শুক্রবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১২

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা


ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কোনভাবেই একটি সহজ ও সরল কাজ নয়। ইসলামী রাষ্ট্র পূন:প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কতগুলো বিশাল প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যেগুলোকে প্রথমে ভাঙ্গতে ও অপসারণ করতে হবে। ইসলামী জীবনধারা পুন:গ্রহণের পথে কতগুলো প্রধান সমস্যা রয়েছে যেগুলো সমাধান করতে হবে। কারণ এটি শুধুমাত্র একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্ন কিংবা নামে মাত্র কোন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়, বরং এটি হচ্ছে এমন একটি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা যা ইসলামকে একটি ব্যবস্থা হিসাবে বাস্তবায়ন করবে যে ব্যবস্থাটি ইসলামী আকীদা হতে উদ্ভূত। এটি এমন একটি রাষ্ট্র যা ইসলামকে শরীয়াহ আইন অনুযায়ী বাস্তবায়িত করবে কারণ এ আইন আল্লাহ সুবহানুওয়াতা’লা কর্তৃক প্রদত্ত। এভাবে ইসলামী জীবনধারা প্রাথমিক ভাবে নিজরাষ্ট্রে পুন:গৃহীত হবে এবং পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া হবে।

ইসলামী রাষ্ট্র ইসলামী আকীদার ভিত্তিতে উদ্ভূত ধারণা ও আবেগের ভিত্তিতে গঠিত হওয়া প্রয়োজন। ইসলামী চিন্তা ও যৌক্তিকতায় লালিত এবং ইসলামী আদর্শ ও পদ্ধতি দ্বারা গঠিত ইসলামী মানসিকতা সমাজের নাগরিকদের মাঝে বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন। শরীয়াহ আকড়ে থাকার উৎসাহ আসতে হবে নিজের ভেতর থেকে। এ ইসলামী আচরণ মানুষের দ্বারা স্বেচ্ছায়, উৎসাহী ও শান্তিপ্রিয় মনে ইসলামী ব্যবস্থা ও এর আইন বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।

ইসলামী রাষ্ট্রের উম্মাহ ও শাসকবর্গ উভয় ক্ষেত্রেই ইসলামিক হতে হবে। এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামীক হবে যা ইসলামী জীবনধারার পূন:গ্রহনকে এমনভাবে নিশ্চিত করবে যেন সে সমগ্র বিশ্বে ইসলামের দাওয়াত পৌছে দিতে সক্ষম হয়। এতে পর্যায়ক্রমে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম নাগরিকগণ ইসলামী আলোকচ্ছটা অবলোকন করতে পারবে এবং দলে দলে আল্লাহ সুবহানুওয়াতায়ালার দ্বীনে প্রবেশ করতে পারবে।

এ কারণেই ইসলামী জীবনধারা পূণ:গ্রহনের ক্ষেত্রে যে সকল সমস্যা রয়েছে তা সংখ্যায় অগণিত। এ সমস্যাগুলোকে নিরীক্ষা করা ও তার সমাধানে স্পষ্ট একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

এসকল প্রতিবন্ধকতার মধ্যে সর্বাপেক্ষা মারাত্মকগুলো নিম্নরূপ:

১. ইসলামী বিশ্বে অনৈসলামিক চিন্তাধারণার উপস্থিতি। এর কারণ হচ্ছে ইসলামী বিশ্ব একটি অধ:পতনের যুগ অতিক্রম করছে যেখানে সাধারণভাবে রয়েছে চিন্তার অগভীরতা, জ্ঞানের অভাব, এবং যুক্তি উপাস্থাপনায় দুর্বলতা ইত্যাদি। যেখানে অনৈসলামিক ধারণাগুলো প্রতিনিয়ত ইসলামী ধারণার সাথে শক্ত বিরোধ তৈরী করছে। এ ধরণের সাংঘর্ষিক অনৈসলামিক ধারণাগুলো গড়ে উঠেছে বর্তমান জীবন, এ জীবনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে ইসলাম বহির্ভূত এক বিভ্রান্তিকর উপলব্ধি থেকে। এধরণের ধারণাগুলো বাধাহীনভাবে বিকশিত হবার জন্য মুসলিমদের মন একটি উপযুক্ত ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ফলে অনায়াসেই এ ধরণের ভ্রান্ত ধারণাগুলো গভীরে শিকড় বিস্তার করছে। ফলে মুসলিমদের মানসিকতা, বিশেষত শিক্ষিত মুসলিমদের মানসিকতায় এ ধরণের ভ্রান্ত ধারণার প্রত্যক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় অনুকরণপ্রিয় একটি মানসিকতা তৈরী হয় যার মাঝে কোনরকম সৃষ্টিশীলতার লেশ মাত্র নেই। এ ধরণের মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি ইসলামী আদর্শ গ্রহণে অপ্রস্তুত এবং ইসলামী আদর্শের নির্যাসটুকু অনুধাবনে, বিশেষত ইসলামের রাজনৈতিক স্বরূপ বুঝতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়।

ইসলামের দাওয়াতের অর্থ হচ্ছে ইসলামী জীবনধারা পূণরায় গ্রহন করার আহ্বান। অমুসলিমদের ইসলামের প্রতি আহ্বান করা হয় ইসলামী ধারণার সঠিক উপস্থাপনের মাধ্যমে। মুসলিমদের নিকট ইসলামকে যথার্থভাবে ব্যখ্যা করার পর ইসলামের পূন:গ্রহণের জন্য কাজ করার আহ্বানের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়। এর মাধ্যমে অনৈসলামিক ধারণাগুলোর দুর্বলতা ও তাদের ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা প্রকাশ করা সম্ভব হয় এবং এভাবে দাওয়াহ একটি রাজনৈতিক রূপ লাভ করে যেখানে উম্মাহকে সম্পৃক্ত করার সাথে সাথে তাদের জীবন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী, অর্থাৎ এ জীবন, জীবনের পূর্বে ও পরের বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়া হয়। এটি করতে গিয়ে জীবনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়। এভাবেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করা যায়।   

২. স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাস্তবায়িত ঔপনিবেশিকদের প্রবর্তিত শিক্ষা কার্যক্রম এবং পদ্ধতি। যে সকল ব্যক্তিবর্গ সরকার, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত এবং যারা এধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শিক্ষা লাভ করেছে, তারা ঔপনিবেশিকদের সাজানো পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা ও তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের একটি স্পষ্ট মানসিকতা গ্রহণ করে থাকে। ঔপনিবেশিকদের প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে এটি পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা দেখতে পাই যে, ঔপনিবেশিক চাকরদের স্থানে বর্তমানে মুসলিমরা স্থান করে নেয়ার পরও তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন রয়েছে আর তা হচ্ছে একই ভাবে ঔপনিবেশিক আইন, সংস্কৃতি, নীতিমালা এবং ব্যবস্থার সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে বর্তমান মুসলিমরা বরং ঔপনিবেশিক প্রভূদের চাইতে কঠোর অবস্থান গ্রহন করেছে। এ ধরণের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলার উপায় হচ্ছে এসকল শাসকবৃন্দের ও সরকারী কর্মকর্তার মুখোশ উন্মোচন করে দেয়া, তাদের কার্যকলাপ প্রকাশ করে দেয়া যাতে জনসমক্ষে ঔপনিবেশিকতার কদর্য রূপটি প্রকাশ হয়ে যায়। এর মাধ্যমে এধরণের নীতিমালা ও ব্যবস্থা সংরক্ষণের প্রক্রিয়া ব্যহত হবে এবং দাওয়াহ মুসলিমদের নিকট সঠিক সমাধান বা পথ তুলে ধরবে। 

৩. অবিশ্বাসী ঔপনিবেশিকদের প্রবর্তিত পাঠ্যসূচী’র অব্যহত বাস্তবায়ন, অধিকাংশ স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীর অনুসৃত ঔপনিবেশিক পদ্ধতি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনৈসলামিক পথে অগ্রসরমানতা। আমরা এখানে শিক্ষা কার্যক্রমের বিজ্ঞান ও শিল্প সংক্রান্ত বিষয়গুলোর কথা বলছিনা, কারণ এগুলো একটি সার্বজনীন বিষয় যা কোন বিশেষ উম্মাহ’র সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। আমরা এখানে ঐ সংস্কৃতির কথা বলছি যা জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রভাবিত করে। কারণ জীবনের প্রতি এ ধরণের অনৈসলামিক দৃষ্টিভঙ্গী এমন সব শিক্ষা কার্যক্রম ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বাধ্য করে যা ইসলামী জীবন পদ্ধতি পূণ:গ্রহণের পথে অন্তরায় বা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এসকল বিষয়ের মধ্যে রয়েছে ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন এবং আইনশাস্ত্র। ইতিহাস জীবনের কার্যকর প্রতিফলন, সাহিত্য মানুষের আবেগ-উদ্দীপনাকে প্রতিফলিত করে, দর্শন হচ্ছে সেই ধারণার মূল যার উপর ভিত্তি করে মানুষের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী গঠিত হয় এবং আইন শাস্ত্র হচ্ছে মানুষের জীবনের বাস্তব সমস্যা গুলোর সমাধান নিয়ে নাড়াচাড়া করে এবং একজন স্বতন্ত্র কিংবা গোষ্ঠীর মধ্যকার লেনদেন ও এ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। সার্বিকভাবে এ বিষয়গুলোর সমন্বয়ে তৈরী হয়েছে ঔপনিবেশিকদের সংস্কৃতি যার মাধ্যমে তারা  মুসলিমদের চিন্তা চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। একারণেই কিছু মুসলিম মনে করেছে, তাদের ও উম্মাহ’র জীবনে ইসলাম একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইসলামের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন বা শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে এবং জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধানে ইসলামের পারদর্শীতাকে অস্বীকার করেছে। কাজেই এধরণের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। এটি করা সম্ভব বর্তমান সময়ের তরুণ প্রজন্মকে প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে সঠিক সংস্কৃতির মাধ্যমে পরিচর্যার মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজন নিবিড় ও প্রগাঢ় শিক্ষা, ইসলামী চিন্তা, ধারণা ও আইন সম্পর্কে  অনুসন্ধিৎসু আলোচনার সূত্রপাত করা।

৪. সংস্কৃতি ভিত্তিক বিষয়, যেমন সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, এবং শিক্ষা বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলোকে অপ্রয়োজনীয় সম্মান প্রদান ও বিভ্রান্তিমূলক ভাবে এদের কে বিজ্ঞান হিসাবে আখ্যায়িত করা। অধিকাংশ লোকই এসকল বিভাগকে বিজ্ঞানের অংশ হিসাবে জানে এবং ধারণা করে এ সকল বিষয়ে যা কিছু পড়ানো হয় তা বাস্তব পরীক্ষা নির্ভর তথ্যের ভিত্তিতে প্রাপ্ত। ফলে তারা এ বিষয়গুলোকে খুব সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকে এবং মনে করে এ বিষয় গুলোর রায় বা সিদ্ধান্ত সমূহ সবরকম বিতর্কের উর্ধে। এ কাজটি করতে গিয়ে তারা তাদের জীবনের সকল সমস্যার সমাধানের জন্য এ বিষয়গুলোর দ্বারস্থ হয় এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ বিষয়গুলোকে বিজ্ঞান হিসাবে পড়ানো হয়। ফলাফল স্বরূপ, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদদের বক্তব্য গুলোকে তর্কাতীত সর্বোচ্চ দিক নির্দেশনা (রেফারেন্স) হিসাবে গ্রহণ করা হয় এবং তাদের কুরআন ও হাদীসের চাইতেও অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। অথবা এ বিষয়গুলোকে ইসলামের বক্তব্যের সাথে মিশিয়ে বিভ্রান্তিমূলক ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গীর জন্ম দেয়া হয়। 

এভাবে জনমানুষের পক্ষে এ বিষয়গুলোর সাথে বিপরীতধর্মী ও সাংঘর্ষিক কোন বিষয়কে গ্রহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এটি সুনিশ্চিতভাবে ব্যক্তি বা জন জীবনের সকল কাজ থেকে দ্বীনকে পৃথক করার দিকে নিয়ে যায় এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাড়ায়। বাস্তব সত্য হচ্ছে এ বিষয়গুলোকে বৈজ্ঞানিক বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা যাবেনা, কারণ এসকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত সমূহ শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ ও অনুসিদ্ধান্ত (অনুমিত সিদ্ধান্ত) থেকে গৃহীত হয়, বাস্তব পরীক্ষা (এক্সপেরিমেন্ট) এর উপর ভিত্তি করে নয়। মানুষের উপর এদের প্রয়োগ কে বাস্তব পরীক্ষা হিসাবে দেখা যাবেনা, কারণ এক্ষেত্রে সেটি হবে পরিবেশ ও অবস্থা ভেদে মানুষের বিভিন্ন আচরণের পর্যবেক্ষণ মাত্র। কাজেই এগুলো শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ এবং অনুমিত ধারণা মাত্র, এবং কোনক্রমেই পরীক্ষাগারে সম্পাদিত বাস্তব পরীক্ষা নয়। এজন্যই এদেরকে সংস্কৃতি ভিত্তিক শিক্ষা বলা হয়, এবং এরা প্রকৃতার্থে বিজ্ঞান ভিত্তি শিক্ষা নয়। এসব ক্ষেত্রে লব্ধ সিদ্ধান্ত সর্বদাই সন্দেহপূর্ণ ও বিভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ হবার উপযুক্ত। সর্বোপরি এ শিক্ষাগুলো একটি মিথ্যা ক্ষেত্রের উপর ভিত্তি করে সৃষ্ট কারণ তারা সমাজকে ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোন থেকে দেখে থাকে।

তাদের সংজ্ঞায় সমাজ হচ্ছে ব্যক্তির সমষ্টি। কাজেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গী, ব্যক্তি থেকে পরিবার-পরিবার থেকে গোষ্ঠী-গোষ্ঠী থেকে সমাজ; এ ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রাপ্ত কারণ তাদের সংজ্ঞায় সমাজ হচ্ছে ব্যক্তির সমষ্টি । এধারণাটি যে উপলব্ধির জন্ম দেয় তা হচ্ছে সমাজগুলো স্বাধীন এবং যা এক সমাজের জন্য প্রযোজ্য তা অন্য সমাজের জন্য প্রযোজ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে সমাজ হচ্ছে, মানুষ (ব্যক্তি), ধারণা, আবেগ এবং ব্যবস্থার সমন্বিত রূপ এবং ধারণা ও সমাধান সম্পর্কিত যা কিছু এক স্থানের মানুষের জন্য প্রযোজ্য তা সব স্থানের মানুষের জন্যও প্রযোজ্য। এ ধারণা ও সমাধান একাধিক সমাজকে একটি অভিন্ন সমাজে পরিণত করে যার ক্ষেত্রে একই ধরণের ধারণা, আবেগ ও ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে। শিক্ষা ও সমাজ বিজ্ঞানের দুর্বলতা হচ্ছে এ দুটি বিষয়ই সমাজ সম্পর্কিত একটি ভ্রান্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।  

এছাড়াও মনোবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞান ও শিক্ষাবিজ্ঞানকে প্রভাবিত করে। দুটি কারণে মনোবিজ্ঞান একটি বিভ্রান্তিকর শিক্ষা। প্রথমত: এটি মস্তিষ্ককে ভিন্ন ভিন্ন অংশ ভাগে বিভক্ত করে। এবং দাবী করে ভিন্ন ভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন কার্যকলাপ, প্রবণতা বা স্বাভাবিক যোগ্যতা (aptitude) এর জন্য দায়ী। ফলে কোন কোন মস্তিষ্কের কোন কোন বিশেষ বিষয়ের শেখার স্বাভাবিক যোগ্যতা অন্য মস্তিষ্কের চাইতে বেশী। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে মস্তিষ্ক একটি একক এবং মানুষের চিন্তা ধারণার বৈষম্য একটি স্বাভাবিক বিষয় কারণ তার পারিপার্শ্বিকতা ও মস্তিষ্কে পূর্বলব্ধ তথ্য ভিন্ন। এমন কোন ঝোঁক বা স্বাভাবিক যোগ্যতা নেই যা একটি মস্তিষ্কে উপস্থিত কিন্তু অন্য মস্তিষ্কে অনুপস্থিত। বরং প্রত্যেকটি মস্তিষ্কেরই কোন বস্তু সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা রয়েছে যখন স্পর্শযোগ্য বাস্তবতা, ঈন্দ্রিয় ও পুর্বলব্ধ জ্ঞান, তার কাছে সহজ প্রাপ্য করা হয়। (অর্থাৎ বস্তুটিকে যখন সে দেখতে, স্পর্শ ও অনুভব করতে পারে এবং এসম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান তাকে দেয়া হয় তখন সে বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করার ক্ষমতা প্রতিটি মস্তিষ্কেরই রয়েছে।) পার্থক্য হয় মস্তিষ্কের মূল্যায়ন করা ও পূর্ববর্তী তথ্যের সাথে যথাযথ সম্পর্ক সৃষ্টি ও ঈন্দ্রিয়গত অনুভব করার যোগ্যতায়। ঠিক যেমনটি তারতম্য হয় স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তির ক্ষেত্রে। কাজেই যে কোন ব্যক্তিকে যে কোন ধরণের তথ্য দেয়া যায় এবং সে ঐ তথ্যাবলীকে আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়। কাজেই মনোবিজ্ঞানীরা প্রবণতা বা স্বাভাবিক যোগ্যতার যে দাবীটি করেন তা ভিত্তিহীন।

মনোবিজ্ঞানের ধারণায় প্রবৃত্তি হচ্ছে অসংখ্য, তাদের কোনটি আবিষকৃত হয়েছে আর কোন কোনটি এখনো অনাবিষকৃত। কিছু কিছু তাত্ত্বিক প্রবৃত্তি সম্পর্কে এধরণের মিথ্যা ধারণার উপর ভিত্তি করে কিছু তত্ত্ব দিয়েছেন। বাস্তবে যদি আমরা মানুষের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করি তবে বুঝতে পারি যে তাদের সকল অনুভূতির দুটি দিক রয়েছে, একটি হচ্ছে তুষ্ট/তৃপ্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা, তুষ্ট না হলে সে মারা যাবে । দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে তুষ্ট না হলেও মানুষের জীবন চলে যাবে, কিন্তু সে হয়ে পড়বে উদ্বিগ্ন ও বিকারগ্রস্থ। প্রথমটি জৈবিক চাহিদার প্রতিনিধিত্ব করে, যেমন; ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার বিষয়গুলো। 

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে প্রবৃত্তি যার মধ্যে রয়েছে, ধর্মীয়, প্রজনন ও বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তিগুলো থেকে দূর্বলতা, প্রজাতি রক্ষার প্রবণতা ও বেঁচে থাকার প্রবৃত্তির জন্ম নেয়। এই তিনটি প্রবৃত্তি ছাড়া আর কোন প্রবৃত্তি নেই। এ তিনটি প্রবৃত্তি ছাড়া যে কোন প্রবৃত্তি মূলত: এ তিন প্রবৃত্তিরই উদ্ভূত রূপ। উদাহরণস্বরূপ, ভয়, আধিপত্য এবং মালিকানা, এ তিনটি উদ্ভূত হয়েছে বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি থেকে, গৌরবান্বিত করা বা উপাসনা করার প্রবৃত্তির উদ্ভব হয়েছে আধ্যাত্মিক প্রবৃত্তি থেকে এবং পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব ও ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি হচ্ছে প্রজনন প্রবৃত্তির বিভিন্ন শাখা প্রশাখা বিশেষ। স্পষ্টতই, মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের প্রবৃত্তির ধারণাটি মিথ্যা/ভ্রান্ত এবং মস্তিষ্ক সম্পর্কে তাদের দাবীটিও ভুল। আর এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে উদ্ভূত তত্ত্ব স্পষ্টতই আরো বড় বিভ্রান্তিকর মতবাদ ও শিক্ষার দিকে নিয়ে যায়।  

সমাজ বিজ্ঞান, শিক্ষাবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান হচ্ছে পশ্চিমাদের পঠিত ও প্রচারিত সাংস্কৃতিক বিভাগ যা ইসলামী চিন্তা’র (আকীদার) সাথে সাংঘর্ষিক। এসব বিষয় সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করা এবং এদের মূল্যবান সূত্র হিসাবে গ্রহণ করা ইসলামী রাষ্ট্র পূণ:প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। আমরা দেখাতে চাচ্ছি যে, এই সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো বিশুদ্ধ বিজ্ঞান নয় এবং এগুলো বিতর্কিত বিষয় এবং এদের ফলাফলগুলো অমীমাংসিত। এরা মিথ্যা ক্ষেত্রের উপর ভিত্তি করে চলছে এবং আমাদের জীবন পরিচালনায় এদের কোন ভূমিকা থাকা উচিৎ নয়।

৫. ইসলামী বিশ্বে সমাজ অনৈসলামিক জীবন পদ্ধতি দ্বারা দিকভ্রান্ত। এর কারণ হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সমষ্টিগতভাবে সমাজ যে মূলনীতির উপর ভিত্তি করে দাড়িয়ে আছে এবং মুসলিমরা যে আবেগ অনুভূতির ধারা অনুসরণ করে ও জীবন সম্পর্কে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারা, সবকিছুই এমন সব ধ্যান ধারণার উপর ভিত্তিকরে দাড়িয়ে আছে যা ইসলাম বহির্ভূত ও ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। যতক্ষণ পর্যন্ত এই মৌলিক বিষয়গুলো অপরিবর্তিত থাকবে, এবং এই ভ্রান্ত ধারণাগুলোর মূলোৎপাটিত হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজে মুসলিমদের জীবন পদ্ধতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সামাজিক শৃংখলা, আবেগ-অনুভূতি ও যৌক্তিক ধারা পরিবর্তন করা দুরূহ।

৬. মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামী শাসনের, (বিশেষত: শাসন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার) মাঝে ক্রমবর্ধমান দুরত্ব। এর ফলে মুসলিমদের মাঝে ইসলামী জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে দূরদর্শীতা (ভিশন) কে সুদূর পরাহত হিসাবে উপস্থাপিত হয়। একই সাথে এটি দীর্ঘদিন মুসলিমদের মাঝে ইসলামের অপপ্রয়োগের সুযোগে অবিশ্বাসীদের ইসলামকে নেতিবাচক ভাবে উপস্থাপনার সুযোগ করে দিচ্ছে। ১৯২৪ সাল থেকে মুসলিমরা তাদের শত্রুদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে এমন এক ব্যবস্থার মাধ্যমে যা প্রতিটি বিভাগে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, বিশেষত শাসন-বিচার কার্য  ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে। কাজেই মানুষের এটি বোঝা প্রয়োজন যে, ইসলামী জীবন পদ্ধতি গ্রহণ হতে হবে পরিপূর্ণ, আংশিক নয়; ইসলামের বাস্তবায়ন হতে হবে যুগপৎ এবং সম্পূর্ণ; ধীরে ধীরে, আংশিক কিংবা বিক্ষিপ্ত ভাবে নয়।

৭. মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গঠিত সরকারের উপস্থিতি, যারা পুঁজিবাদী আদর্শ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছে having strong ties with Western countries এবং যা জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এ বিষয়টি ইসলামী জীবন পদ্ধতি পূন:প্রতিষ্ঠায় সাফল্যর পথে একটি বড় সমস্যা হিসাবে বিরাজ করছে, কারণ এটি সম্পূর্ণ ও ব্যাপক না হলে সম্ভব নয়। ইসলাম, মুসলিম ভূখন্ডগুলোর ছোট ছোট জাতি রাষ্ট্রে বিভক্তি অনুমোদন করেনা। বরং ইসলাম ভূখন্ডগুলোকে একত্রিত হয়ে একটি অভিন্ন শাসনের অধীনে থাকার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করে। এটি দাওয়াহর কাজে সামগ্রিকতা আনার বিষয়টি বাধ্য করে, যা শাসকবর্গের প্রতিনিধিদের শক্ত প্রতিরোধের শিকার হয় যদিও এসকল প্রতিনিধি নিজেদেরকে মুসলিম হিসাবে দাবী করে। কাজেই প্রতিটি ভূখন্ডে এ দাওয়াহর কাজ অব্যহত রাখা প্রয়োজন, যদিও বা মুসলিম ভূখন্ডের শাসকদের প্রতিরোধের মুখে কাজটি সমস্যাসঙ্কুল ও কষ্টদায়ক। 

৮. জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম এবং সমাজতন্ত্রের পক্ষে শক্ত জনমত ও এ সকল ধারণার ভিত্তিতে রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্থান। এটি হয়েছে মুলত মুসলিম ভূখন্ডগুলো পশ্চিমাদের দখলে চলে যাওয়ার ফলে এবং এদের ক্ষমতাসীন হওয়া ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে। আর এসবের মাধ্যমে মুসলিমদের মাঝে আত্মরক্ষার একটি প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জাতীয়তাবাদী আবেগ যার উদ্ভব অপরিপক্ক গোত্রবাদিতা ও বর্ণবাদিতার মাধ্যমে যা মূলত পরিবার এবং গোত্র প্রতিরক্ষার ঝোক থেকে উদ্ভূত এবং যা মানুষকে পরস্পরের মাঝে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত রাখে। এর ফলে ভূখন্ড থেকে শত্রু মুক্ত করতে জাতীয়তাবাদ কিংবা দেশপ্রেম নামক পতাকার নীচে কিছু রাজনৈতিক আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে যা তাদের লোকজনদের মাঝেই শাসন কে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। এরপর পুঁজিবাদের দুর্নীতি ও দুর্বলতা অবধারিত হয়ে উঠায় সমাজতন্ত্রের বিস্তার ঘটে। ফলাফল স্বরূপ, পুঁজিবাদের মোকাবেলায় সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা বহনকারী কিছু দলের সৃষ্টি হয়েছে। এসব আন্দোলনের জীবন সম্পর্কে পরিষ্কার কোন দৃষ্টিভঙ্গী বা দুরদর্শিতা (ভিশন) নেই। তাদের কৌশলের পরিষ্কার কোন লক্ষ্য ছিলনা এবং তারা ইসলামের সার্বজনীন আদর্শ থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন