সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১২

শাসন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কিত রাসুলুল্লাহ (সা) এর বক্তব্যসমুহ ও এর ব্যাখ্যা পর্ব-২

ইসলামী রাষ্ট্র ও তার সম্প্রসারণের ভিত্তি হলো ইসলামী আকীদাহ্

হাদীস-৬
জুনাদাহ ইবনে আবু উমাইয়া থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন - আমরা উবাদা বিন সামিতের নিকট গমন করলাম, তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং আমরা তাঁকে বললাম আল্লাহ্ আপনাকে সুস্থতা দান করুন। আমাদেরকে রাসূল (সাঃ) এর পক্ষ থেকে এমন কোন হাদীস বর্ণনা করুন যা দ্বারা আল্লাহ্ আমাদের উপকার করতে পারেন। তিনি বললেন - রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে ডাকলেন এবং আমরা তাঁকে বাইআত প্রদান করলাম। তিনি যে সকল অঙ্গিকারগুলো আমাদের উপর বাধ্যতামূলক করেছেন সেগুলো হলো - আমাদের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি, সংকট ও সমৃদ্ধি, এমনকি আমাদের উপর যদি অন্য কাউকে প্রাধান্য দেয়া হয় তবুও সর্বাবস্থায় আমীরের নির্দেশ শ্রবণ করব ও তার আনুগত্য করব এবং ক্ষমতার ব্যাপারে আমরা তাদের সাথে বিবাদ করব না (সর্বাবস্থায়ই তাদের প্রতি আনুগত্য থাকবে)। তিনি (সাঃ) বলেন, “কিন্তু তোমরা যদি তাদের মধ্যে আল্লাহ্ কর্তৃক প্রমাণিত স্পষ্ট কুফর দেখতে পাও তবে নয়।” [মুসলিম]

হাদীস-৭
রাসূল (সাঃ) বলেছেন - আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না তারা এই সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই আর মুহাম্মদ আল্লাহ্র রাসূল আর তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে। [বুখারী ও মুসলিম]

ব্যাখ্যা:
ক. ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে ইসলামী আকীদাহ্ ছাড়া অন্য কিছু থাকা জায়েয নাই। সূতরাং রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইন কানুন অবশ্যই শারীআহ্ থেকে গ্রহণ করা হবে।

খ. প্রথমোক্ত হাদীসটি এর প্রমাণ বহণ করে কেননা এতে বলা হয়েছে যে, ইসলামী আকীদাহ্ থেকে বিচ্যুত হওয়াই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণ করার একমাত্র বৈধ কারণ। অন্যকথায় ইসলামী আকীদাহ্ থেকে উদ্ভুত হয়নি এমন কোন আইন বাস্তবায়ন করলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের কোন বৈধতা থাকবেনা।

গ. এরূপ অন্যান্য হাদীসেও শাসকের বিরুদ্ধে তরবারী উত্তোলন করতে নিষেধ করা হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, স্পষ্ট কুফুরী না করে অথবা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে প্রকাশ্য পাপ না করে। মোটকথা হলো শুধুমাত্র ইসলাম বাস্তবায়ন করাই শাসকের কর্তৃত্বের বৈধতার উৎস; অন্য কিছু নয়।

ঘ. ইমাম নববীর মতে, স্পষ্ট কুফর হলো প্রকাশ্য পাপ কাজ যা শারীআহ্র দলিল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।

ঙ. শাসককে অপসারণ করা কখন ফরয হয় এ ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কাজী ইয়াদের মতে, যখন কুফরী সাধন, শারীআহ্ আইনের পরিবর্তন এবং নতুন মনগড়া আইন উদ্ভাবনের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তখন মুসলিমদের জন্য সেই শাসককে অপসারণ করে তদস্থলে অন্য একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক প্রতিষ্ঠা করা ফরয হয়ে যায়।

চ. এটা লক্ষ্যণীয় যে, এই সকল হাদীস শুধু অত্যাচারী শাসকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যে মূলতঃ বৈধ শাসক ছিল কিন্তু পরবর্তীতে সে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠে অথবা শাসন ব্যবস্থা ইসলাম অনুযায়ী পরিচালিত কিন্তু শুধু শাসকের সংশোধন প্রয়োজন। অন্যকথায় এই হাদীসগুলো ইসলামী রাষ্ট্রের সেই শাসকবৃন্দের সংশোধনের সাথে সংশ্লিষ্ট যারা পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান যুগের শাসকবৃন্দ কখনোই ইসলামের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করেনি এবং তাদের শাসন ব্যবস্থা পুরোটাই অনৈসলামিক।

ছ. দ্বিতীয় হাদীসের মতে, শুধু ইসলামী আকীদাহ্ই শাসন কর্তৃত্ব ও সরকারের ভিত্তি হবে তা নয় বরং রাসূল (সাঃ) জিহাদকে ফরয করেছেন এবং এই আকীদাহ্ (ইসলাম) মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য জিহাদকে সকল মুসলিমের উপর ফরয করেছেন।

আইনের উৎস

হাদীস-৮
রাসূল (সাঃ) হযরত মুয়ায (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “যদি তোমার নিকট কোন একটি বিষয় আনয়ন করা হয় তখন তুমি কিভাবে তার সমাধান করবে?” হযরত মুয়ায (রা.) বলেন, “আমি আল্লাহ্র কিতাব (কুরআন) দিয়ে বিচার করব।রাসূল (সাঃ) বললেন, “যদি তুমি আল্লাহ্র কিতাবে এর সমাধান না পাও তাহলে?” মুয়ায (রা.) উত্তরে বললেন, “তাহলে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ (হাদীস) দ্বারা বিচার ফয়সালা করব।রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, “যদি তুমি সুন্নাহ্ কিংবা আল্লাহ্র কিতাবে তার সমাধান না পাও তাহলে?” উত্তরে মুয়ায (রা.) বললেন যে, তিনি তখন তাঁর নিজস্ব বিচার-বিবেচনা ব্যবহার করবেন (অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে ইজতিহাদ করবেন)। [আবু দাউদ, আহমদ]

ব্যাখ্যা:
ক. মুসলিমদের হেদায়েত ও আইন প্রণয়নের প্রধান দুইটি উৎস হলো কুরআন ও সুন্নাহ্ (সহীহ হাদীস) - এখানে তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

খ. যদি কোন বিশেষ ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসে সরাসরি স্পষ্ট বর্ণনা না থাকে তাহলে মুজতাহিদদের জন্য ইজতিহাদের প্রক্রিয়া হলো তারা যে বিষয়ের সম্মুখীন হয়েছে সে ব্যাপারে শারীআহ্র হুকুম বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

গ. আহলে সুন্নাহ্ কর্তৃক গৃহীত শারীআহ্র চারটি মূলনীতি হলো কুরআন, সুন্নাহ্ (হাদীস), ইজমা (সাহাবীদের ঐক্যমত), এবং কিয়াস।

ইসলাম হুকুমগুলো নির্ধারণ করে, কৌশলগত (Styles and Techniques) বিষয়াদি নয়

হাদীস-৯
মুসা বিন তালহা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন - আমি রাসূল (সাঃ) এর সাথে খেজুর গাছের নিকটবর্তী কিছু লোকের পাশ দিয়ে গেলাম। তিনি (সাঃ) বললেন, “এই লোকগুলো কি করছে?” তারা বলল, “তারা গাছের কলম করছে (তারা পুরুষ ও স্ত্রী গাছকে একত্রে রোপণ করে এবং আশা করে যে, অধিক ফলন হবে)।তারপর রাসূল (সাঃ) বলেন, “আমার মনে হয় এটা কোন কাজে আসবে না।যখন লোকগুলো তা জানতে পারলো তখন তারা তা পরিত্যাগ করলো। পরবর্তীতে রাসূল (সাঃ) যখন বিষয়টি জানতে পারলেন তখন তিনি (সাঃ) বললেন, “যদি এতে (গাছের মিলনে) তাদের কোন উপকার হয় তবে তাদের তা করা উচিৎ। এটা শুধু আমার নিজস্ব একটি মতামত ছিল। তোমরা আমার নিজস্ব মতামত গ্রহণ করো না। কিন্তু যখন আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কিছু বলি তবে অবশ্যই তোমরা তা গ্রহণ করবে। কেননা আমি কখনোও সুমহান, মহিমান্বিত আল্লাহ্র উপর মিথ্যারোপ করিনা।” [মুসলিম]

হাদীস -১০
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) কিছু সংখ্যক লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন যখন তারা গাছ কলম করছিল। তখন তিনি (সাঃ) বলেন, “যদি তোমরা কলম না করতে তাহলে তাই তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক হতো।” (ফলে তারা তা বর্জন করে) এতে তাদের ফলন খারাপ হলো। অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন এবং বললেন, “তোমাদের খেজুর গাছের এই খারাপ অবস্থা কেন?” তারা বলল, “আপনি আমাদেরকে এরূপ করতে বলেছেন।তখন তিনি (সাঃ) বলেন, “তোমরাই পার্থিব বিষয়াদি সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখ।” [মুসলিম]

ব্যাখ্যা:
ক. কতিপয় আধুনিকপন্থী লোক এরূপ হাদীসগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে দাবী করে যে - মানুষের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার জন্য ইসলাম কোনরূপ বিধান দেয়নি। এটা এই হাদীসগুলোর সম্পূর্ণ অপব্যাখ্যা কেননা ইমাম নববী তার সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেন, “আলেমগণ বলেন, রাসূল (সাঃ) এর বাণী আমার নিজস্ব মতামতবলতে বুঝায় দুনিয়া ও জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদনের ধরন (Style) সংক্রান্ত বিষয়সমূহ, আইন সংক্রান্ত বিষয় নয়। কিন্তু আইন সংক্রান্ত বিষয় এবং তিনি যা শারীআহ্ ও ইজতিহাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন তা গ্রহণ করা ফরয। খেজুর গাছের পরাগায়ন এই ধরনের হুকুমের অন্তর্ভূক্ত নয় অর্থাৎ এটি দুনিয়া ও জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদনের ধরন (Style) সংক্রান্ত বিষয়।

খ. আমাদের কাজ সম্পাদনের ধরন (Style) ও খুঁটিনাটি বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য শারীআহ্ আসেনি বরং শারীআহ্ এসেছে হালাল-হারাম, বৈধ-নিষিদ্ধ বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে। কোন কাজ সম্পাদনের ধরন সাধারণত ঐ নির্দিষ্ট কাজের নীতিমালার মধ্যেই নিহিত থাকে; ফলে কোন কাজ বৈধ বলেই নির্দেশ দেয়া হতে পারে, যেমন- চাষাবাদ। কিন্তু সময় ও নির্দিষ্ট অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কাজের ধরন ভিন্ন হতে পারে, যেমন - সেচ ব্যবস্থা প্রয়োগ বা জমির উর্বরতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য পর্যায়ক্রমে শস্য উৎপাদন।

গ. এই হাদীসগুলো মূলতঃ খেজুর গাছের পরাগায়ন সংক্রান্ত। ফলে এগুলো কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে উদ্ভুত অনুরূপ পরিস্থিতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

ঘ. প্রথম হাদীসে উল্লেখিত ঘটনায় রাসূল (সাঃ) বলেন, এটা ছিল রাসূল (সাঃ) এর শুধু একটি ধারণা মাত্র। এটা আইন সংক্রান্ত কোন বিষয় নয় বরং তা ছিল কৌশলগত (Styles and Techniques) বিষয়ে রাসূল (সাঃ) এর একটি মতামত। একইভাবে বদর যুদ্ধের দিন সেনাবাহিনীর অবস্থান নির্ধারণে রাসূল (সাঃ) এর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আল হুবাব বিন মুনযির (রা.) জিজ্ঞাসা করেন, সিদ্ধান্তটি কি রাসূল (সাঃ) এর কৌশলগত মতামত নাকি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ওহী, অর্থাৎ যদি এটা তাঁর নিকট অবতীর্ণ ওহী হয় তাহলে এ ব্যাপারে কোন আলোচনার অবকাশ নেই কিন্তু যদি তা কৌশলগত বিষয়ে রাসূল (সাঃ) এর নিজস্ব কোন মতামত হয় তবে তা বিকল্প কোন স্থানে হতে পারে যা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকতর কৌশলগত অবস্থান হবে।


চলবে ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন