রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১২

কেন মুসলিম বিশ্বে শিল্পের প্রসার ঘটেনি?

শিল্পায়ন বলতে কী বোঝায়?


আজকের মুসলিম বিশ্ব শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে অবশ্যই অনেকদূর পিছিয়ে। যদিও পশ্চিমা দেশগুলো এখন থেকে দেড়শ-দুইশ বছর আগেই শিল্পের প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে কিন্তু মুসলিম দেশগুলো এখনও প্রায় প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে এবং অনেকাংশেই উন্নত দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল থেকে গেছে। তবে আলোচনার শুরুতে শিল্পায়ন তথা শিল্পোন্নত অর্থনীতি বলতে কি বোঝায় তা ব্যাখ্যা করা যাক। বাস্তবে যখন কোন অর্থনীতি ম্যানুফ্যাকচারিংকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এবং ম্যানুফ্যাকচারিংই অর্থনীতির অন্য সেক্টরগুলোর চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে, তখন সেই অর্থনীতিকে আমরা শিল্পোন্নত অর্থনীতি হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। আর ম্যানুফ্যাকচারিং বলতে কাঁচামালকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ব্যবহার্য পণ্যে পরিণত করা বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ আমরা বৃটিশ সাম্রাজ্যের কথা বলতে পারি। ম্যানুফ্যাকচারিং ছিল তার অর্থনীতির মূল বিষয়। জাহাজ নির্মাণ, গোলাবারুদ উৎপাদন, খনিজ আহরণে তাদের দক্ষতা তাদেরকে পরাশক্তিতে পরিণত করেছিল। অর্থনীতির এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা সহজেই যে কোন স্থানে যুদ্ধ সূচনা এবং উপনিবেশ স্থাপন করতে পারতো। শান্তিকালীন সময়ে এসব শিল্পকারখানা বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত হতো।

একটি জাতি যখন বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে দক্ষতা অর্জন করে এবং তার শিল্পভিত্তি মজবুত থাকে তখনই সেই জাতি স্বনির্ভর হয় এবং অন্য জাতির নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। কিন্তু শিল্পায়ন না ঘটলে একটি জাতিকে প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষার মত অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতেও অন্য জাতির উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। আর এই অবাঞ্ছিত বাস্তবতাতেই আজকের মুসলিম বিশ্ব নিমজ্জিত।

কেন মুসলিম বিশ্বে শিল্পের প্রসার ঘটেনি?

যে কোন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকই মুসলিম বিশ্বের বর্তমান বাস্তবতায় হতাশ এবং অবাক হবেন। কেননা বিশাল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার নিয়েও এই দেশগুলো দরিদ্র এবং শিল্পের প্রসার ঘটাতে দারুনভাবে ব্যর্থ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরাক একাই পৃথিবীর মোট তেল রিজার্ভের ১০% এর অধিকারী। তেমনিভাবে ক্ষুদ্র কুয়েতও পৃথিবীর মোট তেলের ১০ শতাংশের মালিক। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের মানচিত্রের সর্বত্র একই দশা। সব জায়গাতেই চোখে পড়বে অব্যবস্থাপনা ও ভ্রান্তনীতির শত-সহস্র উদাহরণ। সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং নীতি না থাকায় মুসলিম দেশগুলোর শাসকরা সব সময়ই অদূরদর্শী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। আর এ ধরণের প্রবণতা শুরু হয়েছে সেই ১৯২৪ সালে খিলাফত ধ্বংসের সময় থেকেই।

তুরস্কের মধ্যে যে সম্ভবনা ছিল তা বিকশিত হয়নি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর বিতর্কিত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নীতি বাস্তবায়নের কারণে। তেমনি পাকিস্তানও এমনভাবে বিশ্বব্যাংকের নীতিকে বাস্তবায়ন করছে, যার ফলাফল হলো পাকিস্তান টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি করছে ঠিকই কিন্তু তার শিল্পভিত্তি গড়ে উঠছে না। একই ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশেও। আরব দেশগুলিও পণ্য উৎপাদনের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ কারখানা গড়ে তুলতে পারেনি। এমনকি তেল উৎপাদনের জন্য যেসব স্থাপনা গড়ে উঠেছে সেগুলোও মূলত পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলোরই অবদান। আর পুঁজিবাদী এই কোম্পানিগুলো এ কাজটি করেছে মূলত অপরিশোধিত তেল উৎপাদন এবং তা রিফাইনিং এর ক্ষেত্রে তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য। এছাড়া তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকে রাজনৈতিকভাবে বশে রাখাটাও তাদের এ সেক্টরে বিনিয়োগ করার অন্যতম উদ্দেশ্য। ২০০৬ সালে মধ্যপ্রাচ্য পৃথিবীর মোট অপরিশোধিত তেলের ৩১.২ শতাংশ উৎপাদন করে। কিন্তু এ সময় তারা মাত্র ৩.২ শতাংশ তেল পরিশোধন করতে সক্ষম হয়। ইন্দোনেশিয়া পুরো ৮০ এবং ৯০ দশক জুড়ে অর্থনৈতিক উদারীকরণের নীতি বাস্তবায়ন করে এবং বিদেশী বিনিয়োগের জন্য সবকিছু উন্মুক্ত করে দেয়। কিন্তু তার ফল দাঁড়ায় ১৯৯৭ এর এশিয়া সংকট যা ইন্দোনেশিয়া এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আজ ইন্দোনেশিয়া ১৪০ বিলিয়ন ডলার ঋণের জালে বন্দী।

মুসলিম দেশগুলো রাষ্ট্রীয় জীবনে যে সব নীতি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে তার বেশিরভাগই পরস্পরবিরোধী, যার কারণে রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে জনগণের দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণ করা কোনভাবেই সম্ভব হয়ে উঠছে না। অর্থনৈতিক টানাপোড়ন এখানে এত প্রকট যে জনগণ শুধুমাত্র রুটি-রুজির ধান্ধা করতে গিয়েই দিন পার করে ফেলে; রাষ্ট্রকে পরাশক্তিতে পরিণত করার জন্য কাজ করার সময় তাদের হয়ে ওঠেনা। এজন্য কেউ যদি মুসলিম দেশগুলোকে শক্তিশালী তথা শিল্পোন্নত করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই জনগণকে তার (শিল্পোন্নয়নের) প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে হবে এবং এজন্য যে যে ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন হবে সে ব্যাপারে জনগণকে রাজী করাতে হবে।

২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ভোগ্যপণ্য বিপননের অর্থনীতিকে পাশে সরিয়ে রেখে সমরাস্ত্র উৎপাদন ভিত্তিক শিল্পের প্রসার ঘটানোর নীতিতে মার্কিন জনগণের সহযোগিতা এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। সে সময়কার মার্কিন সরকার যুদ্ধ জাহাজ ও এরোপ্লেন নির্মাণ এবং সমরাস্ত্র উদ্ভাবন ও উৎপাদনের জন্য বিশাল বাজেট বরাদ্দ করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করা। যুদ্ধকেন্দ্রিক এই শিল্পায়ন দ্রুত মার্কিন অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করলো। রাতারাতি বেকারত্ব কমে গেলো। ১৯৪১ এর ডিসেম্বরে যখন আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জড়িত হলো, তখন অর্থনীতির প্রত্যেকটি সেক্টর যুদ্ধের যোগান দিতে সক্ষম হলো। সে সময় এত দ্রুত শিল্প প্রবৃদ্ধি ঘটলো যে আমেরিকাতে বেকারত্বের বদলে শ্রমিক সংকট দেখা দিলো। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনগণ ও শিল্পকে ক্রমাগত উৎসাহ দেয়ার ব্যাপারটিও সমান তালে চলতে থাকলো। ফলে ত্রিশ দশকের শেষাংশে মার্কিন ওয়ার ইন্ডাষ্ট্রি ৩ লক্ষ এরোপ্লেন, ৫ হাজার কার্গো জাহাজ, ৬০ হাজার ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং ৮৬ হাজার ট্যাঙ্ক তৈরী করে ফেলল। অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় মার্কিন অর্থনীতিতে নারী শ্রম সবচেয়ে বেশি পরিমাণে নিয়োজিত হলো।

যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরীতে মার্কিন সরকারের এই বিশাল কর্মকান্ডের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলো মার্কিন ব্যবসায়ীরা। দশক ধরে চলমান মন্দাকে উপেক্ষা করে তারা বড় বড় বিনিয়োগ করলো। ফলে বিশাল শ্রমবাজার সৃষ্টি হলো। জনগণ, পুঁজিপতি শ্রেণী এবং রাষ্ট্র সবাই একসাথে কাজ করে যুদ্ধের প্রয়োজন মেটাতে লাগলো। এই প্রথমবারের মত মার্কিন জনগণ রেশনিং ব্যবস্থা মেনে নিলো। যুদ্ধ অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক নিয়ম হলো এখানে খরচ নয় বরং দ্রুত ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। ফলে কম সময়ে অনেক বেশী শ্রমের প্রয়োজন হয়। মার্কিন অর্থনীতিতেও তাই হয়েছিল, এমনকি রাস্তার ভিক্ষুক পর্যন্ত চাকরির বাজারে লাইন দিয়েছিল। সামরিক বাহিনীতে নিয়োজিত হয়েছিল ১ কোটি ১০ লক্ষ সক্ষম মানুষ। তাদের অনেকেই এর আগে বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত ছিলো; তাদের শূণ্যস্থান পূরণের জন্যও নতুন শ্রমিকের প্রয়োজন পড়লো। ওয়ার ইন্ডাষ্ট্রির টানে কৃষি, খনিজ উত্তোলণ, শিক্ষা-সংস্কৃতি সব জায়গায় নবগতির সঞ্চার হলো। যোগাযোগ ব্যবস্থায় রাতারাতি বিপ্লব সাধিত হলো, শ্রম বাজার ও সামগ্রিক বিপণন ব্যবস্থাও প্রভূত উন্নতি সাধন করলো। শিল্পে ও বাণিজ্যে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অঙ্গনকে দ্রুত বিকশিত হতে হলো। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সেরা বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের চিন্তা-গবেষণাকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছিল। মার্কিন সরকার বুঝতে পেরেছিল তারা যদি পারমানবিক বিক্রিয়ার সূত্রকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র উদ্ভাবনে সক্ষম হয় তাহলে তা তাদেরকে কৌশলগত প্রাধান্য এনে দিতে পারবে। পরাশক্তিগুলোর সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতার এ পর্যায়েই ঐতিহাসিক ম্যানহাটনপ্রকল্পের জন্ম হলো।

মুসলিম বিশ্বের বর্তমান ব্যর্থতা দিয়ে বোঝা যায় প্রাকৃতিক সম্পদের কী পর্যায়ের অব্যবস্থাপনা এখানে চলছে। আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক দূরবস্থা মূলতঃ দুটি কারণে সৃষ্ট; প্রথমত: শাসকদের আদর্শিক শূণ্যতা, দ্বিতীয়ত: আদর্শিক শূণ্যতার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অদূরদর্শীতা। যতদিন পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে এ দুটি বিষয়ে পরিবর্তন না ঘটবে, ততদিন পর্যন্ত যত সম্পদই থাকুক না কেন আমরা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয়ভাবেই পশ্চিমা শক্তিগুলোর আধিপত্যের শিকার হতে থাকবো। কোন শক্তিশালী আদর্শিক ভিত্তি না থাকলে কিসের উপর আমরা আমাদের অর্থনীতিকে গড়ে তুলবো? যখন কোন সুনির্দিষ্ট আদর্শিক ভিত অনুপস্থিত থাকে, তখন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় যেসব নীতি ও কৌশল গ্রহণ করা হয় তা পরস্পর সাংঘর্ষিক হতে বাধ্য এবং এমতাবস্থায় কোন সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে অর্থনীতিকে পরিচালনা করা কখনই সম্ভব নয়।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্প-কারখানার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি:

মুসলিম হিসেবে আমরা প্রতিটি বিষয় কুরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে দেখতে বাধ্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপারেও একই কথা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে এ হাদীসটি বর্ণিত আছে যে, খেজুর গাছের কলম করা বিষয়ক কৃষি প্রযুক্তির ব্যাপারে তিনি (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের দৈনন্দিন জীবনের এসব বিষয় তোমরাই ভাল জান।” [আহমদ] এটাও বর্ণিত আছে যে, তিনি (সাঃ) দুজন সাহাবীকে (রা.) যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ প্রযুক্তি শিখে আসার জন্য ইয়েমেন পাঠিয়েছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে, মুসলিম উম্মাহ্ সব সময়ই এ বিষয়ে সচেতন ছিল যে, দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা সম্পর্কিত বিষয়াদির (যেমন: ইবাদত, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি) ক্ষেত্রে তারা সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহ্ থেকে সমাধান নিতে বাধ্য। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদেরকে স্বীয় জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে আমাদের পারিপার্শ্বিক জগতের কার্যরীতি আবিষ্কার করার অনুমতি দিয়েছেন, এমনকি উৎসাহিত করেছেন। এ কারণেই মুসলিম উম্মাহ্ কাছে কখনোই ওহীলব্ধ জ্ঞানের সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সাংঘর্ষিক মনে হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) এর শাসনকালে তথা ইসলামের প্রাথমিক যুগেই নৌপ্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশ ঘটানো হয়েছিল। উপরন্তু, ইসলামী শাসনব্যবস্থা তখা খিলাফত যুগের বৈজ্ঞানিকরা কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকেই মহাবিশ্ব সম্পর্কে গবেষণা করার ব্যাপারে উৎসাহ ও দিক নির্দেশনা পেতেন। যেমন, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاخْتِلاَفِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لآيَاتٍ لِّأُوْلِي الألْبَابِ
بَّنَا مَا الَّذِينَ يَذْآُرُونَ اللّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىَ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ رَ
ا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِخَلَقْتَ هَذ

‘‘নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং দিন ও রাত্রির আবর্তনে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য নিদর্শন রয়েছে যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহ্কে স্বরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে এবং বলে, ‘হে আমাদের প্রভূ! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করোনি। গৌরব তোমার জন্যই! আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কর” [সূরা আলি ইমরান : ১৯০-১৯১]

وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ
এবং আমি সৃষ্টি করেছি লোহা, যাতে রয়েছে বিপুল শক্তি, এবং সেই সাথে মানবজাতির জন্য নানা উপকার।” [সূরা হাদীদ: ২৫]

অতএব, মহাবিশ্বের বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিয়ম কানুন সম্পর্কে চিন্তা ও গবেষণা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সৃষ্টি কৌশলকেই প্রকাশ করে এবং এ বিষয়ে চিন্তা তার নিকটবর্তী হবার সহায়ক। যখন পৃথিবীতে ইসলাম রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়িত ছিল, তখন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অংশে পারস্য, গ্রীক, ভারত ও অন্যান্য প্রাচীন জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কিত বই অনুবাদের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল। আব্বাসী খিলাফতের শাসনকালে (বিশেষত খলীফা আল মনসুর ও আল মামুনের সময়ে) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত বিদেশী গ্রন্থ অনুবাদের বিপুল উদ্যোগ নেয়া হয়।

ইসলামী শাসনকালে মুসলিম বিজ্ঞানীরা তাদের আবিষ্কারগুলোকে কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ রাখেনি বরং বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছিলো। তারা তাদের চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানের গুণগত ও পরিমাণগত বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করতে সমর্থ হন। বস্তুতঃ যে কোন জাতির শিল্পায়ন তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত গবেষণা ও উন্নয়নের উপর নির্ভরশীল। দীর্ঘ সময়ের ইসলামী শাসনকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে মুসলিমদের অসংখ্য অবদানের অল্প কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১) ১২শ শতকে আল-জাজারি ক্রাংকশ্যাফট আবিষ্কার করে এতে রড ও সিলিন্ডার এর মাধ্যমে ঘূর্ণন তৈরি করেন। এটাই আজকের আধুনিক ইঞ্জিনের আদিরূপ যা সকল গাড়ি ও শিল্পকারখানার মূল চালিকাশক্তি।

২) দশম শতাব্দিতে আল বেরুনী গীয়ার চাকা ব্যবহার করে যান্ত্রিক সৌর ও চান্দ্র পঞ্জিকা নির্মাণ করেন। যার ভিত্তিতে পরবর্তীতে পনের শতকে আরেক মুসলিম বিজ্ঞানী তাকিউদ্দিন যান্ত্রিক ঘড়ি নির্মাণ করেন। ইবনে ইউনুস সময় পরিমাপের জন্য পেন্ডুলামের ব্যবহার দেখিয়েছিলেন।

৩) সকল ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির প্রাণ যে কেমিস্ট্রি বা রসায়ন শাস্ত্র তার জনক এককভাবে মুসলিমরা। জাবের ইবনে হাইয়ান বিভিন্ন রাসায়নিক গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন পদার্থের বৈশিষ্ট্যের উপর গ্রন্থ রচনা করেন। ধাতু নিষ্কাশন, অজৈব এসিড ও ক্ষারীয় পদার্থের ধারণা এ সব শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদানের কয়েকটি মাত্র, যা আধুনিক ধাতব শিল্পের ভিত্তিস্বরূপ।

৪) আল হাজেন অপটিকেল সাইন্সের জনক এবং আধুনিক লেন্সের আবিষ্কারক। এছাড়া কাগজ, বায়ুকল, মেটালার্জি, কেমিক্যাল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রাথমিক ধারণাসমূহ মুসলমানদের হাতেই বিকশিত হয়।

৫) ইবনে খুরদাদবেহ মুসলিম বিশ্বের বিভিনড়ব অংশের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করেন। আল বেরুনী বিভিন্ন বস্তুর বিশেষ মাধ্যাকর্ষণ পরিমাপ করেন। মুসলিম বিজ্ঞানীরা নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে এর ভিত্তিতে আকাশ মানচিত্রপ্রস্তুত করেছিলেন। তাদের আবিষ্কৃত কম্পাস ও এ মানচিত্র সমুদ্রে নৌ চলাচলের কাজে লাগতো।

৬) মুসলিম বিজ্ঞানীরাই প্রথম বীজগণিতকে গণিতের স্থায়ী শাখায় পরিণত করেন। এলজেবরা শব্দটির উৎপত্তিই হচ্ছে আরবী শব্দ জবরথেকে।

৭) ঔষধশিল্পেও মুসলিমদের দীর্ঘস্থায়ী অবদান ও প্রভাব ছিল। ইবনে সিনা হৃদরোগের উপর গ্রন্থ রচনা করেন এবং কানুননামক তার বিখ্যাত গ্রন্থে বিভিন্ন রোগ ও অজস্র ঔষধের বিবরণ দেন। উমাইয়া খিলাফতের শাসনকালে মুসলিমরা বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল গড়ে তুলে। খলীফা হারুন উর রশিদের সময় বাগদাদ নগরীতে ইতিহাসের সর্বপ্রথম হাসপাতালটি নির্মিত হয়। এর পরপরই আরো বেশ কিছু হাসপাতাল গড়ে উঠে। এসবের কোন কোনটির ছিলো নিজস্ব বাগান যাতে ঔষধী গাছসমূহের বিশাল সংগ্রহ থাকতো। বড় বড় হাসপাতালগুলোর সাথে মেডিকেল কলেজও গড়ে ওঠেছিলো।

৮) সমরাস্ত্র প্রযুক্তি ও শিল্পেও মুসলিমরা বিপ্লব তৈরি করেছিল। আল ফুরুসিয়া ওয়াল মানাসিব উল হারাবিয়াসমরাস্ত্র বিষয়ে লিখিত বিশ্বের প্রথম গ্রন্থ যা মুসলিমদের হাতে রচিত। হিজরী প্রথম শতকেই মুসলিমরা যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠা করে যার আরবি নাম দারুস সানাআ। ফরাসি দারসিনও ইংরেজী আরসেনালশব্দের উৎপত্তি এখান থেকেই। খলীফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের সময় তিউনিসে তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ রণতরী নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মুসলিমরাই সর্বপ্রথম জাহাজ শিল্পের উন্নয়নে নৌদপ্তর প্রতিষ্ঠা করে যাকে বলা হতো দীওয়ানুল উস্তুল। এর অধীনে বড় বড় ইঞ্জিনিয়াররা থাকতো।

এসব হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত জিনিসগুলোর মধ্যে কয়েকটি মাত্র। এসব অবদান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরবর্তীকালের অগ্রগতিতে অনবদ্য অবদান রেখেছিলো। মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পশ্চাদপসরণতা শুরু হয় তখন থেকে যখন মুসলিমরা ইসলামকে বোঝার ক্ষেত্রে এবং এর বাস্তবায়নের ব্যাপারে অবহেলা শুরু করে। এর ফলে, ইসলামী জ্ঞানের চর্চা কমে যায়, ইজতিহাদ তথা নব উদ্ভাবিত বিষয়ে ইসলামের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং ফলশ্রুতিতে পাশ্চাত্য কর্তৃক মিশনারী, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের দ্বার উম্মুক্ত হয়। এসব বিষয় কার্যকরভাবেই ইসলামী রাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে ইসলামী রাষ্ট্র ইউরোপের আগ্রাসন থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতো শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং খিলাফত ধ্বংস হয়ে যায়।

কোন জাতিই উন্নতি করতে পারেনা, সেটা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হোক বা অন্য উন্নয়ন হোক, যদি না তারা বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত জীবন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দানকারী কোন জীবন বিধান ও ব্যবস্থাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ না করে। মুসলিমরাও এই নিয়মের বাইরে নয়। মুসলিম উম্মাহ্ অগ্রগতির জন্য আমাদেরকে প্রমে ইসলাম বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুনরায় উঠে দাঁড়াতে হবে, যাতে করে আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার (ইবাদত, শাসনব্যবস্থা, অর্থনীতি ইত্যাদি) অধিকারী হতে পারি এবং এরপরই আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি মুলতঃ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতি, তার প্রেরিত রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি এবং শেষ বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাসের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। তাই ইসলাম বাস্তাবায়ন ছাড়া এই উম্মাহ্ উদ্ভাবনী শক্তিকে পুনরায় জাগিয়ে তোলার আর কোন উপায় নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন