শুক্রবার, ২৩ মার্চ, ২০১২

মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা পর্ব-২


কিন্তু ইজতেহাদের দরজা বন্ধ, আরবী ভাষার প্রতি অবহেলা এবং মিশনারী আক্রমণের মতো সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে আল্লাহর প্রিয় এই উম্মাহ তিলে তিলে ইসলামের চিন্তা হারিয়ে ফেলতে লাগল। চিন্তার এই পতন এমন এক পর্যায়ে পৌছাল যে মুসলিম চিন্তাবিদরা আলোচনা শুরু করল সভ্যতার উৎস ও প্রকৃতি নিয়ে। ইউরোপিয়ানদের ভেতর এটা খুবই প্রচলিত ছিল কার ভাষা সবচেয়ে বিশুদ্ধ, কার সাহিত্য খুবই উন্নতমানের অথবা কোন জাতি সত্যিকার অর্থে সভ্য। রুশো, উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বাস করত সবচেয়ে বড় ভক্তি হল দেশের প্রতি ভালবাসা সভ্যতার উৎস ও প্রকৃতি নিয়ে। ইউরোপিয়ানদের ভেতর এটা খুবই প্রচলিত ছিল কার ভাষা সবচেয়ে বিশুদ্ধ, কার সাহিত্য খুবই উন্নতমানের অথবা কোন জাতি সত্যিকার অর্থে সভ্য। রুশো, উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বাস করত সবচেয়ে বড় ভক্তি হল দেশের প্রতি ভালবাসা। মানুষকে অবশ্যই দেশপ্রেমের গুণ দ্বারা দীক্ষিত করতে হবে। মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে এই প্রকারের জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমের আলোচনা এমন এক সময়ে শুরু করা হয় যখন ভূখণ্ডগুলো প্রত্যেকে স্বাধীনতা চাইতে শুরু করল। রেনেসাঁ পরবর্তী আলোকিত যুগের চিন্তা চারিদিকে ছড়াতে লাগল এবং ১৮১৬ শতকের শুরুতে রুশো, ভলটেয়ার ও মনটেসকু প্রমুখের লেখনীতে মুসলিমদের লাইব্রেরী ভরে গেল। সামরিক আগ্রাসনের সমান্তরালে পরিচালিত সাংস্কৃতিক ও মিশনারী আগ্রাসন (যা “শিক্ষা ও মানবতা” র ছদ্মবরণে ছিল) মূলত ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের পথকে সুগম করে দিয়েছিল মুসলিম ভূখণ্ডগুলোকে রাজনৈতিকভাবে দখল করে নিতে। মিশনারী স্কুলগুলো খুবই সফলতার সাথে আগামী প্রজন্মসমূহের চিন্তাধারাকে দুষিত করতে পেরেছিল। যারা স্কুলগুলোতে পড়েছিলো তারা পশ্চিমা সিলেবাস ও পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে ইতিহাস ও গবেষণাধর্মী লেখনী শুরু করে। এভাবে অনেক মুসলমানই পশ্চিমা মূল্যবোধে দীক্ষিত হয় এবং পশ্চিমা জীবনব্যবস্থায় আলোকিত হতে থাকে। পশ্চিমা সভ্যতা দ্বারা তারা এতটায় মুগ্ধ হয়ে পড়ে যে এক পর্যায়ে তারা মনে করা শুরু করে ইসলামী সংস্কৃতিই মুসলিম উম্মাহর পতন ও পশ্চাদপদতার মূল কারণ। এর পাশাপাশি চলতে থাকে ইউরোপীয়দের দ্বারা গোপনে পরিচালিত বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন, যা উদাহরণ তুর্কি আল ফাতাত (অটোমান বিকেন্দ্রীকরণ সোসাইটি), ইয়ং তুর্ক, ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রোগ্রেস, আল আহদ (আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন)। জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত এই বীজ বপনই ছিল ইউরোপীয়দের নতুন এক পরিকল্পনা। খিলাফত রাষ্ট্রের পক্ষে সবচেয়ে বড় ভুলটি ছিল এই মিশনারী সংগঠনগুলোকে মুক্তভাবে মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে কাজ করার অনুমতি দেওয়া। এই মিশনারীসমূহে যারা ছিল তারা হল মূলত ব্রিটিশ, ফরাসী ও আমেরিকান এজেন্ট, তাদের প্রধান দুটি উদ্দেশ্য ছিল – মুসলমানদের ইসলামের সঠিক ধারণা থেকে দূরে সরিয়ে ফেলা (ইসলামী আক্বিদার ব্যাপারে সন্দেহ তৈরী করা) এবং তুর্কি, পারস্য ও আরবদের মাঝে জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রেক্ষিতে সংঘাত তৈরী করা।

তাদের প্রথম উদ্দেশ্যটি পুরোপুরি সফল হয়নি। আক্বিদা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও ইসলামের সঠিক ধারণা তারা বিনষ্ট করেছিল। বৃটেনের ইহুদী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরাইলির উক্তিটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যখন সে কুরআন হাতে হাউস অব কমন্সে বলেছিল, মুসলমানদের কখনোই হারানো সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত এই কুরআন তাদের অন্তর থেকে সরিয়ে ফেলা না যায়।

ইতিহাস সাক্ষী মুসলমানদের কখনোই সামরিকভাবে পরাজিত করা যেত না কারণ তাদের লড়াই ও চিন্তা ছিল সর্বদা আক্বিদার উপরে প্রতিষ্ঠিত। তারা সঠিকভাবে বুঝত “আযল” (মৃত্যুর কারণ) ও “রিযক” এর ধারণাসমূহ। তাইতো খালিদ বিন ওয়ালিদ একদা এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রুকে বলেছিল “এই মানুষ যারা আমার সাথে আছে তারা মৃত্যুকে সেরকম ভালবাসে যেরকম তোমরা জীবনকে ভালবাস”। চিন্তার জগতের ইউরোপীয় আগ্রাসন মুসলিম উম্মাহর এই সাহস ও পৌরুষদীপ্ত চেতনা সবই ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছিল।

মূল ইতিহাসে আবার ফেরা যাক – ১৯০৮ সালের ইয়ং তুর্কস বিপ্লব এবং খলিফা আব্দুল হামিদের ১৯০৯ সালের নির্বাসন পরবর্তী সময়ে ক্রমশই বুদ্ধিজীবি এবং সামরিক অফিসাররা আরব স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হতে শুরু করে। এই ট্রেনিং ও শিক্ষায় শিক্ষিত যাদের প্রধানতম রাজনৈতিক চিন্তাই ছিল জাতীয়তাবাদ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধচলাকালীন সময়ে ব্রিটেন মূলত আরব জাতীয়তাবাদের চেতনা প্রবলতার সাথে উস্কে দেয়। তারা মক্কা শরীফের হোসেনকে মাসিক ২ লক্ষ পাউন্ডের বিনিময়ে উসমানী খিলাফতের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় যা সে শুরু করে ১৯১৬ সালে এই অজুহাতে যে উসমানীয়রা আরবদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছে। এই আন্দোলন অনেক সামরিক অফিসারদের আকর্ষণ করে যারা ছিল উসমানীয় খিলাফতের সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ।

পশ্চিমা জ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চার সন্তান জাতীয়তাবাদঃ
মুসলিম উম্মাহকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনায় বিষাক্ত হাতিয়ার ছিল বিভিন্ন পশ্চিমা বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষামূলক সংগঠন যাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল লুকায়িত। যে সময় পশ্চিমারা রেনেসাঁ পরবর্তীতে পুঁজিবাদকে তাদের জীবনের জন্য একমাত্র আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়ে নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, সে সময় মুসলমানেরা ইসলামী জীবনাদর্শকে ধীরে ধীরে ত্যাগের মাধ্যমে পশ্চিমাদের দাসে পরিণত হচ্ছিল। আর দাসত্বের শৃঙ্খলকে আরও টেকসই করার তাগিদে মূলত ১৯ম শতকের মাঝামাঝিতে পশ্চিমারা এক নতুন পরিকল্পনা নেয় যা তারা ইতিপূর্বে নেয়নি। মিশনারীরা তাদের বিদ্যালয়য়, হাসপাতাল এর মাধ্যমে যখন মুসলমানদের আকৃষ্ট করতে পারছিলনা, তখনই তারা “বৈজ্ঞানিক সংগঠন” এর পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয় যা সফলতার মুখ দেখে। ১৮৪২ সালে আমেরিকান মিশনের ছত্রছায়ায় একটি কমিটি গঠিত হয় যার উদ্দেশ্যই ছিল বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সংগঠন তৈরীতে সহায়তা করা। পাঁচ বছরে কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টার পর তৈরী হয় Association of Arts & Science যার সদস্য ছিল বুট্রোস আল বুসতানি। এই বুসতানিই সিরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিখ্যাত বিদ্যালয় “আল মাদ্রাসা আল ওয়াতানিয়া” (জাতীয়তাবাদী বিদ্যালয়)। এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল আরব জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টি করার জন্য। এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যই ছিল “হুব আল ওয়াতান” (দেশের প্রতি ভালোবাসা) সৃষ্টি করা শিক্ষার্থীদের ভেতর, একইভাবে মিশরে আমরা দেখতে পাই “রাফি আল তাহতাওয়ি” (১৮৭৩) Wataniya ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের দিকে আহ্বান জানাতে শুরু করে। এই পশ্চিমা দীক্ষিত মুসলিম পুনঃজাগরণবাদীর মতে ভাতৃত্ববোধ কখনোই বিশ্বাস দ্বারা সৃষ্টি হয় না। এর জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট একটি ভূমি, এ থেকে বোঝা যায় কিভাবে মুসলমানরা জাতীয়তাবাদে আস্থা আনা শুরু করল। তাদের জীবনের অর্থ বংশ, ভূমি ও ভাষার দ্বারা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হতে লাগল।

যদিও বা নতুন নতুন অনেক বৈজ্ঞানিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল, কিন্তু “সিরিয়ান সাইয়েন্টিফিক এসোসিয়েশন” এর প্রতিষ্ঠার আগে অন্যান্যগুলো সফলতা পায় নি। অন্যান্যগুলোতে শুধু খ্রিষ্টানরাই যোগদান করতঃ আর শেষোক্তটিতে মুসলমানদের যোগদানই ছিল বেশী। এই সংস্থাটির উদ্দেশ্যই ছিল সব গোত্র, ধর্মকে এক করে আরব জাতীয়তাবাদকে প্রজ্বলিত করা। এর পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আরব অঞ্চলের মুসলমানরা আরব জাতীয়তাবাদকে নিজের জীবনের ভিত্তি হিসেবে নিতে শুরু করল। ঐ সময়কার সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের প্রতিফলন আমরা এখনো দেখতে পাই ইসলাম নিয়ে উম্মাহর সংশয় এবং মুসলিম দেশ সমূহে জাতীয়তাবাদের শক্ত অবস্থান দেখে। তাইতো পুরো বিশ্বের মুসলমানরা ক্ষণিকের অশান্তির পর আবারো স্বাভাবিক বস্তুবাদী জীবনে ফিরে যেতে পারল চোখের সামনে তাদের ফিলিস্তিনি ভাই বোনদের অসহায়ত্ব দ্বারা আবৃত আহাজারি দেখার পরও। এই জাতীয়তাবাদী মানসিকতাই হল সাম্রাজ্যবাদীদের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার।

এভাবেই জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত বীজ মুসলিম ভূমিতে ইউরোপিয়ানরা বপন করেছিল। বিংশ শতকের শুরুতেই জাতীয়তাবাদের জ্বর সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ১ম বিশ্ব যুদ্ধের শুরুতে সর্বশেষ এবং সবচেয়ে সবচেয়ে বর্বর ও ভয়াবহ আক্রমণ সূচিত হল খিলাফতের বিরুদ্ধে এবং ইউরোপীয়রা এক সময়কার অদম্য ও অপরাজেয় রাষ্ট্রকে গ্রাস করে নিল। কোন প্রতিরোধ ছাড়াই দূর্বল ও মৃয়মান এই উম্মাহ তার রাসূল (সা) এর আমানতকে (খিলাফত রাষ্ট্রকে) কাফিরদের হাতে তুলে দিল। তাইতো ১৯১৭ সালে জেনারেল এলেনবি জেরুজালেম দখলের পর যথার্থই বলেছিল “আজ ক্রুসেড সমাপ্ত হল”

চলবে.........

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন