বৃহস্পতিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১২

ইসলামী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নীতিমালা পর্ব-১

খিলাফাহ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ


ইসলামী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নীতিমালা বলতে মূলতঃ বুঝায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ইসলামের হুকুম-আহকামকে বাস্তবায়িত করা। আল্লাহ্ প্রদত্ত এ সমস্ত হুকুম-আহকামকে ইসলামী রাষ্ট্র এর নিজস্ব ব্যবস্থার অধীনেই বাস্তবায়িত করতো। এ রাষ্ট্র জনগণের মাঝে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক ও লেনদেন নির্ধারণ ও দেখাশুনা করাহুদুদ ও আল্লাহ্ প্রদত্ত শাস্তিসমূহ বাস্তবায়ন করাসমাজের সর্বস্তরে উচ্চ মানের মূল্যবোধ বজায় রাখাসমাজে ইসলামের বিভিন্ন রীতিনীত ও ইবাদতকে নিশ্চিত করা এবং সেইসাথে ইসলামী আইন-কানুনের ভিত্তিতে জনগণের সমস্ত বিষয়াদির তদারকি করতো। বস্তুতঃ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে বসবাসরত মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর আল্লাহ্ প্রদত্ত হুকুম-আহ্কামকে কিভাবে প্রয়োগ করা হবে ইসলামে তার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারিত রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র এ নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করেই এ সমস্ত হুকুম- আহকামকে জনগণের উপর প্রয়োগ করতো। এ পদ্ধতি হুকুম শারীআহ্ এবং নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য নির্ধারিত আহকামের সাথে সম্পর্কিত। কারণইসলাম এসেছে সমগ্র মানবজাতির জন্য। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে সমগ্র মানবজাতিকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেছেন। যেমন: তিনি সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের সেই রবের দাসত্ব করো যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, আশা করা যায় যে, তোমরা মুত্তাকী (আল্লাহভীরু) হতে পারবে।” [সূরা বাকারাহ্ : ২১]

তিনি সুবহানাহু ওয়া তাআলা আরও বলেছেন,

হে মানুষ! কি তোমাকে তোমার মহান প্রতিপালক হতে প্রতারিত করলো?” [সূরা আল-ইনফিতার: ৬]

উসুল উল-ফিকহ্ (শারীআহ্র মূল উৎস) বিষয়ে পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ বলেছেন যে, ইসলামী শারীআহ্ আসলে এ পৃথিবীর প্রতিটি সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে উদ্দেশ্য করেই নাযিল করা হয়েছে; হোক সে মুসলিম অথবা অমুসলিম। ইমাম গাজ্জালী তার আল মুস্তাফা ফি আল উসুলবইতে বলেন, “শারীআহ্ আইন দিয়ে শাসিত ব্যক্তিকে আইন অনুযায়ী অবশ্যই একজন দায়িত্বশীল, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন ও আইনপ্রণেতার (আল্লাহ্ তাআলার) আহ্বান বোঝার যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে। (বস্তুতঃ) যে সকল গুণাবলীর জন্য একজন মানুষের উপর আল্লাহ্র হুকুম ফরয হয়ে যায় তা হলো - তার এমন স্বভাবসুলভ মানবপ্রকৃতি যা দিয়ে সে আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধকে (পুরোপুরি) গ্রহণ করতে ও মেনে চলতে পারে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইসলাম আসলে সমস্ত মানবজাতিকেই আহ্বান করেছে। এ আহ্বান ইসলামের দিকে সমস্ত মানবজাতির উপর সাধারণ আহ্বান ও দায়িত্ব হিসাবে আরোপিত হয়েছে। সাধারণ আহ্বানের মাধ্যমে প্রথমে সমস্ত মানুষকে ইসলামে প্রবেশ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। পরবর্তীতে সমস্ত মানুষকে আল্লাহ্ প্রদত্ত সমস্ত হুকুম-আহকামের কাছে আত্মসমর্পণ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। আর যারা নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের অধীনে বসবাস করে, ইসলামী রাষ্ট্র তাদের দল, মত, বিশ্বাস কিংবা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকে একটি দলবদ্ধ মানুষ হিসাবে বিবেচনা করে এবং সকলকে ইসলামী আইন-কানুন দিয়েই শাসন করে। প্রয়োজন হয় শুধু জনগণের ইসলামী রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলে এ রাষ্ট্রে কোনকিছু নেই। কারণ, এখানে সমস্ত মানুষকেই সাধারণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় এবং এদের প্রত্যেককেই ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা অর্পিত নাগরিক দায়িত্ব-কর্তব্য মেনে চলে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রে বসবাসরত প্রত্যেক ব্যক্তিই শারীআহ্ প্রদত্ত পূর্ণ নাগরিক অধিকার ভোগ করে; সে মুসলিমই হোক বা অমুসলিম হোক। আবার, মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও যদি কেউ ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক না হয়, তবে শারীআহ্ প্রদত্ত নাগরিক অধিকার তাকে প্রদান করা হবে না। ধরা যাক, (ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত) কোন মুসলিম ব্যক্তির মা খ্রীষ্টান এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক। আর, তার বাবা মুসলিম কিন্তু তার ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেই। সেক্ষেত্রে, সে ব্যক্তির মা সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবার অধিকারী হবে, কিন্তু বাবা নয়। মা যদি বিচারকের কাছে ভরণপোষণের ব্যাপারে অভিযোগ করে, তবে বিচারক তার পক্ষে রায় দেবে এবং সন্তানকে মায়ের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য করবে, কারণ এক্ষেত্রে উক্ত মহিলা ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হবে। কিন্তু, যদি সে ব্যক্তির বাবা অভিযোগ উত্থাপন করে, তবে বিচারক তার বিপক্ষে রায় প্রদান করবে। কারণ, সে ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক বলে বিবেচিত হবে না। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, শারীআহ্ শুধু ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের উপরই ইসলামী হুকুম-আহকাম বাস্তবায়িত করে এবং এক্ষেত্রে রাষ্ট্রে বসবাসরত সকল মানুষকে সাধারণভাবে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যার কারণে, তারা সকলেই নাগরিক হিসাবে শারীআহ্ প্রদত্ত অভিভাবকত্ব বিষয়ক কিংবা কল্যাণমূলক সকল অধিকার ভোগ করে থাকে।

এটা হচ্ছে শাসন ও অভিভাবকত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে নাগরিকের অবস্থান সম্পর্কিত বিষয়। আর, ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলামী হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নের বিষয়টি কখনও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হয় না, বরং তা সম্পূর্ণভাবে আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। তাই কুরআন-সুন্নাহ্র দলিলগুলোকে অবশ্যই আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে এর কারণ হচ্ছে, শারীআহ্ সম্পর্কিত দলিলগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের সমস্যার সমাধান করা। এক্ষেত্রে, আইনপ্রণেতার (আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা) উদ্দেশ্য হলো মানুষ যেন শুধু আয়াতগুলোর বাহ্যিক অর্থের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আয়াতগুলোর অর্থ ও বিষয়বস্তুকে পরিপূর্ণ ও যথাযথভাবে অনুধাবন করে। এজন্য, হুকুম শারীআহ্র উপর ভিত্তি করে যে কোন আইন গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সবসময়ই শারীআহ্ প্রদত্ত হুকুমের পেছনের কারণ (ইল্লাহ) -কেও বিবেচনা করা হয়। অন্য কথায় বলা যায় যে, হুকুম শারীআহ্ ভিত্তিক কোন সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে সবসময়ই কুরআন সুন্নাহ্র দলিলের আইনগত বিষয়টিকেই প্রধান্য দেয়া হয়। যখন খলীফা (রাষ্ট্র প্রধান) এই সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে গ্রহণ করেন, তখন রাষ্ট্রে সেটা আইনে পরিণত হয় এবং সকলের জন্য সেই আইন মেনে চলা ও তা প্রয়োগ করা কর্তব্য হয়ে যায়।

সুতরাং, ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে বসবাসরত সকল নাগরিকের জন্য শারীআহ্ আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করার বিষয়টি প্রমাণিত ও অপরিবর্তনীয়। আসলে, শারীআহ্ আইনের কাছে আত্মসমর্পণের বিষয়টি মুসলিমদের বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত বিষয়। কারণ, এ ব্যাপারে তারা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। ঈমান আনার অর্থই হলো আকীদাহ্ বা বিশ্বাস থেকে উৎসারিত সমস্ত হুকুম আহকামের কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করা। এক্ষেত্রে মুসলিমদের আকীদাহ্ বা বিশ্বাস তাকে বাধ্য করে এ সমস্ত হুকুম আহকাম পরিপূর্ণভাবে মেনে চলতে। প্রতিটি মুসলিম শারীআহ্ আইন দিয়ে জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহ্র কাছে ওয়াদাবদ্ধ, হোক তা তার সাথে আল্লাহ্র সম্পর্কের বিষয়ে, যেমন: বিভিন্ন ধরনের ইবাদত (নামাজ, রোজা ইত্যাদি); কিংবা, হোক তা নিজের সাথে নিজের সম্পর্কের বিষয়ে, যেমন: মূল্যবোধ বা খাবার সম্পর্কিত বিষয়ে অথবা হোক তা তার সাথে অন্য সকল মানুষের সম্পর্কের বিষয়ে, যেমন: লেনদেন, ক্ষতিপূরণ কিংবা হুদুদ ও শাস্তি সম্পর্কিত বিষয়ে।

ইসলামী রাষ্ট্র সমস্ত মুসলিমকে ইসলামী আকীদাহ্ বা বিশ্বাস দিয়েই ঐক্যবদ্ধ রাখে এবং এক্ষেত্রে অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহ্র দলিলকেই শারীআহ্র মূল ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়। শারীআহ্র মূলনীতি এবং আইনগত সকল সিদ্ধান্ত কুরআন-সুন্নাহ্র দলিলের উপর ভিত্তি করেই প্রণয়ন করা হয় এবং এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত প্রকাশের কোন অবকাশ থাকে না। কিন্তু, ইজতিহাদের কারণে অতীতের মুসলিমরা বিভিন্ন সময় কুরআন-সুন্নাহ্র দলিলকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছে। মূলতঃ এ সমস্ত দলিলের (কুরআনের আয়াত ও রাসূলের (সাঃ) হাদীসের) ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার কারণেই বিভিন্ন ধরনের মতবাদ (Schools of Thought) ও সম্প্রদায়ের জন্ম হয়েছে। এর মূল কারণ হলো, ইসলাম সবসময়ই মুসলিমদের গবেষণা (ইজতিহাদ) করতে উৎসাহিত করে এবং সেইসাথে মানুষের মধ্যকার চিন্তা-ধারার স্বাভাবিক পার্থক্যকেও স্বীকার করে নেয়। এজন্য সবসময়ই মুসলিমদের মাঝে আকীদাহ্, আইন-কানুন ও উসুল উল-ফিকহ্ এর পদ্ধতি বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। রাসূল (সাঃ) সবসময়ই মুসলিমদের ইজতিহাদ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং বলেছেন যে, “মুজতাহিদের (ইজতিহাদের যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি) ইজতিহাদ যদি ভূল হয় তবে তার জন্য রয়েছে একটি নেকী। আর, সঠিক হলে রয়েছে দুটি নেকী।এ কারণে, সুন্নী, শিয়া, মুতাযিলাহ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের আর্বিভাব হওয়া কোন আশ্চর্যের বিষয় ছিলো না। আর না আশ্চর্যের বিষয় ছিলো বিভিন্ন মতবাদের উপর ভিত্তি করে ভিন্ন মাযহাব যেমন: শাফি, হানাফি, মালিকি, হাম্বলী, জাফরী, যায়িদী ইত্যাদি মাযহাবের সৃষ্টি হওয়া। এ সমস্ত সম্প্রদায় এবং মাযহাবগুলো একটি মাত্র আকীদাহ্ বা বিশ্বাসকেই আকঁড়ে ধরেছিল, যা ছিলো ইসলামের আকীদাহ্। তাদের সকলের উপরই আল্লাহ্ নির্ধারিত সমস্ত ফরয দায়িত্ব মেনে চলা এবং নিষিদ্ধ সকল বিষয়কে পরিহার করার কর্তব্য ছিলো। কোন নির্দিষ্ট মাযহাব নয়, তারা সকলেই সর্বাবস্থায় হুকুম-শারীআহ্ দিয়ে জীবন পরিচালনা করতেই বাধ্য ছিলো।

চলবে .........

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন