আমরা যারা মুসলিম তাদের সাথে অন্যদের পার্থক্য হচ্ছে আমরা তাওহীদের স্বীকারোক্তি দিয়েছি যা অন্যরা দেয়নি। আবার আমাদের মধ্যে অনেকেই তাওহীদ বলতে শুধুমাত্র বুঝি আল্লাহর একত্ববাদ, কিন্তু এই বিষয়টি আমরা সার্বিক ভাবে জানি না। আমার এই লেখাটিতে আমি তাওহীদের একটি গুরুত্বপুর্ন রুকন নিয়ে আলোচনা করব যা হল তাগুত। তাগুত সম্পর্কে কোন জ্ঞান না থাকার কারণে মুসলিমরা বিবিধ শিরকে লিপ্ত। তাগুত কি তা ভালোভাবে না জানার কারণে তারা শুধু মাজার পুজা, মোমবাতি জ্বালানো এইগুলোকেই শিরক মনে করে। তাই কোরআন ও সুন্নাহ এর আলোকে ইনশাল্লাহ তাগুত কি তা আমরা বুঝার চেষ্টা করব।
তাওহীদের যেমন কিছু শর্ত আছে তেমনি তার কিছু রুকনও আছে
শর্তগুলো হলো ইলম বা জ্ঞান, ইয়াকীন বাঁ দৃঢ় বিশ্বাস, কবুল, ইনকিয়াদ বা সমর্পণ করা, ছিদক বা সত্যতা, ইখলাস বা একনিষ্ঠতা, মুহাব্বাত। নামাজের যেমন কিছু শর্ত আছে তেমনি এগুলো তাওহীদের শর্ত। শর্তগুলো পূরণ হওয়ার সাথে কবুল হওয়া না হওয়া জড়িত।
আর রুকনগুলি পূরণের সাথে শুদ্ধ হওয়া না হওয়ার বিষয়টি জড়িত। তেমনি একটি রুকন হল তাগুতকে অস্বীকার করা।
আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “যে ব্যাক্তি তাগুতকে অস্বীকার করল ও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলো, সে এমন এক শক্ত রজ্জু ধারণ করল যা কখনো ছিড়ে যাবার নয়”। (আল বাকারাহঃ২৫৬)
উপরোক্ত আয়াতে শক্ত রজ্জু বলতে কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহকে” বুঝানো হয়েছে। আর এটাই মূলত তাওহীদের কালেমা। এই আয়াতে স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে তাগুতকে অস্বীকার করা ঈমানের রুকন।
এখন, প্রশ্ন হল তাগুত কি? আভিধানিকভাবে তাগুত শব্দের অর্থ হল সীমালংঘন করা। কিন্তু শরীয়াতের পরিভাষায় তাগুত হল তাই যেগুলোকে আল্লাহর সাথে শরীক করা হয়। অনেকে তাগুত শব্দের অনুবাদ করেন শয়তান হিসাবে কিন্তু এর সঠিক অর্থ জানার জন্য আমরা দেখব আল্লাহ কোরআনে এই শব্দটিকে কোন অর্থে ব্যবহার করেছেন।
১। “যারা তাগুতের দাসত্ব করা থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহ অভিমুখী হয়, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ”। (আল-যুমারঃ১৭)
বুঝা গেলো তাগুত হচ্ছে একটা শক্তি যার দাসত্ব বা আনুগত্য করা হয়। আর যারা তাগুতের আনুগত্যকে বর্জন করবে ও শুধুমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করবে তাদের জন্য আল্লাহ সুসংবাদ দিয়েছেন।
২। “তুমি তাদের দেখনি যারা কিতাবের কিছু অংশ প্রাপ্ত হয়েছে, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে (মান্য করে) “প্রতিমা” ও “তাগুতকে”এবং কাফেরদের বলে, তারা মুমিনদের তুলনায় অধিকতর সরল-সঠিক পথে রয়েছে। এরা সেসব লোক যাদের উপর লানত করেছেন আল্লাহ তাআলা স্বয়ং। বস্তুত আল্লাহ যার উপর লানত করেছেন তুমি কখনো তার সাহায্যকারী খুঁজে পাবে না”। (নিসাঃ ৫১)
আলোচ্য আয়াতে ইহুদীদের কথা বলা হচ্ছে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছিল তাগুতের উপর ও তাকে মান্য করত। সুতরাং, তাগুত এমন এক শক্তি আল্লাহ ব্যতীত যার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা হয় ও মান্য করা হয়। যারা এরুপ করে তাদের উপর আল্লাহর লানত।
৩।“আপনি তাদের দেখেননি যারা দাবী করে যে, যা আপনার উপর নাযিল হয়েছে তারা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতিও বিশ্বাস করে। তারা বিচার ফায়সালাকে তাগুতের কাছে নিয়ে যাতে চায় অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে যাতে করে তারা তাগুতকে অস্বীকার করে”। (নিসাঃ৬০)
এখানে বুঝা যাচ্ছে তাগুত হল সে যে আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে বিচার ফায়সালা করে।
৪।“যারা ঈমানদার তারা প্রাণান্তকর যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহে, পক্ষান্তরে যারা কাফের তারা যুদ্ধ করে তাগুতের পক্ষে”। (নিসাঃ৭৬)
এখানে বলা হচ্ছে কাফেরেরা তাগুতের পক্ষে যুদ্ধ করত।
৫। “যারা কাফের তাদের বন্ধু হল তাগুত এবং ঐ তাগুত তাদেরকে হেদায়েতের আলো থেকে সরিয়ে গোমরাহীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়”। (বাকারাহঃ২৫৭)
৬। “বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি, কাদের জন্য মন্দ প্রতিফল রয়েছে আল্লাহর কাছে? যাদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন, যাদের প্রতি তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন, যাদের কতককে বানর ও শুকরে রুপান্তরিত করেছেন এবং যারা তাগুতের আরাধনা করেছে তারাই মর্যাদার দিক দিয়ে নিকৃষ্টতর এবং সত্যপথ থেকে অনেক দূরে”। (মায়েদাঃ৬০)
উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে বুঝা যাচ্ছে তাগুত হল তাই আল্লাহ ব্যতীত যার উপর আস্থা রাখা হয়, আনুগত্য করা হয়, দাসত্ব করা হয়, যার বিচার ফায়সালা মানা হয়, কাফেররা যার প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করে। মোদ্দাকথায় আল্লাহর সাথে যাকে শরীক করা হয় তাই তাগুত।
এই তাগুত হতে পারে একটি পাথর যদি আপনি মনে করেন তা সর্বশক্তিমান। হতে পারে আপনার নাফস যদি আপনি নাফসের দাসত্ব করেন। হতে পারে কোন কুফরী মতবাদ বা বিচার ব্যাবস্থা যেমন গণতন্ত্র যেখানে বিচার ফায়সালার মালিক আল্লাহ নন। হতে পারে কোন ব্যাক্তি যাকে অতিরিক্ত মহিমান্বিত করা হয়। যেমনঃ ভন্ড পীর। হতে পারে কিছু লোক বা শক্তি যাদের দাসত্ব করা হয় বা অনুগত্য করা হয়। যেমনঃ আমেরিকা, বুশ, হাসিনা, খালেদা ও অন্য সকল জালেম শাসক। সুতরাং, আল্লাহর কোন গুণাবলীর সাথে আপনি যদি কোন ব্যাক্তিকে, কোন ব্যবস্থাকে অথবা কোন পদার্থকে শরীক করেন তবে তা তাগুত।
ভাইয়েরা চিন্তা করুন, আমরা বলি আমরা তাওহীদের ঘোষনা দিয়েছি কিন্তু আপনি কি তাগুত কে অস্বীকার করেছেন? যেখানে আল্লাহ আমাদের বলেছেন তাগুতকে অস্বীকার কর ও ঈমান আনো সেখানে তাওহীদের এই রুকনটিকে আমরা কতটুকু পালন করছি। আপনি কি এই কুফর ব্যবস্থা বাস্তবায়নকারী তাগুতী সরকার গুলোর বিরুদ্ধে কথা বলেন? আপনি তাগুত আমেরিকার বিপক্ষে কথা বলেন? সমাজে প্রচলিত তাগুতী শিরকগুলোর বিরুদ্ধে আপনি কথা বলেন?
অনেকে বলেন ভাই, আমাদের ঈমান অত্যন্ত দূর্বল। এদের কথা শুনলে মনে হয় ঈমান দূর্বল এই কথাটা বললে মনে অনেক নেকি পাওয়া যায়। তাদেরকে সূরা বাকারাহ এর ২৫৬ নং আয়াত স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যেখানে আল্লাহ বলেন, “ যে ব্যাক্তি তাগুতকে অস্বীকার করল ও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলো, সে এমন এক শক্ত রজ্জু ধারণ করল যা কখনো ছিড়ে যাবার নয়”। ভাই আগেতো তাওহীদের রুকনটি পূর্ণ করেন, এরপর না হয় ঈমানকে আরো শক্তিশালী কইরেন।
আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক”। (সূরা নাহল: ৩৬)
সুতরাং, তাগুতকে অস্বীকার করা ঈমানের দাবী এবং আল্লাহ আমাদেরকে তাগুতকে অস্বীকার করার মত শক্তি দান করুন এবং আমাদের হেদায়াতের পথকে সহজ করে দিন যাতে আমরা আমাদের প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে পারি।
পরিশেষে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আমরা একমাত্র আল্লাহকেই ইলাহ হিসেবে মানি। একমাত্র তাকেই ভয় করি এবং পৃথিবীর সকল তাগুতী শক্তিকে অস্বীকার করি। আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করুন। আমীন…।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন