বৃহস্পতিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১২

ইসলামী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নীতিমালা পর্ব-২

পূর্ব প্রকাশের পরঃ

(খিলাফাহ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ)

আসলে, মাযহাবগুলো হচ্ছে শারীআহ্র একটি নির্দিষ্ট ধরনের ব্যাখ্যা, যে ব্যাখ্যা অনুযায়ী মুকাল্লিদগণ (যারা মুজতাহিদ নয়), যারা নিজেরা ইজতিহাদ করতে পারে না, তারা হুকুম-শারীআহ্ অনুসরণ করে থাকে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, মুসলিমরা শুধু আল্লাহ্ প্রদত্ত আইন-কানুন দিয়েই জীবন পরিচালনা করতে বাধ্য, কোন মাযহাব অনুসরণ করতে বাধ্য নয়। তাই, হয় তাকে শারীআহ্র মূল উৎস থেকে নিজে ইজতিহাদ করে শারীআহ্ আইন মানতে হবে, অথবা, সে যদি নিজে ইজতিহাদ করতে অপারগ হয় তবে তাকে কোন মাযহাব অনুসরণ করতে হবে। এ কারণেই, যে সমস্ত সম্প্রদায় ও মাযহাব কুরআন ও সুন্নাহ্কে শারীআহ্র একমাত্র উৎস হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং ইসলামী আকীদাহকে আকঁড়ে ধরেছে - তারা সবাই ইসলামের অর্ন্তভূক্ত। এ সমস্ত মতবাদের প্রচারকবৃন্দও মুসলিম এবং তারা ইসলামী আইন-কানুন দিয়েই পরিচালিত। যতক্ষণ পর্যন্ত এ সমস্ত মাযহাবের অনুসারীরা ইসলামী আকীদাহ্র সীমারেখার মধ্যে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র এ সমস্ত সম্প্রদায় ও মাযহাবের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু, যদি কোন মুসলিম ব্যক্তিগত কিংবা দলবদ্ধভাবে ইসলামী আকীদাহ্ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় তবে, এ বিষয়টিকে ইরতিদাদ (ধর্মত্যাগ) হিসাবে বিবেচনা করা হবে এবং সে ব্যক্তি বা দলের উপর রাষ্ট্র কর্তৃক মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) এর শাস্তি আরোপিত হবে। শারীআহ্র কিছু কিছু বিষয় আছে যাতে দ্বিমত প্রকাশের কোন অবকাশ নেই। অর্থাৎ, এ সমস্ত বিষয়ে একটি মাত্র সুনির্দিষ্ট হুকুমকে গ্রহণযোগ্য হিসাবে ধরা হয়। যেমন: চোরের হাত কাটা, সুদ নিষিদ্ধ হওয়া, যাকাত প্রদানের অপরিহার্যতা, দৈনিক পাঁচ বার নামাজের বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি। এ সমস্ত বিষয়ে হুকুম-শারীআহ্ সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয়। তাই, মুসলিমরা এ সকল ক্ষেত্রে এই সুনির্দিষ্ট হুকুমগুলোই মেনে চলতে বাধ্য।

আবার, শারীআহ্র কিছু কিছু বিষয় ও ধ্যানধারণা আছে যে সমস্ত বিষয় মুজতাহিদগণ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করার কারণে মুসলিমদের মধ্যে এ সমস্ত বিষয়ে মতপার্থক্য ঘটেছে। যেমন: খলীফা হবার পূর্বশর্ত কিংবা খারায আরোপিত ভূমির নির্ধারিত করের অংশ অথবা জমির ভাড়া প্রদান সম্পর্কিত বিষয় ইত্যাদি। এ সমস্ত আইনের ক্ষেত্রে, খলীফা একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে গ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রে বসবাসরত সকলের জন্য সেই আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। যারা এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে খলীফার সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ করে তাদের সকলের জন্যই তাদের নিজস্ব মতামত ত্যাগ করে খলীফার মতামতকে গ্রহণ করা কর্তব্য হয়ে যায়। আর, এভাবেই খলীফা সিদ্ধান্ত সকলের মধ্যে বিদ্যমান মতপার্থক্য দূর করে। বস্তুতঃ ইমাম বা খলীফা শারীআহ্কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর প্রকাশ্য কিংবা গোপনে সেই আইন মেনে চলা মুসলিমদের জন্য অবশ্য কর্তব্য হয়ে যায়। এ সিদ্ধান্তের বিপরীতে কেউ যদি সেই নির্দিষ্ট বিষয়ে অন্য কোন হুকুম অনুসরণ করে তবে সে গুনাহগার হবে। কারণ, খলীফা যখন কোন নির্দিষ্ট শারীআহ্ আইন কার্যকরী করেন, সঙ্গে সঙ্গে তা সকল মুসলিমের জন্য মেনে চলা ফরয হয়ে যায়। আর, কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে শারীআহ্ আইন কারো জন্য কখনো একের অধিক হতে পারে না।

তবে, খলীফার জন্য আকীদাহ্ সম্পর্কিত বিষয়ে কোন হুকুমকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া ঠিক নয়, কারণ তাহলে এটা মেনে চলা মুসলিমদের জন্য কষ্টকর হয়ে যেতে পারে। কিন্তু, ভ্রান্ত বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে যদি নতুন ধরনের ধ্যান-ধারণা আর্বিভাব হবার সম্ভাবনা থাকে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র এসব দুস্কৃতিকারীদের কঠোর হস্তে দমন করবে যতক্ষণ পর্যন্ত না নতুন এইসব ধ্যান-ধারণা মুসলিমদের কুফরীর (অবিশ্বাস) দিকে ধাবিত না করে। কিন্তু, যদি এইসব ধ্যান-ধারণা মুসলিমদের কুফরীর (অবিশ্বাস) দিকে ধাবিত করে, তবে যারা এ ধরনের অপকর্মের সাথে জড়িত থাকবে রাষ্ট্র তাদের ধর্মত্যাগী হিসাবে বিবেচনা করবে। এছাড়া, খলীফার ইবাদত সম্পর্কিত বিষয়েও কোন নির্দিষ্ট হুকুম গ্রহণ করা ঠিক নয়, কারণ এটাও মুসলিমদেরকে কষ্টকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেবে।

সুতরাং, আকীদাহ্ সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদের মধ্য হতে কোন নির্দিষ্ট মতামতকে গ্রহণ করা খলীফার জন্য সঠিক নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না এই সকল মতামত ইসলামী মতবাদ হিসাবে বিবেচিত হয়। আবার, যাকাত ব্যতীত ইবাদত সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও কোন মতবাদকে নির্দিষ্ট করে দেয়া খলীফার জন্য সঠিক নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইবাদতের এই সমস্ত বিষয় শারীআহ্ প্রদত্ত আইন-কানুনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ সকল বিষয় ছাড়া খলীফা লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া প্রদান, বিবাহ, তালাক, বিবাহ-বিচ্ছেদ পরবর্তী ভরণ- পোষণ, অংশীদারিত্ব ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি বিষয়ে শারীআহ্ ভিত্তিক যে কোন আইনকে সকলের জন্য নির্দিষ্ট ও কার্যকরী করতে পারেন। এছাড়া, খলীফা শাস্তি প্রদান বা খাদ্য, বস্ত্র অথবা মূল্যবোধ সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে শারীআহ্ ভিত্তিক যে কোন সুনির্দিষ্ট আইনকে কার্যকরী করতে পারেন এবং এক্ষেত্রে সকল মুসলিমের খলীফার গৃহীত সিদ্ধান্ত মেনে চলা আবশ্যক হয়ে যায়।

এছাড়া, খলীফাকে অবশ্যই ইবাদতের বিষয় সম্পর্কিত সকল শারীআহ্ আইন প্রয়োগ করতে হবে। যারা নামাজ ত্যাগ করবে এবং রমযান মাসে রোযা রাখবে না শারীআহ্ আইন অনুযায়ী খলীফা তাদেরকে শাস্তি দিবেন। এ সকল ইবাদত সম্পর্কিত আইন-কানুন সহ সমস্ত শারীআহ্ আইন রাষ্ট্রে বাস্তবায়িত বা প্রয়োগ করা খলীফার দায়িত্ব। নামাজ আদায় করার বাধ্যবাধকতা কোন ইজতিহাদ করার বিষয় নয়, বরং এটা যে সমস্ত মুসলিমের উপর ফরয - তা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। তাই, এ সমস্ত প্রতিষ্ঠিত বিষয়ে খলীফাকে শারীআহ্ আইন সরাসরি প্রয়োগ করতে হবে। এ সমস্ত বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা না করার কোন অবকাশ থাকবে না। শাস্তিমূলক বিধানের (Penal Code) ক্ষেত্রে খলীফা একটি নির্দিষ্ট আইন গ্রহণ করবেন এবং সকল মুসলিমকে তা মেনে চলার জন্য আদেশ দেয়া হবে। এ সমস্ত কিছুই শুধু মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য হবে। আর, অমুসলিমদের ক্ষেত্রে, যারা কিনা ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী তাদেরকে তিন ভাগে ভাগ করা হবে:

১. যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবী করে কিন্তু তাদের আকীদাহ্র মধ্যে এমন কিছু বিষয় আছে যা ইসলামী আকীদাহ্র সাথে সাংঘর্ষিক।

২. আহলে কিতাবের দলভূক্ত মানুষ।

৩. মুশরিক, যাদের মধ্যে রয়েছে - মাজুস (অগ্নিপূজারী), হিন্দু, বৌদ্ধ এবং আহলে কিতাব বহির্ভূত জনগণ।

এ সকল দলভূক্ত মানুষদের তাদের বিশ্বাসের উপরই ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস বা উপাসনার ব্যাপারে কোনরকম হস্তক্ষেপ করা হবে না। বিবাহ কিংবা তালাক সংক্রান্ত বিষয়ে তাদেরকে নিজ নিজ ধর্মীয় আইন-কানুন মেনে চলতে দেয়া হবে। এ সকল বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদ তাদের ধর্মীয় আইন- কানুন অনুযায়ীই ফয়সালা হবে এবং এজন্য রাষ্ট্র তাদের মধ্য হতে একজনকে রাষ্ট্র অধিকৃত বিচারালয়ে বিচারক হিসাবে মনোনীত করবে। এছাড়া, তাদের খাদ্য ও সাজসজ্জা বিষয়েও তাদের ধর্মীয় রীতি-নীতিকেই প্রাধান্য দেয়া হবে এবং এ সকল বিষয়ই সাধারণ নির্দেশের আওতাভূক্ত হবে। আহলে কিতাব বর্হিভূত সম্প্রদায়ের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। মাজুসদের সম্পর্কে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা আহলে কিতাবদের সাথে যেমন আচরণ করো তাদের (মাজুস) সাথেও একই রকম আচরণ করো।

কিন্তু, লেনদেন সংক্রান্ত এবং শাস্তিমূলক বিধান সমূহ মুসলিম-অমুসলিমসহ সকলের উপরই সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। বস্তুতঃ বিভিন্ন অন্যায়ের শাস্তি সম্পর্কিত বিচারকার্যের ব্যাপারে মুসলিম-অমুসলিমসহ সকলের উপরই শারীআহ্ আইন প্রয়োগ করা হবে। যারা ইসলামী রাষ্ট্রে নাগরিক হিসাবে বসবাস করবে তারা সবাই লেন-দেন ও শাস্তি সম্পর্কিত শারীআহ্ আইন মেনে চলতে বাধ্য থাকবে। এক্ষেত্রে, ধর্মীয়, জাতিগত কিংবা গোত্রীয় ভেদাভেদ বিবেচিত হবে না। অমুসলিমরা মূলতঃ রাষ্ট্রের শাসন-কর্তৃত্ব এবং আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকেই এ সমস্ত আইন-কানুন মেনে চলবে, ধর্মীয় কিংবা আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। তাদের কোন অবস্থাতেই এ সমস্ত আইন-কানুনের উপর বিশ্বাস আনতে বাধ্য করা হবে না। কারণ, তা করা হলে তাদের প্রকৃতপক্ষে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন,

দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই।” [সূরা বাকারাহ্: ২৫৬]

আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) আহলে কিতাবের অন্তর্ভূক্ত মানুষদের ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ কিংবা বিশ্বাসের জন্য তাদের নিপীড়ন করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু, নাগরিক হিসাবে তাদের অবশ্যই রাষ্ট্রের শাসন-ক্ষমতা ও আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে শারীআহ্ আইন মেনে চলতে হবে।

পরিশেষে এটা বলা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নীতি হবে রাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর শারীআহ্ আইন কার্যকর করা। নাগরিকদের উপর নিম্নোক্ত উপায়ে শারীআহ্ আইন কার্যকর করা হবে:

১. সকল মুসলিম নাগরিকের উপর শারীআহ্ আইন কার্যকর করা হবে।

২. বিশ্বাস এবং উপাসনা সংক্রান্ত বিষয়ে অমুসলিম নাগরিকদের উপর কোনরকম হস্তক্ষেপ করা হবে না।

৩. সাধারণ আইনের আওতায় খাদ্য ও সাজসজ্জা সম্পর্কিত বিষয়ে অমুসলিম নাগরিকদের তাদের নিজস্ব ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসরণ করতে দেয়া হবে।

৪. অমুসলিমদের বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্র তাদের পক্ষ হতে রাষ্ট্র অধিকৃত বিচারালয়ে বিচারক নিয়োগ করবে এবং এ সংক্রান্ত সকল ঝগড়া-বিবাদ উক্ত বিচারালয়েই ফয়সালা করা হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গঠিত কোন আদালত (Private) গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু, এ সংক্রান্ত বিবাদ যদি অমুসলিম এবং মুসলিমদের সংঘটিত মধ্যে হয়, তবে তা মুসলিম বিচারকের মাধ্যমে ইসলামী আইন অনুযায়ী ফয়সালা করা হবে।

৫. অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আইনগত লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে ইসলামী রাষ্ট্র মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর কোনরকম পূর্বশর্ত ছাড়াই শারীআহ্ কার্যকর করবে।

৬. ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত সকলকেই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করা হবে। কোনরকম বৈষম্য ছাড়াই রাষ্ট্র তাদের অভিভাবক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং তাদের সকল কার্যাবলী দেখাশুনা করবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন