বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১২

শাসন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কিত রাসুলুল্লাহ (সা) এর বক্তব্যসমুহ ও এর ব্যাখ্যা পর্ব-১

খিলাফাহ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত

ইসলামী শাসন
খলিফাগণই মুসলিম উম্মাহর শাসক

হাদিস-১

كانَتْ بَنُوِإسْرَائِي َ ل تَسُوسُهُمُ الأَنِبيَاءُ ُ كلَّمَا هَلكَ نِبىٌّ خَلَفهُ نِبىّ
وِإنَّهُ َ لا نِبىَّ بَعْدِى وَسَتَكُو ُ ن خُلَفَاءُ يَكُثرُو َ ن َقاُلوا َفمَا تْأمُرُنَا قَا َ لُفوا ِببَيْعَةِ الأَوَّ ِ ل فَالأَوَّ ِ ل وَأعْ ُ طوهُمْ حَقَّهُمْ فِإنَّ اللَّهَ سَائِلُهُمْ عَمَّ ِ ن
اسْتَرْعَاهُمْ
বনী ইসরাইলকে শাসন করতেন নবীগণ। যখনই কোনও একজন নবী মৃত্যুবরণ করতেন, তখনই অন্য একজন নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন, আর আমার পরে কোনও নবী আসবেন না, আসবেন খলিফাগণ এবং তারা হবেন সংখ্যায় অনেক।

সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন-তখন আপনি আমাদেরকে কি আদেশ করছেন? রসুল (সা) উত্তরে বললেন-একের পর এক তাদের প্রতি তোমাদের বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) পূর্ণ কর এবং তাদের অধিকার পূর্ণ কর। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদেরকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।” (বুখারী ও মুসলিম)

ব্যাখাঃ
১। এখানে تسوسھم তাসুসুহুম (দৈনন্দিন বিষয়াদি দেখাশুনা করা) শব্দটি নির্দেশ করছে যে, রাসুল (সা) এর পূর্বের নবীগণও তাদের প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বিধান দ্বারা তাদের অনুসারীদের শাসন করতেন এবং দৈনন্দিন বিষয়াদি দেখাশুনা করতেন।

২। খুলাফাহ শব্দটি শব্দটি খলীফা শব্দের বহুবচন এবং হাদিসে ব্যবহৃত يكثرون ইয়াকছিরুন’ (তারা সংখ্যায় অনেক হবে) দ্বারা বুঝানো হচ্ছে যে, রাসুল (সা) এর মৃত্যুর পর অনেক খলীফা আসবেন, আর এটা শুধুমাত্র চার খলীফার সময়েই খিলাফত বিদ্যমান ছিল এই দাবীর পরিপন্থী।

৩। খিলাফতের দ্বায়িত্বকাল ৩০ বছর বলে উল্লেখ করে একটি বর্ণনা রয়েছে এবং ইবনে তাইমিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী প্রথম ৩০ বছর খিলাফত রসূল (সা) এর পন্থা ও সুন্নাতের উপর পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তবে ঐ হাদিসটি দ্বারা খিলাফতের সময়কালের ব্যাপারে কোনও সুনির্দিষ্ট সময়কাল নির্ধারণ করে দেওয়া হয় নি। আর তাই খিলাফত মাত্র ৩০ বছর কাল স্থায়ী ছিল তা বলা যৌক্তিক নয়।

৪। ইমাম নববীর মতে একের পর এক তাদের প্রতি তোমাদের আনুগত্যের শপথ (বাইয়াত) পূর্ণ করএই বাক্যের মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে যে, একই সময়ে শুধুমাত্র একজন খলীফা থাকায় অনুমোদিত এবং একজন খলীফা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় অন্য কাউকে বাইয়াত দেয়া সম্পূর্ণ অবৈধ (হারাম)।

খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার রসুল (সা) এর ভবিষ্যতবাণী

হাদিস-২

تكون النبوة فيكم ما شاء الله أن تكون ثم يرفعها إذا شاء أن يرفعها ثم تكون خلافة على
منهاج النبوة فتكون ما شاء الله أن تكون ثم يرفعها إذا شاء الله أن يرفعها ثم تكون ملكا
عاضا فيكون ما شاء الله أن يكون ثم يرفعها إذا شاء أن يرفعها ثم تكون ملكا جبرية
فتكون ما شاء الله أن تكون ثم يرفعها إذا شاء أن يرفعها ثم تكون خلافة على منهاج
النبوة

“তোমাদের মধ্যে নবুয়্যত থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন, তারপর আল্লাহ তার সমাপ্তি ঘটাবেন। তারপর প্রতিষ্ঠিত হবে নবুয়্যতের আদলে খিলাফত। তা তোমাদের মধ্যে থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করবেন অতঃপর তিনি তারও সমাপ্তি ঘটাবেন। তারপর আসবে যন্ত্রণাদায়ক বংশের শাসন তা থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন। এক সময় আল্লাহর ইচ্ছায় এরও শেষ হবে। তারপর প্রতিষ্ঠিত হবে জুলুমের শাসন এবং তা তোমাদের উপর থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করবেন। তারপর তিনি তা অপসারণ করবেন। তারপর আবার ফিরে আসবে খিলাফত নবুয়্যতের আদলে।এরপর তিনি (সাঃ) নীরব থাকলেন।” (মুসনাদে আহমদ)

ব্যাখাঃ
১। এই হাদিস থেকে রসুল (সা) এর মৃত্যুর পর নবুয়্যত ও খিলাফতের শাসনকার্যের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য থাকবে না এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, খিলাফত একমাত্র তার (সা) প্রদর্শিত পথ ও পদ্ধতির উপরই অধিষ্ঠিত থাকবে এবং তার (সা) এর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। সুতরাং ইসলামী শারিআহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নবুয়্যত ও খিলাফতের পদ্ধতিগত সামঞ্জস্য বা মিল রয়েছে। শুধুমাত্র যে পার্থক্যটি রয়েছে তা হল রসুল (সা) এর মৃত্যুর পূর্বেই ওহী অবতরণ পূর্ণ হয়ে গেছে।

২। যন্ত্রণাদায়ক বংশের শাসন বলতে বাইয়াত গ্রহণের অপব্যবহারকে বোঝানো হয়েছে যা রসুল (সা) ও চার খলীফা (রা) র সময়ে যেরূপ সন্তুষ্টচিত্তে বাইয়াত গ্রহণ করা হত তার পরিবর্তে তখন উত্তরাধিকার সূত্রে বাইয়াত হস্তান্তর করা হত।

৩। আর জুলুমের শাসন হল সেই শাসন যখন মুসলমানগণ ইসলাম দিয়েই শাসিত হচ্ছিল কিন্তু শাসকবৃন্দ জনগণের উপর অত্যাচার করত। যেমন অন্যত্র রসুল (সা) এর এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে মুসলমানদের তাদের শাসকদের অত্যাচার সত্ত্বেও তাদের আনুগত্য করা উচিত যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা পাপ কাজের আদেশ করে। এবং বর্তমান সময়ের শাসন যেখানে মুসলিমরা ইসলাম পরিপন্থী তথা কুফুরী শাসন ব্যবস্থা ও জালেম শাসকদের শাসিত হচ্ছে।

৪। হাদিসের শেষ অংশটি মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি সুসংবাদ ও ভবিষ্যৎ বাণী যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইচ্ছা অনুযায়ী খিলাফত আবার নবুয়্যতের আদলে প্রতিষ্ঠিত হবে।

খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা ফরয

হাদিস-৩

مَنْ خَلعَ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ َلقِىَ اللَّهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَ َ لا حُجَّة َلهُ وَمَنْ مَاتَ
وَليْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعٌة مَاتَ مِيتًة جَاهِلِيًّ

যে ব্যাক্তি আমীরের আনুগত্য থেকে তার হাত সরিয়ে নিল, কেয়ামতের দিন সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে এমনভাবে মিলিত হবে যে, তার স্বপক্ষে কোনরূপ প্রমাণ থাকবে না। আর যে ব্যাক্তি এমনাবস্থায় মৃত্যুবরণ করল যে, তার কাঁধে আনুগত্যের শপথ নেই তবে সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।” (মুসলিম)

হাদিস-৪
من خرج من الجماعة قيد شبر فقد خلع ربقة الإسلام من عنقه
حتى يراجعه من مات و ليس عليه إمام جماعة فإن موتته موتة
جاهلية

যে ব্যাক্তি জামাত (ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহ) থেকে নিজেকে এক বিঘত পরিমাণ সরিয়ে নিল তবে সে যেন তার কাঁধ থেকে ইসলামকে সরিয়ে ফেলল যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আবার ফিরে আসে। আর যে ব্যাক্তি এমনাবস্থায় মৃত্যুবরণ করল যে, তার উপর (মুসলিম উম্মাহর) কোন আমীর নেই তবে তার মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যু। (হাকিম)

ব্যাখাঃ
১। উপরোক্ত হাদিসগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে, সত্যের (ইসলাম) উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়া ফরজ। এক বিঘত বলতে বোঝানো হচ্ছে যে, মুসলমানদের মধ্যে ছোট বড় যেকোনও ধরণের অনৈক্য বা ভাঙ্গন হারামবা অবৈধ।

২। ইসলাম বৈধ বা অনুমোদিত শাসকের প্রতি আনুগত্যকে ফরজ করেছে। পাশাপাশি এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে যে অন্যান্য হাদিসে কখন শাসকের বিরোধিতা এমনকি বিদ্রোহ করা যাবে তার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। (যেমনঃ যখন শাসক আল্লাহর প্রণীত ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে শাসন করে।)

৩। হাদিসে উল্লেখিত আনুগত্যের শপথ বাইয়াত বলতে শাসক ও উম্মাহর মধ্যে গৃহীত বাইয়াতকে বোঝানো হয়েছে। যেমন রসুল (সা) তার পরবর্তী সাহাবী (রা) দের ক্ষেত্রে দেখা যায় জনগণকে কুরআন সুন্নাহ দিয়ে শাসন করার নিমিত্তে আই বাইয়াত দেয়া হত।

৪। হাদিসে উল্লেখিত জাহিলিয়াতের মৃত্যুহল একটি ইঙ্গিত যে কাঁধে আনুগত্যের শপথ ছাড়া মৃত্যুবরণ করা হারাম। ফলে আনুগত্যের শপথ থাকাটা বাধ্যতামূলক একইভাবে খলীফা থাকাটাও ফরজ কেননা খলিফাকেই বাইয়াত প্রদান করতে হবে। ইমাম তাফতাজানী ও শাহ ওয়ালী উল্লাহ (তার ইযালাতুল খাফা আন খিলাফাতুল খুলাফা গ্রন্থে) এই মত ব্যক্ত করেন।

৫। দ্বিতীয় হাদিসে তার উপর মুসলিম উম্মাহর শাসক না থাকাদ্বারা প্রথম হাদিসে উল্লেখিত তার কাঁধে আনুগত্যের শপথএই বাক্যাংশের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।

৬। ইসলামী শরীয়াহর মূলনীতি ওয়াজিব পালনের জন্য যা প্রয়োজন তা নিজেই ওয়াজিবএই নীতির আলোকে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা ফরয। তা এমন এক হুকুম যা সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য কেননা من ” ‘মান’ (যে কেউ) শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে সবাইকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

খলীফা একজন হওয়া ফরজ

হাদিস-৫
إَذا بُوِيعَ لِخَلِيَفتَيْ ِ ن فَاقْتُلوا الآخِرَ مِنْهُمَا

যখন দুইজন খলীফাকে বাইয়াত দেয়া হয় তখন দ্বিতীয়জনকে হত্যা কর। (মুসলিম)

১। সাহাবীদের ইজমার (ঐক্যমত) ভিত্তিতে এটা প্রমাণিত যে, কোনও নির্দিষ্ট সময়ে মুসলমানদের জন্য দুজন খলীফা থাকা জায়েজ নেই। ইমাম নববী একে ইজমা হিসেবে প্রমাণ করেন এবং উপরোক্ত হাদিস দ্বারাও তা প্রমাণিত।

২। হাদিসে প্রদত্ত দ্বিতীয় খলীফাকে হত্যার আদেশটি নির্দেশ করে যে, দ্বিতীয় খলীফাকে অপসারণ করার জন্য অন্য সকল পথ অকার্যকর হয়েছে।

৩। যদিও এটা সর্বজন বিদিত যে, একজন মুসলমানের রক্ত পবিত্র তথাপি দুইজন খলীফার দ্বিতীয়জনকে হত্যার আদেশটি মূলত মুসলমানদের এককেন্দ্রিক শাসনের বাধ্যবাধকতারই প্রবল ইঙ্গিত বহন করে এবং অস্তিত্ব রক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।


চলবে ......

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন