শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২

খলীফা নিয়োগ করার প্রক্রিয়া

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেম শাইখ আতা ইবনু খলীল আল-রাশতা কর্তৃক লিখিত আজহিজাতু দাওলাতিল খিলাফাহ - ফিল হুকমি ওয়াল ইদারাহ’ বইটির বাংলা অনুবাদ এর একাংশ হতে গৃহীত)

শরী'আহ যখন উম্মাহ্‌'র উপর একজন খলীফা নিয়োগ করাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে, একইসাথে, শরী'আহ খলীফা নিয়োগ করার পদ্ধতিও নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ পদ্ধতি আল্লাহ্‌'র কিতাব ও রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ্‌ দ্বারা প্রমাণিত। যে সমস্ত মুসলিম খলীফাকে বাই'আত দিবে তাদের অবশ্যই সে সময়ে খিলাফত রাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে। আর, যদি পরিস্থিতি এরকম হয় যে, যখন কোন খিলাফত রাষ্ট্র নেই, তখন সে অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর উপরই বাই'আত দেবার দায়িত্ব বর্তাবে যেখানে খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা কার্যকর করা হবে।

বাই'আত যে খলীফা নির্বাচনের পদ্ধতি তা প্রমাণিত হয়, রাসূল (সাঃ) কে মুসলিমদের বাই'আত দেবার ঘটনা ও ইমামকে বাই'আত দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ্‌'র রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশ থেকে। তৎকালীন মুসলিমরা রাসূল (সাঃ) কে নবী হিসাবে বাই'আত দেয়নি; বরং শাসক হিসাবে বাই'আত দিয়েছিল। কারণ, তাদের এ বাই'আত বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত ছিল না, বরঞ্চ তাদের কাজের সাথে সম্পর্কিত ছিল। সুতরাং, রাসূল (সাঃ) কে নবী বা রাসূল হিসেবে বাই'আত দেয়া হয়নি বরং শাসক হিসেবেই বাই'আত দেয়া হয়েছিল। কারণ, নবুয়্যতকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি মূলতঃ বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত এবং এখানে বাই'আতের প্রক্রিয়াটি প্রযোজ্য নয়। সুতরাং, আল্লাহ্‌'র রাসূলকে বাই'আত দেবার বিষয়টি তাকে শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া বলেই বিবেচিত হবে।

পবিত্র কুর'আন ও হাদীসেও বাই'আতের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন:

"হে নবী ! তোমার নিকট মুমিন স্ত্রী লোকেরা যদি একথার উপর বাই'আত করবার জন্য আসে যে, তারা আল্লাহ্‌'র সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যাভিচার করবে না, নিজেদের সন্তান হত্যা করবে না, আপন গর্ভজাত জারজ সন্তানকে স্বামীর সন্তান বলে মিথ্যা দাবি করবে না এবং কোন ভাল কাজের ব্যাপারে তোমার অবাধ্যতা করবে না, তবে তুমি তাদের বাই'আত গ্রহণ কর।" [সূরা মুমতাহিনা : ১২]

অন্য আয়াতে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,

"হে নবী! যেসব লোক তোমার নিকট বাই'আত গ্রহণ করেছিল তারা আসলে আল্লাহ্‌'র নিকট বাই'আত করছিল। তাদের হাতের উপর আল্লাহ্‌'র হাত ছিল।" [সূরা আল ফাত্‌হ : ১০]

বুখারী থেকে বর্ণিত হযরত উবাদা ইবন সামিত (রা) বর্ণনা করেন,

"আমরা রাসূল (সাঃ) এর নিকট সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি উভয় অবস্থায় শ্রবন ও আনুগত্য করার শপথ নিয়েছি। একথার উপরও শপথ নিয়েছি যে, আমরা উলূল আমর (শাসন কর্তৃত্বশীল)-এর সাথে বিবাদ করবনা। আমরা এই মর্মেও শপথ নিয়েছি যে, হকের জন্য উঠে দাঁড়াবো কিংবা হক কথা বলব যে অবস্থায়ই থাকি না কেন। আর, আল্লাহ্‌'র কাজের ব্যাপারে কোন নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবো না।" (সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস নং-৭০৫৪; সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-৪৭৪৮)

হযরত আবদুল্লাহ্‌ বিন আমর বিন আ'স (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি আল্লাহ্‌'র রাসূলকে (সাঃ) বলতে শুনেছি যে,

"যে ব্যক্তি কোন ইমামকে বাই'আত প্রদান করল, সে যেন তাকে নিজ হাতের কর্তৃত্ব ও স্বীয় অন্তরের ফল (অর্থাৎ সব কিছু) দিয়ে দিল। এরপর তার উচিৎ উক্ত ইমামের আনুগত্য করা। যদি অন্য কেউ এসে (প্রথম নিযুক্ত) খলীফার সাথে (ক্ষমতার ব্যাপারে) বিবাদে লিপ্ত হয়, তাহলে দ্বিতীয় জনের গর্দান উড়িয়ে দাও।" (মুসনাদে আহমাদ, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা-১০)

এছাড়াও মুসলিম বর্ণনা করেন আবু সাইদ খুদ্‌রী (রা) রাসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছেন:

"যদি দু'জন খলীফাকে বাই'আত দেয়া হয়, তাহলে দ্বিতীয়জনকে হত্যা কর।" (সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৫৩)

আবু হাজিমের বরাত দিয়ে ইমাম মুসলিম আরও বর্ণনা করেন যে, আমি আবু হুরায়রার সাথে পাঁচ বছর অতিবাহিত করেছি এবং তাঁকে বলতে শুনেছি, রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

"বনী ইসরাইলকে শাসন করতেন নবীগণ। যখন এক নবী মৃত্যুবরণ করতেন তখন তাঁর স্থলে অন্য নবী আসতেন, কিন্তু আমার পর আর কোনও নবী নেই। শীঘ্রই অনেক সংখ্যক খলীফা আসবেন। তাঁরা (রা) জিজ্ঞেস করলেন তখন আপনি আমাদের কী করতে আদেশ করেন? তিনি (সাঃ) বললেন, তোমরা একজনের পর একজনের বাই'আত পূর্ণ করবে, তাদের হক আদায় করবে। অবশ্যই আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) তাদেরকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবেন।" (সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস নং-৩৪৫৫)

উপরোক্ত দলীল সমূহ এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্‌'র কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ্‌ অনুযায়ী খলীফা নিয়োগ করার প্রক্রিয়া হল বাই'আত। সকল সাহাবী (রা) এটি জানতেন এবং তাদের জীবনে তা কার্যকর করেছিলেন। সুতরাং, খোলাফায়ে রাশেদীনদের কেন বাই'আত দেয়া হয়েছিল, এ সমস্ত দলীল-প্রমাণ থেকে তা পরিষ্কার।

খলীফা নিয়োগ করা ও বাই'আত প্রদানের জন্য গৃহীত বাস্তব পদক্ষেপসমূহ

বাই'আত প্রদানের পূর্বে খলীফা নিয়োগের বাস্তব পদক্ষেপসমূহ বিভিন্ন রকম হতে পারে। যে রকমটি হয়েছিল খোলাফায়ে রাশেদীনদের সময়ে, যারা আল্লাহ্‌'র রাসূল (সাঃ) এর ইন্তিকালের পরপরই উম্মাহ্‌'র খলীফা হিসাবে মনোনীত হয়েছিলেন - যেমন: আবু বকর, উমর, উসমান এবং আলী (রা)। এ সমস্ত পদক্ষেপের ব্যাপারে সকল সাহাবী (রা) নীরব থেকে তাঁদের স্বীকৃতি ও সম্মতি প্রদান করেছিলেন। এ বিষয়সমূহ যদি শারী'আহ্‌ সম্মত না হত তাহলে তাঁরা তা কোনক্রমেই মেনে নিতেন না। কারণ, এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার উপর মুসলিমদের মর্যাদা ও শরী'আহ্‌ হুকুম-আহ্‌কাম বাস্তবায়ন নির্ভর করে। আমরা যদি খোলাফায়ে রাশেদীনদের নিয়োগের বিভিন্ন ধাপসমূহের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব যে, বনু সা'ইদার প্রাঙ্গনে কিছু মুসলিমের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। (আল্লাহ্‌'র রাসূলের পর) সম্ভাব্য খলীফা হিসাবে সা', আবু উবাইদাহ্‌, উমর ও আবু বকর (রা) প্রাথমিকভাবে মনোনীত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে, উমর ও আবু উবাইদাহ্‌ (রা) আবু বকর (রা) কে চ্যালেঞ্জ করতে অস্বীকৃতি জানান। অর্থাৎ, বিষয়টি তখন সা'দ এবং আবু বকর (রা) মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। অনেক তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার পর আবু বকর (রা) কে খলীফা হিসাবে বাই'আত দেয়া হয়। পরদিন মুসলিমদেরকে মসজিদে আহ্বান করা হয় এবং তারা সেখানে আবু বকর (রা) কে বাই'আত দেয়। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, বনু সা'ইদার প্রাঙ্গনের বাই'আতটি ছিল খলীফা হিসাবে নিয়োগের বাই'আত - যার মাধ্যমে আবু বকর (রা) মুসলিমদের খলীফা হিসাবে নির্বাচিত হন। আর তার পরের দিন, মসজিদে গৃহীত বাই'আতটি ছিল আনুগত্যের বাই'আত।

আবু বকর (রা) যখন বুঝতে পারলেন যে তাঁর অসুস্থতা তাঁকে ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে, ঠিক সে সময়ে মুসলিম সেনাবাহিনী পারস্য ও রোমান পরাশক্তিগুলোর সাথে যুদ্ধ করছিল। তখন তিনি তাঁর মৃত্যুর পর কে খলীফা হবেন এ ব্যাপারে মুসলিমদের সাথে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তিনি প্রায় ৩ মাস ব্যাপী মদীনার মুসলিমদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করলেন। আলোচনার এক পর্যায়ে যখন তিনি অধিকাংশ মুসলিমের মনোভাব বুঝতে পারলেন, তখন তাঁর উত্তরসূরী হিসাবে তিনি উমর (রা.) এর নাম ঘোষণা করলেন। তবে, তাঁর এই মনোনয়ন উমরকে তাঁর পরবর্তী খলীফা হিসেবে নিয়োগের চুড়ান্ত চুক্তি হিসাবে বিবেচিত হয়নি। কারণ, আবু বকরের মৃত্যুর পর মুসলিমরা মসজিদে এসে উমর (রা) কে বাইয়াত দেয় এবং এভাবেই খলীফা হিসাবে তাঁর নিয়োগ চূড়ান্ত হয়। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, উমর (রা) শুধুমাত্র বাই'আতের মাধ্যমেই খলীফা হয়েছিলেন; মুসলিমদের সাথে আবু বকর (রা) এর আলাপ-আলোচনা বা তাঁর মনোনয়নের মাধ্যমে নয়। যদি আবু বকর (রা) এর মনোনয়নই খলীফা নিয়োগের চূড়ান্ত চুক্তি হত, তাহলে উমর (রা) কে মুসলিমদের বাই'আত দেবার কোন প্রয়োজন ছিল না। সুতরাং, এ ঘটনা আমাদের স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে যে, মুসলিমদের বাই'আত ছাড়া কেউ খলীফা হিসাবে নির্বাচিত হতে পারবে না।

খলীফা থাকাকালীন সময়ে উমর (রা) যখন গুরুতরভাবে আহত হলেন তখন মুসলিমরা তাঁকে একজন খলীফা মনোনীত করার জন্য অনুরোধ করলেন; কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। কিন্তু, এ ব্যাপারে তাদের ক্রমাগত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ছয়জনকে খলীফা পদের জন্য মনোনীত করেন। অতঃপর তিনি শুয়াইব (রা) কে ইমাম নিযুক্ত করলেন এবং তাঁর মনোনীত ছয়ব্যক্তিকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে (তাঁর মৃত্যুর) তিনদিনের মধ্যে শুয়াইব (রা) কে খলীফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিলেন। উমর (রা), শুয়াইব (রা) কে বললেন, "...যদি (ছয়জনের মধ্যে) পাঁচজন একব্যক্তির (খলীফা হবার) ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছে এবং একজন দ্বিমত পোষণ করে তাহলে তরবারি দিয়ে তার মস্তক উড়িয়ে দেবে...।" এ ঘটনাটি তাবারণী তার তা'রীখ গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন; এছাড়া, আরও উল্লেখিত আছে ইবন কুতাইবা'র গ্রন্থ আল ইমামা ও সিয়াসাহ, যা কিনা 'খিলাফতের ইতিহাস' (দ্যা হিস্ট্রি অফ খিলাফাহ্‌) নামে পরিচিত এবং ইবন সা'দ এর গ্রন্থ আত-তাবাকাত আল-কুবরাহ্‌'তে। তারপর উমর (রা) আবু তাল্‌হা আল-আনসারীকে পঞ্চাশ জন ব্যক্তির সহায়তায় তাঁর মনোনীত ছয়ব্যক্তির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত করলেন এবং সেই সাথে, আল মিকদাদ ইবনে আল-আসওয়াদকে উক্ত ছয়প্রার্থীর মিলিত হবার স্থান নির্ধারণের দায়িত্ব দিলেন। উমর (রা) এর মৃত্যুর পর তাঁর মনোনীত ছয় ব্যক্তি একত্রিত হলেন। এরপর, আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) তাদের প্রশ্ন করলেন, "তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিকে খলীফা নির্বাচিত করার জন্য কে নিজেকে এ পদ থেকে সরিয়ে নিতে চাও?" এ প্রশ্নের উত্তরে সকলে নিশ্চুপ থাকলে তিনি বললেন, "আমি স্বেচ্ছায় খলীফার পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি।" তারপর তিনি এক এক করে প্রত্যেকের সাথে আলাদাভাবে আলোচনা করলেন। তিনি প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করলেন, "নিজেকে ছাড়া ছয়জনের মধ্যে আর কাকে তুমি এ পদের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি বলে মনে কর?" তাদের সকলের উত্তর আলী (রা) এবং উসমানের (রা) মধ্যে সীমাবদ্ধ হল। এরপর, আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) এ দু'জনের মধ্যে কাকে জনগণ খলীফা নির্বাচিত করতে চায়, সে বিষয়ে মতামত সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়লেন। জনমত যাচাই এর জন্য তিনি মদীনার নারী-পুরুষ সবাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এবং খলীফা নির্বাচনের এ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি দিনরাত কাজ করেছিলেন। আল মুসওয়ার ইবনে মাখরামা'র বরাত দিয়ে আল-বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, "রাতের কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর আব্দুর রহমান বিন আউফ আমার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছিল যে পর্যন্ত না আমি জেগে উঠলাম। তিনি বললেন, "আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি ঘুমাচ্ছো, কিন্তু আল্লাহ্‌'র কসম, গত তিন রাত আমি খুব কমই ঘুমের আনন্দ উপভোগ করেছি।" এরপর মদীনার জনগণ ফজরের সালাত আদায় করার পর উসমান (রা) কে খলীফা হিসেবে বাই'আত দিল এবং এভাবেই তিনি মুসলিমদের বাই'আতের মাধ্যমে খলীফা হিসাবে নির্বাচিত হলেন। সুতরাং, উসমান (রা) মুসলিমদের বাই'আতের মাধ্যমেই খলীফা হয়েছিলেন, উমর (রা) কর্তৃক মনোনয়নের মাধ্যমে নয়।

উসমান (রা) নিহত হওয়ার সময় মদীনার সাধারণ জনগণ এবং কুফাবাসী আলী ইবনে আবি তালিব (রা) কে খলীফা হিসেবে বাই'আত দেন। এভাবে তিনিও মুসলিমদের বাই'আতের মাধ্যমে খলীফা হিসাবে নির্বাচিত হন।

সাহাবীদের বাই'আত দেয়ার প্রক্রিয়াকে সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ করলে এটা পরিস্কারভাবে বোঝা যায় যে, প্রথমে জনগণের কাছে খলীফা পদপ্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হতো এবং এদের প্রত্যেককে অবশ্যই খলীফা হবার আবশ্যিক শর্তাবলী পূরণ করতে হত। তারপর উম্মাহ্‌'র প্রভাবশালী ব্যক্তি - যারা উম্মাহ্‌কে প্রতিনিধিত্ব করতেন তাদের মতামত সংগ্রহ করা হত।

খোলাফায়ে রাশেদীনদের সময়ে উম্মাহ্‌'র প্রতিনিধি ছিলেন সাহাবা (রা) কিংবা মদীনার অধিবাসীগণ। যে ব্যক্তি সাহাবীদের (রা) অথবা অধিকাংশ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচিত হতেন, তাকেই বাই'আত দেয়া হত এবং তার আনুগত্য করা তখন মুসলিমদের উপর ফরয হয়ে যেত। এভাবেই মুসলিমরা খলীফাকে আনুগত্যের বাই'আত প্রদান করতো এবং তাদের নির্বাচিত খলীফাই শাসন ও কর্তৃত্বের ব্যাপারে উম্মাহ্‌'র প্রতিনিধি হয়ে যেতেন।

খোলাফায়ে রাশেদীনদের (রা) বাই'আত দেবার ঘটনাসমূহ থেকে মূলতঃ এ বিষয়গুলোই বোঝা যায়। এছাড়া, উমর (রা) এর ছয়জন ব্যক্তি মনোনীত করার বিষয়টি এবং উসমান (রা) কে বাই'আত দেবার সময় যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছিল, তা থেকে আরও দুটি বিষয় পরিস্কারভাবে বোঝা যায়। আর তা হল, প্রথমত একজন অন্তর্বর্তীকালীন আমীর (নেতা) এর উপস্থিতি, যিনি নতুন খলীফা নির্বাচিত হওয়া কালীন সময় উম্মাহ্‌'র দায়িত্বে থাকবেন এবং দ্বিতীয়ত খলীফার জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছয়জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।

অন্তর্বর্তীকালীন আমীর

একজন খলীফার কাছে তার মৃত্যু নিকটবর্তী মনে হলে কিংবা খলীফার পদ শূন্য হবার মত কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে নতুন খলীফা নির্বাচিত হওয়া কালীন সময়ে মুসলিমদের বিষয়াবলী দেখশুনা করার জন্য একজন অন্তর্বর্তীকালীন আমীর নিয়োগ করার ক্ষমতা খলীফার রয়েছে। পূর্ববর্তী খলীফার মৃত্যুর পর তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এবং তার প্রধান কাজ হবে তিনদিনের ভেতর নতুন খলীফা নির্বাচিত করা।

নতুন কোন আইন গ্রহণ করবার ক্ষমতা অন্তর্বর্তীকালীন খলীফার নেই। কারণ, এটি কেবলমাত্র উম্মাহ্‌'র বাই'আতের মাধ্যমে নির্বাচিত খলীফার জন্য সংরক্ষিত। খলীফা পদের জন্য মনোনীতদের মধ্য হতে কেউ অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হতে পারবেন না কিংবা মনোনীতদের কাউকে তিনি সমর্থন করতে পারবে না। কারণ, উমর (রা) তাঁর মনোনীত ছয়জনের মধ্য হতে কাউকে অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হিসেবে নিয়োগ দেননি।

নতুন খলীফা নির্বাচিত হওয়া মাত্রই অন্তর্বর্তীকালীন আমীরের কার্যকাল শেষ হয়ে যাবে, কারণ তার মেয়াদ অস্থায়ী এবং দায়িত্ব একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের (নতুন খলীফা নির্বাচিত করা) মধ্যেই সীমিত।

শুয়াইব (রা) যে উমর (রা) কর্তৃক নির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন আমীর ছিলেন তা উমর (রা) এর মনোনীত ছয়ব্যক্তি সম্পর্কিত উক্তি থেকে বোঝা যায়: "যে তিনদিন তোমরা আলোচনা করবে সে সময় শুয়াইব তোমাদের সালাতে ইমামতি করবে।" এরপর তিনি বলেছিলেন, "...যদি (ছয়জনের মধ্যে) পাঁচজন একব্যক্তির (খলীফা হবার) ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছে এবং একজন দ্বিমত পোষণ করে তাহলে তরবারি দিয়ে তার মস্তক উড়িয়ে দেবে...।" এটা প্রমাণ করে যে, শুয়াইব (রা) কে তাদের উপর কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছিল। এছাড়া, শুয়াইব (রা) কে সালাতের ইমামও নিযুক্ত করা হয়েছিল এবং সে সময়ে সালাতে ইমামতির অর্থ ছিল জনগণের উপরও ইমাম (নেতা) নিযুক্ত হওয়া। এছাড়া, তাঁকে শাস্তি প্রদানের (মস্তক উড়িয়ে দেয়ার) ক্ষমতাও দেয়া হয়েছিল এবং আমরা জানি যে, একমাত্র আমীরই কোন ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করার ক্ষমতা রাখেন।

আমীর নির্বাচনের এ ঘটনাটি একদল সাহাবীদের সম্মুখেই ঘটেছিল এবং এ বিষয়ে তারা কেউ কোন দ্বিমত পোষণ করেননি। সুতরাং, এটি ইজমা আস-সাহাবা বা সাহাবীগণের ঐক্যমত যে, নতুন খলীফা নির্বাচিত হবার পূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে উম্মাহ্‌'র বিষয়াবলী এবং নতুন খলীফা নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া সমূহ দেখাশুনা করার জন্য একজনকে আমীর নিযুক্ত করার ক্ষমতা খলীফার রয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, খলীফা তার জীবদ্দশায় রাষ্ট্রের সংবিধানে এ অনুচ্ছেদটি সংযুক্ত করতে পারেন যে, যদি কোন খলীফা অন্তর্বর্তীকালীন আমীর নিযুক্ত না করেই ইন্তেকাল করেন, তবে একজনকে অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হিসাবে নিযুক্ত করতে হবে।

একইভাবে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, খলীফার শাসনকালের শেষের দিকে যদি তার পক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন আমীর নিয়োগ করা সম্ভব না হয়, তবে খলীফার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ্য প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী (Next Eldest Delegated Assistant) অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হবেন যদি না তাকে খলীফা পদের জন্য মনোনীত করা হয়। যদি তিনি খলীফা পদের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হন, তাহলে তার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ্য প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হবেন। যদি খলীফার সব প্রতিনিধিত্বকারী সহকারীই পরবর্তী খলীফা পদের জন্য মনোনীত হন, তবে খলীফার জ্যেষ্ঠ্য নির্বাহী সহকারীকে আমীর নিযুক্ত করা হবে এবং পূর্বের মতোই ব্যাপারটি চলতে থাকবে। যদি উল্লেখিত সকলেই মনোনীত হন তবে কনিষ্ঠ নির্বাহী সহকারী অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবেন।

যদি খলীফাকে কোন কারণে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয় তাহলেও এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রেও একইভাবে খলীফার জ্যেষ্ঠ্য প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হবেন, যদি না তিনি মনোনীতদের মধ্যে কেউ হন। আর, যদি তিনি মনোনীতদের একজন হন তাহলে তার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ্য প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী আমীর নিযুক্ত হবেন এবং এভাবে প্রতিনিধিত্বকারী সহকারীদের শেষব্যক্তি পর্যন্ত ব্যাপারটি চলতে থাকবে। প্রতিনিধিত্ব সহকারীদের সকলেই মনোনীত হলে, জ্যেষ্ঠ্য নির্বাহী সহকারী আমীর হবেন এবং পূর্বের মতোই ব্যাপারটি চলতে থাকবে। যদি উল্লেখিত সকলেই মনোনীত হন তবে কনিষ্ঠ নির্বাহী সহকারী অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবেন।

খলীফা যদি শত্রুর হাতে বন্দী হন সেক্ষেত্রেও এ নিয়ম প্রযোজ্য। তবে, এক্ষেত্রে খলীফাকে উদ্ধার করার কোন সম্ভাবনা না থাকলে অন্তর্বর্তীকালীন আমীরের নির্বাহী ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ থাকতে হবে। এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা যথাযথ সময়ে উম্মাহ্‌'র কাছে উপস্থাপন করা হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, এই অন্তর্বর্তীকালীন আমীর খলীফা জিহাদে বা ভ্রমণে যাবার সময় যে ধরনের ডেপুটি বা প্রতিনিধি নিয়োগ করেন সেরকম কিছু নয়। রাসূল (সাঃ) যখন জিহাদে বা হিজ্জাত আল ওয়াদাতে যেতেন তখন এ রকম ডেপুটি নিয়োগ করতেন। জনগণের বিষয়াদি দেখাশুনা করার জন্য যতটুকু নির্বাহী ক্ষমতার দরকার হয়, সাধারণত এ ধরনের ডেপুটি খলীফা কর্তৃক ততটুকু নির্বাহী ক্ষমতা প্রাপ্ত হন।

মনোনীতদের তালিকা সংক্ষিপ্তকরণ

খোলাফায়ে রাশেদীনদের খলীফাপদে নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এখানে মনোনীত ব্যক্তিদের তালিকা সংক্ষিপ্তকরণের একটি বিষয় ছিল। বানু সা'ইদার প্রাঙ্গনে মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন আবু বকর (রা), উমর (রা), আবু উবাইদাহ (রা) এবং সা'দ বিন উবাদাহ্‌ (রা)। কিন্তু, উমর (রা) এবং আবু উবাইদাহ (রা) নিজেদেরকে আবু বকরের সমতুল্য মনে করেননি, এজন্য তাঁরা আবু বকরকে চ্যালেঞ্জও করেননি। এ কারণে প্রতিযোগিতা আবু বকর ও সা'দ বিন উবাদাহ্‌র মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে, বানু সাইদা'র প্রাঙ্গণে উপস্থিত মদীনার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ আবু বকরকে বাই'আত দিয়ে খলীফা হিসাবে নির্বাচিত করলেন এবং এর পরদিন জনগণ আবু বকর (রা) কে আনুগত্যের বাই'আত দিলেন।

আবু বকর (রা) শুধুমাত্র উমর (রা) কে তাঁর পরবর্তী খলীফা হিসাবে মনোনীত করেছিলেন। এ পদের জন্য তিনি অন্য আর কাউকেই মনোনীত করে যাননি। পরবর্তীতে, মদীনার মুসলিমরা প্রথমে উমরকে নিযুক্তির বাই'আত ও পরে আনুগত্যের বাই'আত প্রদান করে।

উমর (রা) ছয়ব্যক্তিকে খলীফা পদের জন্য মনোনীত করেছিলেন এবং খিলাফতকে এদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করেছিলেন।

সেইসাথে, তিনি জনগণকে ছয়জনের মধ্য হতে একজনকে পছন্দ করবার সুযোগ দিয়েছিলেন। মনোনীতদের মধ্য হতে আব্দুর রহমান (রা) নিজেকে এ পদ থেকে সরিয়ে নিয়ে বাকী পাঁচজনের সাথে একান্তে আলোচনা করে সংখ্যাটি দুইয়ে নামিয়ে এনেছিলেন - এরা ছিলেন আলী (রা) এবং উসমান (রা)। পরবর্তীতে জনগণের মতামত যাচাই-বাছাই এর পর উসমান (রা) দিকে পাল্লা ভারী হয় এবং উসমান (রা) মুসলিমদের খলীফা নিযুক্ত হন।

আলী (রা) কে খলীফা হিসাবে নিযুক্ত করার ক্ষেত্রে সে সময় খলীফা পদের জন্য আর কেউ মনোনীত না হওয়ায় মদীনা ও কুফার অধিকাংশ মুসলিম তাঁকেই বাই'আত দেয়। আর, এভাবেই তিনি চতুর্থ খলীফা হিসাবে নিযুক্ত হন।

যেহেতু উসমান (রা) কে খলীফা হিসাবে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে (শরী'আহ্‌) অনুমোদিত সর্বোচ্চ সময়ের সবটুকুই নেয়া হয়েছিল; অর্থাৎ, তিনদিন ও এই দিনগুলোর মধ্যবর্তী দুই রাত এবং মনোনীত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছয়জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত করে দুই ব্যক্তিতে নামিয়ে আনা হয়েছিল, সেহেতু গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে সঠিকভাবে বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা বিস্তারিতভাবে এ ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করবো :

১. ২৩ হিজরীর জিলহজ্ব মাস শেষ হবার চারদিন আগে বুধবার ভোরে মিহরাবে নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় উমর (রা) কে ছুরিকাঘাত করা হয়। অভিশপ্ত আবু লু'লুয়া'র ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে ২৪ হিজরীর মহররম মাসের প্রথমদিন রবিবার সকালে উমর (রা) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। উমর (রা) এর ইচ্ছা অনুসারে শুয়াইব (রা) তাঁর জানাযার নামাজ পড়ান।

২. উমর (রা) এর দাফনের পর, তাঁর পূর্ববর্তী নির্দেশ অনুসারে আল মিকদাদ (রা) উমরের মনোনীত ছয়ব্যক্তিকে একটি বাড়ীতে একত্রিত করেন; যাদের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ছিল আবু তাল্‌হা'র উপর। এরপর, তাঁরা একে অন্যের সাথে আলোচনায় বসেন। পরবর্তীতে তাঁরা আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) কে তাঁদের মধ্য হতে এবং তাঁদের সম্মতিক্রমে খলীফা নির্বাচিত করার ব্যাপারে প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেন।

৩. আব্দুর রহমান (রা.) তাঁদের সাথে একান্তে আলোচনা করেন এবং প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করলেন, "নিজেকে ছাড়া ছয়জনের মধ্যে আর কাকে তুমি এ পদের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি বলে মনে কর?" তাঁদের উত্তর আলী (রা) এবং উসমানের (রা) মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছিল। এভাবে আব্দুর রহমান (রা) বিষয়টি ছয়ব্যক্তি থেকে বিষয়টি দুইব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন।

৪. এরপর আব্দুর রহমান (রা) মদীনার জনগণের সাথে আলোচনা করা শুরু করেন।

৫. বুধবার রাতে, অর্থাৎ (রবিবার) উমর (রা) ইন্তেকালের পর তৃতীয় দিন রাতে আব্দুর রহমান তাঁর ভাতিজা আল মুসওয়ার ইবনে মাখরামার বাড়িতে গেলেন। এ বিষয়ে ইবনে কাসীর তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ 'আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াতে বর্ণনা করেছেন যে :

"যখন উমরের মৃত্যুর পর চতুর্থ দিনের রাত শুরু হল আবদূর রহমান তাঁর ভাতিজা আল মুসওয়ার ইবনে মাখরামার বাড়িতে গেলেন এবং বললেন, "দেখতে পাচ্ছি তুমি ঘুমাচ্ছো, কিন্তু আল্লাহ্‌'র কসম! গত তিনরাত আমি খুব কমই ঘুমের আনন্দ উপভোগ করেছি।" তিনরাত মানে রবিবার সকালে উমর (রা.) মারা যাবার পরে অর্থাৎ, সোম, মঙ্গল ও বুধবারের রাত। তারপর তিনি বললেন, "...যাও আলী এবং উসমানকে ডেকে নিয়ে এসো...", তারপর তিনি তাঁদেরকে (আলী ও উসমানকে) মসজিদে ডেকে নিয়ে আসলেন এবং জনসাধারণকে নামাজের জন্য ডাকা হলো। এটা ছিল বুধবার ভোরের ঘটনা। তারপর তিনি আলী (রা) এর হাত ধরলেন এবং তাঁকে আল্লাহ্‌'র কিতাব, রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ্‌ ও আবু বকর ও উমর (রা) এর কর্মের উপর বাই'আত করতে বললেন। আলী (রা) তাঁকে তার সেই বিখ্যাত উত্তরটি দিলেন, "আল্লাহ্‌'র কিতাব ও রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ্‌র উপর আমি বাই'আত নিলাম। কিন্তু, আবু বকর ও উমরের কর্মের বিষয়ে তিনি বললেন যে, এ সকল বিষয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব ইজ্‌তিহাদ প্রয়োগ করবেন। এ কথা শুনার পর আব্দুর রহমান, আলীর হাত ছেড়ে দিলেন। এরপর, আব্দুর রহমান বিন আউফ, উসমান (রা) এর হাতটি ধরলেন ও তাঁকেও একই কথা বলতে বললেন। উসমান (রা) বললেন, 'হ্যাঁ, আল্লাহ্‌'র নামে।' এভাবে উসমান (রা) এর বাই'আত সম্পন্ন হল।

শুয়াইব (রা) সেদিনের ফযর ও জোহরের নামাযে ইমামতি করলেন। এরপর, উসমান (রা) মুসলিম উম্মাহ্‌'র খলীফা হিসেবে আসর থেকে ইমামতি শুরু করলেন। এর অর্থ হচ্ছে, যদিও উসমান (রা) ফজরের সময় নিযুক্তির বাই'আত পেয়েছিলেন, কিন্তু মদীনার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বাই'আত পাবার পূর্ব পর্যন্ত মুসলিমদের আমীর হিসেবে শুয়াইব (রা) এর কর্তৃত্বই বহাল ছিল। প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বাই'আত দেবার পর্ব শেষ হয়েছিল মূলতঃ আসরের কিছু আগে, যখন সাহাবারা উসমান (রা) কে বাই'আত দেয়ার ব্যাপারে একে অপরকে আহ্বান করছিলেন। আসরের কিছুকাল পূর্বে বাই'আত গ্রহণ পর্ব শেষ হয়ে যাবার সাথে সাথে আমীর হিসাবে শুয়াইব (রা) এর কার্যকালও শেষ হয়ে যায় এবং আসরের নামায থেকে উম্মাহ্‌'র খলীফা হিসাবে উসমান (রা) ইমামতি শুরু করেন।

'আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া' গ্রন্থের রচয়িতা ব্যাখ্যা করেছেন, কেন উসমান (রা) ফজরের সময় বাই'আত নেয়া সত্ত্বেও শুয়াইব (রা) জোহরের নামাযে ইমামতি করেছিলেন। এ বিষয়ে তার ব্যাখ্যা হল: "কিছু মানুষ মসজিদে উসমানকে বাই'আত দেয়ার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মাজলিশ আশ-শুরা ভবনে (যেখানে শুরা কমিটির লোকজন মিলিত হতেন)।

সেখানে বাকীরা তাঁকে বাই'আত দেয়। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, জোহর নামায অতিক্রান্ত হবার পরও উসমানের বাই'আত গ্রহণ পর্ব চলছিল। আর, এ কারণেই মসজিদে নববীতে জোহরের নামাযে শুয়াইব (রা) ইমামতি করেছিলেন।

সুতরাং, মুসলিম উম্মাহ্‌'র খলীফা হিসাবে উসমান (রা) প্রথম যে নামাযে ইমামতি করেছিলেন তা ছিল আসরের নামায।"

বিভিন্ন বর্ণনা অনুসারে উমর (রা) ছুরিকাহত হওয়ার দিন, আহত হবার পর তাঁর ইন্তিকালের দিন এবং উসমান (রা) এর বাই'আতের দিনগুলোর ব্যাপারে কিছু মতপার্থক্য আছে। তবে, আমরা চেষ্টা করেছি দলীল-প্রমাণের দিক থেকে যেটি সবচাইতে শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য সেটি উপস্থাপন করতে।

উপরোক্ত আলোচনা অনুসারে, (খলীফার ইন্তিকাল কিংবা অপসারণের মাধ্যমে) খলীফার পদ শূন্য হওয়ার পর নতুন খলীফা মনোনয়নের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়াবলীর প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে :

১. খলীফা নিয়োগের কাজটি দিন-রাত ব্যাপী করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না এটি সম্পন্ন হয়।

২. খলীফা নিযুক্ত হবার আবশ্যিক শর্তাবলী পূরণের মাধ্যমে মনোনীতদের তালিকা করতে হবে এবং এ বিষয়টি মূলতঃ পরিচালিত হবে মাহ্‌কামাতুল মাযালিমের মাধ্যমে।

৩. তারপর মনোনীতদের তালিকা সংক্ষিপ্ত করা হবে দু'বার: প্রথমে ছয় এবং পরে দুই। উম্মাহ্‌'র প্রতিনিধি হিসাবে মজলিশ আল-উম্মাহ্‌ এই সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরীর কাজ করবে। এর কারণ হল, উম্মাহ্‌ উমর (রা) কে তাদের প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিল এবং উম্মাহ্‌'র প্রতিনিধি হিসাবেই তিনি সম্ভাব্য ছয়জনের তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন।

পরবর্তীতে, মনোনীত এই ছয়জন তাঁদের মধ্য হতে একজনকে অর্থাৎ, আব্দুর রহমান বিন আউফকে তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছিলেন। যিনি আবার আলোচনার ভিত্তিতে এই তালিকা সংক্ষিপ্ত করে তা দু'জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছিলেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি পর্যায়ে উম্মাহ্‌'র প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই বিষয়টি সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং, এটি উম্মাহ্‌'র প্রতিনিধিত্বকারী মজলিশ আল-উম্মাহ্‌'র কাজ।

৪. নতুন খলীফা নির্বাচনের ঘোষণার সাথে সাথে অন্তর্বর্তীকালীন আমীরের কার্যকাল শেষ হবে না; বরং বাই'আত গ্রহণ পর্ব পুরোপুরি সম্পন্ন হবার পর তার কার্যকাল শেষ হয়ে যাবে। কারণ, শুয়াইব (রা) এর কার্যকাল উসমান (রা) খলীফা নির্বাচিত হবার সাথে সাথে শেষ হয়নি; বরং বাই'আত গ্রহণ পর্ব সম্পন্ন হবার পরই তা শেষ হয়েছিল।

তিন দিন এবং এদের অন্তর্বর্তী রাত সমূহের ভেতর কিভাবে নতুন খলীফা নির্বাচিত করা যায় সে ব্যাপারে একটি বিল পাশ করা হবে। অবশ্য এটি ইতিমধ্যে কার্যকর হয়ে গেছে। ইন্‌শাআল্লাহ্‌ আমরা যথা সময়ে এটি উম্মাহ্‌'র কাছে উপস্থাপন করবো।

সুতরাং, মুসলিম উম্মাহ্‌'র যদি একজন খলীফা থাকে এবং কোন কারণে যদি তাকে অপসারণ করা হয় কিংবা তার মৃত্যু হয়, তবে এ সকল ক্ষেত্রে এ বিধানগুলো প্রযোজ্য হবে। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে, মুসলিম উম্মাহ্‌'র উপর কোন খলীফা কর্তৃত্বশীল অবস্থায় নেই, তবে সেক্ষেত্রে মুসলিমদের জন্য শারী'আহ্‌ আইন বাস্তবায়ন করা এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেবার জন্য তাদের উপর একজন খলীফা নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক হবে; ১৩৪২ হিজরীর ২৮ রজব তারিখে (১৯২৪ সালে ৩ মার্চ) ইস্তাম্বুলে খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবার পর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় মুসলিমদের প্রতিটি ভূমিই খলীফা নিয়োগ দেবার জন্য উপযুক্ত, যে খলীফার উপর খিলাফত রাষ্ট্রের গুরুভার অর্পণ করা হবে। সুতরাং, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কোন একটি দেশের জনগণ যদি কাউকে খলীফা হিসেবে বাই'আত দেয় এবং তার উপর খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, তাহলে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর উপর উক্ত খলীফাকে আনুগত্যের বাই'আত দেয়া ফরয হয়ে যাবে, অর্থাৎ তার শাসন-কর্তৃত্বকে পরিপূর্ণভাবে স্বীকার করে নিতে হবে। তবে, এটি শুধুমাত্র উক্ত খলীফাকে তার নিজ ভূমির জনগণ বাই'আতের মাধ্যমে তার উপর খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করার পরেই কার্যকরী হবে। যাই হোক, উক্ত রাষ্ট্রকে (যে রাষ্ট্রে খলীফা নিয়োগ করা হবে) নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে:

১. উক্ত রাষ্ট্রের শাসন-কর্তৃত্ব অবশ্যই মুসলিমদের হাতে থাকতে হবে। এ শাসন-কর্তৃত্ব কোন কাফির-মুশরিক
রাষ্ট্র কিংবা শক্তির অধীনস্থ হতে পারবে না।

২. উক্ত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ইসলামের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে অর্থাৎ দেশের আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নিরাপত্তা অন্য সবকিছু ব্যাতীত শুধুমাত্র ইসলামের নামে হতে হবে এবং তা ইসলামী (মুসলিম) সেনাবাহিনীর হাতে থাকতে হবে।

৩. উক্ত রাষ্ট্রে ইসলামকে তাৎক্ষণিক, পূর্ণাঙ্গ এবং মৌলিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ইসলামের দাওয়াতী কার্যক্রমের সাথে খলীফাকে যুক্ত থাকতে হবে।

৪. খলীফাকে অবশ্যই নিয়োগের সকল আবশ্যিক শর্ত পূরণ করতে হবে, যদিও পছন্দনীয় শর্তসমূহ (preferred condition) পূরণ না করলেও চলবে।

যদি কোন রাষ্ট্র এ চারটি শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয় তাহলে শুধুমাত্র তাদের বাই'আতের মাধ্যমেই খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তাদের মাধ্যমেই খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজটি সম্পন্ন হবে। সেইসাথে, তাদের নির্বাচিত খলীফা হবেন উম্মাহ্‌'র বৈধ খলীফা এবং এ অবস্থায় তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বাই'আত প্রদান করা শরী'আহ্‌ সম্মত হবে না।

এরপর যদি অন্য কোন রাষ্ট্র কাউকে খলীফা হিসাবে বাই'আত দেয় তবে তা বাতিল বলে বিবেচিত হবে। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

"যদি দুই জন খলীফাকে বাই'আত দেয়া হয় তাহলে পরের জনকে হত্যা কর।" (সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৫৩)

"প্রথমজনের বাই'আত সম্পূর্ণ কর, তারপরও প্রথমজনের।" (সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস নং-৩৪৫৫)

"যে ব্যক্তি কোন ইমামকে বাই'আত প্রদান করল, সে যেন তাকে নিজ হাতের কর্তৃত্ব ও স্বীয় অন্তরের ফল (অর্থাৎ সব কিছু) দিয়ে দিল। এরপর তার উচিত উক্ত ইমামের আনুগত্য করা। যদি অন্য কেউ এসে (প্রথম নিযুক্ত) খলীফার সাথে (ক্ষমতার ব্যাপারে) বিবাদে লিপ্ত হয়, তাহলে দ্বিতীয় জনের গর্দান উড়িয়ে দাও।" (সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৪৪)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন