শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১২

খিলাফত শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ ও রূপরেখাঃ উৎপাদনমুখী শিক্ষা, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন

১. সূচনা

এবারের আলোচনার বিষয় উৎপাদনমুখী শিক্ষা, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এই আলোচনাটি মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে বর্তমান বাস্তবতা তুলে ধরা হবে। এই ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের দুরবস্থার কারণগুলো আলোচনা করা হবে দ্বিতীয়ভাগে। তৃতীয়ভাগে খিলাফত রাষ্ট্র কি করে এই দুরবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে জাতিকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাবে তা আলোচনা করা হবে।  

২. বর্তমান বাস্তবতা

২.১ শিক্ষাঃ

যদি শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হয়, তাহলে চরিত্র ব্যক্তির মেরুদন্ড। যে শিক্ষা মানুষকে চরিত্রবান করে না, সে শিক্ষা অবশ্যই ব্যর্থ। বর্তমানে আমাদের সার্টিফিকেট-সর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা থেকে একজন শিক্ষার্থী নিজে আদর্শবান হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়না, আর সমাজের অন্যদের নীতি ও আদর্শের দিকেও ডাকে না। এখানে চরিত্র গঠনের চেয়ে সার্টিফিকেটটাই বেশী জরুরী। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা বহুভাগে বিভক্ত। ধর্মকে ভিত্তি  করে রয়েছে মাদ্রাসা। অন্যদিকে রয়েছে তথাকথিত সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা। মাদ্রাসায় রয়েছে আবার দু’টি ধারা - কওমী ও আলিয়া। অপরদিকে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থাতে রয়েছে আবার দু’টি ভাগ - বাংলা মিডিয়াম ও ইংলিশ মিডিয়াম। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রয়েছে পাবলিক ইউনিভার্সিটি ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। এরপরও রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই বহুধা বিভক্তি থেকেই বোঝা যায় যে, কোন বিশেষ উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে এই শিক্ষাব্যবস্থা তৈরী করা হয়নি; এটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যহীন। এরপর  শিক্ষা প্রদানেও রয়েছে সমস্যা। শহর ও গ্রামের শিক্ষার মানে ব্যাপক বৈষম্য থাকায় সকলেই শহরমূখী হচ্ছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটি ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে রয়েছে মানগত বৈষম্য। এদেশের দরিদ্র মানুষ শখ করে পড়ালেখা করে না। শিক্ষাকে চাকুরী জীবনের পূঁজি হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা এখন লাখ ছাড়িয়ে কোটিতে উঠেছে। ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’- এই কথা বলে শিক্ষায় আগ্রহী করার পর শিক্ষাজীবন এককথায় বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ লক্ষ্যহীন।

২.২ শিল্পায়নঃ

কর্মসংস্থানের সাথে শিল্পায়ন সরাসরি জড়িত। গত কয়েক দশকে এদেশে যতটুকু শিল্পায়ন হয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশী শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। যেকোন জাতি মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই ভারী শিল্পে (যেমন, লৌহ ও ইস্পাত শিল্প) স্বাবলম্বী হতে হয়। বাংলাদেশে ভারী শিল্পের অবস্থা বর্ণনাতীত। দেশে উলে−খযোগ্য কোন ভারী শিল্পই গড়ে উঠেনি। উপরন্তু লৌহ ও ইস্পাত শিল্পকে টাটার মতো বিদেশী প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। আদমজী জুট মিলসহ বেশ কয়েকটি জুট মিল, অনেকগুলো চিনির কল, কাগজ তৈরীর শিল্প কারখানা ইত্যাদি বহু সংখ্যক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের পর বহু শিল্প-কারখানা প্রথমে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করা হয়। এরপর কারখানাগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। সাম্প্রতিককালে এই রুগ্ন শিল্পগুলোকে আবার বেসরকারী খাতে ছাড়া হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প আজকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। তাঁত শিল্প, মৃত্তিকা শিল্পসহ সকল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কোন ধরনের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না। অথচ দেশের আভ্যন্তরীণ বস্ত্রের বাজারও বর্তমানে হাতছাড়া হয়ে গেছে। মাত্র কয়েকটি শহর ছাড়া পুরো দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় শিল্পায়ন শহরকেন্দ্রিক হয়েছে। ফলে পুরো দেশের কর্মহীন জনগোষ্ঠী শুধু ঢাকার মতো শহরগুলোতে এসে জমা হচ্ছে। 

২.৩ অবকাঠামোগত উন্নয়নঃ

যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে প্রধানত রয়েছে নদীপথ, রেলওয়ে  ও স্থলপথ (রাস্তা-ঘাট)। এসবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল, জ্বালানী- নির্ভর ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে স্থলপথের যানবাহন। তুলনামূলকভাবে রেলওয়ে অনেক বেশী সস্তা, কম জ্বালানী-নির্ভর। আর নদীপথ হচ্ছে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে ভাল। কিন্তু নাব্যতা হ্রাসের কারণে নদীপথের দৈর্ঘ্য সবসময়ই কমছে। প্রমত্তা পদ্মা নদী শুকিয়ে নর্দমা হয়ে গেছে; তিস্তা আর টিপাইমুখেও নদীশাসনের নতুন প্রকল্প চলছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনামল অবসানের পর তাদের রেখে যাওয়া রেলওয়ে ব্যবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থাতেই রয়ে গেছে। তাছাড়া যমুনা নদীর পূর্ব ও পশ্চিমে ভিন্ন রেল ব্যবস্থা (মিটার গেজ ও ব্রড গেজ) নিয়ে জটিলতারও কোন নিরসন হয়নি। স্থলপথে দেশে যা উন্নতি হয়েছে তা মূলত  Asian Land Transportation Infrastructure Development (ALTID), BYIMT, UN-ESCAP ইত্যাদি আন্তর্জাতিক স্বার্থপুষ্ট Asian Highway (AH) তৈরীর কারণে হয়েছে। যমুনা সেতু এসবেরই ফসল। বাংলাদেশ মূলত আমদানী-নির্ভর হওয়াতে এসব ট্রানজিটে অন্যদের বাণিজ্যিক সুবিধা বেশী হয়। তাছাড়া জাতীয় নিরাপত্তাও এক্ষেত্রে একটি ভাববার মতো বিষয়। অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আই. এম. এফ-এর নির্ধারিত নকশায় বেড়ে উঠা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে আন্তর্জাতিক স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে, জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পায়নি। চীন ও ভারতের মতো দু’টি ক্রমবর্ধমান শক্তির মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান ভূ-রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে উল্লেখ্য চট্টগ্রাম ও মংলার মতো দু’টি প্রাকৃতিক সমূদ্রবন্দরের অধিকারী বাংলাদেশ। এই দু’টি বন্দর নিয়ে চলছে বেসরকারীকরণ করার চক্রান্ত। তাছাড়া চালনা, চাঁদপুরসহ গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দরগুলো পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধ্বংসপ্রায়। 

৩. দুরবস্থার কারণ

যে কোন জাতির নেতৃত্ব যদি সে জাতিকে কোন রাজনৈতিক উচ্চাশার (Vision) ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে, তবে সে জাতি কখনই কোন বিষয়ে অগ্রসর হতে পারে না; প্রতিটি বিষয়েই তারা উদ্দেশ্যহীন থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল উর্বর জমি। কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ। এগুলো এদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, তেলসহ জ্বালানীর বিশাল মজুদ রয়েছে। তাছাড়া রয়েছে বিশাল জনশক্তি। এত কিছুর পরও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব শক্তিশালী নয়। তারা জাতীয় স্বার্থকে বিক্রি করে শুধু লুটপাটে ব্যস্ত থেকেছে। শুধুমাত্র শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবেই আমাদের আজকের এই দূরবস্থাএখন আমরা দেখব বিশেষভাবে শিক্ষা, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুরবস্থার কারনগুলো কী কী। 

৩.১ শিক্ষাব্যবস্থায় দুরবস্থার কারণঃ

বহুভাগে বিভক্ত এই শিক্ষাব্যবস্থা মূলত বিশেষ কোন উদ্দেশ্যকে ঘিরে গড়ে তোলা হয় নি। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থা অন্ধভাবে অনুকরণ করায় এই শিক্ষা আমাদেরকে কোন আদর্শ শেখায় না, চরিত্রবান হিসেবে তৈরী করে না; জাতির জন্য নীতিবান, আপোষহীন শক্তিশালী নেতৃত্ব তৈরী করতে পারেনা। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যহীনতা আরো পরিলক্ষিত হয় যখন দেখা যায় আমাদের উৎপাদনমুখী কোন শিক্ষানীতি নেই। গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম সম্পদ আমাদের আছে তা জানার পরও এর প্রযুক্তি নিয়ে দেশে বিশেষ পড়াশোনা নেই। কয়লা উত্তোলন প্রযুক্তি শত বছরের পুরনো, তথাপি এ বিষয়ে বিশেষ কোন পড়াশোনা নেই। অথচ এদেশের মেধাবী যুব সমাজ কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর মতো অত্যাধুনিক বিষয়েও যে দক্ষতা অর্জন করতে পারে তা প্রমাণ করেছে। অত্যাশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিককালে যেসব বিষয় প্রবর্তন করা হয়েছে তার মাঝে রয়েছে American Studies, Peace and Conflict Studies ইত্যাদি। দেশে শিল্পায়ন না হওয়ার কারণে কোন উৎপাদনমুখী শিল্প নেই। ফলে বর্তমান শিক্ষা চাকুরীর কোনো নিশ্চয়তা দেয়না। অনেকে আবার অন্য দেশে গিয়ে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে। বিষয়টি কতটা প্রকট তা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি আমাদের দেশের নীতি নির্ধারক মন্ত্রী-সাংসদদের প্রত্যেকেই তাদের সন্তানদের বিদেশে পড়াচ্ছেন, আর দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের পেশীশক্তির রাজনীতিতে মাস্তান তৈরীর খামার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এ সুযোগে অনেকে আবার প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি খুলে শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে সরাসরি ব্যবসা করছেন। 

৩.২ শিল্পায়ন না হওয়ার কারণঃ

বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলার কোন পরিকল্পনা কোন সরকারেরই ছিল না। যে কারণে শিল্পকে কখনই অগ্রাধিকার দেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে বাংলাদেশে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে  Import Substitution Strategy (ISS) নেয়া হয়। অর্থাৎ যেসব পণ্য আমাদের আমদানী করতে হবে তা দেশেই প্রস্তুত করার জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। এই নীতি ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় দশকে আগের নীতি ঝেড়ে ফেলে Export-Led Growth Strategy (EGS) গ্রহণ করা হয। কিন্তু সেক্ষেত্রে যেসব পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়, তার অধিকাংশই আমাদের দেশের কৃষি পণ্য, জ্বালানী ইত্যাদি দেশজ শিল্পভিত্তি বাদ দিয়ে নির্ধারিত হয়। ফলাফলস্বরূপ গার্মেন্টস শিল্প ছাড়া অন্য সকল ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থতা নেমে আসে। যেমন - কৃষিভিত্তিক শিল্প, পাটকল, চিনিকল, কাগজের কল ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যায়। শিল্পক্ষেত্রকে দুই দশকে প্রায় ধ্বংস করার পর তৃতীয় দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলোকে (SOE) বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়। এখানে লক্ষ্যনীয় যে প্রথমতঃ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেসরকারী খাতে দেয়ার আগে বলা হচ্ছে যে সরকার এগুলো পরিচালনায় অদক্ষ। অর্থাৎ শাসকগোষ্ঠীর ব্যর্থতা প্রথমেই স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়তঃ এই শিল্প-কারখানাগুলো বেসরকারী খাতে গিয়ে লাভের মুখ দেখছে। অর্থাৎ শিল্পখাতগুলো আসলে লাভজনক। এ প্রক্রিয়ায় বর্তমানে রূপালী ব্যাংক বেসরকারীকরণ করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ বিমানকে বেসরকারীকরণের চেষ্টাও চলছে।  

তিন দশকে তিনটি ভিন্ন নীতি গ্রহণ থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় শাসকগোষ্ঠী শিল্পায়নের ব্যাপারে লক্ষ্যহীন। দু’একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। সাম্প্রতিককালে হংকং-এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO, Hongkong) সম্মেলন থেকে বিভিন্ন নাটকীয় ঘটনার পর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আলতাফ চৌধুরী বাংলাদেশের জন্য বিমান তৈরী করে তা রপ্তানী করার অনুমোদন নিয়ে আসেন। অন্যদিকে আবার “ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ” তাদের ‘রোড ম্যাপ’-এ দেশের অগ্রাধিকার খাত হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ‘কৃত্রিম ফুল তৈরী’ কে প্রস্তাব করেছে! (দেখুন এখানে)

বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী বিশ্বব্যাংকের তাঁবেদারী করতে গিয়ে বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এদেশের পাটশিল্প সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। একদিকে চিনির কলগুলো বন্ধ হয়েছে, অন্যদিকে দেশের মানুষ ৭০ টাকা কেজি দরে চিনি কিনছে। প্রাক্তন বাণিজ্য উপদেষ্টা বরকত উল্লাহ বুলু বলেছেন দেশে ১৪ লক্ষ টনের বেশী চিনির চাহিদা রয়েছে অথচ দেড় লক্ষ টনের মতো উৎপাদন হচ্ছে। তবে কেন চিনির কলগুলো বন্ধ করার হিড়িক পড়ল এ প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (Small & Medium Enterprise, SME) ধ্বংস করার পর এ খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকার একদিকে গালভরা কথা বলে বেড়াচ্ছে, অন্যদিকে টাটার মতো বিশালকায় প্রতিষ্ঠানকে দেশে বিনিয়োগের জন্য আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। টাটা আসলে প্রায় ২,০০০ এর অধিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পই শুধু ধ্বংস হবে না, দেশের টাকা ও সম্পদ দেশের বাইরে চলে যাবে।

৩.৩ অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়ার কারণঃ

শিল্পায়নের যথাযথ বিকাশ না হওয়ায় দেশের অবকাঠামগত উন্নয়ন সুষমভাবে হয়নি। শুরুতে যমুনা সেতুতে রেল সংযোজনের পরিকল্পনা না থাকলেও Trans Asian Railway (TAR)-এর বাস্তবায়নের জন্য বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর চাপে পড়ে Jamuna Bridge Rail Link Project (JBRLP) সংযোজন করা হয়। ফলে সেতু তৈরীর সর্বশেষ পর্যায়ে মাত্র সাত মাসে ঊনিশ কিলোমিটার রেললাইন তৈরী করা হয়। এ থেকে দু'টো বিষয় পরিষ্কার হয়।

প্রথমতঃ সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অত্যন্ত সহজেই দেশে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরী করা সম্ভব।

দ্বিতীয়তঃ সরকার এ বিষয়ে পরিকল্পনাহীন। এই অপরিকল্পিত রেল সংযোজনের কারণে ইতিমধ্যেই এই ব্যয়বহুল সেতুটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানত তিনটি নদী - পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। তিনটি নদীতেই আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা ভারত লুট করে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দু’টি দলই ক্ষমতায় থাকার লোভে ভারতের সাথে নতজানু ও দূর্বল নীতি অবলম্বন করে এসেছে। ভারতের সাথে পানিচুক্তির ত্রিশ বছরে আমাদের প্রাপ্য অংশ না পাওয়ার পরও আওয়ামী লীগ বিগত শাসনামলে এই চুক্তি নবায়ন করেছে। আর এইবার বিএনপি শাসনামলের শেষ পর্যায়ে নির্বাচনী আশীর্বাদ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভারতে যে সফর করেছেন সেখানে আন্তঃনদী সংযোগের বিষয়টি নিয়ে কি কথা হয়েছে তা জনগণ পরিষ্কার না বুঝলেও ঠিক সে সময়েই ভারত টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ উদ্বোধন করেছে। নদীপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার কারণে জনগণ স্থলপথে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে পণ্যের পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে বহুগুণ। গ্রাম ও শহরে কৃষি পণ্যের মূল্যের তফাৎ হয়েছে প্রায় কয়েকগুণ। 

রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত, হাসপাতাল ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনস্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া। এদেশে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিদের এলাকা ছাড়া অন্য অঞ্চল উন্নয়নের আওতাভুক্ত হয় না। অর্থাৎ পক্ষপাতহীনভাবে দেশের সমস্ত অঞ্চলের জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব না দেয়ায় অসমভাবে এই উন্নয়ন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, জাতীয় পার্টির শাসনামলে দেশের অধিকাংশ মানুষ অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকলেও রংপুরের রাস্তায় সোডিয়াম বাতি জ্বলেছে।  

আমাদের শাসকগোষ্ঠী যখন আমাদেরকে লক্ষ্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা দিয়েছে, দেশের ভারী, মধ্যম ও ক্ষুদ্র শিল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছে, জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে দেশকে যখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, তখন দেশের ভূক্তভোগী জনগণ মুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। মূলত আওয়ামী-বিএনপির এই লূটপাট, দুর্নীতি আর দুঃশাসনের পতন ঘটিয়ে একমাত্র ইসলামী আদর্শভিত্তিক খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাঝেই আছে জনগণের মুক্তি।

আসুন, আমরা এখন দেখি খিলাফত রাষ্ট্র কি করে শিক্ষা, শিল্প ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাস্তবায়ন করবে। 

৪. খিলাফত রাষ্ট্রে উৎপাদনমূখী শিক্ষা, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রাসুলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) সহকারে, যেন এই দ্বীন অন্যান্য দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন...।” [সুরা আত্ -তাওবাহ্ - ৩৩]

তিনি আরো বলেন,

“... এবং কিছুতেই আল্লাহ কাফেরদেরকে মুসলমানদের উপর বিজয় দান করবেন না।” (সূরা আন-নিসাঃ ১৪১)

ইসলামকে সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বীন হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে যখন সরে আসার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম, তোমরা আমার ডান হাতে সূর্য, আর বাম হাতে চন্দ্রও যদি এনে দাও, তবুও যতক্ষণ আমার ঘাড়ে মাথা আছে, ততক্ষণ আমি ইসলামকে বিজয়ী করার চেষ্টা করেই যাবো।”

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর অনুসারী সাহাবাদেরকে আপোষহীনভাবে সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত মানুষকে সকল দাসত্ব থেকে মুক্ত করে খিলাফত রাষ্ট্রের অধীনে আনার উচ্চাশায় ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর জমীনে ইসলামের বিজয়ী পতাকা উড়ানোর এই রাজনৈতিক উচ্চাশার (Vision) ফলে আরবের অনগ্রসর জাহেল সমাজ থেকে উঠে আসা সাহাবারা খিলাফত প্রতিষ্ঠার মাত্র বিশ বছরের মাঝে একই সাথে দু’টি পরাশক্তিকে (পারস্য ও রোমান) হারিয়ে বিশ্বের নেতৃত্ব ইসলামের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ব্রিটিশদের দু’শ বছর, রাশিয়া ও আমেরিকার পঞ্চাশ বছরের দুনিয়া শাসনের ইতিহাস থাকলেও খিলাফত রাষ্ট্রের রয়েছে হাজার বছরের একচ্ছত্রভাবে পরাশক্তি থাকার গৌরবময় অতীত। 

খিলাফত রাষ্ট্র তার জাতিকে বিশ্বের নেতৃত্ব দান করার বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ করবে এবং সেই জাতিকে একটি দূর্ভেদ্য, শক্তিশালী, অপরাজেয় পরাশক্তিতে পরিণত করবে। আর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের এই অদম্য উচ্চাশার কারণে ভবিষ্যতে খিলাফত রাষ্ট্র হবে শিল্প ও প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রগামী।

৪.১ খিলাফত রাষ্ট্রে উৎপাদনমুখী শিক্ষাঃ

আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতা’আলা বলেন, “নিশ্চয় আসমান ও জমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকেদের জন্য; যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও।” (সুরা আল ইমরানঃ ১৯০-০৯১)

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “বিদ্যা অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ।”

আরেক হাদীসে রাসুল (সাঃ) বলেন, “শেষ বিচারের দিন তিন ব্যক্তির সুপারিশ গ্রহণ করা হবে- নবীগণ, বিদ্বান, অতঃপর শহীদ।”

অপর এক হাদীসে আছে, “এক ঘণ্টার চিন্তা (গবেষণা) সত্তর বছরের ইবাদতের চেয়ে উত্তম।”

এটা স্পষ্ট যে ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিবেন। খিলাফত রাষ্ট্রের জনগণকে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে খলীফা সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। এটি কোন কথার কথা নয়; উপরোক্ত কুরআন ও হাদীসের আদেশ অনুযায়ী এটা তার অবশ্যকরণীয় দায়িত্ব। রাজনৈতিক উচ্চাশায় উদ্দীপ্ত জাতিকে তার খলীফা যথাযথ শিক্ষার সুযোগ দিতে বাধ্য, অতীতেও দিয়েছেন। খিলাফত রাষ্ট্রে থাকাকালে স্পেন, বাগদাদ, কায়রো ইত্যাদি বিদ্যাপীঠগুলো তারই প্রমাণ দেয়। 

৪.১.১ শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যঃ

 ইসলামী ব্যক্তিত্ব তৈরী ও জাতিকে বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করাই হবে শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য। এটি জাতিকে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে দক্ষ করে গড়ে তুলবে।

১. প্রত্যেক নাগরিককে সৎ, দক্ষ ও উৎপাদনক্ষম করে গড়ে তুলবে। 
২. সামাজিক ক্ষেত্রে ভাল কাজে অংশগ্রহণ ও খারাপ কাজে বাধা প্রদানে দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলবে। 
৩. জাতিকে বিশ্বে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞানে দক্ষ করে তুলবে।

এক্ষেত্রে খলীফা নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গুরুত্বের সাথে বাস্তবায়ন করবেন - ব্যক্তির চরিত্র গঠনে ও আদর্শিক ব্যক্তিত্ব তৈরীতে ফলপ্রসূ পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করা হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের মাঝে নীতিবান ব্যক্তিত্ব ও শক্তিশালী নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা তৈরী হয়। নারী-পুরুষ মুসলিম-অমুসলিম প্রত্যেককে শিক্ষার যাবতীয় সুযোগ দিতে খলীফা বাধ্য থাকবেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সকল শিক্ষা উপকরণ যেমনঃ বই-খাতা ইত্যাদি বিনামূল্যে সরবরাহ করবে। প্রাথমিক শিক্ষা সমস্ত জীবনের ভিত্তি। এক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শিক আক্বীদা জোরালোভাবে তুলে ধরা হবে। ফলে জাতির সামনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের আকাঙ্খা গড়ে উঠবে। এজন্য রাষ্ট্র স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজ করবে। অতীতে এর নিদর্শনও রয়েছে। রাসূল (সাঃ) বদর যুদ্ধে বন্দীদেরকে দশজন মুসলিম শিশুকে শিক্ষা দান করার বিনিময়ে মুক্তি দিয়েছেন। Experimental Science (ফলিত বিজ্ঞান) শিক্ষার যে কোন স্তরেই সংযুক্ত হতে পারে, যতক্ষণ না এটি ইসলামের আক্বীদা-পরিপন্থী কোন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে বাস্তব ব্যবহার শিখানো হবে। শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় রাষ্ট্রের মসজিদগুলো থাকবে। এখানে ফিকাহ, উসুল, তাফসীর, হাদীস, সীরাত এবং অন্যান্য বিষয় শেখানো  হবে। প্রয়োজনে মসজিদে বির্তক, আলোচনা অনুষ্ঠান ইত্যাদি আয়োজন করা হবে। সকল বিদ্যালয়ে পাঠাগার গবেষণাগার তৈরী করা হবে। প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য উৎপাদনমুখী পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করা হবে। শুধুমাত্র প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষা নয়, ররং এর গবেষণাকর্ম, উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণও প্রযুক্তিগত শিক্ষার আওতায় আনা হবে। উলে−খ্য এক্ষেত্রে খলীফা দেশে ডাক্তার, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পোদ্যোক্তা, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এমন কি, মহাকাশ বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রাসয়ন বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা রাখবেন। খলীফা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণাপত্র তৈরীর পৃষ্ঠপোষকতা ও পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করবেন। এক্ষেত্রে পাঠ্যসূচীর বাইরেও বিভিন্ন বই-পুস্তক, পত্রিকা, গবেষণাপত্র ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ পাঠাগার বিভিন্ন এলাকায় বা মসজিদে স্থাপন করা হবে, যেখানে বিনামূল্যে এই সকল বিষয়ে অধ্যয়ন করা যাবে। শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমোদিত পাঠ্যসূচী ব্যতীত অন্য কোন বিদেশী পাঠ্যসূচী অনুসরণ করা যাবে না। বিশেষভাবে আমাদের দেশ বিশাল জ্বালানীও খনিজ সম্পদের অধিকারী হওয়ায় দেশে Gas & Petroleum Technology, Coal Mining  Technology, Agro-Industry ইত্যাদি বিষয়ে নিজেদের বিশেষজ্ঞ তৈরী করার জন্য খলীফা ব্যবস্থা নিবেন। বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে সামরিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান অপরিহার্য। এক্ষেত্রে পরমানু শক্তি গবেষণা, নিজস্ব সামরিক যানবাহন (ট্যাংক, জাহাজ, উড়োজাহাজ) তৈরীর প্রযুক্তি, ভারী  শিল্প তৈরীর প্রযুক্তি ইত্যাদি প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণাধর্মী ও প্রায়োগিক বিজ্ঞান বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরী করার জন্য পর্যাপ্ত পরিকল্পনা নেয়া হবে।

উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনে খলীফা এ বিষয়ে আরও সংযোজন করতে পারেন। 

৪.২ শিল্পায়নঃ

৪.২.১ শিল্পায়নের উদ্দেশ্যঃ

খিলাফত রাষ্ট্রে শিল্পায়ন মূলত নিম্নোক্ত দু’টি উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে।

(ক) স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করাঃ

যে কোন জাতিকে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হয়, অন্যের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হয়। তাই খিলাফত রাষ্ট্র স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে অবশ্যই শিল্পায়নকে গুরুত্ব দিবে। যে বাহিনী যুদ্ধবিমান উড়াতে জানে, ট্যাংক চালাতে জানে, কিন্তু সে বিমান বা ট্যাংক তৈরী করতে জানে না, সে বাহিনী দুর্বল, পরাজিত। রাসূল (সাঃ) তার জীবদ্দশায় মুসলমানদের শিখিয়ে গিয়েছেন কিভাবে শিল্প-প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হয়। তিনি তলোয়ার তৈরীর প্রযুক্তি শেখার জন্য মদীনা থেকে ইয়েমেনে লোক পাঠিয়ে সে প্রযুক্তি আয়ত্ত করিয়েছিলেন। খন্দকের যুদ্ধে তিনি খন্দক খনন প্রযু্ক্তি বহির্বিশ্ব থেকে শিখে আরবে প্রথমবারের মতো প্রয়োগ করেছেন। তায়েফ অবরোধের সময় তিনি লিভার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারী কামান তৈরী করেছেন। মুসলমানরা তাঁর এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে খিলাফত রাষ্ট্রে চিকিৎসা, সমরাস্ত্র (যেমন কামান), জ্যোর্তিবিজ্ঞান ইত্যাদি বহু বিষয়ে দক্ষতা দেখিয়েছে

বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে ত্রাণ কাজে ব্যবহারের জন্য কিছু হেলিকপটার আনা হয়েছিল, যার শুধুমাত্র উড্ডয়ন ব্যবহার আমরা জানতাম। কিন্তু এর যন্ত্রাংশ তৈরী, রক্ষণাবেক্ষণ করার প্রযুক্তি না জানায় আমরা আমদানীকারক দেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে আছি। ফলে দেখা গেছে, কোন কোন হেলিকপ্টার মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের যন্ত্রাংশের অভাবে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির, উৎপাদন, ব্যবহার ও রক্ষনাবেক্ষন, তিনটি পর্যায়েই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকে খলীফা গুরুত্ব দিবেন। আর এজন্যই শিল্পায়ন হওয়াটা খিলাফত রাষ্ট্রের অপরিহার্য অংশ। খলীফা এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ, পরিকল্পনা, গবেষণা, উৎপাদন ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রযুক্তি তৈরীর নির্দেশ দিবেন। 

(খ) শিল্পখাতকে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের প্রভাবমুক্ত রাখাঃ

আগে পশ্চিমাশক্তিগুলো সরাসরি সামরিক ভিত্তি তৈরী করে বাজার দখল করত। এখন এর সাথে নতুন সংযোজন হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেইজ তৈরী করা। এখানে উলে−খ্য যে যেসব দেশে এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেইজ তৈরী করা হয় সেখানে শুধু প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানো হয়, প্রযুক্তি উৎপাদন শেখানো হয় না। ফলে এসব দেশ (যেমন, তাইওয়ান, কোরিয়া, হংকং, ব্রাজিল) এখনো প্রযুক্তিতে অনুন্নত, পশ্চিমাশক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে আছে। তারা কেবল সস্তা শ্রম বিক্রি করে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও একই ধরনের শিল্পভিত্তি রয়েছে এবং সাম্প্রতিককালে টাটা বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলাফলও ঠিক একই হবে। এদেশের মানুষ কেবল এতে শ্রমিক হয়েই খেটে যাবেএক্ষেত্রে বিদেশী নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য খলীফা এধরনের সকল বিদেশী শিল্প ভিত্তিকে উৎখাত করবেন।

৪.২.২ বাংলাদেশে শিল্পায়নের উপযোগিতাঃ

যেকোন শিল্প বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় দরকার –

১. শ্রম
২. শক্তি (জ্বালানী শক্তি)
৩. বাজার

শ্রমঃ
বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ১৫ কোটি মানুষের বসবাস। এত বড় ও ব্যাপক শ্রম বাজারকে ব্যবহার করা খুবই সহজ। উল্লেখ্য যে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ এশিয়ার শ্রমবাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল।

শক্তিঃ
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল ও কয়লার বিশাল মজুদ রয়েছে। এগুলোর জন্য আমরা অন্যের উপর নির্ভরশীল নই। এ সম্পদ বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে না দিয়ে খলীফা এগুলোকে শিল্পায়নের জন্য ব্যবহার করবেন।

বাজারঃ
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ১৫ কোটি মানুষের বাজার যে কোন শিল্প বেড়ে উঠার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এ সকল কারণেই খিলাফত রাষ্ট্র শিল্পায়নের জন্য খুবই অনুকূল। খিলাফত রাষ্ট্রে খলীফা যে বিষয়গলোতে শিল্পায়নের জন্য অগ্রাধিকার দিবেন তা হল-

Ø  স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান
Ø  লৌহ ও ইস্পাত শিল্প
Ø  বাঁধ নির্মাণ শিল্প
Ø  গ্যাস ও কয়লা ভিত্তিক শিল্প (যেমন- বিদুৎ, সার ইত্যাদি)
Ø  মোটর তৈরী শিল্প (যা ট্রাক্টর, ট্যাংক, জাহাজ, উড়োজাহাজ ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়)
Ø  গাড়ী, জাহাজ, উড়োজাহাজ তৈরী শিল্প ইত্যাদি

৪.২.৩ কৃষি-শিল্পঃ

খাদ্যে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। এছাড়া চিনি, পাট, মৎস্য, চা ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলো অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এক্ষেত্রে খলীফা অত্যন্ত জোরালোভাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নিবেন- সকল অব্যবহৃত চাষযোগ্য খাস জমিগুলোকে চাষের আওতায় আনবেন। প্রয়োজনে ভূমিহীন কৃষকদের তা চাষের জন্য দেয়া হবে।

Ø  তাঁত, রেশম ইত্যাদি কুটির শিল্পগুলোকে পূনরুজ্জীবিত করার নির্দেশ দিবেন।
Ø  গবাদি পশুপালন, পোল্ট্রি শিল্পকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিবেন।
Ø  কৃষিতে প্রয়োজনীয় কোন ভারীযন্ত্র আমদানী না করে কি করে দেশে তা তৈরী করা যায়, সে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিবেন। জমির উর্বরতা, উৎপাদন, বিশেষ করে সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়ে কৌশলপত্র তৈরীর জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করবেন।

৪.৩ খিলাফত রাষ্ট্রে অবকাঠামোগত উন্নয়নঃ

অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা তিনটি বিষয়কে ঘিরে তৈরী করা হয়ঃ

৪.৩.১ শিল্পায়নঃ

শিল্পবিকাশের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন পূর্বশর্ত। শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত অবকাঠামোগত সুবিধা থাকা অত্যন্ত জরুরী। সেক্ষেত্রে খলীফা যে সকল পদক্ষেপ গুরুত্বের সাথে নিবেন তা হলো-

Ø  যেহেতু নদীপথে পণ্য পরিবহন সুলভ ও জ্বালানী সাশ্রয়ী, সেহেতু নদীপথ সচল রাখার জন্য দৃঢ় রাজনৈতিক কৌশল নেয়া হবে। নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য শুধুমাত্র ড্রেজিং নয়, বরং পানির ন্যায্য অধিকার আদায়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা হবে।
Ø  দেশের জেলায় জেলায় রেলওয়ে সক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯০০ সালের দিকে খিলাফত রাষ্ট্রের তৎকালীন খলীফা সুলতান আবদুল হামিদ তুরস্ক থেকে আরব পর্যন্ত সুদীর্ঘ রেলওয়ে তৈরী করে ছিলেন।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

৪.৩.২ জনস্বার্থঃ

খলীফা উমর (রাঃ) বলেছিলেন, “ফোরাতের তীরে যদি কোন ভেড়াও না খেয়ে থাকে, তবে আমি উমর এর জন্য দায়ী থাকব।”

দেশের কোন অংশ কম উৎপাদনশীল হলে তাকে বিচ্ছিন্ন রাখা হবে, খিলাফত রাষ্ট্রে সেটা সম্ভব নয়। দেশের প্রতিটি নাগরিকের প্রাপ্য মৌলিক অধিকার তার ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য খলীফা বাধ্য থাকবেন। ফলে তিনি জনস্বার্থের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করবেন। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন যাবৎ অনুন্নত ছিল। সাম্প্রতিককালে বহির্বিশ্বের স্বার্থপুষ্ট এশিয়ান হাইওয়ে তৈরীর কারণে তারা কিছু যোগাযোগ সুবিধা পাচ্ছে। জনস্বার্থে চিকিৎসা, শিক্ষা, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়া হবে।


৪.৩.৩ জাতীয় নিরাপত্তাঃ

যেহেতু খিলাফত রাষ্ট্রে সর্বাগ্রে রাজনেতিক দূরদর্শীতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়, সেহেতু খলীফা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় যেসব পদক্ষেপগুলোকে অগ্রাধিকার দিবেন তা হলঃ

Ø  চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের উপর সকল বিদেশী হস্তক্ষেপ নির্মূল করা হবে। এক্ষেত্রে খলীফা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সমূদ্র বন্দর দু’টিকে সুরক্ষিত ও উন্নত করবেন। কোনক্রমেই এই বন্দরগুলো বেসরকারীকরণ করা বা বিদেশীদের হাতে দেয়া হবে না।

Ø  আন্তর্জাতিক ট্রানজিট বা হাইওয়েগুলোকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হবে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ যেকোন ধরনের চক্রান্ত অবশ্যই প্রতিহত করা হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

এছাড়াও খলীফা এ ক্ষেত্রে আরও উন্নয়ন পরিকল্পনা গুরুত্ব অনুসারে সংযোজন করতে পারেন।

৫. উপসংহার

সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ এই বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে  বিএনপি-আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের কারণে ধ্বংসপ্রায় হয়ে গেছে। এদেশের মানুষকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে, দেশের শিল্প-কারখানাগুলোকে ধ্বংস করে এই শাসকগোষ্ঠী কেবল লুটপাট আর দুর্নীতি করেছে। অক্সিডেন্টাল, এশিয়া এনার্জি, নাইকো ইত্যাদি বিদেশী কোম্পানীর হাতে এদেশের সম্পদ তারা তুলে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিদ্যুতের দাবীতে আন্দোলনকারী কানসাট অঞ্চলের জনগণকে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকার শনির আখরায় দীর্ঘ দুমাস পানিবঞ্চিত জনগণ পানির দাবী করলে প্রকাশ্যে স্থানীয় এমপির নির্দেশে তাদের উপর পুলিশী হামলা চালানো হয়েছে। জনতার উপর গুলি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। পত্রিকায় এসেছে, প্রধানমন্ত্রী যেখানে নির্বাচনী সফরে যান সেখানে কিছুদিন বিদ্যুতের সরবরাহ করা হয়। এদেশের জনগণ আওয়ামী-বিএনপির এই দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। দলের পরিবর্তন অথবা মন্ত্রীর বদল ঘটিয়ে এই দুরবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না। কেবলমাত্র খিলাফত রাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রই এ জাতিকে একটি সুস্পষ্ট নেতৃত্বের মাধ্যমে বিশ্বে অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন