্ষে। তাই আমেরিকা-বৃটেন আজ আমাদের বুকে ছুরি চালাচ্ছে আমাদের পেটের ওপরেই বসে। তারা আজ ইরাক, আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখল করে রেখেছে মুসলিম দেশসমূহের ঘাঁটিসমূহে অবস্থানের মাধ্যমে। কাতারের আদিদ ঘাঁটি, সৌদি আরবের আমীর সুলতান ঘাঁটি, দোহার আহমেদ আল জাবির ঘাঁটি, কুয়েতের আরিফজান প্রশিক্ষণ ঘাঁটি, ওমানের মুসিরা ঘাঁটিসহ বাহরাইন, তুর্কি, পাকিস্তান্ ও উজবেকিস্তানে কুফফার সৈন্যদের অবস্থান হলো মুসলিম এই মক্কেল শাসকদের আতিথিয়তা ও উদারতার জ্বলন্ত প্রমাণ। এই দালালরাই পরাশক্তি ইউরোপ ও আমেরিকার স্বার্থে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে দিচ্ছেনা- একদার মুসলিম উম্মাহকে ৫০ এরও বেশী শক্তিহীন জাতি-রাষ্ট্রে পরিণত করে রেখেছে। "প্রভু" ও "মক্কেল"দের "জাতীয়তাবাদ" নামক এই হীন ষড়যন্ত্র আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় উম্মাহর বর্তমান সমস্যাই হলো রাজনৈতিক সমস্যা যার জন্য চাই উম্মাহকে পুনরায় একত্রিত করা এবং খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাগুতের মূলোৎপাটন এবং এর জন্য চাই বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক এক আন্দোলন যার একমাত্র উদ্দেশ্যই হবে খিলাফত ফিরিয়ে আনা।

খিলাফত পতন পরবর্তী বিভিন্ন পুনর্জাগরণী আন্দোলনঃ

পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা ২০০ বছরেরও অধিককাল শোষিত হওয়া এবং পরিশেষে খিলাফত ধ্বংসের পরবর্তীতে বহু ইসলামী আন্দোলন ও ব্যক্তিত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল উম্মাহকে তার এই করুণ বাস্তবতা থেকে উদ্ধার করতে। উম্মাহ এমন অসংখ্য আন্দোলন দেখলো যা "মুক্তির" কথা বলে মূলতঃ পশ্চিমা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা গ্রহণ করেছিল। বিগত ২০০ বছরের মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তা মুসলিমদের রাজনৈতিক শক্তির পতন ও পশ্চিমা পুজিবাদী রাজনৈতিক শক্তির ও সভ্যতার উত্থানের বিপরীতে সার্বিকভাবে প্রতিক্রিয়া বৈ আর কিছুই ছিলনা। পশ্চিমের বিজ্ঞান প্রযুক্তি আর অথনৈতিক অর্জন মুসলিম চিন্তাবিদদের এতই মোহিত করেছিল যে তারা পশ্চিমের দেয়া "প্রগতি" (Progress)'র সংজ্ঞাই নিজেদের সমাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় মনে করল। প্রচুর সময় ও শক্তি ব্যয় করা হলো ইসলাম ও পশ্চিমা "প্রগতির" ভেতর সেতুবন্ধন তৈরীতে। পশ্চিমা "প্রগতির" সাথে ইসলামের সমন্বয়সাধন করতে গিয়ে অবশেষে এই মুসলিম মনীষীরা ইসলামের জন্য "জাতীয়তাবাদ" "পুজিবাদ" "গণতন্ত্র" এমনকি "সমাজতন্ত্র"ও বেছে নিতে শুরু করেছিলপশ্চিমের সাথে সেতু তৈরীর এই প্রচেষ্টা আমরা এখনো দেখতে পাই "Islamization" (ইসলামীকরণ), "Integration" ও "Interfaith dialogue" এর মাধ্যমে। পশ্চিমের এই মোহই এসব "Islamist"দের ৮০ এর দশকে বিশ্বাস করিয়েছিল যে আমেরিকা হলো "খোদাহীন (Godless) সমাজতন্ত্রের" বিরুদ্ধে মুসলমানদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু (Ismail Fargi in ARABIA, London June 1982)আসুন এবার আমরা দেখি কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী পুনজার্গরনী ইসলামী আন্দোলন ও ব্যক্তিত্বের ইতিহাস যারা পুনর্জাগরন করাতো দূরেই থাক বরং উম্মাহর বাস্তবতা আরো করুণ করে তুলেছিল।

আরব জাতীয়তাবাদঃ

খ্রিষ্টান লেভান্টিন (Levantine) লেখকদের মস্তিস্ক প্রসূত আরব জাতীয়তাবাদী চেতনা ও চিন্তাধারা যার দ্বারা ওসমানীয় খিলাফতকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেই একই চিন্তাধারা পরবর্তীতে আবারো মাথাচারা দিয়ে উঠেছিল আরব মুসলমানদের পুনর্জাগরিত করতে যা আজ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেনিমধ্য প্রাচ্যের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল আরব জাতীয়তাবাদের শূন্য স্লোগান শুনে। আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও পুনর্জাগরনী ব্যক্তিদের আবির্ভাব বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই মিশর থেকেই শুরু হয়েছিল। অতীতে জামাল আব্দুল নাসের এবং নিকট অতীতে সাদ্দাম হোসেন উপসাগরীয় অঞ্চলের সংকটকে কেন্দ্র করে উম্মাহর আবেগ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল। এই শাসকদের কারণেই উম্মাহ যুগে যুগে আরো বিভক্তির শিকার হয়ঃ জাতিগত বিভাজন আরো প্রকট হয়। আরব জাতীয়তাবাদের বিবর্তীত আধুনিক রূপ আমরা দেখতে পেয়েছি "আরবলীগ" সৃষ্টির মাধ্যমে। এই লীগ মুসলিম দেশসমূহের ভেতর জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উজ্জীবিত রেখেছে এবং দেশসমূহের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে মূলতঃ বৃটেন ও ফ্রান্স দ্বারা অংকিত আরব বিশ্বের মানচিত্র অটুট রেখেছে।

আরব জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ইতিহাসের এক চরম পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল মিশরের জামাল আব্দুল নাসের ১৯৫০ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর। সে তার "Philosophy of Revolution" বইতে মিশরের ব্যাপারে তার স্বপ্ন তুলে ধরেছিল। মিশরকে সে আরব বিশ্বের নেতা, মুসলিম বিশ্বের নেতা এবং কালো আফ্রিকানদের নেতা হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খালের রাষ্ট্রয়াত্ব করা ও তার দু'বছর পরে ১৯৫৮ সালে মিশরকে সিরিয়ার সাথে একত্রিত করে "United Arab Republic" এর গঠন আরব জাতীয়তাবাদের দাবীকে আরো শক্তিশালী করে। কিন্তু ১৯৬১ সালে সালে এই "United Arab Republic" এর ভাঙন এবং ১৯৬৭ সালে সিনাই পর্বত দখলের মাধ্যমে ইসরাইলের কাছে পরাজয় এই আরব জাতীয়তাবাদীর ইতি টানে। পরবর্তীতে সকলের কাছ এটা অজানা ছিলনা জামাল আব্দুল নাসের মূলত আমেরিকার নগণ্য এক সহচারী যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে CIA Mukhabarat (গোয়েন্দা সংস্থা) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিল। এই বিখ্যাত আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আজ পর্যন্ত ব্যর্থতার প্রতিমা হিসেবেই রয়ে গেলে। খিলাফত ধ্বংসের আগ থেকে ধ্বংস পরবর্তী সময়ে যত বিখ্যাত আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মাথাচারা দিয়ে উর্ঠেছিল তার কোনটারই বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক ভিত্তি ছিল না। খিলাফতের পতনের প্রাক্কালে আরব জাতীয়তাবাদের নামে কিছু আরব দেশকে ওসমানী খিলাফতের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং ধ্বংস পরবর্তীতে এই উম্মাহ যাতে আবার একত্রিত হতে না পারে তাই বহু বিখ্যাত আন্দোলন ও মুসলিম চিন্তাবিদ তৈরী করা হয়েছিল যাদের পশ্চিমা বিশ্ব রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করেছিল, তাই এদের দ্বারা কখনোই মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়। Bathist এবং Nasirrist যারা তথাকথিত "জাতি-রাষ্ট্র" গঠন ও স্বাধীনতা লাভের সময় ক্ষমতায় আরোহন করেছিল পরিকল্পিতভাবেই তারা ধর্মনিররপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে মুসলিম দেশসমূহের ভেতর প্রভাবশালী করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। আরব জাতীয়তাবাদ তাই মুসলিম আরব দেশসমূহে পশ্চিমা শক্তির চিরস্থায়ী আসন গেড়ে বসার Trojan Horse এ পরিণত হয়েছিল। তাই উম্মাহর পুনর্জাগরণ দুরেই থাক, উম্মাহকে পশ্চিমা শক্তির অতল গহ্বরে তলিয়ে দিতে আরব জাতীয়তাবাদ হতাশাজনক ভূমিকা পালন করেছিল।

সউদী আরব ও উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহের ভূমিকাও মুসলিম পুনর্জাগরণে উল্লেখযোগ্য, ১৯২৩ সাল থেকে সউদ পরিবার আজ পর্যন্ত খুবই কড়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আসছে সউদি আরবে। তেল সমৃদ্ধ অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও কোন উন্নতি আমরা দেখতে পাইনি এই দেশে। তেল থেকে যে পরিমান মুদ্রা অর্জিত হয় তার প্রায় সবটুকুই সউদী আরব Swiss Banks এবং পশ্চিমা দেশের বিভিন্ন Investment House সমূহে ১৯৪০ সালে থেকে নিয়মিত ঢেলে আসছে।

সেই খিলাফত ধ্বংসের আগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পশ্চিমা কুফর শক্তি সবচেয়ে বড় দোসর সউদী আরবের সউদ পরিবার উম্মাহর সাথে অবিরত বিশ্বাস ঘাতকতা করেই আসছে। সাইয়্যেদ কুতুব সহ ইখওয়ানুল মুসলিমীন এর বড় বড় নেতাদের জামাল আব্দুল নাসেরের সরকার দ্বারা হত্যা ও নির্যাতনের এক পর্যায়ে সউদী আরব এদের আশ্রয় দানের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে ফেলার চেষ্টায় সফল হয় যার পরবর্তীতে ইসলামী আন্দোলন ও দাওয়া আরেক দফা বিকৃতির স্বীকার হয়। আশ্রয়দানের মাধ্যমে এক সময়কার ত্যাগী ইখওয়ান নেতাদের সউদী সরকার আরাম প্রিয় ও সুবিধাভোগী Islamist এ পরিণত করে। একই প্রকারের বাস্তবতা আমরা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির ইতিহাসেও দেখতে পাই। একদার ত্যাগী এই ইখওয়ান ও জামাতী নেতৃত্ব এখন ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উম্মাহকে পুনরজ্জীবীত করার নামে মুলতঃ Pro-saudi (সৌদি ঘেষা) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত রয়েছে। নিজেদের আসল এজেন্ডা গোপন করার জন্য এরা বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠানের নামে কুরআনের কপি বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। বিশ্বব্যাপী মুসলিম চিন্তাকে পথভ্রষ্ট করার জন্য এরা সউদী অনুদানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও চিন্তাবিদ তৈরী করেই যাচ্ছে যার মধ্যে ISNA (Islamic Society of North America), ওয়াশিংটনের North American Islamic Trust (NAIT), International Institute of Islamic Thought (IIIT), East-West University of Chicago, বৃটেনের Federation of students' Islamic societies, International federation of students' organization (IFSO) এবং কুয়ালালামপুরের ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তারা বিশ্বব্যাপী সউদী যোগ্যতাসম্পন্ন (Saudi-qualified) দাওয়াকারী, চিন্তাবিদ ও ইমামদের বেতন দিয়ে থাকে। সউদী আরবে এ বিশাল গুরু দায়িত্ব সরকার একাই সামাল দেয় না, বরং প্রধান তিনটি সউদী নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান যারা বিশ্বব্যাপী "American Islam" বিস্তারের এ মহান দায়িত্ব পালন করে যচেছ তারা হলো মক্কার- Rabita Al-Alam-Al Islami, দারুল ইফতা এবং রিয়াদ ভিত্তিক World Assembly of Muslim Youth (WAMY)ইতিহাসের নির্মম পরিহাস ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনের দুইটি বৃহৎ শক্তি - ইখওয়ান ও জামায়াত, কিভাবে সইচ্ছায় ইসলামকে বিরাজনীতিকরণের (depoliticization) সউদী-আমেরিকার ষড়যন্ত্রের অস্ত্রে পরিণত হলো।

এভাবেই শুধু মিশর সউদী আরব সহ মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসমূহই নয় বরং তুরস্ক, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইরান, পাকিস্তান, মালয়শিয়াসহ অসংখ্য দেশ মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

উম্মাহ বারে বারে শুধু তাকিয়েই ছিল নতুন আন্দোলন ও নেতৃত্বের দিকে কিন্তু কিছুতেই এসব আন্দোলন পশ্চিমা বলয় থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। নব্য-সাম্রাজ্যবাদ (Neo-colonialism) বরাবরই এসব আন্দোলনের নেতৃত্ব সরবরাহ করে আসছে। নব্য সাম্রাজ্যবাদ মূলতঃ আরো ভয়ানক এক প্রক্রিয়া ছিল যা সাম্রাজ্যবাদকে নতুন করে গঠন করেছিল। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী দল ও আন্দোলনসমূহ প্রকৃত পক্ষে পশ্চিমা সভ্যতার জন্য আতংকের কোন বিষয়ই ছিলনা বরং সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে নতুন রূপে বিভক্ত মুসলিম দেশসমূহে পশ্চিমা প্রভাব চিরস্থায়ী করতে। পরবর্তীতে "জাতিসংঘ" প্রতিষ্ঠা করা হলো এই শোষণের প্রতিষ্ঠানিক রুপ দিতে।

জাতীয়তাবাদ জ্বরে আক্রান্ত মুসলিম পুনর্জাগরণী মনীষাঃ

শত বৎসরেরও অধিক কালের পশ্চিমা সভ্যতার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসণ মুসলিম উম্মাহকে এমনভাবে ধরাশায়ী করেছিল যে আমরা দেখতে পেয়েছি প্রতিটি পুনর্জাগরণ আন্দোলন পশ্চিমা ছকের ভেতর বন্দি ছিল। পশ্চাৎপদ ও বিভক্ত উম্মাহকে পুনর্জীবিত করার লক্ষে বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী মনীষার অবির্ভাব হয়েছিল যারাও জাতীয়তাবাদ জ্বরে প্রবলভাবে আক্রান্ত ছিল। আমার এই প্রবন্ধের এক পর্যায়ে বলেছিলাম এই পন্ডিতদের চিন্তাসমূহ মূলতঃ পশ্চিমা সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের বিপরীতে নিছক প্রতিক্রীয়া ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। পশ্চিমা সভ্যতা মুসলিম উম্মাহকে এমনই কিছু পরাজিত মানসিকতার (Defeatist mentality) পন্ডিত উপহার দিয়েছিল যারা যদিও বা মুসলিম ঐক্যের কথা বলতেন কিন্তু খিলাফতকে সমাধান মনে করতেন না, যারা যদিও বা মনে করতেন মুসলমানদের পতনের মূলে ইজতিহাদ চর্চার বন্ধই হলো মূল কারণ, আবার সমাধান হিসেবে এও মনে করতেন ইজতিহাদ চর্চার মাধ্যমে ১৪০০ বছরের পুরনো ইসলামকে 'সংস্কার' (Reform) করতে হবে। ওরিয়েন্টলিসাম এবং জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত এমন সব কিছু পন্ডিতদের ব্যাপারে এখন আলোচনা করব যারা পুনর্জাগরিত করার নামে মূলতঃ উম্মাহকে সাম্রাজ্যবাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছেল।

আল্লাহর রাসূল (সা) এর একটি হাদীস দিয়েই লেখার এ পর্বটুকু শুরু করতে চাই। উরওয়া বিন আল যুবায়ের থেকে বর্ণিত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আল আস রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছে "আল্লাহ তোমাদের জ্ঞান দানের পর তা থেকে তোমাদের বঞ্চিত করবেন না। কিন্তু এই জ্ঞান আল্লাহ উঠিয়ে নিবেন ধার্মিক জ্ঞানী ব্যক্তিদের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। অতঃপর কিছু মুর্খ লোক তোমাদের মাঝে বিদ্যমান থাকবে যারা নিজেরা পরামর্শ করে এমন সব ফতোয়া দিবে যা তোমাদের ভুল পথে চালিত করবে" [বুখারী]

এমনই কিছু মূর্খ মুসলিম পন্ডিত উনিশ শতকের গোড়াতে শক্তিশালী জীবনব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদের উত্থানের বিপরীতে ঘুণে ধরা খিলাফত ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারছিলেন না। পতিত সভ্যতাকে কোন চিন্তার ভিত্তিতে পুনর্জীবিত করা যায় তারা সেটি বোঝার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। ইসলামের মৌলিক চিন্তা (Fikrah) এবং এই চিন্তাকে বাস্তবায়নের পদ্ধতি (Tareeqah) কি, কিভাবে চিন্তা ও পদ্ধতি একে অপরের সাথে সম্পর্কিত - এসবের ব্যাপারে তারা বোধশক্তি অর্জন করতে ব্যর্থ হয় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব পশ্চিমা সভ্যতাকে দিয়ে সন্তুষ্ট থাকে।

রিফা রাফি আল তাহতাওয়ি (মিশর, ১৮০১-১৮৭৩)

মুসলিম উম্মাহকে পশ্চিমীকরণের অগ্রপথিক হলো এই তাহতাওয়ি যাকে পাঠানো হয়েছিল প্যারিসে যাতে ফেরত এসে সে পশ্চিমাদের গুণকীর্তন করতে পারে। তার আত্মজীবনী বই -Takhlis al Ibris ila talkhis bariz (The extraction of Gold, or overview of paris, 1834) এ সে প্যারিসের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, কাজের প্রতি ভালবাসা এবং সর্বপরি সামাজিক মুল্যবোধ দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করেছে। ইসলামী সমাজে মহিলাদের স্বাধীনতা এবং খিলাফত ব্যবস্থায় পশ্চিমা ধাঁচের সংস্কার সাধনের পক্ষে সে মত দিয়েছিল। তাহতাওয়ির সূচিত এই সংস্কার পরিকল্পনা আজ পর্যন্ত মুসলিম দেশসমূহে বাস্তবায়নের কাজ চলছে তার উত্তরসূরিদের দ্বারা।

জামালউদ্দীন আফগানি আসাদাবাদি (ইরাক, ১৮৩৯-১৮৯)

যেসব মুসলিম পন্ডিত পশ্চিমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দেখে মনোমুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল জামাল উদ্দীন আফগানি তাদের মধ্যে অন্যতম। সে আধুনিকতার ব্যাপারে ইসলামের অপারগতার কথা অকপটে স্বীকার করল পশ্চিমাদের কাছে। তাই তাকে চিহ্নিত করা হয় "আধুনিক মুসলিম চিন্তা"র জনক। প্রখ্যাত পশ্চিমা দার্শনিক "Ernest Renan" যখন তার লেকচার "ইসলাম ও বিজ্ঞান (La Islamime et la Science) এর মাধ্যমে ইসলামকে আক্রমণ করল এ বলে যে ইসলাম বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও দর্শন তৈরীতে অক্ষম। তখন আফগানী অপরাধস্বীকারমূলক ভঙ্গিতে Renan এর কাছে মাফ চেলেন Journal des Debats (March 27,1883) এ চিঠি পাঠিয়ে। আফগানি স্বীকার করলেন সে ইসলাম ধর্ম মানুষের যুক্তির অবাধ প্রয়োগে (Free use of Reason) বাঁধা দিয়ে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।

অথচ অতীতে আমরা দেখতে পেয়েছি ইসলামী চিন্তাবিদরা "জ্ঞান" (Uloom) কে দুটি ভাগে ভাগ করতেন। ইবনে খালদুন তার বিখ্যাত "আল মুকাদ্দিমা"য় স্পষ্ট করে বলেছেন "জ্ঞান দুপ্রকারের (১) প্রাকৃতিক, যা সকল জাতি তার চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে বিকশিত করতে পারে (২) ঐতিহাসিক বা পাঠসংক্রান্ত, যে ব্যাপারে হুকুম শরীয়ার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। মানুষের মন কখনোই এসবের ব্যাখ্যা দিতে পারেনা।" এই বিভাজন খিলাফত পতনের আগ থেকে পতন পরবর্তীতে কোন পন্ডিতই বুঝতে পারেনি। খিলাফত ধ্বংসের পর (Uloom) জ্ঞানের ব্যাপারে এরকম মৌলিক চিন্তা আমরা প্রথমবারের মতো দেখতে পাই শেখ তাকিউদ্দীন নাবহানী (রহ) এর লেখনিতে। তিনি "হাদারাহ" ও "মাদানিয়া"র চিন্তার দ্বারা ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছেন।

মুহাম্মাদ আব্দুহ (মিশর ১৮৪৯-১৯০৫)

মুহাম্মাদ আব্দুহ হলো জামালউদ্দীন আফগানির ঘনিষ্ট সহকর্মী। উম্মাহর ক্ষতিসাধনকারী এরকম পন্ডিতের ব্যাপারে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা কির কম আত্মবিশ্বাসী ছিল তা একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়- ১৮৮৪ সালে আব্দুহ প্যারিসে বসে যে বৃটিশদের বিরুদ্ধে কথা বলত, সেই একই বৃটিশরা আব্দুহকে "শাইখুল আযহার" (Shekh ul Azher) পদে ভূষিত করেছিল যখন সে মিশরে ফেরত আসে। আব্দুহ বিশ্বাস করত "নৈতিকতা" ও "আইন" যুগে যুগে পরিবর্তন সম্ভব সাধারণ মানুষের কল্যাণ (Maslaha) কে বিবেচনায় রেখে। সে মনে করত ভাল (খায়ের) ও খারাপ (শার) নিজের ইজতিহাদী যোগ্যতা দ্বারা নির্ণয় করা সম্ভব কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই তা পারেনা।

এছাড়াও আব্দুহ ও জামাল আফগানী খিলাফতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে উম্মাহর সব সমস্যার সমাধানে বিশ্বাস করতেন না। তারা মনে করতেন মুসলিম দেশসমূহ একত্রিত থাকুক কিন্তু সব দেশের জন্য একজন খলীফার প্রয়োজন নেই। এদের এই বিখ্যাত চিন্তাকে বলা হতো "Pan-Islamism" যা পরবর্তী "Pan-Arabism" এ রূপলাভ করে। আব্দুহর চিন্তার পতন এত নীচে তলিয়ে গিয়েছিল যে ভারতীয় মুসলিমদের আল্লাহর আইন (হুকুম শরীয়াহ) এর পরিবর্তে "British" আইন মেনে নিতে বলেছিল "মন্দের ভালো" (Lesser of two evils) এর "ইজতিহাদী" নীতির উপর ভিত্তি করে [Tafsir al-Manar, Vol 6, p. 406-409, Muhemmad Abduh]এভাবে "মন্দের ভালো" "Take and  demand" ইত্যাদি ভুয়া শরীয়া নীতির দ্বারা প্রথমত খিলাফতকে দূর্বল ও ধ্বংস করা এবং পরবর্তীতে এই ধ্বংসকে অব্যাহত রাখার জন্য বহু অবদান আব্দুহদের রয়েছে।

রাশিদ রিদা (সিরিয়া ১৮৬৫-মিশর ১৯৩৫)

রাশিদ রিদা ছিল মুহম্মাদ আব্দুহর ছাত্র ও তার সময়কার সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম আইন শাস্ত্রবিদ যে মৃয়মান খিলাফতকে পুরোপুরি ধ্বংসের জন্য "সংস্কার" প্রস্তাব দেয়। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা মোহিত এই পন্ডিত "শুরা" (পরামর্শ) ব্যবস্থার প্রতি জোর দেন। রাশিদ রিদার বিখ্যাত যুক্তি যার দ্বারা সে খিলাফতকে "সংস্কার" করতে চেয়েছিল তা হলো- শরীয়া "ইবাদত" ও "মুয়ামালাত" (সামাজিক সম্পর্ক) দ্বারা গঠিত, মানুষের মনের তেমন কোন ক্ষমতা নেই ইবাদতের বিষয়ে পরিবর্তন আনার কিন্তু "মুয়ামালাত" বিভিন্ন প্রজন্ম ও সমাজের জন্য প্রয়োজনে পরিবর্তিত হতে পারে।

আলি আব্দুর রাযিক (১৮৮৮-১৯৬৬)

মুহাম্মাদ আব্দুহর আরেক শিষ্য যে খিলাফতের জানাযা পড়ানোর জন্য খুবই তৎপর ছিল সে হলো আলি আব্দুর রাযিক। তাকে বলা হতো "ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার পিতা" (Father of Islamic secularism)তার বিখ্যাত গ্রন্থ হলো "Islam and the principles of Government" (Al Islam wa usul Al-Hukm) যেটির মাধ্যমে সে ইসলামকে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক আচার আচরণের সমষ্টিতে বন্দি করতে চেয়েছিল। তার দাবি হলো ইসলামে কোন সুনির্দিষ্ট সরকার ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি, তাই খিলাফত ব্যবস্থা কখনোই বাধ্যতামূলক হতে পারেনা। তার ভাষ্য হলো ইসলামের আত্মিক উন্নতির (Personal Salvation) ধারণা সুস্পষ্টভাবে খিলাফতের আওতায় রাজনীতির ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলাম সব সময় ব্যক্তিগত ইবাদতের কথাই বলেছে, সিয়াসাহ (Politics) এবং ধর্ম কখনোই এক হতে পারেনা। সে আরো দাবি করেছিল যেহেতু সুস্পষ্ট ও বিশুদ্ধ দলিল নাই কুরআন ও সুন্নাহর এবং ইজমাও নেই খিলাফতের পক্ষে তাই কোন অর্থ হয় না খিলাফতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। বরং গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাই ইসলামকে রাজনৈতিক অপব্যবহার (Political Abuse) থেকে রক্ষা করতে পারে। মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংসের রসাতলে নিয়ে যাওয়া এসব মনিষী পশ্চিমাদের কোন পর্যায়ের দাস ছিল তার বড় প্রমাণ আব্দুল রাযিক এর মতো ভন্ড শরীয়াহ বিচারকদের লেখনী থেকে প্রমাণিত। সে তার বই "Al Islam wa Usul al Hukm" বইয়ে সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াত ["হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্ তার রাসূল (সা) ও উলিল আমরদের অনুসরণ কর"] টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১১৯ পৃষ্টায় উল্লেখ করে, "যদি তোমরা এ ব্যাপারে আরো বিশদ জানতে চাও তাহলে Sir Arnold Thomas এর "The Caliphate" বইটি পড়"। উল্লেখ্য Sir Arnold ছিলেন পশ্চিমা ইতিহাসখ্যাত Orientalist যার কাজই ছিল পরিকল্পিতভাবে ইসলামের ইতিহাস বিকৃত করা।

এভাবেই যুগে যুগে বেশ কিছু আলোড়নসৃষ্টিকারী পুনর্জাগরণবাদী মুসলিম চিন্তাবিদের উদয় হয়েছিল যাদের মূল কাজই সমাজ থেকে ইসলামকে পৃথক করা (Secularism)তাদের সংস্কারের বিষয়ই ছিল মুয়ামালাত, উকুবাত এবং এমন সব ইবাদত যা ব্যক্তিগত, উদাহরণস্বরূপ জিহাদ। এরকম মনীষী ও প্রতিষ্ঠান বর্তমানেও বিদ্যমান, যেমন- ইউসুফ আল কারদাওয়ি, Islam and Democracy Institute England, সুদানের ড. হাসান আল তুরাবি প্রমুখ। বিভিন্ন একাডেমি, Activist Traditional Alem রা এখনো আব্দুহ, রাযিকদের ভাবশিষ্য হয়ে আছে যারা ইসলামকে বর্তমান বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানো চেষ্টায় লিপ্ত, বরং ইসলাম দ্বারা বাস্তবতাকে পরিবর্তন তাদের উদ্দেশ্য নয়। এ প্রকারের (Compromising) সমঝোতামূলক আন্দোলন যে দল, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিই করুক না কেন মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণ এদের দ্বারা সম্ভব নয়। খিলাফতের পৃথিবীব্যাপী উপস্থিতি এদের বোধগম্য নয়। পশ্চিমা সাংস্কৃতিক অগ্রাসনের ফলশ্রুতিতে তাই রাজনৈতিকভাবে তারা জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিমাদের স্বার্থ সংরক্ষনের রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়েই রয়ে গেল।

খিলাফত যেভাবে জাতীয়তাবাদ সমস্যার সমাধান ও উম্মাহকে একত্রিত করবেঃ

কোন একটি অঞ্চলে খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা অতঃপর অন্যান্য মুসলিম দেশসমূহকে খিলাফতের ছায়াতলে একত্রিত করা অবশ্যই মুসলিম দেশসমূহে রাজনৈতিক গতিশীলতা (Dominno effect) ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করবে। কুফর শক্তির সকল ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতার ব্যর্থতার এক পর্যায়েই মূলতঃ আন্তর্জাতিক রাজনীতির পট-পরিবর্তনের মাধ্যমেই কোন এক দেশে খিলাফতের পুনরাবির্ভাব হবে যা অপরাপর সকল মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের উম্মাহর ভেতর প্রাণসঞ্চার করবে। জাতীয়তাবাদের মূল্যোৎপাটন ও মুসলিম দেশসমূহের একত্রীকরণের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় আমাদের বুঝতে হবে-

১. খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার বহুকাল আগ থেকে বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম দেশসমূহে খিলাফতের সঠিক আন্দোলন-এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম উম্মাহকে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করে তোলবে এবং জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনার উর্দ্ধে তুলে নিবে।

২. আমরা খুব সহজেই এটা বুঝতে পারি উম্মাহর করুণ ও শোচণীয় বাস্তবতা এবং পশ্চাৎপদতার মূল কারণটিই হলো রাজনৈতিক। তাই রাজনীতিকে দাওয়ার একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিয়ে উম্মাহ ও শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমান্বয়ে বিভাজন সৃষ্টির এক পর্যায়ে যখন খিলাফত "উম্মাহর দাবী" (Popular demand) তে পরিণত হবে তখন খিলাফত প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মীরা নুসরার মাধ্যমে খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে যা অন্যান্য সকল মুসলিম দেশসমূহের "আহলুল হাল্লি ওয়াল আকাদ" (ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী)দের দৃষ্টি আকর্ষণে বাধ্য করবে। ফলে খিলাফতের রাজধানীর সাথে একত্রিত হওয়ার জন্য সেসব দেশের প্রভাবশালীদের অবশ্যই দাবি জানানো হবে।

৩. উম্মাহর একত্রীকরণ মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক- এ তিন পর্যায়ে হতে হবে। কোন এক অঞ্চলে খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এই তিনটি বিষয়ে উম্মাহকে একত্রিত করবে। অতঃপর, প্রতিষ্ঠিত খিলাফতের সাথে অন্যান্য মুসলিম দেশসমূহের একত্রিত হওয়া কেবলই "সামরিক" বিষয় মাত্র হবে কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে অন্যান্য দেশসমূহের উম্মাহকে পুনর্জাগরিত করে রাখা হবে।

পরিশেষে এটা উল্লেখ করতে হবে খিলাফত যেভাবে জাতীয়তাবাদের ব্যধি থেকে উম্মাহকে বের করে এনে একে একত্রিত করবে তা বুঝতে হলে শুধুমাত্র আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচেনা করলে চলবে না। একদার সুপার পাওয়ার "খিলাফত" পুনঃপ্রতিষ্ঠা তাই বিশ্বব্যাপী সংগঠন ও আন্দোলনের (Global Movement) চোখ দিয়েই বোঝা সম্ভব।

উপসংহারঃ

এই নিবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করা হলো কিভাবে পরিকল্পিতভাবে ইসলাম বহির্ভূত "জাতীয়তাবাদ" নামক ব্যধি খিলাফতের ভেতর ছড়িয়ে এর ধ্বংস করা হলো। আরো দেখতে পেলাম ধ্বংসকালীন ও পরবর্তীতে পশ্চিমা স্বার্থান্বেষী পন্ডিতদের আবির্ভাব যারা উম্মাহর ভেতর থেকেই এর বুকে ছুরি চালিয়েছে যার ক্ষতদাগ আর যন্ত্রণা আজো এই মিল্লাত বহন করে চলেছে। যত আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল এবং এখনও টিকে আছে তার সবই জাতীয়তাবাদ এবং বিবর্তিত জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও সাংস্কৃতিক আক্রমণের স্বীকার। রাসূলের (সা) প্রিয় এই উম্মাহর জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একটি বৈশ্বিক (Global) দল যারা উম্মাহর এই সার্বিক পতন ঠেকাতে সক্ষম।  জাতীয়তাবাদের উর্ধে উঠে সংঘটিত এই দলটিকে হতে হবে সম্পূর্ণ নতুন চিন্তার ভিত্তিতে খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আপোষহীন। উম্মাহর সামগ্রিক চিন্তা যা সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা দূষিত তা থেকে বের কের আনার জন্য এ জাতিকে তার জীবনের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তবেই ফিরে আসবে নতুন এক শাসনব্যবস্থা 'খিলাফত' যা এই পুনর্জাগরিত জাতির বিষয়াদি ও স্বার্থের যত্ন নিবে।

আমাদের বুঝতে হবে উম্মাহর মূল সমস্যা অর্থনীতি, শিক্ষা, দূর্নীতি ইত্যাদি নয়, বরং খিলাফতের তত্ত্বাবধানে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অনুপস্থিতিই হলো মূল সমস্যা। খিলাফত ছাড়া উম্মাহকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সাম্রাজ্যবাদীরা খেলতে পারে- প্রবন্ধে আমরা তাই দেখতে পেলাম। আজ আমাদের সম্পদ কুফরের পদতলে, আমাদের জীবনের সম্মান ও নিরাপত্তা নির্ভর করছে তাদের মর্জির উপর, আমাদের মন আজ মিথ্যা ও দ্বীন ইসলামের বিকৃতির স্বীকার। এসব সমস্যা বার বার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ (Vital) বিষয়। আমাদের অবশ্যই অজ্ঞতার সময়কালীন দূর্নীতি ও অবিশ্বাসের শিকড়ের মূলোৎপাটন করতে হবে এবং আরো একবার উম্মাহর মুখে হাসি ফোটাতে হবে খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যার কথা আল্লাহর রাসূল (সা) বলে গেছেন- "....... এবং এরপর আবারো আসবে নবুওয়তের আদলের খিলাফত"। পরিশেষে অবশ্যই সকলকে খলীফা আলী (রা) র একটি উক্তি স্মরন করিয়ে দিতে চাই- "তোমাদের জীবন হলো অনেক মূল্যবান; যার বিনিময় মূল্য জান্নাত ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা। অতএব, শুধুমাত্র জান্নাতের মূল্যের বিনিময়ে একে বিক্রি কর"।

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা'র কাছে এ বলে দোআ করেই শেষ করব উনি যাতে আমদের জীবনের বিনিময়ে হলেও দুনিয়ার বুকে বহু প্রত্যাশিত এই খিলাফাহ এবং পরকালে আমাদের জান্নাতুল ফেরদৌস উপহার দেন। আমীন।


ইমতিয়াজ সেলিম
১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯