বৃহস্পতিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১২

বাউল নাকি ফাউলঃ কাদের সংস্কৃতি, কাদের বিশ্বাস?

গত ১৫ অক্টোবর কিছু ইসলামী দল ও এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সামনের চত্বর থেকে নির্মাণাধীন বাউল ভাস্কর্য অপসারণ করেছিল তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারপর থেকে এদেশের সংস্কৃতিমনা, বাউলপ্রেমিক এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় ক্ষোভে দুঃখে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে এ ভয়ঙ্কর ঘটনার (?) তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। বাউল ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে এবং তা পূনঃস্থাপনের দাবি জানিয়ে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা (?) প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি খোলা চিঠি দিয়েছে। তাদের ভাষায় মৌলবাদের আখড়া (?) স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যা হচ্ছে, কোন সভ্য-ভব্য দেশে তা ঘটার কথা নয়। খোলা চিঠিতে তারা বিমানবন্দরের সামনের চত্বরকে লালন চত্বরনামকরণ করা এবং সেখানে মান সম্মত বাউল ভাস্কর্য স্থাপনের দাবী জানিয়েছে। প্রগতিশীলতার একতরফা দাবীদার চিহ্নিত কিছু পত্রিকায় তাদের ধারাবাহিকভাবে বাউল ভাস্কর্য স্থাপনের পক্ষে বাউলপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গের জ্বালাময়ী কিছু রচনাও প্রকাশিত হয়েছে।

গত ২৮ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় চাই মুক্তসমাজ এবং শিল্প ও জ্ঞানচর্চার অবাধ পরিবেশনামক রচনায় বলা হয়, “গীতিকার ও বাউল সাধক লালন শাহ বাংলাদেশ ও বাঙালীর অমূল্য সম্পদ। বাউল ভাস্কর্যের উপর অপশক্তির এ ধরণের ঘৃণ্য হামলা কার্যত আমাদের চিরায়ত সামাজিক ধর্মীয় সম্প্রীতি ও আত্মপরিচিতির বন্ধনমূলে কুঠারাঘাত হানার সামিল। আমাদের লড়াই এমন এক শক্তির বিরুদ্ধে, যারা বোঝে না সৌন্দর্য্য কি, পাখি-ফুল-নদী কি, সংস্কৃতি কি, গান নাটক কবিতা কি? এরা অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষ, আর এদের প্রশ্রয় দেওয়ায় এই অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে। সংস্কৃতি ও রাজনীতির উপর মৌলবাদীদের অব্যাহত আগ্রাসন যে কোন মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। মৌলবাদের ভয়ে নতজানু হলে উত্থান ঘটবে জঙ্গিবাদের, আমাদের বাস করতে হবে প্রশ্নহীন এক মৃত সমাজে।একই দৈনিকে গত ২৭ অক্টোবর লেখক হুমায়ুন আহমেদ এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব?” নামক রচনায় লিখেছেন, “আফগানিস্তানের তালেবানরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মূর্তি (যা ছিল বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ) ভেঙ্গে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। আমরা ভাঙছি সাঁইজির মূর্তি। যার জীবনের সাধনায় ছিল আল্লাহর অনুসন্ধান।

বাউল ভাস্কর্যের পক্ষে বিপক্ষে যখন জোরদার আন্দোলন চলছে, তখন তা স্বাভাবিকভাবেই জনগণের মধ্যে আলোচনায় চলে এসেছে। কেউ কেউ বাউল ভাস্কর্যের পক্ষে আবার কেউবা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আসলে বাউল ভাস্কর্যের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থহান নেয়ার পূর্বে আমাদের জানর প্রয়োজন কারা এই বাউল সম্প্রদায়? কি তাদের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচরণ? ৯৭ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে লালন ফকির বা বাউল সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, বিশ্বাস ও মূ্ল্যবোধ আসলে কতটুকু সম্পর্কিত? সর্বোপরি যারা বাউল সংস্কৃতিকে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি বলে ১২ কোটি মুসলিমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে তাদের এসব কর্মকান্ডের উদ্দেশ্যই বা কি?

বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেছেন তাদের কাছে প্রয়াত লেখক আহমদ শরীফের বাউল তত্ত্বএবং লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডক্টর আনোয়ারুল করিমের বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীতনামের বই দুটো খুবই পরিচিত। বাউলশব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার বাংলাদেশের বাউলবইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হল, প্রাচীন প্যালেস্টাইন এর রাসসামরায় বাআল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তৌরাত, ইঞ্জিল(বাইবেল), কোরান মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বাআল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বাআল ধর্ম এক সময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বাআল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বাআল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডা. আহমদ শরীফ তার বাউলতত্ত্ববইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপন্থ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,

কালী কৃষ্ণ গড খোদা
কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।
(বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।

সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। নাড়াশব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ওরসেতাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি। আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরআন তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেনএ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।” (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫)

বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে সাঁইহিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধী লাভ করা যায় না। তাই তাকে চেতন গুরুবলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোন মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায়না। জুম্মার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করেনা। তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায়না। এদের জানাজাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। (বা.বা পৃঃ ১৫-১৭)

বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্বসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্বক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বা.বা পৃ ৩৫০, ৩৮২)

বাউলদের গুরু লালিন ফকিরের জীবন সম্পর্কে বেশী কিছু জানা যায় না। তার মৃত্যুর দু সপ্তাহ পর বাংলা ১২৯৭ সালে কুষ্টিয়া লাহিনীপাড়া থেকে পাক্ষিক হিতকারীপত্রিকায় লালন ফকির সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয়, “ ...... লালন নিজে কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না, অথচ সকল ধর্মের লোকেরা তাহাকে আপন বলিয়া জানিত। মুসলমানদিগের সহিত তাহার আহার-ব্যবহার থাকায় অনেকে তাহাকে মুসলমান মনে করিত। বৈষ্ণব ধর্মেও মত পোষণ করিতে দেখিয়া হিন্দুরা ইহাকে বৈষ্ণব ঠাওরাইত। ...... অধিক কি ইহার শিষ্যগণ ইহার উপাসনা ব্যতীত আর কাহারো উপাসনা শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানিত না। ...... ইনি নোমাজ করিতেন না। সুতরাং মুসলমান কি প্রকারে বলা যায়? তবে জাতিভেদ বিহীন অভিনব বৈষ্ণব বলা যাইতে পারে; বৈষ্ণব ধর্মের দিকে ইহার অধিক টান। শ্রী কৃষ্ণের অবতারে বিশ্বাস করিতেন। ...... মৃত্যুকালে কোন সম্প্রদায়ী মতানুসারে তাঁহার অন্তিম কার্য্য সম্পন্ন হওয়া তাঁহার অভিপ্রায় ও উপদেশ ছিল না। তজ্জন্য মোল্লা বা পুরোহিত কিছুই লাগে নাই।” (বাংলাদেশের বাউল পৃঃ ৪১৮-৪১৯)

এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায়, অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমও ধর্মবিবর্জিত বিকৃত যৌনাচারী মুসলিম নামধারী বাউলদেরকে সূফী-সাধকের মর্যাদায় বসিয়েছে। মূলতঃ বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত ভেকধারী এসব বাউলরা তাদের বিকৃত ও কুৎসিত জীবনাচারণকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার জন্য বিভিন্ন গানে মোকাম, মঞ্জিল, আল্লাহ, রাসূল, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহাম্মদ-খাদিজাসহ বিভিন্ন আরবী পরিভাষা, আরবী হরফ ও বাংলা শব্দ প্রতীকরূপে ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যবহার করেছে। এদেশে বহুল প্রচলিত একটি লালন সঙ্গীত হলো,

বাড়ির পাশে আরশি নগর
সেথা এক পড়শী বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে

এই গানটিকে আমাদের সমাজে খুবই উচ্চমার্গের আধ্যাতিক গান মনে করা হলেও, এটি মূলত একটি নিছক যৌনাচারমূলক গান, যাতে আরশিনগর, পড়শী শব্দগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের বিকৃত জীবনাচারকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে। (বা.বা পৃঃ ৩৬৮-৩৬৯) এছাড়া গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, লালন ফকির এবং বাউলদের গানে এমন অনেক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে যা কাফের ও মুরতাদের সমগোত্রীয়। সুধীর চক্রবর্তীর বক্তব্য অনুসারে, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে লালনতত্ত্ব মুশরিক। কারণ, লালন ফকির বিশ্বাস করতো যিনি আল্লাহ, তিনিই রাসুল, তিনিই নবী। এটি ইসলামী আকিদার ঘোরতর পরিপন্থী। যেমন।

যেহিতো মুরশিদ সেহিতো রাসুল
এই দুইয়ে নেই কোন ভুল
মুরশিদ খোদা ভাবলে জুদা
তুই পড়বি প্যাঁচে।

বাউল সুফীসাধকেরা বস্তুতঃ নিরাকার আল্লাহকে সাকারত্ব প্রদান করে তাদের অনুসারীদের পৌত্তলিকতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরা সাধারণ মানুষের সারল্য, অশিক্ষা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করেছে এবং এইসব বিকৃত সাধনাসম্বলিত লোকধর্ম আসলে আমাদের সমাজ জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সমাজ জীবনে বাউল লোকধর্মের এই ভয়ঙ্কর প্রভাব লক্ষ্য করে বাংলা ১৩৩৩ সালে হাজী মৌলভী রেয়াজউদ্দীন আহমদ বাউল ধ্বংস ফতওয়ানামে বাউলবিরোধী একটি বই লেখেন। যেখানে তিনি এই বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ইসলাম, ইসলামী আকিদাহ্ যা এদেশের আপামর মুসলিমের অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের সাথে বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের দূরতম সম্পর্ক নেই এবং তা পুরোপুরি ষাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয়, বিশ্বাসে পৌত্তলিক, আচার-আচরণে ভয়ঙ্কর কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিকৃত জীবানাচারণ ও অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্ত বাউল সম্প্রদায় কোনভাবেই এদেশের মানুষের কৃষ্টি-কালচার বা আত্বপরিচিতির বন্ধনমূল হতে পারেনা। কবীর চৌধুরী, হামিদা হোসেন, আয়েশা খানম এবং তাদের অনুসারীরা বস্তুতঃ প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা ও দেশীয় কৃষ্টি-কালচারের নামে, ফুল-পাখি-গান-কবিতা-সৌন্দর্য ইত্যাদির উছিলায় এদেশের মানুষকে অশ্লীল, বিকৃত ও নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের দিকে নিয়ে যেতে চায়। যে নিকষ কালো আঁধারের মূলে রয়েছে বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা এবং শেষপ্রান্তে অপেক্ষা করছে নিশ্চিত ধ্বংস। স্বনামধন্য লেখক হুমাইয়ূন আহমেদ, সাঁইজির মূর্তি ভাঙায় যার অন্তরে হাহাকার উঠেছে, তার বিতর্কিত ব্যক্তিজীবনই আমাদের বলে দেয় এই হাহাকারের উৎস কোথায়। এছাড়া, রোবায়েত ফেরদৌসের মত ব্যক্তি, যারা কিনা এদেশের তরুন-তরুনীদের বিয়ের আগেই শারীরিক সম্পর্ক তৈরীর ফ্রি লাইসেন্স দিতে চায় তাদের তো বল্গাহীন উদ্দাম বাউলিয়া জীবনাচারণই কাম্য।

তবে, একই সাথে এটাও ঠিক যে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা পরধর্ম মতে সহনশীল। যদিও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজের একটি অংশ মাঝে মাঝেই এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কল্পিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভি্যোগ এনে থাকেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ভারতের মতো এদেশের মানুষ কখনোই সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে না, অন্য ধর্ম বা মতে বিশ্বাসী মানুষদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে না, কিংবা তাদের ঘরবাড়ী, উপাসনালয়ও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়না। তাই, যদি হামিদা হোসেন এবং কবীর চৌধুরীর অনুসারীরা বাউল ধর্মকে তাদের নিজস্ব ধর্ম বা সংস্কৃতি বলে মানতে চায় কিংবা শ্রীকৃষ্ণের অবতারে বিশ্বাসী লালন ফকিরকে তাদের দেবতা বলে ঘোষণা তবে, তবে নিঃসন্দেহে তাদের কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু জাতীয় বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, হাজী ক্যাম্পের সামনে জনগণের অর্থ ব্যয় করে লালনমূর্তি তৈরী বা বিমানবন্দরের সামনের চত্বরকে লালন চত্বরঘোষণার দাবী একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ, তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্বাস বা বিকৃত মূল্যবোধকে জাতীয় কৃষ্টি-কালচার হিসেবে সমস্ত জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই।

সব চাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী বিশ্বের এজেন্ট ও ভোগবাদী জীবনাদর্শে বিশ্বাসী এইসব গণবিচ্ছিন্ন বুদ্ধিজীবি, যাদের নিজেদের জীবনে ইসলামের নামনিশানা নেই, তারা ইসলামের দোহাই দিয়েই এই ভোগবাদী দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। হুমায়ুন আহমেদ তার রচনায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত এবং ইসলামের শত্রুপক্ষের অনুদিত বই দি লাইফ অব মোহাম্মদগ্রন্থের উদ্বৃতি দিয়ে লালন মুর্তিকে যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। আমি বলবো তিনি কি জানেন এই বিশ্বের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম এবং প্রখ্যাত মুসলিম স্কলারদের কাছে ওরিয়েন্টালিস্টদের হাতে অনুদিত বই প্রত্যাখ্যাত? কাফির মুশরিকরা ইসলামের ইতিহাস বিকৃতিতে কতোখানি পারঙ্গম তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস দ্যা জুয়েল অফ মদিনা। যেহেতু হুমায়ুন আহমেদ প্রসিদ্ধ মুসলিম স্কলারদের অনুদিত সীরাত গ্রন্থকে পাশ কাটিয়ে ইহুদী নাসারাদের অনুবাদকে রেফারেন্স হিসেবে নিয়েছেন, সেহেতু আমরা ধরে নেব তিনিও শত্রুপক্ষের একজন। এছাড়া যারা মুহম্মাদ (সা) এর কিছু হাদিস এবং তার জীবনের দু একটি ঘটনাকে এর সপক্ষে যুক্তিপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করাতে চাইছেন তাদের আমরা বলব মুর্খ মোল্লাদের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার জন্য খুব একটা দায়ী করা যায় না। কিন্তু যারা দেশে বিদেশে বড় বড় ডিগ্রী নিয়েছেন, যারা স্বগর্বে নিজেদের নামের পূর্বে ডক্টরেট উপাধি লাগিয়ে থাকেন, জন্মসূত্রে মুসলিম হবার পরও প্রিয়নবীর জীবন সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রসূত বক্তব্যের জন্য অবশ্যই তাদের দায়ী করা যায়। কারণ, আর যাই হোক রাসুল (সা) এর হাদিস বা জীবনী থেকে পৌত্তলিক বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো যায় না। আলী ইবন আবু তালিব (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল (সা) কোন মুর্তি দেখলেই তা ধ্বংস করার নির্দেশ দিতেন।(সহীহ মুসলিম, খণ্ড-২, পৃঃ৪৫৯, হাদীস নং-২১১৫) এছাড়া আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল (সা) বলেছেন, “তাদের (ইহুদী-নাসারা) মধ্যে একজন সৎকর্মশীল ব্যাক্তি মারা গেলে তারা তার কবরের উপর উপাসনার স্থান তৈরী করে এবং তার উপর ঐ ধরণের ছবি আঁকে। তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে খারাপ ব্যাক্তি।” (সহীহ বুখারী, খন্ড-২, পৃঃ২৫, হাদীস নং-৪১৯) শুধু তাই নয় পুরাতন বাইবেলেও প্রতিমুর্তি নিষিদ্ধ করে বলা হয়, “ তোমরা নিজেদের জন্য জন্য কোন খোদাই করা প্রতিমূর্তি তৈরী করবে না……” (এক্রোডাস, ২০:৪)

বস্তুত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মুহম্মদ (সা) কে পাঠিয়েছিলেন শিরক আর পৌত্তলিকতার বীজকে সমূলে উপড়ে ফেলে ইসলামী আকিদাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। অথচ পশ্চিমা তাঁবেদার এই সব অপশক্তি জাতীয় ঐতিহ্যের উছিলায় এদেশ থেকে চিরতরে ইসলাম ধ্বংস করে আবারো এ জাতিকে পৌত্তলিকতা ও শিরকের গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করতে চায়। তারা চায়, এদেশের তরুণ সমাজও ধ্বংসম্মুখ পাশ্চাত্য বিশ্বের মত লাগামহীন নৈতিকতা বিবর্জিত জীবনে অভ্যস্থ হোক। কুকুর-বিড়ালের মত বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচার হোক তাদের নিত্যসঙ্গী। আর তাই, কৃষ্টি, কালচার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আধুনিকতা, ইত্যাদির উছিলায় বিকৃত বাউল সংস্কৃতিকে তারা জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এরাই হচ্ছে সেই শক্তি যারা নারী উন্নয়ন নীতিমালা, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী মুক্তি ইত্যাদি আকর্ষণীয় ব্যনারে পশ্চিমের নারীদের মত এদেশের নারীদেরও পুরুষের বিকৃত বাসনা পূরণের সেবাদাসীতে পরিণত করতে চায়। এদেশের ধর্মভীরু মানুষকে ভোগবাদী জীবনের দিকে ঠেলে দিয়ে সুগম করতে চায় পশ্চিমা পুঁজিপতিদের মুনাফা অর্জনের পথ।

তাই যারা না বুঝে বাউল সংস্কৃতির পক্ষ নিচ্ছেন তাদের উচিত, রাও ভেবে চিন্তে পক্ষ নেয়া। কারণ, যারা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইমান আকিদার বিরুদ্ধে, যারা সাম্রাজ্যবাদী ও দখলদার পুঁজিবাদীগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষাকারী, যারা শোষক আর শোষিতের চিরন্তন আদর্শিক সংগ্রামে বঞ্চিত অসহায় মানুষের বিপক্ষের কাতারের মানুষ তারা কখনো এদেশ ও জাতির বন্ধু হতে পারে না। যারা এদেশে সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথকে সুগম করতে চায় তারা কখনো দেশপ্রেমিক হতে পারে না। যাদের কর্ণকুহরে আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক, দারফুর, কঙ্গো, পাকিস্তান, কাশ্মীর সহ পৃথিবীর আপামর নির্যাতিত গোষ্ঠীর আর্তনাদ পৌছায় না তারা কখনো মানবদরদী হতে পারে না। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদীদের হাতিয়ার ও আমাদের ইমান-আকিদাহ ধ্বংসকারী এই সব গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমাদের জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাদের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চেহারাকে জনগণের সামনে উন্মোচিত করতে হবে। সর্বোপরি রাসুল (সা) প্রদর্শিত পদ্ধতিতে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্থানে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করে ধংস করে দিতে হবে তাদের সকল ষড়যন্ত্রের পথ।

সহায়তাঃ

বাউল তত্ত্ব” - ডঃ আহমদ শরীফ।
বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” - লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডঃ আনোয়ারুল করিম।


ফাহমিদা ফারহানা খানম,
০৭ নভেম্বর ২০০৮
                                                                                     
শিরোনাম আংশিক পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন