বুধবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১২

খিলাফত শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ ও রূপরেখাঃ দারিদ্র দূরীকরণ, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা ও গণমানুষের অধিকার রক্ষা

একমাত্র খিলাফত শাসন ব্যবস্থারই পারে দারিদ্র দূরীকরণ, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা ও গণমানুষের অধিকার রক্ষা করতে পারে।

ভূমিকাঃ

বাংলাদেশের সরলপ্রাণ কঠোর পরিশ্রমী জনসাধারণ দারিদ্র বিমোচনের নামে অনেক প্রতিজ্ঞা আর প্রকল্পের ছড়াছড়ি দেখেছে; কিন্তু তার সাথে সাথে দিন দিন তাদের অবস্থার ক্রমাবনতি আর অধঃপতন ছাড়া কিছুই প্রত্যক্ষ করেনি। বছরের পর বছর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির মত সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানের এসএপি, পিআরএসপি ইত্যাদি নানা রকম প্রকল্পের নামে ছল-চাতুরী আর প্রতারণার আড়ালে বাংলার জনসাধারণের উপর সীমাহীন ঋনের বোঝা চেপেছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের জনগণের উপর সাম্রাজ্রবাদী রাষ্ট্রসমূহের শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ সুসংহত হয়েছে।

দুর্নীতিবাজ শাসকগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত জাতির সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। তাদের পেট আর পকেট ফুলে ফেঁপে উঠেছে। অথচ জনসাধারনের ভাগ্যের ক্রমাবনতি ছাড়া ন্যূনতম কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি। যখন পরিশ্রমী কৃষক ন্যূনতম সার আর বীজ ক্রয় করে কোন রকম টিকে থাকার সংগ্রামে বার বার পরাজিত হচ্ছে, ঠিক তখনই রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট দালাল চক্র, মজুতদার আর ফড়িয়াবাজরা কৃষকের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছে। জিডিপি বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উচু উচু বিল্ডিং আর বিলাসবহুল এপার্টম্যান্ট। বিদেশী প্রসাধনী পণ্য আর কোমল পানীয়ের বন্যায় বাজার ছেয়ে গেছে। অথচ বেকারত্বের মাত্রা এমন একটি জায়গায় এসেছে যেখানে অনেক উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক রিক্সা চালাতে কিংবা হোটেল রেস্তোরার বয় বেয়ারা হতে বাধ্য হচ্ছে। একই সময়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। 

এমন এক পরিস্থিতিতে স্বভাবতই কতগুলো প্রশ্ন আমাদের বুদ্ধি ও অস্তিত্বকে অসাড় করে দিতে চায়; এই চরম দারিদ্রের কোন সমাধান কি আদৌ নেই? আমাদের নেতৃত্ব জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদেরকে এই দুর্দশা থেকে বের করে আনতে কতটুকু দায়বদ্ধ? নাকি তারা শুধুই তাদের পেট পকেট আর শান শওকতের চিন্তায় বিভোর?

আজ আমাদের সমাজের চিন্তাশীল মানুষদের এসব সমস্যা আর প্রশ্ন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এর সমাধান খুঁজে বের করার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে জাতি আমাদের আন্তরিকতা আর দায়বদ্ধতা প্রত্যাশা করে। আর একমাত্র ইসলামের পক্ষেই এই সমস্যার সমাধান দেওয়া সম্ভব। কারণ ইসলাম মানুষের সমস্যা ও প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক অবগত। সুতরাং ইসলাম কিভাবে সমাজ থেকে দারিদ্র দূর করবে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

২. দারিদ্রের বর্তমান চিত্র এবং দারিদ্র দূরীকরণের জন্য গৃহীত নীতি ও কার্যক্রম সমূহ

দেশের ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে শতকরা ৪২ ভাগেরও বেশী মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে। উপরন্ত জনসংখ্যার শতকরা ৩৬ ভাগ মানুষ চরম দারিদ্রের শিকার।

২.১ দারিদ্রের মাত্রা নিরূপনের বিভিন্ন পদ্ধতি

দারিদ্রের সংজ্ঞা নিরূপণের অনেকগুলো পদ্ধতি আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। সংজ্ঞার পরিবর্তনের সাথে সাথে দারিদ্রের শতকরা হার এবং সংখ্যার তারতম্য হয় বটে কিন্তু বাস্তব অবস্থার সত্যিকার কোন পরিবর্তন হয় না। দারিদ্র নিরূপনের জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো গৃহস্থালীর ব্যয়ের (Household Expenditure Survey) উপর জরিপ পরিচালনা করে থাকে। এই জরিপে ১৯৯১/৯২ সাল পর্যন্ত সরাসরি ক্যালরি গ্রহণের (Direct Calorie Intake) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতির প্রধান সমস্যা হলো, এখানে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি কি পরিমাণ পুষ্টিমাণ গ্রহণ করে থাকে, সেটার উপর ভিত্তি করে দারিদ্র নিরূপণ করা হয়। কিন্তু মানুষের জন্য জীবনধারণের অন্যান্য উপকরণ, যেমনঃ বসবাসের ঘর, পরিধানের কাপড়, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় আনা হয় না। এই পদ্ধতিতে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। পশুদের জীবনধারণের জন্য যেমন খাদ্যগ্রহণটাই মুখ্য, মানুষেরও কি তাই?

১৯৯৫-৯৬ এবং ২০০০ সালের গৃহস্থালীর ব্যয় নির্বাহ নামক জরিপে দারিদ্র নিরূপণের পদ্ধতিতে গুণগত কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এ সমীক্ষাগুলোতে মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যয়পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে সীমিত আকারে হলেও মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যয়কে দারিদ্রের মাত্রা নিরূপণে বিবেচনায় আনা হয়। পদ্ধতিগত এই পরিবর্তনের পরও আমাদের সরকারগুলো দারিদ্রের মাত্রা কমিয়ে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে শিক্ষাবঞ্চিত, ভূমিহীন এবং কৃষকরাই মূলত এদেশে দারিদ্রের শিকার। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এদেশের সিংহভাগ মানুষই ভূমিহীন এবং কৃষক।

২.২ দারিদ্র দূরীকরণের জন্য গৃহীত নীতি ও কার্যক্রম সমূহ

বিগত ৩৫ বছর ধরে সব কটা সরকার দারিদ্র বিমোচনের জন্য একের পর এক কর্মসূচী ও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-১৯৭৮) সমাজের সকল স্তরের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করার নামে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের উপর জোর দেয়া হয়। কিন্তু যুদ্ধোত্তর অর্থনীতি পূণর্গঠনের চাপে সরকার তার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করতেই ব্যর্থ হয়। এরপরই আসে দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৮-৮০)। এই দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সরকারকে আসলে দিশেহারা অর্থনীতিতে পরিবর্তন এনে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও উন্নয়নের দিকনিদের্শনা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সম্পদের স্বল্পতার দরু সরকারকে চলমান কার্যক্রমগুলো কাটছাঁট করতে হয়। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৮০-৮৫) সরকার জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের বিষয়ে জোর দেয়ার কথা বলে। বস্তুত এ সময় সরকার তার অর্থনীতিকে বাজারমুখী করতে শুরু করে এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে সামাজিক বাধাগুলো অপসারণ করাকে তার প্রধান কাজ হিসেবে গণ্য করে। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলো একই ধারা বজায় রেখে চলে। প্রতিটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতে দারিদ্র বিমোচনের নামে কিছু নতুন প্রকল্প ও কিছু নতুন চমক উপস্থাপন করা হয়। কোন কোন সরকারের পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যখাত এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি গুরুত্ব পায়। আবার দেখা যায় অন্য সরকার মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতের উপর জোর দিচ্ছে। আর এসবের পাশাপাশি বার্ধক্য ভাতার মতো চমকতো আছেই। স্বাধীনতার পর থেকে সবকটি সরকার তাদের গৃহীত পরিকল্পনার মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনে বিরাট সাফল্য আশা করেছিল। কিন্তু আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সার্বিক অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।

দারিদ্র বিমোচনে সরকারগুলোর সীমাহীন ব্যর্থতা ঢাকতে সাম্প্রতিককালে নতুন নামে নতুন আঙ্গিকে কিছু পরিকল্পনার কথা অলোচিত হচ্ছে। এ সকল বাহারী নামের পরিকল্পনায় দারিদ্র বিমোচনে শিক্ষা, আর্থসামাজিক অবস্থা, সুশাসন এবং অবকাঠামোর উন্নয়নের মত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়।

পরিশেষে একথা নির্দ্বীধায় বলা যায় যে পরিকল্পনা অনেক, কিন্তু ফলাফল শূণ্য। সার্বিক বিচারে দেখা যাচ্ছে দারিদ্র বিমোচনের কৌশল নির্ধারণের বিষয়ে বাংলাদেশ একটি আদর্শ গবেষণা ক্ষেত্র। জনগণ অনেক পরিকল্পনা আর প্রকল্প দেখেছে, কিন্তু নিজেদের অবস্থার উন্নতির কোন সম্ভাবনা তারা দেখতে পায়নি।

৩. বর্তমান নীতিসমূহের সমালোচনা

সরকার কাগজে-কলমে দারিদ্র বিমোচনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা ও প্রকল্প প্রণয়ন করলেও বাস্তবে সরকারী অর্থ বরাদ্ধ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র বিবেচনায় আনলে দারিদ্র বিমোচন তাদের কাছে যে একটি উপেক্ষিত বিষয় তা পরিষ্কার ধরা পড়ে।

বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলো বিচার করলে দেখা যায় যে এ সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সত্যিকার কোন কার্যক্রম বা প্রকল্প সরকার হাতে নেয়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে স্বাস্থ্য, কৃষি, সমাজসেবা এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনভাবে এমন সব প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে যাতে দারিদ্র বিমোচনের বিষয়টি সত্যিকার অর্থে বিবেচনায় আসেনি। দ্বিতীয় ও তৃতীয়-পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পর্যালোচনার ফলাফলে দেখা গেছে যে দারিদ্র বিমোচনে যে পরিমান অর্থ বরাদ্ধ ছিল, সত্যিকার ব্যয় হয়েছিল তার থেকে অনেকগুণ কম। দারিদ্র বিমোচনের অনেক গালভরা বুলি সরকার শুনিয়ে থাকে এবং সরকারী পরিকল্পনায় এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশী জোর দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে দারিদ্র বিমোচনে সরকারী বরাদ্ধ কখনই দেশের জিডিপির ১৪% এর বেশী হয়নি।

৩.১ বর্তমান ব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তি

মৌলিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ অনুসরন করে, যা জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে পরিচালিত। এই পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিচারে যারা বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না, তাদের টিকে থাকার কোন অধিকার নেই। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, বর্তমান সময়ে প্রচলিত অসম প্রতিযোগিতায় যখন সিংহভাগ জনগোষ্ঠী টিকতে পারছেনা, তখন কি দেশের মানুষগুলোকে মেরে ফেলা হবে? সরকার সুকৌশলে এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গিয়ে ধোঁকাবাজীর মাধ্যমে জনগণকে বুঝাতে চায় তাদের গৃহীত প্রকল্প ও পরিকল্পনাগুলোর ফলে দেশের দারিদ্র দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর নির্দেশনায় গৃহীত এ সকল পরিকল্পনাগুলোর সফলতার বিষয়ে তারা নিজেরাই নিশ্চিত নয়। সুতরাং তারা এখন দারিদ্র বিমোচনের বদলে নতুন টার্ম দারিদ্র হ্রাসব্যবহার করা শুরু করেছে। অর্থাৎ তাদের নতুন নির্ধারিত লক্ষ্য দারিদ্র দূর করা নয়, দারিদ্র কমানো। এখানেই শেষ নয়, এর থেকেও ভয়াবহ বিষয় হচেছ দারিদ্র হ্রাসের গতি। তাদের মতে ক্ষেত্রবিশেষে দারিদ্র হ্রাসে ১০০ বছরেরও বেশী সময় লাগতে পারে। তাও যদি এই সময়ে সার্বিক অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে। অর্থাৎ বড় কোন পরিবর্তন এ সময়কে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

৩.২ কিছুসংখ্যক লোকের মাঝে সম্পদ পুঞ্জীভুত হওয়া

প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষকে সুনির্দিষ্ট মৌলিক চাহিদা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না; শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির সূচকের (জিডিপি) মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা হয়। বর্তমান অর্থনীতির এই মানদন্ডে অতি সহজেই গণমানুষের মৌলিক অধিকারকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির জটিল মারপ্যাঁচে লুকিয়ে ফেলা যায়। জনগণকে বুঝনো হয় জিডিপি বাড়লেই জনগণের অবস্থার উন্নতি ঘটবে।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জিডিপি, জিএনপি (GNP), জিডিপি পার ক্যাপিটা, জিএনপি পার ক্যাপিটা ইত্যাদিকে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিমাপের উপায় হিসাবে গ্রহণ করে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঠিক রেখে সন্তেুাষজনক জিডিপি পার ক্যাপিটা (মাথাপিছু আভ্যন্তরীণ আয়), জিএনপি পার ক্যাপিটা (মাথাপিছু জাতীয় আয়) অর্জন করা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র সন্তুষ্ট থাকে। আমাদের দেশের পুঁজিবাদের অনুসারী অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই হিসাব ও চিত্র নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। অথচ প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে জিডিপি পার ক্যাপিটার নামে অধিকাংশ জনগণের হাতে এর কোন সুফল না পৌঁছিয়ে আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা ও ব্যবসাক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণকারী কিছু অতিরিক্ত ধনী ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে এই পুরো প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রীভূত থাকে।

তাছাড়া দারিদ্র দূরীকরণের জন্য সাম্প্রতিক পিআরএসপি এবং মিলেনিয়াম ডেভলাপমেন্ট গোলের নামে প্রকল্পিত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামাজিক প্রেক্ষিত ইত্যাদিকে নুতন করে পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে। এগুলো পুঁজিবাদীদের গোপন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের এমন কতগুলো পরিকল্পনা যার মাধ্যমে তারা আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত তাদের বাজার স¤প্রসারণ করাসহ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো গঠনের প্রকল্পসমূহ বেসরকারী খাতে হস্তান্তরের মাধ্যমে গুটিকয়েক সুবিধাভোগী পুঁজিপতির হাতে পুরো ব্যবস্থাটির নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এটি কিছুতেই দারিদ্র সমস্যার সমাধান করবে না।

মৌলিকভাবে সম্পদ উৎপাদনকারী কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তির হাতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সমস্ত সুফল কেন্দ্রীভূত হয়। পুঁজিবাদ সম্পদের বন্টন ব্যবস্থার উপর কোন গুরুত্ব না দিয়ে বরং একে বাজারে চাহিদা ও সরবরাহ এবং চুঁইয়ে পড়া নীতির উপর ছেড়ে দেয়। সারা বিশ্বে এর বাস্তবতা পরিলক্ষিত - যেখানে মাত্র তিনশটি বহুজাতিকের হাতে বিশ্বের ২৫% সম্পদ পুঞ্জীভূত। পৃথিবীর বৃহৎ কিছু বহুজাতিক কোম্পানির বার্ষিক আয় আমাদের বাংলাদেশের মত অনেক দরিদ্র দেশের বার্ষিক জিডিপির তুলনায় বেশী। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতিই গুটিকয়েক ব্যক্তি ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশে এমন একটি সামাজিক বৈষম্য তৈরী হয়েছে যেখানে কাউকে কোটি টাকা দামের বারতম গাড়িটি কিনতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হয় না। অথচ অনেকের পক্ষে রিকশা ভাড়া যোগাড় করাই দুঃসাধ্য।

৩.৩ বেকারত্ব

বেকারত্ব পুঁজিবাদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদি আমরা একটু গভীরভাবে বাংলাদেশের বাস্তবতা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব শুধুমাত্র ধনীরাই নতুন প্রকল্পের জন্য সব রকম অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পায়, যার ফলশ্রুতিতে আরো বেশী বেকারত্ব তৈরী হচেছ। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মত প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী শিল্পগুলো বৃহৎ শিল্প মালিকদের অধিক মুনাফালোভী প্রবণতা ও অমানবিক প্রতিযোগিতার কাছে না টিকতে পেরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অথচ বৃহৎ শিল্পগুলো জিডিপিতে বেশী অবদান রাখার কারণে রাষ্ট্র সেগুলোকেই সবসময় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বেশী সুযোগ সুবিধা দেয়।

৩.৪ মানুষের তৈরী নিয়ম-কানুনের প্রতারণা

মানবরচিত পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভ্রান্ত চিন্তা শুধু নীতিগতভাবে ব্যর্থ তাই নয়, প্রায়োগিক দিক থেকেও এর ব্যর্থতা সীমাহীন। যার ফলে শোষণ এবং দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার লাভ করে আর দুর্নীতিগ্রস্থ সমাজব্যবস্থা দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি আরো স্পষ্ট যে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দুর্নীতি আরো বৃদ্ধি করেছে। মানুষ যেখানে জনসাধারনের ভাগ্য নির্ধারণ করে, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে এটি খুবই স্বাভাবিক। যে মানুষের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও সম্পদ পুঞ্জীভূত করার প্রবৃত্তি প্রবল, সেই মানুষই যখন আইন বানানোর ক্ষমতা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তখন সে অবশ্যই তার সুবিধা আদায় করে নিবে। তারা তাদের ক্ষমতাকে আরো বিস্তৃত করে আরো ধনী হবার জন্য। তারা আইনকে নিজের পক্ষে আনার জন্য তাদের অর্থ ব্যয় করে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে। যার ফলশ্রুতিতে জনসাধারনের উপর গুটিকয়েক মানুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

৩.৫ ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থা ও এনজিওদের ভূমিকা

জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি ব্যয় হয় নির্বাচনে নয়তো দুর্নীতিতে। আর অসহায়, অভুক্ত জনগণ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। দেশে রমরমা এনজিও ব্যবসা এবং ক্ষুদ্রঋণের অভাবণীয় সাফল্য দরিদ্র জনগণের দারিদ্র নিয়ে আরেকটি নিষ্ঠুর অধ্যায়। দরিদ্র জনগণের উপর অবলীলায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে মোটা অংকের সুদের বোঝা। দারিদ্রকে পুঁজি করে এই অভাবনীয় ব্যবসা মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল একটি ঘটনা।

আমাদের সমাজের চিন্তাশীলদের এই বাস্তবতায় দারিদ্র দূরীকরণে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। তাদেরকে একইসাথে ইসলামিক সমাধান নিয়ে আন্তরিকভাবে চিন্তা করা উচিত। খিলাফত রাষ্ট্রে ইসলামিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিম্মোক্ত খসড়া মূলনীতিসমূহ গ্রহণ করতে পারে।

৪. দারিদ্র বিমোচনে ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে খসড়া ইসলামী নীতি

মানবজাতির সমস্যা সমাধানের জন্য আল্লাহ্ (সুবহানাহুওয়াতায়ালা) কর্তৃক প্রদত্ত ব্যবস্থার নাম ইসলাম। মানুষের সকল সমস্যার মূল কারণ, স্বরূপ ও সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ্ (সুবহানাহুওয়াতায়ালা) সম্যক অবগত।

৪.১ স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেকের প্রয়োজন ও চাহিদার স্বীকৃতি

ইসলাম সমাজের সকল জনগণকে সমষ্টি হিসাবে না দেখে প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্বতন্ত্রভাবে বিচার করে। ইসলাম প্রথমেই তাকে মানুষ হিসাবে দেখে ও তার মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দেয়। অতঃপর ইসলাম তাকে এমন বিশেষ ব্যক্তি হিসাবে দেখে যার সামর্থ্য অনুযায়ী মৌলিক চাহিদা পূরণের যোগ্যতা আছে । স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক চাহিদা পূরণ না করে সামগ্রিকভাবে পুরো সমাজের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা ইসলামিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নয়। ইসলাম প্রত্যেক ব্যক্তির জীবিকাকে নিশ্চিত না করে সবাইকে সমাজ থেকে যেনতেন ভাবে তা অর্জন করার জন্য স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয় না। বরং ইসলাম প্রথমে প্রত্যেককে মৌলিক চাহিদা সম্পন্ন মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করে; অতঃপর তার সামর্থ্যের মধ্যে জীবনযাত্রার মান বাড়িয়ে স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনের জন্য পরিবেশ তৈরী করে। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য খিলাফত রাষ্ট্র খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান - এই তিনটি মৌলিক প্রয়োজন নিশ্চিত করে।

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

আদম সন্তানের এর বেশী চাওয়ার কিছু নাই - একটা ঘর, যেখানে সে বসবাস করে; এক টুকরো কাপড়, যা দিয়ে সে লজ্জা নিবারণ করে এবং এক টুকরো রুটি ও কিছু পানি, যা দিয়ে সে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা মিটায়।

সুতরাং দারিদ্র বিমোচন খিলাফত রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তির মৌলিক চাহিদাই পূরণ করে না বরং সমাজে মানুষের মর্যাদাকে আরো উচ্চে তুলে ধরে।

৪.২ জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে খলিফার বাধ্যবাধকতা

আল্লাহ্ (সুবহানাহুওয়াতায়ালা) খিলাফত রাষ্ট্রের উপর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকটি নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তাকে ফরজ বা বাধ্য করে দিয়েছেন। রাষ্ট্র সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জনগণের এসব মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করবে।

আনাস (রাঃ) থেকে আল্ বাজ্জার বর্ণনা করেন যে রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ

"যে ব্যক্তি নিজের প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত জেনেও ভরপেটে ঘুমাতে যায়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।

উপরোক্ত হাদীস থেকে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারে যে খিলাফত রাষ্ট্র কত সহজে এই সমস্যা সমাধানে সক্ষম। এমন একটি দায়িত্বশীল মানসিকতা খলিফাকে পরিপূর্ণভাবে এই বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়ে রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ সামর্থকে জরুরী ভিত্তিতে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে নিয়োজিত করাবে। যেহেতু খিলাফত রাষ্ট্র মুসলমানদের মৌলিক আকীদার উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই জনগণ সর্বান্তকরণে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করবে। ফলশ্রুতিতে ঐক্যবদ্ধ উদ্দেশ্য নিয়ে এমন একটি স্বতঃস্ফুর্ত সম্মিলিত প্রচেষ্টার সূচনা হবে, যা কখনো ব্যর্থ হবার নয়।

৪.৩ সম্পদের অবাধ প্রবাহ

অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গিতে পুঁজিবাদের সাথে ইসলামের সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। পূঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা যেখানে সম্পদের স্বল্পতাকে সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে উৎপাদনের প্রতি বেশী মনযোগ দেয়, ইসলামী অর্থব্যবস্থা সেখানে সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক উপায় হিসাবে প্রাপ্ত সম্পদের বন্টন ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়। এক্ষেত্রে আল্লাহর (সুবহানাহুওয়াতায়ালা) হুকুম হচ্ছেঃ

যাতে ধনৈশ্বর্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়।” (আল-হাশরঃ৭)

সুতরাং মজুতদারীর মত অমানবিক কার্যক্রম ইসলামী রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে।

আল্লাহ্ (সুবহানাহুওয়াতায়ালা) আরো বলেন,

আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।” (তাওবাঃ ৩৪)

মজুতদারী, ফড়িয়াবাজী কিংবা মূল্য নির্ধারণের মত কার্যাবলীর প্রভাব যেকোন অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এর মাধ্যমে সম্পদের প্রবাহকে বিঘ্নিত করে একে অলস ফেলে রাখা হয়। ফলশ্রুতিতে সমাজে বেকারত্ব তৈরী হয় এবং সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠী আরো দারিদ্রের মধ্যে নিপতিত হয়। এর দুষ্ট প্রভাব আমাদের সমাজেও পরিলক্ষিত, যেখানে এক দিকে গুটিকয়েক সম্পদশালী ব্যক্তি ও ফড়িয়াবাজ সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের একচ্ছত্র মালিক হয়ে বসেছে, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক দুর্যোগ।

৪.৪ কর্মসংস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী

ইসলাম প্রত্যেক সক্ষম নাগরিকের উপর তার নিজের ও তার উপর নির্ভরশীলদের জন্য জীবিকা অর্জন করার জন্য কাজ করা ফরজ করে দিয়েছে।

আল্লাহ্ (সুবহানাহুওয়াতায়ালা) বলেন,

অতএব তোমরা পৃথিবীতে বিচরণ কর এবং তার দেওয়া রিযিক আহার কর।” (সূরা মূলক-১৫)

বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সাঃ) সাদ বিন মুয়াজ (রাঃ) এর সাথে করমর্দন করলেন এবং তার হাতে রুক্ষতা অনুভব করলেন। যখন রসূল (সাঃ) তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, সাদ (রাঃ) বললেন, “আমি আমার পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য কোদাল দিয়ে খনন করি।রাসূল (সাঃ) সাদ (রাঃ) এর হাতে চুম্বন করে বললেন এ দুটো হাতকে আল্লাহ্ (সুবহানাহুওয়াতায়ালা) পছন্দ করেন। কেউই তার নিজ হাতের উপার্জন ছাড়া উত্তম কোন খাবার আহার করতে পারে না।

খিলাফত রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জন্য এমন একটি পরিবেশ তৈরী করা যেখানে জীবিকার জন্য জনসাধারণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। খিলাফত রাষ্ট্র জনসাধারণের জন্য চাষযোগ্য জমির ব্যবস্থা করবে এবং অবকাঠামো তৈরী করবে, এমন শিল্প স্থাপন করবে, যেখানে স্থানীয় দক্ষ জনসাধারনের নিয়োগ দান করা হবে। জনসম্পদ উন্নয়নের জন্য খিলাফত রাষ্ট্র সক্রিয় পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। তাছাড়া সম্পদ পুঞ্জিভূত করে রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম হওয়ার কারণে সম্পদ অলস পড়ে থাকবে না বরং প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হবে। সম্পদশালীরা বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজতে থাকবে। ফলশ্রুতিতে অনেক কর্মসংস্থান ও সম্পদ সৃষ্টি হবে।

৪.৫ প্রাপ্ত সম্পদের সমীক্ষা ও বর্তমান বিতরণ ব্যবস্থার সমস্যা

খিলাফত রাষ্ট্র প্রাপ্ত সম্পদের উপর একটি জরিপ (Study) পরিচালনা করবে এবং সম্পদের বর্তমান বন্টন ব্যবস্থার আগাগোড়া অধ্যয়ন করবে। এই পর্যবেক্ষণ সিষ্টেম লস, মজুতদারী ও দুর্নীতি চিহ্নিত করতে আমাদেরকে সাহায্য করবে। আমরা জানি, সবুজ নান্দনিকতা বাংলাদেশের চিরকালীন স্বকীয় সৌন্দর্য। আমাদের সবুজ গ্রাম্য জীবন ও সেখানে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ আমাদেরকে গর্বিত করে। আমরা গর্ব করি এদেশের কঠোর পরিশ্রমী কৃষককে নিয়ে। আমরা জানি যেকোন দেশ তার কৃষির উপর ভিত্তি করে ও এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করে। হাজার বছর ধরে আমরা পাট, মসলিন, সুতা, সিল্ক, শাক-সব্জি ইত্যাদি পণ্য বিদেশে রপ্তানী করেছি, যা ঐতিহাসিকভাবে একটি স্বীকৃত সত্য। এদেশের কৃষিজ সম্পদের লোভে বার বার বৃটিশ, ফরাসী, পর্তুগীজ ও ওলন্দাজ ইত্যাদি জাতিসমূহ আমাদের দেশে ছুটে এসেছে। কিন্তু আমরা হতাশা নিয়ে দেখেছি বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ এর এস.এ.পি (SAP) কিংবা পি.আর.এস পির (PASP) মত ধ্বংসাত্মক পলিসি কিভাবে এ সম্পদকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। অথচ বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের চাহিদা যেকোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে বেশী। অত্যন্ত বেদনার সাথে আমরা লক্ষ্য করেছি আদমজী পাটকলকে কিভাবে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উর্বর জমিন এবং কঠোর পরিশ্রমী ও দৃঢ়প্রত্যয়ী কৃষক যেকোন দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান। অন্যভাবে বলা যায় এ দুটি থাকলেই যেকোন দেশ রাতারাতি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে এ দুটিই যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। খিলাফত রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিম্নোক্ত নিয়ম-কানুনসমূহ বাস্তবায়ন করবেঃ

ক. খাস জমি হিসেবে চিহ্নিত ভূমি খলিফা ঐ সমস্ত দরিদ্র অভাবী মানুষের মাঝে বিতরণ করবে, যারা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারে। যেহেতু খারাজি ভূমির মালিকানা সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রের, তাই খলিফা একে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারেন। আবার জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হওয়াতে এসব ভূমি সঠিক বন্টনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক চাহিদাসমূহ রাষ্ট্র যথাযথভাবে পূরণ করবে।

খ. ভূমি মালিকদের হাতে অব্যবহৃত জমি এবং যা তারা সরাসরি ব্যবহার করে না, সেসব জমি খলিফা তাদের কাছ থেকে নিয়ে নিবেন। কোন জমি যদি তার মালিকের কাছে তিন বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে থাকে, তবে খলিফা সে জমি অধিগ্রহণ করবেন। যারা এই জমি ব্যবহার করতে সক্ষম, খলিফা সেসব দরিদ্র মানুষের কাছে বন্টন করে দিতে পারে। কৃষিভূমির বর্গা দেয়াও ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। মালিককে তার জমি হয় নিজে সরাসরি ব্যবহার করতে হবে অথবা নিজে ব্যবহার করা কিংবা বিক্রি করার যোগ্যতা অর্জন করার আগ পর্যন্ত কাউকে তা ব্যবহার করার অনুমতি দিতে হবে। যদি তিন বছর পর্যন্ত সে এর কোনটিই করতে না পারে, তবে রাষ্ট্র তার কাছ থেকে সেটি নিয়ে নিতে পারে।

এ ধরনের নিয়মনীতির বাস্তবায়ন ভূমির বন্টনকেই শুধু সম্প্রসারিত করবে না, বরং ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করবে।

৪.৬ কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারের উৎসাহ

খিলাফত রাষ্ট্র কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানোর সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। মুসলমানরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ভীত না হয়ে বরং আল্লাহর (সুবহানাহুওয়াতায়ালা) উৎসাহে প্রকৃতিকে আরো গভীরতর উপলদ্ধি ও গবেষণার মাধ্যমে উন্নয়নের দিকে নিজেদের পরিচালিত করবে। নিত্যনতুন আবিষ্কার ও বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মুসলমানরা আল্লাহ্ (সুবহানাহুওয়াতায়ালা) কর্তৃক নির্ধারিত সীমার মধ্যে জীবনকে সম্পূর্ণ উপভোগ করবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তারা পরকাল এবং তার হিসাব-নিকাশকে উপেক্ষা করে দায়িত্বে অবহেলা করবে না। বিজ্ঞান একটি নিরপেক্ষ বিষয়। একে যে কেউ তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভাল-খারাপ যে কোন কাজে লাগাতে পারে। পশ্চিমারা যখন অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের অন্ধকারে ডুবে ছিল, তখন মুসলামানরাই প্রতিনিয়ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বকে উন্নতির শিখরে নিয়ে গিয়েছিল। মুসলমানরা বিজ্ঞানের নতুন নতুন ক্ষেত্র উম্মোচিত করে বিজ্ঞানের জগতে পৃথিবীতে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। সুতরাং এটি খুব সহজেই অনুমেয় যে খিলাফত রাষ্ট্র উন্নততর শস্য উৎপাদন ও সেগুলোর সুষ্ঠু সংরক্ষণের জন্য বিজ্ঞানকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে জাতিকে খাদ্যসহ বিভিন্ন মৌলিক চাহিদা ও বিলাস দ্রব্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের মাধ্যমে আত্ম-নির্ভরশীলতার দিকে পরিচালিত করবে।

৪.৭ ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ

উপরোক্ত নীতিসমূহ আন্তরিকতা সহকারে বাস্তবায়ন করলে সমাজে দারিদ্র থাকবে না। কিন্তু ইসলাম এখানেই থেমে যায় না। ইসলাম মুসলিম-অমুসলিম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করে। তাই ব্যক্তির সকল মৌলিক চাহিদা পূরণ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে পারে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা কিভাবে ইসলাম পূরণ করে তার পদ্ধতি নিম্নে বর্ণনা করা হলঃ

৪.৭.১ পারিবারিক দায়িত্বশীলতা আরোপঃ খলিফা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সব সময় প্রত্যেক নাগরিকের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে প্রতিনিয়ত অবহিত হবে। তাই যখনই খলিফা কোন নাগরিকের দারিদ্রাবস্থার কথা জানতে পারবে, তখন তিনি তাঁর নির্বাহীর মাধ্যমে ঐ নাগরিকের দায়িত্ব তার নিকটাত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করবেন।

৪.৭.২ খলিফা যাকাত সংগ্রহ ও বন্টন করবেনঃ খলিফা যাকাত সংগ্রহ করে পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত খাত অনুযায়ী বন্টন করবেন। ইসলাম আল্লাহর (সুবহানাহুওয়াতায়ালা) দেয়া পবিত্র জীবনব্যবস্থা। সুতরাং ভ্যাট (VAT), ট্যাক্সের মত নিষ্ঠুর ব্যবস্থায় ইসলাম বিশ্বাস করে না। জনগণের উদ্ধৃত্ত সম্পদের উপর ইসলামের একটি কর ব্যবস্থা রয়েছে। নিসাবের শর্তপূরণকারী ব্যক্তির অব্যবহৃত সম্পদের যাকাত মুসলামানরা তাদের আকীদা থেকে উৎসারিত ইবাদত মনে করে আদায় করে। এটি এমন একটি কর ব্যবস্থা যা সম্পদকে ধনীদের হাতে কুক্ষিগত করে না রেখে পুরো উম্মাহ্র মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া নিশ্চিত করে। কোরআনে বর্ণিত দরিদ্র, অক্ষম, অভাবী ইত্যাদি আটটি ক্ষেত্রে যাকাত দেয়া হয়। যাকাতের মাধ্যমে উম্মতের দরিদ্ররা ধনীদের সম্পদে অংশীদার হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি যত বেশী ধনী এবং সম্পদের অধিকারী, তাকে তত বেশী পরিমাণে যাকাত প্রদান করতে হয়।

৪.৭.৩ উত্তরাধিকারীবিহীন মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ খলিফা (অভাবীদের মাঝে) বন্টন করবেনঃ উত্তরাধিকারীবিহীন মৃত ব্যক্তির সম্পদ রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং খলিফা ঐ সমস্ত সম্পদের অধিগ্রহণ, ব্যয় ও বরাদ্দের সম্পূর্ণ অধিকার সংরক্ষণ করেন। জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণের ফরজ দায়িত্বের অংশ হিসাবে খলিফা যে কোন অভাবী ব্যক্তিকে তার প্রয়োজন পূরণের জন্য এ সম্পদ দান করতে পারেন।

৪.৭.৪ রাষ্ট্র তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার পরও যদি সমাজে অভাবী জনগোষ্ঠী অবশিষ্ট থাকে তবে সম্পূর্ণ উম্মাহর উপর তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব বর্তায়ঃ বাইতুল মাল-এ যদি রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণের মত যথেষ্ঠ সম্পদ না থাকে, তবে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর হাদীস, “যে ব্যক্তি নিজের প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত জেনেও ভরপেটে ঘুমাতে যায়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়”-এর ভিত্তিতে খলিফা ধনীদের স্বাভাবিক ব্যয় ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে নিয়ে অভাবী মানুষের অভাব পূরণ করবেন।

৫. উপসংহার

খিলাফত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরোক্ত পর্যলোচনা থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে দারিদ্র বিমোচনের স্বার্থে এই অর্থব্যবস্থা জনগণের ও রাষ্ট্রের সম্পদের একটি পাথর কণাকেও অলস ফেলে রাখবে না। দারিদ্র দূরীকরণের লক্ষ্যকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিবে খিলাফত ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা জাতির প্রতি গভীর কর্তব্যবোধ ও দায়িত্ব নিষ্ঠার উপর প্রতিষ্ঠিত। উপরোক্ত মূলনীতিগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে দারিদ্রকে উৎখাত করা সম্ভব।

1 টি মন্তব্য:

  1. This writing is 'one of its kind' in bangla... jazakallah. Can you pls give the writers name..? Its sort of important, you know... and cant we publish a booklet on "khilafah rashtrer shwarup o ruprekha"..?

    উত্তরমুছুন