(খিলাফাহ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ অবলম্বনে)
আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যকার শীতল যুদ্ধ অবসানের পর ২১ শতকের
পরিবর্তিত ভূ‐রাজনৈতিক
প্রেক্ষাপটে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব আগের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সমুদ্র এলাকার
মধ্য দিয়ে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথের অবস্থান, পাশাপাশি ভারত মহাসাগরে ক্রমবর্ধমান
সামরিক বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর অবস্থানের কারণে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা তার ঘৃণ্য আগ্রাসী
চেহারায় এই এলাকায় সমরশক্তির সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী দ্বীপ ও বন্দরসমূহের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
ব্যতীত আমেরিকার সামনে আর বিকল্প কোনও পথ নেই। সেজন্য তারা সেন্টমার্টিন দ্বীপ, হাতিয়া
দ্বীপ, চট্টগ্রাম বন্দর, মংলা বন্দরকে এই অঞ্চলে তাদের সুদূরপ্রসারী আগ্রাসী পরিকল্পনা
বাস্তবায়নের ঘাঁটি হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিগত এক দশক ধরে আমেরিকা
কখনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন, কখনো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার, কখনো আঞ্চলিক নিরাপত্তা
বৃদ্ধি এবং কখনো সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের নামে ক্রমাগত বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতি
বাড়িয়েই চলেছে।
মূলত শীতল যুদ্ধে আমেরিকার চূড়ান্ত বিজয়ের পর ওয়াশিংটনের
শীর্ষ নীতি নির্ধারণী মহল সারা বিশ্বে তাদের আধিপত্য বজায় রেখে অন্য যেকোন শক্তির উত্থান
ঠেকানোর জন্য নতুন কৌশল নির্ধারণ করেছে। এর আওতায় তারা “Contain China” নীতির অধীনে
চীনকে করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। তিব্বতে দালাইলামার মাধ্যমে, তাইওয়ানকে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে
সামরিক অর্থনৈতিক সকল সুবিধা প্রদান করে এবং ভারতের সাথে সীমান্ত উত্তেজনাসহ বিভিন্ন
ধরণের বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকা বিরামহীনভাবে চীনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আমেরিকা শুধু অর্থনৈতিক কারণেই চীনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে তা নয়, বরং একটু গভীরভাবে
পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ এখানে মূল ভূমিকা পালন করছে।
কেননা চীন এখানে শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের জন্য “String of Pearls” অনুসন্ধান
নীতির আওতায় মায়ানমারের সিতউ ও কায়োকপু, শ্রীলঙ্কার হামবানতুতা, পাকিস্তানের গদর এবং
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরসমূহে ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে বৈশ্বিক নৌশক্তিতে এক মহীরুহ
হয়ে উঠতে চাইছে যা আমেরিকাকে সম্পুর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলবে এবং এই অঞ্চলে আমেরিকার
কৌশলগত সহযোগী ও বন্ধু ভারতকে এক ঘরে করে রাখবে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমেরিকা
পুরো বিষয়টিকে শুধুমাত্র আমেরিকা-চীন পররাষ্ট্র সম্পর্কের উত্তেজনা হিসাবে দেখছে না,
বরং এই অঞ্চলের ৬০-৭০ কোটি মুসলিমের তীব্র আমেরিকা বিদ্বেষকে তারা যমের চাইতেও বেশী
ভয় পায়। কারণ আমেরিকা খুব ভাল করেই জানে ঐতিহাসিকভাবে আত্মকেন্দ্রিক চীন কখনোই এ অঞ্চলে
কোন ধরণের মুসলিম উত্থানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। আর এ মুহুর্তে এ অঞ্চলে ইসলামের
ক্রমবর্ধমান জাগরণকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে আমেরিকান সাম্রাজ্য চিরদিনের জন্য
ধুলায় মিশে যাবে।
এ অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী দখলদার আমেরিকান বাহিনীর বিরুদ্ধে
মুসলমানদের চলমান অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম এবং খিলাফত রাষ্ট্রের প্রতি মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান
তীব্র আগ্রহ আমেরিকার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইরাক, পাকিস্তান,
আফগানিস্থানসহ চতুর্দিকের দালাল ও উচ্ছিষ্টভোগী তথাকথিত মুসলিম শাসকদের সার্বক্ষণিক
তাঁবেদারী ও সহায়তার পরও আমেরিকান লুটেরাবাহিনী কিছু অসংগঠিত মুসলিমদের হাতে ক্রমাগত
মার খেয়ে চলেছে। শুধুমাত্র বিশ্বাসের জোরে এই বিক্ষিপ্ত মুসলিমগণ সর্বাধুনিক মরণাস্ত্রে
সজ্জিত সুসংগঠিত আগ্রাসী আমেরিকান বাহিনীকে বছরের পর বছর সাহসীভাবে মোকাবেলা করে চলেছে।
তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে এখানে আমেরিকানদের প্রস্তাবিত সব ধরণের রাজনৈতিক সমাধান মুখ থুবড়ে
পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকানদের সত্যিকারের চেহারা এখন মুসলমানদের কাছে দিবালোকের
মত স্পষ্ট এবং এজন্য সাধারণ জনগণের কাছে তাদের নুন্যতম গ্রহণযোগ্যতাও আর অবশিষ্ট নেই।
মূলত এই অঞ্চলে অনেক আগেই রাজনৈতিকভাবে আমেরিকার চূড়ান্ত পরাজয় সুনিশ্চিত হয়েছে। এ
এলাকার মুসলিমরা তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে উৎসারিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য উদগ্রীব
হয়ে আছে। আমেরিকা জানে যেকোন মুহুর্তে এখানে তারা একটি শক্তিশালী খিলাফত রাষ্ট্রের
হাতে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। তাই মুসলিম ভূমিগুলোর কোথাও যেন কখনো খিলাফত
প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে সেজন্য তারা তথাকথিত “সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী” দমনের নামে “ইসলাম
ও মুসলিম” দমনে সদা তৎপর রয়েছে। সর্বশেষ সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আমেরিকার মিত্র যুক্তরাজ্যের
সেনাপ্রধান ও সেদেশের নতুন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা জেনারেল রিচার্ড ডান্নাট বিবিসি
রেডিও ফোর এর সাথে এক সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছে মূলত আফগান যুদ্ধের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে
খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে প্রতিহত করা। এক প্রশ্নের জবাবে সে বলে, “there is an
Islamist agenda which if we don’t oppose and face it off in Southern
Afghanistan or Afghanistan or in South Asia, then frankly that influence will
grow. It could well grow, and this is an important point, we could see it
moving from south Asia to Middle East to North Africa, and to the high water
mark of the Islamic Caliphate in the 14th, 15th century.”(“আমরা যদি দক্ষিণ আফগানিস্তান
কিংবা আফগানিস্তান কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের ইসলামিক এজেন্ডার মোকাবেলা না করি,
তাহলে এর প্রভাব বাড়তেই এমনকি তা বৃদ্ধি পেয়ে দক্ষিণ এশিয়া থেকে মধ্য প্রাচ্য ও সেখান
থেকে উত্তর আফ্রিকা এবং ১৪শ ও ১৫শ শতাব্দীর ইসলামিক খিলাফতের চিহ্নিত ভুমিসমুহ পর্যন্ত
বিস্তৃতি লাভ করবে।”)
এমন প্রেক্ষাপটে রক্তপিপাসু সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ভারত
মহাসাগরে তাদের ঘাঁটি ও নৌসেনা বৃদ্ধি করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। আমেরিকানরা এই আগ্রাসী
নীতি বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গোপসাগর এবং সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন তাঁবেদার
রাজনীতিবিদ ও শাসকগোষ্ঠীকে বেছে নিয়েছে। বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার এদেশের মাটিতে রক্তপিপাসু
মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রবেশের দ্বারকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে
একের পর এক মার্কিন সামরিক মহড়ার মাধ্যমেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যে
অনুষ্ঠিত এবং ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য এ সামরিক মহড়াগুলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্র কিংবা প্রতিরক্ষা
মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত না হয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস কর্তৃক ঘোষিত হওয়ায়
বিষয়টি দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে গত ১১ এপ্রিল থেকে ২২ মে, ২০১০ তারিখ
পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে “টাইগার শার্ক-২” নামের মার্কিন সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত
হয়েছে। এর আগে নভেম্বর, ২০০৯ এ “টাইগার শার্ক-১” নামের যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে, এই
মহড়া অনুষ্ঠিত হওয়ার পর, ২০১০ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারী থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত তথাকথিত
“পোর্ট কল” এর নামে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি যুদ্ধজাহাজের নৌমহড়া
অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া, নিকট ভবিষ্যতে এদেশে তারা এরকম আরও অসংখ্য সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত
করার পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে। গত ২০০৯ সালের নভেম্বর “টাইগার শার্ক-১” এর সমাপনই অনুষ্ঠানে এক বক্তব্যে তদকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস
এফ মরিয়ার্টি বলে “In addition, there will be three more Tiger Shark training
events in the next year. All of these activities will culminate in a combined
Bangladesh/U.S. counter terrorism exercise.” (তাছাড়া আগামী বছর আরও তিনটি টাইগার
শার্ক সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আমেরিকা সন্ত্রাস বিরোধী যৌথ
উদ্যোগ আরও শক্তিশালী হবে।“) এছাড়া উল্লেখ্য যে তারা ইতিমধ্যে “টাইগার শার্ক-৩” এবং
“টাইগার শার্ক-৪” নামের মহড়া সম্পন্ন করেছে। আমেরিকা বারবারই দাবি করে আসছে যে এই সমস্ত
সামরিক মহড়া, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে দৃঢ়
অঙ্গীকারকেই প্রমাণিত করে ……” কিন্তু এদেশের জনগণ খুব ভাল করেই জানে যখন কোন দেশের
দিকে যুক্তরাষ্ট্রের শকুন দৃষ্টি পতিত হয় তখনই সে দেশের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের বাণী
বর্ষিত হতে থাকে, প্রকৃতপক্ষে এসবের অর্থ হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায়
সেদেশে তাদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার পায়ঁতারা।
গত ২১ এপ্রিল, ২০১০ এ ভারতে
নিযুক্ত তদকালীন মার্কিন দূত টিমোথি. জে. রোমার বাংলাদেশ সফর করে। তার সফরের
উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও জোরদার করা এবং সেই সাথে তথাকথিত
সন্ত্রাসবাদ দমনে গৃহীত পদক্ষেপকে আরও শক্তিশালী করা। আমেরিকান সেন্টারের এক
মুখপাত্র জানিয়েছে যে, “মার্কিন দূত রোমার এ সফরকালে মূলত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে
সন্ত্রাসবাদ দমন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও উন্নয়নে পরস্পরকে সহযোগিতা করার ক্রমবর্ধমান
সম্ভাবনা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতাকে আরও জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা করবেন। রোমারের এই
সফরের মাত্র একদিন পরই তদকালীন মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বি স্টেইনবার্গ দু
দিনের সফরে ঢাকয় আসে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সফরের আগে সে ভারত সফর করে। আমেরিকান
সেন্টারের প্রদত্ত বক্তব্য এইসব সফরের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যকে পরিষ্কার হিসেবে
তোলে ধরে। আর তা হল এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে ইসলামের
পুনরুত্থানকে রুখে ঘৃণ্য মার্কিন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে এবং সেই সাথে চীনকে
প্রতিহত করতে মুশরিক রাষ্ট্র ভারতের সাথে হাত মিলানোর জন্য বাংলাদেশকে বাধ্য করা।
চলবে ............
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন