বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ এশিয়া

১. ভুমিকা

ভারতীয় উপমহাদেশ নামে সুপরিচিত এই দক্ষিণ এশিয়া বরাবরই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক মঞ্চ। সংখ্যায় বিপুল এ অঞ্চলের অধিবাসীরা বিশেষ ধরণের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আর ভৌগোলিকভাবে এ অঞ্চল দূর্গম পাহাড়বেষ্টিত। যেজন্য অতীতের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে কেবল সুনির্দিষ্ট কয়েকটি পথেই এ অঞ্চলে প্রবেশ করা যেত। কখনো সফলতা, কখনো ব্যর্থতা ইত্যাদি মিলিয়ে বিভিন্ন সময় শীর্ষস্থানীয় দিগ্বিজয়ীরা এসব পথেই এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে এবং এ অঞ্চলসীমায় নিজ নিজ ক্ষমতার পরিধি বিস্তারের চেষ্টা করেছে। সেই ধারাবাহিকতাতেই একসময় মোঘলদের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার লাভ ঘটে। তবে নিকট অতীতে ভৌগলিক এই সীমাবদ্ধতা থেকে অনেকেই শিক্ষা নিয়েছে এবং এককভাবে কারো পক্ষে পুরো উপমহাদেশের কর্তৃত্ব ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলশ্রুতিতে, উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছে একাধিক অংশে এবং একক কোন ব্যবস্থায় এটা আর পরিচালিত হচ্ছেনা।

২. সাম্প্রতিক পরিস্থিতি (বিংশ ও একবিংশ শতাব্দী)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে আমেরিকার আবির্ভাব ঘটে। সে নতুন উদ্যম, হিংস্রতা ও গোটা পৃথিবীর সম্পদ লুটপাটের সর্বগ্রাসী লোভ নিয়ে নয়া উপনিবেশবাদ শুরু করে। অতি অল্প সময়ে আমেরিকা বৃটিশ সাম্রাজ্যকে চ্যালেঞ্জ করে এবং প্রায় প্রতিটি স্থানে তাদেরকে বিতাড়িত করে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকা শুধু ব্রিটিশদেরকেই নয় বরং সমান লক্ষ্যে অগ্রসর অন্যসব শক্তিগুলোকেও ছাড়িয়ে যায়। এটাই হচ্ছে গত শতাব্দীর সব আঞ্চলিক ও দেশীয় রাজনীতির পেছনে কার্যকর অপ্রকাশ্য কারণ। এভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে বিশ্বে নিজের ভিত তৈরী করে এবং এই ভিতকে আরো মজবুত ও স্থায়ী করার লক্ষ্যে সুগভীর পরিকল্পনার জাল বিস্তার করে।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি মার্কিন নীতি মূলত মধ্য এশিয়ায় মার্কিন স্বার্থ, চীন নিয়ন্ত্রণ নীতি (Policy of Containing China) এবং ইসলামিক আন্দোলন দমনের ভিত্তিতে আবর্তিত, যা নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

৩. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্য এশিয়া

ভূ-কৌশলগত দিক থেকে মধ্য এশিয়া মূলত রাশিয়ার বর্ধিত অংশ, যা মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। মধ্য এশিয়ার সাথে রাশিয়ার কোন প্রকৃতিগত স্বাভাবিক সীমানা নেই, নেই কোন সাগর-মহাসাগর ইত্যাদি। একই কথা চীনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, চীন মধ্যএশিয়াকে তার পেছনের দরজা মনে করে। যেহেতু মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী মুসলিম, সেহেতু চীন ও পূর্ব তুর্কমেনিস্তানে অবস্থানরত মুসলিমদের উপর মধ্য এশিয়ার মুসলিমদের প্রভাব সম্পর্কে চীন খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত। এই কৌশলগত গুরুত্বের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মধ্য এশিয়াকে নিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা সাজায়। এই পরিকল্পনার একদিকে রয়েছে রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা আর আরেকদিকে রয়েছে চীনকে অবরোধ করে রাখা এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর চীনের প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনাকে খর্ব করা।

অধিকন্তু, মধ্য এশিয়া এবং বিশেষ করে কাস্পিয়ান সাগর তেল সমৃদ্ধ অঞ্চল। এছাড়াও এই অঞ্চলে স্বর্ণসহ বহু মূল্যবান ধাতব পদার্থের খনি রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের মতই এই অঞ্চল পৃথিবীর খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যের দিক থেকে অন্যতম ধনী অঞ্চল। এই বিশাল সম্পদের প্রতি মার্কিন বিশালকায় পুঁজিবাদী কোম্পানিগুলো আকৃষ্ট এবং বিনিয়োগের নামে কোম্পানিগুলো এই অঞ্চলে প্রবেশ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের মতই এই অঞ্চলের দুর্ভোগের জন্য ঔপনিবেশবাদীরাই দায়ী আর এই অঞ্চলের মানুষের সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ঔপনিবেশবাদীরা।

২০০৪ সালে পারভেজ মোশার্র‌ফ আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন একটি ধারণা উপস্থাপন করে। তার প্রদত্ত ধারণাটি হচ্ছে - পাকিস্তান তিনটি অঞ্চলের বাণিজ্য ও জ্বালানী পাইপলাইনের মধ্যে সংযোগ রাস্তা হতে পারে। এই তিনটি অঞ্চল হচ্ছে: মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া (ভারত) এবং পশ্চিম এশিয়া (তথা মধ্যপ্রাচ্য)। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে পাকিস্তান এই তিন অঞ্চলের সংযোগস্থলে অবস্থিত বলে এর সুযোগ নিতে চায়। এজন্য পাকিস্তান আরব সাগরের উপকূল জুড়ে আফগানিস্তান সীমান্ত পর্যন্ত অসংখ্য বিশালাকার সমুদ্র বন্দর তৈরী করেছে এবং এই সমুদ্র বন্দরগুলো আমেরিকার অনুকরণে মহাসড়ক দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত।

মার্কিন সিনেটের সামরিক ব্যয় সংক্রান্ত কমিটিতে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী কলিন পাওয়েল এ সম্পর্কে ২৭শে মার্চ, ২০০৪ সালে বিস্তারিত বিবরণ দেয় এভাবে, “বাণিজ্য ও সড়ক নেটওয়ার্কের মধ্যে আনা গেলে ককেশাস, মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চল সমূহের অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। এটা তখনই সম্ভব যখন আমরা এতদ অঞ্চলে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হব। ... পাকিস্তান এই বিষয়টি নিরীক্ষা করছে এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো ও সমুদ্র বন্দরগুলো ঢেলে সাজিয়েছে... আর আমরা আফগানিস্তানে আমাদের সহযোগী, সৌদী ও জাপানিদের সহায়তায় মহাসড়ক তৈরি অব্যাহত রাখব”।

মার্কিন কূটনীতি এই অঞ্চলে (সামরিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক) জোট প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এই সম্ভাব্য জোট পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে কাবুল হয়ে তেহরান পর্যন্ত বিস্তৃত। এর ফলে পাকিস্তানকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে কৌশলগত মিত্রতার মানচিত্র নতুন করে সাজানো সম্ভব। ইসলামাবাদে অবস্থিত কিছু রাজনৈতিক সূত্র ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে নতুন জোট তৈরি হওয়ার ভবিষ্যৎবাণী করছে। পরিকল্পিত এই জোট বিদ্যমান ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মিত্রতার তুলনায় ব্যাপকতর। এরকম আলোচনাও আছে যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপিয়ান ন্যাটোর অনুকরণে এই অঞ্চলেও একটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ন্যাটো তৈরী করার স্বপ্ন দেখছে মার্কিনরা। যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত বন্ধু রাষ্ট্রের পাশাপাশি এতে আরো অংশ নিবে ওয়াশিংটনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান ও আজারবাইজান। এই আঞ্চলিক জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্বালানী পাইপলাইনসমূহের নিরাপত্তা বিধান ও সামরিক সুরক্ষা প্রদান করা এবং চীনা বা রাশিয়ান প্রভাব প্রতিহত করা।

৪. আমেরিকা এবং চীন

চীন তার সুবিশাল জনসংখ্যা ও সুবিস্তৃত ভূমির জন্য সবসময়ই আঞ্চলিক শক্তিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং একই সাথে ভয়েরও কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রথমদিকে বৃটেনই এ অঞ্চলকে নিজেদের বাণিজ্য সম্প্রসারণের বাজার হিসেবে উন্মুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়। চীনকে তারা কোন হুমকি হিসেবে দেখেনি বরং এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতাই তারা চেয়েছিলো যাতে করে দূরপ্রাচ্যে তাদের বাকী উপনিবেশগুলো নিয়ে সমস্যায় পড়তে না হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আমেরিকার সাথে চীনের সম্পর্ক ছিলো মূলতঃ বন্ধুত্বসূলভ। আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে অস্থিতিশীল সম্পর্ক এবং চীনের প্রতি জাপানের আক্রমণাত্মক অবস্থা, আমেরিকা ও চীনকে নিকটতর করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন পার্ল হারবার আক্রান্ত হয়েছিলো, চীন তখন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর চীনের ব্যবস্থা যখন কমিউনিজমে রূপান্তরিত হলো তারপর থেকে তারা অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেদের সীমানার বাইরের বিষয় নিয়ে খুব কমই মাথা ঘামিয়েছে। এ ব্যাপারে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে উত্তর ভিয়েতনাম ও উত্তর কোরিয়ার কিছু বিষয়ে তার সংশ্লিষ্টতা এবং ভারতের সাথে সামান্য বিরোধ। চীনের এই আচরণ রাশিয়ার সাম্রাজ্য বিস্তারের উচ্চাভিলাষের সাথে কোন ক্রমেই তুলনীয় নয়। ফলে, মতাদর্শগতভাবে পুঁজিবাদের বিরোধী হওয়ার কথা বাদ দিলে, এটা ইঙ্গ-মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে কোন প্রত্যক্ষ হুমকি ছিল না। বরং সময় সময় বিভিন্ন বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চীনকে ব্যবহার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু, কমিউনিজমকে বাদ দেয়ার পর থেকে নিজের সীমানার বাইরেও চীন দৃষ্টি দিতে শুরু করেছে। চীন যখন নিজেকে ক্ষমতাধর এক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এবং পারমাণবিক অস্ত্রে সুসজ্জিত করে গড়ে তুলছিলো, আমেরিকার তখন এটাকে সহ্য করা এবং পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া উপায় ছিল না। বর্তমানে চীনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র এশিয়া এমনকি সমগ্র বিশ্বে স্বীয় প্রভাব বিস্তারের পথে অন্যতম হুমকি মনে করে। “সাধারণভবে ধারণা করা যায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের স্বরূপ কেমন হবে তার উপর একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতি বহুলাংশে নির্ভর করবে”।
 
মেডিলিন অলব্রাইট (পররাষ্ট্র মন্ত্রী) ২০০০ সালে প্রদত্ত “U.S. , China & India in the 21st Century” শীর্ষক এক ভাষণে এশিয়া ও ইউরোপে বাজার হারানোর ভয়ে চীনকে ডব্লিও. টি.ও.ভূক্ত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বার বার তাগিদ দেন। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, চীনের অর্থনৈতিক বিস্ফোরণ থামানোর জন্য এই চুক্তিই একমাত্র পথ, কেননা তখন চীনকে W.T.O এর কঠিন বিধিমালা মেনে চলতে হবে। তিনি তার বক্তব্যে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেন যা চীনের উপর চাপ সৃষ্টিতে সহায়তা করবে। যেমন:

· পরমাণু প্রযুক্তি-সমৃদ্ধিকরণ নিষেধাজ্ঞা

· তাইওয়ান প্রণালীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং দক্ষিণ চীন সাগরে সহযোগীতা

· তিব্বতের ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং দালাইলামার সাথে সংলাপ শুরু করা

· কোরিয়ার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা

· মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন

এখানে মূল বিষয় হলো, আমেরিকা চীনের ক্রমাগত একটি পরাশক্তি হয়ে উঠার সম্ভাবনার ভয়ে ভীত এবং সেজন্যই সে বিভিন্ন উপায় উপকরণ ব্যবহার করে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে, যাতে চীনকে নিজের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানেই ব্যস্ত রাখা যায়।

এর পাশাপাশি, আমেরিকা আরেকটি কৌশলও চালিয়ে যাচ্ছে। তা হলো, চীনের চারপাশ ঘিরে যে রাষ্ট্রগুলো আছে, সেগুলোকে আরো শক্তিশালী করা কিংবা আমেরিকার প্রভাবাধীনে আনা অথবা যথেষ্ট পরিমাণে অস্থিতিশীল রাখা যাদেরকে দিয়ে চারপাশ থেকে চীনকে অবরুদ্ধ করে রাখা যাবে। ফলশ্রুতিতে, চীন নিজের সীমানার বাইরে প্রভাব বিস্তারের কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পাবেনা এবং চীন নিজেকে নিজের সীমানার মাঝেই আবদ্ধ রাখবে। উত্তর দিকে চীনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রাশিয়া রয়েছে, অতএব ওইদিক নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। পূর্বদিকে রয়েছে জাপান, তাইওয়ান এবং দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীন ইন্দোচীন, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া। পশ্চিমদিকে (যেটাকে সচরাচর ‘চীনের পিছনের দরজা’ বলে অভিহিত করা হয়) রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন মধ্য এশিয়া, বিশেষ করে উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান। ‘এশিয়ান ন্যাটো’ তৈরি করার যে পরিকল্পনা নিয়ে কথা চলছে, তা হবে আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত এবং এতে উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের পাশাপাশি কাজাখস্তান ও আজারবাইজানকে অন্তর্ভূক্ত করা হবে। চীনের চতুর্দিকের দেশগুলিকে আমেরিকা বল প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের বাধ্য করছে যাতে তারা চীনের দিকে সর্বদা কঠোর দৃষ্টি রাখে। চীন এই অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বের হবার কোন চেষ্টা করছে না। চীনের প্রতি বার্মার আনুগত্য এই অবরোধ প্রাচীর অতিক্রম করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে, যদিও অবরোধ পুরোপুরি ভেঙ্গে ফেলার জন্য এটা যথেষ্ট নয়। মায়ানমারের মাধ্যমে চীন সরাসরি ভারত মহাসাগরে যেতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আমেরিকা বার্মার সামরিক জান্তার উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে এবং অং সান সু কীকে গণতন্ত্র (!) প্রতিষ্ঠায় ইন্ধন দিচ্ছে।

চীনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আমেরিকা ও তার মিত্রদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক হুমকি ছাড়াও, সে তার সীমানা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোতে বিশেষ করে মধ্য এশিয়ায় ইসলামের ক্রম উত্থানে চিন্তিত। এ ক্ষেত্রে চীনের দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে তার সীমানার অভ্যন্তরস্থ মুসলিমরা বিশেষ করে পূর্ব তুর্কমেনিস্তানের মুসলিমরা এ অঞ্চলে ইসলামের এই উত্থানে প্রভাবিত হতে পারে। বিষয়টির আরো জটিলতা হচ্ছে আমেরিকাও পূর্ব তুর্কমেনিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দিচ্ছে। চীন এখন বাধ্য হচ্ছে ‘সাংহাই-৬ সন্ত্রাসবিরোধী সম্মেলন’ এ অংশ নিতে, এটা জানা সত্বেও যে এটা আমেরিকার তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

৫. আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়া

ভারতের সাথে কৌশলগত বন্ধুত্ব
ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজমুকুটে একটি উজ্জ্বল মুক্তা যা শতাব্দীকাল ধরে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। এতদসত্ত্বেও এখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বলশেভিক আন্দোলনের প্রভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানোভাবের ছোঁয়া লাগে। এটা ব্রিটিশদেরকে মধ্যপ্রাচ্যের মতোই ব্যাপক সমস্যায় ফেলে দিয়েছিলো, এমনকি এখানে বরং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা আরো বেশী প্রাণবন্ত ছিল। তথাপি, বৃটেন ধূর্ততার সাথে এ অঞ্চলের স্বাধীনতা এবং দেশ-বিভাগ সৃষ্টি করে ঠিকই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এ সময় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চে পশ্চিম পাকিস্তানের হাত ধরে আমেরিকার আগমন ঘটে, এটা সম্ভব হয়েছিল আইয়ুব খানের আমেরিকা প্রীতির কারণে। যদিও পরবর্তীতে ভারতের কাছে (এবং বৃটেনের কাছে) ১৯৭১ সালে তাদেরকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে হারাতে হয়।

ইঙ্গ-মার্কিন বিরোধের অংশ হিসেবেই আমেরিকার সাথে ভারতের সম্পর্ক ছিল তিক্ত (কিসিঞ্জার ভারতকে “বাস্টার্ড” বলেছিল)। নিক্সন-কিসিঞ্জার শাসনকালে আমেরিকা এ সম্পর্ক উন্নয়নে কোন পদক্ষেপ দেয়নি। ঐ সময় ভারত আমেরিকার কাছে খুব বেশী গুরুত্ব পায়নি, কেননা তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে গাঁট বেধে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলো দক্ষিণ-পূর্ব দিকে থেকে। এর পাশাপাশি ভারত হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং এর সোশালিজম সংস্করণের প্রতি বন্ধুপ্রতিম, যা ছিল আমেরিকা কর্তৃক ভারতকে অপছন্দ করার আরেকটি কারণ। ভারতের প্রতি পাকিস্তানের বৈরি মনোভাবকে আমেরিকা ঔদাসিন্যের দৃষ্টি নিয়েই দেখতো, মাঝে মাঝে উৎসাহ দিত।

ঐ সময়গুলোতো ভারত তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হিসেবে নিজেকে সামলাতেই বেশী ব্যস্ত ছিলো। বাইরের প্রতি তার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ ছিলো মূলত নীচের বিষয়গুলোতে:

· নেপাল, ভূটান ও শ্রীলংকা এসব ছিলো ভারতেরই উপরাষ্ট্রের মতো। এখানে সবকিছু ভারতের নির্দেশনা মতোই চলতো এবং ভারতের জন্য এগুলো তেমন কোন সমস্যা ছিল না।

· বাংলাদেশ - সবসময়ই ভারতের জন্য একটা সম্ভাব্য হুমকি (মুসলিম, ভারত-বিরোধী এবং পাকিস্তান-মার্কিন পন্থী)। বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে ভারতের জন্য বিপদজনক কারণ বাংলাদেশ ভারতের শরীরের মধ্যে এবং ভারতকে ‘সেভেন সির্স্টা‌স’ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

· চীন - সীমান্ত সংঘাত চলছেই এবং ১৯৬২ সালে সংঘটিত হয়েছে চীন-ভারত যুদ্ধ। এছাড়াও, আরেকটি সত্য হচ্ছে ভারত চীনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল, যেখানে পাকিস্তান রাশিয়ার বিরুদ্ধে চীনের সাথে সুসম্পর্ক তৈরী করেছিল।

· পাকিস্তান - যাদের সাথে মূল বিরোধ হচ্ছে ইসলামী ভূ-খন্ড কাশ্মীর নিয়ে। এই উভয়মুখী সমস্যার মিল রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাঈল সমস্যার সাথে। অর্থাৎ ইসরাঈলের অস্তিত্ব মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ছুরি বসানোর মত কিন্তু প্রকারান্তরে তা ঐ অঞ্চলে ইসলামী চেতনাকেই আরো উজ্জীবিত করেছে। এসবের ফলশ্রুতিতে কাশ্মীরে পাকিস্তান ও আমেরিকার সহায়তায় জিহাদী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যারা পুরো উপমহাদেশেই প্রভাব বিস্তার করেছে যদিও তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ভারত।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও চীনের উত্থানের মাধ্যমে উপরোক্ত অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অবরোধ সৃষ্টি করার আমেরিকার পুরোনো কৌশলগুলো চীনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ শুরু হয় যেহেতু চীন এখন একটা নতুন টার্গেট। এ অবস্থায়, প্রতি পদক্ষেপেই মার্কিনীরা ভারতকে সাথী হিসাবে পেতে আগ্রহী যেহেতু ভারত ঐতিহ্যগতভাবে চীন বিরোধী। কংগ্রেসম্যান হেনরী হাইড মন্তব্য করেছেন, “ভারতের সাথে আরো নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে চীনের উত্থানকে ঠেকানো যায়” (Proceedings of the House of Representatives to Pass House Resolution, “The United States and India Nuclear Cooperation Promotion Act”, July 2006) । কংগ্রেসম্যান ওনা রহরাবেচার বলেছেন, "আমি এদিকে দৃষ্টি দিতে চাই যে, ভারত বৃটেনের কাছ থেকে স্বাধীন হবার পরবর্তী সময়গুলোতে মার্কিন-ভারত সম্পর্ক ছিলো খুবই খারাপ। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভারতের অবস্থান ছিলো রাশিয়ার পক্ষে। তা হোক, কিন্তু এখন তো স্নায়ু যুদ্ধ শেষ। এখন আমাদের উচিত ঐ সময় আমরা যা হারিয়েছি তা পুনরুদ্ধার করা"। তাছাড়া, চীনকে সামাল দিতে ভারত অধিকতর সক্ষম একটি শক্তি যেহেতু সে আকৃতি ও জনসংখ্যার দিক থেকে চীনের কাছাকাছি এবং দুই দেশ পাশাপাশি অবস্থিত। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোন রাষ্ট্রেরই এককভাবে এই যোগ্যতা নেই।

অতএব, কার্যত আমেরিকা চায় দক্ষিণ এশিয়া বিশেষতঃ ভারতকে এ অঞ্চলে একটি আঞ্চলিক মহাশক্তি বানিয়ে তাদেরকে চীনের উত্থান দমনের শক্তিশালী হাতিয়াররূপে ব্যাহার করা। আমেরিকা স্বয়ং একাজে মাঠে নেমে পড়েছে। ভারতের সাথে পরমাণু প্রযুক্তি বিনিময়ের সাম্প্রতিক চুক্তি একটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত যে এ পরিকল্পনা সফল করতে আমেরিকা কতটুকু এগিয়ে গেছে। কংগ্রেসম্যান গ্রে একারম্যান বলেছেন, “একবিংশ শতাব্দীতে ভারত নীতি তৈরীর এখনই সময়, যা ভারতকে বিশ্বের একটি অন্যতম ও দায়িত্বশীল শক্তি হিসেবে গড়ে উঠার বিষয়কে সমর্থন করবে ও উৎসাহ দিবে, যাতে করে আগামী দশকগুলোতে মার্কিন-ভারত সম্পর্ক আরো সুসংহত হয়”।

একটি শক্তিশালী ভারত গঠনের লক্ষ্যে মার্কিনীরা চায় এর চারপাশের দেশগুলোতে স্থিতিশীলতা আনয়ন করতে। চীনের চারদিকে অস্থিরতা তৈরী করার নীতির সম্পূর্ণ বিপরীতে মার্কিনীরা ভারতকে স্থিতিশীলতার আবরণে ঢেকে দিতে চাইছে। ভারতকে এভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে তা অবশ্যই পাকিস্তান ও বাংলাদেশের উপর নানামুখী প্রভাব ফেলবে। মার্কিন পরিকল্পনায় ভারত হচ্ছে মূল বিবেচ্য আর ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে যেয়ে মার্কিনীরা এর প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পূর্ণ শঠতার সাথে খেলছে এবং তাদেরকে মার্কিন পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে বাধ্য করছে। এ ব্যাপারে মার্কিনীরা চরম স্বার্থপর। মার্কিনীদের স্বার্থপরতার খোলামেলা প্রকাশ ঘটেছে কংগ্রেসম্যান জি. একারম্যান -এর কথায়, "সময় এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়ার, বিষয়টিকে এখন আর হালকাভাবে নেয়া যাবেনা। পাকিস্তানের মতই ভারতও বেশ কিছু জটিল প্রতিবেশী দ্বারা বেষ্টিত। প্রতিবেশি পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পরমাণু অস্ত্র উৎপাদন করে চলেছে; চীন পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধের ক্ষেত্রে সন্দেহজনক আচরণ করছে... ভারত যদি ঐ দেশগুলোর প্রতিবেশী না হত, আমরা এরই মধ্যে সেগুলোকে আক্রমণ করতাম... আপনি পাকিস্তান, ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে কি বলবেন? আপনি হয়তো তাদেরকে বলতে পারেন তোমরা যদি ভারতের মতো থাকতে চাও, তাহলে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র (Weapons of mass destruction) প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন কর। এগুলোকে উচ্চমূল্যের বিনিময়ে বিক্রি কর না, এগুলোকে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিও না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কর, ভারতের মত প্রকৃত গণতন্ত্র... গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক নীতি ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে কাজ কর এবং কখনো আমাদের বিপক্ষে যেওনা।" অবশ্য চীনের বিপক্ষে পাকিস্তানের ভূমিকাকে খাট করে দেখা ঠিক হবে না। আমেরিকা মনে করে শেষ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করে চীনের মোকাবেলায় শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি হিসাবে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যাবে। এজন্য মার্কিনীরা সার্কের মত বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার নীতিকে উৎসাহ দেয়।

পাকিস্তান ও ইসলামী আন্দোলন
পাকিস্তান নিউক্লিয়ার ক্লাবে অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় মার্কিনীদের উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে তা সমভাবে ভারতের উপরেও সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে, যা মার্কিনীরা চায় না, আর এজন্যই তারা উভয় দেশের ব্যাপারেই চুপচাপ। অবশ্য কাশ্মিরের ঘটনাবলীতে এই অঞ্চলের সমস্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধুমায়িত অসন্তোষ এবং তাদের পরমাণু অস্ত্রের কাছাকাছি থাকাটা মার্কিনীদের যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে এক শুনানিতে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র সচিব ক্রিশ্চিনা রোকা উল্লেখ করেছে, “দক্ষিণ এশিয়ায় উদারতা, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে প্রধানত কাশ্মিরকে ঘিরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা”।

অতএব, আমেরিকা কর্তৃক আফগানিস্তানে নয়া ক্রুসেডের অন্যতম কারণ ছিল কাশ্মিরের মুসলমানদের সমর্থনকারী ইসলামী আন্দোলনগুলোকে দমন করা। মার্কিনীরা মোশাররফকে বাধ্য করেছিল কাশ্মিরী জনগণের স্বশাসনের অধিকারের প্রতি পাকিস্তানের অব্যাহত সমর্থন প্রত্যাহার করতে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন-এর ভাষায়, “শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী হিসাবে মোশাররফ অনেক দুর এগিয়ে গেছেন... তিনি বুঝতে পেরেছেন যে সন্ত্রাসবাদ, সীমিত যুদ্ধ কিংবা পারমানবিক হুমকি দিয়ে ভারতকে কাশ্মির থেকে হটানো যাবেনা... পাকিস্তান যতক্ষণ পর্যন্ত কাশ্মিরী গ্রুপগুলোর সাথে যুক্ত থাকবে, ততক্ষণ সন্ত্রাসবাদের মদদ দেয়ার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে পারে না”।

মোশাররফ তার মার্কিন প্রভুর নির্দেশে এবং ভারতের প্রিয়ভাজন হতে গিয়ে পাকিস্তানে অবস্থিত ইসলামিক ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোকে তছনছ করে দিয়েছে। এছাড়া তাকে বাধ্য করা হয়েছে ভারতের সাথে সমঝোতায় আসতে এবং দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলো সমাধান করতে। আর এ সমাধানের শুরু হয়েছে কাশ্মিরের উপর হিন্দুদের অধিকার স্বীকার করে নেয়ার মধ্য দিয়ে। আর এটিকে বলা হয়েছিল দু'দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এসব কিছুই শেষ পর্যন্ত ভারতকে ঘিরে মার্কিন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথকে প্রশস্ত করেছে।

আমেরিকা ও বাংলাদেশ

প্রেক্ষিত: ভারত
একথা পূর্বেই বলা হয়েছে যে ভারতের জন্য বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সোজা কথায় বলতে গেলে বাংলাদেশে রয়েছে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী এবং এই জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে ভারতবিরোধী। বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে ভারতের পেটের ভিতরে। বাংলাদেশ তার সীমান্তের ৮০ ভাগই ভারতের সাথে ভাগাভাগি করে। বাংলাদেশ তার অবস্থানগত কারণে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যকে (সেভেন সিস্টারস্‌, যারা ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদের মূল যোগানদার) মূল ভারতীয় ভূখন্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে আসার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে বাংলাদেশের উপর দিয়ে যাওয়া।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত মিত্রতার ফলে ভারত আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন ‘স্থিতিশীলতার পরিকল্পনা’র (stabilization plan) উপর যুক্তিভিত্তিক আস্থা ও প্রত্যয় স্থাপন এবং সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়া ভারতের পক্ষে খুবই কঠিন। যার ফলে বাংলাদেশের উপর প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করা ভারতের জন্য প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশে পরিপূর্ণ স্থিতিশীলতা ভারতের স্বার্থের অনুকুলে নয়। বাংলাদেশ স্থিতিশীল থাকলে ভারতের বঞ্চিত সেভেন সিস্টারস এর রাজ্যগুলোর মধ্যে স্বাধীন হবার বাসনা তীব্রতর হবে। স্বাধীনতার সংগ্রামে তারা স্থিতিশীল ও উন্নত বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করবে। তাই ভারত বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, যা মাঝে মাঝে বাংলাদেশকে ঘিরে মার্র্কিনী পরিকল্পনা ওলট পালট করে দেয়। ভারতের এই আচরণ অনেকটা প্রতিবেশীদের প্রতি ইসরাঈলের আচরণের মতই।

প্রেক্ষিত: চীন
চীনের জন্য ভারত মহাসাগরে পৌঁছার স্বল্পতম দূরত্বের পথ হচ্ছে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে, তাই চীনের কাছে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। যদিও দক্ষিণ চীন সাগরের উপর চীনের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত, ভারত মহাসাগরের উপর তার কোন কর্তৃত্ব নেই। চট্টগ্রাম বন্দর চীনের স্বার্থে ব্যবহৃত হতে দিলে চীনের এই সমস্যার একটি সমাধান হত। তবে চীন মায়ানমারে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরী করছে। যেহেতু মায়ানমারের সরকার চীনের অনুগত, তাই এই গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে চীন ভারত মহাসাগরে আংশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। চীনের এই ইচ্ছা ও পরিকল্পনা বুঝতে পেরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠার মন্ত্রণা দিয়ে আসছে। পরিকল্পিত এই গভীর সমুদ্রবন্দরে মার্কিন যুদ্ধ বিমানবাহী রণতরী এসে ভিড়তে পারবে এবং একে তারা একটি সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। ফলে পুরো ভারত মহাসাগর মার্কিনীদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং দক্ষিণ এশিয়া ও দূরপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থ সংরক্ষণ সহজতর হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ‘শান্তি ও স্থিতি’ বজায় রাখার অর্থ হচ্ছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইসলামিক চরিত্র ও উদ্দেশ্য পরিত্যাগ করা এবং পরিশেষে 'মডারেট ইসলামিক গণতন্ত্রের' লেবাস ধারণ করা (ক্রিস্টিনা রোকা)। বর্তমানে দু'টি দেশেই সামরিক শাসন (আড়ালে বা প্রকাশ্যে) থাকা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় এই দুই দেশের ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশে বর্তমান সামরিক শাসন প্রয়োজনীয় কিন্তু তা একটি স্বল্পমেয়াদী অন্তর্বর্তীকালীন সমাধান।

৬. উপসংহার

উপরোক্ত বিষয়গুলোই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে। চীনের উত্থান এবং ইসলামী জাগরণ এই অঞ্চলকে কোন দিকে নিয়ে যাবে তা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। এর ভিত্তিতেই (Criteria) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব ঘটনা বিশ্লেষণ করে এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পরিকল্পনা করে। ডিসেম্বর ২০০৪ সালে জাতীয় গোয়েন্দা কাউন্সিল (National Intelligence Council) কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টে চীনের উত্থান এবং ২০২০ সালের মধ্যে সম্ভাব্য শক্তিশালী খিলাফতের আবির্ভাবের মোকাবেলায় মার্কিন পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়। এ কারণে বুশ ও তার সহযোগীদের মুখ থেকে বারে বারে সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়েছে, “একটি ব্যাপক ও মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সাম্রাজ্য যার বিস্তৃতি স্পেন থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ... এটি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বৈধ সরকারের প্রতি চরম হুমকি”।


কায়সার শাহনেওয়াজ
জানুয়ারী ২০০৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন