শুক্রবার, ১৬ মার্চ, ২০১২

মুসলিম উম্মাহ্‌র অধঃপতনের বিশ্লেষণ

ভূমিকা
অধঃপতন উন্নতির বিপরীত। উন্নতি = বুদ্ধিবৃত্তিক উত্থান। তারাই একটি উন্নত জাতি যারা সমাজে সকল সমস্যার সমাধানের জন্য একটি দর্শন বা আদর্শকে চিন্তার ভিত্তি হিসেবে বেছে নেয় এবং তাতে ঐক্যবদ্ধ থাকে। অর্থাৎ একটি উন্নত সমাজের মানুষেরা তাদের সকল প্রবৃত্তিগত ও জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য জীবন সম্পর্কে একটি আদর্শের উপর ভিত্তি করে চলে, এই আদর্শটি আবার একটি বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থকে। এটাই উন্নত সমাজ, কেননা এটি একটি যুক্তিসঙ্গত (Rational) ও যাচাই বাছাইকৃত (Justified) মৌলিক বিশ্বাসের উপর সংগঠিত এবং সমাজের প্রতিটি ধ্যান-ধারণাই এই মৌলিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। অতএব, সেই সমাজই অধঃপতিত, যা কোন মৌলিক বিশ্বাসকে তার সকল চিন্তার উৎস হিসেবে বেছে নেয় না, অথবা তাতে ঐক্যবদ্ধ থাকেনা।

বুদ্ধিবৃত্তিক উত্থান
কোনও জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক উত্থান ঘটতে পারে দু'টি বিষয়ে ঐক্যমতের ভিত্তিতে। বিষয়ে দু'টি হলো:-

১. কোন একটি আদর্শের মূল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা।
২. রাষ্ট্রের সকল মতবিরোধ ঐ মূল বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমাধান করা যাতে জনগণের মাঝে ঐক্য টিকে থাকে।

মূল বিশ্বাসের উপর জাতিকে ঐক্য:
উন্নত সমাজের একটি সুন্দর উদাহরণ হচ্ছে মদীনা। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মদীনার সমাজ আওস, খাযরাজ ও ইহুদীদের মাঝে তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। তাদের পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে সেখানে যুদ্ধ-কলহ লেগে থাকত এবং তারা ছিল একটি দুর্বল জাতি। ইসলাম গ্রহণের পর তারা সমাজের সকল ধ্যান-ধারণা ও সমস্যা সমাধানের মূলভিত্তি হিসেবে ইসলামী জীবনাদর্শকে বেছে নেয়। যদিও ইহুদীরা অনিচ্ছাসত্ত্বে তা মেনে নেয় কিন্তু সামগ্রিকভাবে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের বিষয়ে সকলেই ঐক্যবদ্ধ থাকে। সমাজের পারস্পরিক স্বার্থগুলোকে তারা ইসলাম অনুযায়ী হালাল হিসেবে গ্রহণ করে অথবা হারাম হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে।

যদিও সে সমাজে মুনাফিকেরা ছিল, তবুও কেউ কখনও ইসলামের মূল বিশ্বাস ও তার উপযোগিতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেনি। ফলে মুনাফিকেরা যখন 'মসজিদে দিরার' প্রতিষ্ঠা করে ইসলামের মূল বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন রাষ্ট্র এর সমুচিত জবাব দেয় এবং 'মসজিদে দিরারকে' ধ্বংস করে। রাসূল (সাঃ) জীবদ্দশায় মুসলিম উম্মাহ্‌র অভ্যন্তরে ইসলামের মূল বিশ্বাস নিয়ে নূন্যতম সন্দেহের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। অতএব সেসময় মুসলিমদের অধঃপতনের প্রশ্নই আসে না। উপরন্তু ইসলামের মূল বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় মুসলিম উম্মাহ্‌ আরবের বর্বর জাতি থেকে অত্যন্ত দ্রুত শক্তিশালী একটি জাতিতে পরিণত হয়েছিল।

সমাজের মতবিরোধ নিরসনে মৌলিক আদর্শের ভূমিকা
রাষ্ট্র যখন সমাজের পারস্পরিক স্বার্থ নির্ধারণকারী মৌলিক বিশ্বাসকে সংরক্ষণ, প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করে তখন কোনও কোনও ক্ষেত্রে কিছু লোক অসন্তুষ্ট হলেও রাষ্ট্রীয় বিধি-নিষেধকে সকলেই মেনে নেয়। ফলে সমাজে কখনও কোনও বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে জনগণ তার মৌলিক বিশ্বাস, জীবনাদর্শ এবং মূল্যবোধের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকে। জনগণ সরকারকে এই মৌলিক বিশ্বাসের সংরক্ষক হিসেবে নিয়োগ করে।

মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে মতবিরোধ নিরসন করে এমন সমাজের উদাহরণ:
১৮৬১ সালে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিভক্তির কারণে গৃহযুদ্ধ (Civil War) শুরু হয় যা কিনা তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ ছিল। প্রায় ৬,২০,০০০ সৈন্য এতে নিহত হয় এবং অসংখ্য সাধারণ মানুষ আহত হয়। আব্রাহাম লিংকন এসে সকল জাতিগুলোকে গণতন্ত্রের মূল বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে। এই ঐক্যের ঠিক পরপরই আমেরিকা বিশ্বের রাজনীতেতে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে আবির্ভূত হয়। আজ পর্যন্ত তারা গণতন্ত্রকে তাদের সকল মতবিরোধ সমাধানের উৎস হিসেবে মেনে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আছে।

৯/১১ এর পর মার্কিন সরকার যখন আফগানিস্তান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আমেরিকান জাতির মাঝে বড় কোনও বিভক্তি দেখা দেয়নি, বরং তারা রাষ্ট্রের দেয়া সিদ্ধান্তের প্রতি ঐক্যবদ্ধ ছিল। এমনকি সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রচারণাতেও বারাক ওবামা ও ম্যাককেইন দুজনই ইসরাইলকে অবৈধ সমর্থনের ব্যাপারে একমত রয়েছেন। দুজনই ইরাক যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত, একজন ভাবছেন এই দখলদারীত্ব দীর্ঘসময় থাকবে, অপরজন ভাবছেন তুলনামূলকভাবে কিছুটা দ্রুততর হবে। দুজনই আফগানিস্তানে দখলদারীত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে একমত।

মতবিরোধ নিরসনে মৌলিক কোন বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে না এমন সমাজের উদাহরণ:
- ১৯৪৫ সলে জোসেফ টিটো যুগোস্লভিয়ায় ঐ অঞ্চলের সার্বিয়ান, ক্রোয়েশিয়ান, বসনিয়ান ও অন্য জাতিগুলোকে একত্রে শাসন করেন। তিনি তাদেরকে সামাজতন্ত্রের কথা বললেও, প্রত্যেক জাতির জাতীয়তাবাদ বহাল রাখেন এবং তাদেরকে পারস্পরিক স্বার্থের সমঝোতার ভিত্তিতে শাসন করেন। কিন্তু ঐ অঞ্চলের জাতিগুলো কখনই সমাজতন্ত্রের মোলিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়নি। ফলে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পরপরই এই জাতিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়ে যায় যা আজোবধি চলছে।

- বাংলাদেশে ১/১১ এর আগে ও পরে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাও ঐ একই কারণে ঘটেছে। এদেশের পুরো জাতি বিএনপি ও আওয়ামীলীগে বিভক্ত হয়ে আছে। পুরো দেশবাসী কোন একটি মৌলিক জীবনাদর্শকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেনি। ফলে এদেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা (Anarchy) এখনও চলছে।

কখন একটি জাতির অধঃপতন ঘটে
অতএব রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে একটি মৌলিক বিশ্বাস যা থেকে একটি জীবনাদর্শ আসে এবং যা সমাজের সব ধরণের পারস্পরিক স্বার্থকে সংজ্ঞায়িত করে এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। যে রাষ্ট্র তার মৌলিক বিশ্বাসের প্রতি যতবেশী দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ সে রাষ্ট্র তত বেশী শক্তিশালী।

যদি শক্তিশালী জাতি বলতে আমরা এমন একটি জাতিকে বুঝি যে প্রতিটি সমস্যার সমাধান করে তার মূল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে, তবে অধঃপতিত জাতি বলতে আমরা সে জাতিকেই বুঝবো যে সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে তার মৌলিক বিশ্বাসের উপযোগিতার উপর সন্দেহ পোষণ শুরু করে।

সমাজের এই অধঃপতন দুইভাবে ঘটতে পারে।

প্রথমত : কোন আন্দোলন বা অন্য কোন আদর্শিক রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ আসলে অধঃপতন ঘটতে পারে।
দ্বিতীয়ত : সমাজের যে কেউ মূল বিশ্বাসকে প্রশ্ন করা শুরু করলেই অধঃপতন ঘটে না। যেমন আবদুল্লাহ্‌ ইবনে উবাই ইবনে সালুল ইসলামকে মেনে না নিলেও সমাজে এর প্রভাব পড়েনি। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে কোনও কমিউনিষ্টপন্থীর মতামত মার্কিন রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনও ভূমিকা রাখে না।

সমাজে যারা বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেন যেমন - বুদ্ধিজীবি, রাজনৈতিক দল বা কোনও রাজনীতিবিদ, তারা যদি সমাজের মূল বিশ্বাসের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে প্রশ্ন করা শুরু করেন তখন তার প্রভাব সমাজে পড়ে। অর্থাৎ সমাজের প্রভাবশালী লোকেরা যখন রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিকে নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে তখনই ঐ জাতি অধঃপতনের মুখে পড়ে।

মুসলিম উম্মাহ্‌র অধঃপতন

আলী (রা.) ও মু'আবিয়া (রা.) এর বিরোধকাল:
মু'আবিয়া (রা.) ও আলী (রা.)-এর বিরোধকালে ইসলামের মূল বিশ্বাস, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার একত্ববাদ বা ইসলাম কি যুগোযোগী কিনা - এ ধরণের কোনও মৌলিক বিষয়ে তাদের মাঝে মতানৈক্য হয়নি। তারা খলীফার বিশেষ একটি বিষয়ে নির্দিষ্ট একটি আহকাম নিয়ে বিরোধের মুখোমুখি হন। উসমান (রা.) এর হত্যার বিচার ও খলীফা নির্বাচনের মাঝে কোনটি আগে হবে তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। মু'আবিয়া (রা.) এর মতামত ছিল আগে উসমান (রা.) এর হত্যাকারীর বিচার করতে হবে, তিনি আলী (রা.) কে খলীফা হিসেবে বাই'আত দিতে অস্বীকৃতি জানান। আলী (রা.), পক্ষান্তরে, খলীফা নির্বাচন ও হত্যাকারীর বিচারের বিষয় দুটিকে আলাদা দুইটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেন যা কিনা সঠিক ছিল। ফলে মু'আবিয়া (রা.) এর বাই'আতের অস্বীকৃতিকে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে দেখেন। এখানে লক্ষণীয় যে, খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা বা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস নিয়ে তাদের মাঝে কোনও প্রশ্ন উঠেনি। ফলে রোমনরা যখন মু'আবিয়া (রা.) কে সাহায্যের আহ্বান করে, তখন তিনি কেবল তা প্রত্যাখ্যানই করেননি বরং এই বিরোধ শেষে রোমানদের সাম্রাজ্য ধ্বংস করে তা ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে আসার বার্তা পাঠিয়েছিলেন। যদিও এটা বড় ধরণের একটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল, তথাপি ইসলামের মূল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে উম্মাহ্‌র মাঝে কোনও প্রশ্ন উঠেনি। অতএব, এসময়ে মুসলিম উম্মাহ্‌র অধঃপতন ঘটেনি।

ইয়াজীদ এর খলীফা মনোনয়ন:
ইয়াজীদকে খলীফা হিসেবে বাই'আত দেয়ার বিষয়টি একটি ভুল ইজতিহাদ ছিল। এই ইজতিহাদ বায়াত প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে ফেলে, যার প্রভাব পরবর্তিতে ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই। যাই হোক, এটা ছিল একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ভুল। কিন্তু ইসলামের মূল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে তখন উম্মাহ্‌র মাঝে কোন সন্দেহ দেখা দেয়নি। অর্থাৎ সে সময়ও উম্মাহ্‌র কোনও অধঃপতন ঘটেনি।

ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করা:
হিজরী চারশত সালের দিকে 'আল কাফফাল' ইজতিহাদ প্রক্রিয়া বন্ধ করার ফতোয়া ঘোষণা করেন। এতে যে কোন নতুন বিষয়ের উদ্ভব হলে অথবা অন্য কোন আদর্শ থেকে আঘাত আসলে করণীয় বিষয় নির্ধারণে ইসলামের মূল উৎসে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

এই প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার পর সর্বত্র পূর্ববর্তী মুজতাহিদগণ কর্তৃক ইজতিহাদকৃত ফতোয়াগুলো লিপিবদ্ধ করে পুস্তকাকারে সংরক্ষণের প্রবনতা দেখা যায়। যেমন উসমানী খিলাফতকালে হানাফি মাযহাবের ফতোয়াগুলো লিপিবদ্ধ করা হয় এবং উম্মাহ্‌ এর বাইরে ইজতিহাদ করা থেকে দূরে সরে আসে। উল্লেখ্য এ অঞ্চলে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকলেও তার শাসনামলেই হানাফি মাযহাবের সব হুকুমগুলোকে 'ফতোয়া-ই-আলমগীরি' গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়।

ইজতিহাদ বন্ধ করার উদ্দেশ্য ছিল মূলত দু'টি।

প্রথমত : উম্মাহ্‌ ইজতিহাদের বিষয়ে নিয়মনীতি মানার কঠোরতার বিষয়ে অসতর্ক হয়ে পড়েছিল, ফলে খুবই দুর্বল ধরণের ইজতিহাদ করা হচ্ছিল।

দ্বিতীয়ত : পূর্ববর্তী ফকীহ্‌গণ এত ব্যাপক ও সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ইজতিহাদের বিশাল জ্ঞানভান্ডার রেখে গিয়েছিলেন যে অনেকের ধারণা ছিল ভবিষ্যতে সকল পরিস্থিতির জন্যই হয়তো ইজতিহাদ করা হয়ে গেছে।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে উম্মাহ্‌ তখনও অধঃপতিত হয়ে পড়েনি। কেননা উম্মাহ্‌ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন জীবনদর্শকে বেছে নেয়ার জন্য ইজতিহাদ করা বন্ধ করেনি। উম্মাহ্‌র জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসলামকে সমস্যার সমাধানের উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছে, ইসলামের মূল বিশ্বাসকে নিয়ে সন্দেহ করার প্রশ্নই আসেনি।

উসমানী খিলাফতকাল:
উসমানী খিলাফতের শুরুর দিকে মুসলিম সেনাবাহিনী দূর্দমনীয় একটি শক্তি ছিল। ইউরোপিয়ানরা সে সময় সুলায়মান আল কানুনীকে 'সুলায়মান দি ম্যাগনিফিসেন্ট' নামে আখ্যায়িত করত। কিন্তু আমরা যদি একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাব যে, মুসলিম উম্মাহ্‌র মাঝে তখন অনেকগুলো উলাইয়া (প্রদেশ) ছিল। এসব উলাইয়াগুলো অনেকটা স্বাধীন ও বিচ্ছিন্ন ছিল। উসমানী খিলাফত কর্তৃক ইউরোপ বিজয়কে প্রথম দিকে সাহাবা (রা.) কর্তৃক আরব বিজয়ের সাথে তুলনা করা যায় না। সাহাবারা (রা.) বিভিন্ন অঞ্চল বিজয়ের সাথে সাথে সে অঞ্চলের জনগণের মাঝে ইসলামের মূল বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। ফলে খিলাফত ধ্বংসের পর আজও আরব জাতিতে ইসলামের মূল বিশ্বাস অটুট আছে। রাজনৈতিকভাবে ইসলামী শাসন না থাকলে আরবের জনগণ আজও জীবনাদর্শ হিসেবে ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করেনি।

পক্ষান্তরে উসমানী খিলাফত ইউরোপ বিজয়ের পর কেবলমাত্র সামরিক শক্তিতে নিজেদেরকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী ছিল। ইসলামের মূল বিশ্বাস ইউরোপে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার বিষয়ে এবং সে অঞ্চলের জনগণকে এর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাদের উল্লেখযোগ্য কোন প্রচেষ্টা ছিল না। ফলে খিলাফত ধ্বংসের পর এসব অঞ্চলের বেশিরভাগ রাষ্ট্রই ইসলামী জীবনাদর্শ পরিত্যাগ করে।

এ অঞ্চলেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসকেরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় থাকলেও এ অঞ্চলের সাধারণ জনগণকে ইসলামের মূল বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ করে আদর্শিক জাতিতে পরিণত করার উল্লেখযোগ্য কোনও চেষ্টা তারা করেননি। ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সমাজে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। একমাত্র আওরঙ্গজেব তার শাসনামলে এব্যাপারে কিছুটা সচেষ্ট হন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ্‌র অধঃপতনের কারণে তিনি ইসলামের ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ততটা সফল হতে পারেননি। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা এ অঞ্চল জয় করার জন্য হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে ব্যবহার করে, যা কিনা 'ডিভাইড এন্ড রুল' নামে পরিচিত। বিট্রিশ শাসনামলে এ অঞ্চলে মুসলিমরা সাধারণভাবে শোষিত ছিল, কিন্তু হিন্দুরা অনেক বেশী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। সেই জাতিগত বিভেদ থেকে এখনকার ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সৃষ্টি। অর্থাৎ এ অঞ্চলে কোন ধরণের ঐক্য কখনই প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

এখানে উল্লেখ্য যে, যদিও সামরিক দিক থেকে ইউরোপের তুলনায় উসমানী খিলাফত শক্তিশালী ছিল, তথাপি মুসলিম উম্মাহ্‌ ভুল মাপকাঠি দিয়ে ইউরোপের সাথে নিজেকে তুলনা করত। তারা কেবল সামরিক শক্তিতে ইউরোপের চেয়ে এগিয়ে থাকার দিকে মনোযোগী ছিল, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিতে নিজেদের উৎকর্ষ সাধনে সচেষ্ট ছিল না। যাই হোক, উসমানী খিলাফতের শুরুকে আমরা অধঃপতন বলতে পারি না। কেননা রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে ইসলামের মূল বিশ্বাসকে নিয়ে তাদের মাঝে তখনও কোনও প্রশ্ন ছিল না।

শিল্প বিপ্লব:
শিল্প বিপ্লবের পর পুঁজিবাদী আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইউরোপের জাতিগুলো সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক উন্নতি লাভ করে। তাদের সমাজের এই অগ্রগতি মুসলিম উম্মাহ্‌র প্রভাবশালীদের মাঝে আদর্শিক আঘাত হানে। তারা রাষ্ট্রের ভিত্তি ইসলাম হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে। এ সময় মুসলিম উম্মাহ্‌র রাজনৈতিক পরিমন্ডলে পশ্চিমাদের সংবিধান নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং ইসলামের যুগোপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। ইসলাম সংস্কারের দাবীতে অনেক আন্দোলনই তখন দানা বেঁধে উঠে। অনেকে পশ্চিমা সংবিধানের বিভিন্ন অংশ মুসলিম সমাজেও বাস্তবায়নের চেষ্টা চালায়। এটাতেই মুসলিম উম্মাহ্‌র অধঃপতনের লক্ষণ প্রকাশ পায়। পুঁজিবাদী আদর্শের পক্ষ থেকে যখন এই চ্যালেঞ্জ আসে তখন মুসলিম উম্মাহ্‌র অধঃপতন ঘটে।

অতএব, খ্রীস্টিয় আঠার শতকের দিকেই মুসলিম উম্মাহ্‌র অধঃপতন ঘটে। কেননা এ সময়ে মুসলিম উম্মাহ্‌ ইসলামের মূল বিশ্বাসকে রাষ্ট্রের ভিত্তি করা নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে। আলী (রা.) ও মু'আবিয়া (রা.) যেমন খলীফা কোন কাজটি প্রথমে করবেন সেটা নিয়ে বিতর্ক করেছিলেন, এসময়ে উম্মাহ্‌ সে ধরণের বিতর্ক না করে খলীফা পদটি থাকবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে। গণতন্ত্র ও ইসলামের মাঝে তফাৎ নিয়ে আলোচনা না করে, সেটাকে ইসলামী সমাজে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুর্বল ব্যাখ্যা দেয়া শুরু হয়। খিলাফত রাষ্ট্রের ওয়ালী এবং রাষ্ট্রের সম্পর্ক আলোচনা না করে, কি করে confederacy of states করা যায় তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই যে, যদিও ইসলামের উদার ব্যাখ্যা রোধের জন্য ইজতিহাদের প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়েছিল, অথচ এসময়ে মুসলিম উম্মাহ্‌র অনেক বুদ্ধিজীবী প্রচুর উদার ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করেন। তারা পশ্চিমা ধ্যান-ধারণাকে ইসলামের ভেতর প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করেন, যদিও সেগুলো ইসলামের মূল বিশ্বাসের বিরোধী ছিল।

ফলে, ইসলামের মূল বিশ্বাস রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে কিনা - উম্মাহ্‌র এই প্রশ্ন করার এই প্রবণতার মাধ্যমেই তার অধঃপতনের শুরু প্রমাণিত হয়। কেননা যার ভিত্তিতে সমাজে উদ্ভুত সমস্যার সমাধান করা হবে, তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। ইসলামের সমাধান বা রাজনৈতিক পরিমন্ডলে যারা এই সমাধান দেন (অর্থাৎ খলীফা, ওয়ালী) তাদের উপর উম্মাহ্‌ আস্থাহীন হয়ে পড়ে।

সারাংশ
মুসলিম উম্মাহ্‌র মাঝে এই ব্যাপক অধঃপতনের মূল কারণ এটাই ছিল যে নতুন নতুন পরিস্থিতিতে ইজতিহাদ করার প্রক্রিয়া তখন সমাজে প্রচলিত ছিল না। ফলে সমস্যার সমাধান ও ইসলামের মূল বিশ্বাসের মাঝে কোনও যোগসূত্র ছিল না। এক পর্যায়ে মুসলিম উম্মাহ্‌ ইসলামকে কেন জীবনাদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা থেকে দূরে সরে যায়। শিল্প বিপ্লব, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্য কিনা তার সিদ্ধান্ত উম্মাহ্‌ নিতে পারছিল না। প্রিন্টিং মেশিনের ব্যবহার বর্জন করা অথবা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই প্রমাণ করে যে উম্মাহ্‌র কাছে কোনও মাপকাঠি ছিল না।

অতএব কোনও সমাজে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে যদি সেখানকার মূল বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন উঠে, তবে সেটাই হবে অধঃপতনের প্রথম লক্ষণ। আর সে সমাজে যদি অন্য কোনও আদর্শ থেকে আঘাত আসে, তবে সে সমাজ অধঃপতিত হয়।


মুস্তফা মিনহাজ

1 টি মন্তব্য: