বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২

খলীফা


(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেম শাইখ আতা ইবনু খলীল আল-রাশতা কর্তৃক লিখিত আজহিজাতু দাওলিাতিল খিলাফাহ - ফিল হুকমি ওয়াল ইদারাহবইটির বাংলা অনুবাদ এর একাংশ হতে গৃহীত)

খলীফা হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি শাসন, কর্তৃত্ব এবং শারী'আহ্'র বিধি-বিধান সমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ্'র প্রতিনিধিত্ব করেন। ইসলাম এটি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, শাসন ও কর্তৃত থাকবে উম্মাহ্'র অধিকারে।

এজন্যই উম্মাহ্ শাসনকার্য পরিচালনা ও তাদের উপর শারী'আহ্'র হুকুম-আহ্কাম সমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার পক্ষ হতে একজনকে নিযুক্ত করে। বস্তুতঃ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা প্রতিটি শারী'আহ্ আইন বাস্তবায়ন করা উম্মাহ্'র জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। যেহেতু খলীফা মুসলিমদের দ্বারা নির্বাচিত হন, সেহেতু স্বভাবতই তাকে শাসন, কর্তৃত্ব ও শারী'আহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উম্মাহ্'র প্রতিনিধি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং, কোন ব্যক্তিই ততক্ষণ পর্যন্ত খলীফা হতে পারবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি উম্মাহ্'র কাছ থেকে বাই'আত প্রাপ্ত হবেন; কারণ, মূলতঃ শাসন, কর্তৃত্ব ও শারী'আহ্ আইনসমূহ বাস্তবায়ন করা উম্মাহ্'র এখতিয়ারে। প্রকৃতঅর্থে, একজন ব্যক্তিকে খলীফা হিসাবে বাই'আত দিয়েই মুসলিম উম্মাহ্ কার্যকরীভাবে তাকে উম্মাহ্'র প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত করে। আর, এই বাই'আতের মাধ্যমেই তার উপর খিলাফত রাষ্ট্রের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, খলীফাকে (উম্মাহ্'র উপর) কর্তৃত্বশীল করা হয় এবং সর্বোপরি, উম্মাহ্কে তার আনুগত্য করতে বাধ্য করা হয়।

বস্তুতঃ যিনি মুসলিমদের শাসন করবেন, তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত খলীফা হতে পারবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না উম্মাহ্'র মধ্য হতে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ (আহ্লুল হাল্লি ওয়াল আকদ্) স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে বাই'আত প্রদান করেন। খলীফা হিসেবে নিয়োগ পাবার জন্য তাকে অবশ্যই বাধ্যতামূলক কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে এবং তারপর তাকে শারী'আহ বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হতে হবে।

পদবি

খলীফার পদবি হতে পারে খলীফা অথবা 'ইমাম' কিংবা 'আমীর উল মু'মিনীন (বিশ্বাসীদের নেতা)। এই পদবিসমূহ সহীহ্ হাদীস এবং ইজ্মা আস্ সাহাবা (রা) থেকে পাওয়া যায়। খোলাফায়ে রাশেদীনদের (প্রথম চার খলীফা) এইসব পদবী দেয়া হয়েছিল। আবু সা'ঈদ আল খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

"যদি দুই জন খলীফাকে আনুগত্যের শপথ দেয়া হয়, তাহলে তাদের মধ্যে পরের জনকে হত্যা কর।" (সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং- ১৮৪২)

আবদুল্লাহ্ বিন আমর বিন আল আস্ (রা) থেকে হতে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

"যখন একজন ইমামের হাতে বাই'আত গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়ে যায় তখন তাকে যথাসাধ্য মান্য করবে..." (সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৪৪)

আউফ ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, "রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

"তোমাদের ইমামদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে তারা যারা তোমাদেরকে ভালবাসে এবং তোমরা তাদেরকে ভালবাসো এবং যারা তোমাদের জন্য প্রার্থনা করে এবং তোমরা যাদের জন্য প্রার্থনা কর;... " (সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-৪৭৮২)

এসব হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, ইসলামের নিয়ম অনুসারে শাসকদের পদবি হল খলীফা অথবা ইমাম।

"আমীর উল মু'মিনীন" উপাধির ব্যাপারে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য হাদীসটি এসেছে শিহাব আল জুহরী'র বর্ণনা থেকে। এ হাদীসটি আল-হাকিম তার মুসতাদরাক গ্রন্থে (খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৭৩, হাদীস নং-৪৪৮০) উল্লেখ করেছেন এবং আল-জাহাবী (তালখিস গ্রন্থে) এটিকে সহীহ্ হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। একই বিষয়ে আল-তাবারাণীর একটি বর্ণনা পাওয়া যায় যেটি সম্পর্কে আল-হাইছামী বলেছেন, এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আল-হাকিম হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে :"ইবনে শিহাব বর্ণনা করেছেন যে, উমর ইবন আব্দুল আজিজ, আবু বকর ইবন সুলাইমান ইবন আবি হাইছামাকে জিজ্ঞেস করেন যে, "কে প্রথম আমীর উল মু'মিনীন উপাধি লিখতে আরম্ভ করেন? তিনি বলেন, "আশ-শিফা', যিনি নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম হিজরতকারী ছিলেন, আমাকে বললেন যে, উমর ইবন আল-খাত্তাব (রা) ইরাকের গভর্ণরকে পত্র মারফত দু'জন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিকে পাঠানোর আদেশ দিলেন যেন তিনি (রা) তাদের কাছ থেকে ইরাক এবং সেখানকার জনগণ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পারেন। তিনি (ইরাকের গভর্ণর) লাবিদ ইবন রাবিয়াহ্ এবং আদি ইবন হাতিমকে তাঁর কাছে পাঠালেন।

মদিনায় এসে পৌঁছানোর পর তারা তাদের উটগুলোকে (মদিনার) মসজিদ প্রাঙ্গনে থামালেন এবং মসজিদের ভেতর প্রবেশ করলেন। হঠাৎ তারা আমর ইবন আল-আসকে দেখলেন এবং বললেন, "হে আমর! আমীর উল মু'মিনীনের সাথে আমাদের সাক্ষাতের অনুমতির ব্যবস্থা করে দাও!" আমর বললেন, "আল্লাহ'র কসম, তোমরা তাঁকে সঠিক নামেই ডেকেছো। তিনি হচ্ছেন আমাদের আমির, আর আমরা হচ্ছি বিশ্বাসী (মু'মিনীন)।" তারপর আমর লাফিয়ে উঠে উমর, আমির উল মু'মিনীনের কক্ষে প্রবেশ করলেন এবং বললেন, "আস্সালামু আলাইকুম, হে আমীর উল মু'মিনীন (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে বিশ্বাসীদের আমীর)। উমর (রা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার মাথায় এ উপাধি কিভাবে আসলো, হে আমর? আল্লাহ্'র কসম, তুমি যা বলেছো (এটা যে ঠিক) তা তোমাকে প্রমাণ করতে হবে।" তখন তিনি (আমর) বললেন, "লাবিদ ইবন রাবিয়াহ্ এবং আদি ইবন হাতিম মদিনায় এসে পৌঁছেছে এবং তারা তাদের উটগুলো মসজিদ প্রাঙ্গনে বেঁধে রেখে আমাকে বলেছে, "হে আমর! আমীর উল মু'মিনীদের সাথে আমাদের সাক্ষাতের অনুমতির ব্যবস্থা করে দাও। আল্লাহ্'র কসম! তারা আপনাকে সঠিক উপাধিই দিয়েছে। কারণ, আমরা হলাম বিশ্বাসী (মু'মিনীন) আর আপনি হলেন আমাদের আমীর (নেতা)।" তারপর থেকেই তারা তাদের লেখনীতে আমীর উল মু'মিনীন উপাধি ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন।" আশ-শিফা (রা) ছিলেন আবু বকর ইবন সুলাইমানের নানী। এরপর থেকে উমর (রা) এর পরের খলীফাদেরও মুসলিমরা এই উপাধিতে সম্বোধন করতে আরম্ভ করে।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন