সোমবার, ৫ মার্চ, ২০১২

মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা পর্ব-১


“অবশ্যই তোমাদের এই উম্মত হল একটাই উম্মত” [সুরা আম্বিয়া-৯২]

“এক জাতি এক ভূমি” এই চেতনা ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে একদা যে মুসলিম উম্মাহ পরিণত হয়েছিল বিশ্বের প্রভাবশালী সভ্যতায় সেই একই জাতি সিংহাসন হারানোর পর আজ হতবিহ্বল ও দিশেহারা। মুসলিম বিশ্বের বর্তমান বাস্তবতা হল বিভক্তি, কোন্দল ও অত্যাচার আর পশ্চাতপদতা। বিশ্বনেতৃত্বের আসন হারানোর পর এই বহুধাবিভক্ত মুসলিম উম্মাহর আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বর্তমানে নির্ধারিত হয় পুঁজিবাদী পশ্চিমা কুফর সভ্যতা দ্বারা। খিলাফতের পতনের পরবর্তীতে যতই জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনা মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে প্রসারিত হচ্ছিল ততই বিদেশী শক্তির দ্বারা পতিত এই সভ্যতা শোষিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছিল যা এখনো পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। আমরা আরও দেখতে পেয়েছি সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য পশ্চিমা সভ্যতা নতুন এক ব্যবস্থা চাপিয়ে ছিল বিভক্ত এই মুসলিম দেশগুলোর উপর যার নাম “জাতি রাষ্ট্র” যা মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক বিভক্তিকরণ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে আসছে। তারই ফলশ্রুতিতে আজ আমরা দেখতে পাই মুসলিমরা নিজেদের চিহ্নিত করে বাঙ্গালী, পাকিস্তানী, আরব রূপে। এরই ধারাবাহিকতাই আমরা আরো দেখতে পেয়েছি মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমা মদদপুষ্ট “নব্য এলিট” জাতীয়তাবাদী শ্রেণী যারা কিনা “জাতীয়তাবাদী” “উদারমনা” “পশ্চিমা চিন্তা চেতনা সম্পন্ন” “ধর্ম নিরপেক্ষ” অথবা “ইসলামিক” হলেও পাশ্চাত্যের দূষণীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত হতে। যুগে যুগে এই জাতীয়তাবাদী এই এলিট শ্রেণীই মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণে বড় বাধা হয়ে আসছে।

জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্পই হল বর্তমানে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জের নাম। কারণ এই জাতীয়তাবাদই হল মুসলিম বিশ্বগুলোতে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ ও অত্যাচারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এই “জাতি রাষ্ট্র” ও এর বিবিধ প্রতিষ্ঠান আজো মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে ঔপনিবেশিক শাসনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে এবং ইসলামের শক্তিকে বিভক্ত রাখতে সক্ষম হচ্ছে। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র হল আদতে “জাতি রাষ্ট্রের” মানচিত্র যেখানে “জাতীয়তাবাদ” ও জাতীয় স্বার্থের মত নষ্ট, দুষিত ধারণা ইসলামের উপর প্রাধান্য পায়, এই নিবন্ধ এই ইসলামী প্রেক্ষাপটের আওতায় জাতীয়তাবাদ ও মুসলিমদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি আলোকপাত করবে ও তা অনুধাবনে সহায়ক হবে।

জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ও স্বরূপঃ
জাতীয়তাবাদের যে রূপ আমরা বর্তমানে দেখতে পাই তা মূলত সাম্রাজ্যবাদের ফসল, যদিও বা এর উৎপত্তি হয়েছিল ইউরোপে, বিশেষতঃ পশ্চিমা ইউরোপে রোমান ক্যাথলিক চার্চের মোকাবেলায় আত্মরক্ষার পদ্ধতি হিসেবে। শুরুর দিকে এই সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিলো খৃষ্টান ধর্মের প্রোটেস্টেন্ট মতাবলম্বীদের দ্বারা, এটা নিজের শক্তি সঞ্চার করতো আবেগতাড়িত প্রতিক্রিয়া থেকে যা সর্বদাই বহিঃশক্তির প্রভাব ও নিষ্পেষণের বিপরীতে ক্রিয়াশীল থাকত। বহিঃশত্রুর আক্রমণ সর্বদাই জনসাধারণকে প্রতিবাদী করে তোলে যা এক পর্যায়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ লাভ করে। অতএব জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের ধারণার গোঁড়ার দিকে ছিল বিদেশী আধিপত্য ও প্রভাব বলয় থেকে মুক্তির তাড়না যা পরবর্তীতে আন্দোলনে রূপ লাভ করে।

জাতীয়তাবাদের ধারণা সম্পূর্ণরূপে বোঝার আগে আমাদের একটা বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকা আবশ্যক যে মানুষ সমাজে কোন চিন্তার ভিত্তিতে নিজেকে চিহ্নিত করে, গড়ে তোলে এবং দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। চিন্তা ও কল্পনার এই ভিত্তি সমূহ হলঃ

                                      ১) দেশপ্রেম
                                      ২) গোত্রবাদ বা জাতীয়তাবাদ
                                      ৩) ধর্ম
                                      ৪) স্বার্থ
                                      ৫) জীবনাদর্শ

উপরোক্ত বন্ধন সমূহের মধ্যে জাতীয়তাবাদের মূল চরিত্রই হল একটি এটা নির্দিষ্ট কাঠামোর আওতায় মানুষকে আলাদা সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক পরিচয় দান করে। এই জাতীয়তাবাদী ভিত্তি বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। একটি জাতির স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির জন্য জাতীয়তাবাদকে অত্যাবশ্যকীয় মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতীয়তাবাদী হতে হলে একটা জাতির নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ অবশ্যই থাকতে হবেঃ একটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চল, স্বাতন্ত্র্য আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য যেমন ভাষা ও গোষ্ঠী, জনস্বার্থ (ট্রানজিট), সাধারণ ইচ্ছা ও অনুভূতি (পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারী) এবং সর্বোপরী অঞ্চলের সর্বসাধারণের জন্য একটি সরকার। এ ছাড়াও একটি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য থাকতে হবে, সংক্ষেপে এটা বলা যায় যে জাতীয়তাবাদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে প্রথমত, এটি এমন একটি রাজনৈতিক চিন্তা যা জাতি রাষ্ট্রে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সর্বোচ্চ আনুগত্য দাবী করে, দ্বিতীয়ত, এই চিন্তার দ্বারা একটি সার্বভৌম জাতি হিসেবে মানুষের ঐক্যবদ্ধ থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়, তৃতীয়ত, এটি সর্বসাধারণের ইচ্ছাশক্তি ও আবেগরূপে বিদ্যমান থাকে। ঐতিহাসিকভাবে রোমান সাম্রাজ্যের অদিবাসীদের সমাজবদ্ধতার চূড়ান্ত ভিত্তি ছিল গির্জা। ক্যাথলিক মতবাদই ছিল রাষ্ট্রীয় ধর্ম এবং যে ক্যাথলিক ছিল না তাকে পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা দেয়া হত না। পোপের হাতেই ছিল সম্রাটদের বৈধতা দানের পূর্ণ ক্ষমতা। সেন্ট আগাষ্টিনের সময় থেকেই চলে আসছিল এ জাতীয় রাজনৈতিক গঠন। কারো ফরাসী, ফরাসী ইতালিয়ান বা জার্মান পরিচিতির চেয়েও বড় বিষয় ছিল তার খৃষ্টান হওয়া বা না হওয়ার বিষয়টি। যখন থেকে খৃষ্টান রোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হতে শুরু করল, তখন থেকেই বিভিন্ন জাতির মানুষ এই খৃষ্টান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলনে লিপ্ত হল। তারা নিজেদের পুনরায় নতুন পরিচিতি দিল নাগরিকত্বের এক নতুন মাপকাঠি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। নাগরিকত্ব প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় বিষয় হিসেবে থাকল না, আন্দোলনকারী বুদ্ধিজীবীরা একটি গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এক নতুন সাংস্কৃতিক পরিচিতি উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল – “ফরাসী, জার্মান, স্প্যানিশ বলতে কি বোঝায় – ধর্ম নাকি অন্য কিছু?”এভাবেই ১৮শ শতকে ইউরোপে জাতীয়তাবাদ নামক এক নতুন চিন্তা ও বন্ধনের আবির্ভাব হল যা সাম্রাজ্যবাদ থেকে জাতি রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক রূপান্তর নিশ্চিত করল। আমরা এও দেখতে পাই যে এই জাতীয়তাবাদী চেতনা মানুষের ভেতর জাগিয়ে তোলে এক প্রচণ্ড আধিপত্যবাদী মনোভাব। তাই এই জাতীয়তাবাদ কখনই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে না কারণ এর ভিত্তিই হল নেতৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের ক্ষুধা যা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এক প্রকার ক্ষমতার সংঘাত সৃষ্টি করে। একই ভাষাভাষী ও তথাকথিত বাঙ্গালী সংস্কৃতির ছায়াতলে থেকেও আওয়ামী ও বিএনপির ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্ধ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় জাতীয়তাবাদের নিরঙ্কুশ ব্যর্থতার চিত্র।

জাতীয়তাবাদ তার এই দ্বন্ধ ও আধিপত্যের মৌলিক চরিত্র নিয়ে কালেক্রমে সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণের সহায়ক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে খুব সুচারুভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে সাম্রাজ্যবাদীরা সমর্থ হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ একই জাতির ভেতর ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে চলমান এই দ্বন্ধ সংঘাতকে সর্বদাই জীবিত রাখে এবং এই দ্বন্ধ সংঘাতে লিপ্ত দল বা গোত্রসমূহের দ্বারা তারা তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বলয় অটুট রাখে। উদাহরণস্বরূপঃ আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন (উগান্ডা, রুয়ান্ডা, কঙ্গো ইত্যাদি) দেশের গৃহযুদ্ধে মার্কিনীরা উভয়পক্ষকেই অস্ত্র যোগান দিয়ে থাকে এবং বিনিময়ে অগণিত প্রাকৃতিক সম্পদ লুট নিশ্চিত করে। ইরাকেও আমরা দেখতে পাই শিয়া, সুন্নি, কুর্দিদের দ্বারা তিনটি ভাগে বিভক্ত করে তাদের মধ্যে দ্বন্ধ অব্যাহত রেখেছে এবং এই দ্বন্ধ নির্মুল করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ইরাকের সেনাদের প্রশিক্ষণের নাম করে মার্কিনীরা শক্ত ঘাটি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এরই মাধ্যমে সে তেল সরবরাহ নিশ্চিত করে চলেছে। অতএব এ থেকে বোঝা যায় কিভাবে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তির কথা বলে সাম্রাজ্যবাদেরই সহায়ক শক্তি হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। এই প্রকারের আজটি রাষ্ট্রের ধারণা একারণেই করা হয়েছে যাতে জাতিসমুহ নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত থাকবে এবং এরই মাধ্যমে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের সমর শিল্পের বিকাশ করবে।

মুসলিম ভূমিসমূহে জাতীয়তাবাদের বিকাশঃ
পতনের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে মুহাম্মদ (সাঃ) এর এই উম্মত সর্বব্যাপী ভয়াবহতম আক্রমণের শিকার হয়, তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় যে বিষয়টি তা হল তার চিন্তার জগত। ১০৯৯ খৃষ্টাব্দে ক্রুসেডারদের দ্বারা সংঘটিত বর্বরতা এই উম্মাহ পাড়ি দিয়েছে ৮ লক্ষ মুসলমানের জীবনের বিনিময়ে, অতিক্রম করেছে ১২৫৮ খৃষ্টাব্দের মোঙ্গলদের বাগদাদ আক্রমণ যার পরিণতিতে আব্বাসীয় খেলাফতেরও পতন ঘটে। তা সত্বেও এই উম্মাহ দ্বীনের সঠিক আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল এবং ইসলামকে আরো সম্প্রসারিত করার জন্য ছিল ঐক্যবদ্ধ।

চলবে......

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন