রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয়

খিলাফাহ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ

আফগানিস্তানে মার্কিন আক্রমণ যুদ্ধ না, আগ্রাসন - এ বিষয়ে এখন আর কোনও সন্দেহ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ও যৌথ বাহিনীর প্রধানের পদচ্যূতকরণ এবং আফগান যুদ্ধ ও কলাকৌশল সম্পর্কিত প্রায় ৯২,০০০ তথ্যপ্রমাণ সম্বলিত দলিল ফাঁস হওয়ায় মুসলিম অধ্যুষিত দেশটিতে মার্কিন আগ্রাসনের প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর বর্তমান অবস্থা এটাকে ভিয়েতনামের পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কানাডার সাবেক প্রতিরক্ষা প্রধান রিক হিলারের মন্তব্য এখানে অপ্রাসঙ্গিক নয় - আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনী এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যার তুলনা করা যায় মৃতদেহের সাথে, যাতে দিন দিন পচন ধরছে। শুরুর দিকে আফগান যুদ্ধ রহস্যে ঘেরা থাকলেও ন্যাটো বাহিনীর মিথ্যে আশ্বাস ও একে একে আফগান যোদ্ধাদের কাছে তাদের প্রাণ হারানোর ঘটনা পুরো আফগানিস্তানকে ন্যাটো বাহিনীর কবরস্থানে পরিণত করেছে। শুধু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নয়, আফগানিস্তানের ইতিহাসই রচিত হয়েছে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে; যা আফগান মুসলিমদের বিশ্বে পরিচিত করিয়েছে যোদ্ধা জাতি হিসেবে। তালেবানদের নাম করে আফগানিস্তানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপস্থিতি ও পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় নির্দেশ করে।

রহস্যের আবর্তে আফগান যুদ্ধ আফগানিস্তান আক্রমণের পর থেকেই মার্কিন প্রশাসন প্রচারণা চালিয়ে আসছে যে, সেখানে আগ্রাসন চালানো ব্যতীত যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষার দ্বিতীয় কোন উপায় ছিলনা। কিন্তু আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে আসলে আক্রমণের কোনও হুমকি ছিলনা। বরং যুক্তরাষ্ট্র তার হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতেই সেখানে আক্রমণের সূচনা করেছে - বিশ্ববাসীর নিকট আজ এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট।

বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে আল কায়দার নেটওয়ার্ক রয়েছে। এবং আফগানিস্তানে আল কায়দার সদস্য সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। এটাও জানা যায় যে, ৯/১১ এর পরিকল্পনার পুরোটাই গৃহীত হয়েছিল জার্মানীর বনে। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণের হুমকি ছিল, তবু বলতে হবে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলনা। কেননা ভারত প্রশাসন ৫ লাখ সৈন্য নিয়ে কাশ্মির দখল করেও আজ পর্যন্ত কাশ্মিরী জনগোষ্ঠীর ভারতীয় শহরাঞ্চলগুলোতে আক্রমণ ঠেকাতে পারেনি। ফিলিস্তিনে উপর্যুপরি ইসরাইলী আক্রমণ ইসরাইলী জনগোষ্ঠীকে ফিলিস্তিনের আক্রমণের হুমকি হতে নিরাপদ করতে পারেনি। ৩৯ বছর ধরে উত্তর আয়ারল্যান্ডে বৃটেনের মেতায়েনকৃত ২৭ হাজার সেনাও আই.আর.এ (আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি) কে বৃটেন আক্রমণ হতে নিবৃত করতে পারেনি। অনুরূপভাবে বিশ্বকে নিরাপদ করতে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান আক্রমণও আদৌ বিশ্ববাসীকে কোনও নিরাপত্তা দিতে পারেনি। বরং এ সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যার পররাষ্ট্র নীতি হল বছর বছর ফিলিস্তিনে ইসরাইলী গণহত্যাকে সমর্থন দেয়া, নিজ দেশে তেল গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে ইরাকের মত সম্পদশালী একটি দেশকে কবরস্থানে পরিণত করা, মুসলিম দেশগুলোতে সুবিধামত পুতুল সরকার বসিয়ে নিরীহ মুসলিম জনগণের সম্পদ লুটে খাওয়া।

কি ধরনের ঠুনকো মিথ্যে অজুহাতে আফগানিস্তানের লক্ষ লক্ষ নিরীহ মুসলিম নরনারীকে প্রাণ দিতে হচ্ছে, তার উপাখ্যান কিছুটা তুলে না ধরলেই নয়। অক্টোবর ২০০৯ সালে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জেমস জোন্স সি.এন.এন-এ দেয়া সাক্ষাতকারে বলেন, “সুসংবাদ হল, আফগানিস্তানে আল কায়দার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। আমি আশা করিনা যে, তালেবানরা কখনও কোনও হুমকি সৃষ্টি করতে পারবে। আমি আরও স্পষ্ট করে বলতে চাই, আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে আর কোনও ধরনের সমস্যার সম্ভাবনা নেই...। (১)

এখন প্রশ্ন হল:

প্রমত, যদি আফগানিস্তান কোনও হুমকি না হয় তবে কেন এখনও ১ লক্ষ ৯০ হাজার মার্কিন বাহিনী সেখানে মজুদ আছে? আফগানিস্তানে আল কায়েদার সংখ্যা ১০০ এরও কম। তাহলে কেন সেখানে মার্কিন যৌথ বাহিনী আরও বাড়ানো হচ্ছে? এ সামান্য সংখ্যক আল কায়েদা মোকাবেলায় আফগান নিরাপত্তা বাহিনীই কি যথেষ্ট নয়?

দ্বিতীয়ত, বলা হচ্ছে আল কায়েদার অবস্থান আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তে। মার্কিন বাহিনীর অবস্থানও তাহলে সেই সীমান্ত এলাকাতেই হওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে মার্কিন বাহিনী কাবুল, হেরাত ও মাজার-ই-শরীফ অবস্থান নিয়েছে কোন উদ্দেশ্যে?

তৃতীয়ত, যদি তাত্ত্বিকভাবে ধরেও নেয়া হয় যে, মার্কিন যৌথ বাহিনী আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থানরত প্রতিটি আল কায়েদা সদস্যকে পরাস্ত করতে সক্ষম, তবুও এটা তাদের ঘোষিত উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণ করেনা। কারণ এ কথা সর্বজন বিদিত যে, আল কায়েদা শুধু আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে নয়, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্র মিডিয়ার সাহায্যে বিশ্বে প্রচার করছে যে, বিশ্বের বেশিরভাগ সন্ত্রাসীর উৎপত্তিস্থল আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে। কিন্তু বৃটেন সরকারের পরিসংখ্যান ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদন এ ধরনের প্রচারণার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। বৃটেনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হতে ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বৃটেন হতে গ্রেফতারকৃত ১৪২ জন চরমপন্থী কয়েদীর মধ্যে মাত্র ৩ জন ছিল পাকিস্তানী। সেখানে আফগানিস্তানের কেউ ছিলনা।

পঞ্চমত, সারা ল্যাডবারি তার এক গবেষণা মূলক প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন বিশ্বব্যাপী ইসলামের উপর পশ্চিমা আক্রমণ; ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান ও ইরাকে নির্বিচারে নিরীহ মুসলিম হত্যা; আফগানিস্তানের মত বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকারগুলোর ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা, অন্যায়-অবিচার ও জননিরাপত্তা দানে ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে মূলতঃ মুসলিমগণ এর অবসান ঘটাতে মুক্তির পথ হিসেবে তালেবান ও হিজব-ই-ইসলামীর মত দলগুলোতে যোগ দিচ্ছে। (৩)

ষষ্ঠত, ২০০৮ সালে প্রকাশিত র‍্যান্ড কর্পোরেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, মুসলিম জনপদগুলোতে মার্কিন সামরিক অভিযানই প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধির জন্য দায়ী।(৪) যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৬ সালের ৭,০০০ তালেবান সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৪ গুন বেড়ে ২৫ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।(৫) উপরন্তু আফগানিস্তানে আরও সৈন্য সংখ্যা বর্ধিত করণের ঘোষণা মূলত তালেবান সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি ব্যতীত আর কোনও ভাল ফল বয়ে আনবেনা।

যুক্তরাষ্ট্রের মিথ্যা আশ্বাস
বেশ কিছুদিন থেকে যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে আফগানিস্তান থেকে সরে আসার জন্য সেখানে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তাবাহিনী গঠন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই আশ্বাস বাস্তবায়নের নমুনা সত্যিই হাস্যকর। ন্যাটোর হিসাব মতে, ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আফগান ন্যাশনাল আর্মির সংখ্যা হল ৯৪,০০০ এবং পুলিশ ফোর্সসহ এই সংখ্যা সর্বমোট ১ লক্ষ ৯০ হাজার। ২০০৯ সালের আগষ্টে সাবেক মার্কিন এবং ন্যাটো কমান্ডার জেনারেল ম্যাকক্রিস্টাল এ সংখা দ্বিগুন অর্থাৎ ৪ লক্ষ করার সুপারিশ করেছেন।(৬) কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা এই যে, জন কেরি তার এক বক্তৃতায় হতাশার সাথে বলেছেন, প্রায় লাখ খানেকের মত আফগান নিরাপত্তা বাহিনী থাকলেও সেখানে ৫০ হাজারেরও কম সেনা আছে, যারা আমাদের চাহিদা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে পারবে।(৭)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিসেব অনুযায়ী আফগানের ৭৮% পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালনে অক্ষম।(৮) অন্যদিকে আফগান ন্যাশনাল আর্মি দ্বিগুন করতে যুক্তরাষ্ট্রের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও এতে নিয়োগের হার অত্যন্ত হতাশা ব্যঞ্জক; সম্প্রতি তা ৫০% এরও নিচে নেমে এসেছে। আর তাও যে কজন নিয়োগ পাচ্ছে মাদকাসক্তি, অসুস্থতা, আহত ও অঙ্গহানি বিভিন্ন কারণে প্রতিবছর ২৫% আফগান সেনা পেশা থেকে অব্যহতি নিচ্ছে।(৯) ফলে যতই সদস্য বৃদ্ধির পক্ষে সাফাই গাওয়া হোক, আফগান ন্যাশনাল আর্মি দ্বিগুন করাতো দূরের কথা; বর্তমানের লাখ খানেক সৈন্য টিকিয়ে রাখতেই যুক্তরাষ্ট্রকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই একথা আজ বিশ্ববাসীর অজানা নয় যে, আফগান ন্যাশনাল আর্মি শক্তিশালী করে মার্কিন বাহিনীর সেখান থেকে সরে যাবার আশ্বাস সম্পূর্ণ মিথ্যে ও ভিত্তিহীন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কখনই আফগান ন্যাশনাল আর্মি গঠন ছিলনা। বরং তার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানির মত আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর পাকাপোক্ত একটি ঘাঁটি নিশ্চিত করা, যাতে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মত এ অঞ্চলকেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

ন্যাটো বাহিনী নিয়ে মার্কিন মিথ্যাচার
আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালিয়েছে যে, তাকে সমর্থন জানিয়ে ৪৩ টি রাষ্ট্র তাদের সৈন্য দল প্রেরণ করেছে। কারণ ইরাক আগ্রাসনের সময় আন্তর্জাতিক সমর্থন ও বিশ্বব্যাপী বৈধতা যুক্তরাষ্ট্রের ছিলনা। তাই আফগানিস্তান আগ্রাসনে বৈধতার ঘাটতি দূর করতে যুক্তরাষ্ট্রের এই আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হল মাত্র দুটি দেশ সেখানে ৫ হাজারের বেশি সেনা পাঠিয়েছে। আফগানিস্তানে মার্কিন যৌথ বাহিনীর ৭০% হল মার্কিন বাহিনী। সেখানে ৩৪ টি দেশের প্রেরিত সৈন্য সংখ্যা ১,০০০ এর কাছাকাছি বা তার চেয়ে কম। এবং ১০টি দেশের সৈন্য সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য - এমনকি একজন দুজন করে (জর্জিয়া ও আইসল্যান্ড)। এইযুদ্ধে বৃটেনের একার সৈন্য সংখ্যাই ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনের সংখ্যাকে ছাড়িয়েছে। এ যুদ্ধে বৃটেনের হারানো সেনা সদস্যের পরিমাণ ন্যাটো ও ইউরোপের সম্মিলিত সৈন্য সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্বের কোনও রাষ্ট্রই আফগানিস্তানে বৃটেনের এই পরিণতি বরণ করতে রাজি নয়।

এ যুদ্ধে ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি ও স্পেনের মত বিশ্ব শক্তিও খুব বেশি সংখ্যক সেনা প্রেরণ করেনি। সেনা প্রেরণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ ও অন্যান্য লাভক্ষতির হিসেব কষে তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়াও এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণটি হল - আফগানিস্তান পশ্চিমাদের জন্য একটি বিরাট হুমকি এবং এ আগ্রাসন তাদের জন্য অপরিহার্য-এ ধারণা বিশ্বব্যাপী প্রচার করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।

আর আফগানিস্তানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যেসব সৈন্য সংগ্রহ করেছে, তাও তাকে পেতে হয়েছে বহু শর্ত সাপেক্ষে। ২০০৯ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের আর্মড সার্ভিস কমিটির দেয়া তথ্য মতে, আফগানিস্তানে সৈন্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে ৬৯ টি রাষ্ট্রের শর্ত ও সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে হয়েছে। আর এই শর্তারোপের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যগণ।(১০)

আরোপিত শর্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হল:

১। জার্মান সেনা সদস্যগণ রাতের বেলায় উত্তর আফগানিস্তানে এবং হাসপাতালের সীমানা হতে ২ ঘন্টার বেশি দূরত্বে কোনও অপারেশন চালাবেনা।

২। তুর্কী সেনাগণ শুধু কাবুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এর বাইরে তারা যাবেনা।

৩। দক্ষিণ ইউরোপের সেনা সদস্যরা বরফ বা তুষারপাতের মধ্যে কোনও অভিযানে যাবেনা।

৪। আর একটি দেশ হতে প্রেরিত সৈন্যদল শর্ত দিয়েছে, পাকিস্তান সীমান্ত থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনও অপারেশনে গেলে তার নিজ দেশের অনুমতি নিতে হবে।

৫। অপর একটি দেশ জানিয়েছে, তাদের প্রেরিত যুদ্ধবিমান তাদের দেশীয় সৈন্য ব্যতীত যৌথ বাহিনীর অন্য কোনও দেশের সদস্য ব্যবহার করতে পারবেনা।

এই হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বহুল প্রচারিত আফগানিস্তান আগ্রাসনে ৪৩ টি রাষ্ট্র হতে প্রাপ্ত ব্যাপক সাহায্য সমর্থনের নমুনা!

আফগানিস্তান: সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের কবরস্থান
চেঙ্গিস খান যখন তার ২ মিলিয়ন দুর্ধর্ষ মঙ্গল সেনা নিয়ে আফগানিস্তানে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন তাকে পরাস্ত করার মধ্য দিয়েই আফগানিস্তানের এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মোকাবেলার বীরত্ব গাঁথা শুরু। দুই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা লড়াই চলাকালে এবং এর পরও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ ও স্থলবেষ্টিত অবস্থানের কারণে সর্বদাই রাষ্ট্রটি বহিঃশক্তির আক্রমণের হুমকি মোকাবেলা করে এসেছে। দেশটির অতীত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ফরাসী, গ্রীক, মঙ্গল, বৃটিশ, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ কোনও দখলদার শক্তিই কখনও একে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। একারণেই একে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের কবরস্থান বলা হয়।(১১)

বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে এই রাষ্ট্রটিতে বারবার আগ্রাসী শক্তির কবর রচিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র তাচ্ছিল্য ভরে নির্বোধের মত আফগানিস্তানের এই গৌরব ইতিহাস অগ্রাহ্য করেছে। যার খেসারতস্বরূপ ডিক চেনি ইতোমধ্যে একে অসমাপ্ত যুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এটা আগ্রাসন হলেও আফগানিস্তানের অধিবাসীদের নিকট এটি তাদের অস্তিত্বের সংকট, জীবন বাঁচানোর লড়াই। এই লড়াইয়ের স্পৃহা এসেছে তাদের বিশ্বাস, জীবন বিধান ইসলাম থেকে।

সুতরাং এর চেয়ে কঠিনতম পরিস্থিতি মোকাবেলায়ও তারা এতটুকু পিছু হটবেনা। ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসী সেখানে মার্কিন যৌথ বাহিনীর নাজেহাল দশা প্রত্যক্ষ করেছে। লোকবল, অস্ত্রসস্ত্রে শ্রেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তারা এই দুর্বল স্বল্প সংখ্যক জনগোষ্ঠীর সাথে পেরে উঠছেনা। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আফগানিস্তানে পূর্ব  যেসব আগ্রাসী শক্তি তাদের স্বার্থ হাসিলে ব্যর্থ হয়েছে, মার্কিন যৌথ বাহিনী অচিরেই সেই একই ভাগ্য বরণ করতে চলেছে।

মার্কিন পরাজয় কেন?
বিস্ময়কর ব্যাপার হল পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি তার অপরিমেয় সম্পদ, সর্বাধিক ব্যয়বহুল সামরিক বাহিনী, সরঞ্জামাদি ও সম্মিলিত ন্যাটো বাহিনী নিয়ে লড়ছে মাত্র ২৮ মিলিয়নের এমন এক হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাথে, যাদের দুই তৃতীয়াংশের প্রাত্যহিক আয় ২ ডলারেরও নিচে। কিন্তু গত ৯ বছর যাবত চেষ্টার পরও তারা এই দারিদ্র পীড়িত জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ এবং সেই সাথে অসম এই যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে যাচ্ছে। দিন দিন মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে; এমনকি পশ্চিমা জনমতও এই আগ্রাসনের বিপক্ষে রায় দিয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতই বলা হোক যে তারা আত্মরক্ষার খাতিরে এ আগ্রাসন চালিয়েছে, সমগ্র বিশ্বের নিকট আজ তাদের এ অজুহাত প্রশ্নবিদ্ধ।

বর্তমান মার্কিন যৌথ বাহিনীর মত সোভিয়েত ইউনিয়নও ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছিল। কিন্তু ১০ বছরের মাথায় তারা চরম পরাজয় বরণ করে এবং খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তৎকালিন সময়ের পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের ২.৫ লক্ষ সৈন্যের বিশাল এক বাহিনী আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। তারা সহজেই ঘনবসতিপূর্ণ শহরাঞ্চল দখল করেছিল, কিন্তু সেখানকার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলগুলোকে কখনই কব্জা করতে পারেনি। মার্শাল একরোমেভ ১৯৮৬ সালে বলেছিলেন, আমরা কাবুলসহ কেন্দ্রীয় প্রদেশগুলো নিয়ন্ত্রণে এনেছি কিন্তু...আফগান জনগণের জন্য আমরা যুদ্ধে হেরে গিয়েছি।(১২)

বর্তমান মার্কিন যৌথ বাহিনীর ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল সৈন্য বহর অত্যাধুনিক অস্ত্র ও রণকৌশল কোনটিই আফগানিস্তানের পাথুরে ভূমি ও অসমতল পাহাড়ি জনপদের বেলায় কাজে আসেনি। নিম্নমানের অস্ত্রসজ্জিত স্বল্প সংখ্যক মুজাহিদীনদের চাতুর্যপূর্ণ গেরিলা আক্রমণের মুখে তারা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আফগানিস্তানে পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নের দুর্দশা থেকে মার্কিন প্রশাসন কিছুই শেখেনি। গত ৯ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ওবামা ক্ষমতায় এসে সেখানে আরও সৈন্যবল বৃদ্ধি ও অর্থ বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।

আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল বিশ্বের দূরদর্শী একমাত্র এই পরাশক্তি তার দীর্ঘ ভিয়েতনাম যুদ্ধের তীক্ত অভিজ্ঞতা থেকেও কোনও শিক্ষা গ্রহণ করেনি। যেখানে ৫ লক্ষ ৩৫ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে মার্কিনীরা ভিয়েতনামে মার খেয়েছে, তার চেয়ে ৪ গুন বড় আফগানিস্তানে তারা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে তা সত্যিই দুর্বোধ্য। উল্লেখ্য, বর্তমানে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর সংখ্যা তৎকালীন ভিয়েতনামের মাত্র ৩২ ভাগের এক ভাগ। মার্কিন বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ভিয়েতনাম ও আফগান অভিযানের কিছু সাদৃশ্য তুলে না ধরলেই নয়:

১। ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তান দুদেশেরই যথাক্রমে ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মত আগ্রাসী শক্তি মোকাবেলার ইতিহাস রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই আগ্রাসী বাহিনী বিশাল সৈন্য সম্ভার ও আধুনিক সমরাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও করুণভাবে পরাজিত হয়েছে।

২। মার্কিন বাহিনীর আগ্রাসনকৃত ২টি দেশই যুক্তরাষ্ট্র হতে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। উল্টো আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে অতিরিক্ত যে সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা হল আফগানিস্তানের স্থলবেষ্টিত সীমান্ত। সেখানে কোনও উপকূল না থাকায় বাধ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে নৌ-বাহিনী ব্যবহারের আশা ত্যাগ করতে হয়েছে।

৩। দুটি দেশের ক্ষেত্রেই মার্কিন বাহিনীকে ৮০ ভাগের বেশি গ্রামাঞ্চলীয় জনগোষ্ঠীর তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যার সাথে তারা সম্পূর্ণ অপরিচিত।

৪। অসমতল পাহাড়ী ভূমি ও পাথুরে রাস্তার কারণে উভয় দেশে প্রচলিত ট্যাংক-কামান ব্যবহার করাটা তাদের জন্য দুঃসাধ্য। ফলে আকাশপথেই তাদের আক্রমণ চালাতে হয়েছে।

৫। উভয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই মার্কিন বাহিনীকে অশান্ত, শত্রুভাবাপন্ন, বিশাল সীমান্ত এলাকার মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং আগ্রাসন চালানোর গ্রহণযোগ্য কোনও অজুহাত তারা দাঁড় করাতে পারেনি।

মার্কিন প্রশাসন ক্রমাগতভাবে আফগানিস্তানকে তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে দাঁড় করাতে চাইছে। অন্যদিকে তালেবান যোদ্ধাদের যুক্তি হল তারা যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের মুখে আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ করছে। যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণের কোন ইচ্ছা আদৌ তাদের ছিলনা, বর্তমানেও নেই। ৯/১১ এর ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র একপাক্ষিকভাবে আফগানিস্তানকে দায়ী করলেও তার যুক্তিযুক্ত কোনও প্রমাণ বিশ্ববাসীকে দেখাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থনকারী লেখকগণও (সেথ জোন্স ও মার্টিন লিবিকি) তাদের রচনায় একই মতামত ব্যক্ত করেছেন: মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে এই আগ্রাসন মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী হামলার আশংকাকে আরও বৃদ্ধি করেছে।(১৩) প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নয়, সম্পূর্ণ হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই এই আগ্রাসন। যা উম্মাহ্র মধ্যে মার্কিনীদের প্রতি পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে এবং কাফির মার্কিনীদের কবর রচনা করে ইসলামী রাষ্ট্র - খিলাফত প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করছে।

উপসংহার
সত্য মিথ্যার সংগ্রাম বস্তুতঃ পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই চলে আসছে। রাসূল (সাঃ) মদিনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও এই কাফির-মুশরিক সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীই ইসলামী রাষ্ট্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু খিলাফত রাষ্ট্রের সৈন্যদের হাতে তারা আজীবনই চরমভাবে পরাজিত হয়ে এসেছে। আল আহযাবের যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনী যেমনি তাদের মিত্রদের সাথে নিয়ে একত্রিত হয়ে মদিনা আক্রমণ করতে এসেছিল, ঠিক তেমনি আফগানিস্তানে মার্কিন ও তার মিত্ররা ন্যাটো বাহিনীর নামে এসেছে আগ্রাসন চালানোর জন্য। কিন্তু কুরাইশ বাহিনী ঐ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল মদিনা রাষ্ট্রের মুসলিম বাহিনীর হাতে। আজ একমাত্র সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা না থাকার দরুণ মুসলিমরা দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও কাফির সাম্রাজ্যবাদিদের হাতে হচ্ছে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত। কারণ পরাশক্তি সৃষ্ট রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মোক্ষম জবাব দিতে পারে কেবল আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী আদর্শিক পরাশক্তি। তাই মুসলিম বিশ্বে মার্কিন আধিপত্যের পতনের জন্য দরকার মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং একক নেতৃত্ব ও খিলাফত রাষ্ট্রের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের সূচনা করা। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন, আর এই মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমরা সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সকলে মিলে যুদ্ধ করে। আর মনে রেখ নিশ্চয় আল্লাহ্ মুত্তাকীদের সাথেই রয়েছেন। [সূরা আত-তাওবা : ৩৬]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন