বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১২

ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকারীর গুণাবলী এবং তার দৈনন্দিন কার্যাবলী

ইসলামের দাওয়াত বহনকারীর গুণাবলী

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন,

তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, তোমরা সৎ কাজে আদেশ করবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে।” [সূরা আলি ইমরান: ১১০]

তিনি আরো বলেন,

তার চেয়ে উত্তম কথা কার, যে মানুষকে আল্লাহ প্রতি আহ্বান করে, সৎকাজ করে এবং বলেঃ আমি তো আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভূক্ত।” [সূরা হা-মীম আস সিজদা ৩৩]

প্রথম আয়াতে মুসলিমদেরকে সর্বোত্তম জাতি বলা হয়েছে এবং তার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে তারা বাকী মানবজাতিকে সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। অতএব বোঝা গেলো, এ কাজ একটি শ্রেষ্ঠত্বসূচক কাজ।

দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহর দিকে আহ্বান তথা ইসলামের দাওয়াত বহনকারীর কথাকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে। অতএব, ইসলামের একজন দাওয়াত-বহনকারী এমন একটি কাজ করছে যেটি ব্যক্তি ও জাতিগতভাবে একটি শ্রেষ্ঠত্বসূচক ও সর্বোত্তম কাজ। এমন একটি কাজের দায়িত্ব বহনকারীকে অবশ্যই বেশকিছু গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে।

প্রথমঃ ইসলামের দাওয়াতকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং ইসলামকে সমাজে ফিরিয়ে আনা এটা হতে হবে তার জীবনে মূল কেন্দ্রবিন্দু। এটাকে ঘিরেই সাজাতে হবে তার অন্য সব কর্মকান্ড যেমনঃ জীবিকা, পেশা, পড়াশোনা, বিয়ে, জীবন-যাপনের মান ইত্যাদি। এসব ব্যাপারে একদিকে যেমন সে শারীআহ্ নির্ধারিত হালাল-হারামকে সুস্পষ্টভাবে মেনে চলবে তেমনি অন্যদিকে এমনভাবে এগুলোকে বিন্যস্ত করবে যাতে করে এগুলোর কোনটা তার দাওয়াত কার্যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। তার প্রধান লক্ষ্য থাকতে হবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা এবং আর সব কিছুকে এ লক্ষ্য অর্জনের সহায়করূপে সাজাতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন,

যদি তোমাদের পিতারা, তোমাদের পুত্ররা, তোমাদের ভাইরা, তোমাদের স্ত্রীরা, তোমাদের আত্মীয়রা, আর ঐসব সম্পদ যা তোমারা অর্জন করেছো আর ঐ ব্যবসা যাতে তোমরা মন্দা পড়ার আশংকা করছো অথবা ঐ গৃহসমূহ যেখানে অতি আনন্দে বসবাস করছো, (এসব কিছু যদি) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে এবং তাঁর পথে সংগ্রাম করার চেয়ে তোমাদের নিকট অধিক প্রিয় হয় তবে অপেক্ষা কর যে পর্যন্ত না আল্লাহ্ তাঁর (শাস্তির) নির্দেশ পঠিয়ে দেন।” [সূরা তওবাঃ ২৪]

দ্বিতীয়ঃ তার ব্যক্তিগত চরিত্র ও আমলে সে হওয়া উচিত সবার অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত। কেননা, মানুষ একজনের কথা শুনে যতটুকু উদ্বুদ্ধ হয় যার চেয়েও বেশী উদ্বুদ্ধ হয় তার কাজে। তদুপরি কথা ও কাজের মধ্যে পার্থক্য পেলে মানুষ কথাও গ্রহণ করতে চায়না। অতএব সে মানুষকে যা বলবে সর্বাগ্রে তার নিজের মাঝেই সেটা থাকা উচিত। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন,

তোমরা কি লোকদেরকে সৎকাজে আদেশ করছো এবং তোমাদের নিজেদের বেলায় ভুলে থাকছো?” [সূরা বাক্বারাঃ ৪৪]

তৃতীয়ঃ তাকে চিন্তাভাবনা করে এবং লক্ষ্য ঠিক করে কাজ করতে হবে। একইসাথে তাকে তার লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে কিনা এবং বাস্তবে সে ফল লাভ করছে কিনা সবসময় সেটা হিসেব-নিকেশ করে দেখতে হবে। কেবল আবেগ নির্ভর কিন্তু চিন্তাহীন, লক্ষ্যহীন কাজে কোন ফল আসে না। লক্ষ্য এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর নূন্যতম সময় এ দুটি নির্ধারণ না করে এমনি এমনি কাজ করতে থাকলে কাজে গতিশীলতাও আসবে না। আবার, একটি কাজ একভাবে করে ফললাভ হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সচেতন না থাকলে ফললাভ করার অন্য উপায়ের চিন্তাও মাথায় আসবে না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

প্রতিটি বিষয় চিন্তা-ভাবনা করে গ্রহণ করবে। যদি এর পরিণাম উত্তম মনে হয়, তবে তা করবে।” (মুসলিম)

তিনি (সাঃ) আরো বলেন,

সুচিন্তিত কর্মপন্থার সমতুল্য কোনও বুদ্ধি নেই।” (মেশকাত)

লক্ষ্য ঠিক করার পাশাপাশি আরো যে গুণটি থাকা দরকার তা হলো লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় সংকল্প। সম্ভাব্য সকল উপায়ে তাকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে লক্ষ্যে পৌঁছার। দৃঢ় সংকল্প না থাকলে সে লক্ষ্য স্থির করার পরও ধীরগতিতে চলতে থাকবে।

চর্তুথঃ তাকে চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল হতে হবে। অর্থাৎ মানুষের কাছে দাওয়াত পৌছে দেয়ার নতুন নতুন কৌশল ও পদ্ধতির উদ্ভাবক হতে হবে। তাহলে সে সব ধরণের পরিস্থিতি ও সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দাওয়াত কার্যে সর্বোচ্চ ফল লাভ করতে পারবে। এর পাশাপাশি তাকে বিচক্ষণ হতে হবে এবং দাওয়াহর পথে একই ভুল যাতে বারবার না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন,


অর্থাৎ, পুনঃ পুনঃ একই ভুল করেনা। তার দাওয়াতের পদ্ধতি হওয়া মুমিন কখনো একই গর্তে দুবার দংশিত হয় না।” (বুখারী, মুসলিম)
উচিত হৃদয়গ্রাহী ও সবার বোধগম্য। আর এটা তখনই সম্ভব যখন সে প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা বাস্তবতা বুঝবে। তখন সে যার যার বাস্তবতা অনুযায়ী তার কাছে ইসলামকে উপস্থাপন করতে পারবে। তা নইলে তার দাওয়াত হবে প্রভাবশূন্য এবং তা মানুষকে বিরক্ত করবে। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন,

মানুষকে তোমার রবের দিকে আহ্বান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর ভাষার মাধ্যমে।” [সূরা নাহলঃ ১২৫]

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

লোকের সাথে এমন কথা বলো যা তারা বোঝে, আর যা বোঝে না তা ত্যাগ কর।” (বুখারী)

পঞ্চমঃ তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী থাকতে হবে। তাহলে সে লোকজনকে দাওয়াতের মাধ্যমে জয় করার পর তাদেরকে একসাথে ধরে রাখতে পারবে। সে যদি লোকজনকে নেতৃত্ব দিয়ে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করতে না পারে তাহলে তার দাওয়াতের চূড়ান্ত ফল লাভে সে সক্ষম হবে না। তাছাড়া, তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী না থাকলে সমাজের লোকজন তার পিছনে সমবেত হতে ভরসা পাবে না।

ষষ্ঠঃ তাকে অবশ্যই সাহসী হতে হবে। এই সাহস হতে পারে যে কোন পরিস্থিতিতে সত্য উচ্চারণের ক্ষেত্রে, অন্যায়ের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অথবা যেকোন বাধার মুখে সমাজে ও রাষ্ট্রে ইসলামের বাণীকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে। দূর্বলতা, ভীরুতা, কাপূরুষতা এসব তার চরিত্র থেকে দূর করতে হবে। দূর্বলচিত্ত, ভীরু, কাপূরুষ কখনো ইসলামের নেতৃত্ব দিতে পারবে না, কেননা এপথে অনেক বিপদাপদ ও পরীক্ষা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

“(একজন) ব্যক্তির মধ্যে যা খারাপ তা হলো কৃপণতাময় লোভ এবং কাপূরুষতা।” (আবু দাউদ, আহমদ)

সপ্তমঃ তাকে যথেষ্ট পরিমাণে ধৈর্যশীল হওয়া উচিত। কেননা, একাজে অনেক বাধা বিপত্তি, নিন্দা, অপমান, নির্যাতন এবং পার্থিব ক্ষতি রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে, দিনের পর দিন কাজ করার পরও কাঙ্খিত ফল না পাওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা। ধৈর্য ছাড়া এসবকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। সে যদি কারো কটু কথায় সহজেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে তবে সে তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে। তার স্মরণ করা উচিত যে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবী (রা.) দের এ কাজ করতে গিয়ে কতো কটুক্তি ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। হতাশা আসতে চাইলে তার স্মরণ করা উচিত নূহ (আঃ) কে যিনি তাঁর সম্প্রদায় কতৃক ক্রমাগত প্রত্যাখ্যাত হয়েও একটানা নয়শত বছর তাঁর সম্প্রদায়ের মাঝে আহ্বান কার্য চালিয়ে গেছেন।

অষ্টমঃ সে হবে সবার বিশ্বস্ত। তার ব্যাপারে মানুষের মাঝে যেন এমন কোন সন্দেহ কাজ না করে যে সে প্রতারণা করতে পারে বা ইসলামের দিকে আহ্বানের পিছনে তার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে, সে বিপদের মাঝে ছেড়ে দিয়ে পালাবে ইত্যাদি। যদি সে ওয়াদা রক্ষাকারী ও আমানতদারী এদুটি গুণের পরিচয় দিতে পারে তাহলেই সে পারবে লোকের মাঝে এরূপ বিশ্বাস অর্জন করতে। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন,

যার মধ্যে আমানত নেই তার মধ্যে ঈমানও নেই, আর যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি পালনের গুণ নেই, তার মধ্যে দ্বীনও নেই।” (বুখারী)

নবমঃ ঘরে বাইরে তাকে হতে হবে দায়িত্বশীল। তার আশেপাশের মানুষদের খোঁজ খবর নেয়া, তাদের যথাসাধ্য দেখাশুনা করা ও প্রয়োজনে সাহায্য করা হওয়া উচিত তার অভ্যাস। তাহলে তার দাওয়াত তাদের মনে রেখাপাত করবে। হযরত আবু বকর (রা.) একই দিনে রোযা রেখেছেন, দরিদ্রকে সাহায্য করেছেন, অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গিয়েছেন আবার দ্বীনের দাওয়াতও চালিয়ে গেছেন। এরকমই হওয়া উচিত দাওয়াহ বহনকারীর বৈশিষ্ট্য।

দশমঃ দ্বীনের দাওয়াত বহনে তাকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হতে হবে কিন্তু নম্রতার সাথে। মানুষের প্রতি তার নম্রতা, ভালোবাসা এবং তাদেরকে হেদায়েতের আলোতে আনার জন্য ব্যকুলতা এসব তার অন্তরে থাকা অপরিহার্য। তাহলে সে মানুষের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠবে। কঠোরতা মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয় অথচ মানুষকে কাছে টানা এবং তাদের ধরে রাখা একজন দাওয়াত-বহনকারীর অন্যতম কাজ। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন,

আল্লাহ্র অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমল চিত্ত হয়েছিলে; যদি তুমি রূঢ় ও কঠোর চিত্ত হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে যেত।” [সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন,

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ দয়াশীল, প্রত্যেকটি বিষয়েই নম্র ব্যবহার তিনি পছন্দ করেন। নম্রতাপূর্ণ ব্যবহারের ফলে তিনি যা দান করেন কঠোরতার কারণে তা দেন না।” (বুখারী)

হাদীসে উল্লেখ রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যখন একাধিক ব্যক্তির সাথে একত্রে কথা বলতেন তখন প্রত্যেকেই মনে করতো যে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তার প্রতিই সবচেয়ে বেশী মনোযোগ দিচ্ছেন।

পরিশেষেঃ সবসময়ই তার কাজে সফলতা দেয়ার জন্য আল্লাহ্র কাছে প্রার্থণা করা উচিত। কখনোই নিজের মেধা ও প্রচেষ্টার উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে আল্লাহ্র সাহায্য কামনা থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, কাজের ফল লাভ কেবলমাত্র আল্লাহ্রই হাতে, অতএব তাঁর সাহায্য ছাড়া কখনোই সফলতা আসবে না। কাজেই সে সদা সর্বদা বিনয়ের সাথে বিগলিত চিত্তে আল্লাহ্র কাছে সাহায্যপ্রার্থী ও নত থাকবে। এমনই হওয়া উচিত একজন দাওয়াহ বহনকারীর গুণাবলী। এমন মুমিনদের ও দাওয়াহ বহনকারীর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ্ তাআলা বলেন,

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মুমিনদের জীবন ও সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন ... তারা তওবাকারী, ইবাদতকারী, আল্লাহ্র প্রশংসাকারী, সিয়াম পালনকারী রুকু ও সিজদাহকারী, সৎকাজের নির্দেশ দানকারী ও অসৎকাজে নিষেধকারী এবং আল্লাহর সীমাসমূহের (হালাল-হারামের) সংরক্ষণকারী; আর তুমি এমন মুমিনদের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।” [সূরা তওবাঃ ১১২]

যদি একজন দাওয়া-বহনকারী উপরোক্ত গুণাবলী অর্জনে সচেষ্ট হয়। তবে আশা করা যায় সে হবে দ্বীনের একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দায়ী। আর আমরা যদি তেমন হতে পারি তবে আল্লাহ্ তাআলা আমাদের এ বলে ওয়াদা দিয়েছেন যে,

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে আল্লাহ্ তাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফত দান করবেনই, যেমন তিনি খিলাফত দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে।” [সূরা নূরঃ ৫৫]

ইসলামের দাওয়াত বহনকারীর দৈনন্দিন কার্যাবলী

ইসলামের দাওয়াত বহনে উদ্বুদ্ধ একজন যখন চিন্তা করে দেখবে যে কত শ্রেষ্ঠতম বিষয় সে বহন করছে, কত বড় আমানত সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে, তখন এ কাজের জন্য নিজেকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করা তার অন্যতম কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। আর নিজেকে এজন্য যোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে তার দৈনন্দিন কাজগুলোকে এ লক্ষ্য অর্জনের উপযোগী করে সাজাতে হবে।

ইসলামের দাওয়াত বহনকারীরকে উপলব্ধি করতে হবে যে তাঁর বহনকৃত বিষয়টি কত ভারী। এটাও তাকে বুঝতে হবে যে কত বড় বড় বাধা রয়েছে এ পথে যেগুলো অতিক্রম করে তাকে গন্তব্য পৌঁছতে হবে। একজন দাওয়াত বহনকারীকে নিজের বর্তমান অবস্থা ও দূর্বলতাগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে; নিজের কোন্ কোন্ বিষয়গুলোকে ঠিক করতে হবে এবং লক্ষ্য অর্জনে আরো কতটুকু সামর্থ্য ও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে তাকে তা চিহ্নিত করতে হবে। তার প্রতিদিনের কাজের তালিকায় ঐ কাজগুলোকে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে যেগুলো তার বর্তমান দুর্বলতা ও অদক্ষতাগুলো কাটিয়ে ইসলামের দাওয়াত বহনে ক্রমান্বয়ে তাকে অধিকতর যোগ্য করে তুলবে। নিম্নের বিষয়গুলোকে সাধারণভাবে একজন দাওয়াত-বহনকারী তার দৈনন্দিন কাজের অন্তর্ভূক্ত করতে হবেঃ

প্রথমতঃ প্রতিদিনই আল্লাহ্র (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে সে সদা সচেষ্ট থাকবে। এর মানে হচ্ছে, ব্যক্তিগত জীবনে শারীআহ্র সমস্ত ফরযগুলো নিষ্ঠার সাথে পালন করা, হারামগুলো পুরোপুরি বর্জন করা এবং যথাসাধ্য নফল ইবাদত করা।

দ্বিতীয়তঃ তাকে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। এই কুরআনের বাণী সে অন্যের কাছে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, একে সে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, সে নিজেই যদি কুরআন পাঠ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে তাহলে কীভাবে হবে? এছাড়াও দাওয়া-বহন করতে গিয়ে সমাজে যে বাধা, অপমান ইত্যাদির সম্মুখীন হতে হয়, যে মানসিক যাতনা তৈরী হয় কুরআন পাঠে তা অপসারিত হয়। কুরআন অন্তরকে প্রশান্ত করে। তার উচিত হবে কুরআনকে অর্থসহ পড়া, এর অর্থ নিয়ে চিন্তা করা এবং তাফসীর অধ্যয়ন করা।

তৃতীয়তঃ অবশ্যই তার দৈনন্দিন কাজের অন্যতম অংশ হবে বাস্তবে এই দাওয়াতকে আরেকজনের কাছে পৌঁছে দেয়া, আরো কার কাছে নেয়া যায় তার সুযোগ অনুসন্ধান করা। পরিচিত-অপরিচিত, বন্ধু, আত্মীয়, কর্মস্থলের সহকর্মী প্রত্যেকের কাছে কীভাবে এই দাওয়াত নিয়ে যাওয়া যায় এ সুযোগ খুঁজে বের করতে সে সদা সচেষ্ট থাকবে। ইসলামের
আহ্বানকে সমাজের কাছে নানা উপায়ে পৌঁছে দেয়ার চিন্তাই তার সারাদিনের প্রধান চিন্তা হওয়া উচিত।

চর্তুথতঃ তাকে অবশ্যই প্রতিদিনকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খবরাখবর জানতে হবে এবং এর ভিত্তিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশেষণ দাঁড় করাতে হবে। এটা এজন্য যে, তার পুরো কাজটাই রাজনৈতিক কাজ যার অংশ হচ্ছে জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের দূর্বল করে ফেলা এবং ইসলামের শত্রুদের মুখোশ উম্মোচন করে দেয়া। এই কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হবেনা যদি না সে তাদের প্রতিদিনকার নিত্য নতুন অপকর্ম, জুলুম এবং জনগণের ব্যাপারে তাদের ক্ষতিকর পরিকল্পনা সমূহের ব্যাপারে সর্বশেষে সংবাদের খোঁজ না রাখে। ফলশ্রুতিতে, সে জনগণের সাথে ঐভাবে জনসংযোগ করতে পারবেনা যা দিয়ে সে জনগণকে শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে এবং তাদেরকে দ্রুত আন্দোলনে নামাতে পারে। উপরন্তু, এর ফলে সে যথা সময়ে যথোচিত কাজ সমাধা করতেও ব্যর্থ হবে এবং এমন সব সুযোগ হারিয়ে ফেলবে যার সদ্ব্যবহার করতে পারলে অল্প সময়েই সে তার দাওয়াত ও আন্দোলনকে এক ধাপে অনেকদূর এগিয়ে নিতে পারতো। তাকে মনে রাখতে হবে যে, রাজনীতিতে একটা মাত্র দিনও অনেক লম্বা সময় যাতে পিছিয়ে পড়া যাবেনা কখনোই।

পঞ্চমতঃ তার দৈনন্দিন কাজের একটি অংশ থাকবে ইসলামী জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য। কেননা ইসলামী জ্ঞান ছাড়া অন্যের কাছে সঠিকভাবে ইসলামকে পৌঁছানো অসম্ভব। তাই নির্ভরযোগ্য ইসলামের বিভিন্ন শাখায় নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করবে এবং এটা দিয়ে তার দাওয়াত ও প্রচারকে সমৃদ্ধ করবে।

ষষ্ঠতঃ প্রতিদিন রাতে সে শোয়ার পূর্বে একটি সময়কে নির্দিষ্ট করে নিবে যখন সে তার সারাদিনের সমস্ত কাজগুলো হিসাব-নিকাশ করবে। কী তার করার কথা ছিল কিন্তু করেনি, কোন কাজটি করেও লক্ষ্য অর্জিত হয়নি, কোন কাজে ভুল-ত্রুটি বা চিন্তার অভাব বা অলসতা ছিল, ব্যক্তিগত ইবাদতে কি কি ত্রটি হয়েছে এসব সে খুঁজে বের করবে এবং পরবর্তী দিন কীভাবে এসবকে ঠিক করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করবে। এভাবে সে উত্তরোত্তর তার কাজে উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন,

ধ্বংস তার জন্য যার আজকের দিন গতদিনের চেয়ে উত্তম নয়।

এই হচ্ছে একজন দাওয়াহ-বহনকারীর দৈনন্দিন জীবন। এ ব্যাপারে সঠিক দিক নির্দেশনা পাওয়ার জন্য তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দাওয়াহ বহনকারীদের অর্থাৎ সাহাবাদের (রা.) দৈনন্দিন জীবনকে অধ্যয়ন করতে হবে। তাঁরা এরূপই ছিলেন। আর আমরা যদি অনুরূপ ভাবে আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলো সাজাই তাহলে তাঁরা যেমন দুনিয়াতে ইসলামকে বিজয়ী করে সাফল্য অর্জন করেছেন এবং আখেরাতে পুরস্কৃত হবেন - আমরাও একইভাবে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মান লাভ করতে পারবো, ইনশাআল্লাহ্।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন