শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২

আমরা কি এই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম?

আবার এসেছে বিজয়ের মাস। চারিদিকে শুধু স্বাধীনতা স্বাধীনতা রব। কেউ বা হাজির হয়েছে স্বাধীনতার সোল এজেন্ট এর দাবি নিয়ে। কেউ বা উপস্থিত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষকের দাবি নিয়ে। এদিকে আবার ডাক দেওয়া হয়েছে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের। “এবারের সংগ্রাম যুদ্ধপরাধিদের বিচারের সংগ্রাম।” “এবারের সংগ্রাম রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম”। তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার করে জাতিকে আরেকটি স্বাধীনতা এনে দিতে চায়। এর আগে আমরা ৪৭ এ পেয়েছিয়াম একবার স্বাধীনতা। এরপর ৭১ এ, এখন ১২ তে, এরপর আবার কবে?

আসলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক আর বিজয় ঘোষণা অনির্দিষ্ট কালের জন্য চলতেই থাকবে যতদিন না আমরা স্বাধীনতা শব্দের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারব। স্বাধীনতার বণিকেরা আমাদের কাছে স্বাধীনতা শব্দটা একটা আবেগীয় শ্লোগান হিসাবে উপস্থাপন করেছে এবং করেই চলছে। আমাদেরকে বুঝতে দেই নি স্বাধীনতার প্রকৃত মর্মার্থ কি। কারণ স্বাধীনতার অর্থ আমরা যদি একবার বুঝে ফেলি তবে এই স্বাধীনতার বণিকদের বাণিজ্যে যে চরম ভাটা পরবে। স্বাধীনতা ব্যবসা এমন এক ব্যবসা যেখানে পুজি অন্যের, শ্রম অন্যের কিন্তু লাভ পুরোটাই নিজের। আমাদেরকে অন্যের বাণিজ্যের পুজি হিসাবে খাটানো হতেই থাকবে যদি আমরা না বুঝি এই স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ কি।

প্রকৃত অর্থে ১৭৫৭ সালে আমাদের স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছে তা আর কখনো উদিত হয় নি। এর পরে যা হয়েছে তা নতুন বোতলে পুরানো মদ। ১৭৫৭ ব্রিটিশ বেনিয়ারা আমাদেরকে যে তাদের কলোনিতে পরিণত করেছিল আজ অবধি আমরা তাদের কলোনিই রয়ে গেলাম। তবে হ্যা, সে কলোনির অনেক আধুনিকায়ন হয়েছে, প্রযুক্তিকায়ন হয়েছে। আগে কলোনি করতে বিরাট একটা এলাকার দরকার হতো আর এখন এত বড় জায়গার দরকার হয় না। শহরের কেন্দ্রস্থলে কূটনৈতিক পাড়ায় একটা বড়সড় বাড়িই যথেষ্ট। আমাদের পূর্ব প্রজন্ম কলোনির অধিবাসীদের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাত। আর নতুন প্রজন্ম এই কলোনির অধিবাসীদের একটি সাক্ষাতের জন্য সারা রাত লাইনে দাড়িয়ে থাকতে রাজি। আমাদের আগের প্রজন্মের মাতব্বরেরা কলোনির আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন অনেকটা বাধ্য ও নিরুপায় হয়ে। আর আমাদের বর্তমান প্রজন্মের মোড়লেরা এই কলোনিতে একটি চায়ের দাওয়াত পেলে নিজকে ধন্য মনে করে। আগের প্রজন্মে যেমন ছিল মীর জাফর তেমনি ছিল সিরাজুদ্দৌলা। বর্তমান প্রজন্মে আছে শুধুই মীর জাফর আর মীর জাফর। এখানে সিরাজুদ্দৌলার দেখা মেলা ভার! আগের প্রজন্মের মীর জাফরেরা ছিল ঘৃণিত। আর বর্তমান প্রজন্মের মীর জাফরেরা চরম শ্রদ্ধেয়। তাই বলতে হচ্ছে আমরা ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করি নি। বরং দিনে দিনে আমাদের পরাধীনতার শেকল আরও মজবুত হয়েছে, আরও গভীর হয়েছে। আমাদের উন্নতি শুধু এটাই যে, আগে আমরা মিথ্যা স্বাধীনতার দাবি করতাম না, কিন্তু এখন করি।

সময়ের ব্যবধানে আমাদের দাসত্ব ও গোলামী নতুন রুপ ধারণ করেছে। আগে পশ্চিমারা সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আসত আমাদের শাসন-শোষণ করতে, কিন্তু এখন তাদের কে আর আমাদের কাছে সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আসতে হয় না। প্রকৃত পক্ষে তারা তখনই এদেশ ত্যাগ করেছে যখন তারা বুঝতে পেরেছিল যে, আমাদেরকে শাসন করতে তাদের আর এখানে সশরীরে থাকার দরকার নেই। আমরা অনেকেই তাদেরকে বিতাড়িত করার গৌরবে গর্বিত কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাদেরকে আমরা বিতাড়িত করি নি, তারা নিজেরাই চলে গিয়েছিল। লন্ডন নিউইয়র্ক এ বসেই আমাদের মাথার উপর ছড়ি ঘোরানোর ব্যবস্থা তারা ইতিমধ্যে করে নিয়েছে। আমাদের কে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তারা যে সমস্ত কৌশল নিয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাঁচটি নিচে আলোচনা করা হলঃ

১। তারা শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে এমন এক প্রজন্ম তৈরি করেছিল যারা দেখতে হবে দেশীয় কিন্তু কর্ম ও চিন্তায় হবে ইউরোপীয়। তাদের নাম হবে মুসলিম কিন্তু চিন্তাধারা হবে ধর্মনিরপেক্ষ। তারা দেশপ্রেমের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে কিন্তু তাদের অন্তরে থাকবে পশ্চিমা প্রীতি। তাদের চিন্তায় যারা একমত হবে না তাদেরকে তারা নানাভাবে মূর্খ, গেয়ো, সেকেলে, মধ্যযুগীয় আর ধর্মান্ধ বলে অন্যের সামনে উপস্থাপন করবে। অপরদিকে এদেরকে সরকারের বড় বড় পোস্টে বসিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বানিয়ে দেওয়া হল। ফলে অন্যরা দেখল, আরে এ পথেই তো দেখছি সাফল্য। ফলে কে কার চেয়ে বেশি শিক্ষিত একা অধিকতর পশ্চিমী সেই প্রমাণে প্রতিযোগীতায় নেমে পড়লো। বর্তমানে এই শিক্ষা ব্যবস্থার বিবর্তন হয়েছে। এখন পশ্চিমারা দেশ ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু রেখে গেছে তাদের গোলামি’র শিক্ষা ব্যবস্থা। আর শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে গেছে, তাদের তৈরি করা কিছু গোলামদের হাতে। লেটেস্ট আপডেটঃ আগে পশ্চিমারা এদেশে আসত গোলাম তৈরি করতে, আর এখন গোলামরা পশ্চিমে যায় গোলামতর, গোলামতম হতে। আগে গোলামদের অনেক মূল্যায়ন ছিল, কিন্তু এখন নেই। এখন মূল্যায়ন পেতে হলে গোলামতর অথবা গোলামতম হতে হয়।

২। তারা দেখল শুধু শিক্ষা বাবস্থা দিয়ে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে নাতাই তারা নতুন আরেকটা ব্রেন ওয়াশিং মেশিন আবিষ্কার করল- মিডিয়া। তারা একটা জিনিস বুঝতে পারল, ছাপার অক্ষরে যাই প্রকাশ করা হয় অধিকাংশ মানুষ যাচাই বাচাই না করেই তা বিশ্বাস করে। তাই তারা একটার পরে একটা মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করল। তারা আরও একটি বিষয় উপলব্ধি করল, জনগণের ভিন্ন মতের প্রতি একটা প্রাকৃতিক আকর্ষণ রয়েছে। তাই তারা অনেকগুল পত্রিকা খুলে বসল আর একেকটা থেকে একেক রকম মত প্রকাশ করতে শুরু করলো। আর জনগণ মনে করল আমাদের মিডিয়া স্বাধীন এবং নিরেপেক্ষ ভাবে সংবাদ প্রকাশ করে চলেছে। কিন্তু জনগণ এই মিডিয়া সিন্ডিকেটের বাহিরে যেতে পারল না। তারা হয়ে রইল নিয়ন্ত্রিত বিরোধী মতাদর্শী। বর্তমান অবস্থাঃ রইটারস, এপি, এএফপি, বিবিসি, সিএনএন শুধু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই নিয়ন্ত্রণ করে না, এরাই তৈরি করে স্থানীয় মিডিয়ার নীতিমালা কি হবে। আমাদের দেশীয় মিডিয়া নামেই স্বাধীন, আসলে তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়া চক্রের গোলামি করে চলেছে।

৩। ব্রিটিশরা জানত তারা এখানে চিরদিন থাকবে না। তাদের হাতে তৈরি গোলামদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একদিন চলে যাবে। তাদের পোষা গোলাম আর দালালরাই যেন চিরদিন আমাদের দেশের শাসন ক্ষমতায় থাকে সে জন্য তারা আমাদের এখানে গণতন্ত্রের বাজারজাতকরণ করল। আমাদের কে শেখাল ‘গণতন্ত্রের কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও এটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য শাসন ব্যবস্থা’। এর কারন হিসাবে বলা হল, এটা নাকি জনগণের শাসন। এতে জনগণই নিজের ভাগ্যের নিজেই বিধাতা! কি চমৎকার কথা! কিন্তু আসলে কি গণতন্ত্র জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে? নাকি ব্রিটিশ আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করে? কি করে এটা মনে করা যায় যে, এই চরম সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, ব্রিটেন আমাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করবে? আজও আমেরিকা দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস ভাবে বোমা মেরে চলেছে। হয় গণতন্ত্র না হয় বুলেট! কেন আমেরিকা তৃতীয় বিশ্বের জনগণের গণতন্ত্রের অধিকার আদায়ের জন্য এত বুলেট বোমা মেরে চলেছে? কোন সুস্থ বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এটা মেনে নিতে পারে না যে, আমেরিকা যে গণতন্ত্রের জন্য বোমা ফেলতেছে সে গণতন্ত্রে আমাদের কোন স্বার্থ নিহিত আছে।

প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, যে ব্রিটিশরা আমাদের দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ছিল তারা কি নিজেরা আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক ভাবে দখল করেছিল? তারা কি কোন গণভোটের আয়োজন করেছিল যেখানে আমরা মত দিয়েছিলাম আমাদের দেশকে তারা কলোনি করতে পারবে এই মর্মে? নিশ্চয় তারা এমনটি করে নি। তারা এসেছিল বণিকের ছদ্দাবরণে। নানা কূট কৌশল এবং সর্বশেষ মীরজাফরদের সহযোগিতায় যুদ্ধ করে আমাদের কে তাদের কলোনিতে পরিণত করেছিলএই ব্রিটিশরাই আবার আমাদেরকে গণতান্ত্রিক অধিকার শেখাল। কি চমৎকার ভণ্ডামি!

ব্রিটিশরা আমাদের দেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের কলোনি শাসন কে চিরস্থায়ী করতে। তার প্রমাণ দেশে দেশে সময়ে সময়ে তাদের আচরণ দেখলে সহজেই বোঝা যায়। ইরানের গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিল মোহাম্মাদ মোসাদ্দেক। তিনি দেখলেন ইরানের তেল সম্পদের সিংহভাগ ব্রিটিশ কোম্পানি বিপি নিয়ে যাচ্ছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এই তেল সম্পদ দিয়ে ইরানের জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করবেন। তিনি সব তেল ক্ষেত্রকে জাতীয়করণ করলেনকিন্তু এতে খেপে গেল ব্রিটিশ সরকার। নালিস করল আমেরিকার কাছে। আমেরিকা CIA কে নিয়োজিত করল মোসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য। CIA খুজে বের করল দালাল রেজা শাহ পাহলভিকে। তাকে দিয়ে উৎখাত করল গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীকে। এরপর স্বৈরশাসক রেজা শাহ ইরানের তেল ক্ষেত্র গুলোকে আবার তুলে দিল ব্রিটিশ-আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী তেল কোম্পানিগুলোর হাতে। অতএব গণতন্ত্র ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণের শাসন বলে বিবেচিত হবে যতক্ষণ পর্যন্ত ‘জনগণের শাসক’ ব্রিটিশ আমেরিকার গোলামী ও দালালী করবে।

অপরদিকে কোন দেশের অগণতান্ত্রিক শাসক যদি পশ্চিমাদের গোলামী করে, ফ্রিতে তেল বিক্রি করে তবে গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের কোনই সমস্যা নেই। নতুবা তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অবরোধ এমনকি যুদ্ধ পর্যন্ত ঘোষণা করবে। যেমন করেছে আফগানিস্থান ও ইরাকে। তালেবান শাসিত আফগানিস্থান ও আল সৌদ শাসিত সৌদি আরব- উভয় জায়গাতেই গণতন্ত্র অনুপস্থিত। এবং উভয় জায়গাতেই শরিয়া আইন চালু ছিল। তারা তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে করে নাই কেন? কারন সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের মধ্যে তাদের এক নম্বর দালাল। তাদের দালালী করলে সব জায়েজ, আর না করলে গন্ত্রতন্ত্রের জন্য আহাজারি! প্রকৃত পক্ষে সৌদি আরব সহ অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলতে গণতন্ত্র না থাকার জন্য আমেরিকাই দায়ি। ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য দখল করে নেয় এবং পরে সেগুলোকে টুকরো টুকরো করে এক একজন দালালের কাছে হস্তান্তর করে। পরে যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসান হয় এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শুরু হয় তখন থেকে আমেরিকা এদেরকে অস্ত্রসস্ত্র টাকা পয়সা দিয়ে লালন পালন করে আসছে। এই মুহূর্তে সৌদি আরবে ১৫ হাজারেরও বেশি আমেরিকান সৈন্য আছে আল সৌদ (সৌদি রাজপরিবার)  এর নিরাপত্তার জন্য। সৌদি আরবের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতেছে আমেরিকা! তাহলে বুঝুন, এদের প্রীতিটা কোথায়? যেখানকার জনগণকে যে বড়ি খাওয়াইলে কাজ হয় এরা সেখানে সে বড়িই খাওয়ায়। আমাদের কে খাওয়াইছে গণতন্ত্রের বড়ি, আরবদের খাওয়াইছে রাজতন্ত্র/স্বৈরতন্ত্রের বড়ি। মধ্য প্রাচ্যে গণতন্ত্র থাকলে আমেরিকা কোনও সুবিধা করতে পারত না। অন্য সব দিক বাদ দিয়ে একটা বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যায় যে আমেরিকা কোন দিনই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্র প্রধানের কাছ থেকে ইসরাইলের স্বীকৃতি আদায় করতে পারত না। কারণ আরবদের ৯৯ শতাংশই ইসায়েলের বিরোধী। একারণে হোসনি মোবারক, বেন আলি আর আলি আব্দুল্লাহ সালেহের এর মত অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের সাথে এদের কোনই সমস্যা ছিল না। যত সমস্যা গাদ্দাফি, মোল্লা ওমর আর সাদ্দাম হোসেনের সাথে।

তাদের অন্যতম পলিসি হল, divide and rule. গণতন্ত্র দেশের মানুষকে খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করে ফেলে। আজকে আমার দেশের ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, ছাত্র, ব্যবসায়ী, হকার, ওলামা, কাজের বুয়া, রিক্সা চালক, পতিতা থেকে শুরু করে গ্রামের কৃষক, রাখাল, জেলেরা পর্যন্ত বিভক্ত। একজন আরেকজনের বিরোধীতা করে শুধুমাত্র অন্য দল করার কারণে। এভাবে দেশের প্রতিটা সম্প্রদায় যদি বিভক্ত থাকে তাহলে সে দেশ কি করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাড়াতে পারবে? এই জন্য আমাদের শাসক গোষ্ঠী এতই দুর্বল যে তারা সবসময় অপেক্ষায় থাকে কখন ‘রাষ্ট্রদূতের’ বাসায় এক কাপ চায়ের দাওয়াত আসবে। অবস্থা দেখলে মনে হয় যেন এদের এক কাপ চা কিনে খাওয়ার সামর্থ্যও নেই! আশা করি এতক্ষণে বুঝেছেন কেন ওরা গণতন্ত্রের জন্য এত মায়া কান্না করে। কেন ওরা বুলেট দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে বেড়ায় দেশে দেশে?

আর আদর্শ গণতন্ত্র বলে কোথাও কিছু নেই। অনেকে আমেরিকার গণতন্ত্রের উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গণতন্ত্র হল আমেরিকার গণতন্ত্র। আমেরিকাতে যা চলে সেটা গণতন্ত্র নয়, তা হচ্ছে Oligarchy (সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একদল ক্ষুদ্র ইহুদী গোষ্ঠীর শাসন)।

৪। ১৬শ, ১৭শ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা সমগ্র পৃথিবীকে কলোনিতে পরিণত করে। এরপর তারা কলোনি বিশ্বে এক অদ্ভুত জিনিস চালু করে। এর নাম হচ্ছে কাগুজের টাকা। তারা প্রথমে কাগুজে মুদ্রা চালু করেছিল, স্বর্ণ বা রোপ্যের বিনিময়ে রশিদ হিসাবে। তবে তাদের মনের মধ্যে লুকায়িত ছিল অসৎ চিন্তা। তারা প্রথমে স্বর্ণের দ্বিগুণ কাগজের টাকা ছাপায়। পরে তিনগুন, চারগুন এভাবে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে প্রকৃত স্বর্ণ আর কাগজের রশিদের মধ্যকার ব্যবধান। বর্তমানে তারা স্বর্ণ এবং কাগজের টাকার মধ্যে সকল সম্পর্কের আবসান ঘটিয়েছে।

চিন্তা করে দেখুন, আমেরিকা ভুয়া ডলার ছাপায়ে আমার দেশের ভেতর যেকোন যায়গা থেকে যা কিছু খুশি কিনতে পারে। কিন্তু আমি আপনি যদি এক বস্তা বাংলাদেশী টাকা নিয়ে নিউইয়র্কে যান তবে তা দিয়ে কি এক কাপ কফিও কিনতে পারবেন? পারবেন না। স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসীদের কাছে আমার প্রশ্ন, একটি দেশের মুদ্রা সে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতীক। তাহলে ভিন্ন একটি দেশের মুদ্রা কেন আজ আমার দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে? এতে কি তোমার স্বাধীনতার চেতনায় কোন আঘাত লাগে না? নাকি আমেরিকার গোলামির মধ্যেই তোমার স্বাধীনতার স্বার্থকতা?

৫। তোমার কথা বলার ধরণ, তোমার পোশাকের ধরণ, তোমার আচার-আচারন সবকিছুইতেই আছে পশ্চিমের অনুকরণ। তারপরও তুমি দাবি কর নিজেকে স্বাধীন জাতি হিসাবে। তোমার জীবনের শুরুতে যে জন্মদিন তুমি পালন কর এটাও এসেছে পশ্চিমা জাতির সংস্কৃতি থেকে। কিন্তু এতে তোমার স্বাধীনতার চেতনায় একটুও আঘাত লাগে না। কারন এটা এসেছে যে তোমার প্রভুর নিকট থেকে! তুমি যে বাংলিশ কথা বল এটা তোমার স্বাধীনতার চেতনায় আঘাত করে না। বরং এতেই তোমার স্বাধীনতা বিকশিত হয়। তুমি পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরে তোমার স্বাধীনতার চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাও কিন্তু তোমার পূর্ব পুরুষদের পোশাক যারা পরে তাদেরকে তুমি আনকালচারড বল। তুমি পশ্চিম থেকে আমদানি করেছ টি শার্ট, ব্লু জিন্স আর মিনি স্কাট। এতে তোমার স্বাধীনতার চেতনায় কোনই ব্যঘাত ঘটে নি।

তুমি যখন খুশি যার সাথে খুশী যেখানে খুশি মেতে উঠবা আদিম উন্মত্ততাই, এটাই তোমার কাছে স্বাধীনতার সংজ্ঞা। ভাল, তুমি যদি এভাবেই স্বাধীনতাকে সংজ্ঞায়িত করতে চাও তবে করতে পারো, আমার কোনই আপত্তি নেই। কিন্তু আমার আপত্তিটা হয় তখনই যখন তোমার এই স্বাধীনতা আরেক জনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তোমার স্বাধীনতাকে তুলনা করা যায় ট্রেনের বগির সাথে। ট্রেনের বগি সবসময় ইঞ্জিনকে অনুসরন করে। ইহা সেই গতিতে যেতে পারে ইঞ্জিন ইহাকে যেই গতিতে যেতে অনুমতি দেয়। ইহার পক্ষে কখনই সম্ভব হয় না ইঞ্জিনের আগে যেতে। তোমার ইঞ্জিন হচ্ছে তোমার প্রভু পশ্চিমা বিশ্ব। বিশ বছর আগে ওরা যা করত এখন তুমি তাই কর। ওরা এখন যা করে তুমি বিশ বছর পরে তাই করবে। ওরা বিশ বছর আগে সমকামিতা অবৈধ বলত, তুমি এখন অবৈধ বল। ওরা এখন সমকামিতাকে বৈধতা দিয়েছে, তুমিও দিবা আজ থেকে বিশ বছর পরে। আসলে তোমার কাছে স্বাধীনতা মানে পশ্চিমের গোলামী।

কিন্তু আমার কাছে স্বাধীনতা মানে, কারও গোলামি করা নয়। কারো অন্ধ অনুকরণের মধ্যে আমি কোন স্বাধীনতা খুজে পাই না। স্বাধীনতা হতে হবে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পাখির মত যার কিনা হাজার মাইল পারি দিতে কোন ইমিগ্রেশন এর সম্মুখীন হতে হয় না। স্বাধীনতা মানে যখন যেখানে খুশি মুক্ত ভাবে বিচরণের স্বাধীনতা। তোমাকে স্বাধীনতার বণিকেরা পুকুরে ছেড়ে দিয়েছে সাতারের জন্য আর তুমি হাত পা আছড়িয়ে নিজেকে স্বাধীন মনে করছো। কিন্তু আমার কাছে স্বাধীনতা মানে অসীম সাগরের বুকে হারিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতাএই স্বাধীনতা বণিকেরা এই মুক্ত পৃথিবীকে ছোট ছোট কারাগারে পরিণত করেছে আর তোমাকে দিয়েছে সেই কারাগারে যেমন ইচ্ছা তেমন চলার স্বাধীনতা। ওরা আজ কেড়ে নিয়েছে আমার পবিত্র বায়তুল্লাহ ভ্রমনের আল্লাহ প্রদত্ত স্বাধীনতা টুকুও। সেখানে যেতেও আজ আমাকে ওই দালাদের মর্জির উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু আমি চাই এমন স্বাধীনতা যে স্বাধীনতার বলে আমি পূর্ব দিগন্ত থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত পাখির মত বাধাহীন মুক্ত বিচরণ করতে পারবো।

তাই আসুন আরেকবার একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ঝাপিয়ে পড়ি যে যুদ্ধ আমাকে এনে দিবে এমন এক স্বাধীন রাষ্ট্র যেখানে থাকবে না কোন ক্ষুদ্র ভাষা বা ভূখণ্ডের উপর ভিত্তি করে কোন বিভেদ। যে পৃথিবীতে আমার ভ্রমণ করতে লাগবে না কোন ভিসা বা পাসপোর্ট। যেখানে একাকি মুসলিম রমণী সানা থেকে হাদ’রা মাওত পর্যন্ত হেটে যাবে কিন্তু কোন জন কটূ কথা বলবে না তারে। থাকবে না কোন জাতিসংঙ্ঘ নামের কোন ভণ্ডসঙ্ঘ। যে পৃথিবীতে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানেরা ইহুদি খ্রিস্টানের চায়ের দাওয়াতে যেতে লাগাবে না কোন হরোহুরি। ইহুদি খ্রিস্টানের থাকবে মুসলিমদের কাছে জিম্মি হিসাবে, আর মুসলিমরাও তাদের নিরাপত্তা বিধান করবে।

আমাদের সেই স্বাধীন রাষ্ট্র হবে পশ্চিমে স্পেন থেকে পূর্বে মায়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত। মুসলিমরা হবে এক জাতি, এক রাষ্ট্র। তারা একজন খলিফার অধিনে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। মুসলিমদের পবিত্রভুমিতে থাকবে না কোন ইহুদি বসতি। যে রাষ্ট্রে ইহুদি খ্রিস্টানেরা সামরিক পোশাক তো দূরের কথা, গলা উঁচিয়ে কথা বলার সাহসও পাবে না। যেখানে থাকবে শুধুই এক আল্লাহ’র শ্রেষ্টত্ব। শিল্পীর কথায় সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে সে রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট।

“একাকি রমণী নির্জন পথে যাবে, কোন জন কটু কথা কবে না
কোন দিন পথে ঘাটে সম্পদের মোহে, খুন আর রাহাজানি রবে না।”

আবু সামির
সংগৃহীতঃ

বি দ্রঃ উপরোক্ত প্রবন্ধটির বক্তব্য লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পর্কিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন