শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১২

ইসলামী রাষ্ট্র - ইসলামী রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা

[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]

আল্লাহর রাসুল (সা.)এর ইন্তেকালের পর সাহাবাগণ সর্বসম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে রাসুল (সা.)এর স্থলে একজন খলিফা নিয়োগ করে তাকে বাইয়াত দেবার সিদ্ধান্ত নেন। এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেমুসলিমরা ১৩৪২ হিজরী বা ১৯২৪ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে খলিফা নিয়োগ করে। তবেতারা নিযুক্ত খলিফাকে আমির আল-মুমিনীন (মুমিনদের নেতা) কিংবা সাধারন ভাবে ইমাম বলেও সম্বোধন করত।

ইসলামের ইতিহাসে বাইয়াত গ্রহন ছাড়া কখনো কেউ খলিফা হয়নি। ইসলামী রাষ্ট্র এই নিয়মের ধারাবাহিকতা তার অস্তিত্ব টিকে থাকার শেষ দিন পর্যন্ত রক্ষা করেছে। তবে, বাইয়াতের প্রয়োগ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে খলিফাকে সরাসরি বাইয়াত দেয়া হয়েছে। কোন সময় খলিফাগণ তাদের আত্মীয়-স্বজনের বাইরে অন্য কাউকে খলিফা হিসাবে মনোনীত করেছেন। কেউ কেউ আবার স্বীয় পুত্র বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মনোনীত করেছেন। আর, অন্যরা তাদের পরিবারের মধ্য হতে একাধিক সদস্যকে খলিফা হিসাবে মনোনয়ন দিয়ে গেছেন। কিন্তু, এই মনোনয়ন কখনোই খলিফা হবার জন্য যথেষ্ট ছিল না। বরঞ্চ, খলিফার দায়িত্ব বুঝে নেবার আগে তাকে অবশ্যই মুসলিমদের পক্ষ হতে বাইয়াত গ্রহন করতে হয়েছে। বাইয়াত ছাড়া কোন খলিফাকেই কখনো এ পদের দায়িত্ব দেয়া হয় নাই। বাইয়াত গ্রহনের পদ্ধতিও সবসময় একরকম ছিল না। কখনো আহল্ আল-হাল ওয়াল আকদ্ (সমাজের সম্মানিত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ) এর কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহন করা হয়েছে। কখনো আবার জনসাধারনের কাছ থেকেও বাইয়াত নেয়া হয়েছে। আবার, কোন কোন ক্ষেত্রে শাইখ আল-ইসলাম (প্রসিদ্ধ আলিম) এর কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহন করা হয়েছে। তবে, কিছু নির্দিষ্ট সময়ে বাইয়াত গ্রহন পদ্ধতির অপব্যবহার হয়েছে। কিন্তু, তারপরেও এই বাইয়াত গ্রহন পদ্ধতি সবসময়ই কার্যকর ছিল এবং বাইয়াত ব্যতীত কেউ কখনো উত্তরাধিকার সূত্রে খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান বা খলিফা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেনি।

প্রত্যেক খলিফাই তার সাহায্যকারী হিসাবে একাধিক সহকারী নিযুক্ত করেছেন, যাদের ইতিহাসে কিছু সময় পর্যন্ত ওয়াজির (সহকারী) বলা হত। এছাড়া, খলিফাগণ বিভিন্ন প্রদেশের গর্ভনর, প্রধান বিচারপতি, সেনাবাহিনী প্রধান এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানকে নিযুক্ত করতেন। ইসলামী রাষ্ট্রের কাঠামো সবসময়ই এই রকমই ছিল। সাম্রাজ্যবাদী কাফিররা উসমানী খিলাফত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ইসলামী রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত করার পূর্ব পর্যন্ত এ রাষ্ট্রের কাঠামো কখনো পরিবর্তিতও হয়নি।

ইতিহাসের পুরোটা সময় জুড়েই ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নানারকম ঘটনার অবতারণা হয়েছিল। তবে, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই এ ঘটনাগুলো বাইরের শক্তি বা কারণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত ছিল না। বস্তুতঃ এ ঘটনাগুলো ছিল তৎকালীন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ইসলামের ব্যাখ্যা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির ফলাফল। পরবর্তী সময়ে যারা এ ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করেছে তারা তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী এ প্রেক্ষাপটকে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। মূলতঃ ইসলামের ব্যাখ্যা নিয়ে যাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, তাদের প্রত্যেকে ইসলামের আলোকেই তৎকালীন পরিস্থিতিকে নিজস্ব মতামত অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু, তারপরও তাদের এ বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা ছিল ইসলামিক।

এই মতভেদগুলো আসলে একজন ব্যক্তি হিসাবে খলিফার সাথে সম্পর্কিত ছিল, খলিফার পদ বা দায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত ছিল না। উদাহরন স্বরুপ বলা যায়, মতপার্থক্য ছিল কে খলিফা হবে সে বিষয়ে, কিন্তু শাসন-ব্যবস্থার কাঠামো নিয়ে কোন মতপার্থক্য ছিল না। মতপার্থক্য সবসময়ই সীমাবদ্ধ ছিল কিছু ক্ষুদ্র বিষয়ের মধ্যে। ফলে, শাসন-ব্যবস্থার ভিত্তি বা মূলনীতির সাথে এর কোন সম্পর্ক ছিল না। কোরআন ও সুন্নাহ যে শাসন-ব্যবস্থার মূলভিত্তি হবে, এ বিষয়ে মুসলিমদের মধ্যে কখনো মতভেদ হয়নি। মতপার্থক্য হয়েছিল কোরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যায়। একই ভাবে, একজন খলিফাকে যে মুসলিম উম্মাহ্র নেতা হিসাবে নিযুক্ত করতে হবে, এ বিষয়েও মুসলিমদের মধ্যে কখনো মতভেদ হয়নি। কিন্তু, কে খলিফা হিসাবে নিযুক্ত হবে তা নিয়ে মতভেদ হয়েছিল। এছাড়া, মুসলিমরা সবসময়ই এ ব্যাপারে একমত ছিল যে, দ্বীন-ইসলামকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ইসলামের আলোকিত আহবানকে সমস্ত পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। আল্লাহর হুকুম-আহকামকে বাস্তবায়িত করতে হবে এবং মানুষকে দ্বীন-ইসলামের দিকে আহবান করতে হবে, এ ভিত্তির উপরই সকল খলিফা শাসনকার্য পরিচালনা করতো । এদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য ইসলামকে ভুল ভাবে বোঝার কারণে ইসলামের আইন-কানুনের ভুল প্রয়োগ করেছিল। আর কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবেই এসব আইন-কানুনের অপব্যবহার করেছিল। কিন্তু, সবকিছুর পরেও তারা সকলেই শুধু ইসলামকেই বাস্তবায়ন করেছিল। তাদের সকলেই ইসলামের ভিত্তিতে এবং ইসলামের আহবান সমস্ত পৃথিবীতে বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যেই অন্যান্য দেশ, জাতি ও মানুষের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল।

এজন্যই, বিভিন্ন বিষয়ে মুসলিমদের মধ্যে এই আভ্যন্তরীন মতপার্থক্য কখনো ইসলামের জয়যাত্রাকে স্তব্ধ করতে পারেনি, কিংবা পারেনি ইসলামের বিস্তার রোধে কার্যকরী কোন ভূমিকা রাখতে। বরঞ্চ, প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে ১১শ হিজরী (১৭শ খ্রীষ্টাব্দ) পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র কোরআনের আলোকিত আহবানকে পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত করতে একের পর এক অঞ্চল জয় করেছে। ইসলামের পতাকাতলে এসেছে পারস্য, ভারতবর্ষ ও ককেশিয়া (রাশিয়ার একটি অংশ)। পূর্বে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা চীন, রাশিয়া এবং কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এছাড়া, ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে এসেছে পশ্চিমে মিশর, উত্তর আফ্রিকা, আন্দালুস (স্পেন) এবং উত্তরে শামের সমগ্র অঞ্চল। একই সাথে আনাদউল (তুরস্ক), বলকান, দক্ষিন ও পূর্ব ইউরোপ জয় করে এ রাষ্ট্রের সীমানা পৌঁছে গেছে ব্ল্যাক সী পর্যন্ত। ইসলামী রাষ্ট্র আরও জয় করেছে আল-ক্বারাম (ক্রাইমিন উপদ্বীপ) এবং ইউক্রেনের দক্ষিনাঞ্চল। বিস্তীর্ণ ভূমিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করবার পর এ রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী পৌঁছেছে একেবারে ভিয়েনার দরজা পর্যন্ত। বস্তুতঃ মানসিক দূর্বলতা উম্মাহর ভেতর শেকড় গেঁড়ে না বসা পর্যন্ত এবং ইসলামের অপব্যাখ্যা তীব্র আকারে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত, শক্তিশালী মুসলিম বাহিনী না কোনদিন দেশ জয় করা বন্ধ করেছে, আর না ইসলামের আহবানকে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করা থেকে বিরত থেকেছে। এরপর, ইসলামী রাষ্ট্র দ্রুত অধঃপতনের দিকে চলে যায়। এমনকি ইসলাম বর্হিভূত জীবনব্যবস্থা থেকে প্রাপ্ত আইন-কানুনকেও শরীয়াহ্ আইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয় ভেবে স্বীকৃতি দেয় এবং শেষপর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যায়।

আসলে, ইসলামী রাষ্ট্রের উন্নতি ও সমৃদ্ধির রহস্য নিহিত ছিল এ রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিসামর্থ্য, এর সৃজনশীলতা এবং ইজতিহাদ ও কিয়াস (যৌক্তিক তুলনামূলক ব্যাখ্যার মাধ্যমে ইসলামী শরীয়াহর মূল উৎস থেকে হুকুম বের করা) করার ক্ষমতার উপর। হিজরী প্রথম শতাব্দীতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জয় করার পর ইসলামী রাষ্ট্র যখন ব্যাপক ভাবে বিস্তৃত হল, তখন অধিকৃত এলাকাগুলোতে উদ্ভুত নতুন নতুন সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে ইজতিহাদ এক নতুন মাত্রা লাভ করেছিল। নতুন নতুন বিষয়ে শরীয়াহ্ আইনের বাস্তবায়ন মূলতঃ পারস্য, ইরাক, আল-শাম, মিশর, স্পেন, ভারতবর্ষ এবং অন্যান্য দেশের অধিবাসীদের ইসলামে গ্রহনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর, তৎকালীন এই পরিস্থিতি মুসলিমদের কৃত ইজতিহাদের গ্রহনযোগ্যতা ও নতুন সমস্যা সমাধানে তাদের সৃজনশীলতাকেও নিশ্চিত করেছিল। হিজরী পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজমান থাকে। তারপর, কাঠামোগত ভাবে যখন ইসলামী রাষ্ট্র দূর্বল হতে থাকে, সেইসাথে মুসলিমদের সৃজনশীলতা ও ইজতিহাদ করার ক্ষমতাও ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়।

এর মধ্যে আবার সংঘটিত হয় ক্রুসেড এবং বিজয়ী শক্তি হিসাবে পূণরায় আবির্ভূত না হওয়া পর্যন্ত এ ক্রুসেড মুসলিমদের মনমগজ আচ্ছন্ন করে রাখে। এরপরে আসে মামলুকদের রাজত্বকাল। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের চালকের আসনে বসে ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলো খুবই কম গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। ফলে, মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক অন্ধত্ব আরও বিস্তৃত হয় এবং রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা অসারতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এরপর, তাতারদের ধ্বংসাত্মক আগ্রাসনের ফলে মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাতার বাহিনী কর্তৃক বিপুল সংখ্যক বই-পুস্তক টাইগ্রীস নদীতে নিক্ষিপ্ত হওয়া এবং তাদের হাতে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত বিশাল জ্ঞানভান্ডার ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়ার ঘটনা বুদ্ধিবৃত্তিক শূণ্যতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। আর, এ সমস্ত কারণ থেকে উৎসরিত গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক শূণ্যতাই মূলতঃ ইজতিহাদের পথকে অবরুদ্ধ করে। ফলে, নতুন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যখন সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়, তখন ইজতিহাদের পরিবর্তে শুধু ফতোয়া জারি করা কিংবা কোরআন ও সুন্নাহর বিকৃত ও অপব্যাখ্যার মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকে।

এ সমস্ত ঘটনার ফলশ্রুতিতে, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে ইসলামী রাষ্ট্র পতনোম্মুখ অবস্থার সম্মুখীন হয়। এ পর্যায়ে আসে উসমানী খিলাফতের যুগ। ক্ষমতায় আরোহন করার পর তারা সামরিক বাহিনীর শক্তিসামর্থ্য বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী হয় এবং ইস্তাম্বুল (কন্সট্যান্টিনোপল) ও বলকান অঞ্চল জয় করে নেয়। ইসলামী রাষ্ট্রকে আবারও নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে তারা দর্শনীয় ভাবে ইউরোপ তছছ করে দেয়। কিন্তু, এ সব কোনকিছুই মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে পূণঃজাগরিত করতে পারে না। আসলে, উসমানী খিলাফতের সময়ে মুসলিমদের সামরিক বাহিনীর শক্তিসামর্থ্য বৃদ্ধি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা বুদ্ধিবৃত্তিক পূণঃজাগরনের ভিত্তিতে হয়নি। ফলে, ইসলামী রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর এই দূর্দান্ত প্রতাপ সময়ের সাথে বুদবুদের মতো মিলিয়ে যেতে থাকে এবং একসময় সম্পূর্ন ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু, এ সকল সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও উসমানী খিলাফত সাফল্যের সাথে দ্বীন ইসলামকে বিস্তৃত করেছিল। আর, বিভিন্ন অঞ্চলে বহন করেছিল ইসলামের আলোকিত আহবান। বিজিত এ সব অঞ্চলের অধিবাসীরা একসময় ইসলামও গ্রহন করেছিল। এ অঞ্চলে বর্তমানে লক্ষ লক্ষ মুসলিমের উপস্থিতির কৃতিত্ব অনেকটাই উসমানী খলিফাদের।

নিম্নলিখিত কারণ দুটি কিছু খলিফা ও গর্ভনরকে এমন ভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সহায়তা করেছে, যা ইসলামী রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও প্রভাব-প্রতিপত্তিকে ক্রমশ দূর্বল করেছে।

১. ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের মতামতের উপস্থিতি বিরাজ করা। (শরীয়াহ্ প্রদত্ত হুকুমের ব্যাপারে)

২. রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে, খলিফাগণ কর্তৃক নির্দিষ্ট কিছু হুকুম-আহকামকে গ্রহন করার ক্ষেত্রে গাফিলতি করা, যদিও অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু হুকুম-আহকামকে গ্রহন করা হয়েছিল।

কিন্তু, এ সকল কারণও আসলে এ রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে বিপন্ন করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। উদাহরন স্বরূপ বলা যায়, গর্ভণরদের সাধারন ভাবে কিছু শাসন-ক্ষমতা ছিল এবং এই ক্ষমতা ছিল ব্যাপক। এ ক্ষমতাবলেই তারা খলিফার প্রতিনিধি বা সহকারী হিসাবে বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। ব্যাপক এ শাসন-ক্ষমতার অধিকারী হয়ে কিছু কিছু গর্ভণর একসময় নিজেদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ভাবতে শুরু করে এবং স্বাধীন ও স্বায়ত্বশাসিত ভূ-খন্ডের শাসকের মতো আচরন করতে থাকে। খলিফার প্রতি তাদের আনুগত্য শুধু খলিফাকে বাইআত প্রদান করা, জুমার নামাজে তার জন্য দোয়া করা, মুদ্রাতে তার নাম ব্যবহার করা সহ অন্যান্য ছোটখাট বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু, তাদের অধীনস্ত অঞ্চলের শাসন-কর্তৃত্ব পুরোপুরি ভাবেই তাদের কাছে চলে যায়। ফলে, ইসলামী রাষ্ট্রের এই প্রদেশগুলো কার্যত স্বায়ত্বশাসিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়। উদাহরন স্বরূপ, হামদানিইন, সালযুক এবং অন্যান্য শাসনামলের কথা বলা যায়। কিন্তু, ওয়ালী বা গর্ভণরদের এই ব্যাপক ক্ষমতার কারণেও আসলে ইসলামের বিশাল রাষ্ট্র খন্ড খন্ড হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তৈরী হয়নি।

যেমন, মিশরের গর্ভণর হিসাবে নিযুক্ত আমর ইবন আল-আসও ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। একই ভাবে, মুয়াবিয়া ইবন আবু সুফিয়ানও শামের বিশাল অঞ্চলের গর্ভণর ছিলেন। কিন্তু, তা সত্ত্বেও, এই গর্ভণররা কখনোই নিজেদের খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে যখন রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে খলিফাদের দূর্বলতা প্রকাশ হতে থাকে, তখন গর্ভণরদের ভেতর প্রদেশগুলোকে স্বাধীন ও স্বায়ত্বশাসিত রাষ্ট্র হিসাবে শাসন করার এই ধারা ধীরে ধীরে শেঁকড় গড়ে বসে। ফলে, উলাইয়াহ্ বা প্রদেশগুলো বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে একক সরকার-ব্যবস্থার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রের মতো আচরণ করতে থাকে।

কিন্তু, এ সবকিছু সত্ত্বেও ইসলামী রাষ্ট্র অবিভক্ত ছিল। একক রাষ্ট্র হিসাবে এর ঐক্য ছিল অটুট, যেখানে খলিফাগণ সবসময়ই ওয়ালী বা গর্ভণরকে নিযুক্ত করতেন কিংবা পদচ্যুত করতেন। আর, গর্ভণররা যতো ক্ষমতার অধিকারীই হোক না কেন, তারাও কখনো নিজেদের খলিফার শাসন-কর্তৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার দুঃসাহস দেখায়নি। বাস্তবতা হলো, ইসলামী রাষ্ট্র ইতিহাসের কোন সময়েই বিভিন্ন প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত কনফেডারেশন ছিল না, এমনকি যখন গর্ভণররা শাসন-কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে চুড়ান্ত স্বাধীনতা উপভোগ করেছে তখনো না। এটা সবসময়ই ছিল একটি একক রাষ্ট্র, যার প্রধান ছিলেন একজন খলিফা। সমস্ত রাষ্ট্রের উপর তারই ছিল সর্বময় ক্ষমতা। এমনকি, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ ছোট ছোট গ্রামেও খলিফার কর্তৃত্বই বিরাজমান ছিল।

এছাড়া, স্পেনে খিলাফত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং মিশরে ফাতিমিদ রাষ্ট্র জন্মের বিষয়গুলো ছিল অন্য ধরনের সমস্যা। এগুলো ঠিক স্বায়িত্বশাসিত গর্ভণরদের তৈরী করা সমস্যার মতো ছিল না। স্পেনের গর্ভণররা তাদের অধীনস্ত প্রদেশের (উলাইয়াহ্) উপর সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আর সেই সাথে তাদের শাসিত প্রদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষনাও দিয়েছিল। কিন্তু, এই গর্ভণরদেরকে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ কখনো খলিফা হিসাবে বাইআত দেয়নি। পরবর্তী সময়ে, এই গর্ভণররা নিজেদের উক্ত প্রদেশে বসবাসকারী মুসলিমদের খলিফা হিসাবে ঘোষনাও দিয়েছিল। কিন্তু, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর খলিফা হিসাবে স্বীকৃতি তারা কখনোই পায়নি। বস্তুতঃ তখনো, সমগ্র মুসলিম উম্মাহ খলিফা একজনই ছিল। আর, শাসন-কর্তৃত্বও ছিল তার হাতেই। স্পেনের উলাইয়াহকেও (প্রদেশ) সেই সময় আলাদা একটি উলাইয়াহ্ বা প্রদেশ হিসাবেই স্বীকৃতি দেয়া হতো, শুধু এই প্রদেশটি খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা বা খলিফার অধীনে ছিল না। উসমানী শাসনামলে ইরানের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটেছিল। ইরানে কোন খলিফা ছিল না, কিন্তু, উলাইয়াহ্ বা প্রদেশ হিসাবে ইরান আবার খলিফার কর্তৃত্বের অধীনেও ছিল না। আর, ফাতিমিদদের রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল ইসমাইলীদের দ্বারা, যারা প্রকৃত অর্থে ছিল ইসলাম বহির্ভূত সম্প্রদায়।

সুতরাং, ইসলামের দৃষ্টিতে ফাতিমিদদের কর্মকান্ডের কোন আইনগত বৈধতা নেই এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রও ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচিত হবার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। আব্বাসীয় খিলাফতের পাশাপাশি তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে তাই কোনভাবেই একের অধিক খিলাফত রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচনা করা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, ফাতিমিদরা পথভ্রষ্ট সম্প্রদায় হওয়ায় শরীয়াহ্ আইনের দৃষ্টিতে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের বৈধতা ছিল না। আসলে, এই সম্প্রদায়টি গোপন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রকে এমন ভাবে পরিবর্তন করতে চেয়েছিল, যেন তাদের ভ্রান্ত মতাদর্শ দ্বারাই ইসলামী রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু, তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। এরপরেও ইসলামী রাষ্ট্র অবিভক্ত থেকে এর একতা বজায় রেখেছে। যদিও বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন মতালম্বী সম্প্রদায় তাদের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে এর শাসন-কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কার্যত, এই সব অপচেষ্টা ইসলামী রাষ্ট্রকে কখনো খন্ড-বিখন্ড করে বহুসংখ্যক রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারেনি।

এভাবেই ভিন্ন মতালম্বীদের সকল প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ইতিহাসে ইসলামী রাষ্ট্র অবিভক্ত থাকে। যদিও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চেয়েছিলো এবং মূলতঃ এ অভিলাষ থেকেই তারা ক্ষমতা দখলের প্রয়াস চালিয়েছিল, কিন্তু, শেষ পর্যন্ত এ সমস্ত প্রতিকুল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে ইসলামী রাষ্ট্র একটি অবিভক্ত একক রাষ্ট্র হিসাবেই টিকে ছিলো। ইসলামী রাষ্ট্রের অবিভক্ততা এবং একটি একক অভিন্ন রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, বিভিন্ন উলাইয়াহতে বিভিন্ন ধরনের শাসন অবস্থা বিরাজ করা সত্ত্বেও যে কোন মুসলিম কোন রকম বাঁধা বিপত্তি বা প্রশ্ন ছাড়াই পূর্ব থেকে পশ্চিমে অবিভক্ত ইসলামী রাষ্ট্রের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ভ্রমন করতে পারতো। সমস্ত সাম্রাজ্যের কোথাও তাদের পরিচয় সম্পর্কে কোনরকম প্রশ্ন করা হতো না।

এভাবেই ইসলামী রাষ্ট্র সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে একটি মাত্র অভিন্ন ব্যবস্থার নীচে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলো এবং ইতিহাসে এর ধারাবাহিকতাও বজায় ছিলো। পশ্চিমা কাফির সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ১৯২৪ সালে তাদের এজেন্ট মুস্তফা কামালের হাতে এ রাষ্ট্র ধ্বংস করে দেবার পূর্ব পর্যন্ত এ রাষ্ট্র ছিলো শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন