বিগত তিন দশক ধরে পুরো বিশ্ব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে
পুঁজিবাদের আধিপত্য দেখেছে । এটা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে করায়ত্ব করেছে এবং পুরো
পৃথিবীতে তার অর্থনৈতিক দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করেছে । এশীয় বাঘ হিসেবে চীন, দক্ষিণ
কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, এবং হংকং উদার অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করে সাফল্য লাভ করেছে এবং
এগিয়ে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্ব
ব্যাংকের মত শিল্পায়ন এবং উদার অর্থনৈতিক চিন্তা গতানুগতিক সমাজ ও অর্থনীতিতে এক
ধরনের রূপান্তর ঘটায় । এর প্রভাব দরিদ্র দেশ সমূহকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যায়- যে পথে
পশ্চিমা শিল্পোন্নত বিশ্ব শিল্প বিপ্লবের সময় গিয়েছে ।
বর্তমান দরিদ্রতা পৃথিবীর অধিকাংশ জনগণের বাস্তবতা।
প্রায় ৩ বিলিয়ন লোক ২ ডলারের কম আয় করে ।অন্য ১.৩ বিলিয়ন লোক ১ ডলারের কম আয় করে।
৩ বিলিয়ন লোকের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা
নেই এবং ২ বিলিয়ন লোক বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। উদার নীতি গ্রহণের কারণে পুরো
পৃথিবী জুড়েই সম্পদের আকাশসম অসম বণ্টন এবং দারিদ্র সুনিশ্চিত হয়েছে। উদার নীতি পশ্চিমা বিশ্বকে সমৃদ্ধ করে বাকি
বিশ্বকে দারিদ্র উপহার দিয়েছে। উদার অর্থনীতি কোনভাবেই দারিদ্র বিমোচন সহায়ক নয়।
সেকারণে তৃতীয় বিশ্ব এ নীতির প্রয়োগের কারণে দারিদ্র আরও ঘনীভূত হয়েছে ।
উদার নীতি পশ্চিমে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি
করেছে-যার উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে প্রবল ।
উদাহরণ হিসেবে যদি যুক্তরাজ্যের কথা বলি তাহলে দেখা যাবে যে , ২০০৫ সালে তাদের মোট
বার্ষিক উৎপাদিত সম্পদ ও সেবার পরিমাণ প্রায় ২.২ ট্রিলিয়ন পাউন্ড –যা বিগত বছরের
তুলনায় বেশী ছিল। অনেকে এক উদার নীতি
গ্রহণের কারণে মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির পরিচায়ক হিসেবে তুলে ধরতে চাইবেন। অর্থাৎ জনগণ এখন খুশী- কারণ তাদের খরচ করার মোট
সম্পদ বেড়েছে। কিন্তু আমরা যদি লক্ষ্য করি কিভাবে ব্রিটেনের ৬০ মিলিয়ন জনগন এ
সম্পদকে গ্রহণ করেছিল। ২০০৫ সালে প্রকাশিত এইচ.এম রেভিনিউ এন্ড কাস্টমস- এর উপাত্ত অনুযায়ী সর্বোচ্চ ধনী শতকরা ১০ ভাগের
কাছে রয়েছে জাতীয় সম্পদের শতকরা ৫০ ভাগ এবং শতকরা ৪০ ভাগ ব্রিটিশ জনগণ এ সম্পদের
মাত্র ৫ ভাগ ভোগ দখল করে। সে কারণে বৃটেনের অধিকাংশ জনগণকে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়
নির্বাহের জন্য ধার করতে হয়। এ কারণে যুক্তরাজ্যে ভোক্তা ঋণের পরিমাণ প্রায় ১.৩ ট্রিলিয়ন
পাউন্ড যা তাদের মোট অর্থনীতির চেয়ে বড়। আমেরিকার অবস্থা আরও ভয়াবহ। তারা হয়ত বছরে
১৩ ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ সম্পদ তৈরি করে কিন্তু জাতীয় ঋণের পরিমাণ ৮ ট্রিলিয়ন
ডলার। অর্থাৎ মার্কিন জনগণ ঋণের মাধ্যমে তাদের ব্যয় নির্বাহ করছে, যতই তারা সম্পদ
ও সেবা তৈরি করুক না কেন। ২০০৫ সালে হার্ভাড ইউনিভার্সিটির এক রিপোর্টে বলা হয়,
শতকরা ১০ ভাগ জনগণ ৭০ ভাগ সম্পদ ভোগ করে এবং শীর্ষে ১ ভাগ ৪০ ভাগ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ
করে। অপরদিকে ৪০ ভাগ জনগণ শতকরা ১ ভাগ সম্পদ ভোগ করে।
সুতরাং উদার নিতি পশ্চিমা বিশ্বেও সম্পদের ব্যাপক বৈষম্য
সৃষ্টি করেছে-যারা প্রায় শতাব্দীকাল ধরে এ নীতির আওতায় রয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্ব আজকাল আমাদের যেসব নীতিমালার কথা বলছে,তারা উন্নয়ন করেছে এর বিপরীত সব
নীতিমালার ভিত্তিতে। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হা জনু চেঙ ২০০৩ সালে তার
অবিস্মরণীয় কাজ “কিকিং অ্যাওয়ে দি ল্যাডার”- উল্লেখ করেন, প্রত্যেকটি শিল্পোন্নত
দেশ উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে রক্ষণশীল নীতিমালা গ্রহণ করেছে। উন্নয়নের
ধারা সম্পর্কে যে ধারনা পাওয়া যায় তাতে অপেক্ষাকৃত বেশী সুযোগ সিবিধা আদায় নয় বরং
বাজারকে রক্ষা করার মাধ্যমে উচ্চ উপযোগ সৃষ্টিকারী পণ্যের উৎপাদনকে উৎসাহিত করা
হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে বাজারকে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়াটি ঔপনিবেশিক
এবং দাসপ্রথাতান্ত্রিক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে বাজার প্রভাবিত হয় কৃষি ও ইস্পাত খাতে ভুতর্কির
মাধ্যমে। সরকার ব্যাপক খরচ করে জীবপ্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাতে যা ও এক ধরনের
ভুতর্কি ।
সে কারণে উদার নীতি তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের জন্য সহায়ক
নয় বরং এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা। দারিদ্র্যের প্রত্যক্ষ কারণ হল উদারনীতি গ্রহণ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন