শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১২

খিলাফত শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ ও রূপরেখাঃ অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা

একমাত্র খিলাফত শাসন ব্যবস্থাই পারে অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা করতে।

১. ভূমিকা

সুশীল সমাজে ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার সম্পর্কে একটি আলোচনা-সমালোচনা বিরাজমান। উপরন্তু এই বিষয়টি সম্পের্কে বিভিন্ন মহলে একটি অস্পষ্ট ধারণা বিদ্যমান। এ প্রেক্ষাপটে খিলাফত রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি আলোচনা করা জরুরী।

২. বাস্তবতা

বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এখানে রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ইত্যাদি সম্প্রদায়ের বাস। একটি রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সাথে অন্যান্য সম্প্রদায়ের নাগরিকদের সম্পর্কের বিষয়টি কখনও কখনও নেতিবাচকভাবে আলোচিত হয়। অনেকে ধারণা করেন বাংলাদেশের মুসলমানদের সাথে অমুসলিমদের কোন সম্প্রীতির সম্পর্ক বিরাজমান নেই। উপরন্তু এখানে অমুসলিমদের বিভিন্ন অধিকার সুরক্ষিত কিনা সন্দেহ পোষণ করা হয়। মুসলিমদের দ্বারা প্রায়ই বিভিন্ন সময় অমুসলিমদের উপর হত্যাযজ্ঞ ও লুণ্ঠন চালানোর অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, এখানে মুসলিম কর্তৃক অমুসলিমদেরকে তাদের পৈতৃক বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনাও ঘটে হরহামেশাই। প্রায়ই বাংলাদেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকে জোর করে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় বলেও প্রচার করা হয়। এর কারণ হিসাবে ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করা এবং উদ্ভুত ধর্মীয় মৌলবাদকে চিহ্নিত করা হয়।

২০০৩ সালে ১৩ মে জেনেভায় জাতিসংঘের অফিসে এক সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধি সিতাংশু গুহ বাংলাদেশে অমুসলিমদের উপর সংঘটিত ঘটনাবলীকে ‘নীরব গণহত্যা’র সাথে তুলনা করেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরো একটি গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে সেনাবাহিনীতে অমুসলিমদের নিয়োগকে অনুৎসাহিত করা ও সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদ অর্জনের পথে তাদেরকে বিভিন্নভাবে বাধা দেয়া হয়।

৩. উপরোক্ত দাবীসমূহের অসারতা

প্রকৃতপক্ষে একটু গভীর ভাবে উপলব্ধি করলেই উপরোক্ত অভিযোগগুলোর পিছনের আসল উদ্দেশ্যটি বুঝা য়ায়। বর্তমানে ধর্ম নিরপেক্ষ পূঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইসলাম ছাড়া আর কোন শক্তিশালী প্রতিপক্ষই অবশিষ্ট নেই। তাই যেকোন উপায়ে ইসলামের উপর আঘাত করে মুসলমান ও ইসলামের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি এবং ইসলামকে দূর্বল করার সব রকমের প্রচেষ্টা চালানো হয়। আসলে যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনা যেনতেন উপায়ে ইসলামের উপর চাপিয়ে দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে বিরূপ একটি ধারণা তৈরী করা বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার একটি কৌশল। সেই কৌশলের অংশ হিসাবেইে বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে অমুসলিদের অধিকার হরণকারী উগ্র এবং ইসলামকে অসহিষ্ণু ধর্ম হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। আর এদেশের মুসলামাদেররকে চিত্রিত করা হয় গোঁড়া সাম্প্রদায়িক হিসাবে। এজন্য বিভিন্ন সময় পরিচিত অপরিচিত নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন থাকলে যে কেউ বুঝতে পারবে এখানে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ একেবারে শূণ্যের কোঠায়। শুধুমাত্র অমুসলিমরা নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরাও এখানে গড়পড়তাভাবে জুলুমের শিকার হয়। এবং সংখ্যাধিক্যের জন্য মুসলমানদের উপর সংঘটিত অত্যাচারের সামষ্টিক পরিমাণ অন্য যে কোন সম্প্রদায়ের উপর সংঘঠিত অত্যাচারের তুলনায় বহুগুণ বেশী। এদেশে হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের ধর্মমতে জন্য নয় বরং একটি তথাকথিত পূঁজিবাদি সেক্যুলার রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্যজনক নাগরিক হওয়ার কারণেই সেই রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকের মতই অত্যাচারের শিকার হয়। বস্তুতপক্ষে সেক্যুলার রাষ্ট্রের মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিকই তাদের অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত হয়। বরং এ বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিকূল তৎপরতা ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের স্থাপিত বিভিন্ন উষ্কানীমূলক দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও এখানকার মুসলমানরা শুধুমাত্র ইসলামী মূল্যবোধের কারণেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় বদ্ধপরিকর। এছাড়াও উল্লেখ্য যে, বর্তমানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টকরা ও অমুসলিমদের অধিকার হরণের যত কারণই উল্লেখ করা হোক না কেন তার জন্য কিছুতেই ইসলামকে দায়ী করা যায় না। কারণ বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা হচ্ছে পূঁজিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এ রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যর্থতার দায় ইসলামের উপর আরোপ করা কখনোই যৌক্তিক হতে পারে না। ‘যত দোষ নন্দঘোষ’- এ নীতিতে যেকোন অপকর্মের দায় ইসলামের উপর চাপানো আসলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেকে টিকিয়ে রাখার মানসে বুদ্ধিবৃত্তিক শূণ্যতা থেকে উৎসারিত একটি অপচেষ্টারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে এ ধরণের রাষ্ট্রব্যবস্থা গুটিকয়েক অত্যাচারী শাসক ব্যতিত মুসলিম-অমুসলিম কারো অধিকারই সংরক্ষণ করতে পারে না।

৪. প্রকৃত কারণ

বাংলাদেশের মুসলমানদের উপর আরোপিত উপরোক্ত অভিযোগগুলো গুরুতর তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এর প্রকৃত কারণসমূহ কি তা তেমন স্পষ্টভাবে কখনোই আলোচিত হয়নি। নিম্নে এর প্রধান দুটি কারণ আলোচিত হলঃ

৪.১. আওয়ামী বিএনপির বিভক্তির রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- একে অন্যকে প্রতিপক্ষ হিসাবে মনে করে। এক দল অন্য দলকে ঘায়েল করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার সব ধরণের কৌশল ব্যবহার করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের অমুসলিম সম্প্রদায় সবসময় এ দুটি দলের রেষারেষি ও ফায়দা লুটার অসুস্থ রাজনীতির শিকার। বিশেষ করে ভোটের রাজনীতিতে অমুসলিম নাগরিকদের অবস্থাকে এমনভাবে চিহ্নিত করা হয় যেন কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী অবস্থান ছাড়া বাংলাদেশে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই অসম্ভব । অপর পক্ষে অন্য দলটিকে অমুসলিমদের প্রতিপক্ষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এ জন্য দেখা যায় বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা থেকে এসব ঘটনার শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে নজর না দিয়ে এগুলোকে আরো বিস্তৃত করার চেষ্টা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এ দুটি রাজনৈতিক দলের বিভক্তির রাজনীতি বাংলাদেশে অমুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমানদের সাথে তাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সবচেয়ে বড় বাধা। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিভক্তির রাজনীতি টিকিয়ে রেখে এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষন করা প্রায় অসম্ভব।

৪.২. সাম্রাজ্যবাদীদের ইসলাম বিরোধী প্রচারণা

সমাজতন্ত্রের পতনের পর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ পূঁজিবাদী শক্তি নতুন প্রতিদ্বন্দ্বি পরাশক্তি হিসেবে ইসলামের আগমনের ভয়ে ভীত। তাই সবসময় তারা ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে। মুসলিম-অমুসলিমদের মধ্যে উস্কানী দিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। এভাবে তাদেরকে দূর্বল করে শাসন ও শোষণ করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, মতাদর্শিক রাষ্ট্র হিসেবে খিলাফত রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরে বসবাসকারী প্রত্যেক ধর্মমতের অনুসারীদের শান্তিপূর্ণ সহবস্থান নিশ্চিত করার সর্বত্মক ব্যবস্থা করে। অতীতেও এর প্রমাণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশরা আসার আগ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তারা এসে “ডিভাইড এন্ড রুল” নীতিতে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি নষ্ট করে। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে ভারত ইঙ্গ-মার্কিন গোষ্ঠী মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী সব অপ্রীতিকর ঘটনায় প্রকাশ্যে ও গোপনে ইন্ধন যোগাচ্ছে। বাংলাদেশও তাদের এই ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত নয়। কারণ বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাবের সম্ভাবনাকে তারা কখনোই সন্দেহের বাইরে রাখেনি। তাছাড়া আমাদের দেশের প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এখানে অস্থিরতা তৈরী করা একান্তই প্রয়োজন। আর হিন্দু মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা এই অস্থিরতা তৈরী করারই অংশ বিশেষ। পূঁজিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণের অধিকারসমূহের নিশ্চয়তা দেয়ার কোন যোগ্যতাই নেই।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য আমাদেরকে ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এ ব্যাপারে ইসলামের সুনির্দিষ্ট কতগুলো মূলনীতি রয়েছে। নিম্নে এই মূলনীতিগুলো আলোচনা করা হলঃ

৫. ইসলামের মূলনীতি

মূলত দু’টি প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় রেখে খিলাফত রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণের সর্বাত্মক ব্যবস্থা করা হবে।

ক) মতাদর্শিকঃ

ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্ম নয়, বরং এমন একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা যা জীবনের সব বাস্তব সমস্যার সমাধান দেয়। যেমন যে কোন সেক্যুলার পূঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে হিন্দু ধর্মসহ বিভিন্ন ধর্মের জনসমষ্টি বসবাস করে তেমনি খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও সব ধর্মের জনসমষ্টি বসবাস করতে পারে। বরং খিলাফত রাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ার লক্ষ্যেই তার নিজস্ব ভূখন্ডের সকল ধর্মমতের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেকে আভ্যন্তরীণভাবে দৃঢ় ও সংহত করবে। আল্লাহ্ (সুবাঃ) বলেন,

“তাছাড়া তোমরা পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। যদি তা কর, তবে তোমরা কাপুরুষ হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব চলে যাবে।” (আল-আনফালঃ ৪৬)

সুতরাং খিলাফত রাষ্ট্রের প্রভাব সমুন্নত রাখতে মুসলিম- অমুসলিম সম্প্রীতি তথা রাষ্ট্রের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা অপরিহার্য।

খ) মানবিকঃ

ইসলাম মানুষের প্রত্যেকটি সমস্যাকে মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে। মানুষের সাধ্যের অতিরিক্ত কোন বোঝা ইসলাম তাদের উপর চপিয়ে দেয় না। এটি কোন মানুষের মনগড়া ধর্ম নয়। বরং এ হচ্ছে মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহ্ (সুবাঃ) প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা কোন একক সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীর জন্য নয়। বরং এ হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য। ইসলামের শ্বাশত ও সার্বজনীন বাণী নিয়ে যাঁকে প্রেরণ করা হয়েছে, সেই সর্বশ্রেষ্ট ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ (সুবাঃ) বলেনঃ-

“আপনি বলুন; হে মানব মন্ডলী! আমি তোমাদের সকলের কাছে আল্লাহর প্রেরীত রাসূল। সমগ্র আসমান ও যমীনে যার রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনিই জীবন ও মৃত্যু দান করেন।” (সূরা আরাফ-১৫৮)

উপরোক্ত আয়াতটি গোটা মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র মুসলমাদের উদ্দেশ্যে নয়। খিলাফত রাষ্ট্রের বিধান প্রদানকারী সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দৃষ্টিতে বর্ণ, গোত্র, জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। তিনি ইরশাদ করেনঃ

“হে মানবগোষ্ঠী! আমি তোমাদেরকে একজন পরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক মুত্তাকী।” (সূরা হুজরাতঃ১৩)

বস্তুতঃ ইসলামের আগমনই হয়েছে মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা ও প্রবৃত্তিগুলো পূরণ করা তথা সকলের মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করার জন্য। ইসলাম এক্ষেত্রে মুসলিম অমুসলিমের কোন ভেদাভেদ নির্ণয় করেনি। খিলাফত রাষ্ট্র অমুসলিমদের যে অধিকারগুলো বিশেষভাবে বাস্তবায়ন করে তা হচ্ছেঃ

ü  খাদ্য-বস্তুর-বাসস্থানের অধিকার,
ü  রাজনৈতিক অধিকার,
ü  বিশ্বাসের অধিকার,
ü  সামরিক অধিকার
ü  জান-মালের নিরাপত্তা,
ü  বিচার প্রাপ্তির অধিকার,
ü  শিক্ষার অধিকার,
ü  অর্থনৈতিক অধিকার,
ü  নাগরিক ও সামাজিক অধিকার।

ইসলামী রাষ্ট্র খিলাফতের অধীনে বসবাসকারী প্রত্যেকটি নাগরিক এই সবগুলো অধিকার ভোগ করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে মুসলিম অমুসলিম নাগরিকগণের মধ্যে খিলাফত রাষ্ট্র কোনরূপ পার্থক্য করে না। নিম্নে খিলাফত রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণে বাস্তবায়িত ইসলামের মূলনীতিসমূহ আলোচিত হল।

৫.১. খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অধিকারঃ

খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে খিলাফত রাষ্ট্র মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিককে সমানভাবে বিচার করে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিকের এ তিনটি মৌলিক চাহিদা পূরণ খিলাফত রাষ্ট্রের উপর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এক্ষেত্রে ইসলাম সামগ্রিকভাবে মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিককে নিশ্চয়তা দেয়। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

“তিনটি বস্তু ছাড়া আদম সন্তানের আর কিছুর অধিকার নেই। তাহলোঃ বসবাসের জন্য একটি ঘর, দেহ ঢাকার জন্য কিছু বস্ত্র এবং কিছু রুটি ও পানি।”

এখানে ‘আদম সন্তান’ বলতে মুসলিম-অমুসলিম সকলকে বোঝানো হয়েছে। খলিফা ওমর (রাঃ) মিসরের গভর্ণর আমর ইবনুল আসকে (রাঃ) লেখা এক চিঠিতে বলেছেনঃ

“কসম আল্লাহর, আমার ভয় হয় তোমার শাসনাধীন এলাকার দূরতম কোণায় যদি একটি উট অবহেলায় মারা পড়ে তবে কিয়ামতের দিন আমাকে এরও জবাবদিহি করতে হবে।”

খিলাফত রাষ্ট্রের কর্ণধার খলিফা এভাবেই তার রাষ্ট্রসীমায় বসবাসকারী প্রত্যেক মানুষ নয় শুধু, বরং প্রত্যেকটি প্রাণীর চাহিদার ব্যাপারেও চিন্তা করেন। তাছাড়া অমুসলিম মুআহিদদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের বিষয়ে মুসলমানদের থাকবে বিশেষ ঈমানী দায়িত্ব। ইমাম কারখী (রহঃ) খিলাফত রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের প্রতি মুসলমানদের কর্তব্য সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেন, “তাদের দূর্বলদের সেবা দেওয়া, নিঃস্বদের যাবতীয় প্রয়োজন মিটানো, অনাহারিদের খাদ্য দেওয়া, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া, তাদেরকে সুন্দরভাবে সম্বোধন করা, এমনকি তাদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার ক্ষতির শিকার হলে প্রতিকার করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা মেনে নেওয়া হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মুসলমানদের উপর আরোপ করা দায়িত্ব।”

৫.২. রাজনৈতিক অধিকারঃ

খিলাফত রাষ্ট্রের একটি গুরুত্ব পূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে House of Represntatives বা মজলিসে সূরা। এটি খিলাফত রাষ্ট্রের একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনের সদস্যবৃন্দ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে খলিফাকে অবহিত করেন এবং এসমস্ত বিষয়ে খলিফাকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এজন্য একে বলা হয় পরামর্শ সভা বা মজলিসে সূরা। খলিফা যদি কোন বিষয় ইসলাম অনুসারে সমাধান না করে, তবে মজলিসের সূরার সদস্যরা এই বিষয়ে খলিফার কাছে কৈফিয়ত তলব করতে পারেন। অমুসলিমরাও এ সভার সদস্য হতে পারেন। এমনকি এর জন্য তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থি কোন শপথ করতে হয় না। এই রাজনৈতিক অধিকার লাভের মাধ্যমে তারা নিজেদের দাবী এবং প্রস্তাবসমূহ বিনা বাধায় খিলাফত সরকারের সামনে উপস্থাপন করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা কোন প্রকার রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হবে না।

৫.৩. ধর্মপালন বা বিশ্বাসের অধিকারঃ

ইসলামী রাষ্ট্র কখনও কোন অমুসলিমকে নিজের ধর্মপালনে বাধা দেয়না। কিংবা জোর করে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেনা। পবিত্র কুরআন এ ব্যাপারে পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছেঃ-

“দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জোর-যবরদস্তি নেই।” (আল-বাকারাঃ ২৫৬)

প্রত্যেকটি অমুসলিম নাগরিক সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত মনে নিজ নিজ উপসনালয়ে যাতায়াত করবে। কেউ তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারবে না। আবু উবায়দ (রহঃ) ‘কিতাবুল আমওয়াল’ নামক গ্রন্থে এমন কতিপয় অঞ্চলের নাম উল্লেখ করেছেন, যা খিলাফতের নিকট পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু সেখানের অধিবাসী অমুসলিমদেরকে তাদের ধর্ম পালন এবং উপাসনার পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অমুসলিমদের ধর্মীয় স্থাপনা বা উপসনালয়ের কোন ক্ষতিসাধন তো দূরের কথা বরং খিলাফত নিজ দায়িত্বে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। ইতিহাস স্বাক্ষী, খিলাফত যখন জেরুজালেম শাসন করছিল, তখন খৃষ্টানদের চার্চ এবং গির্জাগুলোকে খুবই ভালভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ গীর্জার সম্পূর্ণ রক্ষণাবেক্ষন করত একটি মুসলিম পরিবার। বংশানুক্রমে আজও সেই মুসলিম পরিবারটিই উক্ত গীর্জার চাবী সংরক্ষণ করছে এবং প্রতিদিন সকাল-বিকাল গীর্জাটি খুলছে ও বন্ধ করছে। খিলাফত সরকার বিনা কারণে অমুসলিমদের কোন উপাসনালয় বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিতে পারেনা। এমনকি সেখানে উপাসনাকারীদের উপর গোয়েন্দাগিরিও করতে পারেনা। যে অন্যায়টি বর্তমানে মুসলমানদের মসজিদ সম্পর্কে করছে মার্কিন এবং বৃটিশ শাসকরা।

স্যার থমাস তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন “আমাদের এমন কোন তথ্য জানা নেই যে, খিলাফত শাসন চলাকালীন ইসলামী কর্তৃপক্ষ কিংবা কোন সংগঠন কোন অমুসলিমকে জোর করে মুসলমান বানানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে কিংবা খৃীষ্টানদেরকে উত্যক্ত করার কোন পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।” তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “যদি এমনটি হতো- তাহলে রাজা ফার্ডিনেন্ড এবং রাণী ইসাবেলার নিষ্ঠুর পদক্ষেপের দরুণ যেমন স্পেন মুসলিম শূণ্য হয়ে পড়েছিল এবং সাড়ে তিন শত বছর যাবত বৃটেনে ইয়াহুদীদের কোন নিবাস ছিল না, তেমনি জেরুজালেমও খৃষ্টান ইয়াহুদী শূন্য হয়ে যেত।”

৫.৪. সামরিক অধিকার

শক্তিশালী মতাদর্শিক রাষ্ট্র হিসাবে খিলাফত রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী নিয়মিত সামরিক বাহিনী থাকবে। এর প্রত্যেক সদস্যকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিয়মিত বেতন দেয়া হবে। এই নিয়মিত বাহিনীতে মুসলিমরা যেমন অর্ন্তভুক্ত থাকবে তেমনি অমুসলিমরাও এর সদস্য হতে পারবেন। মুসলমানরা তাদের বিশ্বাসকে সমুন্নত রাখতে এবং অমুসলিমরা বেতন-ভূক্ত কর্মচারীর মর্যাদায় একটি লাভজনক পেশা হিসাবে এ বাহিনীর সদস্য হবেন। আল-জাহরির বর্ণনামতে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যুদ্ধে কিছু ইয়াহুদীর সাহায্য নিয়েছিলেন এবং তাদের জন্য রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে একটি অংশ নির্ধারণ করেছিলেন। ওহুদের যুদ্ধে অমুসলিম খোজমান মুসলমানদের সাথে অংশ গ্রহণ করে বনু আবু যর গোত্রের তিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে রাসূল (সাঃ) বলেন “নিশ্চই অমুসলিমদের দ্বারা আল্লাহ এই দ্বীনকে সাহায্য করেন।” মুশরিক থাকাকালীন সাফওয়ান আবু উমাইয়া মুসলমানদের সাথে খায়বার অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নির্ধারণ করে দেন। রাসূলূল্লাহ্ (সাঃ) অন্য এক হাদিসে বলেনঃ যার অর্থ নিম্মরূপ “যে নিজের জন্য যুদ্ধ করবে সে পুরষ্কার পাবে আর যে অন্য কারো জন্য যুদ্ধ করবে সে পাবে মজুরী।” অন্য হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “আমার উম্মতের যারা মজুরির বিনিময়ে যুদ্ধ করে শত্রুর বিরুদ্ধে নিজেদেরকে শক্তিশালী করে তারা মুসার মায়ের মত যে তার নিজের সন্তানকে দুগ্ধ পান করিয়ে পুরষ্কার (মজুরি) পেয়েছিল।” এখানে ‘যারা’ বলতে অমুসলিমদেরকে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং খিলাফত রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে অমুসলিমগণ নির্বিঘ্নে যোগদান করতে পারেন। তেমনিভাবে পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহীনিতেও অমুসলিমদের অন্তর্ভূক্তিতে কোন বাধা নেই। বরং খিলাফত রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকগণ এক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা ভোগ করেন; রাষ্ট্রকে সামরিকভাবে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে মুসলমানদের উপর বাধ্যবাধকতা থাকলেও অমুসলিমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। খলিফা অমুসলিম নাগরিকদেরকে সামরিক বাহিনীতে যোগদানে বাধ্য করতে পারে না।

৫.৫. জান-মালের নিরাপত্তাঃ

খিলাফত রাষ্ট্রে একজন মুসলমানের মতই একজন অমুসলিম মুআ‘হিদের জীবন পবিত্র ও সুরক্ষিত থাকে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেনঃ-

“যদি কোন ব্যক্তি কোন মু’আহিদকে হত্যা করে তবে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবেনা। যদিও চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকেই জান্নাতের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।” (বুখারী শরীফ)

তিনি আরো বলেন- সাবধান! কেউ যদি কোন মু’আহিদের প্রতি যুলুম করে কিংবা তার অধিকার হতে কিছু কমিয়ে দেয়, অথবা তার সাধ্যাতিত কোন কাজ তার উপর চাপিয়ে দেয়, বা তার স্বতস্ফূর্ত অনুমতি ছাড়া তার কোন সম্পদ নিয়ে নেয়- তাহলে আমি কিয়ামত দিবসে তার বিরুদ্ধে মামলা করব এবং সে মামলায় জিতব।” (আবু দাউদ)

রাসূল (সাঃ) এর যুগে এক মুসলিম ব্যক্তি অপর এক অমুসলিমকে হত্যা করলে বিচারে তিনি হত্যাকারী মুসলিম ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং তা কার্যকর করেন।

৫.৬. বিচার প্রাপ্তির অধিকারঃ

খিলাফত রাষ্ট্রে বিচার প্রাপ্তির অধিকার সবার জন্য সমান। খলীফা কিংবা তাঁর সরকারের যে কোন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও মুসলিম অমুসলিম যে কোন নাগরিক নির্দ্বিধায় বিচার প্রার্থী হতে পারে। বিচারক বাদী বিবাদীর মাঝে কে মুসলিম কে অমুসলিম কিংবা কে খলীফা কে সাধারণ নাগরিক এই বিবেচনায় বিচার কার্য পরিচালনা করেন না। বরং তার উপর ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে ন্যায়-ইনসাফের ভিত্তিতে বিচার করার। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ-

“যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার কার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কতই না উত্তম।” (সুরা নিসাঃ ৫৮)

অন্য আয়াতে ইয়াহুদীদের প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তাঁর রাসুলকে নির্দেশ দিয়েছেন এই বলে যেঃ

“যদি ফয়সালা করেন তবে ন্যায়ভাবে ফয়সালা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ্ সুবিচারকারীকে ভালবাসেন।” (মায়িদাঃ ৪২)

খিলাফতের ইতিহাসে এমন অনেক অবিস্মরনীয় বিচারের ঘটনা ঘটেছে যা একদিকে ন্যায়বিচারের ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ অন্যদিকে সর্বকালের অমুসলিমদের জন্য হয়ে আছে অনুপ্রেরণার উৎস। আলোচনা দীর্ঘ না করার স্বার্থে শুধুমাত্র একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি। সপ্তম শতাব্দির ঘটনা। তখন খিলাফতের মসনদ অলংকৃত করে আছেন মহাবীর হযরত আলী (রাঃ)। একজন ইয়াহুদী নাগরিক খলীফা আলীর (রাঃ) একটি ঢাল চুরি করলে বিষয়টি বিচারালয়ে উত্থাপিত হয়। তখন কাজী অর্থাৎ বিচারক খলীফাকে তার পক্ষে স্বাক্ষী উপস্থিত করতে বলেন। হযরত আলী তাঁর পুত্রকে স্বাক্ষী হিসাবে হাজির করেন। বিচারক মামলাটি খারিজ করে দেয় এই বলে যে, কোন পিতার পক্ষে পুত্রের স্বাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। ন্যায় বিচারের এই চমৎকারিত্য দেখে ইয়াহুদী লোকটি দারুণভাবে অভিভূত হয় এবং চুরির কথা স্বীকার করে নিজেই মুসলমান হয়ে যায়। এমন অনেক ঘটনা খোদ রাসূল (সাঃ) এর জীবনেও ঘটেছে। যেখানে অমুসলিমরা নিজেদের ধর্মীয় নেতার কাছে না গিয়ে মুকাদ্দমা নিয়ে ইসলামের আদালতে এসেছে এই আশায় যে এখানেই পাওয়া যাবে প্রকৃত ন্যায় বিচার। আমরা আশা করি, ইসলামের এই ইনসাফ ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা এদেশের অমুসলিমদেরকে আশ্বস্ত করবে এবং ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহকে তীব্র করবে। আর অপপ্রচারকারীদের চেহারাকে করবে মলিন।

৫.৭. শিক্ষার অধিকারঃ

একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ার লক্ষ্যে খিলাফত রাষ্ট্র তার নাগরিকদেরকে শিক্ষিত করে তুলবে। নাগরিকগণ তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী বিজ্ঞান, ব্যবসা, আইন, শিল্পকলার মত যেকোন শাখায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। খিলাফত রাষ্ট্রের শিক্ষা সম্পূর্ণ অবৈতনিক। শিক্ষা দান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করে না। শত শত বছর ধরে খিলাফত রাষ্ট্রে এমন শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়িত ছিল। এই শিক্ষাব্যবস্থার সুফল হিসেবে খিলাফত রাষ্ট্রে বিভিন্ন বিষয় হাজার হাজার বিশেষজ্ঞ তৈরী হয়েছিল। এদের মাঝে অমুসলিমদের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। স্পেন মুসলিমদের অধিকারে আসার পর খিলাফত রাষ্ট্র কর্ডোভার পন্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। শুধু তাই নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অমুসলিমরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য নিয়মিত খিলাফত রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত। রাসূল (সাঃ) বদরের যুদ্ধে বিভিন্ন রকম মুক্তিপণের বিনিময়ে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল একজন শিক্ষিত যুদ্ধবন্দির মুক্তিপণ হিসেবে দশজন মুসলিমকে শিক্ষাদান।

৫.৮.অর্থনৈতিক অধিকারঃ

খিলাফত রাষ্ট্রের অর্থনীতি খুবই সরল এবং নাগরিক বান্ধব। এ ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক সম্পদ তথা তেল গ্যাস কয়লা ইত্যাদি কোন কিছুই প্রাইভেট কোম্পানীকে দেওয়া হয়না। সরাসরি সরকারের তত্ত্বাবধানে রেখে এ খাত থেকে লব্ধ আয় জমা রাখা হয় সরকারী ট্রেজারী বা বাইতুল মালে। আর এর রাজস্ব ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র নাগরিকদের স্বার্থ সংলিষ্ট কাজে। আয় উৎপাদন কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রচলিত VAT এর মত অনাকাংখিত কোন কর দিতে হয়না। এ ক্ষেত্রে খিলাফত রাষ্ট্র মুসলমানদের তুলনায় অমুসলমানদের অনেক বেশী সুবিধা দিয়ে থাকে। কারণ মুসলমানদের যাকাত নামক একটি বিশেষ কর দিতে হয় যা অমুসলিম ব্যক্তি বা কোম্পানীকে দিতে হয়না। এমন আরও কিছু বিষয় আছে যা মুসলিম নাগরিকদের উপর বর্তায় কিন্তু অমুসলিমদের উপর বর্তায় না। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, অমুসলিমদের কাছ থেকে নাগরিক নিরাপত্তা বাবৎ যে জিযিয়া আদায় করা হয় তার হার মুসলমানদের যাকাতের হারের চেয়ে অনেক কম। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

“যে ব্যক্তি কোন মুআহিদের উপর জুলুম করবে; তার শক্তির বাইরে খারাজ ও জিযিয়া ধার্য করবে কেয়ামতের দিন আমি তার গর্দান পাকড়াও করব।”

খিলাফত রাষ্ট্র অমুসলিম নাগরিকদেরকে সরকারের প্রশাসনিক কাজে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে থাকে। এতে তারা তাদের মেধা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডে যোগ দানের মাধ্যমে ইসলামী সরকারের অর্থনীতিকে গতিশীল করার ব্যাপারে অবদান রাখতে পারেন। এখানে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উদ্ধৃতি বিষয়টিকে আরও সহজবোধ্য করে তুলবে। পনেরশ শতাব্দিতে ইয়াহুদীদেরকে যখন স্পেন থেকে বের করে দেওয়া হয়, তখন ইসলামী খিলাফত তাদেরকে স্বাগত জানায়। এই সুবাদে তারা স্বাস্থসেবা, গ্লাস তৈরী, মেটাল ওয়ার্কিং ইত্যাদি খাতে ইসলামী সরকারকে প্রচুর সহযোগিতা করেছিল। তৎকালে এই ইয়াহুদীরাই ছিল বিদেশী ব্যবসায়ীদের জন্য বড় বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বি। কারণ তাদের ছিল অসামান্য মেধা, কর্মদক্ষতা এবং বিদেশী ভাষাজ্ঞান। তাদের এই অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে তদানিন্তন উসমানী খলীফা সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ একটি বিখ্যাত উক্তি করে তিনি বলেছিলেন “তোমরা কি করে এই ফার্ডিনেন্ডকে বুদ্ধিমান বল, যে নিজের নাগরিকদেরকে বের করে দিয়ে তার সাম্রাজ্যকে করেছে গরীব আর আমাকে করেছে ধনী।”

৫.৯. নাগরিক ও সামাজিক অধিকারঃ

অমুসলিমরা খিলাফত রাষ্ট্রের বিশেষ সম্মানিত নাগরিক। তারা সবসময় নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপন করবে। নাগরিক নিরাপত্তা ও সকল প্রকার সামাজিক সুবিধা লাভের বিষয়ে খিলাফত রাষ্ট্রের সাথে তাদের একটি চুক্তি থাকবে। সেই চুক্তির আলোকে তারা হবে মুআহিদ। যার অর্থ হচ্ছে চুক্তিবদ্ধ নাগরিক। বর্তমান সমাজের মত সংখ্যালঘু (Ethnic Minorities) নামের কোন অমযার্দাকর উপলব্ধি তাদের থাকবে না। কিংবা বৃটেন বা আমেরিকার মত অভিবাসী নামের কোন পরিচিতি থাকবে না। যার দ্বারা একথা প্রমানিত হয় যে তারা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।

সকল মুসলমান তাদের সাথে সৎ ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করতে বাধ্য থাকবে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

“যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের ক্ষতি করল সে যেন আমাকে ক্ষতিগ্রস্থ করল।”

৬. উপরোক্ত মূলনীতিসমূহের বাস্তব ফলাফল

অমুসলিমদের সম্পর্কে ইসলামের এমন ইনসাফ ভিত্তিক মূলনীতিসমূহ এবং সেগুলোর সফল বাস্তাবায়নের ফলেই মুসলমানদের দ্বারা বিজিত এলাকাসমূহে অমুসলিমরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছিলেন। আফ্রিকা থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত এমনকি ইউরোপের অনেক রাষ্টেও ইসলাম বিজয়ীর বেশে গিয়েছিল। ঐসব রাষ্ট্রের তৎকালীন অমুসলিম নাগারিকরা ইসলামের ন্যায়বিচার দেখে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ইসলাম উদারতার মাধ্যমে আফ্রিকার অসভ্য আদিবাসী থেকে শুরু করে পারস্য ও রোমের মত পরাশক্তিধর সম্রাজ্য দুটির সুসভ্য নাগরিকদেরকে একই রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে পেরেছিল। তাই ইসলামের ন্যায়বিচারে মুগ্ধ হয়ে অর্ধপৃথিবীর মানুষ খিলাফতের ছায়াতলে এসে নিজেদেরকে ধন্য মনে করেছিল। এসব দেশের সাধারণ জনগণ কখনো ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি। উপরন্তু আমরা দেখি রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে খিলাফত না থাকলেও আজও মানুষ ইসলাম ত্যাগ করেনি। মধ্য এশিয়ার কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কিমিনিস্তান ইত্যাদি দেশসমূহে শত বছর মুসলমান ও ইসলামের উপর চরম অত্যাচার চালিয়ে সমাজতন্ত্রীরা জনগণকে ইসলাম থেকে এক দিনের জন্যও বিচ্যুত করতে পারেনি। বরং অধিকাংশ দেশেই ইসলামকে রক্ষা করার জন্য মুসলমানরা দখলদারদেরকে সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবিলা করছে। বাংলাদেশেও আমাদের পূর্বপুরুষরা হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ খ্রিষ্টান তথা মানুষ হিসেবে নির্বিশেষে সকল মুসলিম-অমুসলিমের উপর ইসলামের ন্যায় বিচারে আকৃষ্ট হয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তার প্রমাণ এদেশের অধিকাংশ জনগণ এখনো ইসলামকে সব কিছুর চেয়ে বেশী ভালবাসে। এখনো এদেশের জনগণ বিশ্বাস করে ইসলাম তার সত্যিকার রূপ নিয়ে ফিরে আসলে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরে আসবে, মুসলিম-অমুসলিম সকলের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং এদেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।

৭. উপসংহারঃ

একটি মতাদর্শিক রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্মমতের অনুসারী জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও তাদের মৌলিক অধিকারগুলো সংরক্ষণ ছাড়া শান্তি স্থাপন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতিগুলো খুবই স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট। অতীতে বহু শতাব্দি ধরে এগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং তার সুফল সমাজ ভোগ করেছে। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অনেকগুলো অপপ্রচারের একটি হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার অভিযোগ। বাংলাদেশ একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হওয়ার পরও অমুসলিমদের অধিকার হরণের সব দায়ভার ইসলামের উপর চাপানো সম্পূর্ণরূপে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি - আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতিতে এদেশের অমুসলিমদের ব্যবহার করছে। তাদের অবস্থাকে এমনভাবে চিহ্নিত করা হয় যেন কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী অবস্থান ছাড়া বাংলাদেশে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই অসম্ভব। অপর পক্ষে অন্য দলটিকে অমুসলিমদের প্রতিপক্ষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তাই আমাদের সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ব্যর্থ এই সেক্যুলার রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সবাইকে মনোযোগী হতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন